জন্ম ও বংশ পরিচয়
১৯৪১ সালের ২৩ অক্টোবর বিক্রমপুর শ্রীনগর থানার সমষপুর গ্রামে আজকের চাষী নজরুলের জন্ম। চাষী ছিলেন বাবা-মায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র। বাবা মোসলেহ উদ্দিন আহম্মদ, ভারতের বিহারে টাটা আয়রন এন্ড স্টীল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সেদিন বাবা ডায়েরিতে খুব যত্ন করে টুকে রেখেছিলেন পুত্র জন্মের সময়-ক্ষণ। ভেবেছিলেন ছেলেকে টাটা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার করবেন । বাবার এ ভাবনা বাস্তব না হয়ে মনে হয় ভালোই হয়েছিল, আমরা আমাদের মতো করে পেয়েছি একজন চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলামকে ।
বাবা মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ লস্করের পূর্বপুরুষেদের সম্বন্ধে যা জানা যায় সে অনুযায়ী প্রথম পুরুষ আমিন লস্কর, তারপর মোমেন ল
স্কর। এভাবে আহমেদ লস্কর, জরিপ লস্কর তারপর চাষীর দাদা হেলাল উদ্দিন আহমদ লস্কর। চাষী নজরুল ইসলামের পূর্বপুরুষদের নামের সঙ্গে লস্কর এলো কি করে জানা নেই। একযুগে বাদশাহের সৈন্যদলকে বলা হতো লস্কর। তবে আমাদের চাষীর নাম কি করে নজরুল ইসলাম হলো তা নিয়ে একটি গল্প আছে। নামের ক্ষেত্রে যা হয়, পারিবারিক নামের ধারাবহিকতার ঐতিহ্য রক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টোতো বটেই, গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিকও বটে।
জানা যায়, শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক চাষীর নাম রেখেছিলেন। চাষীর মামা চাষী ইমাম উদ্দিন শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতি করতেন এবং নবযুগ ও লাঙ্গল পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই সূত্রেই একদিন ফজলুল হককে একটা নাম দিতে বলা হলে তিনি চাষী ইমাম উদ্দিনের ‘চাষী’ আর কাজী নজরুল ইসলামের ‘নজরুল ইসলাম’ মিলিয়ে একটা নাম দেন। চাষী নজরুল ইসলামের নামের এ হলো ইতিহাস। ঘটনাচক্রে সেদিন সেখানে কাজী নজরুল ইসলাম এবং ‘সওগাত’-এর সম্পাদক নাসির উদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। চাষী নজরুলের বয়স সেদিন মাত্র তিন মাস। মা আর মামার সঙ্গে জামশেদপুর বাবার কাছে যাচ্ছিলেন। পথে কলকাতায় ফজলুল হকের বাসায় এই ঘটনা। তখন পর্যন্ত সবাই চাষীকে টিনা নামে ডাকতো। আজকের প্রতিভাবান শিল্পী চাষী নজরুলের দ্যুতিময় জীবনের আশীর্বাদ হয়তো একচল্লিশের ঐ দুপুরেই এসেছিল।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
চাষী নজরুল ইসলামের শৈশবের বেশিরভাগ পড়ে আছে জামশেদপুরে। তিন মাস বয়সের চাষীকে কোলে করে চাষীর মা স্বামীর চাকরিস্থল জামশেদপুরে গিয়েছিলেন। তারপর টানা চার বছর সেখানে ছিলেন। এরপর কিছুদিনের জন্য আবার নিজেদের গ্রাম বিক্রমপুরে ফিরে এলেন। বিক্রমপুরে চাষীদের বাড়ির সামনে বেশ খোলা জায়গা ছিল। তার কিছু অংশে পারিবারিক হাট বসতো-সবাই বলতো হাটখোলা। পাশেই ছিল একটা প্রাইমারী স্কুল। এ স্কুলটার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চাষীর মামা চাষী ইমাম উদ্দিন,বতᐂমানে সমরপুর হাইস্কুল ও কলেজ। ঐ স্কুলেই ক্লাস ওয়ানে তাকে ভর্তি করানো হয়। ক্লাস টুতে ওঠার পর চাষীর বাবা আবার তাকে নিয়ে গেলেন জামশেদপুরে। ওখানে চাষীর বাবারই প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল মুসলিম স্কুলে তিনি ফাইভ পর্যন্ত পড়েন। তারপর ক্লাস সিক্স-সেভেন পড়েন গোলামুড়ি মাধ্যমিক স্কুলে। তারপর আরডি টাটা হাইস্কুলে-এখান থেকেই পরে চাষী ইলেভেন পাস করেন। ঠিক এ সময় চাষীর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও তিনি চাননি সবাই বিক্রমপুরে ফিরে আসুক। মোসলেহ উদ্দিন সাহেব ভেবেছিলেন টাটা কোম্পানিতে চাষীর একটা চাকরি হবে। মূলত তিনি জামশেদপুরে স্থায়ীভাবে থাকার পরিকল্পনা করেছিলেন। চাষীর মা শায়েস্তা খানম সেরকমটি চাইলেন না। শেষমেশ ১৯৫৮ সালে সবাই বিক্রমপুর চলে এলেন।
এভাবে জামশেদপুরে চাষীর জীবনের ১৮ বছর পেরিয়ে গেল। জামশেদপুর তাঁদের ছাড়তে হলো। এ জামশেদপুরে হাজারো স্মৃতি চাষীকে এখনো নস্টালজিক করে তোলে। চাষী এক জায়গায় বলেছেন, ‘আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর জামশেদপুর। সেই সাঁওতালপাড়া, তাঁদের ছেলেমেয়ে, শালবন, মহুয়াবন, দালমা পাহাড় – সেখানকার সবকিছুই অপূর্ব।’ চাষী নজরুলরা থাকতেন জামশেদপুরের এগ্রিকো এরিয়াতে। সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটে ক্রিকেট, ফুটবল খেলা আর সিনেমা দেখা নিয়ে। ভারতের যুবদলের অধিনায়ক, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অধিনায়ক পিকে ব্যানার্জী তখনকার দিনে স্বনামখ্যাত ফুটবলার। চাষী নজরুলের চেয়ে বছর পাঁচেক বড় হলেও তাঁরা একই টিমে খেলতেন।
চাষী ছিলেন দিলীপ কুমারের প্রচণ্ড ভক্ত। দিলীপ কুমারের কোনো ছবিই মিস করতেন না। এ ভালোলাগা থেকেই মনে হয় অভিনেতা হবার বাসনা তাঁর মধ্যে বাড়তে শুরু করে। নিয়মিত নাটক, নৃত্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ তাঁকে এনে দেয় খ্যাতি এবং শিল্পী হবার প্রেরণা। এরপর পাড়া আর স্কুলে বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। শুধু সুন্দর মুখশ্রী আর যথাসর্বস্ব দৈহিক গড়ন নয়, তাঁর অভিনয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অনেকেরই। এদের মধ্যে একজন টাটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মি. কে কে রায়। তাঁর সুনজরে থাকার কারণে একটা ছোট ছবিতে চাষীকে অভিনয়ের সুযোগ করে দিলেন। টাটার জন্মদিন উপলক্ষে প্রামাণ্যচিত্রটি যেদিন প্রদর্শিত হয় নিজের অভিনয় দেখে সেদিন নিজেই মুগ্ধ হয়ে পড়েন। অভিনয়ের প্রতি উত্সাহ বেড়ে যায়, সিনেমায় অভিনয় করতেই হবে, নায়ক হতেই হবে এমন একটা ভাবনা সবসময় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।
হঠাত্ একদিন কি ভেবে মায়ের হাতের বালা চুরি করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান বোম্বেতে। মনের ভেতর জেদ সিনেমায় অভিনয় করতেই হবে। সঙ্গে দুই বন্ধু ছিল, দুইদিন যেতেই তারা পগারপার। চাষী ঐ শহরে থেকে গেলেন মীনা কুমারীর সঙ্গে দেখা করার আশায়। একদিন সত্যি সত্যি দেখা হয়ে গেল। স্টুডিওর সামনে থেকে মীনা কুমারীর স্বামী কামাল আমরোহী তাঁকে নিয়ে গেলেন বান্দ্রা বোম্বাই। মীনা কুমারী একেবারেই ভেস্তে দিলেন সবকিছু। বললেন ‘তোমার বয়স এখনও কম, তুমি বাড়ি ফিরে যাও।’ সেদিন তিনি কথা দিয়েছিলেন চাষী এম.এ. পাস করতে পারলে তাঁকে মীনা হিরো বানাবেন। এরপর আর মীনা কুমারীর মুখোমুখি হননি চাষী। এরপর যখন সুযোগ হয়েছিল বোম্বেতে যাবার ততোদিনে মীনা কুমারী মারা গেছেন। চাষী নজরুল তখন পুরদস্তুর পরিচালক, ‘ওরা এগারো জন’ বোম্বে চলচিত্র উত্সবে ঘুরে এসেছে। ২০ দিন পর জামশেদপুর ফিরে এলেন। এ ২০ দিনের মায়াভরা স্মৃতি পকেটে পুরে বেশ ক’দিন কাটিয়ে দিলেন। বাবা খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন তাই আর জামশেদপুর থাকা হলো না। বিক্রমপুরে আবার সপরিবারে ফিরে এলেন।
কর্মজীবন
১৯৫৭ সালের দিকে মুসলেহ উদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। টাটার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সপরিবারে স্বদেশে চলে এলেন। স্বদেশে মৃত্যু তাঁর অপেক্ষায় ছিল। কিছুদিন পর তিনি মারা যান। পিতার শোক ভুলে যাবার আগেই সংসারে বড় ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে।
বরিশালে বেণু খালার বাসায় ছিলেন কিছুদিন। গিয়েছিলেন চাকরির খোঁজে। এদিকে এক মামা তৎকালীন একাউনটেন্ট জেনারেল অব ইস্ট পাকিস্তান হাফিজুল্লাহ টেলিগ্রাম পাঠালেন ঢাকা থেকে, ‘জব রেডি কাম সার্প’-এএস হাফিজুল্লাহ। মামার সুপারিশে এজি অফিসে চাকরি হলো। অফিসের পোস্ট-সর্টার। ১৯৬৯ পর্যন্ত চাকরি করেছেন। বেশির ভাগ সময় অফিস ফাঁকি দিতেন। সইটই করে বেরিয়ে পড়তেন। মাস শেষে বেতন তুলতেন ১১০ রুপি-সে সময়ে অনেক টাকা। বাড়িতে টাকা পাঠিয়েও ঢাকায় নাটক-থিয়েটার করে বেড়াতেন নিয়মিত।
এফডিসি মাত্র তখন গড়ে উঠছে। খালাতো বোনের স্বামী সৈয়দ আওয়াল বিখ্যাত সিনেমা করিয়ে ফতেহ্ লোহানীর প্রধান সহকারী। চাষী চাকরির ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, একই সঙ্গে শুরু করলেন নাটক। আলী মনসুর কৃষ্টি সংঘের সঙ্গে কাজ করেন মঞ্চে অভিনয় করেন। এদিকে চাষীর সিনেমা প্রীতিটা জানতেন সৈয়দ আওয়াল। একদিন সুযোগ এলো- চাষীকে পরিচয় করিয়ে দিলেন পরিচালক অভিনেতা ফতেহ লোহানীর সঙ্গে। ফতেহ লোহানী তখন ‘আসিয়া’ করছিলেন। চাষীকে ছোট্ট একটা রোল করার জন্য নিয়েছিলেন। কিন্তু ফতেহ্’র নির্দেশে পরদিন সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৬১’র জুন মাসে চাষী কাজ শুরু করলেন। সেদিনের ক্লাপস্টিক দেয়া থেকে শুরু হলো সিনেমায় এক নতুন চাষীর জন্ম। হয়তো সেদিন থেকেই চাষী নজরুল নিজেকে চিনতে বা আবিষ্কার করতে শুরু করেছিলেন। এরপর ১৯৬৩-তে কাজ করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রাকার ওবায়েদ-উল-হকের সহকারী হিসাবে ‘দুইদিগন্ত’ ছবিতে। এভাবে কাজ করতে করতে এলো ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন আর সবার মতো। তারপর যুদ্ধশেষে বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণ করলেন। ১৯৭২-এ এই ছবির মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে চাষী নজরুলের আত্মপ্রকাশ ঘটলো। এছাড়া নিয়মিত বেতারে, টিভিতে সান্ধ্য অভিনয় অব্যাহত ছিল।
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত চাষী নজরুল ইসলাম ২০টির বেশী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। টেলিভিশনের জন্য তৈরি করেছেন নাটক। আরো কিছু তথ্যচিত্রও রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই বাংলা চলচ্চিত্রে দাগ কেটে আছে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে সময়ের। বহু বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে তাঁর একাধিক ছবি ও তিনি নিজে। শুধু তাই নয়, তাঁর সারা জীবনের কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদকও পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্যভিত্তিক কাজ করেছেন বেশি। যে কারণে অতি সহজে গতানুগতিক আর সব বাণিজ্যিক নির্মাতাদের থেকে তাঁকে আলাদা করা যায়। শেরে বাংলা, ভাসানী জিয়াউর রহমানের উপর প্রামান্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
সংক্ষেপে চাষী নজরুল ইসলামের কর্মজীবন
ক. তত্কালীন সময়ের কিংবদন্তীতুল্য পরিচালক ফতেহ্ লোহানীর সহকারী হিসেবে ১৯৬০ সালে চলচ্চিত্র জগতে কর্ম শুরু
খ. ১৯৬৩ সাল থেকে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার ওবায়েদ-উল-হক এর সঙ্গে কাজ করেছেন
গ. ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ
ঘ. বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণ ও পরিচালনা
ঙ. পরবর্তীতে আরও প্রায় বাইশটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সাফল্যের সঙ্গে নির্মাণ
চ. সম্পূর্ণ সরকারী অর্থানুকূল্যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ তিন মহত্ ব্যক্তি মাওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘটনা বহুল জীবন ভিত্তিক প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ
ছ. সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নির্মাণ
জ. জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রযোজিত প্রামাণ্য নাট্যচিত্র ‘নতুন দিগন্ত’ পরিচালনা
ঝ. বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রযোজিত প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র ‘কমলাপুর যুদ্ধ’ পরিচালনা
পারিবারিক জীবন
চাষীর পারিবারিক জীবন এক মোহনীয় সুখের। ১৯৬৯ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর দেশের অন্যতম বিখ্যাত কাজী পরিবারের কে.জি. আহমেদের মেয়ে জোত্স্না কাজীকে বিয়ে করলেন চাষী নজরুল ইসলাম। একাত্তর পূর্ববর্তী দেশের চূড়ান্ত অস্থিতিশীল পরিবেশে প্রতিটি সচেতন মহলে আন্দোলন বড় দানা আকার ধারণ করেছে। জোত্স্না কাজী তখন রাজপথে, বাংলা ছাত্রলীগ করেন। আন্দোলনের মাঠে ফজলে লোহানীর মাধ্যমে চাষীর সাথে পরিচয় হয় জোত্স্না কাজীর। তারপর এই সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। সে সময় যত প্রগতিশীল আর উদারনৈতিক পরিবারই হোকনা কেন, প্রেম করে বিয়ে করাটা আনেকের পক্ষে মেনে নেয়াটা সহজ ছিলনা। তারপর আরো জুড়ে বসেছিল চাষীর সিনেমা ইমেজ। সিনেমা করিয়েদের সেকালে কেমন অচ্ছুত ভাবা হতো তা অনেকেরই জানা। তাই বেশ কিছুদিন শ্বশুর-জামাইর সম্পর্ক বেশ রগরগা ছিল। যদিও শেষমেশ কে.জি.আহমেদ সাহেব, চাষীর প্রতি বেশ আস্থাশীল হয়ে ওঠেন।
যুদ্ধের টাটকা রিক্ততা গায়ে লেগে আছে। দেশ স্বাধীনের পর নির্মিত হলো চাষী নজরুল ইসলামের প্রথম ছবি, প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি, স্বাধীন বাংলার প্রথম ছবি- ‘ওরা ১১ জন’। তারপর ১৯৭২ এ ‘সংগ্রাম’-এর পরে একটার পর একটা ছবি নির্মাণ করে গেছেন। কিন্তু এই ছবিগুলোতো কোনো অর্থনৈতিক সমাধান ছিলনা। তারপরও নানা অর্থনৈতিক-পারিবারিক সম্পর্কে দুজন-দুজনার অবলম্বন হয়ে থেকেছেন। জোত্স্না কাজী ও চাষী নজরুল ইসলামের এই আত্মিক সম্পর্ক তাই অনেকের কাছেই দৃষ্টান্ত। শুধু তাই নয় চাষী নজরুল ইসলাম নিজেও বেশ কৃতজ্ঞ। তাঁর এই উত্থানের পেছনে জোত্স্না কাজীর অবদানকে সব সময় সর্বাগ্রে স্থান দেন। তাঁর ভাষায়, ‘জোত্স্নার কোন চাওয়া পাওয়াই ছিল না। সব সময় আমার অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছে। বরং আমার চাওয়া পাওয়া গুলোই তাঁর কাছে বড় ছিল।’ পরবর্তীতে চাষীর দুটি মেয়ে হয় চাষী আন্নী ইসলাম ও চাষী মান্নি ইসলাম। তারাও বড় হতে থাকে। বাবার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে চাষী ও জোত্স্নার সাথে যোগ হয় দুই মেয়ে। সবার মধ্যে একটা যেন নেশা বাবাকে কি করে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।
ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
ষাটের দশকের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ফতেহ লোহানীর সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে ১৯৬০ সালে চলচ্চিত্রের সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন চাষী নজরুল ইসলাম। তারপরে ১৯৭২-এ ‘ওরা ১১ জন’ দিয়ে বর্নাঢ্য চলচ্চিত্র জীবনে চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। সেই শুরুর পর এখনো কিন্তু শেষ হয়নি। এছাড়াও চাষী নজরুল অনেক অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ফুটবলের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণের কারণেই তিনি ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো একটি নামকরা জাতীয় ফুটবল ক্লাবের সাথে আজীবন জড়িত। এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনেও চলচ্চিত্র সংগঠনের কর্তা ব্যাক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সম্পাদিত দায়িত্ব সমূহ
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে চারবারের মতো সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
– সদস্য-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের চতুর্থবারের মতো
– সাবেক সদস্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যৌথ প্রযোজনা কমিটি br> – সাবেক নির্বাহী সদস্য- চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি
– সাবেক সদস্য ঢাকা মেট্রোপলিটন ফুটবল লিগ এসোসিয়েশন (ডামফা)
– সাবেক ফুটবল সম্পাদক (১৯৭৬-৮১) ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব
– ভাইস প্রেসিডেন্ট (২০০৩) ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব
– জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি।
– সাংস্কৃতিক সম্পাদক শত নাগরিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী
– উপদেষ্টা, জাতীয়তাবাদী চলচ্চিত্র পরিষদ
– সমরপুর হাইস্কুলের পরিষদ সদস্য
– চেয়ারম্যান, সায়েস্তাখানম, চাষী আজিজুল ইসলাম ট্রাস্টী বোর্ড
সম্মাননা | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
|
বিশেষজ্ঞদের চোখে
‘চাষী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে জানা- শোনা হওয়ার আগে নামের মাধ্যমেই তিনি আমার পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। এর প্রধান কারণ ছিল বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র ‘ওরা ১১ জন’ এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘সংগ্রাম’ (১৯৭৪) নির্মাণ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরপর দুটি চলচ্চিত্র পরিচালনার কারণে চাষী নজরুল ইসলাম হয়ে উঠেছিলেন পরিচালকদের মধ্যে খুবই আলোচিত। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চাষী এখন ‘তারকা’। চাষী আর কে মিশন রোড তথা গোপীবাগের যে বাড়িটিতে (‘চিওড়া হাউজ’) থাকতেন অনেকের কাছে তখন সেটিই হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয়। কুমিল্লার চিওড়ার বিখ্যাত কাজী পরিবারের (কাজী কাইউম, কাজী জাফর) মেয়ে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির নেত্রী কাজী জ্যোত্স্না (চাষীর স্ত্রী)। ১৯৬৬ থেকে রামকৃষ্ণ মিশন পাঠাগার, সাদেক হোসেন খোকাদের বাসা, ছায়াবিথী, গোপীবাগ মসজিদ রেললাইন আমার পরিচিত। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি হতে ১৯৭৩ সালের মার্চ পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশন রোডের দুটো বাসায় মেস জীবন এবং ১৯৭৪ হতে সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী পত্রিকায় লেখালেখির সূত্রে জড়িত হওয়ার কারণে ‘চিওড়া হাউজ’ এবং ওই বাড়ির বাসিন্দা-জামাই চাষীও যেন হয়ে ওঠেন আপন। তাঁর ছোট ভাই চাষী সিরাজুল ইসলাম ‘চিত্রালী পাঠক-পাঠিকা সমিতি’ (চিপাপস) এর নেতা ছিলেন। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সূত্রে এই দুই চাষী-ভাই হন আমার লেখালেখির সূত্র।
১৯৭৭ সালে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি শুরু করি। ও সময় একদিন আকস্মিকভাবে পরিচয় চাষী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী সম্ভবত তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আমাকে। চাষী তখন ‘বাজীমাত’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে সেই ‘বাজীমাত’ (১৯৭৮) নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
যাই হোক, চাষী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ঢাকার মতিঝিলের প্রাচী এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার প্রযোজক-পরিবেশক এম. এ. মালেক ও আজহারুল ইসলাম প্রমুখ সূত্রে। তাঁদের প্রযোজনা-ব্যবস্থাপনায় চাষী নজরুল ইসলাম তখন শরৎ-কাহিনী ‘দেবদাস’ নির্মাণ করছিলেন। ‘দেবদাস’ এর প্রাথমিক পর্যায়ের শুটিং হয় সাভারের এক বাড়িতে। আমি তখন ‘বিচিত্রা’র প্রদায়ক। ওই ছবির রিপোর্ট করার জন্য ওখানে যাই চাষী ও অন্যান্যের সঙ্গী হয়ে। পথিমধ্যে পার্বতী চরিত্রে রূপদানকারী কবরীকে বাসা থেকে নিতে হয়। সাভারে পৌঁছার পর দৃশ্য টেক করতে দেরী করতে হয়নি। ওখানে লোকেশনে দেখলাম চাষীর আরেক রূপ। দৃশ্যটি ছিল দেবদাস (বুলবুল আহমদ) কর্তৃক পার্বতীকে বড়শীর ছিপ দিয়ে আঘাত করা। এমন দৃশ্যে আঘাত পেয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে পার্বতী অর্থাত্ কবরী কেঁদে ফেলেন। সেদিন দেখলাম শিল্পী কবরীর আরেক শিল্পীত এবং স্বাভাবিক অভিনয়। গ্লিসারিন ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে কেঁদে ফেললেন কবরী। চাষী নজরুল ইসলামের নির্দেশনায় অমর কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্রের ‘দেবদাস’ নতুনরূপে জীবন্ত হয়ে ওঠে বাংলাদেশে। এর আগে এই কাহিনী বাংলা-উর্দু-হিন্দি-তামিল ভাষায় ও নির্বাক অবস্থায় ১০/১২ বার চিত্রায়িত হয়েছে কলকাতা-বোম্বে-লাহোরে। কিন্তু চাষীর ‘দেবদাস’ নানাদিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে।” অনুপম হায়াত, চলচ্চিত্র সমালোচক
“আমি বেশ উপলব্ধি করি তখনকার সহকারী পরিচালক আর এখনকার সহকারী পরিচালকের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। আমার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমি শুটিং করছিলাম কক্সবাজারে। রাজ্জাক এবং আমি ছিলাম। জঙ্গলের মধ্যে কাদা পানি এরকম একটি জায়গা। খালি পায়ে শুটিং করছিলাম। শুটিং যখন শেষ হলো আমি জুতো পায়ে দেয়ার আগেই চাষী ভাই জুতো জোড়া হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম, উনি সহকারী পরিচালক অথচ উনি নির্দ্বিধায় আমি কিছু বলার আগেই জুতো জোড়া নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি তাঁর আচরণে অভিভূত হয়েছিলাম। আমি ওই ঘটনার সঙ্গে তুলনা করে মাঝে মাঝে ভাবি, এখনকার সহকারী পরিচালকরা নায়িকার জুতা নেওয়া তো দূরে থাক নিজের কাজ করতেই তো দ্বিধা বোধ করে। চাষী নজরুল ইসলাম তখন থেকে এই এতো বছর পর্যন্ত কাজ করছেন তাঁর একাগ্রতা, নিষ্ঠা, সততা সবকিছু মিলে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক ব্যাপার।
তিনি তাঁর কাজের মূল্যায়ন হিসেবে একুশে পদক পেয়েছেন। যা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য একটি গৌরবের বিষয়। চাষী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমাদের একটি পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর আরেকটা জিনিস আমার ভালো লাগে সেটি হল তিনি খুব বন্ধুবত্সল। তাঁর সঙ্গে আমি যতো ছবিতেই কাজ করেছি খুব ভালো লেগেছে আমার। উনি আমার প্রোডাকশনের দুটো ছবিরও পরিচালক। কাজ করতে গিয়ে আমি কখনোই ভাবিনি যে তিনি একজন পরিচালক। তিনি ভিন্ন, আমি ভিন্ন। আমার কাছে তাঁকে সব সময়ই একজন কাছের মানুষ মনে হয়েছে। একটি আন্তরিক সহানুভূতিশীল লোক মনে হয়েছে। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি।
তিনি ভীষণ রসিকও বটে। কাজ করতে গিয়ে তাঁর রসিকতা আমার বেশ ভালো লাগে। তিনি পরোপকারী মনোভাবাপন্ন মানুষ। সবার বিপদেই তিনি এগিয়ে আসেন। আর বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় তিনি স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। আমরা হয়তো কোনো বিয়ে অনুষ্ঠানে যাই না, ভাবি না গেলেও চলবে। এটা চাষী ভাইয়ের মধ্যে নেই। তাঁর নেতৃত্বের ক্ষমতাও তীব্র। তিনি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। পরিচালক সমিতির সভাপতি। তাঁকে দেখলে আমরা বলি যে, মাইক এসে গেছে। তিনি খালি গলায় যে রকম বলিষ্ঠ কন্ঠে কথা বলতে পারেন তা খুবই বিরল এবং প্রশংসার যোগ্য। তাঁর ‘অন্তরঙ্গ’ ও ‘সংগ্রাম’ ছবিতে আমি কাজ করেছি। তিনি আমার প্রযোজিত ‘বেহুলা লখিন্দর’ ও ‘বাসনা’ ছবি পরিচালনা করেছেন। একটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে, আমরা বেহুলা লখিন্দর ছবির শুটিং করছি। একজন অভিনেতা সংলাপ বলতে পারছিলেন না। ভদ্রলোক চাষী ভাইয়ের চেয়েও অনেক লম্বা। চাষী ভাই তার অভিনয় হচ্ছিল না বলে রেগে গিয়ে জাম্প করে তার গালে খুব জোরে চড় দিলেন। তুমি পারছো না কেন? দৃশ্যটি এতোই হাস্যকর ছিল যে পুরো ইউনিটে হাসির রোল উঠলো। দৃশ্যটা মনে পড়লেই হাসি পায়। আমার ‘বাসনা’ ছবির একটি দৃশ্যে প্রচুর ভিক্ষুক নিয়ে শুটিং করতে হবে। সেদিন প্রচুর ভিক্ষুক যোগাড় করা হয়েছে। ওদেরও সময় নেই। মানে ওরা সময় দিতে পারে না। যাই হোক আমরা ওদের নিয়ে সাভারের দিকে শুটিং করতে যাবো। খিচুড়ি মাংস রেধেছি প্রচুর পরিমাণে। ভিক্ষুকদের খাওয়াবো বলে। দুতিনটি ট্রাক জোগাড় করা হয়েছে, কিন্তু সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। সূর্য ওঠার নাম নেই। আমার মনটা ভীষণ খারাপ। এতো আয়োজন কিন্তু তা ভেস্তে যাচ্ছে। চাষী ভাইয়ের কোনো ভাবান্তর নেই। তিনি বললেন, ‘কি ম্যাডাম মন খারাপ করে বসে আছেন, হাসেন, হাসেন। হাসলেই দেখবেন সূর্য এসে গেছে। জ্বলন্ত সূর্য এসে গেছে’। আমি বললাম, ‘চাষী ভাই দেখেন সব সময় জোক করেন আপনি। আমার মনটা কেন খারাপ আপনি বুঝতে পারছেন না?’ চাষী ভাই বললেন, ‘আপনি হাসেন, দেখবেন সূর্য উঠে যাবে শুটিংও হবে।’ ঠিক আছে আমি কোনো রকম হাসি দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে দেখা গেলো বৃষ্টি কমছে। এরপর চাষী ভাই বললেন, ‘এখন আপনি গাড়িতে উঠেন। আপনি লোকেশনে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন সূর্য উঠে গেছে।’ আমি শুটিং এর গাড়িতে ওঠলাম, বৃষ্টি অনেকটা কমে গেছে। আমরা লোকেশনে পৌছলাম এবং আমি যখন গাড়ি থেকে নামলাম তখন সত্যিই একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। মাথার ওপর বিশাল সূর্য। চারদিকে বৃষ্টির কোনো লেশও নেই। আমি ভীষণ অবাক হয়ে ভাবলাম চাষী ভাই কিছু জানেন নাকি! তারপর সারাদিন প্রখর সূর্য। আমি ঘটনাটা নিয়ে প্রায়ই ভাবি। অবাক হই।” – সুচন্দা
“শুটিংয়ের সময় শিশুর মতো আচরণ করেন। দৌড়- ঝাপ বা রাত জাগায় আমরাও অনেক সময় তাঁর সঙ্গে পেরে উঠি না। এমনিতেই ওনার ওপেন হার্ট সার্জারী করা। ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও কিছুই তিনি মেনে চলেন না। এইতো সেদিন ‘মেঘের পরে মেঘ’ ছবির শুটিংয়ে হাজারো দর্শকের মধ্যে একজন দর্শক কথা শোনেনি বলে চাষী ভাই নিজে ধানক্ষেতের আইল দিয়ে মানুষটিকে ধাওয়া করতে করতে কোয়ার্টার মাইল চলে গেলেন। পুলিশ যেখানে লোকটিতে ধরতে পারেনি, তিনি ঠিকই ধরে নিয়ে এসেছেন। এটাও ঠিক পুলিশ বা স্থানীয় লোকজন যেটা কন্ট্রোল করতে পারে না চাষী ভাই মেরে হোক, চিত্কার করে হোক আর বক্তৃতা দিয়েই হোক, ঠিকই তিনি নিমেষেই সব পরিস্থিতির মোকাবেলা করে ফেলেন। ‘মেঘের পর মেঘ’ ছবির আরেকদিনের শুটিংয়ে দর্শকদেরকে বলা হয়েছে আপনাদের সাইকেলগুলো সরিয়ে ফেলুন। হাজার হাজার দর্শক, কে শোনে কার কথা, এদিকে বারবার ফ্রেমে সাইকেলের অংশ বিশেষ চলে আসছে। চাষী ভাই গর্জে উঠলেন, এবং দৌড়ে গিয়ে এক এক করে ছয়টি সাইকেল প্রতিমা বিসর্জনের মতো করে মাথার ওপর তুলে পাশের পুকুরে ফেলে দিলেন। একটি মানুষেরও সাহস হলো না প্রতিবাদ করার। শুটিং কিন্তু ঠিকই যথাসময়ে শেষ হলো।” – উত্তম গুহ, শিল্প নির্দেশক
ফিল্মোগ্রাফী
‘ওরা ১১ জন’ (১৯৭২)
বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত ছবি ‘ওরা ১১ জন’। এটি স্বাধীন বাংলাদেশ ও পরিচালক চাষী নজরুলেরও প্রথম ছবি’।
চিত্রনাট্য- কাজী আজিজ
চিত্র গ্রহণ- এম. এ. সামাদ
শব্দগ্রহণ- মালেক মনসুর
‘সংগ্রাম’ (১৯৭৪)
চিত্রনাট্য-কাজী আজিজ
চিত্রগ্রহণ-এম. আব্দুস সামাদ
প্রযোজক-অনুপম কথাচিত্র
সম্পাদনা-বশির হোসেন
সঙ্গীত- খন্দকার নূরুল আলম
‘ভালো মানুষ’ (১৯৭৫)
কাহিনী- প্রফুল্ল রায়
চিত্রনাট্য- সুমন আহমেদ (স্মৃতিময় বন্দোপাধ্যায়)
চিত্রগ্রহণ-খান আরিফ
সম্পাদনা- সৈয়দ আওয়াল
‘বাজীমাত্ (১৯৭৮)
চিত্রনাট্য- কাজী আজিজ
চিত্রগ্রহণ-খান আরিফ
প্রযোজক-জোছনা আলো ছায়াছবি
সম্পাদনা- সৈয়দ আওয়াল
‘দেবদাস’ (১৯৮২)
শরত্চন্দ্র অবলম্বনে
চিত্রনাট্য- কেশব চট্টোপাধ্যায়
চিত্রগ্রহণ- এম. এম মবিন
সম্পাদনা- সৈয়দ আওয়াল
প্রযোজনা- অভিসার কথাচিত্র
‘চন্দ্রকথা’ (১৯৮৫)
শরত্চন্দ্র অবলম্বনে
চিত্রনাট্য- কেশব চট্টোপাধ্যায়
চিত্রগ্রহণ- সাধন রায়
সম্পাদনা- সৈয়দ আওয়াল
প্রযোজনা – আলমগীর পিকচার্স
‘শুভদা’ (১৯৮৬)
শরত্চন্দ্র অবলম্বনে
চিত্রনাট্য- সাধন রায়
চিত্রগ্রহণ-খোরশেদ আলম
প্রযোজনা- আলমগীর পিকচার্স
‘লেডি স্মাগলার’ (১৯৮৬)
চিত্রনাট্য- নূর (পাকিস্তান)
চিত্রগ্রহণ-কামরান মির্জা ও জেড এইচ মিন্টু
সম্পাদনা- দুলু
প্রোডাকশন-ববিতা মুভিজ এন্ড শামীম আরা প্রোডাকশন
‘মিয়া ভাই’ (১৯৮৭)
চিত্রগ্রহণ -জেড এইচ মিন্টু
চিত্রনাট্য- কেশব চট্টোপাধ্যায়, কমল সরকার
সম্পাদনা- জিন্নাহ
প্রোডাকশন – এফ. পি প্রোডাকশন
‘বেহুলা লখিন্দর’ (১৯৮৭)
চিত্রনাট্য- আহমেদ জামান চৌধুর
চিত্রগ্রহণ- রফিকুল বারী চৌধুরী
সম্পাদনা- দুলু
প্রযোজনা- সূচন্দা চলচ্চিত্র
‘বিরহ ব্যথা’ (১৯৮৮)
বঙ্কিমচন্দ্র অবলম্বনে
চিত্রনাট্য- কেশব চট্টোপাধ্যায়
চিত্রগ্রহণ- জেড.এইচ. মিন্টু
সম্পাদনা-দুলু
প্রযোজনা- বন্ধন বানী চিত্র
‘মহাযুদ্ধ’ (১৯৮৮)
চিত্রনাট্য-জোসেফ শতাব্দী
ক্যামেরা- মিরাজুর রহমান মিরাজ
সম্পাদনা-আমিনুল ইসলাম মিন্টু
প্রডাকশন ফজলুর রশিদ ঢালী
‘বাসনা’ (১৯৮৯)
চিত্রনাট্য- আহমদ জামান চৌধুরী
মিউজিক-আলম খান
চিত্রগ্রহণ- জেড এইচ মিন্টু
সম্পাদনা -দুলু
প্রযোজনা-সুচন্দা চলচ্চিত্র
‘দাঙ্গা ফ্যাসাদ’ (১৯৯০)
চিত্রনাট্য-বেলায়েত
চিত্রগ্রহণ- মিরাজুর রহমান মিরাজ
সম্পাদনা- আমিনুল ইসলাম মিন্টু
প্রযোজক-ফজলুর রশিদ ঢালী
‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ (১৯৯১)
জি.এম. মহিউদ্দিনের উপন্যাস অবলম্বনে
চিত্রনাট্য- জালাল উদ্দিন রুমি
চিত্রগ্রহণ- জেড. এইচ. মিন্টু
সম্পাদনা- খোরশেদ
প্রযোজনা- ইকবাল ফিল্ম লিঃ
‘দেশ জাতি জিয়া’- ১৯৯৩
চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তর
চিত্রগ্রহণ-আসফাক মুনির চৌধুরী
‘আজকের প্রতিবাদ’ (১৯৯৫)
চিত্রনাট্য-জোসেফ শতাব্দী
চিত্রগ্রহণ- এ.এইচ. পিন্টু
সম্পাদনা-সৈয়দ আওয়াল
প্রোডাকশন-অন্তরা কথাচিত্র
‘শিল্পী’ (১৯৯৫)
চিত্রনাট্য-জোসেফ শতাব্দী
চিত্রগ্রহণ – জেডএইচ মিন্টু
সম্পাদনা- সৈয়দ আওয়াল
প্রোডাকশন – লাভ ফিল্মস্
‘হাঙ্গর নদীর গ্রেনেড’ (১৯৯৫)
চিত্রনাট্য- চাষী নজরুল ইসলাম
চিত্রগ্রহণ- জেড এইচ. মিন্টু
সম্পাদনা- সৈয়দ মুরাদ
প্রোডাকশন-চাষী চলচ্চিত্র
‘হাছন রাজা’ (২০০১)
চিত্রনাট্য- মমতাজ উদ্দিন আহমদ
চিত্রগ্রহণ- দুলাল
সম্পাদনা- আতিকুর রহমান মলি্লক
প্রোডাকশন- হাসক প্রোডাকশন
‘কামালপুরের যুদ্ধ’ (২০০২)
চিত্র নাট্য-চাষী নজরুল ইসলাম
পরিচালনা-চাষী নজরুল ইসলাম
‘মেঘের পরে মেঘ’ (২০০৪)
চিত্রনাট্য-ওয়াকিল আহমেদ
চিত্রগ্রহণ-মজিবুর রহমান ভূইয়া
সম্পাদনা- আতিকুর রহমান মল্লিক
প্রোডাকশন- ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
‘শাস্তি’ (২০০৫)
চিত্র নাট্য – মমতাজ উদদীন আহমদ
চিত্রগ্রহণ- মজিবর রহমান ভূইয়া
সম্পাদনা- আতিকুর রহমান মল্লিক
প্রোডাকশন- ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
‘সুভা’ (২০০৫)
চিত্র নাট্য- মমতাজ উদদীন আহমদ
চিত্রগ্রহণ- মজিবর রহমান ভূইয়া
সম্পাদনা- আতিকুর রহমান মল্লিক
প্রোডাকশন- ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
‘ধ্রুবতারা’ (২০০৬)
চিত্র নাট্য- চাষী নজরুল ইসলাম
চিত্রগ্রহণ- জেড.এইচ.মিন্টু
সম্পাদনা- আতিকুর রহমান মল্লিক
প্রোডাকশন- ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
চাষী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপচারিতা
প্রশ্ন: চলচ্চিত্র জগতে কীভাবে এলেন?
– হঠাত্ করেই কখনো কিছু হয় না। যে কোনো ক্ষেত্রের জন্যই এটা হলো সত্য কথা, আর চলচ্চিত্র তো কঠিন ব্যাপার। আসলে ছোটবেলা থেকে নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ ছিল। এ অংশগ্রহণ আমার আগ্রহকে আরো বাড়িয়ে তুলল। এরপর হলে ছবি দেখা। আমি হলে গিয়ে প্রথম যে ছবিটা দেখি সেটি সম্ভবত ‘শকুন্তলা’। তারপর দেখেছিলাম মধুবালা অভিনীত কিসমত, তারপর দেখি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এই যে হলে গিয়ে ছবি দেখা দিনদিন বাড়তেই লাগলো পরে একসময় ছবির পোকা হয়ে গেলাম। এমন অবস্থা হয়েছিল যে টিকিট কেনার জন্য বন্ধুদের বই বিক্রি করে দিয়ে পরে আরেকজনের নাম দিতাম।
সিনেমা দেখতে দেখতে এমন হলো যে, কেন যেন আমার মাথার ভিতর দিলীপ কুমার চেপে বসলো। মনে মনে খুব ইচ্ছে দীলিপ কুমার হবো। তারপর এমন হলো তার মতো অভিনয়, কথা বলা, চলাফেরা সব করতে লাগলাম। অভিনয় করবো অভিনয় করবো এই ভেবে বোম্বে পাড়ি দিলাম। কিন্তু বোম্বে কিছুদিন থাকার পর ফিরে এলাম। আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন আমরা বিক্রমপুরে ফিরে এলাম। বিক্রমপুরে ফিরে আসার পর ভাবলাম আমার স্বপ্ন আর সত্যি হবে না। আমি আর অভিনয় করতে পারবো না।
আমার এক খালাত বোনের হাজবেন্ড ফিল্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি আমার অভিনয়ের ইচ্ছার কথা জানার পর বললেন ঢাকায় এসো, তখন ১৯৬১ সাল। তিনি তখন ‘সমাধান’ নামের একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম করছিলেন। তিনি এই ছবিতে আমাকে চাপরাশির ভূমিকায় অভিনয় করতে বললেন। বললাম আমি চাই হীরো হতে আর আপনি বলছেন চাপরাশির অভিনয় করতে। তখন তিনি বললেন আগে এটাই করতো দেখি। কি আর করা চাপরাশির ভূমিকায় অভিনয় করলাম। এতে একটি দৃশ্যে আমি ও বিখ্যাত অভিনেতা গোলাম মোস্তফা ছিলাম। সেই শট করতে গিয়ে আমি ১৩ বার সময় নিয়েছি ১৪ বারের বোলায় শট ওকে হয়েছিল।
প্রশ্ন: আপনার প্রথম ছবি নির্মাণের কথা বলুন?
– যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় আমার মাথার কাজ করত, কি করে যুদ্ধের এই অবস্থা ছবিতে তুলে আনা যায়। আমি তখন গুপীবাগে থাকি। বাসায় বসে আছি আর ভাবছি যে একটা ছবি করবো। মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) বললো, ‘চলেন ছবি করি।’ আমি বললাম, ‘ছবি করবো টাকা কোথায়?’ ও বলল, ‘চলেন ছাত্রনেতা খসরুর কাছে যাই।’ তিনি আমাকে দেখে চিনলেন। বললাম, ‘মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানাবো, আপনি অভিনয় করবেন।’ খসরু টাকার সন্ধান বললেন। স্টার ফিল্ম কর্পোরেশন তখন বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। ইফতেখারুল আলম কিসলু ছিলেন কর্ণধার। তাদের মালিকানায় তখন স্টার, মুকুল সহ ১১টি সিনেমা হল। প্রথম গেলাম স্টার সিনেমা হলে। আমরা বললাম, ‘কিসলু ভাই আমরা ছবি বানাবো কিন্তু টাকা নেই, আপনাকে টাকা দিতে হবে।’ ইফতেখারুল আলম পরামর্শ দিলেন, ‘আপনারা শের আলীর কাছে যান।’ হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের পাশে একটি বাড়ীতে তিনি থাকেন। শের আলী একজন মাড়োয়ারি ব্যাবসায়ী, গেলাম তার কাছে। উনি তো খসরুকে দেখে ওর কথায় ভয়ই পেলেন। কারণ ‘৬৯-এ আইয়ূব খান বিরোধী আন্দোলনের এক পরিচিত মুখ ছিলেন খসরু। পরে আমাদের বসতে বললেন, অরেঞ্জ জুস দিলেন। পরে বললেন কত টাকা লাগবে। তিনি ভয়ে ভয়ে ব্রিফকেস বের করে দিলেন। আমরা বললাম, ‘আমরা কিন্তু ছিনতাই বা লুট করতে আসিনি। আমরা ছবি বানাবো আপনি ডিস্ট্রিবিউটার হবেন, সেইভাবে এগ্রিমেন্ট করে টাকা দেন।’ তিনি আমাদের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। আমাদের পরের দিন যেতে বললেন। ইফতেখার কিসলুকে বললেন, জহির রায়হানের সাথে যে এগ্রিমেন্ট আমাদের আছে, সেই পুরাতন এগ্রিমেন্ট বদলে আমাদের নামে করতে।
ছবির কাহিনী নিয়ে আলোচনা করলাম। তখন তিনি আমাদের সোয়া ৩ লাখ টাকার চেক দিলেন। টাকা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম। ‘ওরা ১১ জন’ নামটি নিয়ে অনেক ভেবেছি। মুক্তিযুদ্ধে ১১ সেক্টর, ‘৬৯ এর ১১ দফা দাবী। আমাদের ছবিতেও ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা থাকবে। ১১ জনের মধ্যে ১ জন হিন্দু, ১ জন খ্রিস্টান, বাকি ৯ জন মুসলমান।
জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে গেলাম শুটিং করতে। তখন জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টের সিও (কমান্ডিং অফিসার) ছিলেন কর্নেল শওকত আলী। ছবিটি যখন এডিটিং করছি তখন এডিটর বললেন কত খরচ পড়ল? বললাম সাড়ে ৩ লাখ। তিনি বললেন ২০ লাখ টাকার ব্যবসা করবে। পরে ছবি হিট হলো। ছবিটি অভিসার ও মধুমিতায় এক নাগাড়ে ছয় সপ্তাহ প্রদর্শিত হয়েছে।
প্রশ্ন: ‘ওরা ১১ জন’ ছবির কাহিনী তো বাস্তব ঘটনা থেকে নেয়া, তাই নয় কি? এ ছবির নাম কেন ‘ওরা ১১ জন’ হলো? ?
– হ্যা, ঠিকই শুনেছেন, ‘ওরা ১১ জন’-এর কাহিনীর বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। আর ‘ওরা ১১ জন’ নামটি দেয়া হয়েছে দুটি কারণে। প্রথমত, ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা মানে এগারোজন সেক্টর কমাণ্ডার, দ্বিতীয়ত এগারো দফা আন্দোলন। এই এগারো দফা আন্দোলনই কিন্তু পরে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। তারপর ছবির টাইটেলে যখন ‘ওরা ১১ জন’ নামটি আসে, তখন নেপথ্যে ছয়টি কামানের গোলা ছোঁড়ার শব্দ শোনা যায়। অর্থাত্ এগারো দফার জন্যেই যে আমরা ছয় দফা পাই সেটি প্রতীকি ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার জন্ম, বড় হওয়া, চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাচ্ছি?
– এখন আমার বয়স পয়ষট্টি বছর। আমার জন্ম ১৯৪১ সালের ২৩ অক্টোবর বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার সমষপুর গ্রামে। সেদিন ছিলো প্রথম রোযা। আমার জন্মের সাথে সাথে মাগরেবের আযান পড়েছিলো এবং আমার নানী ইফতার করেছিলেন। আমার বাবারা ছিলেন দু’ভাই। বড় ভাই শামসুদ্দনী আহমেদ। তিনিও ইঞ্জিনিয়ার এবং তিনিই আমার বাবাকে জামশেদপুর নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার জন্মের সময় বাবা জামশেদপুরেই ছিলেন। আমার বয়স যখন ৪০ দিন আমার মা আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যান। জামশেদপুর যেতে হতো কলকাতা হয়ে। সাথে ছিলেন মামা চাষী ইমামউদ্দিন। যিনি শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সাথে রাজনীতি করতেন এবং নবযুগ ও লাঙ্গল পত্রিকার সাথ জড়িত ছিলেন। শেরে বাংলা জানতে পারেন চাষীর বোন জামশেদপুর যাচ্ছেন। তিনি আমাদেরকে তার বাসায় একবেলা খাওয়ার জন্য দাওয়াত করেন। মামা আমাদের নিয়ে তার বাড়িতে গেলেন। আমি তখন মামার কোলে। শুনেছি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসির উদ্দিন। শেরে বাংলা আমাকে দেখিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নাম রেখেছো কি?’ মামা জানালেন নাম এখানো রাখা হয়নি। তবে টিনা বলে ডাকা হয়। তার প্রশ্ন ‘এটা কি রকম নাম?’। মামা জানালেন টাটা স্টীল কোম্পানীতে ওর বাবা টিন বানায় তাই টিনা ডাকা হয়। মামা শেরে বাংলাকে একটি নাম দিতে বলায় তিনি বললেন, ‘তোমার নামের চাষী লাগাও আর কাজী নজরুল ইসলামের নজরুল নাও আর ইসলামতো আছেই দেখবে আগুন হবে’। সেই থেকে আমার নাম চাষী নজরুল ইসলাম। অনেকের ধারণা এটা আমার ছদ্ম নাম।
প্রশ্ন: আপনার শৈশবের দিনগুলি কীভাবে কেটেছে?
– ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে আমরা জামশেদপুর গেলাম। চার বছর পর আবার বিক্রমপুর ফিরে এলাম। আমাদের এলাকাটা ডোবা জায়গা। প্রতিটি বাড়িই মাটি দিয়ে ভরাট করা উঁচু জায়গায় বানানো হয়, যাতে বর্ষায় ডুবে না যায়। আমাদের বাড়ির সামনে একটি জায়গা ছিল যাকে হাটখোলা বলা হয়। সেখানে নাকি পারিবারিক হাট বসতো। তার পাশেই একটি প্রাইমারী স্কুল ছিলো যেটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমার মামা চাষী ইমামউদ্দিন। স্কুলটি গ্রামের সামনের দিকে। ঐ স্কুলে ক্লাস ওয়ানে আমাকে ভর্তি করে দেয়া হয়। তো টু’তে ওঠার পরই বাবা আমাদের আবার জামশেদপুর নিয়ে গেলেন। ওখানে গিয়ে আমার বাবারই প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল মুসলিম স্কুলে ভর্তি হই এবং ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ি। তারপর ক্লাস সিক্স থেকে সেভেন পর্যন্ত পড়ি গোলমুড়ি মিডল স্কুলে। আমার বাবা মা সবসময়ই চাইতেন আমি একটি ভালো স্কুলে পড়ি কিন্তু সিট সমস্যা ও নানা সমস্যার কারণে পারছিলাম না। এরপরে আমি চান্স পেলাম আর ডি টাটা হাই স্কুলে। আমি কিন্তু লেখাপড়া করেছি হিন্দি মিডিয়ামে। ঐ স্কুলে বাংলা ছিলো, তবে অপশনাল বিষয় হিসেবে; আর যেহেতু হিন্দি রাষ্ট্রীয় ভাষা তাই আবশ্যিক বিষয়গুলো ঐ ভাষাতেই পড়তে হতো। এখন যে সাম্প্রদায়িকতার কথা শুনি তখন কিন্তু আমি তা উপলব্ধি করিনি, সহপাঠীদের আচরণেও পাইনি। মাঝে মধ্যে টিচাররা বলতেন, এই ম্লেচ্ছ বা এই জবন বা এই মুসলমানটা ঐটুকুই। ওটাকে আমি ধরতাম না। মনে করতাম আদর করে বলছে কিন্তু পরে বুঝেছি। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের প্রতি ওদের একটা ক্ষোভ ও ঘৃণা রয়েছে। ওরা কিন্তু সেখানকার স্থানীয় হিন্দু নয়। দেশ ভাগ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তান থেকেই গিয়েছে। স্থানীয়রা এমন ছিলো না। ওদের সাথে আমি আন্তরিকভাবে মিশেছি। নাটক, থিয়েটার করতাম, দুর্গাপূজার আয়োজনেও থাকতাম। মনে হতো আমি একজন কমিটির সদস্য। বাবা মা ধার্মিক ছিলেন, পীরের মুরিদ ছিলেন কিন্তু আমার চলাফেরায় বাধার কারণ হননি। ধর্মভেদ ছিলো না বলেই হয়তো দেশের প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক সাধন রায়ের মৃত্যুর পূর্বে তার অন্তিম ইচ্ছে ছিলো তাঁর মুখাগ্নি যেন আমি করি। তাঁর একটি মেয়ে ছিলো, ছেলে ছিলোনা। মেয়েটি থাকতো কলকাতায়। আমিই তাঁর মুখাগ্নি করেছিলাম। এরকম ঘটনা বোধ হয় ইতিহাসে প্রথম। হিন্দু-মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ববোধের কথা সেই মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে অনেকেই বলেছেন কিন্তু এমন দৃষ্টান্ত আগে কেউ রাখতে পারেননি। সবাই অবাক হয়েছেন। কি করে সম্ভব হলো ! ধর্ম ধর্মের জায়গায় ঠিক আছে এটা তো একটা কর্ম মাত্র।
যাই হোক আর ডি টাটা হাই স্কুল থেকে যখন আমি ইলেভেন পাশ করি তখন আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যেই আমার চাচা বিক্রমপুর চলে গিয়েছেন। আমার চাচা-চাচী, মা-বাবা মাওলানা মোঃ আলী ও মোঃ শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের মামা হযরত ইব্রাহীম রামপুরী (রঃ) ‘র মুরিদ ছিলেন। সেই সূত্রে পীর সাহেব ছয় মাসে একবার দিল্লী থেকে আমার চাচার বাসায় আসতেন এবং বিরাট মজলিস বসতো। ভারত সরকার ভাবলো আমার চাচা বোধ হয় পাকিস্তান সরকারের স্পাই এবং ২৪ ঘন্টার নোটিশে তাকে ভারত থেকে বের করে দিলো। বাবা অসুস্থ হলেও চাননি আমরা বিক্রমপুর ফিরে যাবো। তার ধারণা ছিলো টাটা কোম্পানীতে আমি চাকরি পাবো এবং আমরা সেখানেই থাকবো। মা তা চাননি। তিনি বাবাকে বললেন তিনি মারা গেলে সন্তানাদি নিয়ে মা কোথায় যাবেন। মোহলবেড়া ঢাকা লেনে আমাদের একটি বাড়ি ছিলো। সেটা বিক্রি করা হলো। আমার বাবা ছিলেন সংস্কৃতিমনা, বিপ্লবীমনা যার কারণে ঢাকা লেনের নামকরণে তার প্রস্তাব গুরুত্ব পেয়েছিলো। ওখানকার সবাই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের। আমার জীবনের ১৮টি বছর কেটেছে জামশেদপুর শহরে। আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর। সেই সাঁওতাল পাড়া, তাদের ছেলেমেয়ে, শালবন, মহুয়াবন, বৃন্দাবন পর্বত সবই অপূর্ব। সেখানে গ্রীষ্মে ছিলো প্রচণ্ড দাবদাহ, শীতে প্রচুর শীত এবং বর্ষা বৃষ্টিমুখর। চমত্কার সেই শহরের প্রশাসন থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ, হাসপাতাল সব ছিলো টাটা কোম্পানীর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে। তার স্থায়ী শ্রমিক ছিল ৩ লাখ। তাদের আবাস, চিকিত্সা, আহার, সন্তানাদির পড়াশোনা-সব ব্যবস্থা টাটার নিজের করা। সুন্দর ব্যবস্থাপনায় ঐ কোম্পানী এলাকায় আমি ঐ প্রতিষ্ঠানের ৫০ বছর পূর্তি পর্যন্ত ছিলাম। তখন পর্যন্ত সেখানে এক ঘন্টার জন্য ধর্মঘট হয়নি, এখন পর্যন্তও না। সেখানেই সখ্যতা হয়েছিলো অজস্র শুভার্থীর সাথে। ঐ চমত্কার শহর, অসংখ্য বন্ধুবান্ধব ছেড়ে আসতে আমার মন বড় ব্যাকুল হয়েছিলো। যাদের কথা এখনও মনে পড়ে অজয় দত্ত (সেন্টু), মরতুজা হোসেন, বিজয় দত্ত আরো অনেকে।
অনেক স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পড়শী আমাদের ‘সী অফ’ করতে এলো জামশেদপুর টাটা রেল স্টেশনে। একসময় সেই লাল বোম্বে মেল এল। সবার চোখ অশ্রুসজল; জানি জীবনে আর দেখা হবে না। হাওড়া নামলাম, সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়িতে গেলাম শিয়ালদা স্টেশন। শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠবো। প্রচণ্ড ভিড়, জায়গা পাওয়া মুশকিল। আমার এক ফুফাতো ভাই মাখনদা চাকরি করতেন ট্রামে। তিনি পান খেয়ে কম্পার্টমেন্টে উঠে সশব্দে কাশতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন যক্ষ্ণা- শুনে অনেকেই সিট ছেড়ে পালাল। আমরা বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। রানাঘাট, বানপুর, দর্শনা হয়ে গোয়ালন্দ আসতো ঢাকা মেল। বানপুর বর্ডারে ইঞ্জিন চেঞ্জ হতো। সেই গোয়ালন্দ এখন হারিয়ে গেছে। সেখানে দু’পাশে দোকান ছিল, নদীর পারে রাশি রাশি বালি। চাঁদনী রাতে বালি চিকচিক করতো, পাশাপাশি চিকচিক করতো নদীর পানিও। বালি আর পানি আলাদা করা মুশকিল হতো। দূরে নৌকা যাচ্ছে, ঘাটে স্টীমার বাঁধা। স্টীমারের ওঠার জন্য কাঠের সিঁড়ি লাগানো। বাচ্চারা সব হাত ধরে স্টীমারে উঠছে। স্টীমারের একটি শব্দ ছিলো শো… শো… এবং মাঝে মাঝে ‘শম’ করে ভ্যাকুয়াম ক্লিয়ারের একটি শব্দ হতো, পাশাপাশি প্রোপেলারের দুম্ দুম্ শব্দ-এসব খুব ভালো লাগতো। ওপারে ঘাটের যে পাশটায় স্টীমার ভিড়তো সেখানে সারিবদ্ধভাবে বাঁদরের মতো ঝুলে থাকতো লাল ড্রেসের বিহারী কুলিরা। ঘাটের গায়ে ভেড়ার আগেই সবাই দক্ষতার সাথে দ্রিম দ্রিম শব্দে স্টীমারে লাফিয়ে পড়তো। ওরা যাত্রীদের লাগেজ বইতো।
ছোটবেলা থেকেই আমি খুব কৌতুহলী ছিলাম। ছোট ট্রেন ইঞ্জিন বানাতে পারতাম। আমার এক ভাই (পরিচালক আলমগীর কুমকুমের চাচা) দারোগা ছিলেন। তার নাম ছিল হোসেন দারোগা। তিনি মাকে বলতেন, এই ছেলে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। নিচে স্টীমারের প্রোপেলার ঘুরছে,তার শব্দ আমাকে কৌতূহলী করতো। আমি নীচতলায় প্রোপেলারের আশেপাশে থাকতাম। যখন নদীতে পানি কম থাকতো বা আশেপাশে চর থাকতো তখন একটি লোক মুখে চোঙ লাগিয়ে ওপর তলার সারেঙের উদ্দেশ্যে বলতো এক ডান, দুই বাম, তিন ডান, চার বাম…৷ সম্ভবত সারেঙ সেই সংকেত অনুযায়ী স্টীমার নিয়ন্ত্রণ করতেন যাতে পাড়ে না ঠেকে যায়।
একবার ছোটবেলায় বাবার সাথে জামশেদপুর যাচ্ছিলাম, তখন ছিল শীতকাল। জাহাজের রেলিঙের পাশে শতরঞ্চি বিছিয়ে আমরা বসেছিলাম। হঠাত্ একটি ইলিশ মাছ আমার কোলে এসে পড়লো আর জাহাজের ভেতরে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেলো-‘এই ছেলে অমুক হবে, তমুক হবে, ইলিশ মাছ কোলে পড়েছে রাজ কপাল!’ ইলিশ গভীর পানির মাছ। হয়তো প্রোপেলারের সাথে ধাক্কা খেয়ে উঠে এসেছে। অথচ সাধারণ মানুষ এটাকে অলৌকিক ভাবছিলো।
যাই হোক, এই স্টীমার ফরিদপুর টেকেরহাট স্টেশনে থামতো। সাথে সাথে দু’পাশ থেকে জাহাজের গায়ে নৌকা ভিড়তো। দু’পয়সায় চমত্কার দই ও সন্দেশ পাওয়া যেত যা আমার খুবই প্রিয় ছিলো। সেই পদ্মাও নেই, স্টেশনও নেই। তারপর আসতো মানিকগঞ্জের নাইশ্যা এবং এরপর শ্রীনগরের ভাগ্যকূল। এখন যেখানে মাওয়া স্টেশন তখন তা ছিল না। ওখানে ছিলো তারপাশা স্টেশন। এখন তা নেই, নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আমি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘তুলির টানে’ উপন্যাসে তারপাশা স্টেশনের বর্ণনা পেয়েছি। অত্যন্ত চমত্কার সেই তারপাশা ঘাট। স্টেশনটি ছিলো একটি চরে। ওখানে নেমে লৌহজং থেকে হলদিয়া, কেউটিয়া ও গোয়ালীমান্দ্রা হয়ে আমরা আসলাম কাজীল পাগলা এবং সেখানে থেকে দোগাছি। দোগাছি থেকে আমাদের বাড়ি দু’আড়াইশ গজ হবে। দোগাছি খান পার, নৌকাটা সেখানে ভিড়লো। তার পাশেই দু’টো বজরা নৌকা ডোবানো ছিলো। বজরা দু’টো আমার নানাদের ছিলো। আমার দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি একই গ্রামে। আমার বাবা-মা সম্পর্কে ভাইবোনও হতেন। আমার দাদা বাবাকে পড়িয়ে সংসার চালিয়ে মোটামুটি সচ্ছল ছিলেন। তবে আমার নানারা ছিলেন বিত্তবান। অভিজাত বা জমিদার বলবো না। অনেকে অহংকার করে বলেন আমরা জমিদার, আমরা অভিজাত-এটা আমার খুব খারাপ লাগে। তাদেরকে আমি বলি, ‘আপনাদেরতো কোনো অরিজিনালিটি নেই, কারণ জমিদাররা অনেক বিয়ে করেন, অপ্রকাশ্যে সম্পর্ক রাখেন।’ তো আমার নানারা বিত্তবান পাশাপাশি ভদ্র, বিনয়ী ছিলেন। তারা খুব সৌখিনও ছিলেন। সে যুগে গোটা বিক্রমপুরে কারো বজরা ছিলো না। শুধু নানাদের ছিলো। এক নানার পাঁচটি আর এক নানার তিনটি। তাদের দেখে অনেক পরে কোলাপাড়ার কেউ কেউ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বজরা তৈরী করেছিল।
নানাদের বজরা তৈরির পেছনেও একটি ঘটনা আছে। আমার বড় মামা কিশোর বয়সে ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। নওয়াব সলিমুল্লাহ’র বাড়িতে বজরা দেখেন। তাতে উঠতেও গিয়েছিলেন। দারোয়ান দেখতে পেয়ে তেড়ে আসলো। মামা গোঁফঅলা ষণ্ডামার্কা নেপালী দারোয়ান দেখে ভয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। কেঁদে কেটে নানাকে সেই ঘটনা জানালেন। নানা রাগী মানুষ ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘তোকে তো মারেনি, কাঁদছিস কেনো?’ তিনি ফুলকুচি গ্রামের জীবন মিস্ত্রীকে ডেকে আনালেন। তাকে বললেন, ‘তোকে বজরা বানাতে হবে’ ও বললো, ‘কর্তা বজরা তো কখনো বানাই নাই’। নানা বললেন, ‘ব্যাটা আগে বানাসনি এখন বানাবি।’ জীবন মিস্ত্রী জানালো,’কর্তা কাঠ আপনার, টাকা আপনার আমার আপত্তি নাই তবে আমাকে বজরা জিনিসটা দেখতে হবে।’ নানা লোক দিয়ে জীবন মিস্ত্রীকে ঢাকা পাঠালেন। মিস্ত্রী বজরা দেখে এসে বানাতে লেগে গেলো। চমত্কার একটি বজরা বানালো জীবন মিন্ত্রী। নানা তাকে অনেক পুরস্কার দিলেন। বজরার নাম রাখলেন ‘পানসী’। প্রথম যেদিন বজরাটি পানিতে নামানো হয় সেদিন জীবন মিস্ত্রী ও তার সম্প্রদায়কে দেয়া হয় দু’মণ বাতাসা ও দু’শো শাড়ি ধুতি। নানা উত্সাহিত হয়ে পরে আরো ৪টি বজরা বানালেন। সেগুলো আগের চেয়ে আরো সুন্দর হয়েছিলো। আমরা যখন বিক্রমপুরে আসবো তখন সবগুলো বজরা নেই, নষ্ট হয়ে গেছে। দুটো ছিলো। গ্রীষ্মকালে যখন পানি কম থাকে ভেতরে ডালপালা সমেত বজরাগুলো ডুবিয়ে রাখা হয়। একে জাগ দেয়া বলে, এর মধ্যে মাছ বাসা বাঁধে। যখন বজরা তোলা হয় তখন প্রচুর মাছও ওঠে। বর্ষার প্রারম্ভে বজরাগুলো তোলা হয় এরপর রং করা হয়, আলকাতরা ও গাব লাগানো হয়। তো আমাদের নৌকা বজরার পাশে ভেড়া মাত্র এলাহী কাণ্ড শুরু হয়ে গেলো। হরেক রকম মাছ বিশেষ করে পুটি মাছ লাফালাফি শুরু করে দিলো। আমি ভীষণ বিস্ময় ও আনন্দে মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম এবং পানিতে পড়ে গেলাম। শহর থেকে দীর্ঘদিন পরে বিক্রমপুর যাচ্ছি, পরনে ছিলো আমার শ্রেষ্ঠ সুন্দর পোশাকগুলো। বুঝতেই পারছেন সেগুলোর তখন কি অবস্থা।
বর্ষার পানি চলে গেলেও শুকনো ক্ষেতে রয়ে গেছে অজস্র কচুরিপানা। সেগুলোর ওপর দিয়ে হাঁটার সময় এক অদ্ভুত আনন্দ খুঁজে পেলাম। কচুরির পটকাগুলো পটপট শব্দে ফুটছে। আনন্দে আমি দৌড়ে ছুটতে লাগলাম। শব্দগুলো, ছন্দগুলো গতি পেলো। আমি ছুটতেই লাগলাম। জীবনে তো কতো আনন্দের পেছনে ছুটেছি, মুগ্ধতার পেছনে ছুটেছি কিন্তু কই তেমন আনন্দ তো পাইনি। এখনকার নগর জীবনের কিশোর তরুণরা কি তেমন আনন্দ পায় ? আর মাটির সোঁদা গন্ধের কথাতো বলে বোঝানো যাবে না। এক কথায় অপূর্ব। শ্রেষ্ঠতম পারফিউমও এর কাছে কিছু না। বুকের গভীরে নাড়া দেয়া এক সুগন্ধি।
বাড়িতে প্রথম কয়েকদিন এর বাড়ি ওর বাড়ি, পুকুর পারে বেড়ানো, কোষা নৌকায় ওঠা, সেই বজরার ভেসে থাকা অংশে উঠে গান গাওয়া- এসব করে ভালই কাটলো। একদিন গান গাইতে গিয়েই মন খারাপ হয়ে গেলো। মনে হলো আমার বোধ হয় ফিল্মে অভিনয় করা হলো না। আমি যখন জামশেদপুর স্কুলে পড়তাম তখন একটি ডকুমেন্টারী ফিল্মে অভিনয় করেছিলাম। নাম নয়াদর নির্মাতারা স্কুলে এলো, জানালো ছবির নায়ক স্কুলের ছাত্র তাই তাঁদের একটি ছেলে দরকার। আমি ছাত্র অবস্থায়ই নাটক থিয়েটার করতাম। ভালো খেলোয়াড় ছিলাম। স্কুলে থাকা অবস্থায়ই ফার্স্ট ডিভিশনে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতাম। ভারতের প্রখ্যাত ফুটবলার পি.কে. ব্যানার্জী এগ্রিকো ক্লাবে খেলতেন। আমিও সেই ক্লাবেই খেলতাম। তিনি আমার চেয়ে ৫ বছরের সিনিয়র ছিলেন। যাই হোক স্কুলের হেড মাস্টার কে.কে.রায় নির্মাতার কাছে আমাকেই দিলেন। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর অভিনয়ের প্রতি আমার ঝোঁক বেড়ে গেলো এবং সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে বড় অভিনেতা হতে হবে। ১৯৫৭ সালে আমি মা’র হাতের একটি বালা নিয়ে দুই বন্ধুর সাথে বোম্বে পালিয়ে গেলাম। বন্ধুদের মধ্যে চিমনবাই পাটেলের বাড়ি বোম্বে এবং মোহন রাও মাদ্রাজী। আমরা ষ্টেশনে থাকি। তিন দিন পর চিমনবাই পাটেল নিজ বাড়িতে চলে গোলো আর মোহন রাও ফিরে গোলো মাদ্রাজে। আমি রোজ স্টুডিওর পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াই। একদিন এক ভদ্রলোক আমাকে লক্ষ্য করে তার কালো গাড়ি থামালেন। পরনে কালো আচকান বুটিদার পাজামা, হাতে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট নামের দামী সিগারেটের কৌটা। তিনি আমাকে নানা প্রশ্ন করে সব জানলেন এবং গাড়িতে উঠিয়ে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক আমাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে দোতলায় চলে গেলেন। একটু পর দেখি ভদ্রলোক নেমে আসছেন পাশে গাউন পরা এক মহিলা। মহিলাকে লক্ষ্য করে আমি থ হয়ে গেলাম। মনে হলো আমি স্বপ্ন দেখছি। যাকে দেখলাম তিনি প্রখ্যাত অভিনেত্রী মীনা কুমারী। ভদ্রলোক মীনা কুমারীর হাজবেন্ড। ভদ্রলোক মীনা কুমারীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় বললেন, ‘এই যে সেই হিরো (সম্ভবত ওপরে গিয়ে আমার প্রসঙ্গে আলাপ করেছেন)। আমি তাঁকে সালাম দেবো, না প্রণাম করবো, না নমস্তে বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু এক্সপ্রেশনে বোঝালাম যে, আমি তাঁকে অভিবাদন জানাচ্ছি। উনি মিষ্টি হেসে বললেন আদাব। ডাইনিং টেবিলে খাবার খেতে পারছিলাম না। ভদ্রলোক বার বার খেতে বলছিলেন কিন্তু মনে মনে চাচ্ছিলাম মীনা কুমারী আমাকে বলুক। এক সময় মীনা কুমারী বললেন,’কেনো খাচ্ছো না? খাও।’ তাদের ওখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। ঐ বাসায় থাকা অবস্থায়ই তখনকার অভিনেতা করণ দেওয়ান,শাম্মী কাপুর ও অশোক কুমারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাচ্ছিল্যের সাথে বলেছিলেন এই সেই হিরো। তাঁরা ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘এ তো হিরোর মতোই লাগছে।’ একদিন মীনা কুমারী আমাকে প্রয়োজনীয় টাকা দিয়ে, ট্রেনের টিকেট সমেত একজন লোক দিয়ে স্টেশনে পাঠালেন এবং বলেছিলেন বালা দিয়ে যেনো মা-বাবার কাছে মাফ চাই, আরো বলেছিলেন আমি যেনো এম.এ. পাস করে তাঁর কাছে যাই। তখন তিনি আমাকে হিরো বানাবেন। আমি তাঁদের বাসায় ২০ দিনের মতো ছিলাম। জামশেদপুরে ফিরে বন্ধুদের সাথে বললাম বোম্বে দেখে এসেছি। যা দেখেছি বা ঘটেছে তার চেয়ে কয়েক গুণ বাড়িয়ে বললাম। বন্ধুরা বললো বেশ, প্রমাণ দেখা, ছবি দেখা। আমার কাছে ছবি তো নেই। ওরা বললো, গুল ছাড়ার জায়াগা পাস না। আমি প্রমাণের জন্য মীনা কুমারীকে চিঠি লিখলাম। এক এক করে বিশটির মতো।
প্রশ্ন: আপনার পারিবরিক জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন?
– ১৯৬৯ সালে আমি ভালবেসে বিয়ে করলাম জ্যোত্স্না কাজীকে, আমার স্ত্রী দেশের অন্যতম সম্ভ্রান্ত পরিবার চৌদ্দগ্রাম চিওড়া কাজী বাড়ির মেয়ে। বাবা কে. জি. আহমেদ। কিছুদিন পলিটিক্স করলাম ভাসানীর সাথে। পরিচয় হয় ফজলে লোহানী, ফকির মতিউর রহমান, আজিজ মেহের এর সাথে। তখন দেশে আন্দোলনমুখর অস্থিতিশীল অবস্থা। ১৯’৬৭-‘৬৮ তে আমার স্ত্রী ছাত্রলীগ করতেন। ছাত্রলীগ ভেঙে বাংলা ছাত্রলীগ হলো। আমার স্ত্রী এ দলে আসলেন। সে এখন বিএনপির সাথে জড়িত।
প্রশ্ন: সিনেমা বানানোর মানসিক প্রস্তুতি কীভাবে নেন?
– যখন একটি গল্প উপন্যাস লিখব যেই লিখুক আবেগটা আগে, তারপর কমেডি আসবে, আমি যদি লিখি তবে আগে দেখবো চিত্রনাট্যের সঙ্গে চরিত্রগুলো ঠিক আছে কি না। গেট-আপ মেকাপ কি হবে। ছবির এডিটিং, আবহসঙ্গীত কি হবে। এডিটরদের দায়িত্ব আমার চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী সে তার এডিট করে দিবে। আমার ধারণা, এডিটিং, আবহসঙ্গীত, গল্পের লোকেশন সবকিছুরই গুরুত্ব থাকবে। চরিত্র নির্বাচনে আমি এক্সেপ্রশন কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সবার ক্ষেত্রে আমি দেখি চোখ, তার চোখ কথা বলে কিনা। কারো দেখি তার বডি। এই শরীরে এই চরিত্র করতে পারবে কিনা৷ অনেকে বলে একে নেও, ওকে নেও, কারণ তারা অনেক ছবি বা নাটকে অভিনয় করেছেন; আমি মনে করি যে চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারবে তাকেই নিব।
যেমন রবি ঠাকুরের দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী আমার মনে হয়েছে সুভার জন্য শাকিবই ফিট। আমাদের দেশের শিল্পীদের উচ্চারণের সমস্যা আছে। এই যে মান্না ৩০০ ‘র বেশি ছবি করেছে, এখনো উচ্চারণে সমস্যা। দোষ ওর না দোষ আমার কারণ, আমরা তাদের শিখাই না। রিয়াজ, শাকিব এর উচ্চারণ ঠিক না, মৌসুমী শাবনুর, পূর্র্ণিমা কারোর উচ্চারণ ঠিক না।
প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে বর্তমানে কী সমস্যা বিরাজ করছে?
– আর্থিক দিকটি অবশ্যই একটি ফ্যাক্টর। তবে প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ছবি করার জন্যে যে প্রচণ্ড ইচ্ছা শক্তি দরকার, সেটাই কারো নেই। ইচ্ছা থাকলেই উপায় হবে। আমার ইচ্ছা ছিল বলেই আমি মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে পাঁচটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি এবং ইচ্ছাশক্তির জোরেই আগামীতে আবার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করব।
ভালো ছবি নির্মাণের জন্যে প্রচন্ডভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। আগে যে সরকারি অনুদান প্রথা ছিল সেটাতেও ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। যে পঁচিশ লাখ টাকা দেয়া হতো সেটা একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যথেষ্ট নয়। আবার শুরুতে অংশবিশেষ শুট করে অনুদান কমিটিকে দেখাতে হবে, তারপর টাকা দেয়া হবে এরকম একটি নিয়ম ছিল। কিন্তু একবারও চিন্তা করা হয়নি যে একজন নির্মাতা সেই টাকাটা কোথায় পাবেন ?
আসলেই যদি ভালো ছবি নির্মাণ করতে চাই তাহলে অনুদানের টাকার পরিমাণ ষাট সত্তর লাখ করতে হবে, তত্সঙ্গে থাকতে হবে এফডিসির সুযোগ-সুবিধা। এছাড়া শিল্পী ও কলাকুশলীদের সহযোগিতারও প্রয়োজন রয়েছে। ছবি রিলিজের সময়ও সরকারের ভূমিকা থাকতে হবে। ছবিটি ট্যাক্স ফ্রি করতে হবে এতে দর্শক সংখ্যা বেড়ে যাবে। সরকারি মাধ্যম বিটিভিতে ছবিটির প্রচার করতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর শুধুমাত্র চিত্রনাট্য দেখে নয়, ভালো নির্মাতা সিলেক্ট করে অনুদানের টাকা দেয়া দরকার। সরকারি অনুদান বিকল্প ও মূলধারা দু’ধারার নির্মাতাদেরই দেয়া উচিত। কোনো বছর হয়তো একজন বিকল্পধারার, দু’জন মূলধারার, আবার আরেক বছর দু’জন বিকল্পধারার ও একজন মূলধারার নির্মাতা এই অনুদানের অর্থ পেতে পারেন। এভাবে এই দুই ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। অনুদানের অর্থ দিয়ে যে ধারার নির্মাতারাই ভালো ছবি নির্মাণ করুক তাতে আমাদের সিনেমা শিল্পেরই লাভ।
প্রশ্ন: আপনাকে নির্মাতা হতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন কারা?
– তরুণ বয়সে আমি মহানায়ক দিলীপ কুমারের ভক্ত ছিলাম। তাঁকে ফলো করতাম। তাঁর মতো চুলের স্টাইল ছিলো। আমি দিলীপ কুমার হতে চাইতাম। তিনি ছিলেন আমার স্বপ্নপুরুষ। বলতে গেলে আমি তাঁর আকর্ষণেই অভিনয়ে আগ্রহী হয়েছি। ‘৯৪ তে তাঁকে দেশে আনা, এয়ারপোর্টে রিসিভ করা, সংবর্ধনা দেয়া-সবকিছুতেই আমার মূখ্য ভূমিকা ছিলো। দেখা গেলো তিনি আমাকে পুরস্কার দিচ্ছেন, আমিও তাঁকে পুরস্কার দিচ্ছি। মজার ব্যাপার এখন তিনি আমাকে বলেন ‘চাষী ভাই’। শুধু আমার সাথেই নয় ঐ ৮/৯ দিনে আমার স্ত্রী সন্তানদের সাথে এমন আন্তরিকতা হলো যে, যাওয়ার সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হলো৷ যেন সেই জামশেদপুরে ছেড়ে আসা বন্ধুদের জন্য ব্যাকুলতা। আসলে মানুষ আন্তরিকতা, ধৈর্য্য ও নিষ্ঠার সাথে কোন কিছু চাইলে তা অবশ্যই একদিন পাবে। আল্লাহকে পাওয়া যায় আর মানুষকেতো পাওয়া যাবেই।
প্রশ্ন: কোন কোন ছবিতে স্বীকৃতি পেয়েছেন?
– জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন করেন জিয়াউর রহমান। যদি এর আগে এর প্রচলন থাকতো তবে নিশ্চিতভাবে ‘ওরা ১১ জনে’র জন্য আমি পুরস্কার পেতাম। ‘সংগ্রাম’ ও ‘দেবদাস’ও পুরস্কার পাবার যোগ্য ছবি। আমি পরিচালক হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই ‘শুভদা’ ছবিতে। ছবিটি ১২টি পুরস্কার পায়, এটি একটি রেকর্ড। এছাড়া ‘চন্দ্রনাথ’ ৬টি পুরস্কার, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ৭টি এবং ‘বিরহ ব্যথা’ ২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। এছাড়া পরিচালক হিসাবে আমি যেসব পুরস্কার পেয়েছি তার মধ্যে প্রযোজক সমিতির পুরস্কার, যুব পদক, মধুসূদন পদক, জগদীশ চন্দ্র বসু পদক, মানিক মিয়া পদক, শেরে বাংলা পদক, জে.সি বোস পদক, ফিম ক্রিটিক্স এওয়ার্ড উল্লেখযোগ্য।
প্রশ্ন: আপনার জীবনের স্মরণীয় মুহুর্ত কোনটি ?
– অনেক ঘটনাই মনে পড়ছে। তবে একবার সত্যজিত্ রায়ের বাড়িতে যাই। পরিচয় করিয়ে দেয় আমার সহকারী ও বন্ধু সুমন আহমেদ। ওর সাথে সত্যদার মধুর সম্পর্ক ছিলো। সত্যজিত্ রায়ের সাথে দীর্ঘ দেড়ঘন্টা আলাপ হয়। প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র, বাংলাদেশ, পদ্মাপাড়, জেলে জীবন ইত্যাদি। সত্যদা জানালেন তিনি পদ্মা নদীর মাঝি করবেন। প্রযোজনা করবেন তিনি এবং পরিচালনা নাকি আমাকে করতে হবে। আমি জানতে চাইলাম কেনো ? তিনি বললেন, ‘পদ্মা, পদ্মা পাড়ের জেলে জীবন, তাদের আশা-আকাঙ্খা সম্পর্কে আপনি ভালো জানেন, ওদের সাথে মিশেছেন। অতএব পরিচালক হিসাবে আপনি ভাল করতে পারবেন। আমি বিনয়ে বিব্রত হলাম আশান্বিতও হলাম। আজ সত্যজিত্ রায় নেই তাঁর স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো।
প্রশ্ন: কোন পুরস্কার পেয়ে সবচেয়ে আনন্দিত হয়েছেন?
– সব পুরস্কারই আনন্দের। তবে যেটা আমাকে সবচেয়ে আনন্দিত করেছে তা হলো একুশে পদক। এই অঙ্গণে কাজ করে এমন পুরস্কার সত্যিই আনন্দের। আর তাই সব পুরস্কারের চেয়ে একুশে পদকই আমার বেশি প্রিয়।
মৃত্যু
চাষী নজরুল ইসলাম ২০১৫ সালের ১১ই জানুয়ারী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লেখক : বিপ্লব মোস্তাফিজ