ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ঠিক দশ বছর পরের পুরোনো ঢাকা। ঐতিহাসিক সেই ঢাকার পুরোনো ঐতিহ্য তখনো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। লালবাগের কেল্লা, চকবাজার, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, খান মোহাম্মদ মসজিদের ঐতিহ্যে লালিত ঢাকার এই অংশের ব্যস্ততা ও জীবনযাত্রা ছিলো নতুন ঢাকার জীবনযাত্রা থেকে আলাদা (তত্কালীন সময়ে ধানমন্ডি সংলগ্ন অঞ্চলকে নতুন ঢাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো)। পঞ্চাশের দশকের পুরনো ঢাকার ঐতিহ্য আজকের মতো এতটা ফিকে ছিলোনা। ঐতিহাসিক ভবনগুলো মাটিতে গুড়িয়ে দিয়ে তখনো পযর্ন্ত ঢাকায় এতো বাণিজ্যিক ভবন ও মার্কেট গড়ে উঠেনি। ১৯৫৭ সালে সেই পুরোনো ঢাকার লালবাগের উর্দু রোডে জন্ম হয় বাংলাদেশের অন্যতম চলচ্চিত্রকার বিশেষভাবে বলতে গেলে সুস্থধারার প্রথম দিককার চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলামের। একটি রক্ষণশীল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাশক্তির বলে তিনি আজকে একজন সফল এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন ।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
বাবা খোরশেদুল ইসলাম ছিলেন হেকিম। ইউনানী শাস্ত্রে তাঁর যথেষ্ট পান্ডিত্য ছিল। তিনি ভারতের লক্ষ্ণৌতে ইউনানী শাস্ত্রের উপর লেখাপড়া করেছিলেন এবং তত্কালীন সময়ে পুর্ব পাকিস্তানে এ পেশায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। শুধু তাই নয় তিনি তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ইউনানী কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। চার ভাই ছয় বোন অর্থাত্ দশ ভাই বোনের মধ্যে মোরশেদুল ইসলাম ছিলেন সবার ছোট। উল্লেখ্য যে, মোরশেদুল ইসলাম তাঁর বাবাকে দেখেননি। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে খোরশেদুল ইসলামের মৃত্যু হয়। বাবা যখন মারা যান তখন মোরশেদুল ইসলাম তাঁর মার গর্ভে। শৈশবকাল, শিক্ষাকর্ম ও পারিবারিক জীবন ঢাকাতে কাটলেও তাঁর আদি নিবাস কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার চিনাইর গ্রামে। এখানে তাঁদের আদিপুরুষের বসবাস কতকাল আগে থেকে ছিল তা তিনি মনে করতে পারেননি। মোরশেদুল ইসলামের চার ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই হাকিম হাফেজ আজিজুল ইসলাম তাঁর বাবার পেশাকেই নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনিই পরিবারের হাল ধরেন। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার হলেও মোরশেদুল ইসলামের সব ভাই বোনই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। বড় ভাই হাকিম হাফেজ আজিজুল ইসলাম ইউনানী চিকিত্সাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং তিনি এই চিকিত্সা পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিলেন। সেই সময়ে এই চিকিত্সা পদ্ধতি অশিক্ষিত লোকদের দিয়েই পরিচালিত হতো। হাকিম হাফেজ আজিজুল ইসলাম ইউনানী চিকিত্সাকে বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন ইউনানী চিকিত্সা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইউনানী বিষয়ক সেমিনারে আমন্ত্রিত হতেন। মেজোভাই আনোয়ারুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। তিনি ছাত্র হিসেবে খুবই মেধাবী ছিলেন এবং অনার্স-মাস্টার্সে রেকর্ড সংখ্যক মার্কস নিয়ে পাশ করেন। তিনি স্কলারশিপ নিয়ে কানাডা থেকে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রী অর্জন করেন। সেজোভাই এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম আইন ও রাজনীতির সাথে জড়িত। মোরশেদুল ইসলামের ছয় বোনই উচ্চশিক্ষিত। এই দশ ভাইবোনের সবাইকে প্রচন্ড অর্থকষ্টের মধ্যে লেখাপড়া শেষ করতে হয়েছে আর আজ তাঁরা সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
শৈশবকাল
মোরশেদুল ইসলামের শৈশব কেটেছে পুরোনো ঢাকার ঐতিহাসিক পরিবেশে। তিনি বাবাকে কখনো দেখেননি। বলতে গেলে তাঁর বড় ভাই হাফেজ হাকিম আজিজুল ইসলামই তাঁর বাবার অভাব পূরণ করেন। মোরশেদুল ইসলামের বাবা যখন মারা যান তখন তাঁর বড় ভাই ছাত্র ছিলেন এবং ঐ অবস্থাতেই সংসারের হাল ধরেন। তিনি উর্দু রোডে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত চেম্বারে বসতেন। সুতরাং শৈশব থেকেই মোরশেদুল ইসলাম তাঁর বড়ভাইকে সংসারের কর্তা হিসেবে দেখেছেন। ছোটবেলা থেকেই মোরশেদুল ইসলাম ছিলেন আত্মকেন্দ্রিক এবং জেদী প্রকৃতির। আর দশটি শিশুর সঙ্গে মোরশেদুলের কোন তুলনা চলতো না। তাঁর সব বন্ধুরাই ছিল পুরানো ঢাকার আদি বাসিন্দা যারা ঢাকাইয়া কুট্টি নামে পরিচিত। ছোট্ট মোর্শেদ খুবই চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন। তিনি খুব সহজে নিজেকে প্রকাশ করতেন না। এজন্য শৈশবে তাঁকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে।
শৈশবের অনেক স্মৃতি থাকলেও সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর মনে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার চিনাইল গ্রামের কথা যেখানে তিনি বহুবার গিয়েছেন। যতদূর মনে পড়ে প্রথম তাঁর গ্রাম দর্শন হয় মার সাথে। গাঁয়ের প্রতিটি স্মৃতিই ছিলো তাঁর কাছে অত্যন্ত আনন্দের। বছরে অন্তত দুবার তাঁদের গাঁয়ে যেতে হতো এবং একমাস কিংবা তাঁর কিছু বেশি দিন সেখানে থাকতে হতো। শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে এখনো তিনি আবেগাক্রান্ত হয়ে পরেন। শৈশবে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কারণটা তিনি তখনই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাঁর গ্রামে যাওয়াটা যে নিছক বেড়ানোর বা ছুটি কাটানোর জন্য নয় এই সত্যটি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আসলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার এই গ্রামটি ছিল তাদের পুরনো ঢাকার এতবড় সংসারের অর্থ যোগানের একটি বড় উত্স। এতকিছুর পরেও বছরে দু-একবার করে গ্রামে যাওয়া তাঁর শৈশবজীবনে একটি ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছিল। কারণ পুরানো ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে শীতকালের কুয়াশা ঢাকা বিস্তৃত প্রান্তরের দৃশ্য তাঁর মনে অন্য ধরনের প্রশান্তি এনে দিতো। শৈশবেই এই পার্থক্য বোঝার সুযোগ সব শিশুর হয় না। তিনি কখনো গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলার সুযোগ হাতছাড়া করেননি। মাঝে মাঝে ছোট্ট মোর্শেদ একাই চলে যেতেন গ্রামের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেল লাইনের কাছে। সেখান আনমনে স্লিপারের উপর দিয়ে হাঁটতেন। কখনো কখনো সঙ্গী হতো তাঁর মামাত ভাই। শীতের পিঠা খাবার সময়টা শিশু মোর্শেদের খুবই আনন্দের সময় ছিলো। চাচাদের ছিল যৌথ পরিবার আর এই পরিবারেও মোরশেদুল ইসলাম যথেষ্ট আদর পেতেন। পরিণত মোরশেদুল ইসলাম আজো সেই গ্রামের স্মৃতিকে এড়াতে পারেন না। আর তাই এখনো মাঝে মধ্যেই চলে যান সেই প্রত্যন্ত গ্রামে।
শৈশব থেকেই শুরু
সেই পঞ্চাশের দশকে পুরনো ঢাকার বাড়ির রকম-সকমই ছিল আলাদা। বিশাল বাড়ি, মাঝে উঠোন। একেকটি বাড়িতে দু-চারটা কিংবা তারও বেশী পরিবার অনায়াসে বাস করতে পারত। মোরশেদুল ইসলামদের বাড়িটাও ছিল ঠিক সেরকমই। শৈশব থেকেই মোরশেদুল ইসলামের নির্দেশনা ও অভিনয়ের প্রতি অন্যরকম আগ্রহ কাজ করত। যদিও নির্দেশনা শব্দটির মধ্যে একটি পরিণত বা বয়স্কভাব আছে কিন্তু ছোট্ট মোরশেদুল যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই তাঁর প্রতিভার প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করেননি। শৈশব থেকেই তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। অর্থাত্ একটি স্কুল পড়ুয়া ছেলের জন্য অভিনয়, স্কুলের নাটক মঞ্চস্থ করা সহ আর যা যা সম্ভব তিনি তার সব কিছুই করেছেন। তাঁর বড় ভাইয়ের (মোরশেদুল ইসলামের চেয়ে প্রায় ২৫ বছরের বড়) ছিল ছয় মেয়ে যার ফলে শৈশবে মোরশেদুল হাতের নাগালেই একটি রেডিমেড নাট্যদল পেয়ে যান। মোর্শেদের মেজো বোন থাকতেন করাচীতে। তার স্বামী ১৯৫৮ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তিনিও ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হন। সেজো বোনের ছিল দুই ছেলে দুই মেয়ে। সুতরাং ছোট্ট মোর্শেদকে একটি দল করতে বেশি দূর যেতে হয়নি।
সন্ধ্যা নেমে এলে মোর্শেদ নিজেই ঘরোয়া পরিবেশে তাঁর বিশেষ দর্শকদের জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতেন। তা হলো একটি বাক্সের মধ্যে বিভিন্ন খবরের কাগজ থেকে আঁকা ছবি সংগ্রহ করে বাইস্কোপের ব্যবস্থা করতেন। এখান থেকেই সাত-আট বছরের ছোট্ট মোরশেদুল ইসলামের মধ্যে ছবি তৈরির ইচ্ছাটা চলে আসে। এছাড়া প্রায়ই বাসাতে নাটক মঞ্চস্থ করতেন। বাসার বড় খাটটা হোত স্টেজ আর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন সেই নাটকের দর্শক। মোর্শেদের সেজভাই এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭২ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসলে যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র (তখনো মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র জমা দেওয়া হয়নি) দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নাটকগুলো মঞ্চস্থ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মোর্শেদের বয়স ছিল ১৪ বছর। স্বাধীনতা যুদ্ধ কিশোর মোর্শেদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর পরিবার ছিল রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার এবং মোরশেদুল ইসলামের বড় ভাই হাকিম আজিজুল ইসলাম (যিনি তখন পরিবারের প্রধান পুরুষ) যুদ্ধের ব্যাপারটায় অনেকটাই নির্লিপ্ত ছিলেন। আর তাই কিশোর মোর্শেদ একেবারে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছিলেন। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে মোরশেদুল ইসলামের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে এবং ছোট্ট মোর্শেদকে এই মহান আন্দোলন থেকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
শিক্ষা জীবন
তত্কালীন পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন মোরশেদুল ইসলামের শিক্ষাজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। শৈশবে তেমন কিছু না বুঝলেও কৈশোরে তিনি এই মহান আন্দোলনকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। শিক্ষাজীবনের শুরুতে মোরশেদুল ইসলাম প্রথম ভর্তি হন পুরনো ঢাকার চাঁদনীঘাট এলাকার একটি অখ্যাত প্রাইমারি স্কুলে। এরপর তিনি ভর্তি হন এক সময়ের বিখ্যাত নবকুমার ইনস্টিটিউশনে। এখানে তিনি ক্লাস সেভেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ক্লাস এইটে গিয়ে ভর্তি হন ওয়েস্টার্ন হাইস্কুলে। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। মোরশেদুল ইসলামের পরিবারের ভিত্তি ছিল শিক্ষা। তাঁর বাবার মৃত্যুর পর বড় ভাই ছোট নয় ভাই-বোনের লেখাপড়ার প্রতি সচেতন হন। কিন্তু এই পরিবারটি ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত ছিল। কারণ বাবার অকাল মৃত্যুতে পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয় বড় ভাই হাফেজ আজিজুল ইসলামকে। এছাড়া অর্থের মোটামুটি যোগান আসত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিনাইর গ্রামের জমি থেকে। এভাবেই খুব কষ্ট করে এই পরিবারকে পড়াশুনার মতো ব্যয়বহুল কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছে। আরেকটি বিষয়, এই পরিবারটি ছিল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। এই ধরণের পরিবারে মাদ্রাসা কেন্দ্রিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ থাকে। কিন্তু মোরশেদুল ইসলামের বড় ভাই-এর যথেষ্ট উদার ও আধুনিক মানসিকতার জন্য ভাই বোন সবাই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পেরেছিলেন। এমনকি বোনদের মধ্যে সকলে কলেজে লেখাপড়া সম্পন্ন করলেও বড় বোনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (যেখানে ছেলে মেয়েদের একসাথে পড়াশুনার প্রশ্ন থেকে যায়) পড়ালেখা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের জন্য এটি একটি বিপ্লবের মতো। ১৯৭৪ সালে মোরশেদুল ইসলাম ম্যাট্রিক (এস.এস.সি.) পাস করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বড় ভাই-এর ছয় মেয়ে প্রত্যেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে এবং আজ তারা প্রকৌশল, প্রশাসন ও অধ্যাপনার মতো সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত। সুতরাং মোরশেদুল ইসলামের বড়ভাই হাকিম হাফেজ (শেষ বয়স পর্যন্ত তিনি রমজান মাসে তারাবীর নামাজ পড়িয়েছেন এবং তিনি ২০০৫ সালে মারা যান) আজিজুল ইসলাম যথেষ্ট আধুনিক মানসিকতার অধিকারী ছিলেন এবং মোরশেদুল ইসলামের শিক্ষা ও কর্মজীবনে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
মোরশেদুল ইসলামের জন্ম ১৯৫৭ সালে। তিনি যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন তখন ‘৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গিয়েছে। সুতরাং ভাষা আন্দোলন তাঁর ওপর খুব বেশী প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তিনি যখন নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিলেন তখন সেই স্কুলের ছাত্র ছিলেন শহীদ মতিউর। সেদিনের কথা মোরশেদুল ইসলামের আজও মনে আছে। স্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছিল। হঠাত্ খবর আসে দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর শহীদ হয়েছেন। এই খবর পাওয়ার সাথে সাথে স্কুল ছুটি হয়ে যায়। এই ঘটনাটি শিশু মোর্শেদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিলো৷
শৈশব ও ১৯৭১
১৯৭০ সাল, উত্তাল পূর্ব পাকিস্তান। আন্দোলনের উত্তাপ কিশোর মোর্শেদ একেবারে এড়িয়ে যেতে পারেননি। স্কুল ছুটির পর বা মাঝে মাঝে ঝুঁকি নিয়েই চলে যেতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় (যা আন্দোলনের মূলকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল)। তিনি প্রায় প্রতিদিন দল বেঁধে এবং অধিকাংশ সময়ে একাই মিছিল মিটিং-এ যোগ দিতেন। ১৯৭০ সালের শেষে তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের দেয়া কার্ফ্যু ভেঙ্গে একটি মিছিল হয়েছিল যা শুরু হয়েছিল পলাশীর মোড় থেকে এবং মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে কোন মুহূর্তে গুলি হতে পারে কিন্তু মোর্শেদ ভয় পাননি। প্রায়ই পায়ে হেটে খুঁজে বেড়াতেন কোথায় মিছিল মিটিং হচ্ছে। ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়া মোর্শেদ তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের শোষণ নির্যাতন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এরপরেই এল ১৯৭১। মোরশেদুল ইসলামের সেজো ভাই যুদ্ধে অংশ নিলেন এবং ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ (পেট্রল পাম্প ও পাওয়ার হাউজ) অপারেশনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত স্টেনগান, গ্রেনেড ইত্যাদি বাসাতেই লুকিয়ে রাখা হতো এবং এই অস্ত্র ভান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন মোর্শেদ ও তাঁর বড় বোন। কখনো তাঁরা এই সব অস্ত্র ছাদের উপরে লুকিয়ে রাখতেন। তবে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান ছিল তাদের বাসার একটি গলি। গলির ভেতরে একটি ইটের স্তুপ ছিল। সেই স্তুপের নিচে মাটি খুড়ে গ্রেনেড লুকিয়ে রাখতেন। পরে প্রয়োজনের সময় বের করতেন। একবার অল্পের জন্য ধরা পড়ার হাত থেকে রক্ষা পান। তাঁর সেজভাই তখন ডা. মোস্তফা জালাল সাহেবের বাসায় আলোচনায় ব্যস্ত। মিটিং-এ পরবর্তী অপারেশনের পরিকল্পনা চলছে। হঠাত্ পাকিস্তানী আর্মি কিভাবে যেন খবর পেয়ে যায়। তারা সাদা পোশাকে পুরো বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। এটা টের পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সবাই দেয়াল টপকে পালিয়ে যায় এবং পরে সবাই মোরশেদুল ইসলামের বাড়িতে আসেন। তাঁরা এসে বলেন যে তারা যেখানে মিটিং করছিলেন সেখানে একটি জুতার বাক্সে ভুলে তিনটি গ্রেনেড রেখে এসেছেন। আর্মি যদি ওটা পেয়ে যায় তবে বাসার কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না। শেষ পর্যন্ত ১৩ বছর বয়সী কিশোর মোর্শেদের ওপর দায়িত্ব পড়ে সেটি উদ্ধারের। মোরশেদুল ইসলাম মোস্তফা জালালের বাসায় গেলেন সেই জুতার বাক্সের খোঁজে। এক সময় পেয়েও গেলেন বাক্সটা। এই বাসা থেকে মোরশেদুল ইসলামের বাসা ছিল পাঁচ থেকে সাত মিনিটের পথ। কিন্তু এই বাক্সের কারণে তাঁকে বেশ ঘুরে আসতে হচ্ছিল। ঠিক এই সময়ে দেখা হয়ে যায় তাঁর এক বন্ধুর সাথে। সে জানতে চায় বাক্সে কি? মোর্শেদ বললেন জুতা। স্বাভাবিক ভাবেই সেই বন্ধুর জুতা দেখার আগ্রহ জন্মে এবং মোর্শেদ পড়ে যান মহাবিপদে। একসময়ে ব্যাপারটি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যে মোর্শেদ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দৌড়ে নিজেকে রক্ষা করেন এবং বাক্সটি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন। এতকিছুর পরেও শেষ রক্ষা হয়নি। পাকিস্তানি আর্মিরা ঠিকই বাড়ি তল্লাসী করে এবং মোস্তফা জালালের বড় ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা মোরশেদুল ইসলামের পুরো মনে আছে। একেবারে ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস পর্যন্ত। ২৫ মার্চের ভয়াল কালোরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। পরদিন সকালে এলাকার লোকজন সবাই মিলে মিলিটারী প্রতিরোধের জন্য ব্যারিকেড দিতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অনুসারে প্রতিটি বাড়ি যেন দূর্গের রূপ নেয়। কিন্তু পরে শোনা যায় যে আর্মিরা যেখানেই ব্যারিকেড দেখছে সেখানেই গুলি করে সব মানুষ মেরে ফেলছে। ফলে তাঁরা ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হন। অল্প বয়সের কারণে তিনি ২৫ মার্চের গণহত্যার নৃশংসতা দেখতে পারেননি। তাঁকে মহল্লার মধ্যেই থাকতে হতো। এখান থেকে তিনি বিচ্ছিন্নভাবে সাধারণ মানুষ হত্যার খবর পেতেন। ২৬শে মার্চ দেখলেন এলাকার পাশেই নয়াবাজার বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেবার দৃশ্য। মোরশেদুল ইসলামের বাড়ি থেকেই দেখা যাচ্ছিল আগুনের লেলিহান শিখা। শুনতে পাচ্ছেন মানুষের চিত্কার। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে দেখেছেন পাক হানাদারদের বর্বরতা। লিয়াকত নামে তাঁর প্রায় সমবয়সী কর্মচারীর (বড় ভাই-এর ফার্মেসিতে চাকুরী করতো) সাইকেলের সামনে বসে দুজনে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা চষে বেরিয়েছেন। বিশেষ করে পাকিস্তানী আর্মিরা যখন বিমান থেকে বোমা হামলা করে তখন বোমার ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলো দেখতে যেতেন। একবার দেখলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে কর্মচারীদের বোমার আঘাতে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া বস্তি। দেখলেন অনেক বিকৃত মৃতদেহ। মুক্তিযুদ্ধের সময়গুলো তাঁর এভাবেই কেটেছে।
প্রথম সিনেমা দেখা ও অন্যান্য ঘটনা
শৈশব ও কৈশোরের স্মরণীয় ঘটনার মধ্যে একটি ছিল সিনেমা হলে গিয়ে প্রথম সিনেমা দেখা। এটি ছিল একটি উর্দু ছবি। দেশ তখনো স্বাধীন হয়নি। মোরশেদুল ইসলামের এক ফুফাতো ভাই এলেন গ্রামের বাড়ি থেকে। তাঁকে নিয়েই প্রথম সিনেমা হলে যাওয়া, হলটি ছিলো গুলিস্তান সিনেমা হল। মজার ব্যাপার হলো এই ছবিটির কাহিনী সম্পর্কে তিনি কিছুই মনে করতে পারেন না। পুরো স্মৃতিটিই আবছা। তবে ফেরার সময় বাসে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে নামলেন এবং সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরলেন এগুলো তাঁর দিব্যি মনে আছে। এরপর ছবি দেখেন দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে। সাবিস্তান সিনেমা হলে সপরিবারে ছবি দেখতে গিয়েছিলেন। এই ছবির নামও তিনি মনে করতে পারেননি। সিনেমা চলার সময়ে একটা হট্টগোল শুরু হয় এবং কর্তৃপক্ষ ছবি বন্ধ করে দেয়। সময়টা ছিল ১৬ই ডিসেম্বরের ঠিক মাসখানেক পর। বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তান কারাগারে। তাঁরা যখন ছবি দেখছিলেন তখনই খবর আসে যে, বঙ্গবন্ধুকে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই মুক্তি দেওয়া হবে। এই খবরে সাধারণ মানুষ ছবি দেখার বদলে আনন্দ মিছিল বের করতে শুরু করে। শুধু সিনেমা হলের বাণিজ্যিক ছবি মোরশেদুল ইসলামকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। এর মাঝেই খবর পেলেন আরো ভালো ছবি দেখতে হলে ফিল্ম সোসাইটির সদস্য হতে হবে। হয়ে গেলেন ইমেজ ফিল্ম সোসাইটির সদস্য। তখনই তাঁর বেশ কিছু ভালো ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে। বেশ উপভোগ্য একটা সময় কেটেছে তখন। মজার ব্যাপার হচ্ছে মোরশেদুল ইসলামের ছবি দেখার প্রক্রিয়াটা ছিল ভিন্ন। কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা ছবি দেখে সেই ছবির হিরোর অনুকরণ করে কখনও বা বিখ্যাত অভিনেতা হবার স্বপ্ন দেখে। ইংরেজী কি বাংলা যে সিনেমাই হোক না কেনো মোরশেদুল ইসলাম দেখতেন আর ভাবতেন তিনি হলে এই ছবিটা কিভাবে বানাতেন।
ছবির পেছনে সময় ব্যয় করলেও মোরশেদুল ইসলাম লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। ঢাকা কলেজে পড়ার সময়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয় তখন তিনি ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। তাঁর স্পষ্ট মনে আছে মেজর ডালিমের ঘোষণার পরপরই পুরো ঢাকা শহর স্তব্ধ হয়ে যায়। মোরশেদুল ইসলাম প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করতে তৈরী হয়ে যান। কিন্তু তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেন যে কোন মিছিল বের হচ্ছে না, কোন প্রতিবাদ হচ্ছে না। সবাই কেমন চুপ মেরে গেছে। মোরশেদুল ইসলাম রওনা হল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। পুরনো ঢাকার বাসা থেকে ৩২ নম্বর আসেন হাঁটতে হাঁটতে এই আশায় যে পথে কোন মিছিল হলেই তাতে যোগ দেবেন। কিন্তু তাঁর আশা পূরণ হলো না। ৩২ নম্বরে গিয়ে দেখেন বঙ্গবন্ধুর বাসভবন আর্মিরা ঘিরে রেখেছে এবং কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। মন খারাপ করে ফিরে আসেন তিনি। যাই হোক এরপরের বছরই ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে ছাত্র হিসেবে মোরশেদুল ইসলাম খুবই মেধাবী ছিলেন। একজন সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আমরা সবাই তাঁকে চিনি কিন্তু তাঁর শিক্ষাজীবনের সফলতা কৃতিত্ব সম্পর্কে কতটুকু জানি। ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর পরিবারের সবাই চাপ দেন মেডিকেলে পরার জন্য। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় ভর্তি হবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন এই বিভাগটি মাত্র চালু হয়েছে। বাসা থেকে বলা হলো মেডিকেলে না হলে অবশ্যই ফার্মেসিতে ভর্তি হতে হবে। সেই সময়ে ফার্মেসি ছিল ছাত্রদের প্রথম পছন্দ। তখন ফার্মেসি বিভাগের দেয়ালে পোস্টার লাগানো থাকত ”Join Pharmacy and Fly to America”. অর্থাত্ ফার্মেসি থেকে পাশ করার পর আমেরিকা যাওয়ার নিশ্চিত ভিসা হয়ে যেত।
এরকম অবস্থায় মোরশেদুল ইসলাম মোট তিন বিষয়ে পরীক্ষা দিলেন, (১) মেডিকেল (২) সাংবাদিকতা (৩) ফার্মেসি এবং তিনটি বিষয়েই তিনি সফল হলেন। মোরশেদুল ইসলাম সিলেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের ক্লাস আগে থেকে শুরু হয়ে যাওয়ায় প্রথমে তিনি সেখানেই ক্লাস করতে আরম্ভ করেন। তিন মাস সাংবাদিকতা বিভাগে ক্লাস করার পরে মেডিকেলের রেজাল্ট বের হলো এবং তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজে চান্স পেলেন। বাসার সবাই জোর করে তাঁকে সিলেট পাঠিয়ে দিল। সিলেট মেডিকেলে ক্লাস করলেন দুই মাস। কিন্তু ঢাকার ব্যস্ততার আনন্দ তিনি কিছুতেই ভুলতে পারলেন না। এক পর্যায়ে তিনি মানসিক ভাবে খুব ভেঙ্গে পড়লেন এবং সিলেট থেকে পালিয়ে ঢাকা চলে এলেন। তাঁর এ জাতীয় কর্মকান্ডে পরিবারের সবাই মারাত্মক হতাশ হলেন। শেষে আর কি করা তাঁকে ফার্মেসিতেই ভর্তি হতে হলো। কিন্তু তাঁর এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন কিছুই তাঁর কর্মজীবনে কাজে আসেনি। ফার্মেসি পড়ার সময় একটি ঘটনা ঘটে। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম এসোসিয়েশন এন্ড আর্কাইভে তিন মাস ব্যাপী একটি ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্সের আয়োজন করেছিল। সেটার খোঁজ দিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের তত্কালীন প্রযোজক ও লিটল থিয়েটারের সভাপতি সৈয়দ সিদ্দিক হোসেন। সৈয়দ সিদ্দিক হোসেনের কাছ থেকে খবর পেয়েই মোরশেদুল ইসলাম ছুটে গেলেন। কিন্তু এখানেও বিপত্তি। মোরশেদুল ইসলাম যখন কোর্সটি করতে গেলেন তখন জানতে পারলেন এ কোর্সে আবেদন করার ন্যূনতম যোগ্যতা হচ্ছে গ্রাজুয়েশন, তিনি তখন মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। যদি থার্ড ইয়ারের ছাত্রও হতেন তাহলেও হয়তো বিবেচনা করা যেত। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর এসোসিয়েসনের ডিরেক্টর শিল্পী আব্দুল রউফ তাঁকে এ্যাডমিশন টেস্ট দেওয়ার সুযোগ দিলেন। সেটা ছিল খুব কঠিন এক পরীক্ষা। প্রথমে লিখিত তারপর মৌখিক। মৌখিক পরীক্ষায় মোরশেদুল ইসলাম আলমগীর কবীর, বাদল রহমানের মতো বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে প্রথম পরিচিত হলেন। যাই হোক সবগুলো পরীক্ষাতেই তিনি সফলভাবে উৎরে গেলেন। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ অফিসটা ছিল ধানমন্ডি শংকরে। কোর্সটি ছিল তিন মাসের। এই সময়ে আর্কাইভের অডিটোরিয়ামে মোরশেদুল ইসলাম প্রচুর ছবি দেখেছেন। ছবি নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করেছেন এবং ঠিক তখনই ফিল্ম ব্যাপারটা সত্যিকার অর্থে তিনি বুঝতে পারেন।
এর পর ৪০ জন থেকে ১৬ জনকে বাছাই করে একটি এ্যাডভান্স কোর্সের আয়োজন করা হল। এবং ঠিক করা হল এই ১৬ জনের মধ্যে থেকে ১০ জনকে বাছাই করে একটি ছবি বানানো হবে। তখন থেকে মোরশেদুল ইসলামের ছবি বানানো শুরু।
অভিনেতা মোরশেদুল ইসলাম
ছোটবেলা থেকেই মোর্শেদ শিশু সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় কঁচিকাঁচার মেলার পক্ষ থেকে নিজেই একটি নাটক লেখেন ও নির্দেশনা দেন। এই নাটকটি ব্রিটিশ কাউন্সিলে মঞ্চস্থ হয়েছিল। মোরশেদুল ইসলাম যখন ক্লাস নাইনে পড়েন তখন থেকেই এই নাট্য জীবনের শুরু হয়েছিল। ঐ একই স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র ছিলেন বিখ্যাত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। সেই সময়ে স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছুটি নামে একটি নাটকের আয়োজন করা হয়। নাটকের নির্দেশক ছিলেন বাংলার শিক্ষক মিয়া মুহম্মদ মনিরুজ্জামান। স্কুল ঘরেই নাটকের মহড়া চলছিল। মোরশেদুল ইসলাম প্রতিদিন মহড়া দেখতেন। নাটকের ফটিক চরিত্রে একটি ছেলেকে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু সে ঠিকমতো অভিনয় পারছিল না। তখনই মোরশেদুল ইসলাম সুযোগ পেয়ে গেলেন এবং অভিনয়ে বেশ সফলতার পরিচয় দিলেন। কলেজে পড়ার সময় আরেকটি নাটকে তিনি অভিনয় করেছিলেন। নাটকটির নাম ছিল ‘মায়া কানন’। সেই নাটকে তিনি রাজা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই নাটকে অভিনয় করে মোরশেদুল ইসলাম খুব প্রশংসিত হয়েছিলেন। কিন্তু নাটকটি যখন টেলিভিশনের জন্য করা হয় তখন কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়। ‘মায়া কানন’ নাটকটির প্রযোজক ছিলেন দুজন। মঞ্চে অভিনয় করলেন মোরশেদুল ইসলাম, বিটিভিতে রেকর্ডিং এর আগে রিহার্সেলেও ছিলেন তিনি কিন্তু রেকর্ডিং এর সময় দুজন প্রযোজকের মধ্যে একজন প্রযোজক মোরশেদুল ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য একটি ছেলেকে সুযোগ করে দেন। ঘটনাটি তাঁকে প্রচন্ড আঘাত দিলেও তিনি এর কোন প্রতিবাদ করেননি। ষোল বছর বয়সের মোরশেদুল ঠিক করলেন অভিনয় আর নয়। এভাবেই সমাপ্তি হয় মোরশেদুল ইসলামের অভিনয় জীবন। সেই সময়েই সংকল্প করলেন তিনি একটি সংগঠন করবেন এবং এই ধরনের স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না। এরপরই ‘লিটল থিয়েটার’ নামে বাংলাদেশের অন্যতম শিশু সংগঠনের জন্ম
কর্মজীবন
মোরশেদুল ইসলামের ছাত্রজীবনে এমন অনেক কিছুই করেছেন যা একজন মানুষ ছাত্র জীবন শেষ করে শুরু করে। তিনি ছাত্রজীবনে একাধিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু পড়াশুনাকে কখনোই অবহেলা করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ থেকে যথাসময়ে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। কিন্তু ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ‘মায়া কানন’ নাটক থেকে বাদ পড়ার ঘটনাটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার পর তাঁরা নিজেরাই একটি নাটকের দল করলেন। বাচ্চাদের নিয়ে নাটকের দল নাম ‘ঢাকা লিটল থিয়েটার’। ড. সিরাজুল হোসেন চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ড. নাজমা হোসেন চৌধুরীর সহযোগিতায় গড়ে ওঠে এই নাট্য সংগঠনটি। তাঁরা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। তাঁদের বাসাতেই নাটকের মহড়া হোত। নাজমা আপা (ড. নাজমা হোসেন চৌধুরী মারা গেছেন) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ নাটকটি বাচ্চাদের উপযোগী করে রূপান্তর করে দেন। উল্লেখ্য যে, ঢাকা লিটল থিয়েটার গঠন করেছিলেন মোরশেদুল ইসলাম ও মাজহারুল ইসলাম বাবু। তাঁরা দুজনে মিলে নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই সময়ে নাটকটি যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ‘তাসের দেশ’-এর প্রদর্শনী হয়েছিলো মহিলা সমিতি নাট্যমঞ্চে। ‘ঢাকা লিটল থিয়েটার’-ই প্রথম দল যাঁরা দর্শনীয় বিনিময়ে ছোটদের নিয়ে ঢাকায় শো করেছে। এই সময়ে বা এর আগে যে এমন নাটকের দল ছিলো না তা নয় কিন্তু তারা দর্শনীর বিনিময়ে শো করতে পারেনি। পঞ্চাশ বারের বেশি শো হয় এই নাটকটির, যা একটি অকল্পনীয় ব্যাপার। এরপর লিটল থিয়েটার থেকে বেশ কয়েকটি সফল প্রযোজনা হয়। এর মধ্যে অন্যতম প্রযোজনা ছিল সত্যজিত্ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’। প্রথমে মোরশেদুল ইসলাম ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিটি দেখেন এবং তিনি ঠিক করেন ছবিটিকে বাচ্চাদের উপযোগী করে মঞ্চরূপ দেবেন। ব্যাপারটা বেশ কঠিন ছিল। কারণ কোন ছবিকে মঞ্চে রূপান্তর করতে হলে সেই ছবির পরিচালকের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সৌভাগ্যক্রমে বিশিষ্ট সমালোচক ও সাংবাদিক মাহমুদা চৌধুরী তখন কলকাতায় যাচ্ছিলেন। মোরশেদুল ইসলাম ‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চায়নের অনুমোদন চেয়ে একটি চিঠি তাঁর কাছে দিয়ে দিলেন। সত্যজিত্ রায় তাঁর প্যাডে নিজে হাতে চমত্কার একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন এবং তিনি এই প্রস্তাবটিকে খুব আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। এই চিঠিটি মোরশেদুল ইসলাম দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করেছিলেন এবং সেই সময়ে ছোটদের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘কিশোর বাংলা’-য় চিঠিটা ছাপা হয়েছিলো।
দুঃখজনকভাবে মোরশেদুল ইসলাম এই বিখ্যাত চিঠিটা হারিয়ে ফেলেন। পরবর্তীকালে তিনি বিখ্যাত পরিচালক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিত্ রায়ের সঙ্গে দেখা করেন (সত্যজিৎ রায়ের সাথে তাঁর মোট তিন বার দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল) তখন এই নাটক ও চিঠি সম্পর্কে আলোচনা হয়। মঞ্চ নাটকে লিটল থিয়েটার একটি নতুন ধারা নিয়ে আসে এবং মঞ্চ নাটকের সাথে জড়িত সবাই লিটল থিয়েটারকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতেন কারণ লিটল থিয়েটার দর্শকদের বেশ উন্নতমানের নাটক উপহার দিতে পেরেছিলো। ছবি পরিচালনার আগে মোরশেদুল ইসলাম ছোটদের সংগঠক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নাটক নির্দেশনার পাশাপাশি ছবি বানানোর ইচ্ছেটা শুরু হয় ফিল্ম আর্কাইভ কোর্সটি করার সময়। বলা যায় ছবি তৈরির প্রতি তাঁর প্রচন্ড আগ্রহ জন্মে। তিনি কখনোই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ বোধ করেননি। জীবনে দুবার অভিনয়ের সুযোগ এসেছে এবং বলতে গেলে দুবারই কাকতালীয় ভাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই স্কুল পড়ুয়া বয়সেই তাঁর ছুটি নাটকের অভিনয়ের চেয়ে নির্দেশনার প্রতি আকর্ষণ ছিল। তখন থেকেই তিনি পরিচালনার বিষয়টি লক্ষ্য করতেন। আবার যখন সিনেমা দেখতেন তখন কলাকুশলীদের অভিনয়ের চেয়ে তিনি বেশি খেয়াল করতেন নির্মাণ কৌশল। তিনি ভাবতেন তিনি যদি ছবিটির পরিচালক হতেন তাহলে কিভাবে নির্মাণ করতেন। ১৯৮১ সালে ফিল্ম আর্কাইভ কোর্সটি তাঁর চোখ খুলে দেয়। বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট এন্ড আর্কাইভের এটি ছিল প্রথম কোর্স। এর আগে ১৯৬৯ সালে আলমগীর কবীর যখন লন্ডন থেকে ফিল্মের উপর পড়া শেষ করে দেশে আসেন তখন তিনি ‘ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট’ নামে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি প্রতিষ্ঠান করেন যেখানে বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু কোর্স হয়েছিল। আরেকটি কোর্স হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। ভারতের বিখ্যাত পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সতীশ ভাদুর এসেছিলেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে তিনি একটি কর্মশালার আয়োজন করেন যেটা নাকি ফিল্মের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোর্স ছিল। এসব কোর্স সম্পর্কে তিনি পরে জানতে পেরেছিলেন। আর ১৯৭৫ সালে মোরশেদুল ইসলামের বয়স মাত্র ১৭ কি ১৮। এই বয়সে ফিল্ম নিয়ে পড়াশুনা অসম্ভব ব্যাপার এছাড়াও ঐ সময়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতাগণ যেমন, বাদল রহমান, সৈয়দ সালাউদ্দিন গাজী, ক্যামেরায় আনোয়ার হোসেন এরা সবাই ক্লাস নিতেন। এই কোর্স করতে গিয়ে সবার সাথে বিশেষ করে সৈয়দ সালাউদ্দিন গাজী ও আলমগীর কবীরের সাথে মোরশেদুল ইসলামের বেশ ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং আলমগীর কবীর সব সময় ছবি বানানোর জন্য তাঁকে উত্সাহ দিতেন। ছবি বানানোর ক্ষেত্রে সবার যে ধারণা থাকে সেটা হলো ছবি বানানো অনেক টাকার ব্যাপার, যথেষ্ট দক্ষতা না থাকলে ছবি বানানো যায় না (মূলত টাকাই হচ্ছে ছবি বানানোর প্রধান হাতিয়ার)৷ এই ধারণাটা মোরশেদুল ইসলাম ভেঙ্গে দিলেন। তিনিই প্রথম কম বাজেটে ছবি বানানোর পথ করে দিলেন।
‘আগামী’ এবং যাত্রা শুরু
বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট এন্ড আর্কাইভের কোর্সটি ছিল তিন অংশে বিভক্ত। প্রথমে ৪০ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হলেও পরে তা থেকে বাদ পরে ২৪ জন, পরে আরো ১৪ জন ছাত্র বাদ দিয়ে ছাত্রসংখ্যা হয় ১০ জন। এই ১০ জনকে নিয়ে আবার একটা ৬ মাসের এডভান্স কোর্স শুরু হলো। এই কোর্সের একই অংশ ছিল ছবি বানানো। তখন থেকেই মোরশেদুল ইসলামের ছবি তৈরির স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিল। তানভীর মোকাম্মেল প্রথম শুরু করলেন ‘হুলিয়া’ ছবিটি। নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ কবিতাটির অনুসরণে নির্মিত হয় এই ছবিটি। সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী নিতেন চিত্রনাট্যের ক্লাস। তিনিই সবাইকে ‘হুলিয়া’ কবিতাটি চিত্রনাট্যে রূপান্তরের এ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন। সবাই চিত্রনাট্য লিখলেও তানভীর মোকাম্মেল তাঁর চিত্রনাট্য অনুযায়ী কাজ শুরু করলেন। মোরশেদুল ইসলাম শুরু করলেন ‘আগামী’ এর কাজ। তাঁরা ছবি বানানোর জন্য ১৬ মিলিমিটার ফরম্যাটকে বেছে নিলেন। ১৬ মিলিমিটার ফরম্যাটকে বেছে নেবার পেছনে দুটো কারণ ছিল। প্রথম কারণ ৩৫ মিলিমিটারের চেয়ে ১৬ মিলিমিটারের খরচ কম (ক্যামেরাসহ আনুষঙ্গিক খরচ)। আরেকটি কারণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে ৩৫ মিলিমিটারে কিছু ভালো ছবি তৈরি হলেও তা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। দেখা গেল যে বেশ কিছু ভালো ও উন্নতমানের ছবি (৩৫ মিলিমিটারে নির্মিত) মুক্তি পাওয়ার ৩ দিনের মাথায় হল থেকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। সিনেমা হলের মালিকদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে এসব ছবি সিনেমা হলে টিকতে পারছিল না। এই পরিস্থিতির একেবারে বড় উদাহরণ ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’। এই ছবিটি নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালে। ছবিটি মুক্তি পায় ঢাকা থেকে দূরে একটি হলে এবং ঢাকায় মুক্তি পেতে সময় লেগেছিল এক বছর। ‘মেঘের অনেক রঙ’ নামের একটি চমত্কার ছবি ছিল যেটা কিনা ৩ দিনের মাথায় সিনেমা হল থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে তাদের মনে একটা প্রশ্ন আসে যে ছবি বানিয়ে যদি প্রদর্শনী না করা গেল তবে লাভ কি? এই কারণে তাঁরা ১৬ মিলিমিটারের ফরম্যাটকে বেছে নিলেন। প্রথমত এতে খরচ কম, দ্বিতীয়ত ১৬ মিলিমিটার ফিল্মে নির্মিত ছবিগুলো সিনেমা হলের বাইরেও প্রদর্শন করা যায়। কারণ এর প্রজেক্টর তুলনামূলকভাবে হালকা এবং (Portable Projector) যার ফলে ১৬ মিলিমিটারে নির্মিত ছবি যেকোন জায়গায় দেখানো সম্ভব। আর স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রেও কারণটা একই, সেটা হলো অর্থ। অবশেষে তাঁরা ২৫, ৩০, ৪০ মিনিটের ছবি নির্মাণ করতে উদ্যোগী হলেন। তাদের প্রযোজক ছিল না, ছবি নির্মিত হত চাঁদা তুলে। মোরশেদুল ইসলাম যখন ‘আগামী’ বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তখন তাঁর মনে হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি শুধু পুনর্বাসিতই হচ্ছে না বরং এরাই ক্ষমতার কেন্দ্রে বিচরণ করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবক্ষয় মোরশেদুল ইসলামকে খুব জর্জরিত করছিল সেজন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধকেই ছবিটির প্রেক্ষাপট হিসেবে বেছে নিলেন। সময়টা ১৯৮২, ‘আগামী’ ছবির প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ, গল্প ও চিত্রনাট্য মোরশেদুল ইসলামের। তিনি ‘আগামী’র মাধ্যমে তুলে ধরলেন যে, মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেশের এই অনিয়মের প্রতিবাদ করতে পারছে না তখন একটি ছেলে যার জন্ম ১৯৭১ সালে সে তার নিজের মতো প্রতিবাদ করছে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন এই ছেলেটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করছে প্রতীকী অর্থে এবং এরাই হচ্ছে ‘আগামী’৷ আগামীতে এরাই হয়তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ফিরিয়ে আনবে। গল্পটি লেখার সময় বেশ কিছু ব্যাপারের দিকে তাঁকে খেয়াল রাখতে হয়েছে। প্রথমত ছবিটি হবে কম বাজেটের সুতরাং খুব বেশী রাতের দৃশ্য দেখানো যাবে না। কারণ রাতের দৃশ্য মানেই লাইট এবং খরচ।
গল্প লেখা শেষ কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে। তখন তাঁরই এক শুভাকাঙ্খী এবং লিটল থিয়েটারের অভিভাবক মিসেস নাসিমা ইসলাম ছবি বানানোর মূল টাকাটা দিলেন। পুরো ছবি বানাতে খরচ হয়েছিল ৭০ হাজার টাকা এবং মিসেস ইসলাম দিয়েছিলেন ৪০ হাজার টাকা। বাকী টাকা মোরশেদুল ইসলামকে বিভিন্ন ভাবে যোগাড় করতে হয়েছিল। উল্লেখ্য যে মোরশেদুল ইসলাম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্র। এই সে সময়ে ৭০ হাজার টাকা মানে অনেক টাকা বিশেষ করে একজন ছাত্রের সাধ্য ও কল্পনার বাইরে। ছবিটির শুটিং শুরু হলো ১৯৮২ সালের অক্টোবর মাসে এবং শেষ হয়ে গেল ডিসেম্বরের মধ্যেই। ছবিটির অন্যান্য কাজ হয় ১৯৮৩ সালে। এর মাঝে সৃষ্টি হলো জটিলতা কারণটা অবশ্যই অর্থনৈতিক। কারণ ৭০ হাজার টাকা বাজেট হলেও খরচ হয়েছিল প্রায় দ্বিগুণ। ফলে ধার পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। কারো কাছে দুই হাজার কারো কাছে চার হাজার এভাবে ধার করে করে ছবিটির কাজ শেষ হলো। এভাবে অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে ১৯৮৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ছবিটি সেন্সর বোর্ডে গেল। কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছবিটি মেনে নিচ্ছে না। কারণ ছবিটিতে কয়েকটি দৃশ্য ছিল যে গ্রামের বাচ্চারা জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছে, পাকিস্তানী মিলিটারী শব্দটি ছবিটিতে অসংখ্যবার ব্যবহৃত হয়েছে। জয় বাংলা ও পাকিস্তানী মিলিটারী বলা যাবে না অর্থাত্ নাম উল্লেখ করা যাবে না বলতে হবে হানাদার বাহিনী। মোরশেদুল ইসলাম তাদের বেঁধে দেয়া শর্ত মেনে নিলেন না, প্রতিবাদ করলেন। তিনি একরকম আন্দোলন শুরু করলেন এবং সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলেন। পত্র পত্রিকা বেশ গুরুত্বের সাথে ব্যাপারটি বিবেচনা করল। দেশের বুদ্ধিজীবিরা মোরশেদুল ইসলামের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাঁরা বিবৃতি দিলেন ছবিটির পক্ষে এবং ‘সন্ধানী’ নামে একটি পত্রিকার প্রচ্ছদ কাহিনী ছিল এই ছবি প্রসঙ্গে। পরবর্তীকালে যখন আপীল করা হলো তখন আপীল বোর্ড থেকে ছবিটা ছেড়ে দেয়া হলেও নষ্ট হলো একটি বছর। ১৯৮৩ সাল শেষ ১৯৮৪ সাল শুরু। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, আপীল বিভাগ যে তাঁকে সহজে ছেড়ে দিয়েছে তা কিন্তু নয়। আপীল করতে গিয়ে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ব্যক্তিগতভাবে মোরশেদুল ইসলাম জেদী প্রকৃতির এবং যে কাজটি তাঁর অন্যায় মনে হয়েছে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। কোন ব্যাপারে ছাড় দেননি এতটুকু। আপীল কোর্টে ছিলেন একজন ডেপুটি সেক্রেটারী, মোরশেদুল ইসলাম সরাসরি তাঁর রুমে গিয়ে পিটিশন জমা দিলেন। সেই সময় ঐ রুমে ফিল্ম আর্কাইভের কিউরেটর আব্দুল রউফ (বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা) উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু ডেপুটি সেক্রেটারী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ, রাজাকার। তিনি আবেদনপত্রটি নিয়েই বললেন, ‘কিসের ওপর ছবি?’ মোরশেদুল ইসলাম বললেন ছবির বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ। তখন ঐ সেক্রেটারী একটা বাজে মন্তব্য করলেন যার ধরণ ছিল এরকম যে, হারামজাদা মুক্তিযোদ্ধারাই দেশটার নষ্টের মূল। মোরশেদুল ইসলামের মাথায় রক্ত চড়ে গেল এবং সাথে সাথে উঠে গিয়েই তাঁর কলার চেপে ধরলেন। ‘কি বললেন, ক্ষমা চাইতে হবে, না হলে একেবারে খুন করে ফেলবো।’ জয়েন্ট সেক্রেটারী বুঝতেই পারেননি ব্যাপারটা এরকম হবে। তিনি থতমত খেয়ে গেলেন এবং আব্দুল রউফ সাহেবের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটার একটা মীমাংসা হোল। অনেক চড়াই-উতরাই পার হবার পর ১৯৮৪ সালের জানুয়ারীতে সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে ছেড়ে দিল। ফেব্রুয়ারির ৪ কি ৫ তারিখে একটি প্রিমিয়ার শো করলেন এবং ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে বাণিজ্যিক প্রদর্শনী করলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলে। মোরশেদুল ইসলাম খুব অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন-একেতো ২৫ মিনিটের ছবি তার উপর সাদা কালো, কাঁচা হাতের কাজ, দর্শক কি দেখবে? (উল্লেখ্য যে, মোরশেদুল ইসলাম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তাঁর বন্ধু-বান্ধবরাই ‘আগামী’ ছবি নির্মাণের সময় তাঁর সহকারী ছিলেন) কিন্তু শেষে দেখা গেল দর্শক ছবিটাকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করলেন। তাঁরা দুইটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলে। কিন্তু এত দর্শক হলো যে, টিকেট দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। পরে আরো একটা শো বাড়াতে হলো। কিন্তু একটা শো বাড়িয়ে দর্শকদের চাহিদা পূরণ করতে পারলেন না। দর্শকরা ক্ষোভে ব্রিটিশ কাউন্সিলের দরজা ভেঙ্গে ফেলে এবং তাতে মোরশেদুল ইসলামও আহত হলেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের দরজা গ্লাস ভেঙ্গে ফেলার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। পরে তাঁরা প্রদর্শনীর আয়োজন করেন বড় পরিসরে পাবলিক লাইব্রেরিতে। সেখানে দেখা গেল দর্শকদের লাইন অডিটোরিয়াম ছাড়িয়ে রাস্তায় চলে আসে। দর্শকদের উত্সাহ দেখে মোরশেদুল ইসলাম স্তম্ভিত হয়ে যান। আসলে সেই সময় দর্শকদের ভালো ছবি দেখার ইচ্ছা ছিল। তবে ভালো ছবি যে সে সময় হচ্ছিল না তা নয়, পাশাপাশি খারাপ ছবিও হচ্ছিল। তবে ছবিটির দর্শক চাহিদার মূল কারণ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে দেয়ার একটা চক্রান্ত চলছিল এবং ‘আগামী’ ছবিটি প্রতিপাদ্য বিষয়ই ছিল এর প্রতিবাদ। তাই মোরশেদুল ইসলাম দর্শকদের উত্সাহে প্রচন্ড খুশি।
‘আগামী’ মুক্তি পেল ১৯৮৪ সালে আর তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ মুক্তি পেল তার ঠিক এক বছর পর অর্থাত্ ১৯৮৫ সালে। যদিও ‘হুলিয়া’র নির্মাণ শুরু হয়েছিল ‘আগামী’ নির্মাণের দুই এক মাস আগে কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায় আগামী মুক্তি পাওয়ার এক বছর পরে। পরবর্তীতে দুটি ছবি একসাথে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। ছবি দুটি যে শুধু ঢাকায় দেখানো হবে তা নয় ঢাকার বাইরেও প্রদর্শনীর ব্যাবস্থা করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম প্রতিটি জায়গায় দর্শকদের অপ্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যায়। ১৯৮৫ সালে ‘আগামী’কে সরকারিভাবে দিল্লী উৎসবে পাঠানো হলো। সরকার তিনটি ছবি পাঠালো দুটা ফুল লেংথ ফিচার ফিল্ম- পেনশন ও পুরস্কার আর স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি হিসেবে ‘আগামী’। সরকার সবকিছু ব্যবস্থা করার জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়েছিল। যদিও পেনশন ও পুরস্কার ছবির জন্য সরকার তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি টাকা বরাদ্দ করেছিল কিন্তু ছবি দুটি উৎসবে সুযোগ পায়নি সুযোগ পেল শুধুমাত্র ‘আগামী’। মোরশেদুল ইসলাম সেই টাকা নিয়ে বোম্বে গেলেন এবং সেটাই ছিল তাঁর প্রথম বিদেশ যাত্রা। সময়মতো তথ্য না পাওয়ায় পরে উৎসবে মোরশেদুল ইসলামের যাওয়া হয়নি। তখন তো আর ইন্টারনেটের ব্যবস্থা ছিল না, একমাত্র মাধ্যম ছিল টেলেক্স। তিনিই আসলে উৎসবের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন কারণ তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি পুরস্কারের কথা। সেদিনের কথা তাঁর পরিস্কার মনে আছে। তিনি গোড়ান থেকে টেম্পুতে করে পুরানো ঢাকার বাসায় ফিরলেন এবং ফেরার সাথে সাথেই সবাই তাঁকে বললেন, ‘তোমার ছবি পুরস্কার পেয়েছে আটটার খবরে দেখিয়েছে।’ তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না। দশটার সংবাদের অপেক্ষায় রইলেন। দশটার সংবাদে শিরোনামেই তাঁর ছবির পুরস্কারের খবর শুনলেন। পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানটি উপস্হাপনা করেছিলেন কবীর বেদী। মোরশেদুল ইসলাম ছিলেন না বলে, বাংলাদেশ দূতাবাসের হাই কমিশনার পুরস্কারটি গ্রহণ করলেন। এটি ছিল মোরশেদুল ইসলামের জন্য একটি স্মরণীয় ঘটনা। একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ‘আগামী’ যখন বাংলাদেশে দেখানো হচ্ছিল তখন দু-একটি পত্রিকা ছবিটির তীব্র সমালোচনা করে। ‘আগামী’ পুরস্কৃত হওয়ার পর পত্রিকায় আসে যে, ‘একজন তরুণ নির্মাতার কাজ হিসেবে নির্মাতাকে উত্সাহ দেওয়ার জন্য পুরস্কারটি দেওয়া হয়।’ একথা পরিস্কার কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে নির্মাতা তরুণ কি বৃদ্ধ সেটা বিবেচনায় আনা হয় না, সেখানে গুরুত্ব পায় ছবির বিষয়বস্তু এবং নির্মাণশৈলী। সেইসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই চলচ্চিত্র পুরস্কার দেয়া হয়। আর সেই চলচ্চিত্র উত্সবে মোরশেদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন না। পরবর্তীকালে মোরশেদুল ইসলাম জানতে পারেন পুরস্কারটি তিনি কিভাবে পেয়েছেন। পুরস্কার পেলেন ১৯৮৫ সালের জানুয়ারিতে আর সে বছর জুন মাসে ইতালীতে গেলেন একটি ফিল্ম উৎসবে অংশ নিতে।
সেই উৎসবে ভারত থেকে একটি বিশাল দল গিয়েছিল যাঁদের মধ্যে ছিলেন মৃণাল সেন, শাবানা আজমী, শ্যাম বেনেগাল প্রমূখ। মোরশেদুল ইসলাম তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং দলের মধ্যে কনিষ্ঠতম সদস্য। যার কারণে সবাই তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। শ্যাম বেনেগাল ও তিনি পাশাপাশি কক্ষে থাকতেন। একদিন সকালে নাশতার টেবিলে শাবানা আজমী ‘আগামী’ কিভাবে পুরস্কার পেল সেটা বললেন। তিনি বললেন যে, কলকাতার একটা ছবি ছিল, সেই ছবি ও ‘আগামী’র মধ্যে কাকে পুরস্কার দেয়া হবে এই নিয়ে একটা বিরোধ দেখা দিল এবং ভোটাভুটিতে টাই হয়ে গেল। তখন জুড়ি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন একজন আফ্রিকান ফিল্ম মেকার তিনি ‘আগামী’র পক্ষে ভোট দিলেন। এভাবেই ‘আগামী’ পুরস্কার পায়। সুতরাং ছবি নির্মাতার বয়স কখনোই প্রাধান্য পায়নি, ছবির নির্মাণ কৌশল, পটভূমি, বক্তব্য এগুলোই ছিল পুরস্কার প্রাপ্তির মূল হাতিয়ার। আসলে আমাদের একটা দোষ যে, আমরা প্রশংসা করতে জানি না এবং কারো অর্জনকে মূল্য দিতে চাই না। অবশ্য সেই সময়ে প্রতিটি কাগজের প্রথম পাতায় ছিল পুরস্কার প্রাপ্তির খবর। দৈনিক ইত্তেফাক ‘আগামী’ পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য বিশেষ সম্পাদকীয় লেখে। একটি চমত্কার সমালোচনা লিখেছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন।
ঐ বছরেই মোরশেদুল আরেকটি ছবির কাজ শুরু করলেন। ছবিটির নাম বোট এন্ড লাইফ(Boat and Life), এই ছবির কাজ শেষ হয় ১৯৮৬ সালে। এটা একটি ডকুমেন্টারী ফিল্ম যা তিনি একটি বিদেশী সংস্থার জন্য নির্মাণ করেন। ছবিটি পরিচালনার জন্য মোরশেদুল ইসলামকে ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়। এই ছবিটা তিনটি ভাষায় রূপান্তরিত হয় এবং বিভিন্ন উৎসবে প্রদর্শিত হয়। এরপর তিনি নির্মাণ করেন ‘সূচনা’ যা ৬২ মিনিটের একটি কালার ছবি। এরপরেই নির্মাণ করেন ‘চাকা’। এই ছবির কাজ শুরু হয় ১৯৯১ সালের শেষের দিকে এবং কাজ শেষ হয় ১৯৯৩ সালে। ‘চাকা’ মূলত সেলিম আল দীনের নাটক। নাটকটি দেখেই মোরশেদুল ইসলাম তাঁর নিজের মতো করে ছবি বানাবেন বলে ঠিক করেন। এখানে উল্লেখ্য মোরশেদুল ইসলাম ছবি বানানোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়কে প্রাধান্য দেন। অর্থাত্ তাঁর ছবির কিছু সাধারণ দিক আছে, যাঁরা তাঁর ছবি দেখতে অভ্যস্ত তারা এটা সহজেই বুঝতে পারবেন। তিনি ছবি বানানোর ক্ষেত্রে লং শট, কম ডায়ালগের মাধ্যমে ছবির মূল বিষয়বস্তুকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। আসলে ফিল্ম এমন কিছু নয় যা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর উপর নির্মিত হতে হবে। ফিল্মের মাধ্যমে যেকোন অনুভূতির প্রকাশ করা সম্ভব। এই ছবিটির শুরুতে গাড়োয়ানদের মৃতদেহটি পাওয়ার পর যে বিরক্তি আসে, মোরশেদুল ইসলাম দর্শকদের মধ্যেও সেই বিরক্তি চেয়েছেন। তাই ব্যবহার করেছেন দীর্ঘ শট, চাকার ঘড়ঘড় শব্দ, সংলাপহীন একঘেয়ে যাত্রা। পরে যখন মৃতদেহটির সাথে তাদের আত্মিক সম্পর্ক তৈরী হয় তখন ছবির বেগটা কিছুটা হলেও বাড়ে। চাকার শুটিং করতে মোরশেদুল ইসলামকে নওগাঁ যেতে হয়েছিল কারণ তাঁর প্রয়োজন ছিল বিস্তৃত ভূমি যেখানে টানা রাস্তা চলে গেছে। মাটির রাস্তা, আশেপাশে লোকজন কম। ছবিটি নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছ। প্রথমত ছবিটির বাজেট ছিলো কম, আর বাজেট কম হলেই নানা সমস্যার উদ্রেক হয়। শুটিং এর সময় এই ইউনিটকে থাকতে হতো একটি ইউনিয়ন পরিষদের ঘরে। শুটিং শেষ হতো অনেক রাতে। সেই রাতেই তাঁরা পুকুরের ঠান্ডা পানিতে গোসল সেরে নিতেন। সারা দিনের ক্লান্তি আর প্রচন্ড ধুলা। ইউনিয়ন পরিষদের ঘর থেকে শুটিং স্পটে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল একটি টেম্পু। এই তিন-চার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা যখন শুটিং স্পটে পৌঁছাতেন তখন ধুলার জন্য তাদের চেনা যেতো না। আর রাস্তা ছিল ভয়ংকর খারাপ। তাই অনেক সময় তাঁরা গল্প করতে করতে হেটেই চলে আসতেন। টেম্পু থাকতো কিন্তু ধুলার জন্য কেউ উঠবেন না। সব মিলে ১৫-২০ দিন তাঁদের থাকতে হয়েছিল।
ছবি তৈরীর সময় কুকুর নিয়ে মোরশেদুল ইসলামকে খুব বেগ পেতে হচ্ছিল। স্বাভাবিক কারণেই মৃতদেহর গাড়ির পেছনে কুকুর দৌড়াবে না। শুটিং-এ ছিল বিস্কুটের গুড়া। কুকুর দৌড়েছিল তার পেছনে। কাজটি করেছিলে আশীষ খন্দকার (ছবির গাড়োয়ান)। তিনি অভিনয়ের সাথেই সাথেই কৌশলে একটি হাত চাদরের নিচ থেকে বিস্কুটের গুড়া ছিটিয়ে দিয়েছিলেন আর কুকুর তার পেছনেই দৌড়াচ্ছিল। এই দৃশ্যে একাধিক কুকুর ব্যবহার করা হয় কিন্তু দর্শক সেটা বুঝতে পারেননি। ছবিটির আরেকটি দৃশ্য নির্মাণ করতে নির্মাতাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। দৃশ্যটা ছিল এমন মৃতদেহটা যখন পচতে শুরু করেছে তখন তার গায়ের উপর মাছি বসছে এই দৃশ্যটা ধারণ করা হয় ঢাকায়। তখন শীতকাল শেষ, আম কাঁঠালের মৌসুম শুরু হয়েছে। মোরশেদুল ইসলাম কাঁঠালের আঠা মৃতদেহর গায়ে মেখে দিলেন, ফলে একটা পচা পচা অবস্থা আর রসের কারণে সব মাছি এসে জড়ো হলো। এভাবেই তৈরী হয় ‘চাকা’। যা মোরশেদুল ইসলামকে বিপুল ভাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে মোরশেদুল ইসলাম নুতন ভাবে উন্মুক্ত করেছেন ‘চাকা’ ছবিটি দিয়ে। ‘চাকা’ বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাণিজ্যিক ভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। ‘চাকা’ আন্তর্জাতিক ভাবে অনেক পুরস্কার অর্জন করেছে। ফ্রান্সে ১৯৯৩ সালে Dunkerque Film Festival এ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচালনায়- ‘ Grand Prix‘, জার্মানিতে Mannheim Film Festival এ ১৯৯৪ সালে FIPRESCI এবং INTERFILM Jury Awards অর্জন করে।
এরপরে আরো বেশ কিছু ছবি নির্মাণ করেছেন- ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘দুখাই’, ‘দূরত্ব’, ইত্যাদি। নির্মাণ করেছেন ‘খেলাঘর’। মজার ব্যাপার হচ্ছে মোরশেদুল ইসলাম তাঁর কোন কাজেই সম্পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট নন। তাঁর মনে হয়েছে তিনি যা দেখাতে চান তা কখনোই সম্পূর্ণরূপে পারেননি। কারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ ব্যাপারটিই সম্পূর্ণ আলাদা। এটি একটি দলগত প্রচেষ্টার ফসল। একজন পরিচালককে কাজকে ফুটিয়ে তোলার জন্য অনেকগুলোর লোকের উপর নির্ভর করতে হয়। অনেকগুলো টেকনিক্যাল প্রসেসের মাধ্যমে যেতে হয়। যেমন শুটিং, ক্যামেরা ঠিক আছে কিনা, লেন্স, ফিল্ম ঠিক কিনা, ল্যাবের অবস্থা, সাউন্ড, লাইট আরো অনেক কিছু। আর কোনো শিল্প মাধ্যমে এরকম অবস্থা নেই। আর চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্থের ব্যাপারটা তো অবশ্যই বিবেচ্য বিষয়। যেকোনো ভালো কিছু নির্মাণ করতে হলে টাকার ব্যাপার প্রথমেই এসে যায় অন্তত ছবি বানানোর ক্ষেত্রে। মোরশেদুল ইসলাম চাকা নির্মাণের সময় যদি আরো কিছু টাকা পেতেন. তবে তিনি আরো সময় নিয়ে শুটিং করতে পারতেন। তার মতে, শুধুমাত্র বাজেটের অভাবে ছবিটিতে কিছুটা টেকনিক্যাল প্রবলেম ( Technical Problem) থেকে গেছে। এটা দেখা যায় শেষ দৃশ্যে। দৃশ্যটা তিনি ধারণ করতে চেয়েছিলেন সন্ধ্যার সময় এবং সন্ধ্যার সময় করতে গেলে কমপক্ষে দশদিন ধরে প্রতিটি সন্ধ্যায় দৃশ্যটি ধারণ করা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত অর্থ থাকলে প্রতি সন্ধ্যায় একঘন্টা কাজ করতে পারতেন কিন্তু দশদিনের সন্ধ্যার কাজ তাঁকে মাত্র দুইদিনের সন্ধ্যায় শেষ করতে হয়েছে। যার কারণে কিছু ত্রুটি থেকে গেছে। তার মতে, কোন বিষয়কে পর্দায় রূপদান করতে একজন নির্মাতার অনেকগুলো মাধ্যম অতিক্রম করতে হয়। মোরশেদুল ইসলাম তাঁর কল্পনাকে ছবিতে ৭০ ভাগও যদি রূপদান করতে পারতেন, তবে তিনি নিজেকে সফল ভাবতেন। ১০০ ভাগ রূপদান কখনোই সম্ভব নয়, তিনি কেন কোন নির্মাতার পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা করেন যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সত্যজিত্ রায়ের প্রসঙ্গ চলে আসে। তিনিও মোরশেদুল ইসলামের সাথে একমত ছিলেন। এই ব্যাপারে তাঁদের আলোচনা হয়েছিল। প্রথম যখন তিনি কলকাতা যান তখন রায় সাহেবের বাসা ঠিকানা (ঠিকানা যোগাড় করেছিলেন বিখ্যাত শিল্প চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবীরের কাছে থেকে) বরাবর উপস্থিত হন। সে একজন অন্যরকম অনুভূতি। তখন ১৯৮৪ কি ১৯৮৫ সাল। সত্যজিত্ রায় নিজেই এসে দরজা খুললেন, যে ঘরে সাধারণত তিনি লেখাপড়াসহ আনুষঙ্গিক কাজ করেন। একটা স্কেচ করতে করতে সত্যজিত্ রায়ের সাথে মোরশেদুল ইসলামের আলাপচারিতা হয়। এভাবে পরবর্তীকালে আরো দুবার তাঁর বাসায় যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল।
‘চাকা’ ছবিটির প্রথম প্রদর্শনীর পর তাঁকে বেশ মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়। কেউ কেউ খুবই নিন্দা করলেন। আজিজ মিসির (মারা গেছেন) নামের একজন বিখ্যাত সমালোচক ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় লিখলেন, এটা কোনো ছবিই হয়নি। আবার কিছু কিছু পত্রিকা খুবই ভালো সমালোচনা করেছিল। যেমন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ‘চাকা’ ছবিটির প্রসংশা করে খুবই সুন্দর কলাম লিখেছিলেন। এর সবই হয়েছিল ‘চাকা’ পুরস্কার পাবার আগে। পাবলিক লাইব্রেরিতে ‘চাকা’ প্রদর্শনীর সময় মোরশেদুল ইসলাম একটি মন্তব্য খাতা খুলেছিলেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন রকম মন্তব্য পেয়েছেন। একটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয় মোরশেদুল ইসলাম ছবি বানাতে গিয়ে কখোনো থেমে যাননি। হয়তো অর্থনৈতিক কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন কিন্তু একেবারে হাল ছেড়ে দেননি। এছাড়া তিনি খুবই প্রতিবাদী স্বভাবের। ছবি বানাতে গিয়ে কখোনো কম্প্রোমাইজ করেননি। প্রতিবাদ করেন কিন্তু একটু অন্য রকমভাবে কিন্তু প্রতিবাদ না করে ছেড়ে দেননি। সুতরাং প্রতিটি ছবিই মোরশেদুল ইসলামকে অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে শেষ করতে হয়েছে। অনেক ছবি নির্মাণের সময় অর্থের অভাবে থেমে গিয়েছেন আবার অর্থের যোগান হয়েছে আবার নতুন শুরু করেছেন। কিন্তু একেবারে ভেঙ্গে পড়েননি। এভাবেই তিনি কাজ করতে অভ্যস্ত। তার মধ্যে লক্ষণীয় আরেকটি ব্যাপার হলো, তিনি তাঁর চলচ্চিত্রে সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তা, কল্পনার প্রকাশ ঘটাতে চেষ্টা করেন । মোরশেদুল ইসলাম যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলেন (১৯৮৬ সাল) তখন তাঁর দুটা ছবি হয়ে গেছে -‘আগামী’ এবং ‘বোট এন্ড লাইফ’। এ সময় তিনি কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হলেন। এই ছবি দিয়ে তো পয়সা আসবে না। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন চাকুরি করবেন। যুক্ত হলেন নাম করা একটি কোম্পানীতে। প্রথমে তারা ২০ জন জয়েন করেন এবং শুরু হয় ট্রেনিং। প্রতিদিন সকালে স্যুট-টাই পড়ে যেতে হবে এই নিয়ম। প্রথম দিন ট্রেনিং শেষ করে এসে, তাঁর সারারাত ঘুম হলো না। তাঁর মনে হলো জীবনটা শেষ।
তাঁর জীবনটা একটা নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা হয়ে গেল। তিনি ঠিক পরদিনই ইস্তফা দিয়ে দিলেন। এখানে তাঁর একটা বৈশিষ্ট খেয়াল করার মতো যে, তিনি কোন সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেন না। যা একবার মনস্থির করেন তাই করেন। তাঁর সিনিয়ররা অনেক বোঝালেন, কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। তিনি ঠিক করেছেন চাকুরী করবেন না, ছবি বানাবেন। তাঁর সময় যারা ঢুকেছেন, তাঁরা পরবর্তীতে দুই থেকে তিন লাখ টাকা বেতন পেয়েছেন, কিন্তু তাঁরা কেউ মোরশেদুল ইসলাম হতে পারেননি। চাকুরি ছেড়ে দেওয়ার পর একটি ছোট্ট কোম্পানী দিয়ে শুরু করলেন। একটা অফিস নিলেন এলিফ্যান্ট রোডে। ফার্মাসিউটিক্যাল লাইনেই, ডিজাইন ডেভেলপ করা অর্থাত্ ডক্টরদেরে যেসব প্যাড বা আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের (ছাপার ক্ষেত্রে) প্রয়োজন সেসব কাজ তিনি করতেন। এতেও তিনি বেশ ভালোই রোজগার করতে শুরু করলেন। পাশাপাশি করতেন ছবির কাজ। ছোট অফিস বড় হয়ে গেল। ১৯৯৬ সালে ঐ ব্যবসাটি বন্ধ করে দিলেন। একটা চালু ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে তেমন উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল না। অবশ্য ১৯৯৬ সালে যখন মোরশেদুল ইসলাম ফুল লেংথ ফিচার ফিল্ম বানাচ্ছেন তখন এই ছাপাছাপির কাজ আর ভালো লাগছিল না। আসলে কারো পেছনে ব্যবসায়িক কাজে ঘোরা, তদবির এগুলো তিনি করতে পারেন না। আসলে তাঁকে কেউ পরিচালিত করুক তিনি তা কখোনো হতে দেননি। আর ছবি বানানোর ক্ষেত্রে এই সমস্যা চিরন্তন। হয়ত বাজেটের সমস্যা, নয়ত টেকনিক্যাল সমস্যা, আবার হয়ত সবই ঠিক আছে, পর্দায় ভালো লাগছে না। মোরশেদুল ইসলামকে যদি নতুন করে ‘আগামী’ নির্মাণের সুযোগ দেয়া হয় তবে তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করবেন না। কারণ একটি ছবি যতই ত্রুটিযুক্ত হোক না কেন, সেটা সেই সময়ের চাহিদা পূরণ করে। হয়ত তিনি অনেক বড় বাজেটে ‘চাকা’ নির্মাণের সুযোগ পেলেন, হয়ত সেটা অনেক ভালো হবে, ঝকঝকে প্রিন্ট হবে, কোন খুঁত নাই, কিন্তু একটি ছবি খুঁতহীন হলেই তো ভালো হয় না, ছবির আসল জিনিস হলো প্রাণ। সেই প্রাণের সৃষ্টি একবারই হয় আর তাতে যদি কোন ভুল থাকে তবে সেটাই শিল্প। মোরশেদুল ইসলামের ঈর্ষা হয় ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি দেখে। এই ছবিটি তিনি বহুবার দেখেছেন। যতবারই দেখেন ততবারই নতুন মনে হয়। এছাড়া দেখেছেন সত্যজিত্ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘চারুলতা’, এছাড়া অন্যান্য পরিচালকদের মধ্যে কুরোসোয়া, কৃষান, দক্ষিণের ছবিগুলো। কিন্তু সত্যিকার ভাবে মুগ্ধ হলেন ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি দেখে।
পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন
মোরশেদুল ইসলাম ছোটবেলা থেকে একটু চুপচাপ ধরনের কিন্তু ভয়ংকর দুষ্ট ছিলেন। দুষ্টুমি করতেন নির্বিকারভাবে। কলেজ পর্যন্ত ছোটখাট দুষ্টুমি ছাড়া উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু করেননি। তবে ধূমপানে অভ্যাস গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে। এ ব্যাপারে তাঁকে বিশেষ সহযোগিতা করতেন তাঁর বন্ধু খোকন। মোরশেদুল ইসলামের ব্যক্তিগত জীবন খুবই রোমাঞ্চকর এবং ঘটনাবহুল। উল্লেখযোগ্যভাবে যে প্রেমের ঘটনাটি ঘটে, তখন মোরশেদুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। যাকে পছন্দ করতেন তাকে অবশ্য স্কুল পড়া অবস্থাতেই চিনতেন। তাঁদের মধ্যে পারিবারিক যোগাযোগ ছিল। কচিকাঁচার মেলা থেকে ‘আগামী’ পর্যন্ত সবকিছুর কেন্দ্রই ছিল ঐ মেয়েটির বাসা। মোরশেদুল ইসলাম প্রথমদিকে কখনোই বুঝতে পারেননি যে তিনি তাঁকে ভালোবাসেন। তিনি তাঁকে নিয়ে কোন চিন্তাই করেননি। সবসময় নিজের অংশই ভেবে আসছেন। একদিন ঠিক করলেন মেয়েটিকে চিঠি দেবেন। সেদিন বিকেলে ‘হীরক রাজার দেশে’-এর রিহার্সেল হচ্ছিল টি.এস.সি. তে। মোরশেদুল ইসলাম সকালে চিঠি দিয়ে বিকেলে উত্তরের প্রত্যাশায় ছিলেন। রিহার্সেলের পরে তাঁরা হেটে ফিরছিলেন। তখন তাঁদের মধ্যে বেশকিছু আলাপচারিতা হয় এবং বোঝা যাচ্ছিল মেয়েটি রাজি ছিল। কিন্তু তিনি মোরশেদুল ইসলামকে বোঝাচ্ছিলেন যে তিনি তাঁর যোগ্য নন, তিনি আরো ভালো মেয়ে পাবেন। এইসব কথাবার্তায় মোরশেদুল ইসলাম বেশ রেগে গেলেন এবং বললেন যা বলার এখনই বলতে হবে। এক পর্যায়ে তিনি বললেন. ‘তুমি এখন জানাবে নাকি বল?’ মেয়েটি বলল না। মোরশেদুল ইসলাম চলে আসলেন। ঠিক করলেন তিনি আত্মহত্যা করবেন। রাতে চিঠি লিখলেন ঠিক কি লিখেছিলেন মনে নেই। অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ খেলেন এবং ভোরবেলা জেগেও উঠলেন, কারণ ঔষধে ভেজাল ছিল। এতে তাঁর জেদ আরো বেড়ে গেল। ফার্মেসির ছাত্র হিসেবে তিনি রীতিমতো গবেষণা শুরু করলেন কি খেলে কাজ সম্পন্ন হবে। অথচ যে কারণে এসব করা সে কিন্তু মনে মনে রাজি কিন্তু মুখে বলেনি। আর মোরশেদুল ইসলাম সুযোগ দিয়েছেনই তো একবার। তারপর এইসব কর্মকান্ড শুরু করে দিয়েছেন। মোরশেদুল ইসলামের জেদ তিনি দ্বিতীয়বার তাঁর কাছে যাবেন না। যাই হোক বই ঘেটে খুঁজে বের করলেন কোনটা সবচেয়ে কড়া ঘুমের ঔষুধ। ১০০টা ট্যাবলেট খেলেন সকাল নটায়। সামনে পরীক্ষা সবাই ভাবছেন তিনি ঘুমুচ্ছেন। দুপুরের দিকে তাঁকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া গেল এবং ৩ দিন পর তার জ্ঞান ফিরল। বাঁচার কথা ছিল না কিন্তু বেঁচে গেলেন। কিন্তু মেয়েটির সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল। ১৯৮৪ সালের মে জুন মাসের দিকে একটি ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্সের আয়োজন করা হয়। এখানে একটি মেয়ে অংশগ্রহণ করে। এই মেয়েটিকে মোরশেদুল ইসলেমর ভালো লেগে যায় এবং ১৯৮৫ সালে তাঁকে বিয়ে করেন। এটা সম্পূর্ণ পারিবারিকভাবে হয় তেমন কোন নাটকীয়তা ছিল না। ১৯৮৫ সালে তাঁর নতুন জীবন শুরু হলো। চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলামের জীবনে একটি কালো অধ্যায় আছে। সেটা হচ্ছে প্রচন্ড হতাশাবোধ জীবনে কিছুই হলো না এ জাতীয় একটা হতাশার জন্ম নিলেই তিনি গাদা গাদা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ফেলতেন। আসলে ঐ আত্মহত্যা করার চেষ্টার পর থেকেই এই আসক্তির জন্ম নেয়। পরে অবশ্য মানসিক চিকিত্সকের পরামর্শ নেন কিন্তু তাতে বিশেষ কোন লাভ হয়নি। এমনিতেই তার প্রচন্ড জেদ এবং এই জেদ যখন হতাশায় রূপান্তরিত হয় তখন কি ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে অনুমান করা কঠিন। এই রকম অবস্থায় তিনি ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে হাত কেটে রক্তারক্তি করে ফেলতেন। তাঁর হাতে এবং বুকে অসংখ্যা সেলাই এর দাগ আছে।
উল্লেখ্য যে অনেকে (সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব) নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য নেশার জগতে চলে যান। মোরশেদুল ইসলাম এর সাথে মোটেও একমত নন। অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মনে করেন যে সংসার সৃষ্টির অন্তরায়। এখানেও তাঁর কাছ থেকে ভিন্ন মত পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন পরিবারে সহযোগিতা ছাড়া ছবি নির্মাণ সম্ভব না। সৃষ্টিশীল কোনো কাজ করতে হলে যে ছন্নছাড়া জীবন হতে হবে এটা ঠিক না। বর্তমানে মোরশেদুল ইসলাম এক ছেলে মনন ও এক মেয়ে মেধার জনক। স্ত্রী মুনিরা মোরশেদ মুন্নী স্বনামধন্য আলোকচিত্রী। মোরশেদুল ইসলাম সেই ‘আগামী’ থেকে শুরু করে ‘খেলাঘর’ পর্যন্ত যতগুলো কাজ করেছেন প্রতিটি কাজই তাঁর সমান প্রিয়। তাঁর জীবনের সেই অন্ধকার সময়ে তিনি দুটো কাজ করেন একটি ‘শরত্ ৭১’ এবং ‘কূপ’ নামে একটি নাটক। দুটো কাজই খুবই প্রশংসিত হয়। কিন্তু এই দুটি কাজই করেন খুবই খারাপ অবস্থায় যা কল্পনার বাইরে। সুস্থ হওয়ার পর মুক্তি পায় ‘বৃষ্টি’, ‘দূরত্ব’। মাহমুদুল হক এর উপন্যাস নিয়ে তাঁর পরিচালিত ‘খেলাঘর’। ‘খেলাঘর’ এর প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের সময়কার। দর্শকদের কাছে নন্দিত হয়েছে এই ছবি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার
চলচ্চিত্র: আগামী
১. শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ১৯৮৪
২. শ্রেষ্ঠ পরিচালনার জন্য ‘রৌপ্য ময়ূর’ ১০ম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, নয়াদিল্লী ১৯৮৫
চলচ্চিত্র : সূচনা
১. শ্রেষ্ঠ মিডিয়াম লেন্স চলচ্চিত্র হিসেবে সিকোয়েন্স এ্যাওয়ার্ড, ১৯৮৮
চলচ্চিত্র : চাকা
১. FIPRESCI (আন্তর্জাতিক ক্রিটিক এ্যাওয়ার্ড) ম্যানহাইস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, জার্মানী, ১৯৯৩
২. ইন্টারফিল্ম জুডি এ্যাওয়ার্ড ম্যানহাইস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, জার্মানী, ১৯৯৩
৩. শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে GRAND PRIX ডানকার্ক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, ফ্রান্স ১৯৯৪
৪. শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার ডানকার্ক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, ফ্রান্স ১৯৯৪
৫. স্টুডেন্ট জুডির বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার ডানকার্ক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, ফ্রান্স ১৯৯৪
চলচ্চিত্র : দীপু নাম্বার টু
১. ৩টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৯৬
চলচ্চিত্র : দুখাই
১. শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ ৯টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৯৭
চলচ্চিত্র : দূরত্ব
১. শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উত্সব লন্ডন, ২০০৪
চলচ্চিত্র: খেলাঘর
১. শ্রেষ্ঠ পরিচালনার জন্য ‘সার্ক চলচ্চিত্র উৎসব ২০১২’ পুরস্কার
অন্যান্য পুরস্কার
১. তারকালোক পদক, ১৯৯৫
চলচ্চিত্রসহ অংশ নেয়া আন্তর্জাতিক উত্সব
১. দিল্লী আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, ভারত, ১৯৮৫
২. পেসারো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, ইতালী, ১৯৮৫
৩. সিনেমা দ্যু রিল, প্যারিস, ফ্রান্স, ১৯৯২
৪. ম্যানহাইস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব,জার্মানী, ১৯৯৩
৫. রটারডাম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, হল্যান্ড, ১৯৯৪ ও ১৯৯৮
৬. ডানকার্ক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, ফ্রান্স, ১৯৯৪
৭. সান হুয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, পুরোটো রিকো, ১৯৯৪
৮. তেহরান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, ইরান, ১৯৯৫
৯. ফুকুওকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, জাপান, ১৯৯৬, ১৯৯৭, ১৯৯৮, ২০০৫
১০. আর্থ ভিশন’, টোকিও, জাপান, ১৯৯৬
১১. তাইপে গোল্ডেন হর্স’ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, তাইওয়ান, ১৯৯৬
১২. অলিম্পিয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, গ্রীস, ১৯৯৭ ও ২০০৪
১৩. হায়দ্রাবাদ চিলড্রেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ভারত, ১৯৯৭ ও ২০০৫
১৪. ভেসুল আন্তর্জাতিক এশীয় চলচ্চিত্র উত্সব, ফ্রান্স ১৯৯৮ ও ২০০০
১৫. মন্ট্রিয়াল ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, কানাডা, ১৯৯৮
১৬. কলকাতা চলচ্চিত্র উত্সব, ভারত, ১৯৯৮ ও ২০০৪
১৭. কলম্বো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, শ্রীলংকা, ১৯৯৮
১৮. টেলুরাইড আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৯২
১৯. সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, সিঙ্গাপুর, ২০০৫ ও অন্যান্য।
লেখক : শাহরিয়ার খান নয়ন