১৯৭৬ সালের মে মাস। মজলুম জননেতা মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহী থেকে ফারাক্কা মিছিল বের হবে। সেই মিছিলের সংবাদ ও ছবি সংগ্রহ করার জন্য ঢাকা থেকে সাংবাদিকরা রাজশাহীতে পৌঁছেছেন। মোনাজাতউদ্দিনের তখনো পর্যন্ত কোনো পত্রিকায় স্থায়ী চাকুরি হয়নি। কিন্তু সংবাদে লেখা পাঠান, সেগুলো ছাপা হয়; এই পর্যন্তই। তাঁর নিজের কোনো কার্ড নেই। তারপরও প্রবল উৎসাহ ও চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে তিনি মিছিলের দু’দিন আগেই নিজের পকেটের টাকা খরচ করে রাজশাহীতে পৌঁছে যান। ভাসানীর মিছিল কাভার করার জন্য সংবাদ অফিস থেকে সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার পাঠানো হয়েছে। তাঁদের কাছে মোনাজাতউদ্দিন পাত্তাই পেলেন না। বরং মোনাজাতউদ্দিনকে পেয়ে ঢাকার ওই সাংবাদিকরা ‘পান-বিড়ি-সিগারেট’ আনার মতো ফুট-ফরমায়েসের কাজ কিছুটা করিয়ে নিলেন। মোনাজাতউদ্দিনও ‘ভয়ে ভয়ে, বিনয়ের সাথে’ সেই কাজ করে দেন। প্রতিবাদ করতে পারেননি। ঢাকার সাংবাদিকরা ‘যদি মাইন্ড করে’! কারণ তাঁর তো তখন ‘চাকুরি চাই, নিয়োগপত্র পেতে হবে’। ‘সংবাদ’-এর সন্তোষ গুপ্ত সরাসরি বলে দিয়েছেন, “সংবাদ-এর জন্য উত্তরাঞ্চলভিত্তিক খবর ও ছবি পাঠাতে পারেন, ভালো হলে ছাপাও হবে। কিন্তু চাকুরির ব্যাপারে আমি কোনো সুপারিশ করতে পারবো না। আপনার নিজের কাজের যোগ্যতায় যদি এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আদায় করতে পারেন, করুন।” ফলে মোনাজাতউদ্দিনের কাছে প্রশ্নটা যোগ্যতার। তাঁকে সেই যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। ভাসানী মিছিল শুরুর আগে স্থানীয় এক মাদ্রাসার মাঠে বক্তব্য দিলেন। মোনাজাতউদ্দিন তাঁর নিজের ভাঙ্গা ক্যামেরা দিয়ে দূর থেকে সমাবেশে ভাসনীর বক্তব্যরত অবস্থার কয়েকটি ছবি তুলে নিলেন। যদিও জানেন এগুলো কোনো কাজে লাগবে না। তারপরও নেশায় পড়ে তুলে নিলেন ছবিগুলো। একবার ভাসানীর মঞ্চের কাছাকছি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোনো পত্রিকার কার্ড তো নেই! তাই আয়োজকরা ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলেন। অপমান! থোরাই কেয়ার করলেন মোনাজাতউদ্দিন।
ভাসানী বক্তব্য শেষ করে যে স্থান দিয়ে মিছিল নিয়ে যাবেন আগে থেকেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মোনাজাতউদ্দিন। কারণ, অন্যান্য সাংবাদিক ও ফটোসাংবাদিকের জন্য গাড়ি তৈরি আছে মিছিলের সাথে যাবার জন্য। মোনাজাতউদ্দিনের সেখানে জায়গা হবে না তা তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য সাংবাদিকদের বহনকারী গাড়িটি মুহুর্তেই মিছিল যে দিকে যাবে সেদিকে না গিয়ে ঠিক তার উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করল। গাড়ির সাংবাদিকরা ‘গাড়ি ঘুরাও, গাড়ি ঘুরাও’ বলে চিৎকার শুরু করে দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে জনতার স্রোত এতো প্রবল হয়ে উঠেছে যে বেচারা চালকের আর সেই ক্ষমতা ছিল না। এদিকে মিছিল প্রায় চলে গেছে আধা মাইলের মতো। উপায়ান্তর না দেখে সাংবাদিকরা গাড়ি থেকে নেমে দৌড় লাগালেন মিছিলের সামনের দিকে। কিন্তু জনতার স্রোতে সেই প্রচেষ্টাও খুব বেশি সফল হল না। প্রমোদ গুণলেন মোনাজাতউদ্দিন। যে অবস্থা তাতে ‘সংবাদ’-এর ফটোগ্রাফারের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই মিছিলের সামনে ভাসানীর ছবি তোলা সম্ভব নয়। অথচ এই ছবি মোনাজাতউদ্দিনের কাছে তোলা আছে। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন এই ছবি ও সংবাদ নিয়েই রওনা দেবেন ঢাকার পথে। তখনকার দিনে রাজশাহী থেকে ঢাকা মানে অনেক দূর আর অফুরন্ত সময়েরও ব্যাপার। কিন্তু মোনাজাতউদ্দিন রাত বারোটার আগেই ঢাকায় পৌঁছুবেন এমন পণ করেই রওনা হয়ে গেলেন। পকেটে মাত্র পঞ্চাশটি টাকা। বৃষ্টি পড়ছে গুড়ি গুড়ি। প্রবল প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে রাজশাহী-নাটোর-ঈশ্বরদী-পাবনা- নগরবাড়ী ঘাট হয়ে ঠিক রাত এগারোটায় ঢাকায় পৌঁছেন আর সাড়ে এগারোটায় পৌঁছেন বংশালের ‘সংবাদ’ অফিসে। সন্তোষ গুপ্ত তখন ‘সংবাদ’-এর টেবিলে মাথা গুজে বসে আছেন। রাজশাহী থেকে কোনো ছবি তো দূরের কথা সংবাদও এসে পৌঁছেনি। মোনাজাতউদ্দিনকে দেখে সন্তোষ গুপ্ত বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘আমি ঠিকই ধারণা করেছিলাম, আপনি আসবেন। ছবি এনেছেন? ফিল্মটা দিন, আপনি বসুন। আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করি।’ কিন্তু মোনাজাতউদ্দিন খাবার স্পর্শ না করে লিখতে বসে যান। একটানা সংবাদ লিখে শেষ করে তারপর বসেন খাবার টেবিলে। ‘সংবাদ’-এর প্রথম পাতায় ফারাক্কা মিছিলের লীড নিউজ এলো ছয় কলাম জুড়ে। খবরটি ছাপা হলো মোনাজাতউদ্দিনের নামে। দু’টি ছবিও ছাপা হলো তাঁর নাম দিয়ে। রাতে, অফিসেই পত্রিকার ফাইলের ওপর শুয়ে থাকলেন। কিন্তু সেই রাতে আনন্দে ঘুম এলো না মোনাজাতউদ্দিনের দু’চোখে।
সকালে সন্তোষ গুপ্ত বাসা থেকে ফোন করে জানালেন, ‘সংবাদ’ সম্পাদক আহমেদুল কবীর তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন। কবির সাহেব এলেন। মোনাজাতউদ্দিনকে ডেকে নিলেন কামরায়। বললেন, ‘তোমার কাজে আমি খুব খুশি হয়েছি। কি চাও তুমি?’ এই কথা শুনে, হাঁটু-বুক-গলা তিনই কেঁপে উঠলো মোনাজাতউদ্দিনের। মিনমিনে গলায় বললেন, ‘একটা চাকুরি।’ শেষ পর্যন্ত মোনাজাতউদ্দিন নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পেরেছিলেন ‘সংবাদ’ তথা সারা বাংলাদেশের সংবাদ জগতের কাছে। যোগ্যতা দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের কাঙ্গাল হরিনাথের পর প্রথম স্বার্থক ‘চারণ সাংবাদিক’। মোনাজাতউদ্দিন-এর জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মরনিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আলিমউদ্দিন আহমদ ও মার নাম মতিজাননেছা। বাবা আলিমউদ্দিন ছিলেন চাকুরিজীবি। তিনি ছিলেন সেযুগের মেট্রিক পাশ। তিনি রংপুর পৌরসভার ঊর্ধ্ব-করণিক, রংপুর পুলিশ দপ্তরে প্রধান- করণিক এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজের হিসাব রক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আলিমউদ্দিনের শিল্প-সাহিত্যের প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। তিনি ‘আম্বিয়া চরিত’ নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়াও ‘আধুনিক যোদ্ধা’ নামে একটি বইয়ের পান্ডুলিপি রচনা করেছিলেন। আলিমউদ্দিন ধর্ম বিষয়ে ছিলেন প্রবল আগ্রহী। এলাকার লোকজন তাঁর কাছ থেকে ধর্মীয় উপদেশ নিতেন। নিজ অঞ্চলে তিনি একজন মৌলভী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তবে ধর্মের গোঁড়ামি থেকে মুক্ত একজন আধুনিকমনস্ক মানুষ ছিলেন তিনি। মোনাজাতউদ্দিনের বাবা-মার পরিবার আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে ছিলো যথেষ্ট প্রভাবশালী। আলিমউদ্দিন ও মতিজাননেছার ছয় পুত্র। মোনাজাতউদ্দিন ছিলেন সবার বড়। মোনাজাতউদ্দিনের বাবা অক্লান্ত পরিশ্রম করে পরিবারের সকলকেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। বাবা মারা যবার পর বড় ছেলে হিসেবে মোনাজাতউদ্দিন সেই দায়িত্ব পালন করেন।
মোনাজাতউদ্দিনের পড়াশোনার শুরু গ্রামেরই প্রাইমারি স্কুলে। যেদিন তিনি স্কুলে ভর্তি হতে যান সেদিন তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা। মোনাজাতউদ্দিন তাঁর স্মৃতিচারণায় সেদিনের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, “মনে পড়ে প্রথম যেদিন আমাকে ক্লাস ওয়ান-এ ভর্তি করে দিতে গেলেন বাবা, জরিফ স্যারের সামনাসামনি হতেই আমি প্যান্টে পেচ্ছাব করে দিয়েছিলাম এবং দুইয়ের ঘরের নামতা পুরোটা বলতে পারিনি বলে নীল- ডাউন করে রেখেছিলেন তিনি তাঁর টেবিলের সামনে। বাবা আতংকিত হয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেটা একটু বোকা, তাতে আবার তোতলামী আছে…ওকে একটু দেখে শুনে নিবেন।’ স্যার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠেছিলেন, ‘তা হইলে একে আপনি অন্য স্কুলে নিয়ে যান আলিমউদ্দিন মিয়া…আমি পারবো না। আমার এখানে পড়া না পারলে সে যেই হউক আমি তাকে রক্ষা দিবো না।’ সাধারণ যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ ভুল হয়ে যাবার কারণে কতো ছড়ি আমার পিঠে ভেঙ্গেছেন জরিফ স্যার।”
মোনাজাতউদ্দিন রংপুরের ধাপপাড়ায় কৈলাসরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাশ করেন। পরে ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। রংপুর কারমাইকেল কলেজ ছিল সেসময় খুবই নামকরা। তিনি সেখান থেকে মানবিক শাখায় ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কলেজে পড়ার সময় মোনাজাতউদ্দিন শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এসময় তিনি প্রচুর ছড়া ও কবিতা লেখেন এবং অঙ্কন শিল্পী হিসেবেও কলেজে বেশ সুনাম অর্জন করেন। পাশাপাশি স্কুল জীবন থেকেই নেশা ছিল ফুটবল, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলার। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে মোনাজাতউদ্দিনের ছাত্র জীবন বেশ ভালোভাবেই অতিবাহিত হচ্ছিল । কারমাইকেল কলেজে বি.এ. পড়ার সময় হঠাৎ করেই বাবা আলিমউদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স তখন আঠার বছর। বাবার মৃত্যুতে পরিবারে আর্থিক অনটন দেখা দেয়। স্বাভাবিক কারণেই তখন পরিবারের দায়-দায়িত্ব নিতে হয় মোনাজাতউদ্দিনকে। তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ছোটভাইদের পড়াশোনা নির্বিঘ্নে চালানোর জন্য তিনি চাকুরি নেন নিশাতগঞ্জ সরকারী প্রাইমারি স্কুলে। নিজের বাড়ি থেকে সাইকেল চালিয়ে যেতেন কর্মস্থলে। কিছুদিন পরে সেই চাকুরি ছেড়ে দিয়ে পিডিবি অফিসে একজন একাউনটেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু এই চাকুরিতে তাঁর মন বসেনি। তিনি কিছুকাল কাজ করেন রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ক্যাটালগার হিসেবে। নিজের হাতের লেখা যেহেতু খুবই সুন্দর ছিলো সেকারণে এই কাজটি তিনি অনায়াসেই পরিচ্ছন্নভাবে করতে পারতেন। পারিবারিক কারণে বিভিন্ন স্থানে কাজ করলেও তিনি কখনোই লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যাননি। বাবার মৃত্যুর কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলেও তিনি সকলের অগোচরে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বি.এ. পাশ করেন।
মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ছাত্র অবস্থাতেই। তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ‘বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকার ‘দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকার স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। পরে ১৯৬৬ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজে যোগদান করেন। এর আগে কিছুদিন ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায়ও কাজ করেন। এসব পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে মোনাজাতউদ্দিন লক্ষ্য করেন অনেক সময় তাঁর রিপোর্ট যথাযথ হবার পরেও ছাপা হয় না। কখনো কখনো স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাস আর আদর্শের ভিত্তিতে প্রাণ খুলে লিখতেও পারছেন না। এই অবস্থায় চিন্তা করেন নিজেই একটি ‘দৈনিক’ করবেন। সেই চিন্তা থেকেই স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে প্রকাশ করেন ‘দৈনিক রংপুর’। শুধুমাত্র স্থানীয় সংবাদের ভিত্তিতে তিনি এই পত্রিকাটি বের করার চিন্তা করেন। ‘দৈনিক রংপুর’ ছিল মিনি সাইজের পত্রিকা, দাম মাত্র পাঁচ পয়সা। মোনাজাতউদ্দিন ছিলেন এর সম্পাদক- প্রকাশক। অল্প দিনেই পত্রিকাটি মানুষের নজর কাড়ে। ভোর হবার আগ থেকেই মানুষ পত্রিকাটির জন্য প্রেসে গিয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। এর অর্থ যোগাতেন একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী। বাহ্যিকভাবে সেই ব্যবসায়ী সৎ মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন অসৎ ব্যবসায়ী। যে কারণে তাঁর সঙ্গে মোনাজাতউদ্দিনের সম্পর্কের ইতি ঘটে। অবধারিতভাবেই এই পত্রিকাটির করুণ মৃত্যু হয়। এ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে সেই পত্রিকায় ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল সংখ্যায় জনৈক স্টাফ রিপোর্টার লিখেন, “গতকাল রংপুর কারমাইকেল কলেজের সর্বজনবিদিত দালাল অধ্যক্ষ নাসিম আহমেদের বিরুদ্ধে স্থানীয় ছাত্র ও জনসাধারণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সংগৃহিত তথ্যাবলীর ভিত্তিতে একটি খবর প্রকাশ করি। এর ফলস্বরূপ অদ্য শুক্রবার সন্ধ্যায় রংপুর শহরের কতিপয় অতি পরিচিত মুখ-চেনা ছাত্র নামধারী গুন্ডা দলবল সহকারে ‘দৈনিক রংপুর’ কার্যালয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। সেসময় ‘দৈনিক রংপুর’-এর সম্পাদক জনাব মোনাজাতউদ্দিন কর্মরত ছিলেন। উক্ত কথিত ছাত্র নামধারী গুন্ডারা জনাব মোনাজাতউদ্দিনকে প্রথমে অশ্লীল ভাষায় গালিগালি করে এবং পরে তাঁকে টেনে রাস্তায় বের করে নির্মমভাবে প্রহার করে। ফলে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন। তাঁর হাত-পা ও বুক থেকে রক্তক্ষরণও হয়।…” এই ঘটনার পর পরই ঢাকায় ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাও বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাধ্য হয়েই মোনাজাতউদ্দিনকে জীবিকার তাগিদে একটি কীটনাশক কোম্পানিতে চাকুরি নিতে হয়। কিন্তু এই চাকুরি করে তিনি যেন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। মোনাজাতউদ্দিনের মনের ভিতর কেবলি উৎকীর্ণ হয়ে ওঠছিল সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ। ১৯৭৬ সালে আসে সেই সুযোগ। তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কাজ করার সুযোগ পান। তারপর থেকে একটানা প্রায় বিশ বছর সেখানেই কাজ করেছেন দায়িত্বশীলতার সাথে। ‘সংবাদ’ই ছিল তাঁর কাছে পৃথিবীর আপন ঠিকানা। তিনি যেন ধীরে ধীরে এই পরিবারের সদস্য হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। অনেক সময় সেখান থেকে নিয়মিত বেতন পাওয়া যায়নি। তাতে কী? মোনাজাতউদ্দিন তো শুধু জীবিকার প্রয়োজনেই গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে গড়ে তোলেননি নিজেকে। তাঁর গণমাধ্যম কর্মী হবার পেছেনে ভিন্ন এক মতাদর্শ কাজ করেছে। যে মতাদর্শই সামগ্রিকভাবে তাঁকে মর্যাদা দিয়েছিল ‘চারণ সাংবাদিক’ অভিধায়। সংবাদের প্রতি সেই মোহ-মমতার কথা অকপটেই বিভিন্ন লেখায় স্বীকার করে নিয়েছেন সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন।
তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে এক সময়ে ‘সংবাদ’-এর বার্তা সম্পাদক প্রখ্যাত কলামিস্ট সন্তোষ গুপ্ত লিখেছেন, “মোনাজাতউদ্দিনের সংবাদ সংগ্রহের স্টাইল ও নিষ্ঠা জড়িয়ে গিয়েছিল; কোথাও ভঙ্গী দিয়ে চোখ ভোলানোর আয়োজন ছিল না। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, ফলোআপ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অনন্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। গ্রাম বাংলার জনজীবনের একটা নিখুঁত তথ্যনির্ভর এবং একই সঙ্গে সংবেদনশীল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ও চিত্ররূপময় বর্ণনা এবং চিত্র তিনি দেশবাসীকে উপহার দিয়েছেন খবরের মাধ্যমে। তাঁকে ‘চারণ সাংবাদিক’ অ্যাখ্যা দান যথার্থ। এই একটি অভিধাতেই তাঁর সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য ও অনন্যতা ধরা পড়ে।” বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’-এ কাজ করার পর তিনি দৈনিক জনকন্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন। তাঁর মৃত্যু ছিল এক অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্খিত ঘটনা।
মোনাজাতউদ্দিনের শরীরটা সেসময় খারাপ যাচ্ছিল। শরীরে অত্যধিক পরিশ্রমের কারণে জেঁকে বসেছিল নিম্ন-রক্তচাপ আর গ্যাস্ট্রিক আলসার। মৃত্যুর তিন দিন আগেই অসুস্থতার কারণে রংপুর প্রেসক্লাবে মাথা ঘুরে পড়ে যান। সতীর্থরা তাঁকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসেন। দু’দিন বাসায় বিশ্রাম নেন তিনি। আরো কয়েকদিন বিশ্রামে থাকার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেসময় অফিস থেকে তাঁকে গাইবান্ধায় যেতে বলা হয়। কারণ, সেখানে ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দু’টি নৌকাডুবি হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেখানকার সঠিক তথ্যানুসন্ধান করতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন গাইবান্ধায়। মোনাজাতউদ্দিনের সঙ্গে ছিলেন ‘দৈনিক সংবাদ’- এর সাংবাদিক মফিজুল হক তারা ও তাঁর ক্যামেরাটি। যাবার পথে ‘শেরেবাংলা’ নামক ফেরিতেই তিনি দুর্ঘটনার মুখে পতিত হন। ফেরির ছাদ থেকে হঠাৎ করেই পানিতে পড়ে যান। স্থানীয় নৌকার মাঝিরা তাঁর দেহ তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করতে পারলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। ধারণা করা হয়, পানিতে পড়ার সাথে সাথেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায় বাংলার চারণ সাংবাদিকতার শিরোমণি মোনাজাতউদ্দিনের জীবন-প্রদীপ। ৩০ ডিসেম্বর তাঁকে রংপুর শহরের মুন্সীপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি মোনাজাতউদ্দিন প্রচুর সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। গ্রামীণ এলাকায় মানুষের কুসংস্কার, অন্ধতা দূর করতে তিনি তরুণদের নিয়ে সংগঠন করেছেন। কখনো তাদের নিয়ে নাটক করিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন গীতিকার ও নাট্যকার। রংপুর বেতারে নিয়মিত কাজ করতেন। তাঁর একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। যদিও চারুশিল্পে তাঁর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু নিজের অধ্যাবসায়ের ফলে তিনি অনেক বই ও ছোট কাগজের প্রচ্ছদ করেছেন। একজন দক্ষ ফটোগ্রাফার হিসেবেও বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। নিজে ছিলেন একজন নিপাট-নিরপেক্ষ সংবাদকর্মী। সৎ ও আদর্শ সাংবাদিক হিসেবে ভারত, নেপাল, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের সংবাদ জগতের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
মোনাজাতউদ্দিন তাঁর কর্ম জীবনের সাধনা ও স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে-১৯৭৭ সালে রংপুর নাট্য সমিতি কর্তৃক সংবর্ধনা, ১৯৮৪ সালে পান সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, আলোর সন্ধানে পত্রিকা তাঁকে ১৯৮৫ সালে সংবর্ধনা দেয়, ১৯৮৬ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বগুড়া কর্তৃক সম্মাননা সার্টিফিকেট অর্জন করেন, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৩৯৩ সালে পান ঐতিহ্যবাহী ফিলিপস্ পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে সংবাদপত্রে প্রভূত অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার পান, রংপুর পদাতিক গোষ্ঠী তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধনা দেয় ১৯৮৮ সালে, বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পান ১৯৯০ সালে, একই সালে লেখনির মাধ্যমে প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত শক্তিকে প্রত্যক্ষ ও জনপ্রিয় করার দুরূহ প্রচেষ্টা চালানোর জন্য সমাজ ও প্রযুক্তি বিষয়ক পত্রিকা ‘কারিগর’ সম্মাননা পান, ১৯৯৫ সালে মর্যাদাশালী অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন, রংপুরের নাগরিক নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক তাঁকে পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯৯৬ সালে, ১৯৯৬ সালে তিনি লালমনিরহাট ফাউন্ডেশন ও উন্নয়ন সমিতি স্বর্ণপদক পান, ঢাকাস্থ রংপুর জেলা সমিতি তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধিত করে ১৯৯৫ সালে, ১৯৯৭ সালে পান রংপুর জেলা প্রসাশন কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা, ১৯৯৭ সালে অর্জন করেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক, খুলনায় তাঁকে রুমা স্মৃতি পদক প্রদান করা হয় ১৯৯৮ সালে। এছাড়া ওয়াশিংটনের পদ্মার ঢেউ বাংলা সম্প্রচার কেন্দ্র সম্মাননা প্রদান করা হয় মোনাজাতউদ্দিনকে। তবে মোনাজাতউদ্দিন এই পুরস্কারের চাইতেও বড় পুরস্কার মনে করতেন মানুষের শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালবাসাকে, যা তিনি অকুন্ঠই পেয়েছেন।
সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন নাসিমা আক্তার ইতির সাথে ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইতি রংপুর বেগম রোকেয়া কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেছেন। পরে সংসার জীবনে মনোনিবেশ করেন। মোনাজাতউদ্দিন ও নাসিমা আক্তার ইতি’র দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে মাহফুজা মাহমুদ চৈতি একজন ডাক্তার, ছোট মেয়ে হোসনাতুল ফেরদৌস সিঁথিও ডাক্তার এবং একমাত্র ছেলে আবু ওবায়েদ জাফর সাদিক সুবর্ণ ছিলেন বুয়েটের মেধাবী ছাত্র। সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় ১৯৯৭ সালে আত্মহত্যা করে।
মোনাজাতউদ্দিন তাঁর সাংবাদিক জীবনে নানা মাত্রিকতার রিপোর্ট করেছেন। এসব নিয়ে বইও হয়েছে। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। যা পাঠক সমাজকে মোহতায় আবিষ্ট করে রাখে এখনো। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে-‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্য’, ‘কানসোনার মুখ’, ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’, ‘নিজস্ব রিপোর্ট’, ‘ছোট ছোট গল্প’, ‘অনুসন্ধানী রিপোর্ট’, ‘গ্রামীণ পর্যায়’, ‘চিলমারীর এক যুগ’, ‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী’, ‘লক্ষীটারী’, ‘কাগজের মানুষেরা’। এছাড়াও মাসিক মোহাম্মদি, দৈনিক আজাদ, সওগাত ও অন্যান্য পত্র- পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। নাটকের একমাত্র প্রকাশিত বই ‘রাজা কাহিনী’। এছাড়া তিনি প্রচুর ছড়া লিখেছেন।
তথ্যসূত্র: এই লেখাটি তৈরির জন্য মোহাম্মদ জয়নুদ্দিন রচিত ‘মোনাজাতউদ্দিন’ গ্রন্থ থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে। গ্রন্থটি ২০০১ সালের মে মাসে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। একাডেমির গবেষণা সংকলন ও ফোকলোর বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়েছে এটি। এর প্রচ্ছদ করেছেন সমর মজুমদার। ছবিগুলিও এই বই থেকে নেওয়া।
লেখক: চন্দন সাহা রায়