জুয়েল আইচ, বাংলাদেশে যাদু র পথপ্রদর্শক
কাগজ থেকে টাকা তৈরি কিংবা মানুষকে দ্বিখণ্ডিত করে আবার জোড়া লাগানোর কথা বলতেই সবার স্নায়ুতে যে বিষয়টি প্রথম কড়া নাড়ে সেটি যাদু। আর যাদুকে যিনি বিনোদন থেকে শিল্পের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে পরিচিত ও সম্মানিত করেছেন তিনি যাদুকর জুয়েল আইচ। তিনি কেবল যাদু শিল্পীই নন; একাধারে বাঁশিবাদক, চিত্রশিল্পী, সমাজসেবী ইত্যাদি নানা পরিচয়ে পরিচিত। এছাড়াও তাঁর আরেকটি পরিচয় রয়েছে- তিনি একজন দেশপ্রেমী মুক্তিযোদ্ধা। আর এই পরিচয়টিকেই তিনি সবচেয়ে মূল্যবান মনে করেন।
শিক্ষাজীবন
জুয়েল আইচের ছেলেবেলা কেটেছে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার সমদেকাঠির গ্রামের বাড়িতে। সেই সুবাদে সমদেকাঠি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন হয়। পরে তিনি পিরোজপুর শহরে চলে আসেন। সেখানকার সরকারি হাইস্কুল থেকে এস.এস.সি. এবং স্থানীয় কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এছাড়াও শিক্ষকতার সুবাদে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে বি.এড. কোর্স সমাপ্ত করেন।
আকর্ষণের জন্ম
বাবার আঁকাআঁকির কারণে জুয়েল আইচের আকর্ষণ জন্মে চিত্রশিল্পের প্রতি। আবার ছোট বেলায় গ্রামের মেলায় বাঁশি দেখে এবং বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বেদেদের বাঁশি বাজানো দেখে তাঁর আগ্রহ জন্মেছিল বাঁশি বাজনোর প্রতি। তবে যাদুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ভিন্ন। কারো যাদু দেখে নয়, কেবল বই পড়েই যাদুর প্রতি মোহাবিষ্ট হন তিনি। ছোটবেলা থেকেই যাদুর প্রতি একটা অন্যরকম টান অনুভব করতেন। বন্দে আলী মিয়ার ‘রূপকথা’ তাঁকে টেনে নিয়ে যেত যাদুর দেশে। যাদুর পাশাপাশি আঁকাআঁকি এবং বাঁশিটাকে এখনো ধরে রেখেছেন তিনি।
যেভাবে যাদু তে এলেন
প্রথমদিকে এক ধরনের ভাললাগা থেকেই যাদু ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ শুরু হয়। কিন্তু একটা সময় তিনি বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে পাকিস্তানের সঙ্গে এক হকি ম্যাচে বাংলাদেশ ১৭ গোলে হেরে যায়। মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল আইচ এভাবে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের হেরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি। কষ্টে তাঁর বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল। এরপর শপথ নেন, যেভাবেই হোক বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে সম্মানের আসনে বসাতেই হবে। সেই থেকেই জোরেসোরে যাদুর চর্চা শুরু। আমাদের যাদুর হাজার বছরের ঐতিহ্যের ইতিহাস তিনি জানতেন। বাংলাদেশের মাথা উঁচু করার হাতিয়ার হিসেবে তাই নিজের জানা ক্ষেত্রকেই বেছে নেন। এরপরের ইতিহাস কেবল সামনে চলার। তাঁর যাদু শিল্পে আসাটাকে তিনি সম্পূর্ণই মুক্তিযুদ্ধের ফসল বলে মনে করেন।
শিক্ষক জুয়েল আইচ
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ রাজধানী ঢাকার দিকে ছুটতে লাগল। জুয়েল আইচ করলেন বিপরীত কাজটি। তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেন গ্রামে। গ্রাম ও শহরের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণ হিসেবে তিনি শিক্ষার অভাবকেই প্রধান মনে করতেন। শিক্ষার বিষয়টা শহরের চেয়ে গ্রাম থেকেই সবচেয়ে ব্যাপকভাবে আরম্ভ করা উচিত বলে মনে হয়েছিল তাঁর। তাই শিক্ষকতা দিয়েই কর্মজীবন শুরু করেন জুয়েল আইচ।
হঠাত্ ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঘটে এক মারাত্মক দুর্ঘটনা। স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একদল ডাকাত তাঁর বন্ধু নিটুল করের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। ওই বন্ধুর বাড়িতেই ছিল জুয়েল আইচের যাদুর সমস্ত সরঞ্জাম, বইপত্র। একাত্তরের পরে মাত্র ছ’বছরের মাথায় তিনি দ্বিতীয়বারের মত সর্বস্ব হারান। এরপর শিক্ষকতা ছেড়ে ঢাকায় ফিরে এসে নিজেকে জড়ালেন যাদু শিল্পে। তাঁর প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে লাগল টেলিভিশনে, মঞ্চে, দেশে, বিদেশে।
মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল আইচ
বাংলাদেশে যাদুর সম্রাট হিসেবে পরিচিত এই গুণী শিল্পী স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। জুয়েল আইচ যখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র তখন শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তারুন্যের রক্ত টগবগ করছে তাঁর শরীরে। উপলব্ধি করলেন পাকিস্তানের নির্যাতনে বাংলাদেশীদের দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। ওদের শোষণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই উপায় আর সেটা হল সশস্ত্র সংগ্রাম। তাই জীবনের মায়া ছেড়ে নেমে পড়লেন হিংস্র হায়ানাকে বধ এবং দেশকে শৃংখলমুক্ত করার সংগ্রামে। পিরোজপুর জেলার স্বরুপকাঠি থানার পেয়ারাবাগান নামক স্থানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে হঠাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর।
পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কখোনো গেরিলা যুদ্ধে আবার কখনো সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। অনাহার, অনিদ্রা, পায়ের গভীর ক্ষত, চিকিত্সাবিহীন ‘সুইসাইড মাইগ্রেন’ নিয়ে দিনরাত ছোটাছুটি আর নিষ্ঠুরতর প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধের কথা ভাবলে জুয়েল আইচ আজো শিউড়ে ওঠেন। অসংখ্য প্রিয়জনকে হারানোর স্মৃতি তাঁর হৃদয়কে এখনো ভারাক্রান্ত করে। নিজের জীবন রক্ষা পেলেও পাক হানাদার এবং তাদের দোসরদের হাতে সহায় সম্বল সবই হারান। সম্পূর্ণ নিজস্ব অবস্থায় নতুন করে আবার জীবন শুরু করেন। স্বাধীনতার গৌরব ছাড়া তখন তাঁর আর কিছুই ছিলনা।
সমাজসেবী জুয়েল আইচ
দেশের প্রয়োজনে জুয়েল আইচ ১৯৭১ সালে কোমল তুলি, বাঁশি আর যাদু দন্ড ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। তেমনি সমাজের প্রয়োজনে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ যখন চরমে তখন তিনি রাজপথে নেমে এসেছেন। অংশ নিয়েছেন ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ক সচেতনতা অভিযানে। তাছাড়া ধূমপান বিরোধী অভিযানে তার অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি যুক্ত ছিলেন ‘আমরা ধুমপান নিবারণ করি (আধুনিক)’ এর সাথে। তাঁর এ অভিযানের প্রেক্ষিতে সরকার সিগারেটের প্যাকেটে “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” কথাটি লেখার নিয়ম চালু করে। এসিড সন্ত্রাস বিরোধী প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে যুক্ত রয়েছেন এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) সঙ্গে। এছাড়াও পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামে ‘পরিবেশ আন্দোলন’ এবং মাদক বিরোধী অভিযান ‘মাদককে না বলো’-এর সঙ্গে জুয়েল আইচ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন।
এখানেই তিনি সমাপ্তি টানেননি। মৃত্যুর পরও কিভাবে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা যায় সেই ভাবনায় মরণোত্তর দেহ দান করেছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন মানব কল্যাণে মরণোত্তর দেহদাতা সমিতি। তিনি এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
সংগ্রহশালা
জুয়েল আইচের রয়েছে বিশাল সংগ্রহ ভাণ্ডার। এ সংগ্রহশালার অধিকাংশই বই। এর মধ্যে যাদুর বইতো আছেই, আরো আছে প্রবন্ধ ও কবিতার বই, দর্শন, উপন্যাস, জীবনী, আত্মজীবনী, আত্মউন্নয়ন, নৃতত্ব, স্বাস্থ্য, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোলসহ বিচিত্র ধরনের হাজার হাজার বই। তাঁর সংগ্রহে এমন অনেক দুর্লভ বই রয়েছে যার প্রকাশ বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে।
জুয়েল আইচের সংগহশালার আরেকটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে প্রচুর ভিডিও ও অডিও ক্যাসেট, ডিভিডি এবং সিডি। এর অধিকাংশই ক্লাসিক কিংবা ক্লাসিক্যাল। তাঁর সংগ্রহের আরেকটি ভিন্ন বিষয় হলো বাঁশি। তাঁর সংগ্রহশালায় কয়েকশ দেশী-বিদেশী বাঁশি রয়েছে। তিনি নিয়মিত বাঁশি বাজান। তাই সংগ্রহ করেছেন দেশ বিদেশের নানা আকারে নানা ধরনের অসংখ্য বাঁশি। নিজে আবিষ্কার করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার একটি বাঁশী। পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া এই বাঁশীর নাম রেখেছেন ‘জুয়েল বাশী’। বড় বাঁশী বাজাতে গেলে নিজের ঘাড় অনেকখানি বাঁকাতে হয় যা অনেক বেশি কষ্টসাধ্য। তাই নিজের ঘাড় না বাঁকিয়ে বাঁশীর ঘাড় বাঁকিয়ে দিয়েছেন। প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে তৈরী এই বাঁশীর আকৃতি অনেকটা ইংরেজী ৭ এর মতো।
তাঁর সবচেয়ে বড় সংগ্রহ যাদুর সরঞ্জাম। প্রতিনিয়ত গবেষণা করে নতুন নতুন আবিষ্কার করেই চলেছেন। ১৯৭৭ সালে সব কিছু পুড়ে যাওয়ার পরে যা কিছু তৈরী করেছেন তার সবকিছুই জুয়েল আইচের সংগ্রহে রয়েছে। তাঁর সংগ্রহশালাকে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংগ্রহশালার একটি বলে মনে করেন।
যাদু নিয়ে ভাবনা
ম্যাজিক বা যাদুকে জুয়েল আইচ সব সময় একটি শিল্প এবং বিজ্ঞান বলে মনে করেন। যাদু একই সাথে অন্যান্য শিল্পের মত একটি কৌশলও বটে। যে কোনো শিল্পই বিজ্ঞান কেননা এটি এমনই বিষয় যা পুনঃনির্মাণ বা বারবার করা সম্ভব। তাই যাদু শিল্প সম্পূর্ণভাবেই বিজ্ঞান। তবে বাংলাদেশের যাদু শিল্পে তাঁর পরে উল্লেখযোগ্য কেউ না আসায় জুয়েল আইচ কিছুটা চিন্তিত। তিনি মনে করেন, যাদুকে তিনি যে পর্যায়ে নিয়ে গেছেন সেই অবস্থান ধরে রাখতে নতুনদের এগিয়ে আসতে হবে।
পুরস্কারের ডালা
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এই গুণী শিল্পী বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পেয়েছেন দেশসেরা জাতীয় পুরস্কার ‘একুশে পদক’। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে কাজী মাহমুদুল্লাহ স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ টেলিভিশন অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা জাতীয় পুরস্কার বেস্ট ম্যাজিসিয়ান অব দ্যা ইয়ার। সোসাইটি অব অ্যামেরিকান ম্যাজিসিয়ান ১৯৮১ সালে জুয়েল আইচকে এ পুরস্কারে ভুষিত করে। এছাড়া ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে তাঁর দখলে প্রায় দেড়শ’র মতো পুরস্কার রয়েছে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
যাদুর ওপর কোনো একাডেমিক শিক্ষা না নিয়েও নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এতদূর এগিয়েছেন জুয়েল আইচ। তরুণ প্রজন্মের অভাবটা তাই তাঁর কাছে সহজেই অনুভূত হয়। আর তাই ভবিষ্যতে একটি ম্যাজিক একাডেমি খোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। এখন তিনি এ ব্যাপারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্মৃতির যাদু ঘর
জুয়েল আইচের স্মৃতির কুঠরিতে কড়া নাড়ে হাজারো চমত্কার ঘটনা। এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা তাঁকে আজও আবেগাপ্লুত করে তোলে। যেমন-
আমেরিকায় প্রথম দিনের ঘটনা
১৯৮১ সালের পহেলা জুলাই আমেরিকার যাদু শিল্পী সম্মেলনে যোগদানের স্মৃতি জুয়েল আইচের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। তাঁর মুখ থেকেই শুনুন, “বাংলাদেশ নামে একটি দেশ আছে সেটিই জানা ছিলনা আমেরিকানদের। বুঝতে বাকি রইল না, ওরা আমাকে অবজ্ঞার চোখেই দেখবে। যা ভাবলাম তাই। বস্টনের নোগান বিমানবন্দরে নামার পর কাস্টমস কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কত ডলার সঙ্গে এনেছো?’ ভাবখানা এমন যে, আমাদের মতো গরিব দেশ থেকে কেউ এদেশে কিছু নিয়ে আসে না, কেবল নিয়ে যায়। আমি বললাম, ‘আমি একজন বাঙ্গালি যাদুকর। ডলার আমার জন্য কোনো সমস্যাই না।’ সে বললো, ‘ওসব তোমরা মঞ্চেই পারো, এখানে ওসব চলবে না।’ পরক্ষণেই সে কিছু সাদা কাগজ টুকরো করে বললো, ‘পারলে এগুলোকে ডলার বানাও দেখি।’ আমি হাত বুলিয়ে টুকরো কাগজগুলোকে ডলার বানিয়ে দিতেই শুরু হলো হৈ চৈ। সাদরে সবাই আমার মালপত্র বহন করে আমাকে বিমান বন্দরের বাইরে নিয়ে এলো। তার পরের ঘটনা আরও অবাক করা। সোসাইটি অব আমেরিকান ম্যাজিসিয়ানস সম্মেলনের জেনারেল চেয়ারম্যান নরম্যান জে হো সহ প্রায় সবগুলো কমিটির চেয়ারম্যানরা আমাকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করছেন। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। সে দৃশ্য আজও আমার স্বপ্ন-স্মৃতি হয়ে আছে।”
গাইবান্ধার ঘটনা
“১৯৭৯ সালে গাইবান্ধার বি. ডি. হলে জিভ কেটে আবার জোড়া লাগানোর যাদু প্রদর্শনী চলছে। মিডিয়ামের নাক, চোখ, জিভ সমস্ত মুখমণ্ডল দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত দর্শকরা (যাদের মধ্যে ডাক্তার ও মেডিকেলের ছাত্ররাও ছিলেন) নিথর হয়ে পড়তে লাগলেন। পরে যখন জিভটা কেটে ডাক্তারদের হাতে দেওয়া হলো তখন হলের অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। এই শো’টি ব্যাপক প্রশংসিত হল। এক পর্যায়ে বিভিন্ন মহিলা সংগঠন ও মেয়েদের স্কুল থেকে মেয়েদের জন্য একটি বিশেষ প্রদর্শনী করার অনুরোধ জানানো হলো। অবশেষে আয়োজন করা হলো বিশেষ প্রদর্শনীর। অনুষ্ঠানের দিন আমার বেশ সংশয় জাগতে লাগলো, পুরুষরাই যেখানে এ দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে যায় মেয়েদের অবস্থা না জানি কি হয়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ব্যাপারটি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। অনুষ্ঠান শুরু হল। সবাই বেশ মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করছে। জিভ কাটার পর সবাই বেশ জোরে হাততালি দিয়ে আমাকে অনুপ্রাণিত করল। আমি ভাবলাম, ‘ব্যাপার কি? ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের স্নায়ুর জোর দেখছি বেশি।’ অনুষ্ঠান শেষে যখন অনেকে মঞ্চে অটোগ্রাফ নিতে এলো জিজ্ঞেস করলাম, ‘জিভ কাটার এ দৃশ্য দেখে পুরুষরা পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে যায়। আপনারা যে একটুও ভীত হননি?’ সঙ্গে সঙ্গে তারা দলবেঁধে বলে উঠলো, ‘আপনার এই ভয়াবহ ম্যাজিকটির কথা আমরা সবাই আগে থেকেই শুনেছিলাম। তাই ওই দৃশ্য আসার আগেই আমরা সবাই চোখ বন্ধ করে ফেলি। শেষ হওয়ার পর আমরা চোখ খুলে হাততালি দিয়েছি।'”
ছোটবেলার যাদু -যাদু খেলা
একবার জুয়েল আইচের গ্রাম সমদেকাঠিতে সার্কাস দল মজার মজার খেলা দেখাচ্ছে। এর মধ্যে যাদুও ছিল। যাদুটি হচ্ছে, একজন মানুষকে টেবিলে শুইয়ে তাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর চওড়া একটি ছুরি লোকটির গলার বসিয়ে দেওয়া হয়। লোকটি ছটফট করতে থাকে আর রক্ত ঝড়তে থাকে। কিন্তু কিভাবে এটি সম্ভব তা ভাবিয়ে তোলে শিশু জয়েল আইচকে। ভাবতে ভাবতে একসময় আবিষ্কার করে ফেললেন কৌশলটি। মাটির চুলায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা একটি পাতলা কাঠ দিয়ে তৈরি করলেন ছুরি। আর রক্ত বানালেন পুই ফলের লাল টকটকে রস দিয়ে। খেলার সাথী গোবিন্দকে মিডিয়াম বানালেন। তবে গলা কাটতে দিতে রাজি না হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো গোবিন্দর পা কেটে প্রদর্শনী করা হবে। বাড়ির পাশেই কলাগাছের পাতা দিয়ে প্যান্ডেল তৈরি করা হলো। খেলার সব সাথী উপস্থিত। পয়সা হিসেবে নেওয়া হলো শামুকের মুখের শুকনো চাকতি। জুয়েল আইচ বললেন, ‘যাদু শুরু হলো, গোবিন্দর পায়ে রক্তমাখা ছুরিটি বসিয়ে দিলাম। সবাই অবাক হলো। আমি সফল হলাম। সেই আমার যাদু -যাদু খেলা এবং প্রথম মঞ্চ প্রদর্শনী।’
জুয়েল আইচের পরিবার
জুয়েল আইচের বাবা-মা মারা গেছেন অনেক আগে। স্ত্রী বিপাশা আইচ ও একমাত্র মেয়ে খেয়া আইচকে নিয়ে সংসার জুয়েল আইচের। স্ত্রী বিপাশা একদিকে সংসার এবং অন্যদিকে তাঁর যাদুর সহযাত্রী। এ দু’টি ক্ষেত্রই জুয়েল আইচের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছে স্ত্রী বিপাশা। সংসারের পাশাপাশি যাদুতে স্ত্রী বিপাশার অনুপ্রেরণার কথা অকপটেই স্বীকার করেন জুয়েল আইচ। বললেন, ‘ওর অনুপ্রেরণা ও ভালবাসায় আজও আমি পুরোদ্যমে কাজ করার সাহস পাই।’ এ তারকা দম্পতির ভালবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় করেছে তাদের একমাত্র মেয়ে খেয়া।
প্রোফাইল
পুরো নাম : জুয়েল আইচ
ডাক নাম : জুয়েল
স্ত্রী : বিপাশা আইচ (গৃহিনী ও যাদু শিল্পে সহায়ক)
সন্তান : একটি (কন্যা-খেয়া আইচ)
জন্মদিন : ১০ ই এপ্রিল
জন্মস্থান : পিরোজপুর
বিয়ে : ১৯৮৫
মঞ্চে প্রথম যাদু প্রদর্শন : ১৯৭২ সালে
মিডিয়ায় প্রথম যাদু প্রদর্শন : ১৯৭৯ সালে
দেশ ভ্রমণ : যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত এবং মধ্যপাচ্যের সব দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ
প্রথম বিদেশ সফর : যুক্তরাষ্ট্র (১৯৮১ সালে)
প্রিয় যাদু শিল্পী : পিসি সরকার সিনিয়র, ডেভিড কপারফিল্ড
লেখক : সাদেক হোসেন