ইংরেজি শব্দ ‘স্টপ জেনোসাইড’। যার বাংলা অর্থ ‘বন্ধ কর গণহত্যা’। আমরা সবাই জানি এটি একটি আলোচিত ইংরেজি চলচ্চিত্র, যার রূপকার জহির রায়হান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বাঙ্গালি নিধনযজ্ঞে মত্ত, ঠিক তখনই অস্ত্র হিসেবে ক্যামেরাকে হাতে তুলে নিলেন তিনি এবং এপ্রিল-মে মাসের দিকে এই চলচ্চিত্র নির্মানের পরিকল্পনা করলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, রাজাকার, আল-বদর ও আল-সামস-এর খুন-ধর্ষণ-রাহাজানি তুলে ধরা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। এছাড়াও ভারতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দিনকাল আর কার্যক্রমও তুলে ধরা হয়েছে এই তথ্যচিত্রে। তিনি বিশ্বাস করতেন চলমান গণহত্যা বন্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরির ক্ষেত্রে এই ধরণের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লাখ বাঙ্গালির প্রাণের বিনিময়ে এবং জহির রায়হানদের মতো অসংখ্য দেশপ্রেমীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সত্যিই বন্ধ হল নারকীয় সেই গণহত্যা এবং অর্জিত হল আমাদের বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা। কিন্তু হায়! লাল সবুজের পতাকার অধিকারী এই দেশ থেকে তিনি যে চিরতরের জন্য নিখোঁজ হবেন সেটি কী কেউ জানত? যে দেশ স্বাধীন করার জন্য তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতি মুহুর্তে কাজ করে গেছেন, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য সেই স্বাধীন দেশ থেকেই তিনি চিরতরের জন্য নিখোঁজ হয়েছেন। আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁকে। গণহত্যা বন্ধ করার জন্য যিনি সারা জাগানো চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণ করলেন, আর তাঁকেই হত্যা করা হলো এই স্বাধীন দেশের মাটিতে।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে দেশের মানুষের জীবন, সংগ্রাম ও স্বাধীনতার চেতনায় সমৃদ্ধ ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি নির্মাণ করেন জহির রায়হান। ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ছবি। কারণ এর আগে অন্য কোনো ছবিতে যেমন পাকিস্তানীদের সাথে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের মূল বিষয়টি আসেনি। তেমনি এটিই হলো প্রথম ছবি যাতে শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আলেখ্য এবং পরিণামে পাকিস্তানি শোষকের বিরুদ্ধে শোষিত বাঙালির বিজয় প্রদর্শিত হয়েছে। তবে পুরো বিষয়টিই রূপক আকারে এসেছে। একটি পারিবারিক ঘটনার আদলে যেভাবে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা বোঝার যোগ্যতা ছিল বাঙালির।
আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এ ছবি দেখার জন্য বাঙালির আকুলতা। এ ছবি প্রদর্শনের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে গুলিস্তান প্রেক্ষাগৃহের সামনে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালি এবং আন্দোলন করে সরকারকে ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনে বাধ্য করে। এটি হলো এদেশের প্রথম ছবি যা দেখার অধিকার দর্শককে আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার আগেই এ ছবি বলে দিয়েছিল যে, মুক্তিযুদ্ধ আসছে এবং এই যুদ্ধে আমাদেরকে জয়ী হতে হবে।
জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার মজুপুর গ্রামে। তাঁর পারিবারিক নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। তবে ছেলেবেলায় তাঁকে ডাকা হতো জাফর বলে। বাবা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। জহির রায়হানের পূর্বপুরুষরা পীর ছিলেন। তাঁর বাবা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পড়াশুনা শেষে তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। আরবীতে উচ্চ ডিগ্রিধারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তার মানুষ। তাঁর মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কারণেই ওই পরিবারে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার অনুকূল পরিবেশ তৈরী হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি তাদের পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। এসময় জহির রায়হানের বাবা ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় ফেকাহ ও আরবি দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। চাকুরী জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুনের জন্ম এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। তিনি নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। তাঁর পিতৃকুল ছিল তালুকদার। রক্ষণশীল হলেও প্রভাবশালী এই পরিবার তৎকালীন জাতীয়তাবাদী এবং স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের সময় সুফিয়া খাতুন নিজ হাতে সুতো কেটে কাপড় বুনে পরতেন। তখন তিনি তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোরী ছিলেন। পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের জননী সুফিয়া খাতুন। তিনি সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সর্তক ও যত্নশীল। তাঁর প্রথম সন্তান শহীদুল্লাহ কায়সার, দ্বিতীয় নাফিসা কবির, তৃতীয় জহির রায়হান, চতুর্থ জাকারিয়া হাবিব, পঞ্চম সুরাইয়া বেগম, ষষ্ঠ শাহেনশা বেগম, সপ্তম ওবায়দুল্লাহ, সর্বকনিষ্ঠ সাইফুল্লাহ।
নিজ পরিবারেই জহির রায়হানের পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়। শৈশব-কৈশোর ও স্কুল জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কলকাতায়। ১৯৪০ সালে তিনি কলকাতা মডেল স্কুলে ভর্তি হন। তাঁর বাবা তখন কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। মডেল স্কুলে তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তাঁকে মিত্র ইনস্টিটিউশনে (মেইন) ভর্তি করা হয়। এখানে সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি আলীয়া মাদ্রাসার অ্যাংলো-পার্শিয়ান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাবার সঙ্গে মজুপুর গ্রামে চলে আসেন। ওই সময় তিনি গ্রামের আমিরাবাদ স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। স্কুলে পড়ার সময় প্রায়ই বোতাম না থাকায় একহাতে ঢোলা হাফপ্যান্ট কোমরের সঙ্গে ধরে রেখে ছাত্র ফেডারেশন ও কম্যুনিস্ট পার্টির আত্মগোপনকারী সদস্যদের মধ্যে চিঠিপত্র আর খবর আদান-প্রদানের কাজ করেছেন তিনি, খোলা রাস্তায় বিক্রি করেছেন কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘স্বাধিকার’।
গ্রামের আমিরাবাদ হাই স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ঢাকা কলেজে পড়াশুনার সময় তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে জহির রায়হান ঢাকা কলেজ থেকে আই.এসসি. পাস করেন। ওই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। এক বছর পর তিনি অর্থনীতি ছেড়ে বাংলা বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হন।
জহির রায়হানের লেখালেখির অভ্যাস গড়ে উঠে স্কুল জীবন থেকে। তখন তিনি কবিতা লিখতেন। লিখতেন, ছিঁড়তেন আর পড়ে শোনাতেন নিকট আত্মীয়-স্বজনকে। তারাও তাঁকে লেখার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। প্রথম দিকে পরিবারের সদস্যরাই ছিলেন তাঁর রচনার একনিষ্ঠ শ্রোতা। তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা একটি কবিতা। কবিতাটির নাম ‘ওদের জানিয়ে দাও’। কবিতাটি ১৯৪৯ সালে ‘নতুন সাহিত্য কুটির’ থেকে প্রকাশিত ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প ‘হারানো বলয়’। এটি ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয় ড. আলিম চৌধুরী এবং এমএ কবীর সম্পাদিত ‘যাত্রিক’ পত্রিকায়। তখন তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এরপর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। এটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের দুঃখ-দারিদ্র, সংস্কার-সংকীর্ণতা প্রেম-এই উপন্যাসের মূল বিষয়। ১৯৬৮ সালে ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে রচিত। ‘৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর আন্দোলনে জহির রায়হান কারারুদ্ধ ছিলেন। তাঁর সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলন সবচেয়ে বেশি স্থান পেয়েছে ।
‘বরফ গলা নদী’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। এটি প্রথমে ‘উত্তরণ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এটি শহুরে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনী। ‘আর কতদিন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। এটিও ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এটি একটি প্রতীকধর্মী রচনা। এগুলি ছাড়াও তাঁর আরও অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
তাঁর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ‘খাপছাড়া’ পত্রিকায়। তিনি তাঁর বড় বোনের স্বামী এমএ কবীর ও ড. আলিম চৌধুরী সম্পাদিত ‘যাত্রিক’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে ‘প্রবাহ’ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া জহির রায়হান ‘সমকাল’, ‘চিত্রালী’, ‘সচিত্র সন্ধানী’, ‘সিনেমা’, ‘যুগের দাবী’ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ‘চিত্রালী’-তে ‘প্রবেশ নিষেধ’ শিরোনামে কিছুদিন একটি ধারাবাহিক ফিচার লিখেছিলেন।
রাজনৈতিক ঘটনা-আন্দোলন জহির রায়হানকে কিশোর বয়সেই নাড়া দিতো। ১৯৪৫ সালে ‘ভিয়েতনাম দিবস’-এর মিছিলে তিনি অংশগ্রহণ করেন। সেই মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও আহত হন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মিছিলেও তিনি উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিতেন। দেশ-বিভাগের পর গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সক্রিয় সদস্য বসন্ত ভৌমিক ও ক্ষিতিশ চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তাঁর রাজনৈতিক চেতনায় এঁদের প্রভাবও পড়েছিল। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। এ সময় অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের দ্বারা সক্রিয় বাম রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত ও দীক্ষিত হন তিনি।
১৯৫৩ কী ৫৪ সালের দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। এ সময়ে মনি সিংহের দেয়া রাজনৈতিক নাম ‘রায়হান’ গ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার কারারুদ্ধ হয়েছেন তিনি। প্রথমে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়ে কারাবরণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দশ জনের খন্ড খন্ড মিছিল বের হয়। প্রথম দশজনের মধ্যে ছিলেন জহির রায়হান। এই মিছিল অল্প কিছুদূর অগ্রসর হবার পরেই পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে। ওই বছরই জুন মাসে শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরতে এসে পুলিশ জহির রায়হানকে ধরে নিয়ে যায়। তিন মাস কারাভোগ করেন তিনি। এরপর তিনি ১৯৫৫ সালে গ্রেফতার হয়ে তিন সপ্তাহ বন্দী থাকেন। ১৯৫৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি পুনরায় রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হন এবং তিন মাস কারাগারে থাকেন।
পরিচালক এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময়ে ওই ছবির নায়িকা সুমিতা দেবীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরী হয়। এরপর ১৯৬১ সালে তিনি সুমিতা দেবীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের দু’ সন্তান- বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। পরে ১৯৬৮ সালে তিনি চিত্রনায়িকা সুচন্দাকে বিয়ে করেন। সুচন্দা ও জহির রায়হানের দু’ সন্তান- অপু এবং তপু।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে জহির রায়হান ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল কুমিল্লা দিয়ে ভারতে চলে যান। কলকাতায় গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে জহির রায়হানের যোগাযোগ হয়। সে সময় কলকাতায় বাংলাদেশের যে-সব সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং সংস্কৃতিকর্মী শরণার্থী হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদেরকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্সিয়া’ গঠিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ডক্টর আজিজুর রহমান মল্লিক। তিনি এই সংগঠনের সভাপতি ও জহির রায়হান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জহির রায়হান অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়ে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিলো চলচ্চিত্রকারের, আর তাঁর অস্ত্র ছিলো ক্যামেরা। যে মুষ্টিমেয় সংখ্যক শিল্পী সাহিত্যিক স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন জহির রায়হান তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
জহির রায়হান ছিলেন এদেশের প্রগতিশীল চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা। তিনি ছিলেন একাধারে কাহিনীকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা, পরিচালক, চিত্রগ্রাহক এবং প্রযোজক। চলচ্চিত্রের আঙ্গিক ও গঠনশৈলীর নানান দিক নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এক নব দিগন্তে। এদেশে তিনিই প্রথম ইংরেজি ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নির্মাণ করেন। তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম রঙীন ছবি ‘সঙ্গম’ তৈরি করেন জহির রায়হান, তাঁর হাতেই প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি ‘বাহানা’র জন্ম হয়।
ছাত্রজীবন থেকেই জহির রায়হান ছায়াছবি সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। ছাত্রজীবনের শুরুতে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বই এবং পত্রপত্রিকার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিলো। ‘৫২ সালে কারাবরণের পর মুক্তি পেয়ে তিনি কলকাতায় প্রমথে বড়ুয়া মেমোরিয়াল ফটোগ্রাফিক স্কুলে চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষা লাভের জন্যে ভর্তি হন। কিন্তু দশ মাসের কোর্স তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি, ছয় মাস পড়াশুনা করার পর অর্থাভাবে ঢাকায় ফিরে আসেন।
তারপর ছাত্রজীবন শেষ হবার আগেই ‘৫৬ সালের শেষদিকে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এ জে কারদারের সঙ্গে পরিচিত হন। সে সময়ে কারদার ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ ছবি করার জন্য ঢাকায় আসেন। কারদার জহির রায়হানকে এই ছবির সহকারী পরিচালক নিযুক্ত করেন। এখান থেকেই শুরু হয় জহির রায়হানের চলচ্চিত্র জীবন। ‘জাগো হুয়া সাবেরা’র পর তিনি পরিচালক সালাউদ্দিনের ‘যে নদী মরুপথে’ এবং পরিচালক এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ ছবিতে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয় ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এফডিসি)। এবার তিনি নিজেই ছবি তৈরিতে হাত দিলেন, সহকারী নয়- পরিচালক হিসেবে।
১৯৬১ সালে তার প্রথম পরিচালিত ছবি ‘কখনো আসেনি’ মুক্তি লাভ করে। এরপর তিনি পরিচালনা করলেন ‘সোনার কাজল’ (১৯৬২), ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩), ‘সঙ্গম’ (উর্দু : ১৯৬৪), ‘বাহানা’ (১৯৬৫), ‘বেহুলা’ (১৯৬৬), ‘আনোয়ারা’ (১৯৬৭) এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। তাঁর ‘আর কতদিন’ উপন্যাসের ইংরেজি ভাষান্তরিত ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সমাপ্ত হবার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তিনি চলে যান ওপার বাংলায়। এ সময় তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচারকে কেন্দ্র করে তৈরী করেন প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘বার্থ অব আ নেশন’। তাঁর তত্ত্বাবধানে বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’ এবং আলমগীর কবীরের ‘লিবারেশন ফাইটারস’ নামক প্রামাণ্যচিত্র দু’টি নির্মিত হয়।
চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি জহির রায়হান অনেকগুলো ছবি প্রযোজনা করেন। সেগুলো হলো, ‘জুলেখা’ (১৯৬৭), ‘দুই ভাই’ (১৯৬৮), ‘সংসার’ (১৯৬৮), ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’ (১৯৬৮), ‘কুচবরণ কন্যা’ (১৯৬৮), ‘মনের মত বউ’ (১৯৬৯), ‘শেষ পর্যন্ত’ (১৯৬৯) এবং ‘প্রতিশোধ’ (১৯৭২)।
জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস ১৯৬৪ সালে ‘আদমজী পুরস্কার’ লাভ করে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের জন্য তাঁকে বাংলা একাডেমী পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়।
তৎকালীন পাকিস্তানে ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘কাঁচের দেয়াল’ ছবিটি নিগার পুরস্কার লাভ করে। এই ছবিটি ৭টি শাখায় পুরস্কার জিতে নেয়। তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ এবং ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবি দুটিকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৯২ সালে সাহিত্যে কৃতিত্বের জন্য স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে জহির রায়হান ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ফিরে আসেন। ফিরে এসে শুনলেন অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। তিনি পাগলের মতো তাঁকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। এমনি সময়ে কোনো একটি সূত্র থেকে তিনি সংবাদ পেলেন শহীদুল্লাহ কায়সার জীবিত অবস্থায় মিরপুরে আটক আছেন। জহির রায়হান ৩০ জানুয়ারি সার্চ পার্টির সঙ্গে মিরপুরে যান। এরপর তাঁর আর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে গিয়ে তিনি নিজেই চিরকালের জন্যে নিখোঁজ হয়ে গেলেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম : জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার মজুপুর গ্রামে। তাঁর পারিবারিক নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। তবে ছেলেবেলায় তাঁকে ডাকা হতো জাফর বলে।
বাবা-মা: বাবা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন।
লেখাপড়া: নিজ পরিবারেই জহির রায়হানের পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়। শৈশব-কৈশোর ও স্কুল জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কলকাতায়। ১৯৪০ সালে তিনি কলকাতা মডেল স্কুলে ভর্তি হন। তাঁর বাবা তখন কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। মডেল স্কুলে তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তাঁকে মিত্র ইনস্টিটিউশনে (মেইন) ভর্তি করা হয়। এখানে সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি আলীয়া মাদ্রাসার অ্যাংলো-পার্শিয়ান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাবার সঙ্গে মজুপুর গ্রামে চলে আসেন। ওই সময় তিনি গ্রামের আমিরাবাদ স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। গ্রামের আমিরাবাদ হাই স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ঢাকা কলেজে পড়াশুনার সময় তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে জহির রায়হান ঢাকা কলেজ থেকে আই.এসসি. পাস করেন। ওই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। এক বছর পর তিনি অর্থনীতি ছেড়ে বাংলা বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হন।
কর্মজীবন: তাঁর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ‘খাপছাড়া’ পত্রিকায়। তিনি তাঁর বড় বোনের স্বামী এমএ কবীর ও ড. আলিম চৌধুরী সম্পাদিত ‘যাত্রিক’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে ‘প্রবাহ’ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া জহির রায়হান ‘সমকাল’, ‘চিত্রালী’, ‘সচিত্র সন্ধানী’, ‘সিনেমা’, ‘যুগের দাবী’ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ‘চিত্রালী’-তে ‘প্রবেশ নিষেধ’ শিরোনামে কিছুদিন একটি ধারাবাহিক ফিচার লিখেছিলেন।
ছাত্রজীবন শেষ হবার আগেই ‘৫৬ সালের শেষদিকে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এ জে কারদারের সঙ্গে পরিচিত হন। সে সময়ে কারদার ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ ছবি করার জন্য ঢাকায় আসেন। কারদার জহির রায়হানকে এই ছবির সহকারী পরিচালক নিযুক্ত করেন। এখান থেকেই শুরু হয় জহির রায়হানের চলচ্চিত্র জীবন। ‘জাগো হুয়া সাবেরা’র পর তিনি পরিচালক সালাউদ্দিনের ‘যে নদী মরুপথে’ এবং পরিচালক এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ ছবিতে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয় ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এফডিসি)। এবার তিনি নিজেই ছবি তৈরিতে হাত দিলেন, সহকারী নয়- পরিচালক হিসেবে।
১৯৬১ সালে তার প্রথম পরিচালিত ছবি ‘কখনো আসেনি’ মুক্তি লাভ করে। এরপর তিনি পরিচালনা করলেন ‘সোনার কাজল’ (১৯৬২), ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩), ‘সঙ্গম’ (উর্দু : ১৯৬৪), ‘বাহানা’ (১৯৬৫), ‘বেহুলা’ (১৯৬৬), ‘আনোয়ারা’ (১৯৬৭) এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। তাঁর ‘আর কতদিন’ উপন্যাসের ইংরেজি ভাষান্তরিত ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সমাপ্ত হবার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তিনি চলে যান ওপার বাংলায়। এ সময় তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচারকে কেন্দ্র করে তৈরী করেন প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘বার্থ অব আ নেশন’। তাঁর তত্ত্বাবধানে বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’ এবং আলমগীর কবীরের ‘লিবারেশন ফাইটারস’ নামক প্রামাণ্যচিত্র দু’টি নির্মিত হয়।
চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি জহির রায়হান অনেকগুলো ছবি প্রযোজনা করেন। সেগুলো হলো, ‘জুলেখা’ (১৯৬৭), ‘দুই ভাই’ (১৯৬৮), ‘সংসার’ (১৯৬৮), ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’ (১৯৬৮), ‘কুচবরণ কন্যা’ (১৯৬৮), ‘মনের মত বউ’ (১৯৬৯), ‘শেষ পর্যন্ত’ (১৯৬৯) এবং ‘প্রতিশোধ’ (১৯৭২)।
মৃত্যু : জহির রায়হান ৩০ জানুয়ারি সার্চ পার্টির সঙ্গে মিরপুরে যান নিঁখোজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে। এরপর তাঁর আর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে গিয়ে তিনি নিজেই চিরকালের জন্যে নিখোঁজ হয়ে গেলেন।
তথ্যসূত্রঃ
জহির রায়হান- সরোয়ার জাহান, বাংলা একাডেমী
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস- মোহাম্মদ হান্নান
জহির রায়হান রচনাবলী- ড. আশরাফ সিদ্দিকী
লেখক: মৌরী তানিয়া এবং শেখ রফিক