১৯৪২ সাল। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছে। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বড় ভাই শেখ হাবিব আলী আব্দুল আলীমকে নিয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে। আব্দুল আলীমের অজ্ঞাতে বড় ভাই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কাছে তাঁর নাম দিয়েছিলেন গান গাইবার জন্য। এক সময় মঞ্চ থেকে আবদুল আলীমের নাম ঘোষণা করা হলো। শিল্পী ধীর পায়ে মঞ্চে এসে গান ধরলেন, ‘সদা মন চাহে মদিনা যাবো।’ মঞ্চে বসে আবদুল আলীমের গান শুনে শেরে বাংলা শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। কিশোর আলীমকে জড়িয়ে নিলেন তাঁর বুকে। উৎসাহ দিলেন, দোয়া করলেন এবং তখনই বাজারে গিয়ে পাজামা, পাঞ্জাবী, জুতা, পুটি, মোজা সব কিনে দিলেন। এরপর একদিন গীতিকার মোঃ সুলতান কলকাতায় মেগাফোন কোম্পানীতে নিয়ে গেলেন আবদুল আলীমকে। সেখানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। কবি নজরুল শিল্পীর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে রেকর্ড কোম্পানীর ট্রেনার ধীরেন দাসকে আবদুল আলীমের গান রেকর্ড করার নির্দেশ দিলেন। ১৯৪৩ সালে মোঃ সুলতান রচিত দু’টি ইসলামী গান আবদুল আলীম রেকর্ড করলেন। গান দু’টি হলো- (১) ‘আফতাব ঐ বসলো পাটে আঁধার এলো ছেয়ে ও চল ফিরে চল মা হালিমা আছেরে পথ চেয়ে।’ (২) ‘তোর মোস্তফাকে দেনা মাগো, সঙ্গেলয়ে যাই, মোদের সাথে মেষ চারণে ময়দানে ভয় নাই।’
বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের ইতিহাসে আবদুল আলীম এক অবিস্মরণীয় নাম। কণ্ঠস্বরের অসাধারণ ঐশ্বর্য্য নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন এবং সেক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দী দরাজ কণ্ঠের অধিকারী আব্দুল আলীম যখন গান গাইতেন, তখন মনে হতো পদ্মা মেঘনার ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে শ্রোতার বুকের তটভূমিতে। মানুষের মনের কথা, প্রাণের সাথে প্রাণ মিলিয়ে যে গানের সুর আবদুল আলীমের কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হতো, তা শুধু এই বাংলা ভাষাভাষীদের মনেই নয়; বিশ্বের সকল সুর রসিক যারা, বাংলা ভাষা জানেননা- তাদেরও আপ্লুত করতো।
প্রতিভাধর এই শিল্পী ১৯৩১ সালের ২৭শে জুলাই পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শেখ মোঃ ইউসুফ আলী। শিল্পীর বয়স যখন ১০/১১ বছর তখন তাঁর এক সম্পর্কিত চাচা গ্রামের বাড়ীতে কলের গান (গ্রামোফোন) নিয়ে আসেন। তিনি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ বরকত তাঁর সহপাঠী। প্রায় প্রতিদিনই তিনি চাচার বাড়ীতে গিয়ে গান শুনতেন। পড়াশোনার জন্য গ্রামের স্কুল তাঁকে বেশী দিন ধরে রাখতে পারেনি। তাই কিশোর বয়সেই শুরু করলেন সঙ্গীতচর্চা। আবদুল আলীমের নিজ গ্রামেরই সঙ্গীত শিক্ষক সৈয়দ গোলাম ওলীর কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। ওস্তাদ তাঁর ধারণ ক্ষমতা নিরীক্ষা করে খুবই আশান্বিত হলেন। গ্রামের লোক আবদুল আলীমের গান শুনে মুগ্ধ হতো। পালা-পার্বনে তাঁর ডাক পড়তো। আবদুল আলীম গান গেয়ে আসর মাতিয়ে তুলতেন। সৈয়দ গোলাম ওলী আবদুল আলীমকে কোলকাতায় নিয়ে গেলেন। কিছুদিন কলকাতা থাকার পর তাঁর মন ছুটলো ছায়াঘন পল্লীগ্রাম তালিবপুরে। কিন্তু ওখানে গান শেখার সুযোগ কোথায়? তাই বড় ভাই শেখ হাবিব আলী একরকম ধরে বেঁধেই আবার কলকাতা নিয়ে গেলেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের একমাস পূর্বে আবদুল আলীম কলকাতা ছেড়ে গ্রামের বাড়ীতে চলে এলেন। ঐ বছরেই ডিসেম্বর মাসে ঢাকা এলেন। পরের বছর ঢাকা বেতারে অডিশন দিলেন। অডিশনে পাশ করলেন। ১৯৪৮ সালের আগষ্ট মাসের ৯ তারিখে তিনি বেতারে প্রথম গাইলেন, ‘ও মুর্শিদ পথ দেখাইয়া দাও।’ গানটির গীতিকার ও সুরকার – মমতাজ আলী খান। এরপর পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের সাথে আবদুল আলীমের পরিচয় হয়। কবি জসীম উদ্দিন তাঁকে পাঠালেন জিন্দাবাহার ২য় লেনের ৪১ নম্বর বাড়ীতে। একসময় দেশের বরেণ্য সঙ্গীত গুণী শিল্পীরা এখানে থাকতেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ মমতাজ আলী খানের কাছে তালিম গ্রহণ করেন। মমতাজ আলী খান আবদুল আলীমকে পল্লী গানের জগতে নিয়ে এলেন। পরবর্তীতে তিনি কানাই শীলের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন। এদেশের পল্লীগান হলো মাটির গান। পল্লীর কাদা মাটির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা শিল্পী আবদুল আলীম মাটির গানকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিলেন। এর আগে তিনি ইসলামী গানসহ প্রায় সব ধরনের গান গাইতেন। গান শেখার ক্ষেত্রে আর যাঁরা তাঁকে সব সময় সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছেন- তাঁদের মধ্যে বেদার উদ্দিন আহমেদ, আবদুল লতিফ, শমশের আলী, হাসান আলী খান, মোঃ ওসমান খান, আবদুল হালিম চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লোকসঙ্গীতের অমর কণ্ঠশিল্পী মরহুম আব্বাস উদ্দিনের পরামর্শক্রমে তিনি ওস্তাদ মোঃ হোসেন খসরুর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম গ্রহণ করেন। তিনি পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে বেশ কিছুদিন চাকুরীও করেন।
১৯৫১-৫৩ সালে আবদুল আলীম কলকাতায় বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলনে গান গেয়ে বিদেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এ সময় পল্লী গানের জগতে শিল্পীর সুখ্যাতি শীর্ষচূড়ায়। তিনি ১৯৬২ সালে বার্মায় অনুষ্ঠিত ত্রক্ষীয় সঙ্গীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। বার্মায় তখন অনেকদিন যাবৎ ভীষণ খরা চলছে। গরমে মানুষের প্রাণ বড়ই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আকাশে খন্ড খন্ড মেঘের আনাগোনা। শিল্পী অন্যান্যদের সাথে মঞ্চে উঠলেন গান গাইতে। গান ধরলেন- ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে।’ কি আশ্চর্য! গান শেষ হতেই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। অনুষ্ঠানে বার্মার জনৈক মন্ত্রী বললেন, ‘আবদুল আলীম আমাদের জন্য বৃষ্টি সাথে করে এনেছেন।’ তখন থেকেই শিল্পী বার্মার জনগণের নয়ন মণি হয়ে আছেন। সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে তিনি ১৯৬৩ সালে রাশিয়া এবং ১৯৬৬ সালে চীন সফর করেন। এই দুটি দেশে তিনি পল্লীগান পরিবেশন করে দেশের জন্য প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করেন। বিদেশে বাংলাদেশের পল্লীগানের মান বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে আবদুল আলীমের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বেতার ও টেলিভিশন ছাড়াও অসংখ্য ছায়াছবিতে গান করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এ কণ্ঠ দেন। এছাড়া ‘আজান’, ‘রূপবান’, ‘জোয়ার এলো’, ‘শীত বিকেল’, ‘এদেশ তোমার আমার’, ‘কাগজের নৌকা’, ন’বাব সিরাউদ্দৌলা’ (বাংলা ও উর্দু), ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘দস্যুরাণী’, ‘সুজন সখি’ প্রভৃতি অসংখ্য ছবিতে কণ্ঠ দেন।
১৯৬০ সালে গ্রামোফোন কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁর প্রথম গান ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না’ ও ‘অসময় বাঁশী বাজায়’ এবং পরবর্তীতে ‘হলুদিয়া পাখী’, ‘দুয়রে আইসাছে পাখি’, ‘নাইয়ারে নায়ে বাদাম তুইলা’, ‘এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া’, ‘পরের জাগা পরের জমিন’ প্রভৃতি গান অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি দেশের প্রথিতযশা গীতিকার ও সুরকারদের গান গেয়েছেন, তাদের মধ্যে লালনশাহ, হাসন রাজা, জসীমউদ্দিন, আবদুল লতিফ, মমতাজ আলী খান, শমশের আলী, সিরাজুল ইসলাম, কানাইশীল, মন মোহন দত্ত প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ পর্যন্ত তাঁর প্রায় ৫০০ গান রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া বেতারে স্টুডিও রেকর্ডে ও প্রচুর গান আছে। বাংলাদেশ গ্রামোফোন কোম্পানী (ঢাকা রেকর্ড) শিল্পীর একখানা লংপ্লে রেকর্ড বের করেছে।
তিনি জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেন। এরমধ্যে একুশে পাদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার ও স্বাধীনতা পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। তিনি সঙ্গীত কলেজের লোকসঙ্গীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ছিলেন। তিনি অনেক ছাত্র/ছাত্রীকে গান শিখিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মোঃ আবদুল হাশেম (অধ্যাপক, বেতার, টিভি শিল্পী বাংলা বিভাগ, কবীর হাট কলেজ), ইন্দ্রমোহন রাজবংশী (বেতার, টেলিভিশনের কণ্ঠশিল্পী), আবদুল করিম খান (বেতার ও টেলিভিশনের কন্ঠ শিল্পী), মোশতাক তালুকদার ( বেতার ও টেলিভিশনের কন্ঠ শিল্পী), শহীদুজ্জামান ও রুকশানা হক প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
তাঁর ৪ মেয়ে ও ৩ ছেলে। তাঁরা হলেন- আকতার জাবান আলীম, জহির আলীম, আসিয়া আলীম, আজগর আলীম, হায়দার আলীম) নূরজাহান আলীম ও জোহরা আলীম। আবদুল আলীম শুধু পল্লীগানের শিল্পী ছিলেন না, লোক সংস্কৃতির মুখপাত্রও ছিলেন। পল্লীগানের যে ধারা তিনি প্রবর্তন করে গেছেন সেই ধারাই এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের গান গ্রাম বাংলাকে সুরের আবেশে মাতোয়ারা করে তুলেছিল। তাঁর কণ্ঠে ভাটিয়ালীর সুর যেন মাঝির মনের বেদনার কথা বলতো। বাউল গান শুনে বৈরাগীরা থমকে দাঁড়াতো। মারফতী আর মুর্শিদীর সুরে তাঁর বিনয় নম্র ভক্তি নিবেদন ঝরে পড়তো। পাল্লীগানের জগতে তিনি এক আদর্শ গায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
আজ আকাশ সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতিকে গ্রাস করতে চলেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের পল্লীসংগীত যথাযথভাবে পৌঁছাতে না পারলে আমাদের সংস্কৃতিতে যে দৈন্য আসবে তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। তাই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে না পারলে আমরা পৃথিবীর সংস্কৃতির মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবো। তাই আবদুল আলীমের বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও গ্রামোফোন রেকর্ডে গাওয়া গানগুলো সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। তাঁর গানগুলো সংরক্ষণ করতে না পারলে আমাদের পল্লীগানের ভান্ডার শূন্য হয়ে যাবে এবং নতুন প্রজন্ম তাঁর এই ধারা অনুসরণ করা থেকে বঞ্চিত হবে। পল্লীগানের এই কালজয়ী শিল্পী, ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মাত্র ৪৩ বৎসর বয়সে পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ আবদুল আলীম নেই। কিন্তু আছে তাঁর গান। কিন্তু তাঁর গানের মাঝে তিনি সঙ্গীত পিপাসু জনগণ- তথা পল্লীগ্রামের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।
লেখক: জহীর আলীম (আবদুল আলীমের ছেলে)