কলিম শরাফী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
মানবজীবনকে সহজেই তুলনা করা যেতে পারে নদীর জীবনের সঙ্গে। নদী যেমন কলকল বেগে বয়ে যেতে যেতে হঠাৎ কোথাও বাধা পেলে খানিক থমকে দাঁড়ায় এবং সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে নেয় নতুন পথরেখা, মানুষের জীবনও তেমনি। সকল বড় মানুষের জীবন-সংগ্রামের যে বহুমাত্রিকতা, তা সত্যিকার অর্থেই চোখ দিয়ে দেখার আর হৃদয় দিয়ে অনুভবের। প্রবীণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী-বিশেষজ্ঞ, সংগ্রামী সংস্কৃতিসেবী কলিম শরাফীর জীবনও নানা সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত, দীপ্ত আর ঋদ্ধ।
বলতে দ্বিধা নেই, আর দশজনের মতো তিনিও যদি পারিবারিক পেশার সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিতেন, তাহলে আজকের এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে হয়তো এমন করে পেতাম না। কারণ কলিম শরাফীর পূর্বপুরুষ ছিলেন বিহার শরীফের পীর হযরত শারফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরী। শরাফীর পূর্বপুরুষ মধ্যপ্রাচ্য থেকে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের সোনারগাঁওয়ে হযরত আবু তাওয়ামার কাছে শিক্ষালাভ করেন এবং তাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। অবশ্য পরে বিহারের নালন্দায় স্থায়ী আবাস গড়েন। আর মজার ব্যাপার হলো, শরাফীর পারিবারিক ব্যবসা ছিল সিনেমা হলের ব্যবসা। এমনকি তাঁর বাবা শাহ সৈয়দ সামী আহমেদ শরাফীকেও সিনেমা হল দেখাশোনা করতে হয়েছে। জীবন-দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পেশাগত বৈপরীত্যের এটি এক আশ্চর্য নজির বটে।
মানবজীবনকে সহজেই তুলনা করা যেতে পারে নদীর জীবনের সঙ্গে। নদী যেমন কলকল বেগে বয়ে যেতে যেতে হঠাৎ কোথাও বাধা পেলে খানিক থমকে দাঁড়ায় এবং সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে নেয় নতুন পথরেখা, মানুষের জীবনও তেমনি। সকল বড় মানুষের জীবন-সংগ্রামের যে বহুমাত্রিকতা, তা সত্যিকার অর্থেই চোখ দিয়ে দেখার আর হৃদয় দিয়ে অনুভবের। প্রবীণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী-বিশেষজ্ঞ, সংগ্রামী সংস্কৃতিসেবী কলিম শরাফীর জীবনও নানা সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত, দীপ্ত আর ঋদ্ধ।
বলতে দ্বিধা নেই, আর দশজনের মতো তিনিও যদি পারিবারিক পেশার সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিতেন, তাহলে আজকের এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে হয়তো এমন করে পেতাম না। কারণ কলিম শরাফীর পূর্বপুরুষ ছিলেন বিহার শরীফের পীর হযরত শারফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরী। শরাফীর পূর্বপুরুষ মধ্যপ্রাচ্য থেকে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের সোনারগাঁওয়ে হযরত আবু তাওয়ামার কাছে শিক্ষালাভ করেন এবং তাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। অবশ্য পরে বিহারের নালন্দায় স্থায়ী আবাস গড়েন। আর মজার ব্যাপার হলো, শরাফীর পারিবারিক ব্যবসা ছিল সিনেমা হলের ব্যবসা। এমনকি তাঁর বাবা শাহ সৈয়দ সামী আহমেদ শরাফীকেও সিনেমা হল দেখাশোনা করতে হয়েছে। জীবন-দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পেশাগত বৈপরীত্যের এটি এক আশ্চর্য নজির বটে।
কলিম শরাফীর লেখাপড়ার হাতেখড়ি তাঁতীপাড়া পাঠশালায়। হাতেখড়ি হয় আরবি ওস্তাদজী আর বাংলা পণ্ডিত মশাইয়ের হাতে। পাঠশালায় ভর্তি হন ১৯২৯ সালে। তাঁতীপাড়া প্রাইমারী স্কুলে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে চলে আসেন কলকাতায়, বাবার কাছে। এখানে এসে ১৯৩৫ সালে ভর্তি হন মাদ্রাসা-ই-আলিয়াতে, যার অন্য নাম ছিল ক্যালকাটা মাদ্রাসা। অ্যাংলো পর্শিয়ান বিভাগে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর সহপাঠী হিসেবে পান শহীদুল্লা কায়সারকে। পাঠশালায় সুর করে ধারাপাত পড়ার স্মৃতি আজও মনের জানালায় উঁকি দেয় তাঁর। এভাবে সুর করে পড়ার রীতি কোমলমতি শিশুদের মনে চিরস্থায়ী রূপ পায় বলেই শৈশবের এ শিক্ষা যেন সঙ্গী হয়ে যেত সারা জীবনের। কলিম শরাফী যখন দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তখন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ অপসারণের আন্দোলন শুরু করেন। নেতাজীর ডাকে তরুণ বাঙালি ছাত্রসমাজের সঙ্গে কিশোর কলিম শরাফীও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পুরো ভারতবর্ষ তখন উত্তাল। এভাবেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। একবার এক মিছিলে হঠাৎ করেই পুলিশ লাঠিচার্জ করলে কয়েকজনের সঙ্গে তিনিও আহত হন। এসময় তাঁর এবং বন্ধু শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে রউফ ভাইয়ের। এই ‘রউফ ভাই’-ই হয়ে ওঠেন তাঁদের রাজনীতির শিক্ষাগুরু।
কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি জনতার দুর্দশা দূর করার জন্য কীভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, এ আন্দোলন থেকে তাঁরা সেই শিক্ষাই নেন। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহতাও ক্রমশ বাড়ছিল। এক ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা চারদিকে। কলকাতা শহরে দিনেদুপুরে বোমা হামলা হচ্ছে। রাতের লোডশেডিংয়ে ভুতুড়ে নির্জনতা। সে-বছরই কলিম শরাফীর মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার কথা। এরকম অস্থির ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র বদলের সুযোগ দেয়া হয়। এ সুযোগে কলিম শরাফী ফিরে যান বীরভূমে। সেখান থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তিনি ১৯৪২ সালে পাশ করেন ।
অবশ্য পরীক্ষার পরই তিনি গান্ধীজীর ব্রিটিশবিরোধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। গ্রামে-গ্রামে ঘুরে আন্দোলনের সমর্থনে বক্তৃতা ও সভা-সমাবেশ করতে থাকেন। আন্দোলন ঠেকাতে ব্রিটিশরাজও তৎপর হয়ে ওঠে। শুরু করে গ্রেফতার অভিযান। কলিম শরাফীও ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টের আওতায় গ্রেফতার হন নিজ বাড়িতেই। এটা ১৯৪২ সালের আগস্টের ঘটনা। গ্রেফতারের পরপরই ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা। মুহূর্তের মধ্যেই গ্রেফতারের সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। চারদিক থেকে দলে দলে ছুটে আসে লোকজন। উপস্থিত জনতা তাঁকে উদ্দেশ্য করে নানা রকম উদ্দীপনামূলক শ্লোগান দিতে শুরু করে। আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের এ সম্পৃক্ততা তরুণ কলিম শরাফীর মনে এক অন্যরকম শক্তি যোগায়। ভয়শূন্য চিত্তে যেন গর্ববোধ মাথা তুলে দাঁড়ায়।
গ্রেফতারের পর কলিম শরাফীকে পাঠিয়ে দেয়া হয় শিউড়ি জেলে। অন্যসব আন্দোলনকারীর মধ্যে ঐ জেলে তখন একমাত্র মুসলমান রাজবন্দী ছিলেন তিনি। ক্রমশ জেলে পরিচয় ঘটে সেকালের অনেক রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে। জেলে সঙ্গী হিসেবে পান বীরভূম জেলার কংগ্রেস নেতা কামদা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়- যাঁর পুত্র বর্তমানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়; শ্রীমতি রাণী চন্দ, যিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বই ‘ঘরোয়া’র জন্য বিশেষ খ্যাত; শ্রীমতি নন্দিতা কৃপালিনী (বুড়িদি), রবীন্দ্রনাথের নাতনি; চিত্রশিল্পী সুহাস দে- প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও কোলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ মুকুল দে’র ছোটভাই; মহারাষ্ট্রের দীনুকর কৌশিক, যিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্র, পরবর্তী সময়ে কলাভবনের অধ্যক্ষ ও নামকরা চিত্রশিল্পী। এছাড়াও জেলসঙ্গী ছিলেন কুমিল্লার অভয় আশ্রমের হেনাদি; বিখ্যাত কবিরাজ নৃসিংহ সেন, আনন্দ গোপাল সেনগুপ্ত, প্রণব গুহঠাকুরতা। জেলে দীনুকর কৌশিক, আনন্দ গোপাল সেনগুপ্ত, প্রণব গুহঠাকুরতার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে জনাব শরাফীর। প্রণব গুহ জেলে সব সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। তাঁর সঙ্গে গলা মেলাতেন কলিম শরাফীও। জেলের ভেতরেও এই জেলবন্দীদের আন্দোলন কখনো থেমে থাকেনি। জেলের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে চলতো প্রতিবাদ, এমনকি হাঙ্গার স্ট্রাইকও। জেলে তাঁদের সম্বোধন করা হতো ‘স্বদেশী বাবু’ বলে। একটানা ১১ মাস জেল খাটার পর অবশেষে মুক্তি পান কলিম শরাফী। কারামুক্তির পর তাঁকে ভর্তির উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান প্রণব গুহঠাকুরতা। কিন্তু রাজনৈতিক জীবনের পটভূমির কারণে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হতে পারলেন না।
এরই মধ্যে দেশজুড়ে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। যাকে বলা হয় ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’। চারদিকে ক্ষুধাতাড়িত মানুষের আর্তহাহাকার। দলে দলে শহরে ছুটে আসছে মানুষ। এমন দুঃসহ পরিস্থিতিতে কলম ধরলেন কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। লিখলেন নবজীবনের গান। এসব হৃদয়ভেদী গান কণ্ঠে তুলে নিলেন কলিম শরাফীরা। দল বেঁধে গান গেয়ে গেয়ে পীড়িত মানুষজনের জন্য অর্থ সাহায্য সংগ্রহ করতে লাগলেন। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন বিপন্ন মানুষের জন্য খুলল লঙ্গরখানা। কলিম শরাফীও লঙ্গরখানায় খাদ্য বিতরণে আত্মনিয়োগ করলেন। দিনরাত একটানা খাটাখাটুনিতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। তাই পার্টির পক্ষ থেকে নিয়মানুযায়ী তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হল দার্জিলিংয়ের কালিম্পং- এ। কালিম্পংয়েই দেখা পান ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জনক কমরেড মুজফ্ফর আহমদের। আর এই কমরেডের সংস্পর্শ যেন জনাব শরাফীর জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। মুজফ্ফর আহমদকে সকলের মতো তিনিও ডাকতেন ‘কাকাবাবু’। কাকাবাবুর এই অপত্য স্নেহ ও ভালবাসা শরাফীর জীবনে যেনো এক দুর্লভ প্রাপ্তি।
তারপর শরাফী ভর্তি হন হেতমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। তিনি এখানে ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণেই তিনি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, ধর্মীয় সংস্থা, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ান। চারদিকে তখন চরম দুর্ভিক্ষ। প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কৃষ্ণনাথ কলেজ ছেড়ে তিনি ভর্তি হন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে। এটা ১৯৪৫ সালের ঘটনা। এখানেও পড়াশোনা চালাতে পারলেন না। বিশেষ করে অর্থনৈতিক কারণেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফেলতে হয়। এ খবর শোনার পর কমরেড ‘কাকাবাবু’ খুব কষ্ট পান। তিনি অনেককেই বলেছেন, ‘ওর (কলিম শরাফী) অসুবিধার কথা একটুও জানতে পারলাম না।’
এদিকে দুর্ভিক্ষে ৫০ লাখ মানুষের প্রাণহানিতে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ আর অসন্তোষের আগুন চারদিকে। এমন উত্তাল পরিস্থিতিতে চিরকালের মতো পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে শরাফী যোগ দেন ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপে আইপিটিএ-তে। দেশের মানুষকে রাজনীতিসচেতন করে তোলার জন্য এটি ছিল একটি কালচারাল স্কোয়াড। এ সংগঠন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আইপিটিএ অর্থাৎ ইন্ডিয়ান গণনাট্য সংঘই হয়ে ওঠে কলিম শরাফীর আনুষ্ঠানিক সঙ্গীত চর্চার মূল কেন্দ্র। গান শেখা এবং গান পরিবেশনা দুটোই চলতে থাকে সমান তালে। বলতে দ্বিধা নেই, এখানেই তাঁর শিল্পী সত্তার পুরো বিকাশ ঘটে। দেশের মানুষকে রাজনীতি সচেতন করে তোলার জন্য গণনাট্য সংঘের ব্যানারে তাঁরা দেশাত্মবোধক ও সাম্রাজ্যবিরোধী গানের পাশাপাশি পুরনো দিনের গানের অনুষ্ঠানও করতে থাকেন। সঙ্গে চলে উদ্দীপনামূলক নাটক মঞ্চায়নও। এসময় বন্ধু হিসেবে পান খালেদ চৌধুরীকে। একপর্যায়ে আইপিটিএ-র মিউজিক বিভাগের দায়িত্ব নেন সলিল চৌধুরী ও কলিম শরাফী। শুভ গুহঠাকুরতা, দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর কাছ থেকেই শরাফী বিশেষভাবে রপ্ত করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ও স্বদেশী গান। আইপিটিএ-র গণনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে ক্রমশ জড়িয়ে পড়েন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য, অভিনেতা-পরিচালক শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, মুলুকরাজ আনন্দ, খাজা আহমদ আব্বাস, রবিশঙ্কর, শান্তিবর্ধন, বুলবুল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ। এসব আলোকিত মানুষের সান্নিধ্যে থেকে কলিম শরাফী সঞ্চয় করেন জীবনাভিজ্ঞতার অমূল্য রত্নরাজি। গণমুখী গান আর ছায়ানাট্য ‘শহীদের ডাক’ নিয়ে তখন ঘুরে বেড়ালেন সারা বাংলা ও আসাম অঞ্চল। ১৯৩৬ সালে আবার কলেজে ভর্তি হন। এবার সিটি কলেজে, বাণিজ্য বিভাগে। এসময় শম্ভু মিত্র ও সুধী প্রধানদের সঙ্গে উত্তর কলকাতার ‘কমিউন’-এ অবস্থান করতেন। এবছরই শুরু হলো ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মৃত্যু যেন পায়ে পায়ে ঘোরে। এসময় আইপিটিএ-র সদস্য হিসেবে কলিম শরাফী ‘বর্ডার গার্ড’-এর দায়িত্ব পালন করেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের লক্ষ্যে দিনরাত কাজ করতে থাকেন মহল্লায়-মহল্লায়। দাঙ্গার প্রথম দিকে তিনি আশ্রয় নেন দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে। পার্ক সার্কাস এলাকা ছিল মুসলিমপ্রধান। এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়েকে যেন দাঙ্গা স্পর্শ করতে না পারে, সেজন্য কলিম শরাফী ছিলেন বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকায়। পার্ক সার্কাসের পামপ্লেসে তখন বাস করতেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক কেপি চট্টোপাধ্যায়। তরুণ কলিম শরাফী এসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই অধ্যাপকের বাসা পাহারা দিতেন। এমনকি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা অবসানের পাশাপাশি সম্প্রীতি গড়ে তুলতে আয়োজন করতেন চিত্র প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এতকিছুর পরও তাঁর সঙ্গীত সাধনা কখনো থমকে দাঁড়ায়নি। বরং মানবতাবাদের দীক্ষায় আরও খরস্রোতা হয়েছে। কৌতূহলী পাঠক কলিম শরাফীর এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের আদ্যপান্ত জানতে চাইলে পড়তে পারেন তাঁর লেখা ‘স্মৃতি অমৃত’ গ্রন্থটি। বইটির প্রকাশক আগামী প্রকাশনী, প্রকাশকাল ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ। ৮৬ পৃষ্ঠার এ বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে। এই বইয়ে আছে ‘৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম ভয়াবহ দাঙ্গার অভিজ্ঞতার বিস্তৃত বয়ান।
দাঙ্গাবিধ্বস্ত ছেচল্লিশ সাল কলিম শরাফীর জীবনে আরও কিছু কারণে এক স্মরণীয় অধ্যায়। এ বছরই বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে বের হয় তাঁর প্রথম গণসঙ্গীতের একটি রেকর্ড। তখনই নিয়মিত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন কলকাতা বেতারে। এসময় কলকাতার বিখ্যাত পত্রিকা ‘স্টেটসম্যান’-এ শরাফীর গানের প্রশংসা করে ছাপা হয় একটি রিভিউ। এদিকে পার্ক সার্কাসের এক অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনে পরের দিন বাড়িতে গিয়ে হাজির হন তড়িৎ চৌধুরী। তিনি কলিম শরাফীকে নিয়ে গেলেন তাঁর সঙ্গীতগুরু শুভ গুহঠাকুরতার কাছে। ‘দক্ষিণী’ শুভ গুহঠাকুরতার রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবার প্রতিষ্ঠান। শরাফী যোগ দিলেন দক্ষিণী’তে আর এভাবেই তাঁর নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা শুরু। সকালে ‘দক্ষিণী’ আর বিকেলে গণনাট্য সংঘের কর্মকাণ্ড। ব্যস্ততার যেন কোনও শেষ নেই। এক সময় ‘দক্ষিণী’তে যোগ দিলেন শিক্ষক হিসেবেও। এখানে পেলেন সঙ্গীতগুরু দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্রকে। এঁরা সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীত, গণসঙ্গীত, আধুনিক- সব ধরনের গানই গাইতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে কলিম শরাফী তখন পেলেন বিশেষ অনুপ্রেরণা। এসময় কলকাতার প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং গণজাগরণের গান গাওয়ার দরুন স্থানীয় প্রশাসন তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতো। ফলে ১৯৪৮ সালে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। এসময় আইপিটিএ-এর নেতৃত্বে আসে পরিবর্তন। পরিবর্তন আসে নীতিতেও। পরিবর্তিত নীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারলেন না আইপিটিএ-এর তখনকার স্বনামখ্যাত অনেক শিল্পী। ফলে কেউ হলেন নিষ্ক্রিয়, কেউবা পাড়ি জমালেন বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই)। অন্যদিকে মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, অশোক মজুমদার, মোহাম্মদ ইসরাইল, কলিম শরাফী প্রমুখ আইপিটিএ থেকে বেরিয়ে এসে গঠন করলেন নাট্যসংস্থা ‘বহুরূপী’। এটা ১৯৪৮ সালের ঘটনা। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পর কলকাতায় আবার শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এসময় মুসলিম হওয়ার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েন কলিম শরাফী। প্রচণ্ড অর্থকষ্ট তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে যেন। এদিকে ১৯৪৯ সালে তিনি বিয়ে করেন। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫০ সালে পুরো পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী কামেলা খাতুন ও একমাত্র শিশুকন্যাকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়।
ঢাকায় এসেই ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন রেডিওতে। এরই মধ্যে তিনি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘অবাক পৃথিবী’ গানটি গেয়ে পাকিস্তান গোয়েন্দা দফতরের সন্দেহের চোখে পড়েন। এ পরিস্থিতিতে তাঁর ঢাকায় বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অবশ্য কলকাতায় থাকতে প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং গণজাগরণের গান গাওয়ার ফলে প্রশাসন যে তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতো, তা যেন ঢাকায় এসেও তাঁকে তাড়া করে। এতকিছুর পরও কিন্তু কলিম শরাফীর গান কখনো থেমে থাকেনি। ১৯৫১ সালে ঢাকা ছেড়ে তিনি চলে যান চট্টগ্রামে। তারপর গেট্জ ব্রাদার্স নামে একটি আমেরিকান কোম্পানিতে চাকুরিতে যোগ দেন।
আবার তাঁর মাথায় আসে সাংগঠনিক চিন্তা। এবার চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন ‘প্রান্তিক’ নামে একটি সংগঠন। পূর্ববাংলায় তখন তিনি নবনাট্য আন্দোলনের প্রথম প্রতিনিধি। প্রান্তিকে সহযোদ্ধা হিসেবে পেলেন তরুণ সংগঠক মাহবুব উল আলম চৌধুরী, মাহবুব হাসান, কাজী আলী ইমাম, চিরঞ্জীব দাশ শর্মা, রমেন মজুমদার, অচিন্ত্য চক্রবর্তী, এমএ সামাদ, ফওজিয়া সামাদ, নিত্যগোপাল দত্ত প্রমুখকে। তারপর ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন দু’বাংলার প্রথিতযশা শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দ। সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল। আর যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কথাশিল্পী শওকত ওসমান ও সায়ীদুল হাসান (একাত্তরের শহীদ)। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল শহরের হরিখোলার মাঠে। এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসে আলো ছড়িয়েছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র। শিল্পী-সংগঠক কলিম শরাফীর ‘প্রান্তিক’ও এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে জয় করে নেয় দর্শক-শ্রোতার অকুণ্ঠ ভালবাসা।
১৯৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন। এ সম্মেলনে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে শতাধিক শিল্পী-সাহিত্যিক ও প্রতিনিধি যোগ দেন। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার কার্জন হলে। কলিম শরাফীর প্রান্তিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে নাচ-গান ও ‘বিভাব’ নাটকের এক ব্যাপক আয়োজন নিয়ে। প্রান্তিকের এ আয়োজন সেবার অর্জন করে বিশেষ খ্যাতি।
গোটা পাকিস্তানে তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা। ১৯৫৬ সালে বরখাস্ত করা হয় শেরে বাংলার মন্ত্রিসভাকে। এবং জারি করা হয় সেকশন নাইনটি টু। ফলে আবারও আত্মগোপনে যেতে হয় কলিম শরাফীকে। তবে বছরের শেষ দিকে তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। তারপর ‘হ-য-ব-র-ল’ নামে গড়ে তোলেন একটি সংগঠন। এ সংগঠনের ব্যানারেই মঞ্চস্থ হয় ‘তাসের দেশ’ নাটকটি। সে সময় তাঁর সহযোগী ছিলেন ড. আনিসুর রহমান ও ড. রফিকুল ইসলাম। ১৯৫৭ সালে তাঁর জীবনে ঘটে একটি স্মরণীয় ঘটনা। চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংযোজন। আর এটা ঘটে ‘আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে। পূর্ব পাকিস্তানে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে’ গানটির দু’লাইনে কণ্ঠ দেন কলিম শরাফী। আরো একটি কারণে বছরটি তাঁর কাছে বিশেষ স্মরণীয়। এবছরই স্ত্রী কামেলা খাতুনের সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
১৯৫৮ সাল। দেশজুড়ে জারি হলো আইউব খানের সামরিক শাসন। রেডিওতে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হলো কলিম শরাফীর গান। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ঐ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি।
‘আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে দু’লাইন গানে কণ্ঠ দেয়ার পরই কলিম শরাফীকে যেন চলচ্চিত্রের নেশা খানিকটা পেয়ে বসে। ১৯৬০ সালে পরিচালনা করেন ‘সোনার কাজল’ ছবিটি। এ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন জহির রায়হান। এসময় কলিম শরাফীর সঙ্গীত পরিচালনায় নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র ‘ভেনিস’ আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে। তারপর ‘সূর্যস্নান’ ছবিতে ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে’ গানটি গেয়ে তিনি শ্রোতামহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এছাড়া কবিয়াল রমেশ শীলের জীবন নিয়ে একটি তথ্য চিত্রও নির্মাণ করেন কলিম শরাফী। ‘সোনার কাজল’ ছবি পরিচালনার নেপথ্য-কথা বলতে গিয়ে শরাফী জানান, ”সোনার কাজল’ করার কোনও ইচ্ছা আমার ছিল না। কাহিনীটা মাথায় এলে আমি কথা বলি শম্ভু মিত্রের সঙ্গে। তিনি বললেন, এটা দিয়ে সিনেমা করতে পারো। সেই মতো আমি জহির রায়হানকে প্রস্তাব দিই ছবিটি পরিচালনার। জহির উল্টো বলে, কলিম ভাই, ছবিটা আপনিই করেন; বরং আমি আপনার অ্যাসিসটেন্ট হিসেবেই থাকব। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ছবিটি পরিচালনা করতে হয়। জহিরকে করে নিই কো-ডিরেক্টর। ক্যামেরায় ছিলেন জামান।’
‘সোনার কাজল’ ছবির মধ্য দিয়েই চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে খলিলের। ছবিতে নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী আর সহঅভিনেত্রী ছিলেন সুলতানা জামান। চলচ্চিত্র নিয়ে শরাফীর ভিন্ন রকম চিন্তার এক অনন্য নজির ‘সোনার কাজল’। এ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনাও করেন শরাফী নিজেই।
আর এভাবেই যেন সেলুলয়েডের ফিতায় জড়িয়ে পড়েন কলিম শরাফী। চলতে থাকে তাঁর আলো-ছায়ার খেলা। ১৯৬০ সাল থেকেই শুরু করেন ডকুমেন্টরি ফিল্ম তৈরি। মূলত সমবায়কে বিষয় করে নির্মিত হতো এসব ডকুফিল্ম। এছাড়া শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার তাঁর তৈরি পাপেট নিয়ে উপস্থিত হন কলিম শরাফীর ডকুমেন্টারি ফিল্মে। এসব ফিল্মে শিল্পী মনোয়ার তাঁর পাপেট নিয়ে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট চালান। পাশাপাশি এসব ডকুফিল্মে বিষয়ভিত্তিক চমৎকার বর্ণনা দিতেন দরাজ কণ্ঠের আবৃত্তিকার সৈয়দ হাসান ইমাম।
আবারও চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন শিল্পী কলিম শরাফী। এবারের চলচ্চিত্র ‘মেঘ ভাঙ্গা রোদ’। ‘রংধনু রংঙে আঁকা’ সেই বিখ্যাত গান। এটা ১৯৬৩ সালের ঘটনা। একই বছর তাঁর দুটি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। গান দুটি হলো- ‘কুহেলী রাত মায়া ছড়ায়’ এবং ‘আজ হলো শনিবার’। এসময় কলকাতায় অনুষ্ঠিত রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলনেও তিনি যোগ দেন। এবছর কলিম শরাফীর জীবনে ঘটে আরো একটি স্মরণীয় ঘটনা। দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তিনি। স্ত্রী নাওশাবাকে নিয়ে শুরু হয় তাঁর নতুন সংসার-যাত্রা।
১৯৬৪ সাল। ঢাকায় প্রথম টিভি সেন্টার চালু হলো জাপানীদের কারিগরি সহযোগিতায়। নতুন চালু হওয়া এ টিভি সেন্টারে কলিম শরাফী যোগ দেন প্রোগ্রাম ডিরেক্টর পদে। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেয়ার কিছুদিন পরই তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হলো ষড়যন্ত্র। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল তিনি বেশি বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার করছেন। ফলে দু’এক বছরের বেশি চাকরি করা হলো না তাঁর। শেষে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আবার ফিরে গেলেন এইচএমভি-তে। এ পর্যায়ে ঢাকাস্থ এইচএমভি’র তিনি প্রতিনিধি। ১৯৬৫ সালে শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। তখন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত। এসময় শিল্পী কলিম শরাফী জাপানে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। কিন্তু সরকারি রোষানলে পড়ে তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত হলে জাপান যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালে কলিম শরাফী আবারও চাকরিতে যোগ দেন। এবার ইএমআই নামে ব্রিটিশ গ্রামোফোন রেকর্ডিং কোম্পানিতে। প্রথমে ছিলেন ম্যানেজার, ইস্ট পাকিস্তান। পরে এ কোম্পানিতে জেনারেল ম্যানেজার এবং আরও পরে ডিরেক্টর এন্ড জেনারেল ম্যানেজার পদে পদোন্নতি পান।
১৯৬৯ সালে শিল্পী কলিম শরাফী উদীচীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি দীর্ঘকাল ছিলেন উদীচীর উপদেষ্টা ও সভাপতি। নিজের সঙ্গীত চর্চা অটুট রেখেও ১৯৬৯ সালে ঢাকা থেকে সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, আফসারী খানম, রাখী চক্রবর্তীকে নিয়ে যান করাচিতে। তারপর গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে এঁদের রেকর্ড বের করার ব্যবস্থা করেন।
ইতোমধ্যে শুরু হয় পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন। ক্রমশ বাড়ছে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা। তাই কলিম শরাফী সিদ্ধান্ত নিলেন রেকর্ড রিলিজ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করাবেন শেখ মুজিবকে দিয়ে। যে কথা সেই কাজ। রেকর্ড রিলিজের খবর তাই পরিণত হলো আন্তর্জাতিক সংবাদে। এসব কারণে পাকিস্তান সরকারের সন্দেহের তালিকায় কলিম শরাফীর নাম উঠে গেল আরও উপরে।
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধেও সম্পৃক্ততা ছিল কলিম শরাফীর। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে অবস্থান কালে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে গড়ে তোলেন জনমত। গান গেয়ে, বিভিন্ন সভা-সমিতিতে অংশ নিয়ে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করেন। একপর্যায়ে তিনি লন্ডন থেকে পাড়ি জমান আমেরিকায়। সেখানেও তিনি এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। অতঃপর দেশ স্বাধীন হলে কলিম শরাফী দেশে ফেরেন। ১৯৭৪ সালে জনাব শরাফী শিল্পকলা পরিষদের উপদেষ্টা সদস্য পদ লাভ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনে। এখানে তিনি জনসংযোগ কর্মকর্তা ও জেনারেল ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে গঠিত একুশে উদযাপন কমিটিতে তাঁর নাম রয়েছে এমন খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে এক ঘণ্টার নোটিশে তাঁকে বরখাস্ত করা হয় বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন থেকে।
১৯৭৯ সালে গঠিত হয় ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’। শিল্পী শরাফী উক্ত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক। পরবর্তী সময় ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’ই রূপান্তরিত হয় ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’-এ। ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে অর্থাৎ ১৩৯০ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ ‘সঙ্গীত ভবন’ নামে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় গড়ে তোলেন কলিম শরাফী। এটি শান্তিনিকেতনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পীদের প্রতিষ্ঠান। ‘সঙ্গীত ভবন’-এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই শিল্পী কলিম শরাফী এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৯০ সালে শরাফী বেতার-টিভি শিল্পী সংসদ-এর কার্যকরী পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের ২৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির গণসমাবেশে অংশগ্রহণ করায় দেশের ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাঁকেও আসামী করা হয়। কিন্তু এসব কোনকিছুই তাঁকে তাঁর নীতি-নৈতিকতা থেকে দূরে ঠেলতে পারেনি। তিনি সবসময় দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছিলেন। দেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে ইতোমধ্যে বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। এরমধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, চীন, পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ইত্যাদি।
এবার চলুন, শিল্পী কলিম শরাফীর পারিবারিক জীবনের দিকে একটু চোখ ফেরাই। স্ত্রী নাওশাবা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজিতে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন। কলিম শরাফীর এক কন্যা ও এক পুত্রসন্তান। মেয়ে আলেয়া শরাফী ও পুত্র আজিজ শরাফী। আড্ডাপ্রিয় শিল্পী কলিম শরাফী সস্ত্রীক বাস করতেন নিউ বেইলী রোডের বেইলী হাইটসের নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে। ছিমছাম, সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটের বাসিন্দা শুধু স্বামী-স্ত্রী দুজনই। অত্যন্ত নিয়মানুবর্তিতায় বেঁধে রেখেছিলেন জীবনকে। প্রতিদিনই সকাল-বিকেল বন্ধুজন কিংবা প্রিয়জনদের বাসায় ঢুঁ মারতেন এ দম্পতি। জমিয়ে তুলতেন গল্প আর আড্ডায়। প্রায়ই বেড়াতে যেতেন বীরাঙ্গনা শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বাসায়। প্রিয়ভাষিণীর অসাধারণ শিল্পকর্ম শিল্পী শরাফীকে খুব টানত। অবাক চোখে অবলোকন করতেন এসব শিল্পকর্ম।
বহু বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে আমাদের এই প্রবীণ শিল্পীর ছিল শ্রদ্ধা-ভালবাসার সম্পর্ক। এ তালিকায় আছেন প্রিয় মানুষ ও বন্ধু সুচিত্রা মিত্র, পঙ্কজ মল্লিক, শচীন দেববর্মণ, সত্যজিৎ রায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আব্বাস উদ্দিন, আবু সয়ীদ আইয়ুব, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, খালেদ চৌধুরী, শামসুর রাহমান, রশীদ করীম, শহীদুল্লা কায়সার, এম আর আখতার মুকুলসহ আরও অনেকে।
গভীর রবীন্দ্র-অন্তঃপ্রাণ শিল্পী ছিলেন কলিম শরাফী। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালবেসে তিনি জীবনে নানা নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। তবু ডুবে ছিলেন রবীন্দ্রনাথেই। সবাইকে পড়তে বলতেন রবীন্দ্রসাহিত্য। কারণ রবীন্দ্রসাহিত্যেই আছে নির্বাণের সকল মন্ত্র। তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিকায় আছে : আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান; আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল; আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী; আকাশভরা সূর্যতারা; যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক অমি তোমায় ছাড়ব না মা ইত্যাদি জনপ্রিয় গান।
তাঁর দীর্ঘ জীবনে মাত্র ৫টি গানের ক্যাসেট/অ্যালবাম বেরিয়েছে বরেণ্য শিল্পী কলিম শরাফীর। শিরোনামগুলো হলো- এই কথাটি মনে রেখো; আমি যখন তার দুয়ারে; কলিম শরাফীর যত গান; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কথা ও সুরে নবজীবনের গান।
এবার কিছু প্রিয় প্রসঙ্গ। কলিম শরাফীর প্রিয় কবিতা ছিল জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘তোমার প্রেরণা পেয়েছি’। সাহিত্যের প্রিয় চরিত্র শরৎচন্দ্রের অসাধারণ নির্মাণ ‘দেবদাস’। প্রিয় বই মানেই রবীন্দ্রনাথের বই; সঙ্গে আছে তারাশঙ্করের বইও। ফ্যাশনেবল এই প্রবীণ শিল্পীর পোশাকরুচিও লক্ষ করার মতো। পাট দেয়া পাজামা-পাঞ্জাবি তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল। পারফিউমের মধ্যে প্রিয় ব্যান্ড ওয়ান ম্যান শো, অ্যারামিস ইত্যাদি। খাবারদাবারেও বেশ সাবধানী ছিলেন তিনি। একেবারেই ফ্যাটজাতীয় খাবার খেতেন না। তবে ভেজিটেবল খেতেন নিয়মিত। মিষ্টি তাঁর দারুণ প্রিয় খাবার ছিল। নিয়মের নিগড়ে বাঁধা জীবন যাকে বলে তেমনি তাঁর জীবন ছিল। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙত ছ’টা-সাড়ে ছ’টায়। সকাল আটটায় এক কাপ চা আর এক পিস রুটিতে সেরে নিতেন নাস্তা। তারপর ন’টা-সাড়ে ন’টায় গোসল। দশটায় আবার চা। তারপর প্রায় প্রতিদিনই স্বামী-স্ত্রী বেরিয়ে পড়তেন বাসা থেকে। আশপাশের কোনও শপিংমলে টুকটাক কেনাকাটা করতেন কিংবা ঘুরে বেড়াতেন। বারোটা-সাড়ে বারোটায় বাসায় ফেরা। দুপুরের খাবার একটায়। হালকা খাবার। তারপর বিশ্রাম নিতেন। নিয়মিত পড়তেন খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন। বিকেলে কোনও অনুষ্ঠানে কিংবা বন্ধুজনের বাসায় বেড়াতে যেতেন। রাতে বাসায় ফিরে কখনো টিভি দেখতেন, কখনো গান শুনতেন। প্রায়ই ছেলেমেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন। দশটা-সাড়ে দশটায় রাতের খাবার খেয়েই গা এলিয়ে দিতেন বিছানায়। এভাবেই কাটত আমাদের প্রিয় শিল্পী কলিম শরাফীর এককটি দিন।
রেডিও-টেলিভিশন ছাড়াও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন শিল্পী কলিম শরাফী জয় করেছেন অসংখ্য মানুষের হৃদয়। আর এ জন্যে স্বীকৃতিও কম পাননি। রবীন্দ্রসঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি জাতীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পদক অর্জন করেছেন। পেয়েছেন নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, জেবুন্নিসা-মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা ও পদক। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, পেয়েছেন মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা ও সম্মান।
শিল্পী কলিম শরাফী ২ নভেম্বর, ২০১০-এর দুপুরে ঢাকার বারিধারার বাড়িতে মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৬ বছর। বাংলাদেশের সবকটি জাতীয় আন্দোলনসহ নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ ছিলেন শিল্পী কলিম শরাফী। প্রগতিশীলতার মশাল হাতে সেই তরুণ বয়সে যে সংগ্রাম তিনি সূচনা করেছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা চালিয়ে গেছেন নিরলসভাবে। তাই এই বরেণ্য শিল্পীর প্রতি আমাদের ভালবাসা কখনো ফুরোবার নয়।
লেখক : মতিন রায়হান