খলিল আহমেদ ও মোসলেমা খাতুনের অষ্টম সন্তান বুলবুল আহমেদ। তাঁর জন্মের প্রহর ছিল বেশ ঘটনাবহুল। বড় ছেলে হামেদ আহমেদের পরে পরপর ছয়টি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে, যাদের মাঝে দুই কন্যা সন্তানের মৃত্যুতে সকলেই বেশ শোকাহত ছিলেন। অনেক দোয়া মানত করেছিলেন পরবর্তী সন্তানের জন্যে। এরপর ১৯৪১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার আগামসি লেনের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত এক সন্তান। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আনন্দে চারিপাশে তাবাররুক বিলানো হয়। তাই তাঁর নামকরণ হয় তাবাররুক আহমেদ ওরফে বুলবুল। পরবর্তীতে সবাই তাঁকে বুলবুল আহমেদ নামেই জানেন। আর তিনিই হলেন এদেশের শক্তিমান ও খ্যাতিমান অভিনেতা বুলবুল আহমেদ।
বুলবুল আহমেদের বাবা দেশ বিভাগের কিছুদিন পূর্বে এপার বাংলায় বদলি হয়ে এসে সেগুনবাগিচায় বাসা ভাড়া নেন। পরবর্তীতে টিকাটুলির বাড়িটি কিনে নেন। সামনে বৈঠকখানা আর তার পিছনে বড় দু’তলা বাড়ি। বৈঠকখানায় আগত পুরুষদের অন্দরমহলে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। এই বৈঠকখানার বেশ বড় ভূমিকা আছে বুলবুল আহমেদের পরবর্তী জীবনে। প্রতিদিন এই বৈঠকখানাতেই সন্ধ্যায় খলিল আহমেদের মত অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সম্মিলনে আসর বসত। এখানে আড্ডার পাশাপাশি নাটকের মহড়া চলত। খলিল আহমেদ একইসাথে নাটকে অভিনয় করতেন এবং নির্দেশনা দিতেন। আড়াল থেকে, কখনও জানালা কখনওবা দরজার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এই মহড়া দেখতেন বুলবুল আহমেদ। শৈশবকালে এই আসর থেকেই তিনি অভিনয়ের অনুপ্রেরণা পান । এই মহড়ার সুবাদে অনেক নামীদামী শিল্পীদের তিনি তাঁদের বাড়িতে আসতে দেখেছেন, যাঁদের সাথে পরবর্তীতে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। এদের মাঝে কাজি খালেক, মহম্মদ আনিস, আয়েশা আক্তার, রানি সরকার, রহিমা খালা, নারায়ণ চক্রবর্তী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ছেলেবেলায় বুলবুল আহমেদ প্রায়ই তাঁর বাবার কোট পড়ে মাথায় হ্যাট দিয়ে হাতে লাঠি নিয়ে ভাই-বোনদের সামনে এসে বলতেন, “ম্যায় আব্বা হু, ম্যায় আব্বা হু”। এই ছোট্ট বয়সেই বাবার অনুকরণ আর বাড়িতে নাটকের মহড়ার অনুশীলন ক্ষুদ্র মনে অভিনয়ের সুপ্ত বাসনার সঞ্চার করে। পুরান ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় ছিল মাহবুব আলি ইন্সটিটিউশন, যেখানে খলিল আহমেদের নাটক মঞ্চস্থ হত। বুলবুল আহমেদ এই নাটকগুলো দেখতে যেতেন সবসময়। তিনি বলেন, “ছোটবেলায় অভিনেতা হব এটা ভাবিনি, কিন্তু আমার মনে হয় এসব বিষয় আমার অবচেতন মনে গভীর ছাপ ফেলে। এর ফলেই পরবর্তীতে অভিনেতা হিসেবে আমার পদচারণা। আমি মনে করি জন্মগত প্রতিভা না থাকলে অভিনেতা হওয়া যায় না। অনুকূল পরিবেশ ও পারিবারিক পরিমণ্ডলও অবশ্যই প্রভাব ফেলে।’’
চাকরিসুত্রে খলিল আহমেদকে প্রায়ই নানা জায়গায় বদলি হতে হত। যেকারণে বুলবুল আহমেদের জন্ম আগামসি লেনে হলেও যখন তাঁর স্কুলে পড়ার বয়স হল তখন খলিল আহমেদ কোলকাতায় বদলি হন। তাই তাঁর পড়ালেখার শুরুটা কোলকাতাতেই। মুসলিম গার্লস স্কুলে তিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় দেশ বিভাগের পূর্বে খলিল আহমেদের আবার ঢাকায় পোস্টিং। ছেলেবেলায় ঢাকা শহরের নির্জন পথে সাইকেল চালাতে খুব পছন্দ করতেন বুলবুল আহমেদ। সাত আট বছর বয়সে যখন তিনি ক্লাস থ্রিতে পরেন তখন বাবার হাত ধরে ফুটবল খেলা দেখতে যেতেন। জিপিও-এর সামনে একটা কাঠের মাঠ ছিল। সেখানে খেলা দেখতেন আর চিনা বাদাম খেতেন দুজনে। তিনি নিজেও ফুটবল খেলেছেন। প্রিয় খেলা ছিল ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন। কিশোর বুলবুল আহমেদ বই পড়তে খুব ভালবাসতেন। বন্ধুদের সাথে বিকেলে কখনও কখনও হেঁটে চলে যেতেন স্টেডিয়ামের বইয়ের দোকানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। বন্ধুদের সাথে লেকের পাশে, নদীর ধারে বসে প্রাণ খুলে গান গাইতেন। নানা প্রসঙ্গে আলোচনাও চলত। ছেলেবেলায় এবং তরুন বয়সেও বুলবুল আহমেদের একটা শখ ছিল সিনেমা দেখা। এটা একটা নেশার মত ছিল। বড় ভাইবোনেরা সিনেমা দেখতে গেলে তাঁকে সঙ্গে নিত না। তিনি খুব মন খারাপ করতেন, কাঁদতেনও। ঢাকায় যখন প্যারাডাইস ও ব্রিটানিয়া হল ছিল তখন সেখানে ইংরেজি সিনেমা দেখানো হত। বাবার হাত ধরে এই সিনেমা হলে লরেল হার্ডির সিনেমা দেখে হেসে কুটিকুটি হয়েছেন তিনি। থ্রি ডাইমেন্সনের সিনেমা আসার পর চশমা পড়ে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে দেখা ছবির রোমাঞ্চের তুলনা হত না। পছন্দের তালিকায় গানও ছিল। বাসায় রেডিওতে ৭৫ স্পিড রেকর্ডে প্রচুর গান শুনতেন তিনি। গান শুনতে শুনতে গানের সাথে ঠোঁট মেলাতেন। বাবা খলিল আহমেদ যাতে টের না পায় সেজন্য দরজা বন্ধ করে গান করতেন। জগন্ময় মিত্র, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সতীনাথের গান সবচেয়ে পছন্দ ছিল তাঁর। স্কুলের উপরের ক্লাসে পড়ার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে উত্তম কুমার আর দিলীপ কুমারের সিনেমা দেখতে যেতেন। সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে ফটোসেট বা পোস্টার দেখার সময় কখনও চিন্তাও করেননি যে একসময় তিনিও অভিনয় করবেন। উত্তম কুমার আর দিলীপ কুমারের বেশ ভক্ত ছিলেন বুলবুল আহমেদ, তাঁদের আদলে চুলের ছাঁট দিতেন। ছোট থেকে বড় হওয়া অবধি এই স্টাইল অনুসরণ করেছেন।
এসএসসি পরীক্ষার পর পাড়ার এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে “কবির লড়াই” নামক এক নাটিকায় অভিনয় করেন যেখানে তিনি সতীনাথ ও শ্যামল মিত্রের দুটি গান গেয়েছিলেন। বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন প্রথমবারেই। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের পুরানা পল্টন শাখায় ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর সদরঘাট শাখায় ভর্তি হন। পরবর্তীতে এখান থেকে মেট্রিক পাশ করেছিলেন। স্কুল পেরিয়ে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ভর্তি হওয়ার পরপরই ১৯৫৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর আকস্মিকভাবে তাঁর মা মারা যান। বড় ভাই হামেদ আহমেদ চাকরিসূত্রে তখন সিলেটে ছিলেন । মায়ের মৃত্যুর পর ভাইয়ের ডাকে সিলেটে চলে যান বুলবুল আহমেদ। কিছুদিন থাকার পর বড়ভাই তাঁকে এমসি কলেজে ভর্তি করে দেন। কিন্তু কিছুদিন পর আবার আকস্মিকভাবে তাঁর বাবা মারা যান। পরপর এই দুটি শোক সামলে ওঠা বেশ কষ্টকর ছিল বুলবুল আহমেদের জন্যে। শোকে বিপর্যস্ত হলেও জীবনের স্বাভাবিক নিয়মের গণ্ডিতে আবার ফিরে আসেন তিনি। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ভর্তি হন নটরডেম কলেজে। এবার আর্টসে।
বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর বুলবুল আহমেদ তাঁর বড় ভাই হামেদ আহমেদের অভিভাবকত্বেই ছিলেন। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও অবস্থাপন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় কখনও দৈন্যদশা কি তা দেখেননি। ছেলেমেয়ের পড়ালেখা আর বিয়েশাদীর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ রেখে গিয়েছিলেন পিতা খলিল আহমেদ।
অভিনয়ের শুরুটা মঞ্চনাটক দিয়েই হয়েছিল বুলবুল আহমেদের। ১৯৫৮ সালে প্রথম সিলেটের এমসি কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে রবি ঠাকুরের ‘শেষ রক্ষা’ নাটকে মূল চরিত্র ‘গদাই’ নামভূমিকায় অভিনয় করে অনেক প্রশংসা কুড়ান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের মূল চরিত্রে প্রথম অভিনয় করার পর তিনি উপলব্ধি করেন, শিল্পচর্চা তাঁকে যতটা আনন্দ দিতে পারে তা আর অন্যকিছু দিতে পারে না। বোম্বেতে দিলীপ কুমার আর ওপার বাংলার উত্তমকুমার, নায়িকা মধুবালা, নার্গিস ও সুচিত্রা সেন তাঁর বিশেষ পছন্দের তালিকায় আছেন। দিলীপ কুমার ও উত্তমকুমার তাঁর অভিনয় জীবনে অনেক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ঢাকায় কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘শ্যামলী শিল্পী সঙ্ঘ’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী গঠন করেন। নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘উল্কা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়ে এই সঙ্ঘের যাত্রা শুরু হয়। এই বিখ্যাত নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে, যেখানে বুলবুল আহমেদ ‘সুবীর’ চরিত্রে অভিনয় করেন। শ্যামলী শিল্পী সঙ্ঘের সদস্য হিসেবে পরবর্তীতে আরও অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ। যার মাঝে ‘কানাকড়ি’, ‘বারো ঘণ্টা’, ‘মানচিত্র’, ‘গোধূলির প্রেম’ ও ‘অ্যালবাম’ উল্লেখযোগ্য। বুলবুল আহমেদ ছাড়াও সেসময় এই নাট্যগোষ্ঠীর হাত ধরে গৌরবের স্বাক্ষর রেখেছেন সৈয়দ আহসান আলি সিডনী, ত্রিরত্ন খ্যাত জলিল, আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম, নাজমুল হুদা বাচ্চু, কেরামত মওলা প্রমুখ। নাজমুল হুদা বাচ্চু এবং আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম এই দুজন প্রথিতযশা শিক্ষাগুরুর কাছে গভীর নিমগ্নতায় ডুবে থেকে একটু একটু করে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন বুলবুল আহমেদ। অভিনয়ের আকুলতা নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন মঞ্চ থেকে মঞ্চে, এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে, ঢাকা কলেজ থেকে এমসি কলেজ সর্বত্র। এরপর এক পর্যায়ে ষাট দশকের সাড়া জাগানো নাট্যদল ‘ড্রামা সার্কেল’-এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। অভিনয়ের দক্ষতা আরও প্রসারিত হয় ‘ইডিপাস’ এবং ‘আর্মস এন্ড দি ম্যান’ নাটক দুটির মধ্য দিয়ে। নাটকের নির্দেশক বজলুল করিম বেশ স্নেহ করতেন বুলবুল আহমেদকে। তিনি বুলবুল আহমেদের মাঝে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। আর সেকারণে ‘আর্মস এন্ড দি ম্যান’ নাটকের মূল চরিত্র ক্যাপ্টেন ব্লান্টশলীর ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পান তিনি। এ নাটকটি শুধু মঞ্চেই নয় টেলিভিশনেও প্রচারিত হয়েছিল। বলা বাহুল্য বুলবুল আহমেদের অভিনয় সেসময় সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
বুলবুল আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে এম.এ.-তে ভর্তি হন। ইতিহাস বরাবরই তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল। এম.এ. পড়ার সময় ভাললাগা আরও বিস্তৃতি পায়। এসময় তিনি ‘ডাকসু’ ও এস এম হলে নাটকে অভিনয় করেন। এছাড়া অন্যান্য সংগঠনের নাটকেও অভিনয় করেন তিনি। ১৯৬৩ সালে এম.এ. পাশ করার পর কিছুদিন রেডিওতে কাজ করেন তিনি। রেডিও পাকিস্তানের ‘অনুরোধের আসর’ নামে গানের অনুষ্ঠানটি দিয়েই ঘোষক হিসেবে নাম লেখান। তাঁর শব্দচয়ন ও কণ্ঠস্বর শ্রোতারা বেশ পছন্দ করতেন। একাজেই জীবনের প্রথম রোজগারের মুখ দেখেন বুলবুল আহমেদ। পনেরো টাকা মাইনে পেয়েছিলেন প্রথম। তৎকালীন সময়ে এই পনেরো টাকাই অনেক টাকা ছিল। কিন্তু এ কাজ দিয়ে তো আর জীবন চলে না। তাই বিজ্ঞাপন দেখে ব্যাংকের চাকরীতে আবেদন করেন। ইন্টারভিউয়ের ডাক পেয়ে যান। সকল ধাপ সুষ্ঠুভাবে পার করার পর তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক যা বর্তমানে জনতা ব্যাংক নামে পরিচিত, সেখানে শিক্ষানবিশ অফিসার হিসেবে যোগ দেন। মতিঝিলের হেড অফিস ছিল তাঁর প্রথম কর্মস্থল। ছয়মাস পর পুরোদস্তুর ব্যাংকার হিসেবে বদলী হন চট্টগ্রামে। কয়েক মাস চাকরীর পর আবার বদলী হন ঢাকাস্থ টিএসটি ব্র্যাঞ্চে, তবে এইবার পদোন্নতি হয় ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে। একজন সফল ব্যাংকার হিসেবে দশবছর কাজ করার মাঝেও নাটক ছাড়েননি। মঞ্চে ও টেলিভিশনে নাটক করে গেছেন নিয়মিত। বুলবুল আহেমদের আরেকটি গুণ ছিল, তিনি কবিতা আবৃত্তি করতেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল বলিষ্ঠ ও সুদৃঢ়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, মঞ্চে ও টেলিভিশনে তিনি আবৃত্তি করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন চালু হওয়ার পর সেখানে তিনি নিয়মিত নাটক করতে শুরু করেন। টেলিভিশনে তাঁর প্রথম নাটক আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘পূর্বাভাস’। ‘ইডিয়েট’ নাটকটির জন্যে তিনি দর্শক হৃদয়ে আজও এক দুর্লভ স্থান অধিকার করে আছেন। যেকোনো নাটকে অভিনয়ের সময় বুলবুল আহমেদ নাটকের চরিত্রের ভেতর মিশে যেতেন।
বুলবুল আহমেদের স্ত্রী ফওজিয়া পারভিন ডেইজি। ছেলেবেলা থেকে দুজনে পরিচিত ছিলেন। দুজনের ভেতর ভালোলাগা থেকে ভালবাসা তৈরি হয়ে অবশেষে শেষ পরিণতিতে উপনীত হন তাঁরা। দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয় । বিয়ের কিছুদিন পর বুলবুল আহমেদ চট্টগ্রামে বদলি হন। দুজনে মিলে চট্টগ্রামে নতুন সংসার শুরু করেন। চট্টগ্রামে ব্যাংকের কাজের পাশাপাশি সেখানকার বেতারেও যোগ দেন বুলবুল আহমেদ। শুধু ঘোষক হিসেবেই নয়, তিনি বেতারের নাটকেও অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে তিন বছর কাটানোর পর আবার ঢাকায় বদলি হন। চাকরি, সংসার এবং অভিনয় সব কিছুই সুনিপুণ হাতে চালিয়েছেন তিনি। স্ত্রী ডেইজি সবসময় পাশে থেকে সহযোগিতা করেছেন। তাঁর এক ছেলে, দুই মেয়ে।
টেলিভিশনে বুলবুল আহমেদের নাট্যজীবন শুরু হয় নাট্যগুরু আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামের হাত ধরে। শুরুতে তিনি কিছু নাটিকায় অভিনয় করেন। অভিনেতা হিসেবে সত্যিকার অর্থে পথ চলা শুরু ১৯৬৮ সালে ‘পূর্বাভাস’ নাটকের মধ্য দিয়ে। ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘ইডিয়ট’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘তোমাদের জন্যে ভালোবাসা’, ‘তুমি রবে নীরবে’, ‘টাকায় কি না হয়’, ‘মালঞ্চ’, ‘হৈমন্তী’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘সারাদিন বৃষ্টি’, ‘রূপনগর’, ‘সারাবেলা’ এরকম প্রায় তিনশতাধিকেরও বেশি নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। জহির রায়হানের উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’-তে অভিনয় করে সবার নজরে আসেন তিনি। ‘কায়েসের’ চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করায় পরবর্তীতে জহির রায়হানের উপন্যাস নিয়ে করা সমস্ত নাটকে তিনি সুযোগ পেতে থাকেন। ‘দূরদর্শীনী’ নাটকে বুলবুল আহমেদের সাথে তাঁর স্ত্রীও সহশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের উদ্বোধনী দিনে নাটকটি প্রচারিত হয়।
সেসময় একমাত্র তিনিই ছিলেন এক নাটকে দুটি ভিন্ন সময়ে দুটি ভিন্ন চরিত্রে অভিনয়কারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হৈমন্তী’ নাটকটিতে শুরুতে অপুর ভূমিকায় এবং পরবর্তী জীবনে হৈমন্তীর বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’-তে অভিনয় করেও অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি, যা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী ভারত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। হুমায়ুন আহমেদের নাট্যগল্পে ‘শফিক’ চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। তাঁর অভিনয় এত ভালো হয়েছিল যে দীর্ঘদিন দর্শকদের মুখে তিনি শফিক নামে ঘুরে ফিরে আসছিলেন। ভারতে একটি নাটকের শুটিং-এ গিয়েছিলেন তিনি। তখন একটি বাড়ি থেকে এক মহিলা তাঁকে শফিক নামে ডেকেছিলেন। ১৯৯২ সালে বিটিভিতে ‘স্বপ্নের শহর’ নাটকে অভিনয় করে তিনি অনেক প্রশংসা কুড়ান। পরবর্তীতে প্যাকেজ নাটকের চল শুরু হলে সেসব নাটকেও সুনিপুণ শৈল্পিকতায় কাজ করেন তিনি। বিটিভির নাটকগুলোর মাঝে কিছু নাটকে মেয়ে ঐন্দ্রিলা আহমেদ এবং স্ত্রী ফওজিয়া পারভিন ডেইজিও অভিনয় করেন। সেসময় তিনিই ছিলেন সবচেয়ে উচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত শিল্পী।
আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম ছিলেন বুলবুল আহমেদের নাট্যগুরু। অভিনয়ের জানা অজানা নানা বিষয়ে গুরুর পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা পেয়েছেন তিনি। মঞ্চ থেকে মঞ্চে দৌড়ানোর সেই সময় গুরু তাঁর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন, যদি কখনও তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তবে সেখানে বুলবুল আহমেদকে অভিনয় করতে হবে। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেই ১৯৭৩ সালে ‘ইয়ে করে বিয়ে’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে রুপালি পর্দায় যাত্রা শুরু হয়। শুরুটা মোটেই সহজ ছিলনা। মঞ্চ, রেডিও, টিভি নাটকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে পরিবারের সকলের সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু রুপালি পর্দায় প্রবেশের সিদ্ধান্তে স্ত্রী ডেইজি বেঁকে বসলেন। কিছুতেই তাঁকে বোঝাতে পারছিলেন না। অবশেষে ডেইজির মা লতিফা খানের শরণাপন্ন হলেন বুলবুল আহমেদ। তিনিই বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালেন ডেইজিকে। বুলবুল আহমেদ স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন, শখের বশে একটি বা দুটি ছাড়া চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন না তিনি। টেলিভিশন নাটক ‘এপিঠ ওপিঠ’-এর চলচ্চিত্ররূপ ছিল এই ‘ইয়ে করে বিয়ে’। রুপালি পর্দায় প্রবেশের এই মাহেন্দ্রক্ষণেই তাবাররুক নাম বদলে শিষ্যের নাম পাল্টে ‘বুলবুল’ রাখলেন পরিচালক আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘অঙ্গীকার’-এ নায়ক হিসেবে অভিনয়ের পাশাপাশি কার্যনির্বাহী প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেন তিনি। এই চলচ্চিত্রেই কবরীর সাথে জুটি বেঁধে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এই জুটি পরবর্তীতে আরও অনেকগুলো কাজ করে প্রশংসিত হয়েছিল। দিন দিন অভিনয়ের নেশাটা বাড়তে থাকায় স্ত্রীকে দেয়া কথা আর রাখতে পারেননি বুলবুল আহমেদ। শখের অভিনয়, নেশা থেকে পেশায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। দশ বছরের ব্যাংকিং পেশা ছেড়ে দিয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে অভিনয়ে নেমে পড়েন। সেসময় ‘জীবন নিয়ে জুয়া’ সিনেমাটির মধ্য দিয়ে ববিতার সাথে জুটি বেঁধে দর্শক প্রিয়তা অর্জন করেন। এই জুটিটি আরও বেশ কয়েকটি সিনেমা একসাথে করেন। ১৯৭৬ সালে আলমগির কবির পরিচালিত ‘সূর্যকন্যা’ সিনেমাটিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জহির রায়হান পুরস্কার লাভ করেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হল- ‘রুপালি সৈকতে’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘মোহনা’, ‘মহানায়ক’, ‘পুরস্কার’, ‘সোহাগ’, ‘বৌরানী’, ‘ঘর সংসার’, ‘বধু বিদায়’, ‘ছোট মা’, ‘আরাধনা’, ‘সঙ্গিনী’, ‘সময় কথা বলে’, ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’, ‘শেষ উত্তর’, ‘স্বামী’, ‘ওয়াদা’, ‘গাংচিল’, ‘কলমিলতা’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দেবদাস’, ‘ভালো মানুষ’, ‘বদনাম’, ‘দুই জীবন’, ‘দিপু নাম্বার টু’, ‘ফেরারি বসন্ত’, ‘দি ফাদার’, ‘রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত’ প্রভৃতি। ইরান, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মত দেশে নিজের দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে ঘুরে এসেছেন তিনি। নিজ দেশের চলচ্চিত্র প্রতিনিধি হিসেবে গৌরব অর্জন করেন।
অভিনয় জীবনের এক প্রান্তে এসে বুলবুল আহমেদ চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। ‘অঙ্গীকার’, ‘জীবন নিয়ে জুয়া’, ‘ওয়াদা’, ‘ভালোমানুষ’, ‘মহানায়ক’ সিনেমাগুলো প্রযোজনা করেন তিনি। মহানায়ক তাঁর প্রথম একক প্রযোজনা, এই সিনেমাতেই তিনি বাংলাদেশ থেকে প্রথম শুটিংয়ের জন্যে বিদেশে গিয়েছেন ৩৫ জন কলাকুশলী নিয়ে। প্রথম চলচ্চিত্র পরিচালনা করে তিনি বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। ‘রাজলক্ষী শ্রীকান্ত’ পরিচালনা করে ১৩ টি শাখায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেন।
তাঁর পরিচালিত অন্যতম প্যাকেজ নাটকগুলো হল- ‘শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’, ‘মেঘে ঢাকা আকাশ’, ‘তুমি কি সেই তুমি’, ‘একটি প্রেমের জন্য’, ‘মন ছুঁয়ে যায়’, ‘চিরকুট’, ‘অনামিকা’, ‘অন্য মনে’, ‘পলাতক সে’, ‘অকারণে অবেলায়’, ‘বিলেতি বিলাস’, ‘নীলা নামের মেয়েটি’, ‘তৃতীয় পক্ষ’, ‘একা’, ‘এক ঝলক আলো’, ‘জীবন নদীর জোয়ার ভাটা’, ‘ঝরা পাতা’, ‘মানুষজন’, ‘আরাধনা’, ‘কোন গগনের তারা’, ‘ঋতু গৃহ’, ‘বৃষ্টি’, ‘চলে যায় বসন্তের দিন’, ‘ওরা তিনজন’, ‘ইয়ে নিয়ে বিয়ে’, ‘সুভা’, ‘একজন পৃথিলার কথা’ ইত্যাদি।
অভিনয়, প্রযোজনা এবং পরিচালনার পাশাপাশি উপস্থাপনা, বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশগ্রহণ এমনকি বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণেও সাবলীল ভূমিকা রেখেছেন বুলবুল আহমেদ।
সাংস্কৃতিক পরিসরে একাধিক ক্ষেত্রে বুলবুল আহমেদের সরব উপস্থিতি তাঁর নিজের একটি উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি তৎকালীন সাংস্কৃতিক মণ্ডলকে সমৃদ্ধ করেছিল।
শেষ সময়ে ডায়াবেটিকস ও হৃদরোগের পাশাপাশি কিডনির সমস্যায়ও ভুগছিলেন তিনি। অবশেষে ২০১০ সালের ১৫ জুলাই বুলবুল আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। এই কীর্তিমান অভিনেতা বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্র শিল্পের একজন দুর্দান্ত কর্মী ও কারিগর দুই রূপেই ভাস্বর হয়ে আছেন ও থাকবেন।
তথ্যসূত্র: ঐন্দ্রিলা আহমেদের লেখা বুলবুল আহমেদের জীবনীগ্রন্থ ‘একজন মহানায়কের কথা’। প্রকাশনী- বইপত্র, প্রকাশক-মাহবুবুর রহমান বাবু, প্রথম প্রকাশ- সেপ্টেম্বর, ২০১৩
লেখক : অনুপমা ইসলাম নিশো