পার্থ প্রতীম মজুমদার : নিঃশব্দ কবিতার কবি
পার্থ প্রতীম মজুমদার। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে মানুষ হয়েছেন। বড় হয়ে হয়েছেন মূকাভিনয় বা মাইমের এক অনন্য সাধারণ শিল্পী। ৩২ বছরের বেশী সময়ে ফ্রান্স প্রবাসী এই মাইম শিল্পী মাইমের বিচারে বিশ্বে দ্বিতীয়। যেখানে যান উজ্জ্বল করে আসেন বাংলাদেশের মুখ আর পতাকা। বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে মাইম প্রদর্শন করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেন পদ্মাপাড়ের এই ছেলে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদক ২০১০’ এবং ফ্রান্স সরকারের সংস্কৃতির সর্বোচ্চ সম্মান ‘শেভালিয়ের আর্ট ও লিটারেচার নাইট’ উপাধি লাভ করা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু আন্তর্জাতিক সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেছেন। আমৃত্যু তিনি মাইম ও পৃথিবীর বুকে তাঁর ছোট্ট দেশটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। সাধারণ জীবন যাপন আর শিল্পী জীবনের একটাই মাত্র স্বপ্ন তাঁর। বাংলাদেশের বুকে একটি পূর্ণাঙ্গ মাইম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার। বড় অভিমানী এই মানুষটির একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হলো।
জন্ম
১৯৫৪ সাল। বছরের শুরুটা ছিল আর পাঁচটা বছরের মতোই। পাবনা জেলার কেউ জানতো না। বাংলাদেশের কেউ জানতো না। এমনকি ফ্রান্সেরও কেউ জানতো না একজন শিল্পীর সম্ভাব্য আগমনের কথা। একজন মা শুধু জানতেন। তিনি চিনতেন তাঁর সন্তানকে। তবে শিল্পী হিসেবে নয়। তার চেয়েও বড় জাদুকর, বড় শিল্পী, যে তার হাসি দিয়ে মুছিয়ে দিতে পারে অন্তরালের সমস্ত দুঃখ। আর একজন প্রেস ফটোগ্রাফারও জানতেন। এই জানাও শিল্পী হিসেবে নয়। সফর সঙ্গী হিসেবে। এবাড়ি ওবাড়ি ছবি তোলার সময় তাঁর ধুতি-পাঞ্জাবী ধরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আর একজনের পৃথিবীতে আগমন ঘটতে চলেছে। অবশেষে সেই দিন এলো। সেই বছরের জানুয়ারী মাসের ১৮ তারিখে পাবনা জেলার কালাচাঁদপাড়ায় পার্থ প্রতীম মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মায়ের তিনি দ্বিতীয় সন্তান। মা ছিলেন সুশ্রিকা বিশ্বাস আর হিমাংশু কুমার বিশ্বাস ছিলেন তাঁর বাবা। ভাই বোনের সংখ্যা ছিল চারটি। তিনি ছাড়া ছোটবড় আরও তিনটি ভাই আর চার ভাইয়ের একটি মাত্র বোন।
নামে বেনামে পার্থ প্রতীম
ছেলে একটা জন্মালো বটে কিন্তু একেবারেই লিকলিকে। তালপাতার সেপাই। ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। ছেলের দিকে তাকালেই মায়ের মন মায়ায় ভরে যায়। আহা বেচারা, মানুষের স্বাস্থ্য এতো খারাপ হয়। অনেকেই ধারণা করেছিলেন যদি দুটো ডানা নিয়ে এ ছেলে জন্মাতো তাহলে উড়ে বেড়াতে এর কোন অসুবিধাই হতোনা। ঠাম্মার ধারণাও এর কিছু ব্যতিক্রম নয়। তাই তিনি পার্থকে ডাকেন ফুরফুরি বলে। ফুরফুরি হচ্ছে ফড়িং। এ ঘাস থেকে ও ঘাসে উড়ে বেড়ায় যে, পার্থ হলেন ঠাম্মার সেই ফড়িং। বাবার চিন্তা ছিল অন্য রকম। চিন্তাটা কোন অংশে দুশ্চিন্তার কিছু কম নয়। এই তালপাতার সেপাইটার গায়ে গতরে কি কোনদিন মাংস লাগবে? তার উপরে মা যদি তাকে ফুরফুরি ডাকেন তাহলে তো আর আশাই নেই। একদিন সাহস করে মাকে তিনি বলেও ফেললেন সেই কথা। তাঁর মা, ফুরফুরির ঠাম্মা, বললেন, ‘তুই তবে নাম ঠিক করে দে।’ নাম ঠিক হলো। মহাভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্রের নামে নাম- ভীম। বিষয়টা অনেকটা কানা ছেলের নাম পদ্মলোচনের মতোই। তারপরেও বাবার আশা নামের কারণে যদি ছেলের গায়ে একটু মাংস লাগে। সেই থেকে তিনি ভীম। পাবনার কালাচাঁদপাড়ার সবাই এই নামেই তাঁকে ডাকে। তাঁর বাবা মা ঠাম্মা আর বন্ধুরা সব্বাই। আরও একটা নাম কিন্তু তাঁর ছিল। সেটা প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস।
শৈশবের জানালা
পাবনার কালাচাঁদপাড়াই পার্থর প্রথম স্কুল। বাড়ি থেকে মাত্র দু’তিনটি বাড়ি পরে ছিল জুবলী ট্যাংক নামে একটা বিশাল পুকুর। আর পুকুরের পাশেই জুবলী স্কুল। সেখানেই পড়াশোনার প্রথম পাঠ। এমন কিছু ভালো ছাত্র নয়। তারপরেও ক্লাসরুমের ফাস্ট বেঞ্চটা ছাত্রের খুব পছন্দের। ঐটাই পার্থকে স্কুলে টানতো। অন্য কিছু নয়। আর তাই রোজই এটা ধরা তাঁর চায়ই। ঘুম থেকে উঠেই এর বাড়ির উঠোন আর ওর বাড়ির বাগানের ভেতর দিয়ে চলে যেতেন সকালের স্কুলে। অন্য বাড়ির ছেলেরা তখনও হয়তো স্নান সারেনি, খাওয়া সারেনি। অথচ ঐদিকে বইখাতা রেখে পার্থ ফাস্ট বেঞ্চ দখল করে বসে আছেন।
এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার ঘটনাটাও ছিল একটু অন্য রকম। বাবা নিয়ে গেছেন দাদাকে স্কুলে ভর্তি করাতে। দাদা বাবার সাথে সাইকেলে চড়ে স্কুলে গেল। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলো আর ফিরে আসলো পেছনের ক্যারিয়ারে বাঁধা একটা মস্ত বড় মিল্ক পাউডারের কৌটো নিয়ে। তখন স্কুলে ভর্তি হলে একটা করে মিল্ক পাউডারের কৌটা পাওয়া যেত। কিন্তু কৌটা যেটা পাওয়া গেল সেটাতো দাদার। তাতে তো তাঁর কোন অধিকার নেই। তাই তিনি আছড়ে বিছড়ে শুরু করলেন কান্না, তাঁকেও স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু তখনওতো তাঁর স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি আর মিল্ক পাউডারের কৌটার টান উপেক্ষা করার মতো বয়সও হয়নি। তাই কান্না আর থামেনা। তিনিইবা কি করবেন, কান্নার উপরে তাঁর নিজেরতো কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলনা। অগত্যা বাবাকে আবার সাইকেলে চড়তে হলো। তবে এবার মেজ ছেলেকে নিয়ে। পার্থ স্কুলে ভর্তি হলেন আর মিল্ক পাউডারের বিরাট একটা কৌটা জয় করে হাসি মুখে বাড়ি ফিরে এলেন। তারপর থেকে স্কুলে যেতেন। পড়াশুনা তেমন কিছু নয়। শুধু ছোট ছোট বেঞ্চ আর ক্লাসে গিয়ে বসে থাকা। এটা ছিল প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা।
স্কুল থেকে মিল্ক পাউডার জয় করে আনার পর সেটা চলে যায় মায়ের হেফাজতে। দাদারটাও, তাঁর নিজেরটাও। এই পাউডার বেশি খেলে পেট খারাপ হতো বলে তখনকার মায়েরা বাচ্চাদেরকে বেশি খেতে দিতেন না। তাই মা ওগুলোকে ছো মেরে নিয়ে রান্নাঘরের কাঠের আলমারিতে লুকিয়ে রাখলেন। ভাইবোনগুলো, পুরো দলটাই অতো ভালোমন্দ বোঝেনা, বুঝতে চায়ও না। তারা শুধু তক্কে তক্কে থাকে। মা কখন ঘুমোবেন। মা ঘুমোন আর ভাইবোনেরা নেমে পড়ে অভিযানে। কাঠের আলমারি থেকে সেই পাউডার চুরি করে রাখা হতো খাতা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া পাতায়। সেইসাথে কিছুটা চিনিও চুরি করে নেওয়া হতো। তারপর পুরো দলটি চলে যেত জুবলী ট্যাংক পুকুর পাড়ে। সেখানে বসেই খাওয়া হতো। আর তারপরে ধরা পড়ার ভয়ে পুকুর পাড়ে চলতো ভাইবোনদের কুলকুচি। বাড়ি ফিরলে কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে পারতো না।
চার ভাইবোন একসঙ্গে খেলতেন। হাডুডু, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ডাংগুলি, চাকা চালানো, মার্বেল এসবের কোন কিছুই বাদ যায়নি খেলার তালিকা থেকে। মেয়েদের সাথে (এক্কা দোক্কা) খেলেছেন। শৈশবে মেয়েদের সাথে সখ্যতা তাঁর তাই কম ছিলনা। দুপুর বেলা মা ঘুমিয়ে পড়লে বাড়ি থেকে চাল ডাল তেল লবণ চুরি করে চলে যেতেন বাগানে। দুপুরের অন্যান্য বাড়ি থেকে মেয়েরা আসতো। আর বাগান থেকে আসতো শুকনো কাঠ আর পাতা। সবাই মিলে পিকনিক হতো। মেয়েরা খিঁচুড়ি রাঁধতো। কলা পাতায় খাওয়া দাওয়া হতো। দুপুর বেলা একথালা ভাত খেয়ে এসেই এই চুরি করে রান্না আর আবারও খাওয়া। ভালো লাগতো খুউব। সেই দুপুর কন্যাদের হাতের রান্নার স্বাদ মায়ের হাতের চেয়েও ভালো ছিল। তবে কি মায়ের রান্না খারাপ হতো। না, তাও নয়। ঐ রান্নাটা নয় বরং চুরি করে খাওয়াটাই সব কিছুর স্বাদ বাড়িয়ে দিত।
ফুরফুরি থেকে ততদিনে ভীম হয়ে গেছেন। কিন্তু উড়োউড়ি থামেনি। পাশের বাড়ির নারকেল গাছে তরতর করে উঠে যান। আর ঐ কোন মাথা থেকে ম্যাজিশিয়ানের মতো নারকেল পেড়ে আনেন। বৌদিরা দেখে, পাড়ার মেয়েরা দেখে। পাড়ার দাদাদিদিরা অনুরোধ নিয়ে আসে, মগডাল থেকে আম পেড়ে দিতে হবে। ঐ অতো ওপর আর সরু ডালে সমস্ত কালাচাঁদপাড়ায় আর কেইবা উঠতে পারে একমাত্র ভীম ছাড়া। তারতো শুধু নামই বদলেছে। চেহারাতো বদলায়নি কিছু। অনুরোধ রাখতেন। আম পেড়ে দিতেন। সেই আম কুঁচিয়ে শুকনো লঙ্কা আর লবণ দিয়ে পাড়ার দাদারা খেত, দিদিরা খেত। তাঁকেও হিস্যা দিত। কিন্তু এতো টক। বেশি খেতে পারতেন না। ফলে দাদাদিদিদের ভাগে কিছু কম পড়তো না। আর তাই অনুরোধগুলো ঘুরে ঘুরে আসতোই। ভীম নিজের জন্য যে যে গাছে উঠতো তার ভেতরে পেয়ারা, জাম, জামরুল আর সফেদা গাছ অন্যতম। এসব গাছেরতো আর কমতি ছিলনা। সমস্ত গাছেই ফলগুলো আনন্দ হয়ে ঝুলে থাকতো। ভীম সেই আনন্দ পেড়ে আনতেন। আর তাঁর লিকলিকে শরীর ছিল তাঁর প্রধান হাতিয়ার।
দাদু বাড়ী ছিল পাবনা শহরের সবচেয়ে বড় ঠাকুর বাড়ী। দাদু বাড়ির রথযাত্রাও হাজির হতো আনন্দের এক বিশাল চিত্র নিয়ে। রথের চারকোনায় চারটে মুর্তি। তার পাশে যে প্লাটফর্ম পার্থ সেখানে দড়িওয়ালা হাফপ্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। রথ চলতো আর রথের পেছনে পেছনে ভেঙে পড়তো পৃথিবীর সমস্ত মানুষ। অত ভীড়তো আর কোথাও কিছুতে হতোনা। শৈশবে তাই ঐ ভীড়ই ছিল পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ভীড়। সেই ভীড়ের ভেতর থেকে মানুষ রথের উপরে পান, চিনি আর বাতাসা ছুড়ে মারতো। পার্থ মানুষের সেই ভালোবাসা আর ভক্তি রথের উপর বসে বসে কুড়োতেন। আর যাত্রা শেষ হলে একটা ছুট লাগাতেন। বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষের সেই ভক্তি আর ভালোবাসা খেয়ে ফেলতেন। সেই আনন্দ পৃথিবীর কোন দোকানে বিক্রি হয়না।
মা সুশ্রিকা বিশ্বাস গান গাইতে ভালবাসতেন। ভজন গাইতেন। নিজেই গাইতেন, কোন ওস্তাদ ছিলনা। বাড়িতে হারমোনিয়াম ছিল। ভাইবোনদের প্রতিদিন সেটা বাজানোর নিয়মও ছিল। কেউ মানতো না। পার্থ শুধু মাঝে মাঝে বাজাতেন মায়ের সাথে। কোন নিয়মের জন্য নয়। বাজাতে তাঁর ভালো লাগতো। এতে একটা সুবিধাও পেয়ে যান তিনি। বাড়ির সমস্ত কিছুইতো ছিল মায়ের অনুশাসনে। চালের ড্রামের পাশে ভাইবোনদের নাম লেখা আলাদা আলাদা বেত ছিল। সন্ধ্যায় পড়তে বসলে বা কেউ কথা না শুনলে সেই বেত চালের ড্রামের পাশ থেকে বেরিয়ে আসতো। তারপর নাম অনুযায়ী যে যার জায়গা খুঁজে নিত। মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম ধরে ধরে সা রে গা মা করার কারণে পার্থ বেঁচে যেতেন।
জুবলী স্কুলের টিফিন টাইমটা ছিল অন্যরকম। সে সময়টায় পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকর্তা ছিলেন আইয়ুব খাঁন। তাঁর মনে হয়েছিল এদেশের দুবলো-পাতলা ছেলেদের স্কুল থেকে কিছু খাওয়া টাওয়া দেয়া দরকার। তাঁরই নির্দেশে সে সময়ে বিধান হলো দুপুরে স্কুলে ছেলেদেরকে রান্নাকরা খিঁচুড়ি দেওয়া হবে। মোটামোটা বুটের ডাল আর মোটা চালের সেই খিচুড়ি খাওয়ার জন্য লম্বা লাইন। কাঠফাটা দুপুরের রোদে স্কুল মাঠের লম্বা লাইনটা চলে গেছে একটা মস্তবড় আমগাছ তলায়। সেখানে দুইজন বাবুর্চি ডেক থেকে একটা থালার সাহায্যে খিঁচুড়ি তুলে লাইনে দাঁড়ানো ছাত্রদেরকে দিচ্ছে। দু’চারজন শিক্ষকও থাকতেন গাছের ছায়াটায়। ড্রিল স্যার বাঁশি আর বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিছুক্ষণ পরপর বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে চিত্কার করে উঠতেন, ‘এই লাইন সোজা কর্, এই ঠিকমতো দাঁড়া, এই পেছন থেকে লাইন ঠেলছে কারা।’ আর ছাত্রদের কেউ কেউ সেই খিঁচুড়ি খাওয়ার জন্য বাসা থেকে থালা আনতো। এক হাতে তাদের বই খাতা ধরা থাকতো আর অন্য হাতে থালা। ভীমের বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, ওখানকার খিঁচুড়ি না খেয়ে যেন বাড়িতে এসে খাওয়া হয়। ওখানে ভাতের ভেতর কি পোকা মাকড় না কি খেয়ে আসবে। ভীম তাই রোজ কাগজ পেঁচিয়ে ঠোঙা বানিয়ে চলে যেত লাইনের একদম সামনে। আর খিঁচুড়ি নিয়েই এবাড়ির উঠোন আর ও বাড়ির বাগানের ভেতর দিয়ে চলে আসতো নিজেদের বাড়িতে। স্কুলের দু’তিন ঘর দূরেই বাড়ি। খিঁচুড়ি নষ্ট হতোনা। গরমই থাকতো। সেই খিচুড়ি খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতো ছোট ভাই রূপকুমার। দুপুরের ঘুম নষ্ট করে দাঁড়িয়ে থাকতো জানালার পাশে। মোটা রড দিয়ে বানানো জানালার শিক। সেখান থেকেই মুখ সে বাড়িয়ে দিল। আর ওমনি তার ভীম দাদা হাত বাড়িয়ে দিল। সেই হাতে খিঁচুড়ির প্রায় গলে যাওয়া ঠোঙা। রূপকুমার খাচ্ছে। সেই গরম খিঁচুড়ি রূপকুমারের শরীরে লেগে শুরু হলো জ্বলাপোড়া। রূপকুমার লাফাচ্ছে, ‘দাদা জ্বলে গেল।’ দাদা বলছেন, ‘যা জল দিয়ে ধুয়ে আয়।’ রূপকুমার গেল জলের কাছে আর তার জানালা ধরে দাদা দাঁড়িয়ে আছেন রূপকুমারের ফেরার অপেক্ষায়। এই রকমই চলতো প্রতিদিন। প্রতিটি দুপুর বেলায়।
দুই ভাই এর ভেতরে এই বোঝাপড়া হয়ে গেছে অনেকদিন। এক ভাই সেই দুপুরের রোদ, লম্বা লাইন, আর এর বাড়ির বাগান ওর বাড়ির উঠোন ঠেঙিয়ে একটা জানালার কাছে এসে দাঁড়াবে। আর সেখানে একজন আগে থেকেই দুপুরের ঘুম কামাই করে বসে আছে দাদার অপেক্ষায়। দুই ভাইয়ের সখ্যতা দেখে দুপুরের চড়াই আর শালিখেরা উঠোন আর চৌকাঠ থেকে উড়ে এসে গাছে গাছে বসে যায়। বাড়ির কেউ জানেনা। এমন ছোটখাট দু একটা অপরাধের কথা বাড়ির বড়দের না জানলেও চলে। এরকম ভাবেই প্রতিটি দুপুর আসে দুই ভাইয়ের জীবনে। আরো আসতো। কিন্তু একদিন দেখে ফেললেন পাশের বাড়ির জ্যোত্স্না পিসি। তিনি হিমাংশু কুমার বিশ্বাস এর চারটি ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন মাতৃ স্নেহে। রূপকুমার অনেকদিন পর্যন্ত জানতো উনিই, মায়ের বয়সী ঐ জ্যোত্স্না পিসিই ওর মা। এই পিসিই দুজনের কীর্তিটি সবার আগে দেখে ফেললেন। আর দেখেই তাঁর কি চিত্কার। ‘এই ভীম তুই কি সব বিষ খাওয়াচ্ছিস’। ভীম দিল দৌড়। জানালার পাশে আর কেউই নেই। না এপাশে ভীম অথবা অন্যপাশের ছোটভাই রূপকুমার। অথচ পিসির চিত্কার আর থামেনা। চিলের ডানায় ভর করে নেমে আসা সেই দুপুর, বড়দের বেলায়, বড়দের জীবনে বোধহয় আসেনা কোনদিন।
নিচের তলায় তিন ভাই একসঙ্গে ঘুমোতেন পার্থরা। একরাত্রে ঘুম ভেঙে গেল জলের পিপাসায়। জল খেতে উঠলেন তিনি। বাবার ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে গেল একটা সার্ট, বাবার, ঝুলে আছে আলনায়। সার্টের সাথে একটা পকেটও লাগানো আছে আর সেখান থেকেই খুচরো পয়সাগুলো দুর্বার আকর্ষণে তাঁকে টানতে লাগলো। সেই টান উপেক্ষা করা বড় কঠিন। বাবার পকেট থেকে পার্থর হাতের ভেতর আসতেই পরদিন তারা নাড়ু আর বাদাম হয়ে ফুটে উঠলো। বাড়িতে তো নাড়ু সব সময়ই হচ্ছে, কিন্তু দোকানের মতো নাড়ু তো আর কোন বাড়িতে কোনদিন বানানো যায়নি। তাই বাইরের খাবার কিনে খাওয়ার টানটা ফুটতে লাগলো রাত্রির পিপাসা হয়ে। প্রতি রাতেই পিপাসায় ঘুম ভেঙে যায় আর বাদামওয়ালার রেগুলার কাস্টমারের খাতায় নাম ওঠে ভীমের। শুধু বড় ভাইয়ের হিসেব মেলেনা কিছুতেই। ভীম এতো পয়সা পায় কোথা থেকে। যখনই তার সাথে দেখা হচ্ছে তখনই কিছু না কিছু তার মুখে। বাবার কাছে নালিশ গেল। বাবা মুচকি হেসে বললেন, ‘বাদ দে’। বাবা আসলে অনেকদিন ধরেই জানতেন। কিন্তু বড় ভাইটি আর বাদ দিতে পারেনা। সারাক্ষণ ভীমের পেছনে তার ছোক ছোক। অবশেষে একটা রফা হলো। যা কেনা হবে তার আধাআধি ভাগ হবে। এই আপস রফায় দুই ভাইই সন্তষ্ট।
ফটোগ্রফার বাবা
বাবা হিমাংশু কুমার বিশ্বাস ছিলেন প্রেস ফটোগ্রাফার ও প্রচন্ড সংস্কৃতিমনা। পাবনা শহরের যে কোন সাংকৃতিক কর্মকান্ডের সাথে সে সময় জড়িত ছিলেন। পাবনা শহরেই তাঁর স্টুডিও ছিল। তত্কলীন পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে তিনি ফটোগ্রাফি ও সাংবাদিকতার কাজ করতেন। আগফা, গেভার্ট, ইলফোর্ট ইত্যাদি ফ্লিম কোম্পানির সাথেও তাঁর ভালো যোগাযোগ ছিল। এখানে উল্লেখ্য বিশ্বখ্যাত আগফা-গেভার্ট কোম্পানি ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একমাত্র তাঁকে কালার ফটোগ্রাফিতে ট্রেনিং দেবার জন্য বেলজিয়াম ও জার্মানিতে নিয়ে যায়। তাঁর একটা সাইকেলও ছিল। সেই সাইকেল নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়তেন দূর দূরান্তে ছবি তোলার কাজে। ভীম মাঝে মাঝে বাবার সফর সঙ্গী হতেন। বাবার সাথে সাইকেলে চড়ে দূরে যাওয়ার আনন্দতো ছিলই। বাড়তি পাওনা হিসেবে পাওয়া যেত বাইরের খাবার। কোন বাড়িতে ছবি তুলতে গেলে তারাতো খাবার দিতই আর দোকানের খাবারের স্বাদও খুব খারাপ ছিলনা। আর বাবার সাথে বেরুলে সেই বেলা আর পড়তে বসতে হতোনা। ফলে ফটোগ্রফার বাবার সফর সঙ্গী হতে বেশ আগ্রহই বোধ করতেন তিনি।
জীবনের প্রথম স্টেজ
পাবনাতে বনমালী ইন্সটিটিউট নামে একটা থিয়েটার ছিল। বাবা হিমাংশু কুমার বিশ্বাস ছিলেন সেখানকার সদস্য। ফলে ওরা যে সমস্ত আয়োজন করতো তার সবগুলোই পরিবারের সবাই মিলে দেখতে যেতেন ভীম। ওরা একদিন করল ”আলী বাবা চল্লিশ চোর”। আলী বাবা চিচিং ফাঁক বলে আর শব্দ করে দরজা খুলে যায়। সেই সন্ধ্যায় ভাইবোনেরা সবাই মিলে বাড়িতে ফিরে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে চিচিং ফাঁক বলে আর মুখ দিয়ে দরজা খোলার আওয়াজ করে। একদল ভাইবোনের সম্মিলিত চিচিং ফাঁক উচ্চারণে অদৃশ্য দরজা খুলে যায়। এরপর সাহস যখন আর একটু বাড়লো তখন মায়ের শাড়ি চুরি করে মশারির স্ট্যান্ডে বেঁধে গোল করে ঘিরে দিলেন। সব ভাইবোন মিলেই করলেন। এটাই ছিল ভীম-এর জীবনের প্রথম স্টেজ। মায়ের শাড়ীর গন্ধমাখা স্টেজ। এভাবেই ভাইবোনোরা মিলে থিয়েটার থিয়েটার খেলতেন। কোনকোন দিন সারাদিন ধরে এই খেলা চলতো।
”এই মধুর স্মৃতি ধরে রাখুন”
ভীম চলেছে হামাগুড়ি দিয়ে। সে হলো রাজচক্কোতির ঘোড়া। আর তার পিঠের ওপর স্বয়ং রাজা মহাশয়। জরীর পোষাক নেই। পেছনে লোক লস্কর নেই। একদম উলঙ্গ রাজা। ‘এই সর, আমার ঘোড়া ডাইনে যাবে’। গাড়োয়ানের মতো রাজা নিজেই হাক ছাড়েন। এই রাজা হচ্ছেন ভীমের ছোট ভাই, রূপকুমার। ছবিটি তুলেছিলেন ভীম-এর বাবার স্টুডিওর কোন কর্মচারী। ভাই দুটির কিন্তু মডেল হওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিলনা। দুই পয়সার মডেলের চেয়ে উলঙ্গ রাজা অথবা রাজার ঘোড়া হওয়াও অনেক সুখের। সেই সুখের আলো জানালা দিয়ে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অনেকখানি। তারই কিছুটা অংশ ক্যামেরা বন্দী করে নিয়ে যান বাবার সেই কর্মচারী। আর সেটাই হয়ে যায় বাবার স্টুডিওর ব্যবসায়িক সিম্বল। পাবনার দুটো সিনেমা হলে বিরতির সময় সবাই যখন আলো জ্বেলে সিটের ছারপোকাগুলোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে অথবা কেউ কেউ নায়ক নায়িকার বেদনায় ভারাক্রান্ত। আর কিছু মানুষ গিয়েছে বিড়ি ফুঁকতে। বিড়ি শেষ না করে তাঁদের আসার কোন রকম ইচ্ছেই নেই। ঠিক সেই সময়ে হলগুলোতে বিজ্ঞাপনী স্লাইড চলতো। সেই স্লাইডগুলোর ভেতর এই উলঙ্গ রাজা আর তাঁর হাফপ্যান্ট পরা লিকলিকে ঘোড়ার ছবিটিও ঠাঁই করে নেয়। ছবিটির নিচেই একটু ফাঁক দিয়ে লেখা ছিল কথাটি। ”এই মধুর স্মৃতি ধরে রাখুন”। রূপছায়া স্টুডিও, পাবনা।
অভিনয়ের শুরু যেখান থেকে
একটা ভিখারী এসেছে বাড়িতে। ‘মাগো দুইটা ভাত দ্যান।’ আর একটা লিকলিকে ছেলে ঘুরছে ভিখারীর পেছন পেছন। থেকে থেকে ভিখারীর চেয়েও বিকৃত স্বরে চিত্কার করছে। ‘মাগো দুইটা ভাত দ্যান’। সেই বিকৃত স্বর ভেসে বেড়াচ্ছে ভেতরের বাড়ির বাতাসে বাতাসে। মা ছুটে আসেন। ‘ভীম, এরা গরীব মানুষ না। গরীবদের সাথে এই রকম আচরণ করতে আছে।’ ভীম লাঠির ভয়ে ছুটে পালান। আর মা চলে যান ভেতরের ঘরে। ভিখারী ফিরে যায়। শুধু তার ভাত চাওয়ার ভঙ্গিটি রেখে যায় একজনের কাছে। কালাচাঁদপাড়ার মাটির রাস্তা ধরে ছুটতে ছুটতে সেই ভঙ্গিটি, সেই ভাত চাওয়ার করুণ আকুতি ফিরে আসে। অন্দর মহলের মা আর বাহির মহলের ভিখারী জানতেও পারেনা। হতে পারে এটাই পার্থর অভিনয় জীবনের প্রথম পাঠ।
বিরতির সময় ঐ যে ঘোড়াসহ রাজার যে ছবি, তার স্লাইডগুলো সিনোমা হলগুলোতে চলে, এ কারণে ভীম বেশ কিছু সুবিধা পেয়ে যান। রাজার ঘোড়া হওয়ার সুবাদে সিনেমা হলগুলোতে তাঁর অবাধ যাতয়াত। দু’আনা চার আনা টিকিটের পয়সা জোগাড় হলেই শুক্রুবারের ম্যাটিনি শো দেখে আসতেন। একা ফিরতেন না কখনই। সিনেমার চরিত্রগুলোও তাঁর সাথে সাথে হল থেকে চলে আসতো। সেগুলো খুব একটা শান্তও ছিলনা। তারা তাঁকে দিয়ে লাঠি কেটে তলোয়ার বানাতে বাধ্য করতো। মাথায় গামছা দিয়ে পাগড়ি বানাতে বলতো। বেচারা পার্থ চরিত্রদের জিম্মি হয়ে যেতেন। আর তাদের কথা মতোন কাঠের তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন ভাইবোনদের উপর। তিনি তখন ভীম নন। প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাসও নন। যুদ্ধ ফেরত সাহসী সৈনিক। নোঙর করা জাহাজের নাবিক। অথবা কোন যুদ্ধ জয়ী পরাক্রমশালী সেনাপতি। এই রাগী সেনাপতির আক্রমণ আর ভাইবোনদের দুর্বল প্রতিরক্ষা। এটাও হয়তো অভিনয়েরই প্রথম পাঠ।
সেসময় পাবনাতে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে হাজরা ও গাজন নামে একটা অনুষ্ঠান হতো। একদল লোক ছিলেন, যারা সারা মাস ধরে সন্নাস গ্রহণ করতেন। আর যারা ধনী তারা ঐ চৈত্রসংক্রান্তি দিনে, রাতের বেলায় বাড়িতে মাদুর বিছিয়ে দিত, হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে দিত। হ্যাজাকের আলোয় রাজ্যের পোকা এসে জুটলো। আর অন্যদিকে পাড়ার লোক ভেঙে পড়েছে ধনীর বাড়িতে। তার ভেতর থেকে ঢোল করতাল বেজে চলেছে। বাজিয়ে আর সাধারণ মানুষ বসে আছে গোল হয়ে। মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেই জায়গা জুড়ে নিয়েছে আর একদল লোক। তারা শিল্পী। তারা নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করে শিবপার্বতী আর রাঁধাকৃষ্ণ এর কাহিনী উপস্থাপন করতো।সেই শিবপার্বতী আর রাঁধাকৃষ্ণও ঐ হ্যাজাক লাইটের আলো ছেড়ে, একদল ছেলেবামুন আর ধনী লোকের পেতে দেওয়া মাদুর ছেড়ে ভীমের হাত ধরে চলে এসেছে। এসেই কিন্তু থেমে থাকেনি। তাঁরাই, ঐ রাত্রির বাড়ি থেকে চলে আসা শিব আর কৃষ্ণ ঠাকুর প্রেমিক হয়ে দিন কতক হিমাংশু কুমারের ঘরদোরে পড়ে থাকলেন। সবাই হেসেই বাঁচেনা। এই ছেলে বড় হয়ে ঠিক কি হবে অনুমান করতে কারো অসুবিধা হয়না। কিন্তু এবাড়ির ছেলেরা কি আর ঐসব হয়। ওরা হয় ডাক্তার। সেটুকুও যদি কেউ না হতে পারে তবে ইঞ্জিনিয়ার হলেও চলবে। তাই-ই হয়ে থাকে। তাই আজকে যখন কৃষ্ণ ঠাকুর হয়ে সকলকে হাসিয়ে বেড়াচ্ছে তা বেড়াক না। ছেলেপুলের শখ। ভীমটা পারেও ভালো। কৃষ্ণ ঠাকুরকে দেখে এর আগে এমন করে কেউ বোধহয় হাসেনি।
বনমালী ইন্সটিটিউট প্রতি বছরে অনেকগুলো অনুষ্ঠান করতো। সেখানে কালাচাঁদপাড়া ছাড়াও পাবনা শহরের অধিকাংশ হিন্দু মেয়েরা গান গাইতে আসতো। অল্প কয়েকটি মুসলমান মেয়েও ছিল। তারা সবাই মিলে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করলো তো নজরুলের জন্মবার্ষিকীও পালিত হচ্ছে। সেইসব অনুষ্ঠানে ভীম যেতেন মায়ের সঙ্গী হয়ে। আর ইফা সঙ্গীত একাডেমী নামে গানের যে স্কুলটা পাবনাতে ছিল সেখানেও তিনি যেতেন। ছাত্র হয়ে। ‘কত রাজপথ জনপদ ঘুরেছি’, ‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা’ এগুলো ছিল তাঁর প্রথম জীবনের গান। ঘুরে ঘুরে সুর করে এই সমস্ত গানই গাইতেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে। সেই গানের চর্চা এখন আর তেমন নেই ঠিকই কিন্তু শিল্পী হয়ে উঠতে চাওয়ার বীজ হয়তো, কে বলতে পারে বপিত হয়েছিল ‘ইফা সঙ্গীত একাডেমীর’ মতো একটি অখ্যাত সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই।
তখনকার দিনে মায়েরা বাড়ির সব কাজ শেষ করে সন্ধ্যার দিকে সিনেমা হলে যেতেন ছবি দেখতে। বাড়ির কাছেই সিনেমা হল। আর সারা জীবনে একটু একটু করে জমানো দুঃখগুলোকে চোখের জলে প্রকাশ করতে আর কারো সাহায্যের দরকার ছিল। সেই সাহায্য নিয়ে পরিত্রাতা হয়ে আসতো উত্তম-সুচিত্রা জুটি। আবার কারো হয়তো তেমন কোন দুঃখই নেই, কিন্তু উত্তম আর সুচিত্রার দুঃখে তিনি তিনদিন ঘুমোতে পারেননি। কাজ করছেন, এই পটলটা কুটে রাখলেন খালি গামলায় বা চাল ধুয়ে চলেছেন এর ভেতরেই মনে পড়ে গেল একটি মুখ। মহা নায়ক উত্তমকুমারের মুখ। কী ক্লান্ত, কী বিষন্ন সেই মুখচ্ছবি। চোখ ভেঙে জল আসছে। আহা বেচারা, এতো করেও মনের মানুষের দেখা পেলনা। সিনেমা চলছে, আর সন্ধ্যা হলেই হলগুলো ভেঙে পড়ছে মায়েদের ভীড়ে। পাবনার দুটি মাত্র হল। তাদের দোতলাটা লেডিসদের জন্য। মায়েরা সেখানে যান ছবি দেখতে। ছোট হওয়ায় ভীমও মায়ের আঁচল ধরে চলে যান ছবি দেখতে। গিয়ে মায়ের পাশে, অন্য একটা লেডিস সিটে বসে থাকেন তিনি। দুঃখভারাক্রান্ত নায়ক সমস্ত পর্দা জুড়ে গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়ান। শিশুটি কি এই মহানায়কের মহাদুঃখটি বোঝে? সে বিচারের ভার অন্যান্য গবেষকদের। আমরা শুধু জানি সেই সিনেমা হলের লেডিস সিট আর মায়েদের চোখের জল অথবা একটা ভিখারীর ভাত চাওয়ার আকুতির ভেতরই লুকিয়ে ছিল আমাদের ভব্যিষত্ প্রজন্মের শিল্পী।
কলকাতার পথে
সুধাংশু কুমার বিশ্বাস ছিলেন ভীম-এর একমাত্র কাকা। তাঁর ডাক নাম নব। নব কাকা মানুষ হয়েছেন পার্থ প্রতীম এর বাবা হিমাংশু কুমার বিশ্বাস-এর ছত্রছায়ায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি কলকাতায় চলে যান চাকুরী করতে। সেখানকার জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে তিনি চাকুরী করতেন। সেখান থেকে যখন ফিরলেন তখন তাঁর মুখে শুধু কলকাতার গল্প। কলকাতার অমুক ভালো, তমুক ভালো। বাবা বললেন, ‘ছেলে দুটোকে তবে মানুষ করার দায়িত্ব নে নব। ওরা কলকাতায় পড়াশোনা করলে দেশে এসে অনেক ভালো কিছু করতে পারবে।’ তখন, সেই পাকিস্তান আমলে এফ ক্যাটাগরি ভিসায় ইন্ডিয়াতে পড়াশোনা করা যেত। কাকা দায়িত্ব নিলেন। পার্থ তখন সবে প্রাইমারী পড়াশুনা শেষ করেছেন। এক পবিত্র দিন দেখে পার্থ আর বড়দা’ দুজনে মিলে চলে এলেন কলকাতায়। সেই শহর থেকে আরও বাইশ কিলোমিটার দূরের এক সময়ের ফরাসী কলোনী। নাম চন্দন নগর। সেখানেই শুরু হলো দুই ভাইয়ের নতুন জীবন। পার্থ এখানকার ড. শীতল প্রসাদ ঘোষ আদর্শ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ক্লাস সিক্সে পাবনার কালাচাঁদপাড়ার সেই পরম প্রিয় শহরখানি ছেড়ে, মা আর বাবাকে ছেড়ে শুরু হল পার্থ প্রতীম মজুমদারের প্রথম প্রবাস জীবন। তবে তখন পর্যন্ত কিন্তু তিনি পার্থ প্রতীম মজুমদার নন। প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস। আর ডাক নাম সেই আদি ও অকৃত্রিম “ভীম”।
চন্দন নগরের ছুটিতে
পার্থ প্রতীম মজুমদার চন্দন নগরে থাকেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেই আত্মীয়ের বাবা বেঁচে ছিলেন। এবং তিনি তাঁর ছোট ছেলে ডা. রনেন রায় এর কাছে থাকতেন। সেই কাকু থাকেন কলকাতার পূর্ণদাশ রোডে। ফলে ছুটি ছাটাতে আত্মীয় তাঁর বাবার সাথে দেখা করতে পূর্ণদাশ রোডে যেতেন। আর পার্থকেও আসতে হতো। ডা. রনেন রায় যে ফ্ল্যাটে থাকতেন তার পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন তাপস সেন (ভারতবর্ষের থিয়েটার মঞ্চের আলোর যাদুকর) আর সেখানেই থাকতেন যোগেশ দত্ত। ওপর তলায় দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়। পাশে অশোক তরু বন্দোপাধ্যায়। সেই ফ্ল্যাটেই একদিন হঠাত্ করে আবিষ্কার করলেন যে কে একজন যেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটে। আবার নানা রকম মুখভঙ্গি করে। চমকে গেলেন তিনি। পাগল দেখেছেন এতোকাল রাস্তায়। একটা ময়লা ছেঁড়া জামা আর তার পেছনে এক দঙ্গল ছেলে ছোকরা। তাঁদের কেউ কেউ পাগলকে বলছে, এই পাগল কলা খাবি। আর সে হুউশ করে একটা শব্দ করলো তো ছেলেছোকরারা সব পড়িমরি করে দৌড়ে পালালো। সেই পাগল আস্ত এক ফ্ল্যাট বাড়ির ভেতরে। তাও আবার দিনের পর দিন। এও কি হতে পারে। পারেনা। তবে নিজের চোখকে দোষ দেয়াও তো যায়না। ঐ লোক একা একা যা করে, ঐরকম হা করা আর তাকানো শুধু পাগলরাই করে। কাকীমাকে বললেন সেই সন্দেহের কথা। কাকীমা হচ্ছেন রনেন কাকুর বৌ। শুনে তিনি হেসেই বাঁচেননা। পার্থ লজ্জায় একেবারে লজ্জাবতী হয়ে পাতাগুলোকে গুটিয়ে ফেলেছেন। কাকীমা বললেন, ‘দূর বোকা, উনি পাগল হতে যাবেন কেন। উনি একজন অনেক বড় আর্টিষ্ট। কথা না বলে উনি সর্বপ্রকার মনের ভাব, গল্প বা স্টোরি সকল কিছুই প্রকাশ করতে পারেন।’ শুনে পার্থর খুব ভালো লাগলো। তিনি ঐ লোকের সাথে যোগাযোগ করলেন। ভদ্রলোকের নাম যোগেশ দত্ত। আর তিনি যে শিল্পটি চর্চা করেন তার নাম মূকাভিনয় বা মাইম। তারও পর উনি বাংলাদেশিও বটে। ফলে পার্থর সাথে তাঁর একরকম বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
এই বন্ধুত্ব ছিল প্রবল স্নেহের একটি বিশেষ রূপ। উনি যেসব অনুষ্ঠানে যান পার্থও সাথে সাথে যান। অনেক বড় বড় অনুষ্ঠান। আর মান্না দের মতো অনেক গুণী মানুষ সেসব অনুষ্ঠানে হাজির থাকেন। মানুষ হাততালি দেয়। একটা নেশার মতো হয়ে গেল। এই কথা না বলে অভিব্যক্তি প্রকাশ করার শিল্পটি তাঁকে প্রবল ভাবে টানে। পার্থ একদিন বলে বসলেন মনের কথা যোগেশ দত্তকে। তিনি মাইম শিখতে চান। যোগেশ দত্ত খুব একটা উত্সাহ দেখালেন না। রনেন কাকার মতো ডাক্তার হতে বললেন। ডাক্তার হলে অনেক নাম হয়, টাকা হয়। আর শিল্পী জীবন বড়ই কষ্টের। হোক কষ্টের, তবু শিল্পী জীবনতো। সেই কষ্টের জীবনই হু হু করে টানতে লাগলো পার্থ প্রতীম মজুমদারকে। নিজে পড়াশুনা করেন। পাশপাশি যোগেশ দত্তের পেছনে পেছনে তাঁর সব অনুষ্ঠানে ঘুরে বেড়ান। আর যা শেখেন চন্দননগরে ফিরে গিয়ে একা একা তার চর্চা করেন। একদিন দেখালেন যোগেশ দত্তকে। এক জায়াগায় দাঁড়িয়ে হাঁটাটা। যোগেশ দত্ত বললেন, ‘আবার কর।’ তিনি করলেন। এরপর দত্ত বললেন, ‘দেয়াল ধরে প্রাকটিস্ করিস। আরো ভালো করবি।’ তিনি তাঁর পাশের দেয়ালটা চট করে ধরে ফেলে একটুখানি দেখিয়েও দিলেন। অবশেষে বরফ তাহলে গললো। যোগেশ দত্তের এই চট করে দেয়াল ধরাটা আর একটুখানি দেখিয়ে দেওয়াটা পার্থর জীবনে মাইমের প্রথম হাতেখড়ি। ঐদিন বরফের গলে যাওয়া ঐ পবিত্র জল সাথে নিয়ে ফিরে এলেন পার্থ প্রতীম। শুরু হলো অন্যরকম আর এক জীবন।
প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস থেকে পার্থ প্রতীম মজুমদার
সেটা ১৯৭২ সালের কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযু্দ্ধ শেষ হয়ে গেছে। যুদ্ধের সময়টাতে রিফিউজি হয়ে ইন্ডিয়াতে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে ফেলে আসা বাড়িঘর দখল করে নিয়েছে এক পাকিস্তানি মেজর। সেই যুদ্ধ শেষ হল। মেজরদের দৌরাত্ম আর দুরাত্মারা এদেশের মানুষের কাছ থেকে ক্ষমা ভিক্ষা নিয়ে প্লেনে চেপে নিজ দেশে চলে গেল। পার্থরা ফিরে এলেন পাবনার বাড়িতে। সেই বাড়িতে আসতেন বারীণ মজুমদার। বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদ। বাংলাদেশের মিউজিক কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। বারীণ মজুমদার ছিলেন সম্পর্কে হিমাংশু কুমারের দূর-আত্মীয়। হিমাংশু কুমার তাঁকে মামা ডাকতেন। বারীণ মজুমদার প্রায়ই আসতেন পার্থদের বাড়িতে। যুদ্ধের পরেও সেই আসা থামেনি। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর একমাত্র মেয়েকে হারিয়েছেন। সেও সেই স্বাধীনতার যুদ্ধে। তিনিই বললেন বাবাকে। ‘হিমাংশু, তোরতো চার ছেলেমেয়ে আর আমার আর তোর মামীমারতো বড় ছেলে ছাড়া কেউ নেই। তুই মেজ ছেলেটিকে আমাকে দে। ওর শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা। আমার কাছ থেকে কিছু শিখুক।’ হিমাংশু রাজী হলেন। রাজী হলেন সুশ্রিকা বিশ্বাসও। ফলে ভীমকে দত্তক নিতে বারীণ মজুমদারের কোন অসুবিধাই হলোনা। পালক পুত্রকে নিয়ে তিনি ঢাকাতে তাঁর বাসগৃহে ফিরে আসেন। নাম বদলালেন। নিজের পরিবারের সাথে মিলিয়ে প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস থেকে বদলে দিলেন পার্থ প্রতীম মজুমদার নামে। তারপরের যে জীবনের শুরু হলো সেও এক ইতিহাস। সেও শিল্পী হয়ে ওঠার অন্য এক গল্প।
ঢাকার মিউজিক কলেজ
২৮ নং সেগুনবাগিচায় ঢাকার মিউজিক কলেজ। এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা পার্থর পালিত পিতা বারীণ মজুমদার। কলেজেই পার্থরা থাকতেন। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠি আর অন্যান্য থিয়েটার গ্রুপ সেখানে মহড়া করতো। তখন মুক্তিযুদ্ধের নাচের ডিরেক্টর ছিলেন আমানুল হক। অঞ্জনা, তিথি খন্দকার, নিলুফার, ফ্যান্সি, কচি, মাহফুজ, নিরঞ্জন আর মুনির ভাই ও পার্থ প্রতীমকে নিয়ে তিনি “ব্যালেড অব বাংলাদেশ” নামে বিরাট একটা প্রোডাকশন করলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেটাকে গোল্ড মেডেল দিয়েছিলেন। ঢাকায় বড় বড় যত অনুষ্ঠানই হতো, বঙ্গভবন বা অন্য কোথাও কোন বড় একটা প্রোগ্রাম হবে। অবধারিত ভাবে ডাক পড়বে মিউজিক কলেজ আর গণসাংস্কৃতিক পরিষদের। ফলে রেসকোর্সে শেখ মুজিব যুদ্ধ পরবর্তী যেসব ভাষণ আয়োজন করতেন, সেই ভাষণের আগে আগে একদল সাংস্কৃতিক কর্মী মঞ্চে উঠে গান গাইতো। আর সেই গানের কর্মীদের দলটি যেত মিউজিক কলেজ থেকে। সেইসব দলে পার্থ থাকতেন। ফলে গানের প্র্যাকটিস কিন্তু করতেই হতো। মিউজিক কলেজের উপরে একটা অডিটোরিয়াম ছিল যেটা আজকে দখল হয়ে চারটে বাড়ি হয়ে গেছে। যেটা পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে মিউজিক কলেজকে দেওয়া হয়েছিল। সেই সম্পত্তি থেকে বারীণ মজুমদারকে বের করে দিয়ে পরে সেটা দখল হয়ে যায়। সেখানে সেই অডিটোরিয়ামের দোতলায় পার্থ প্র্যাকটিস করতেন। গানের আর মূকাভিনয়ের। গানটা সকলে বুঝতো। কিন্তু অভিনয় বুঝতো না। সেখানে গান শুনতে আসতেন অনেক নাট্যকর্মী। তারা একদিন বললেন, ‘তুই চুপি চুপি এইগুলো কি করিস।’ পার্থ বললেন, বোঝালেন। তারা বললেন, ‘দেখাতো।’ পার্থ দেখালেন। আর এক টিভি প্রডিউসার আলিমুজ্জামান দুলু বললেন, ‘পার্থ, তুই এটা টিভিতে কর।’ দুলু ভাইসহ অন্যদের চেষ্টায় হেদায়েত হোসেন মোর্শেদ, রিয়াজউদ্দিন বাদশা, আলী ইমাম, বেলাল বেগ, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ এঁরা অনুষ্ঠান করাতেন। এখানে গান আর মাইম করতে করতে একদিন টিভির রঙধনু অনুষ্ঠানে করলেন। সেই যে সুনামের শুরু হলো আর কোনদিন পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি পার্থর। আমাদের পার্থ প্রতীম মজুমদারের।
ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ এবং একটি স্কলারশিপ
টিভিতে পার্থ প্রতীম মজুমদার প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৭৫ সালে। প্রথম সুযোগটি করে দেন মরহুম আলিমুজ্জামান দুলু ও হাবীব আহসান নামে টিভি প্রযোজক। তাঁরা মিউজিক কলেজে আসতেন আড্ডা দিতে আর গান শুনতে। সেখানেই কতকদিন ধরে পার্থর করা মাইম নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। অনেকেই বলেছিলেন টিভিতে কর। কিন্তু বলা আর করার মধ্যে বেশ খানিকটা পার্থক্য থাকেই। এতবড় শিল্পী পরিবার, বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদ শিল্পী। সেই পরিবারের ছেলে রঙ মেখে সঙ সেজে একটা কিছু করবে, হোক সেটা টিভিতে। তাতে শিল্পীর মান থাকবে? এই ভয়টা কিন্তু প্রথম দিকে ছিলই। কিন্তু এর ভেতরেই দুলু ভাই ও হাবীব আহসান প্রযোজক হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দিয়েছেন। মাত্র কয়েকদিন আগে পরিচয়। এরমধ্যে পার্থর মাইম দেখেছেন একবার। দশ মিনিটের একটা প্রোগামে। সেইই শুরু। বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণ নতুন একটি শিল্প দেখলো, কিন্তু তাদের কোন প্রতিক্রিয়া বোঝা গেলনা। তবে কি তারা বোঝেনি। এই সংশয় দূর হলো ‘রঙধনু’ অনুষ্ঠানে পার্থর কাজটি প্রচার হবার পর। ‘রঙধনু’ করতেন হেদায়েত্ হোসেন মোরশেদ। এরপর আর ভাবতে হয়নি তাঁকে। টেলিভিশনের অনেক অনুষ্ঠানেই তিনি ডাক পান। দশ মিনিট, পনের মিনিটের এক একটা গল্প উপস্থাপন করেন মানুষের সামনে। সেসব গল্পগুলো ছিল ঢাকার জনজীবনের প্রতিচ্ছবি। কখনও ‘বাসযাত্রী’, কখনো ‘লোডশেডিং’ অথবা কখনও ‘ছিনতাইয়ের কবলে পড়ার গল্প’ নিয়ে তিনি হাজির হতে থাকেন টেলিভিশন পর্দায়। এই অনুষ্ঠানগুলি ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই। এর ভেতরেই করলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর একটি অনুষ্ঠান ‘আপনপ্রিয়’। এরপর শফিক রেহমানের ‘বলা বাহুল্য’ এবং বিবিসির সাংবাদিক ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানের টাইটেল করা ছিল পার্থর। ‘যদি কিছু মনে না করেন অনুষ্ঠানটি, যেটি সুদীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চলেছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে। সেই অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে টাইটেলে পার্থকে দেখা যেত।
এভাবেই জনপ্রিয়তা ছড়াচ্ছে চারদিকে। রিকশায় করে ঘুরে বেড়ায় বাংলাদেশের অমিতাভ বচ্চন আর মেয়েরা পেছন থেকে চিৎকার করে ওঠে, ‘ঐ যে পার্থ প্রতীম মজুমদার যায়।’ কোথাও গেলেই অটোগ্রাফের জন্য বেশ ভীড় লেগে যায়। একজন অবিবাহিত, অল্পবয়স্ক শিল্পীর কারো কাছেই এর চেয়ে বেশি চাওয়ার কিছু নেই। এভাবেই চলতে পারতো নায়কের জীবন। কিন্তু এর ভেতরেই ডাক এলো ঢাকাস্থ ফ্রেঞ্চ কালচারাল সেন্টার অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ থেকে। তিনি গেলেন। ওরা বলল, ‘মাইম করো ভালো কথা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কর। আমাদের দেশে মাইম বেশ পপুলার। তুমিও চলো। সেখানে মাইম করবে।’ তিনি বললেন, ‘গরীব দেশের মানুষ। তোমাদের দেশে যাওয়ার টাকা নেই।’ ডিরেক্টর বললেন, ‘দেখি কি করা যায়।’ পার্থ চলে এলেন। আবার ডাক পড়লো। ফ্রেঞ্চ কালচারাল সেন্টারে পার্থ মাইমের দুটো অনুষ্ঠান করলেন। চলে এলেন। আবারও ডাক পড়লো। অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ এই উপমহাদেশে প্রথমবারের মত মাইমের উপর একটি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করলো। কিন্তু নায়কের মন বাংলাদেশ থেকে আর সরেনা। কি আছে ফ্রান্সে। ওখানে কেউ, কোন মেয়ে রিকশা দিয়ে যেতে যেতে বলবে, ‘ঐ যে পার্থ প্রতীম মজুমদার যায়?’ অথবা কেই তাঁর অটোগ্রাফ চাইবে? হোক সে ফ্রান্স, বাংলাদেশ কিছুতেই ছাড়া চলবেনা তাঁর। কিন্তু নতুন কিছু শেখার বাসনাটা ছিলই চিরকাল। মাইমের প্রতি ভালোবাসাও কিছু কম ছিলনা আর মাত্র অল্প কয়েকটা দিনইতো মাত্র। যাওয়াই ঠিক হলো। কিন্তু কোথায় যেন ফাইলপত্রগুলো আটকে রইলো। দিনের পর দিন। পার্থ অপেক্ষা করেন। বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের ক্লিয়ারেন্স- কোন কারণ ছাড়াই আটকে থাকে। নাট্যজন আলী যাকের ও নাট্যজন আতাউর রহমানের আন্তরিক চেষ্টায় তা মুক্তি পায়। এর দু’বছর পর তিনি ফ্রান্সের ভিসা হাতে পেলেন। অবশেষে ১৯৮১ সালে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে রওনা করেন পার্থ প্রতীম মজুমদার।
পার্থ, ‘হি ইজ মাই সান’
জগত্ বিখ্যাত মাইম আর্টিস্ট মারসেল মার্সো। তাঁর ওস্তাদ ছিলেন এতিয়েন দু ক্রু। এতিয়েন দু ক্রু নিজে কর্পোরাল মাইম এর জন্মদাতা ও প্রখ্যাত মাইম শিল্পী ছাড়াও একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা। তিনি ‘চিলড্রেন অব প্যারাডাইস’ নামে একটি বিখ্যাত ফরাসী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। পার্থ প্রতীম মজুমদার ফ্রান্সে যেয়ে সর্বপ্রথম তাঁর কাছে মাইমের উপর শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিষয় ছিল কর্পোরাল মাইম। কর্পোরাল মাইমে শরীরকে সবচেয়ে বেশি যতগুলো জ্যামিতিক আকৃতিতে ভাঙা যায়, ভাগ করা যায় সেটা শেখানো হয়। এই শিক্ষা গ্রহণের শেষ দিকে তাঁর সাথে পরিচয় হয় জগত্ বিখ্যাত মাইমের অনবদ্য পন্ডিত ও শিল্পী মারসেল মার্সোর সাথে। পার্থ প্রতীম গিয়েছিলেন মারসেল মার্সোর একটি অনুষ্ঠান দেখতে। সেখানে অনু্ষ্ঠান শেষে তিনি বাংলাদেশ থেকে সাথে নিয়ে যাওয়া শিল্পকলা একাডমীর একটি ব্রুসিয়ার মার্সোকে দেখান। এই ব্রুশিয়ারটি ছিল পার্থর নিজের উপর। মার্সো অবাক হন। বলেন, ‘ছবির এই শিল্পীটি আসলে কে?’ পার্থ তখন বললেন নিজের কথা। মার্সো আরো অবাক হলেন৷ বললেন, ‘তোমাদের দেশে তাহলে মাইম আছে।’ পার্থ বললেন, ‘আছে।’ মার্সো বললেন, ‘তুমি আমার কোম্পানীতে জয়েন কর।’ দনোমনো ভাব যায়না পার্থর। বাংলাদেশে অগণিত ভক্ত আর শুভাকাঙ্খী রেখে এসেছেন। এবার মারসেল মার্সো তাঁর ঝুলি থেকে কয়েকটি ঢিল বের করে ছুড়ে মারলেন পার্থর দিকে। পার্থকে দেখালেন কিভাবে একটি গাছকে আরও বাস্তবসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করা যায়। অথবা একটি ফুল তোলাকে। ছোট ছোট স্ট্রোক দিয়ে ভেঙে ভেঙে দেখালেন পার্থকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না। মাইম এতো সুন্দরও হয়। এতোকাল তিনি শুধু ছন দিয়ে আর খড় দিয়ে কুড়ে ঘর বানিয়েছেন। এই প্রথম দেখলেন অভিব্যক্তিতে ভরা এক সুরোম্য প্রাসাদ। প্রাসাদের চূড়োয় অবস্থানকারী মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধায় পার্থর মাথা নত হয়ে গেল। আরো শিখতে হবে তাঁকে। এই মানুষটির মাইম জ্ঞানের তুলনায় তাঁর মাইম জ্ঞান প্রায় নগণ্য। সমস্ত পিছুটানকে ভুললেন তিনি। যোগ দিলেন মারসেল মার্সোর কোম্পানী ‘ইকোল ইন্টারন্যাশনাল দ্য মাইমোড্রামাতে’। ৩বছর মেয়াদী কোর্সে।
মারসেল মার্সোর স্কুলটিতে সুযোগ পাওয়া অনেক কঠিন। সারা পৃথিবীতে থেকে বহু মানুষ নিজেরা মাইম করে তার ভিডিও ধারণ করে পাঠিয়ে দেয় মারসেল মার্সোর কোম্পনীতে। সেখানে তাঁর সহকারীরা সেগুলোকে দেখে ৪০-৫০ জনের মতো লোককে বাছাই করে রাখে। এই ৪০-৫০ জন লোকের ভিডিও চিত্র দেখে মার্সো ডেকে পাঠালেন হয়তো ২০ জনকে। আর মারসেল মার্সোর সামনে উপস্থাপন করার পর হয়তো স্কুলে সুযোগ পেল ৭-৮ জন। এই ৭-৮ জন লোক সব দিক থেকেই চৌকস। তারা ব্যালে জানে, অ্যাক্রোবেটিক জানে, মডার্ন ড্যান্স জানে, ড্রামাটিক আর্ট জানে, পেন্ট্রোমাইম, মাইম, কর্পোরাল মাইম জানে। পার্থ কিন্তু বাংলাদেশে থাকতে এসব কিছুই জানতেন না। তারপরেও মারসেল মার্সোর সাথে দেখা হওয়া আর এই কোম্পানীতে জয়েন করার আমন্ত্রণ পাওয়ার মতো বিরল সৌভাগ্যের জন্য পার্থ গুরুজনের অপার আশীর্বাদ বলেই মনে করেন। এই আশীর্বাদ কিন্তু হেলায় হারাননি পার্থ। প্রচুর পরিশ্রম করেছেন জীবনে। মারসেল মার্সোর সাথে দৈনিক ষোল থেকে আঠারো ঘন্টা করে পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে। এই পরিশ্রম কিন্তু বৃথা যায়নি মোটেই, দিন দিন পার্থ মারসেল মার্সোর আরো কাছাকাছি চলে এসেছেন। এই কাছকাছি আসার একটি বহিঃপ্রকাশের কথা না বললেই নয়।
মারসেল মার্সো গিয়েছেন আমেরিকাতে অনুষ্ঠান করতে। সেখানে তাঁর অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছে বাংলাদেশী এক ছেলে। সেই ছেলে সেদিন অনু্ষ্ঠান শেষে এগিয়ে গেল মার্সোর দিকে। জানতে চাইলো, পার্থ প্রতীম মজুমদারকে চেনেন কিনা। মার্সো জবাব দিলেন, ‘অফর্কোস, হি ইজ মাই সান।’ সেই বাঙালী ছেলে একদিন পার্থকে মেইল করে জানালো এই কথা। প্রিয় মানুষের ছাত্র থেকে পুত্র হতে পারার এই বিরল সম্মান পার্থর জীবনের একটি বড় পাওয়া। এই পাওয়ার কথা পার্থ সমগ্র জীবনে কোনদিন ভুলবেন না।
কর্মক্ষেত্র
পার্থ প্রতীম মজুমদার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে মূকাভিনয় নিয়ে গৌরবমন্ডিত করেছেন বাংলাদেশের পতাকাকে। সেই চিরন্তন লাল সবুজকে পৃথিবীর মানুষের কাছে চিনিয়ে নেওয়ার যে প্রাণান্ত আর সুখকর প্রচেষ্টা তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা সংযুক্ত করা হল।
১৯৭৫ : বলা যায় এটিই তাঁর শুরুর বছর। এবছরে তিনি বিটিভির (বাংলাদেশের জাতীয় টেলিভিশন) দুটি অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন। এছাড়া এবছর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের সাংস্কৃতিক মূকাভিনয় শিল্পী হিসেবে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৫-১৯৮১ : বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪৮ বার মাইম প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে, বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে মাইম প্রদর্শন করেন। এবছরই তিনি একটি মাইম প্রজেক্টের নির্দেশনা প্রদান করেন। এছাড়া ঢাকার ড্রামাটিক আর্টস স্কুলে মাইমের শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন থিয়েটার গ্রুপের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাইমের উপর কর্মশালা পরিচালনা করেন।১৯৮২-১৯৮৫ : এবছরগুলোতে তিনি প্যারিসের বিভিন্ন থিয়েটারে মোট ২৬টি শো করেন। লন্ডনে ২টি, গ্রীসে ২টি এবং স্পেনে মাইমের ২টি শো করেন।১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে মারসেল মার্সোর সাথে আমেরিকা যান এবং সেখানে মার্সোর নির্দেশনায় ‘ইকোল ইন্টারন্যাশনাল ডি মাইমোড্রামা ডি প্যারিস-মারসেল মার্সো’ নামে একটি শো করেন।১৯৮৫ সালের জুলাই মাসে পার্থ প্রতীম মজুমদার মারসেল মার্সোর কোম্পানি এবং ‘থিয়েটার দ্য লা স্পেহয়ার’ এর সাথে যৌথ উদ্যোগে সারা ইতালিতে মাসব্যাপী ‘লে কারগো দ্য ক্রেপুসকুল’ এবং ‘আবিম’ নামে দুটি মাইমোড্রামা প্রদর্শন করেন।এবছরগুলোতেই প্যারিসে দুটি ছোট বিষয়কে নিয়ে ক্যামেরার সামনে হাজির হন। এবং প্যরিসেই তাঁর কাজের উপর একটি বড় ভিডিও ধারণ করা হয়। এসময় ফ্রান্সের টেলিভিশনে তাঁর একটি কাজ প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া লন্ডনে একটি ছোট ভিডিও ধারণসহ ‘বিবিসি’-তে তাঁর একটি কাজ প্রদর্শন করা হয়।১৯৮৫-১৯৮৬ : মারসেল মার্সোর তত্ত্বাবধানে পার্থপ্রতীম মজুমদার এবছরে মাইমের তত্ত্ব্ব বিষয়ক গবেষণা কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। এছাড়া ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ‘ইয়ার অব ইন্ডিয়া’-তে অংশগ্রহণ করেন।১৯৮৬ : পার্থ প্রতীম মজুমদার এবছর লন্ডনে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৫তম জন্ম বার্ষিকীতে যোগদান করেন। এছাড়া ‘শ থিয়েটার’ এবং ‘ওয়েস্টমিনিস্টার স্টুডিও থিয়েটারে’ও মাইম প্রদর্শন করেন। বিবিসির রেডিও ও টেলিভশনে তাঁর সাক্ষাত্কার প্রচার করা হয়। আর এবছরেই ইউনেস্কো কালচারাল কমিটি আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্যারিসের ইউনেস্কোর প্রধান অডিটোরিয়ামে মাইম প্রদর্শন করেন ও অসাধারণ সাফল্য ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন।১৯৮৭ : মালয়শিয়ান সরকারের অতিথি হয়ে কুয়ালালামপুরের ফেস্টিভালে অংশগ্রহণ করেন। এখানেই মালয়শিয়ান থিয়েটার এবং ড্যান্স গ্রুপের সহায়তায় মালয়শিয়ার প্রতিবন্ধী (বোবা ও কালা) শিশুদের সাথে নিয়ে মাইমের উপর একটি কর্মশালা পরিচালনা করেন। কুয়ালালামপুরে রাষ্ট্রীয় প্রধান মঞ্চে একটি ও কয়েক হাজার দর্শকের উপস্থিতে দুটি অনুষ্ঠান করেন। প্রতিটি দৈনিক ও সাপ্তাহিকে তাঁর অনুষ্ঠানের উচ্চ প্রশংসা ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। যা দেশের জন্য এক বিরল সম্মান।১৯৮৮ : জার্মানির স্টুটগ্রাটের ‘লিনডেন’ মিউজিয়ামে মাইম প্রদর্শন করেন।১৯৯০ : ফ্রান্সে একটি মাইমোড্রামা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া মারসেল মার্সোর সাথে যৌথ উদ্যোগে ওরিয়েন্টাল এবং ওয়ের্স্টান মাইমের উপর একটি গবেষণা কাজ সম্পাদন করেন।১৯৯১ : বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সাহায্যার্থে প্যারিসের ‘হেবারতো থিয়েটারে’ একটি ও প্রাক্তন ফরাসী প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ‘বার্দো’ শহরে ও ‘ননত্’ এর মেয়রের আমন্ত্রণে সেই শহরে তিনটে শো থেকে প্রাপ্ত টাকা ‘কারিতাস’ ও ‘ফরাসী রেডক্রসের’ মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে নিজের দেশের জন্য হাসিমুখে এই শোগুলো করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন।১৯৯২-১৯৯৩ : ফ্রান্সে কয়েকটি কর্মশালা পরিচালনা করেন। এবং ইউরোপে মাইম প্রদর্শন করেন।১৯৯৪ : আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ (ঢাকা) ও ঢাকা লিটল থিয়েটার গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় এই উপমহাদেশের প্রথম মাইমোড্রামা প্রদর্শন করেন। ‘শিশুদের যৌন নির্যাতনের’ উপর ভিত্তি করে এই মাইমোড্রামা সারাদেশে প্রচন্ড আলোড়ন তোলে। জাতীয় জাদুঘরে তিনটি ও শিল্পকলা একাডেমীতে একটি প্রদর্শনী হয়।১৯৯৫ : লন্ডনে কয়েকটি শো ছাড়াও হল্যান্ডের আমস্টারডামে, ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে কয়েকটি শো করেন। এছাড়া লন্ডনে একটি কর্মশালা পরিচালনা করেন।১৯৯৬ : আমেরিকার নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, মায়ামি এবং বোস্টনে শো করা ছাড়াও নিউইয়র্ক টেলিভিশনে মাইম প্রদর্শন করেন।কানাডার মন্ট্রিল, অটোয়া এবং টরেন্টোতে শো করা ছাড়াও কানাডিয়ান টেলিভিশনে মাইম প্রদর্শন করেন। পার্থ প্রতিমের মূকাভিনয় ও মাইমের প্রদর্শন ও সাক্ষাত্কার (বাংলা) দিয়ে প্রথম কানাডাতে টিভি অনুষ্ঠান প্রচার হয়। এরপর শো করতে যান অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে।এবছর বাংলাদেশের ২৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে লন্ডনের ‘ইয়র্ক’ হলে, বোস্টনে এবং ভারতীয় বিদ্যা ভবনে (লন্ডন) মাইম প্রদর্শন করেন।১৯৯৭ : ঢাকাস্থ অলিয়ঁস ফ্রসেজে সহোযোগিতায় বাংলাদেশের সকল গ্রুপ থিয়েটারকে সাথে নিয়ে একটি মাইম কর্মশালা আয়োজন করেন। এবছর ‘বিআইপিএ’ (বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ফাইন আর্টস, নিউইয়র্ক) সাথেও একটি কর্মশালার আয়োজন করেন। এছাড়া জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটে, আমেরিকার নিউইয়র্কে, প্যারিসের ‘মনএই’ ফেস্টিভালে, বাথের ‘গিল্ড’ হলে, বিবিসি চ্যানেল ফোরের একটি ছবিতে কাজ করেন।১৯৯৮ : বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অর্থায়নে বড় বড় দুটি শো করেন৷ বেশ কয়েকটি সলো টিভি পারফরমেন্সও করেন বাংলাদেশ টেলিভিনের জন্য। এছাড়া ঢাকার আমেরিকা স্কুলের শোতেও অংশগ্রহণ করেন। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভাল চলাকালীন ঢাকার আমেরিকা স্কুলে একটি মাইম কর্মশালার আয়োজন করেন।১৯৯৯ : এমজিসিএম এর অর্থায়নে আয়োজিত ফ্রান্সের সবচেয়ে নামী হল প্যালে দ্য কংগ্রেসে একটি অসাধারণ শো করেন। ইউরোপের আলাদা আলাদা দেশসহ আমেরিকার নিউইয়র্ক এবং নিউজার্সিতে শো করেন। এবছর প্যারিসে একটি কর্মশালার আয়োজন করেন। ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রে, বিজ্ঞাপনে এবং টিভিতে কাজ করেন।২০০০ : গ্রীসের এথেন্সে পালাস-এ অংশগ্রহণ করেন। এবং মেডিসন স্কয়ার গার্ডেন (নিউইয়র্ক) অনুষ্ঠিত ফোবানা সম্মেলন ২০০০-এ অংশগ্রহণ করেন বিশেষ সম্মানীয় অতিথি হিসেবে।২০০১ : ডেনমার্কের ‘সেভেনবর্গ ফেস্টিভালে’ অংশগ্রহণ করেন। সুইডেনের ‘মালমোতে’ শো করার পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুলের শিশুদের সাথে নিয়ে একটি মাইম কর্মশালা করেন। এছাড়া এবছর ডেনমার্কের ‘কোপেনহেগেনে’ মাইম প্রদর্শন করেন।
ওয়ান ডলার কারি ও অন্যান্য
পার্থ প্রতীম সারা পৃথিবী ঘুরে শো করার পাশাপাশি কয়েকটি টেলিভিশনেও নিয়মিত প্রোগ্রাম করেন। ইউরোপের ‘গালা শো’ আর ফ্রান্সের ‘চ্যানেল ফাইভ’ এর তাঁর উপস্থিতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ফ্রান্সের চ্যানেল ফাইভ সন্ধ্যে সাতটার পর জার্মান চ্যানেলের সাথে মিশে ‘আরতে’ হয়ে যায় এবং এখানে আরও বিস্তৃত হয় পার্থ প্রতীমের বৃত্ত। একসময় এই চ্যানেলের প্রতীক তৈরী হয়েছিল পার্থর হাতের ছায়া দিয়ে৷ ইউনেস্কোর মাতৃভাষা দিবসের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে পার্থ বাংলা ভাষায় কিছু শব্দ ব্যবহার করেন। এখনো চ্যানেল ফাইভে তাঁর কন্ঠস্বর শোনা যায় ‘বিজ্ঞাপন- বিজ্ঞাপন-বিজ্ঞাপন৷’ আইবিএম প্রোডাক্টের সাথে চারটি মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে পার্থর কাজ।
পার্থ প্রতীম মজুমদার বেশ কয়েকটি আমেরিকান, কানাডিয়ান ও ফরাসি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত সাম্প্রতিক ছবিগুলো হচ্ছে ‘ওয়ান ডলার কারি’, ‘জেনিস এ্যান্ড জন’, ‘ফার্মাসী দ্য গার্ড’, ‘দ্য মর দ্য বেলভিল’, ‘ভাই ভাই’ প্রভৃতি। এদের মধ্যে ‘ওয়ান ডলার কারি’ অর্জন করেছে সবচেয়ে বেশি সফলতা। ‘ভাই ভাই’ ইতিমধ্যে ২৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে এবং ৭৫টি উৎসবে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের মাইম ও পার্থর স্বপ্ন
বাংলাদেশের মাইমের পথিকৃৎ পার্থ প্রতীম মজুমদার। কেননা সমগ্র বাংলাদেশে এই শিল্পটির চর্চা যেমন তিনিই শুরু করেছিলেন। আজকে বাংলাদেশে মাইমের যে অল্প কয়েকটি বিষয় চর্চা করা হয় সেগুলোও মোটামুটি ভাবে পার্থরই নির্দেশিত। ১৯৭৫ সালে পার্থ বাংলাদেশ টেলিভিশনে যখন প্রথম মাইম প্রদর্শন করেন তখন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষেরই মাইম সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিলনা। পার্থ প্রতীমই সর্বপ্রথম এই ধারণা তৈরী করেন। এরপরে তিনি ফ্রান্সে পাড়ি জমালেও মাঝে মাঝে নিজ খরচে দেশে এসে এখানকার থিয়েটার বা নাট্যঙ্গনের কিছু শিল্পীদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করেন। এই কর্মশালার মাধ্যমে বাংলাদেশে মূকাভিনয় শিল্পটিকে এগিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ই তাঁর সকল পরিশ্রমের মূলে। একারণে যখন তিনি বাংলাদেশে থাকেন তখনও ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় তাঁকে। সকাল থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সংগঠনের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করেন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে পার্থ প্রতীম মজুমদার বাংলাদেশে প্রথম মাইমোড্রামার প্রবর্তন করেন। মাইম যদি ছোটগল্প হয় তবে মাইমোড্রামা হচ্ছে উপন্যাস। চলচ্চিত্র পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম ও ‘ঢাকা লিটল থিয়েটারের’ উদ্যোগে কিংবদন্তী শিল্পী মারসেল মার্সোর ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করে ‘দুঃস্বপ্ন’ নামে একটি ব্যতিক্রমধর্মী মাইমোড্রামা মঞ্চস্থ করেন তিনি।
একথা সকলেই জানে শিল্পচর্চার জন্য মাইম জানা থাকা যেমন দরকার একজন শিল্পীর তেমনি মাইম জানার জন্য দরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া একজন মানুষের পক্ষে মাইম শিক্ষা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই মালয়শিয়ান সরকারই পার্থকে প্রথম প্রস্তাবটি দেয়। মালয়শিয়ার মাটিতে একটি মাইম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করার। পার্থ সে প্রস্তাবটি বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দেন। কারণ তাঁর আদি ও অকৃত্রিম ইচ্ছা বাংলাদেশের ছেলে মেয়েদের মাইম শেখানোর জন্য বাংলাদেশের মাটিতে একটি মাইম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করার। তিনি দেশে এসে বেশ কয়েকবার উদ্যোগও নিয়েছেন। এদেশের বড় বড় পর্যায়ের মানুষের সাথে কথা বলেছেন। এবং তাঁরা সকলেই পার্থর সাথে একমত যে বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ মাইম ইন্সটিটিউট এর আসলেই প্রয়োজন আছে এবং তাঁরা যত শিগ্রী সম্ভব সে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ব্যবস্থা আর গৃহীত হয়না। এক সময় এদেশ থেকে ফ্রান্সে থাকার অনুমতি হাতে পেতে তাঁর সময় লেগেছিল দুবছর। সেই চিন্তাকে মাথায় রেখে পার্থ অপেক্ষা করে আছেন সেই দিনের যখন এদেশের মাটিতে একটি পূর্ণাঙ্গ মাইম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্য পার্থ প্রতীম মজুমদার বছরে ছয় মাস করে বাংলাদেশে থাকতে রাজী আছেন। সেই দিন কি সত্যিই আসবে?
শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ
পার্থ প্রতীম মজুমদার ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কলকাতার যোগেশ দত্ত মাইম একাডেমীতে মাইমের উপর শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে ভারতের চন্দননগর থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা মিউজিক কলেজ থেকে স্নাতক হন। ১৯৮১ ও ‘৮২ সালে মডার্ণ কর্পোরাল মাইমের উপর ‘ইকোল দ্য মাইম’ নামে এতিয়েন দ্যু ক্রু কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মারসেল মার্সোর কাছে ‘ইকোল ইন্টারন্যাশনালি দ্য মাইমোড্রামা দ্য প্যারিস’-এ মাইমের উপর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে স্ট্যান্ডার্ট চার্টার্ড ব্যাংকের পৃষ্টপোষকতায় এইডস-বিরোধী বিজ্ঞাপন আকারে ক্যাম্পেন তৈরী করেন।
পার্থপ্রতীম মজুমদারের পাওয়া যত স্বীকৃতি
১৯৮৭ সালে তিনি কলকাতা যোগেশ মাইম একাডেমী থেকে ‘মাস্টার অব মাইম’ উপাধি অর্জন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি একক মূকাভিনেতা হিসেবে এথেন্স, নিউইয়র্ক, ডেনমার্ক, সুইডেনসহ সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। মালয়শিয়ার সাংবাদিকদের কাছ থেকে তিনি ‘মাস্টার অব ওয়ার্ল্ড’ সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৮৯ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বেঙ্গলি লেটারেচার ফেস্টিভালে একমাত্র বাঙালী অতিথি শিল্পী হওয়ার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেন। ১৯৯১ সালে ‘বার্দোতে’ ও ‘ননত্’ শহরের মেয়র কর্তৃক মেডেল প্রাপ্তি ও সংবর্ধিত হন। ১৯৯৬ সালে আমেরিকার মায়ামিতে অনুষ্ঠিত দশম নর্থ আমেরিকান বাংলাদেশ ফেস্টিভালে বিশেষ অতিথি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ২০০০ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ফোবানা সম্মেলন ২০০০ কতৃক মূকাভিনয়ের সঙ্গে দীর্ঘসময়ের সম্পৃক্ততার জন্য বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। এবছরই বাঙালী সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মূকাভিনয় চর্চার জন্য বাংলা সাপ্তাহিক ‘পত্রিকা’ তাঁকে ‘ইউকে মিলেনিয়াম এ্যওয়ার্ড ২০০০’- এ ভূষিত করে। ২০১০ সালে তাঁকে ‘একুশে পদক’ দেওয়া হয়।
পার্থ প্রতীম ২০১১ সালের মে মাসে পেলেন ফ্রান্স সরকারের ‘Order of Fine Arts and Humanities’এর ‘Knight’ উপাধি।
২০১৪ সালে পার্থ প্রতীম মজুমদারকে বাংলা একাডেমীর বিশেষ সম্মাননা ‘ফেলোশীপ’ প্রদান করেন, যা তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাক থেকে গ্রহণ করেন।
পরিবার পরিজন
পার্থ প্রতীম মজুমদার এর বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। তাঁর স্ত্রীর নাম জয়শ্রী (ঝুমু)। পার্থ প্রতীম ও ঝুমু দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের নাম সুপ্রতিম ও মেয়ের নাম দোয়েল। পার্থ প্রতীমের দাদা স্নেহাংশু কুমার বিশ্বাস। সবাই তাঁকে কানুদা ডাকেন। পার্থর পরের ভাই অরুনাংশু বিশ্বাস। ডাক নাম রাজকুমার। তিনি ইঞ্জিনিয়ার। একদম ছোট ভাই শুভ্রাংশু বিশ্বাস, ডাকনাম রূপকুমার। তিনি ডাক্তার। আর চার ভাইয়ের একটি মাত্র বোনের নাম স্নিগ্ধা বিশ্বাস, ডাকনাম মিনু।
লেখক : পথিক সুমন
বিভিন্ন সময়ে পার্থ প্রতীমের ছবি তুলেছেন :১. আনোয়ার হোসেন২. পাভেল রহমান৩. মুনিরা মোর্শেদ৪. ডলি আনোয়ার৫. ডেভিড বারিকদার