নীলুফার ইয়াসমীন- বাংলাগানের বরেণ্য শিল্পী ৷ ভাল গাইতেন বটেই, সংগে যুক্ত হয়েছিল ভক্তি ৷ তাঁর অপার ভক্তি ছিল সংগীতের প্রতি, শিক্ষকের প্রতি, শ্রোতার প্রতিও ৷ একনিষ্ঠ শিল্পী বলতে যা বোঝায় নীলুফার ছিলেন তা-ই ৷ সৃজনশীল বাংলা গান যখন ভেসে যাচ্ছিল তখন গুটিকয় শিল্পী ভালোবাসা দিয়ে উজ্জীবিত করেছেন আমাদের নিজস্ব গীতি, নিঃসন্দেহে নীলুফার ইয়াসমীন তাঁদের অন্যতম।
জন্ম ও বংশ পরিচয় :
নানা মুর্শিদাবাদের এষ্টেটের এডভোকেট এবং বেগম জয়তুননেছার সন্তান বেগম মৌলুদা খাতুনের বেড়ে উঠা সংগীত পরিমন্ডলে ৷ সরকারী বড় কর্মকর্তা মৌলুদা খাতুনের মামার সাথে পরিচয় হয় তখনকার দিনের বিসিএস ক্যাডার (সিভিল সার্ভিস অফিসার) লুত্ফর রহমানের ৷ লুত্ফর রহমান ও মৌলুদা খাতুনের বিয়ে হয় ১৯৬৮ সালের ২৬ শে এপ্রিল ৷ ১৯৪৮ সনের ১৬ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার ১৩০/অ পার্ক স্ট্রীটের দোতলায় পাঁচ বোনদের মধ্যে চতুর্থ জনের আগমন ৷ তত্কালীন গোড়া সমাজে বারবার কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার যন্ত্রনা সচরাচর বইতে হতো মাকে ৷ সেই ঘূনেধরা সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে লুত্ফর রহমান কোলে তুলে নিলেন নীলা অর্থাত্ নীলুফার ইয়াসমীনকে ৷
নীলুফার ইয়াসমীনের পিতা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার ৷ সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল প্রবল ৷ পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গান গাইতেন ৷ আর নীলুফার ইয়াসমীনের মা হারমোনিয়াম বাজাতেন ৷ পিতার বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার মুকুন্দপুর গ্রামে ৷ মুকুন্দপুরের ‘পন্ডিত বাড়ি’ বললে ঐতিহ্যবাহী এ পরিবারটিকে সবাই চেনেন ৷ বহু আগে থেকেই এ বাড়ির লোকজন শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অগ্রগামী ৷ নীলুফারের মা মুর্শিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ কাদের বখশের ছাত্রী ছিলেন ৷ তিনি ভালো গান গাওয়া ছাড়াও ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন ৷
শৈশবকাল :
কখনওবা মুর্শিদাবাদ কখনওবা রাজশাহী কিংবা ঢাকায় থাকলেও নীলুফার কখোনো সুরের পথ থেকে বিচ্যুত হননি ৷ মায়ের কাছে সংগীতে হাতেখড়ি ৷ বাসায় গ্রামোফোন রেকর্ড প্লেয়ার ছিল ৷ পিতা নতুন নতুন রেকর্ড কিনে আনতেন আর বোনেরা সবাই মিলে সে সব রেকর্ডের গান বারবার বাজিয়ে শুনে শিখে ফেলতেন ৷ আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া, হরিমতী, কে মল্লিক, জ্ঞান গোস্বামী, শচীনদেব বর্মন, মৃণালকান্তি ঘোষ, কমল দাশগুপ্ত, আব্বাসউদ্দীনসহ আরো বিখ্যাত সব শিল্পীদের গাওয়া রেকর্ড থেকে তাঁর মা গান তুলে গাইতেন এবং তাঁর গাওয়া থেকেই নীলুফার গান শিখে ফেলতেন ৷ তাঁর মা-ই তাঁকে বলতেন যে এ-সব গানগুলির রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম ৷ তখন থেকেই নজরুল-সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষন দূর্বার, যা আমৃত্যু জাগ্রত ছিল ৷
চার বছর বয়সে একবার কাউকে কিছু না বলে ছোট্ট নীলু পার্কস্ট্রীটের দোতলা থেকে নেমে সোজা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন ৷ রিক্সা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বাবা লুত্ফর রহমান রাস্তা থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়ার নীলুফারকে উদ্ধার করে বাড়ীতে নিয়ে আসেন ৷ সেই সময় বাবা যদি নীলুফারকে উদ্বার করে না আনতেন তবে আজকে হয়ত শুদ্ধ সংগীতাঙ্গনের পূর্নতা অনেকাংশেই সম্ভব হতনা ৷
শিক্ষাজীবন :
সংগীত শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও তার ছিলো সমান মনোযোগ ৷ তিনি আদমজী কটন মিল স্কুল, বাংলাবাজার গার্লস স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ ও সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ অধ্যয়ন করেন ৷ নীলুফার ইয়াসমীন ১৯৬৩ সালে এস এস সি, ১৯৬৫ সালে এইচ এস সি, ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে বি এ (অনার্স) এবং ১৯৭০ সালে ২য় শ্রেনীতে প্রথম হয়ে এম এ পাশ করেন ৷
পারিবারিক জীবন:পাঁচ বোনের মধ্যে নীলুফার ইয়াসমীন ছিলেন চতুর্থ তাঁদের কোন ভাই নেই ৷ বড় বোন ফরিদা ইয়াসমীন ও মেজো বোন ফওজিয়া খান প্রতিষ্ঠিত সংগীত শিল্পী ৷ সেজো বোন শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রীধারী নাজমা ইয়াসমীন হক সংগীতের চর্চা না-করলেও একজন ভালো শ্রোতা ও বোদ্ধা ৷ তিনি ধানমন্ডি রেডিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ (ইংলিশ মিডিয়াম)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ৷ ছোট বোন সাবিনা ইয়াসমীন প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী ৷প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও অভিনেতা খান আতাউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬৯ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ৷ একমাত্র পুত্র আগুন বর্তমান প্রজন্মের একজন প্রতিষ্ঠিত কন্ঠশিল্পী ৷
কর্ম জীবন:নারায়নগঞ্জের দুর্গাদাস-এর কাছে বড় বোনেরা গান শিখতেন, নীলুফার তাঁদের পাশে বসে থাকতেন ৷ দুর্গা দাস বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রে সেতার (উচ্চঙ্গ-সংগীত) বাজাতেন ৷ মূলত তাঁর উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখা শুরু হয় ওস্তাদ পি সি গোমেজ এর কাছে ১৯৬৪ সালে ৷ একাধারে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখেন ৷ তারপর উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ-র সুযোগ্যা ছাত্রী মীরা ব্যানার্জীর কাছে তালিম নেন ৷ এরপর প্রখ্যাত সারেঙ্গীবাদক ওস্তাদ সগীরউদ্দীন খাঁ ও মুরশিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ এ দাউদ সাহেব, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দীর্ঘকাল তালিম গ্রহণ করেন ৷ তিনি নজরুল-সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছেন স্বরলিপিগ্রন্থ থেকে ৷ স্বরলিপি অনুসরণ করেই প্রথম দিকে বেতার-টেলিভিশনে নজরুল-সংগীত গেয়েছেন ৷ এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, ওস্তাদ পি সি গোমেজ তাঁকে প্রথমদিকে কোনো রাগের বন্দিশ শিখিয়ে তার স্বরলিপি লিখে দিতেন ৷ এমনিভাবে স্বরলিপির নিয়ম অনুসরণ করতে করতে এক সময় তিনি দেখলেন স্বরলিপি থেকে যে- কোন গান সহজেই ওঠানো যায় ৷ পরবর্তীতে তিনি প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী, নজরুল-সংগীত স্বরলিপিকার ও বিশেষজ্ঞ শেখ লুত্ফর রহমান ও সুধিন দাশ-এর কাছে নজরুল-সংগীত শিখেছেন ৷ নীলুফার ইয়াসমীন বাংলাদেশ বেতারের ছোটদের অনুষ্ঠান খেলাঘরের মাধ্যমে শিল্পী জীবনের শুরু করেন ৷ পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরু থেকে অংশগ্রহণ করে আমৃত্যু একজন নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন ৷ নীলুফার ইয়াসমীন উচ্চাঙ্গ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, টপ্পা, ঠুমরি, কীর্তন, রাগপ্রধান, আধুনিক গান, মোট কথা গানের ভুবনের প্রায় সবগুলো শাখাতেই অবাধ বিচরণ করতেন ৷ রাগপ্রধান গানে অসাধারণ দখল থাকলেও নীলুফার ইয়াসমীন নজরুল-সংগীতশিল্পী হিসেবেই বেশি পরিচিত ৷নীলুফার ইয়াসমীন শ্রোতার আসর প্রযোজিত ও খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘বেলা শেষের রাগিনী’ -তে ”আবার ভালবাসার সাধ জাগে’ শিরোনামের নজরুল-সংগীতটি রেকর্ড করেন ৷ বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রম থেকে ‘এ কোন সোনার গাঁয়’ রেকর্ডে একটি ও নজরুল ইন্সটিটিউট প্রকাশিত ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ ও ‘বাজলো কিরে ভোরের সানাই’ রেকর্ড দুটিতে দু’টি নজরুল-সংগীত গেয়েছেন ৷ এছাড়াও তাঁর কন্ঠে নজরুল-সংগীত, কীর্তন ও পুরোনো দিনের গানের বেশ কয়েকটি অডিও ক্যাসেট ও সিডি বেরিয়েছে ৷ পুরোনো দিনের গানের গীতিকাররা হলেন চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলার ও নজরুল ৷শিল্পী হিসেবে নীলুফার ইয়াসমীনের জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র দেশের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিলনা, বিদেশেও তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন ৷ ১৯৮৪ সালে কলকাতার ”অগ্নিবীনা’-র আমন্ত্রণে ঢাকাস্থ নজরুল একাডেমীর সাংস্কৃতিক দলের সংগে কলকাতা গমন করেন ৷ বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের আমন্ত্রণে দিল্লী ও কলকাতায় সংগীত পরিবেশন করেন ৷ এছাড়াও তিনি পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, পাকিস্তান ভ্রমণ করেন এবং সংগীত পরিবেশন করে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেন ৷নীলুফার ইয়াসমীন বেশ কয়েকটি ছায়াছবিতে কন্ঠ দিয়েছে ৷ যেমন- শুভদা, অরুণ-বরুন-কিরণমালা, জোয়ার ভাটা, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী , যে আগুনে পুড়ি, জীবন-তৃষ্ণা , জলছবি ইত্যাদি ৷১৯৯৫ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের নজরুল সংগীত বিষয়ের প্রভাষক হিসাবে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন ৷ শিল্পী নীলুফার ইয়াসমীন ছিলেন ব্যবহারে বিনম্র ও চাল-চলনে অতিশয় শালীন ৷ অহংকারের লেশমাত্র তাঁর ছিল না ৷ ঈর্ষা, বিদ্বেষ, প্রতিযোগিতার উর্ধ্বে উঠে তিনি সবার প্রিয় হওয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ৷
সন্মাননা,স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা:আগুন জ্বলেরে/জীবন সেতো পদ্ম পাতার শিশির বিন্দু/তোমাকে পাবার আগে জ্বলে জ্বলে বুঝতাম/ এক বরর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে/এতো সুখ সইবো কেমন করে/ পথের শেষে অবশেষে বন্ধু তুমি/যদি আপনার লয়ে এ মাধুরী/ এতো কান্নাই লিখা ছিলো ভাগ্যে আমার/যে মায়েরে মা বলে কেউ ডাকে না… ষাট/সত্তর দশকের পুরোটা সময় এমনি আরো অজস্র শ্রোতানন্দিত গানে যার কন্ঠ মাধুর্য সম্মোহীত করে রাখতো তিনি হলেন আমাদের বাংলা সংগীতের এক গুনী কন্ঠশিল্পী নীলুফর ইয়াসমীন ৷ সুদীর্ঘ শিল্পী জীবনে তিনি ‘সুজন সুখী’ চলচ্চিত্রে কন্ঠপ্রদানের জন্য ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার, ”শুভদা’ চলচ্চিত্রে কন্ঠ প্রদানের জন্য ১৯৮৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার, সংগীত বিষয়ে অনন্য অবদানের জন্য ২০০৪ সালে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় “একুশে পদক” এবং নজরুল সংগীতে তার অবদানের জন্য ১৪১০ বাংলা সালে “নজরুল পদক” সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন ৷ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ নজরুল সংগীত বিষয়ে তাঁর অবদানের কথা চিরস্মরণীয় করে রাখতে সম্প্রতি তাঁর নামে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে একটি পাঠাগার স্থাপন করেছে ৷
সমকালীন মূল্যায়ন :অসাধারণ সংগীত-প্রতিভার অধিকারী নীলুফার ইয়াসমীনের তুলনা শুধুই নীলুফার ইয়াসমীন ৷ বিনয়ী, নম্র, মিষ্টভাষিনী, নিরহংকার নীলুফারের মতো ব্যতিক্রমধর্মী শিল্পী আমার জীবনে বোধহয় আমি আর দেখিনি ৷ শুধু নজরুল সংগীতই নয়, বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ বাংলা গানের বিভিন্ন ধারায় নীলুফার সাবলীল বিচরণ ছিল সত্যিই বিস্ময়কর ৷দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গানগুলিও সে সমান আগ্রহে সমান পারদর্শিতায় গাইত ৷ দেশে বা দেশের বাইরে কোথাও কোনো অনুষ্ঠানে গাইতে যাবার আগে আমার কাছে এসে গানগুলির নির্বাচন করে নিত ৷ বাংলা গান ছাড়াও উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতি ওর দুর্নিবার আকর্ষণ আমাকে মুগ্ধ করত ৷ নীলা জানত, সংগীত সাধনার বস্তু, তাই ওর ব্যক্তিগত জীবন খুব কুসুমাস্তীর্ণ না হলেও প্রতিদিনের সংগীত চর্চায় কোনো ব্যত্যয় সে ঘটতে দিত না ৷ প্রায় সন্ধ্যায় ওর বাড়িতে গেলে দেখতাম একটি অতি সাধারণ আসনে (মাদুরে) বসে তানপুরা নিয়ে নীলার সাধনামগ্ন রূপ, যা মৃত্যুর বোধহয় ৩/৪ দিন আগ পর্যন্ত বজায় ছিল ৷অসাধারণ ছিল ওর মনের জোর ৷ মৃত্যু যে এত কাছে, নীলা সেটা বিশ্বাসই করত না ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগের চাকরিটি তার অত্যন্ত প্রিয় ছিল ৷ কিন্তু প্রথম দিকে এই চাকরিটি নিয়ে একটি মহল কাগজে লেখালেখি শুরু করেছিল এই বলে যে, নীলুফার ইয়াসমীন সাধারণ এম এ ডিগ্রী প্রাপ্ত হয়ে কী করে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংগীত বিভাগে চাকরি পেলেন, যেখানে বিশ্বভারতীর সংগীতে মাস্টার্স ডিগ্রী প্রাপ্তদের সুযোগ হলো না ৷ যারা এই সমালোচনা করেছিল সেই মহাপন্ডিতরা জানত না নীলুফার ইয়াসমীনের প্রতিভার কাছে পোষাকি এম এ ডিগ্রি কত তুচ্ছ! সে-কথাই বলেছিলেন নজরুল সংগীতের প্রধান পুরুষ প্রয়াত মহান শিল্পী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র ৷ ….নীলা একদিন এসে আমাকে বলল যেহেতু ওর মিউজিকে মাস্টার্স ডিগ্রী নেই এবং নজরুল সংগীতের কোনো বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিত্বের সার্টিফিকেটও নেই সে কারণে হয়তো তার খণ্ডকালীন চাকরিটি স্থায়ী হবে না বরং চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ৷ আমি লোকমারফত প্রয়াত ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র মহাশয়ের কাছে নীলার গাওয়া দুই খানা ক্যাসেট পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ৷ মাসখানেক পরে কোন অনুষ্ঠানে ধীরেনবাবু ঢাকায় এলে নীলাকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ৷ নীলার পরিচয় পেয়ে আবেগে উচ্ছ্বাসে আপ্লুত ওই মহান শিল্পী আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, একে আমি কী সার্টিফিকেট দেব, ওর প্রতিভা তো সার্টিফিকেট দিয়ে মাপা যাবে না ৷জীবদ্দশায় অসুস্থতার এক পর্যায়ে নীলা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যেতে পারত না তখন ওই চাকরিটির জন্য কিছু প্রার্থীর চেষ্টা-তদবির শুরু হয়েছিল ৷ নীলা বিমর্ষ কন্ঠে আমাকে বলেছিল, তাঁর প্রিয় চাকরিটি অনিয়মিত উপস্থিতির সুযোগে অন্য কেউ নিয়ে নেবে ৷ সেদিন আমি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলাম, যতদিন সুস্থ না হবে ততদিন আমি ওর ক্লাস চালাব ৷ ক্লাস আমি ঠিকই চালিয়েছিলাম-কিন্তু নীলা তো সুস্থ হয়ে ওর ক্লাসে ফিরে এসে আমাকে অব্যাহতি না দিয়ে নিজেই চিরঅব্যাহতি নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল! ভাগ্যোর কি নির্মম পরিহাস! আজ জীবনসায়াহ্নে বসে আমি প্রাণপ্রিয় ছোটবোন নীলার স্মৃতিচারণ করছি, অথচ এর উল্টোটাই তো হওয়া স্বাভাবিক ছিল ৷ ………..সুধীন দাশ (নজরুল সংগীত বিশেষজ্ঞ) ৷
ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান :নীলুফার ইয়াসমীন উচ্চাঙ্গ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, টপ্পা, ঠুমরি, কীর্তন, রাগপ্রধান, আধুনিক গান, মোট কথা গানের ভুবনের প্রায় সবগুলো শাখাতেই অবাধ বিচরণ করতেন ৷ রাগপ্রধান গানে অসাধারণ দখল থাকলেও নীলুফার ইয়াসমীন নজরুল-সংগীতশিল্পী হিসেবে বেশি পরিচিত ৷ পারিবারিক প্রেরণা, উত্সাহ এবং স্বামীর আগ্রহে উচ্চাঙ্গ সংগীতের উপর আরো ব্যাপক সাধনা, নজরুল, অতুল, ডিএল রায় রজনীকান্ত, আধুনিক, লোকজ, কীর্তনসহ নানামুখী সংগীতে বুত্পত্তি অর্জন করেন ৷ তার স্বামী খান আতাউর রহমান ছিলেন এদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গণের এক পুরোধাব্যক্তিত্ব ৷ সংস্কৃতির যে শাখায়ই তিনি হাত রেখেছেন সেখানেই ফলিয়েছেন সোনা ৷ নিজের অতুলনীয় প্রতিভা, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং গুণী স্বামীর তত্ত্বাবধানে নীলুফার ইয়াসমীন সংগীতে তৈরি করে নেন নিজস্ব একটি অবস্থান ৷
প্রকাশনা ও সৃষ্টিকর্মের নমুনা :
নীলুফার ইয়াসমীন শ্রোতার আসর প্রযোজিত ও খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘বেলা শেষের রাগিনী’ -তে ‘আবার ভালবাসার সাধ জাগে’ শিরোনামের নজরুল-সংগীতটি রেকর্ড করেন ৷ বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রম থেকে ‘এ কোন সোনার গাঁয়’ রেকর্ডে একটি ও নজরুল ইন্সটিটিউট প্রকাশিত ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ ও ‘বাজলো কি রে ভোরের সানাই’ রেকর্ড দুটিতে দু’টি নজরুল-সংগীত গেযেছেন ৷ এছাড়াও তাঁর কন্ঠে নজরুল-সংগীত, কীর্তন ও পুরোনো দিনের গানের বেশ কয়েকটি অডিও ক্যাসেট ও সিডি বেরিয়েছে ৷ পুরোনো দিনের গানের গীতিকাররা হলেন চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলার ও নজরুল ৷বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এই গুণী শিল্পীর কন্ঠে ধারনকৃত ৫ টি সিডি ও ক্যাসেট প্রকাশ করেছে ৷ এর মধ্যে ৩ টি নজরুল সংগীতের, ১টি পুরোনো দিনের গানের এবং অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান নিয়ে ১টি সিডি ৷মৃত্যু :নিরবে নিঃশব্দে এই শিল্পী অনেকটা অগোচরেই অনেকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন ৷ কিন্তু কখন যে তার শরীরে স্থায়ীভাবে বাসা বেধেছে একটি জটিল রোগ তা শুধু বিধাতাই জানতেন ৷ মাঝে মাঝে হঠাত্ ক্লান্তি, ঘুমে দুচোখ ভেঙ্গে আসা এসব উপসর্গ নীলুফার ইয়াসমীন অতি ব্যস্ততার ফল হিসাবেই জানতেন ৷ যতটা দরদ ও খেয়াল রেখে গান করতেন তিনি তার কিঞ্চিত্ পরিমানও খেয়াল ও দরদ ছিলনা নিজের প্রতি ৷ ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ধরা পড়ল টিউমার ৷ অপারেশনের পর আবার ফিরে এসেছিলেন সংগীত ভূবনে ৷ কিন্তু ততদিনে অন্য ভূবন থেকে বিধাতার ডাক এসে গিয়েছিল ৷ নীলুফার ইয়াসমীন তার ডাকে সাড়া দিলেন ৷ ২০০৩ সালের ১০ই মার্চ বারডেম হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন ওপারের পথে যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেনা ৷ মাত্র ৫৫ (পঞ্চান্ন) বত্সর বয়সে তার অকাল প্রয়াণ আমাদের কে বিপর্যস্ত করেছে ৷ এ অপূরণীয় ক্ষতি মেনে-নেয়া কঠিন, কষ্টকর ৷
লেখক: আহমেদ সারোয়ার হোসেন