জন্ম, ছেলেবেলা ও বেড়ে ওঠা
বাংলাদেশের লোক সঙ্গীতের পুরোধা পুরুষ আব্বাসউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও লোকসঙ্গীত শিল্পী। কুচবিহার অঞ্চলে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, যেখানে গাঁথা রয়েছে তাঁর মূল শিকড়, ভাওয়াইয়া সুরের দেশ, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে কৃষকরা হাল বাইতে বাইতে, পাট নিড়াতে নিড়াতে গাইত ভাওয়াইয়া গান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সারাটা গ্রাম মাটির গানের সুরে মুখরিত হয়ে থাকত। সেসব গানের সুরেই শিল্পীর মনের নীড়ে বাসা বেঁধেছিল ভাওয়াইয়া গানের পাখি। এ গানে সুর তাঁর সত্তায় তুলে দিত আলোড়ন। চাষীদের গানের সুর অবিকল আয়ত্ত করে তুলে নিতেন নিজের গলায়। স্কুলের পথে হেটে যেতে বাড়ি আড়াল হলেই ধরতেন গানের অনুশীলন, বাজারে আসার আগ পর্যন্ত চলত। গান নিয়ে আত্মীয়- স্বজনের ঘোর আপত্তি থাকলেও তাঁর বাবার মৌন সম্মতিতে আসলে শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের সুরময় জীবনের সূচনা ঘটে। এই কীর্তিমান শিল্পীর জন্ম বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারের বলরামপুর গ্রামে। ১৯০১ সালের ২৭শে অক্টোবর। তিনি ছিলেন তুফানগঞ্জের বিত্তবান উকিল জাফর আলীর সন্তান, তবে জীবন ধারা ছিল গ্রামের আর দশটি সাধারণ ছেলের মতই। গ্রাম-বাংলার প্রাকৃতিক নিসর্গের কাছে বেড়ে ওঠা গান পাগল আব্বাসউদ্দীনের কল্পনাপ্রবণ মনে এদেশের মাটির লোকসুরের বিকাশ ও বৈচিত্রতা ঘটেছিল ঋতু পরিবর্তনের রূপ বৈচিত্রতা অবলোকন করে, পাখির ডাক শুনে। পরবর্তী জীবনে খুব অল্প সময়ের জন্য কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করলেও এই শিল্পী ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত শিল্পী। বরেণ্য শিল্পীর লোকগানে নিজে নিজে পারদর্শিতা অর্জন করার গল্প বেশ আকর্ষণীয়। বাংলাদেশের লোকগান বেঁচে আছে তাঁর গলায় তাঁর অসামান্য কীর্তিতে।
পালাগান, দোতারার সাথে পরিচয় হয়েছিল ছেলেবেলাতেই, ঘোড়ার লেজ সংগ্রহ করে নিজ হাতে ‘বেণা’ তৈরী করে জীবনের প্রথম গান গাওয়া হয়েছিল। এই লোকসঙ্গীত শিল্পী জীবনে প্রথম গান গেয়েছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত। ছেলেবেলায় গান ও লেখাপড়ায় পারদর্শী আব্বাসউদ্দীনের বেশ নামডাক ছিল। একটু বড় হয়ে মানে মেট্রিক পরীক্ষার সময় গ্রামে আগত একটি সমাজ সংস্কারক যাত্রা দলের পরিবেশনা দেখে জীবনে প্রথম নব চেতনার গানের সংস্পর্শে আসেন। গানের সুর দিয়ে গণমানুষের মনে উদ্দীপনা জাগাবার শপথ নিয়েছিলেন। ছেলেবেলায় কলকাতা থেকে আগত তুফানগঞ্জের একটি হিন্দু পরিবারের সাথে আত্মার-আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, ধর্ম ও সমাজের উর্ধে গিয়ে সম্পর্ক হয়েছিল, যার সুবাদে তিনি বাংলা বইয়ের সংস্পর্শে আসেন, তখনই মূলত পড়ুয়ার অভ্যাসটি তৈরী হয়েছিল, পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ভাল কিছু বই। কিছু দিন পরই কোচবিহার কলেজে আইএ পড়ার সময় ঝোঁকের মাথায় পুলিশের দারোগার চাকুরী পেয়ে খুব খুশি হলেও নিজের বাবা এবং সেই পালক বাবার হস্তক্ষেপে চাকুরীটা আর করা হয়নি। সতের বছর বয়সে আব্বাসের জীবনে প্রথম প্রেম নীরব চরণ ফেলে এসেছিল এক অনিন্দ্যসুন্দর কিশোরীর জন্য। তুফানগঞ্জের কালজানি নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতে গলা ছেড়ে গানের অনুশীলন করতে গিয়ে দেখা হয়েছিল। নদীর তীরে বসে অফুরন্ত সময়ের জন্য গল্প করা, পূর্নিমার চাঁদের আলোয় ফুল আদান-প্রদান হয়েছিল।
ভদ্র ও শিক্ষিত আব্বাস সেই বাড়ির সাথে যোগাযোগ স্থাপনও করেছিল, পরে বাবা-মা জানতে পেরে তাঁর প্রথম প্রেমে শুভ পরিণয় ঘটার পরিকল্পনা করলেও তাঁর মানস্প্রতিমা, জীবনের প্রথম প্রেমের কল্পতরুকে স্বর্গ থেকে ধরার ধূলোয় নামিয়ে আনতে সাহস করেননি। ফলে সেই অধরা প্রেম অধরাই রয়ে যায়, সেই প্রেম আব্বাসের মনে স্মৃতির ধ্রুবতারা হয়েছিল সারাজীবন। আইএ পাশ করার পর লখনৌ মরিস মিউজিক কলেজে পড়তে যাবার ইচ্ছা বাড়ীতে ব্যক্ত করলেও অনুমতি মেলেনি, ফলে গিয়েছিলেন রংপুর কলেজে, কিছুদিন পড়বার পর সেখানে মন টেকেনি, চলে গিয়েছিলেন রাজশাহী কলেজে, আবহাওয়া সয়নি, দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তবে বি.এ. ফাইনাল পরীক্ষাটা সেখান থেকেই দেন। পরীক্ষার ছুটিতে বেড়াতে গেলেন রংপুরের বড়খাতায় বন্ধুর বাড়ি, কিন্তু সেসময়ে হঠাৎ করে খবর এল বাবা মৃত্যুশয্যায়। পড়িমড়ি ঘরে ফিরে দেখতে পান বাড়ির সবাই বাবার শেষ শয্যা পাশে কান্নাকাটি করছে। বাড়ির সবাইকে ভেঙ্গে পড়তে দেখেও সেদিনে সদ্য যুবা আব্বাস জায়নামাজে বসে পরম করুণাময়ের কাছে এক আশ্চর্য মনোবল নিয়ে নিজের বি.এ. পাশের বিনিময়ে বাবার প্রাণ ভিক্ষা চাইবার প্রার্থনা করলেন, বাবার চোখ না খোলা পর্যন্ত পড়েছিলেন সিজদায়।
বাবা ১১৫ বছর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছিলেন, তবে সেই ঘটনার পর কলেজের সবচে’ নামকরা ছাত্র আব্বাসউদ্দীনের নাম বি.এ. পরীক্ষায় ফলাফলে কলেজ গেজেটে উঠলো না। বাবা অনেক বোঝানোর পর আবার বি.এ.’র দরজায় গিয়েছিলেন, কিন্তু এর আগের তিনমাস কাটিয়েছিলেন বাড়িতে। পারিবারিক হাটের নিয়মিত ইজারা সংগ্রহ করার জন্য প্রতিদিন ৫ মাইল যাওয়া আসা করতে ধনীর ছেলে আব্বাস অমানুষিক পরিশ্রম করতে লাগলেন। বর্ষায় দু’কূল হারানো কালজানি নদীর পাড়ে খেয়া পারাপারের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতেন আর গলা ছেড়ে গান গাইতেন, মনের দুঃখ আর বিষন্নতা সবই ধরা পড়ত সেই গানে। সেখানে একদিন এক বৃদ্ধ মাড়োয়ারি আব্বাসকে বললেন, ‘এমন মিষ্টি গলায় গান গাও তুমি কলকাতায় গিয়ে কলের গানে গান দাও, জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে।’ কালজানি নদীতে নৌকায় চড়ে আব্বাস গান গাইতেন। নদীর ঢেউ-এর ওপর দিয়ে তাঁর গানের সুরের কাঁদন কাঁপতে কাঁপতে দূরে মিলিয়ে যেত। বাড়ি থেকে দক্ষিণ দিকে অবস্থিত কলকাতার পানে চেয়ে থাকতেন যুবক আব্বাস।
কলকাতা শহরে শিল্পীর আসনে প্রতিষ্ঠালাভ
আর তাই কলকাতা থেকেই শৈলেন রায় ও ধীরেন দাসের লেখায় নিজের সুর সংযোগে আব্বাসের জীবনের প্রথম দুটি গানের রেকর্ড হয়েছিল। এসময় গ্রামোফোন কোম্পানির সুরকার, গীতিকার ও ম্যানেজারসহ বেশকিছু লোকজনের সাথে পরিচয় ঘটে। প্রথম গানের রেকর্ডের কথা আব্বাসের বন্ধু মহলে প্রায় সবাই জেনে গিয়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই।প্রথম গানের রেকর্ড হবার পর পরই আব্বাসকে যেন কলকাতা বৃহত্তর জীবনের অনাগত দিনসব হাতছানি দিয়ে ডাকা শুরু করল। এ আহবানে সাড়া দেবার তাগিদে তিনি বি.এ. পাশ দেবার কথা তুচ্ছ ভাবতে লাগলেন। এভাবে একদিন আব্বাস তাঁর অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে নিজের সিদ্ধান্তে একরকম পালিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। সেখানে কিছুদিনের মধ্যে ছোটখাট একটি চাকুরী যোগাড় ও মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন। এসময় পরিচয় হয়েছিল ছদ্মবেশে থাকা ভারতের প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ওস্তাদ শ্রীতারাপদ চক্রবর্তীর সাথে। এত বড় শহরে এসে যুবক আব্বাস তখন পথে পথে ঘুরতেন আর ভাবতেন কিভাবে এখানে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়। তাঁর মনের এ সুক্ষ্ম অভিলাষ বিধাতা মঞ্জুর করেছিলেন। আর তাই জীবনের প্রথম স্টেজশোতে গান গাইবার সুযোগ এসে গেল কিছুদিনের মধ্যে, কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রদের রি-ইউনিয়ন উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে মিলনায়তনের বিশাল মঞ্চে সেসময়কার বিশিষ্ট কিছু শিল্পী কৃষ্ণ চন্দ্র দে, পঙ্কজ মল্লিক ছিলেন তাঁর সহশিল্পী। কম্পমান হৃদয় আর শিহরিত শরীরে জীবনের প্রথম স্টেজে গান গাওয়া হলেও সেদিন বাহবা পেয়েছিলেন প্রচুর, একে একে অনেকগুলো গান গাইতে হয়েছিল সেদিন। এরপর অবশ্য আব্বাসউদ্দীনকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক স্টেজশো’র আমন্ত্রণ আসতে থাকে। উদীয়মান শিল্পী আব্বাস এভাবে কলকাতায় মেসে কাটালেন প্রায় দু’বছর।
ইসালামী গান, কাজী নজরুল ও আব্বাসউদ্দীন
আব্বাসউদ্দীন ও কাজী নজরুল ইসলামের সম্মিলিত সৃষ্টি বাংলা গানের জগতে তৈরী করেছিল একটি ভিন্ন অধ্যায়। তৎকালে বাঙ্গালী গোঁড়া মুসলমানদের ইসলামী গান উপহার দিয়ে গান তথা আধুনিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের দিকে উৎসাহিত করে তুলেছিলেন তাঁরা দুজনে মিলে। আব্বাসউদ্দীনের উৎসাহে কাজী নজরুল কাওয়ালী ও সুফি ঘরানার বাংলা গানের বিশাল ভান্ডার তৈরী করেন। আব্বাসউদ্দীনের গলায় সেগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তাও কুড়িয়েছিল। তাঁদের প্রথম জনপ্রিয় গান ছিল ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’। এই দু’জন কীর্তিমানের প্রচেষ্টায় সেসময় অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে গানের রেকর্ড সাধারণ মানুষের হাতের কাছে পৌঁছেছিল। যার ফলে তখন প্রায় সকল সামর্থবান বাঙ্গালী মুসলমান ঘরে পৌছে গিয়েছিল গানের রেকর্ড ও বাংলা বই। ভাটিয়ালি গানের ক্ষেত্রে কাজী নজরুলের রচনা ও গ্রাম্য সুরে আব্বাস প্রথম নাম পেতে শুরু করেন। গ্রাম্য সুরের ওপর করা নজরুলের লেখা ও সুর করা গান – ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা’ তখন খুব বিখ্যাত হয়েছিল।
পল্লীগীতি, আব্বাসউদ্দীন ও কবি জসীম উদ্দীন
এ সময় আব্বাসউদ্দীনের নাম ডাক চারদিকে বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। সৃষ্টি হল সাড়া জাগানো গান ‘আমি গহীন গাঙের নাইয়া’ ও ‘ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’।এরপর আব্বাস আর জসীম তখন পল্লীগীতিকে জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যেন অভিযানে নেমে পড়লেন। বিভিন্ন কলেজে গিয়ে গিয়ে আব্বাস-জসীম ডুয়ো পল্লীগীতি’র আসর করতে লাগলেন। প্রথম প্রথম তেমন সাড়া না মিললেও তাঁদের দলে যোগ দিলেন খগেন মিত্তির, রায়বাহাদুর দীনেশ সেন, গুরুসদয় দত্ত।তখন কলকাতায় বসবাসরত প্রায় আশি ভাগ মানুষের মূল শিকড় বাঁধা ছিল গ্রামাঞ্চলে। তখন তারা কলকাতায় বসতি গেড়েছিল রুজি- রোজগারের আশায় তবে তাদের মন পড়ে থাকত শিকড়ের কাছে। যখন রেকর্ড আর রেডিওর মাধ্যমে আব্বাসের কন্ঠে ধ্বনিত হল পল্লীর সেই মেঠো সুর তখন যেন নগর জীবনে ক্লান্ত পথচারী থমকে দাঁড়াল! এই সুরের সঙ্গে খুঁজে পেল নাড়ির টান ও প্রাণের যোগাযোগ। এভাবে শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের গানের সুরের মাধ্যমে বাংলার আকাশ-বাতাস পল্লীগীতির সুরশ্রীসমৃদ্ধ হল। অভিজাত মহল, পেশাজীবি সমাজ, খেটে খাওয়া শ্রেণী তথা পুরো সমাজে বাংলাদেশের পল্লীগীতি বিশেষভাবে সমাদৃত হল।ভাটয়ালী গানের জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠা পাবার পর আব্বাসের মনে নতুন উন্মাদনা জেগে উঠল তাঁরই শিকড়ের সুর ভাওয়াইয়া। কোচবিহারের তোরষা নদীর তীর ধরে গান গেয়ে চলেছে, মোষের পিঠে করে দোতারা বাজিয়ে মেষপালক মৈষালের দল। তাদের কন্ঠের সুর আব্বাসের কন্ঠে বেঁধে গিয়েছিল ছেলেবেলায়। তাদের মুখের ভাষাই ছিল আব্বাসের মাতৃভাষা।
কোচবিহারের স্থানীয় ভাষাস্বত্বেও সর্বজনীন আবেদনসমৃদ্ধ এ ভাষায় আব্বাস প্রথম গাইলেন ‘ও কি ও গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’ ও ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে’। এসব গান শুধু উত্তরবঙ্গে নয় সারা বাংলায় জাগিয়েছিল বিপুল আলোড়ন। শুধু গানই নয় উত্তরবঙ্গের ভাষায় এসময় আব্বাসউদ্দীন রেকর্ড করলেন মধুবালা, চারুমতি কন্যা, রুপধন কন্যা, হলদী-শানাই, মহুয়া সুন্দরী ইত্যাদি কয়েকটি নাটক। পল্লী সাহিত্য ও পল্লীগীতির ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও কাটতি দেখে রেকর্ড কোম্পনীর লোকেরা প্রতিমাসে নতুন নতুন রেকর্ড বাজারে আনতে লাগল। ব্যাপক চাহিদার প্রেক্ষিতে এসময় আব্বাস শুধু নিজেই নন, কোচবিহার থেকে নিজের পরিচিত বন্ধু, অগ্রজ ও অনুজদের নিয়ে এসে গান রেকর্ড করাতে লাগলেন। এ সময় অনেক গানের রচয়িতা ছিলেন তাঁর বন্ধু প্রতীম কবি আব্দুল করিম।এভাবে শিল্পী আব্বাসউদ্দীন কাজী নজরুলের ইসলামী গান গেয়ে পরিচিতি পেলেন বাংলার মুসলমান সমাজে আর বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিতি পেলেন পল্লীবাংলার ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদি, ভাওয়াইয়া, চটকা ও ক্ষীরোল গান গেয়ে। পূর্ববাংলার হাটে মাঠে ঘাটে এই পল্লীগীতি ছড়িয়ে ছিল, লুকিয়ে ছিল, অনাদৃত হয়ে পড়ে ছিল। এসময় শ্রীকানাইলাল শীল স্বার্থহীন সহায়তায় শিল্পী আব্বাসউদ্দীন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই হারানো মানিক উদ্ধারের কাজ করেছিলেন সব ধরণের পল্লীগীতির সংগ্রহ ও সেগুলোর রেকর্ডের মাধ্যমে।তবে লোকসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে শুধু নিজ দেশে নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান কম নয়। বিশ্ব লোকসঙ্গীত সম্মেলনে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং সেটাকে বিশ্ব শিল্প-সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আব্বাসউদ্দীনের অবদান ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
ধ্রুপদীসঙ্গীত ও আব্বাসউদ্দীন
এর মাঝে কিছু সময়ের জন্য আব্বাসউদ্দীন কাজী নজরুল ইসলামের প্রেরণায় ঠুমরীর বাদশাহ ওস্তাদ জমীর উদ্দীন খাঁ’র কাছে ধ্রুপদীসঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেছিলেন। এসময় আব্বাসের কন্ঠে রেকর্ড করা কবি গোলাম মোস্তফা’র লেখা ও জমীর খাঁ সাহেবের দেয়া অপূর্ব সুর মহিমায় সৃষ্ট দু’টি বাংলা ভাষার ধ্রুপদীসুর ভিত্তিক গান – ‘ফিরে চাও বারেক ফিরে চাও, হে নিঠুর প্রিয়া’ ও ‘সে তো মোর পানে কভু ফিরে চাহে হায়’ অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
কলকাতার রেডিও
কলকাতার রেডিওতে ইসলাম ধর্মের গৌরবময় ইতিহাস ও বীরত্বগাঁথা নিয়ে জীবন্তিকা পরিচালনা ও প্রচারের মাধ্যমে সে সময়কার পশ্চাদপদ নিরস মুসলমান সমাজকে জাগ্রত করতে আব্বাসউদ্দীনের অবদান ছিল অপরিসীম।
নাটক ও সিনেমাতেও আব্বাসউদ্দীন
আব্বাসউদ্দীন বাংলার নটসূর্য শিশির ভাদুড়ীর বেশ কিছু নাটকে গাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তুলসী লাহিড়ীর ‘ঠিকাদার’ ছবিতে অবতীর্ণ কুলির ভূমিকায়। অংশ নিয়েছিলেন ‘বিষ্ণুমায়া’, ‘মহানিশা’, ‘একটি কথা’র মত আরও কিছু সিনেমাতেও।
পূর্ব বাংলায় নবজাগরণের ছোঁয়া
কাজী নজরুল ও আব্বাসউদ্দীনের প্রচেষ্টা ও অভিযানে তৎকালের সারা পূর্ব বাংলা অর্থাৎ এখনকার বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে শিল্প-সাংস্কৃতিক চর্চা শুরু হয়েছিল। সেসময়কার মুসলমান সমাজ শিক্ষিত হয়েও ধর্মীয় গোঁড়ামীভিত্তিক চিন্তা-ভাবনার বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল যা কিনা তাদেরকে আধুনিক ও উদার চিন্তা-চেতনা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছিল। নজরুল ও আব্বাসের সম্মিলিত প্রয়াসে সৃষ্ট গান ও সুর বাংলাদেশের মুসলমান সমাজকে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। গান রেকর্ডের পাশাপাশি মুসলমানদের নবজাগরণের লক্ষ্যে বাংলার পথে পথে জেলায় জেলায় ঘুরে ঘুরে তাঁরা দু’জন যুব সভা ও সম্মেলনের আয়োজন করতে লাগলেন যেখানে কবি নজরুল নওযোয়ানদের উদ্দ্যেশে শিক্ষার বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা, অন্ধ-বিশ্বাস দূর করে উদার বিশ্বাস বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা, মানসম্মত বিনোদন ও শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা তথা একটি নতুন জাতীয়তাবোধ জাগ্রতমূলক বক্তব্য প্রদান করতেন ও শিল্পী আব্বাস সভা গায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। এ ধরণের অনুষ্ঠানে ব্যপক সারা এসেছিল।
ছাত্রদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ঈদ বা পূজা উপলক্ষ্যে জলসা, দাতব্য অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে নজরুল-আব্বাসের নামে কিশোর-যুবা-বৃদ্ধ সকল শ্রেণীর মানুষের ঢল নামত।বাংলাদেশের কীর্তিমান সন্তান আব্বাসউদ্দীন তাঁর জীবনে বহু পুরষ্কার ও সম্মানে ভূষিত হলেও সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ পান ১৯৮১ সালে তাঁর প্রয়াণের প্রায় বিশ বছর পর, মৃত্যুবরণ করেন ১৯৫৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আব্বাসের শরীর মিশে গেছে বাংলাদেশের মাটির সাথে কিন্তু আব্বাস বেঁচে আছেন তাঁর মহিমাময় কীর্তির মাধ্যমে, বাংলাদেশের লোকসুরের মাধ্যমে। তাঁর তুলে ধরা লোকসুর বাংলাদেশের মানুষকে সবসময় নিয়ে যায় মাটির কাছে, প্রাণের কাছে, বহু বছর পরও নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেয় তাঁদের মূল শিকড়ের সাথে।তথ্যসূত্র : ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পীজীবনের কথা’- আব্বাসউদ্দীন আহমদ, সম্পাদনা – মুস্তাফা জামান আব্বাসী, প্রকাশক – প্রথমা প্রকাশন।
লেখক : শামসুন নাহার রূপা