নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত-নূরজাহান বেগম
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে নূরজাহান বেগম একটি বিশিষ্ট নাম। বাবা সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের হাত ধরে সংবাদপত্র জগতে তাঁর আবির্ভাব। উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক (বেগম) পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে এর সম্পাদনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি শুধু একজন সাংবাদিকই নন লেখক গড়ার কারিগরও। তিনি ছয় দশক ধরে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।
নূরজাহান বেগম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের চালিতাতলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন ছিলেন মাসিক সওগাত এবং সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং মা ফাতেমা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। তাঁর বাবার আদি নিবাস ছিলো কুমিল্লা জেলার (তত্কালীন ত্রিপুরা) চাঁদপুর মহকুমার অন্তর্গত পাইকারদী গ্রামে। এই গ্রামটি অনেক বছর আগে মেঘনার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
নূরজাহান বেগমের শৈশব কেটেছে গ্রামের বাড়িতে মা, মামা, দাদী, নানীর সঙ্গে। ছোটবেলায় তিনি ছিলেন খুবই চঞ্চল। তাঁকে সামাল দিতে মা, চাচা, চাচী, মামা, দাদী, নানা, নানিকে হিমশিম খেতে হতো। বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন থাকতেন কলকাতায় ১১ নং ওয়েলেসলি স্ট্রিটের একটি দোতলা বাড়িতে। দোতলার একদিকে ছিল তাঁর সওগাত পত্রিকার অফিস। নিচতলায় ছিল প্রেস ‘ক্যালকাটা আর্ট প্রিন্টার্স’ আর অন্যদিকে থাকা খাওয়ার ঘর। সওগাত প্রকাশের পূর্বে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন চাকরি করতেন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। মাঝেমধ্যে তিনি গ্রামে বেড়াতে আসতেন।
জন্মের পর সবাই নূরজাহান বেগমকে আদর করে ডাকত নূরী। খেলার সাথীরা ডাকত মালেকা, চাচীরা ডাকতেন নুরুননেছা। স্কুলে ভর্তি করার সময় বাবা তাঁর নাম রাখেন নুরুন্নাহার। একবার তাঁর নানি কলকাতায় ওয়েলেসলি স্ট্রিটে বেড়াতে এলেন। তিনি নূরীকে দেখে মুগ্ধ হন এবং তাঁর নামে নাতনীর নাম রাখেন নূরজাহান বেগম।
গ্রামে থাকাবস্থায় নূরী ছুটে বেড়াত গ্রামের মাঠে ঘাটে, পুকুর নদী খালের পাড়ে। একদিন ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা। নূরী পুকুরে পড়ে গেলন। আশেপাশের লোকজন দেখে ফেলে তাঁকে দ্রুত পানি থেকে তুলে ফেলেন। আরেকদিন খাল পাড় দিয়ে দৌড়ে যেতে গিয়ে খালে পড়ে গিয়েছিলেন। এবারও সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে পানি থেকে টেনে তুলল। এভাবে দুবার ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে তিনি বেঁচে গেলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল তিন বছর। কন্যার এই দুর্ঘটনার সংবাদ শোনামাত্র নুরজাহানের বাবা তাঁদের কলকাতায় নিয়ে যাবার জন্য গ্রামে চলে এলেন। আত্মীয়স্বজনের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন স্ত্রী ও কন্যাকে ১৯২৯ সালে কলকাতায় নিয়ে এলেন। সঙ্গে এলেন মামা ইয়াকুব আলী শেখ। শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে চোখ ধাঁধিয়ে যায় নূরীর। কি প্রকাণ্ড স্টেশন আর কত রং-বেরং এর মানুষ। এরপর স্টেশন থেকে ফিটন গাড়িতে (ঘোড়ার গাড়ি) চড়ে এসে নামলেন ১১ নং ওয়েলেসলি স্ট্রিটের সেই বাড়িতে। বাবা কন্যাকে কলকাতার সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য তৈরি করতে মনস্থ হলেন। প্রথমে স্যাকরার দোকানে নিয়ে গিয়ে মেয়ের নাকের ফুল কাটালেন। এরপর একদিন মেয়েকে কোলে করে সেলুনে নিয়ে গিয়ে লম্বা চুল কাটিয়ে চায়না ববকাট করালেন। এই বাড়ির নিচতলায় বাস করতেন এক ইংরেজ পরিবার। এই দম্পতির দুটি সন্তান ছিল। একজনের নাম লডেন অন্যজনের নাম টিটু। ওদের সঙ্গে নূরীর বন্ধুত্ব্ব হয়ে যায়। ভাষার প্রতিবন্ধকতায় বন্ধুত্ব তেমন গাঢ় না হলেও তাদের সঙ্গে মিশে নূরীর লাভই হয়। কারণ ইংরেজিতে কথা বলার প্রথম পাঠটা নূরী ওদের কাছ থেকেই শিখে নেন। এছাড়াও এই বাড়িটি ছিল নূরীর খুবই পছন্দের বাড়ি। এখানেই তাঁর প্রথম দেখা হয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। নজরুলও এই বাড়িতেই থাকতেন। নজরুল যখন লেখায় গভীর মগ্ন তখন অনেক সময় মা নূরীর হাত দিয়ে চা পাঠিয়ে দিতেন। একদিন নূরী জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। এমন সময় তাদের বাড়ির সামনে গোলাপ ফুল দিয়ে সাজান একটি গাড়ি এসে থামল। সেই গাড়িতে উঠে বসলেন মাথায় গেরুয়া টুপি, পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবি ও ধুতি, কাঁধের ওপরে পাটকরা চাদর আর চোখে চশমা পড়া কাজী নজরুল ইসলাম। ঐ দিন ছিল মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন আয়োজিত এলবার্ট হলে কাজী নজরুল ইসলামের সংবর্ধনা। সংবর্ধনা শেষে নজরুল বাড়ি ফিরলেন সোনার দোয়াত কলম, ভেলভেটের থলেতে মোহর আরো কিছু উপহার নিয়ে। এসময় তাঁদের কলকাতার বাড়িতে প্রায় বিকেলে ও রাতে মেঝেতে ফরাস বিছিয়ে বসত সাহিত্যের আসর। আসরে আসতেন কবি খান মঈনুদ্দীন, ইব্রাহিম খাঁ, আবুল ফজল, ওয়াজেদ আলী, আবুল মনসুর আহমেদ, এম ওয়াজেদ আলী বার এটল ও তাঁর কন্যা মিরর পত্রিকার সম্পাদক। এসব আসরের প্রতি মা ফাতেমা খাতুনের কোনো আগ্রহবোধ না থাকলেও লোক দিয়ে চা বিস্কুট পাঠাতেন। হাবিবুল্লাহ বাহার কলকাতায় এলেই তাঁদের বাড়িতে আসতেন। হাবিবুল্লাহ বাহার নূরজাহান বেগমকে নূরী বলে ডাকতেন। কাছে ডেকে মজা করে বলতেন, দেখ নূরী আমার দাঁত পাখি নিয়ে গেছে। ছোট্ট নূরী তাই বিশ্বাস করে মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে পাখির খোঁজ করতেন।
ছোটবেলায় মা তাঁকে কাপড় দিয়ে সুন্দর সুন্দর পুতুল বানিয়ে দিতেন। তিনি এই পুতুল নিয়ে খেলতেন। আর তাঁর প্রিয় খাবার ছিল চকোলেট। সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন ব্রিটেনের তৈরি টাকা চকোলেট। এই চকোলেট খাবার জন্য বাবার সঙ্গে প্রায়ই বেড়াতে যাবার বায়না ধরতেন। মাঝে মাঝে বাবা তাঁকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতেন কখনও বিরক্ত হতেন। এভাবে নূরীর দিনগুলো আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু এর মাঝে তাঁর শান্তি আর আনন্দের ব্যাঘাত ঘটায় একটা বিরাট হনুমান। ওদের বাড়ির বিপরীত দিকের এক জমিদার বাড়িতে সে থাকত। দিনের বেলায় সে এবাড়ি ওবাড়ি লাফিয়ে বেড়ায় আর রাতের বেলায় নূরীদের ছাদের ওপর এসে ধুপধাপ আওয়াজ করে। ভয়ে নূরী ঘুমাতে পারেন না। ওর জন্য কোথাও কোনো খাবার রাখার উপায় নেই। কোন ফাঁকে যে হনুমানটা এসে সব নিয়ে যায় কেউ ধরতে পারে না। ঈদের দিন নূরীর মা অনেক মজার মজার খাবার তৈরি করলেন অথচ হনুমানটা সব নিয়ে গেল। এবার সত্যি সত্যিই জমিদার বাড়িতে নালিশ করা হলো। তারা হনুমানটাকে পাঠিয়ে দেন চিড়িয়াখানায়। হনুমানটা চলে যাওয়ায় নূরীর সাহস অনেক বাড়ল। একদিন বাবা যখন অফিসে, মা রান্নাঘরে, তখন তিনি গুটি গুটি পায়ে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠছিলেন, হঠাত্ দেখতে পেলেন সিঁড়ির অন্ধকার কোণায় দুটো জ্বলন্ত চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ ভয় পেয়ে চিত্কার করে নূরী সিঁড়িতে পড়ে যান। পড়ে দেখা গেলো ওটি ছিল একটি কালো বেড়াল।
নূরী সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হবার পর মা প্রতিদিন স্কুলে খাওয়ার জন্য টিফিন দিতেন পরোটা, ডিম, হালুয়া, মিষ্টি। আর মা বিদ্যালয়ের আয়ার হাতে কিছু পয়সা তুলে দিতেন মেয়ের যত্ন নেওয়ার জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই এক উর্দুভাষী মেয়ের সঙ্গে তাঁর বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। মেয়েটি নূরীকে ফুসলিয়ে তার দুটো গুলগুললার বিনিময়ে নুরীর ভালো ভালো টিফিনগুলো খেয়ে ফেলত। বেশিদিন বিষয়টি গোপন রইল না। একদিন আয়ার চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়ে। আয়া তার মাকে সব খুলে বলে। তখন ছোট্ট নূরীও বুঝতে পারেন মেয়েটি বন্ধুত্বের নাম করে এতোদিন তাকে ঠকিয়েছে। এই উপলব্দি পরবর্তীতে নূরীকে মানুষ চিনতে সাহায্য করেছে।
নূরজাহান বেগমের লেখাপড়ার প্রথম হাতেখড়ি হয় মায়ের হাতে। একদিন মা কন্যার হাত ধরে নতুন স্লেটের ওপর পেন্সিল দিয়ে লিখলেন অ আ ই ঈ। মায়ের হাত ধরে এভাবেই নূরী আদর্শ লিপি লিখতে শুরু করল। একই দিনে বাবাও তাঁকে আরবি পড়ার হাতেখড়ি দিলেন। শেখালেন আলিফ, বে তে সে। সেই সঙ্গে ইংরেজি এ বি সি ডি। অবসর সময়ে মা নূরীকে কবিতা, ছড়া, আরবি সুরা শেখান। নূরী পরম আগ্রহে সব শিখে নেন। বাবা তাঁর জন্য নিয়ে আসতেন অনেক পত্রপত্রিকা। যদিও নূরী তখনও তেমন পড়তে শেখেননি। কিন্তু তবুও আগ্রহ ভরে পত্রপত্রিকাগুলো উল্টেপাল্টে দেখেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনটি ছিল তাঁর খুবই প্রিয়। এখানে মজার মজার ছবি, প্রজাপতি, ফুল আর নানা ধরণের জীবজন্তুর ছবির সঙ্গে পরিচিত হন। এভাবে ছবি দেখতে দেখতে পত্রপত্রিকা ফাইলিং করা শিখে ফেললেন তিনি। চকের গুড়ো ঘষে ঘষে ব্লক থেকে ছবি বের করে বাবার চাহিদা মতো তাঁর হাতে তুলে দেন নূরী। শিশু বয়সেই নূরী বাবা নাসিরউদ্দীনের কাছে সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ নেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য বাবা তাঁকে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। প্রার্থনা সঙ্গীত ও দোয়া পড়ে বিদ্যালয়ের পাঠ শুরু হয়। এরপর সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত চলত একটানা ক্লাশ। মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে টিফিন খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার ক্লাশ করতেন। হাসি আনন্দ খেলার মধ্য দিয়েই বিদ্যালয়ে সব কিছু শেখেন তিনি। পড়ালেখা ছাড়াও ছিল ছবি আঁকার জন্য আলাদা ক্লাশ। আর ছবির ওপর বিভিন্ন রং বা পুঁতি বসানোর কাজ, কখনো নানান ছবির টুকরো একসঙ্গে জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা সম্পূর্ণ ছবি তৈরি করা শেখানো হতো। বেলা চারটায় বিদ্যালয় ছুটির পর বাসে চড়ে বাড়ি ফিরতেন। তিনি শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এখানেই পড়াশুনা করেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে আরবি, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু এই চার ভাষায় পড়ানো হয়। শিশু নূরীর ওপর লেখাপড়ার প্রচণ্ড চাপ পরায় বাবা তাঁকে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে এনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন বেলতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন।
পঞ্চম শ্রেণিতে আবার আগের বিদ্যালয়েই ভর্তি হন অর্থাত্ সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে। তখন বিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ১৭ নং লর্ড সিনহা রোডের তিনতলা ভবনে। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর কিশোরী নূরী বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। ক্লাশে নাইটিংগেল, মাদামকুরি ইত্যাদি নামের দল ছিল। এদের কাজ ছিল শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যারা অংশগ্রহণ করবে তাদের তদারকি করা। এখানে নূরী অংশগ্রহণ করেন। পড়ালেখার সঙ্গে সঙ্গে গানবাজনা, নাটক, রান্না, সেলাই, ছবি আকাঁ, খেলাধূলা সবকিছুতেই অংশ নেন। অষ্টম শ্রেণি থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত তিনি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করেন। তিনি ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর আই এ ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে। তাঁর আই এ তে পড়ার বিষয় ছিল দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল। এসময় তাঁর সহপাঠীরা মিলে (সাবেরা আহসান ডলি, রোকেয়া রহমান কবির, সেবতি সরকার, জ্যোত্স্না দাশগুপ্ত, বিজলি নাগ, কামেলা খান মজলিশ, হোসনে আরা রশীদ, হাজেরা মাহমুদ, জাহানারা ইমাম) একটি সাংস্কৃতিক দল তৈরি করেন। তিনি কলেজে কবিতা আবৃত্তি, নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখে, অভিনয়ের মাধ্যমে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। ‘মেঘদূত’ নাটকে নাচের মাধ্যমে মেঘের গতিবিধি তুলে ধরে কৃতিত্ব্বের পরিচয় দেন। পড়াশুনার পাশাপাশি কলেজে খেলাধূলার ব্যবস্থাও ছিল। নূরজাহান বেগমের পছন্দের খেলা ছিল ব্যান্ডমিন্টন। তিনি সময় পেলেই ব্যান্ডমিন্টন খেলতেন। লেডি ব্রেবোর্ণ থেকে ১৯৪৪ সালে আই.এ. পাশ করে বি.এ.-তে ভর্তি হন। তাঁর বিষয় ছিল Ethics, Philosophy, History. লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে কলেজের সব রকম সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে তিনি স্বতম্ফুর্ত অংশগ্রহণ করে কৃতিত্ব্বের পরিচয় দেন। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৬ সালে কৃতিত্ব্বের সঙ্গে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। নূরজাহান বেগম শৈশবেই বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কাছে সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ নেন। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষ হবার এক বছর আগে ১৯৪৫ সালে বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য সওগাত পত্রিকা অফিসে বসতে শুরু করেন। পরীক্ষা শেষ হলে তিনি সওগাত পত্রিকার সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করেন।
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ১৯২৭ সালে মাসিক সওগাত-এ ‘জানানা মহল’ নামে প্রথম মহিলাদের জন্য একটি বিভাগ চালু করেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমান মেয়েরা বিভাগটি টিকিয়ে রাখতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেননি। মেয়েদের এগিয়ে না আসার কারণে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সিদ্ধান্ত নেন মেয়েদের লেখা দিয়ে বছরে একবার সওগাত এর একটি সংখ্যা বের করবেন। এরই প্রেক্ষাপটে তিনি মেয়েদের ছবি দিয়ে ১৯২৯ সালে মহিলা সংখ্যা সওগাত প্রকাশ করেন। এই সংখ্যাটি বের করতে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন অন্দরমহলের নারীদের কাছ থেকে লেখা ও ছবি সংগ্রহ করতেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সওগাত মহিলা সংখ্যা বছরে মাত্র একটা করে প্রকাশ করা হয়। এসব প্রকাশনার সঙ্গে নূরজাহান বেগম সবসময়ই বাবার পাশে থেকেছেন। কবি সুফিয়া কামালও মহিলা সংখ্যা সওগাত-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর কার্যালয় ছিল কলকাতার ১২ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িতে। আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ‘বেগম’-এর প্রচ্ছদে মহিলার ছবি ছাপা হবে। সেই মোতাবেক প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ছবি ছাপা হয়। ‘বেগম’-এর প্রধান সম্পাদক হন বেগম সুফিয়া কামাল এবং নূরজাহান বেগম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব্ব পালন করেন। তবে বেগম সুফিয়া কামালের নাম থাকলেও নূরজাহান বেগমই এর দেখাশুনা করতেন। ‘বেগম’ পত্রিকায় মূল বিষয়গুলো স্থান পায়। যেমন- নারী জাগরণ, কুসংস্কার বিলোপ, গ্রামে-গঞ্জের নির্যাতিত মহিলাদের চিত্র, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ থেকে লেখা চিঠি এবং মণীষীদের জ্ঞানগর্ভ বাণী। ‘সওগাত’ পত্রিকা অফিসে বসে নূরজাহান বেগম ‘বেগম’ পত্রিকার কাজ করতেন। বেগম সুফিয়া কামাল মাঝে মধ্যে ‘বেগম’ পত্রিকা অফিসে এসে দু-একটা লেখা সংগ্রহ করে দিয়ে যেতেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না থাকায় লেখা সংগ্রহ করাও ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। ঘরে বসেই ফোনের মাধ্যমে লেখা সংগ্রহ করতে হতো। প্রথমে ভেবেছিলেন হিন্দু-মুসলমান লেখিকাদের মিলিত প্রয়াসে পত্রিকাটি চালাবেন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হিন্দু লেখিকাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এদিকে পত্রিকায় প্রতি সংখ্যায় বিভাগ অনুযায়ী একাধিক নিবন্ধ, প্রবন্ধ, প্রতিবেদন দরকার। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন নূরজাহান বেগমকে বিভিন্ন ইংরেজি পত্র-পত্রিকা থেকে প্রতিবেদনগুলো অনুবাদ করে ছাপানোর পরামর্শ দেন। এরপর তিনি ইংরেজি পত্রিকার প্রতিবেদনগুলো নিজেদের প্রয়োজনমতো সহজ সরল ভাষায় অনুবাদ করে বেগম পত্রিকায় প্রকাশ করতে লাগলেন। এতে লেখা সংগ্রহের সমস্যা কিছুটা হলেও নিরসন হলো।
এসময় নূরজাহান বেগম লেখিকা মোতাহেরা বানুর দুই কন্যা তাহমিনা বানু ও নাসিমা বানুকে বেগম পত্রিকায় কাজ করার জন্য ডেকে পাঠান। তখন তারা পড়াশুনা শেষ করে ঘরে বসে আছেন। নূরজাহান বেগমের আহবানে দু’বোন বেগম পত্রিকায় যোগদান করেন। এবার বিশেষ বিষয়গুলো তিনজন মিলে ভাগ করে নেন। নূরজাহান বেগম ‘বেগম’ পত্রিকার দায়িত্ব্ব পেলেও বাবার তত্ত্বাবধানেই পত্রিকাটি পরিচালনা করতেন। কোন লেখার সঙ্গে কোন ছবি যাবে, কিভাবে লেখাটি সাজাবেন এসব বিষয়ের সমস্ত সিদ্ধান্ত তিনি বাবার কাছ থেকে জেনে নিতেন। বাবার নির্দেশ ছাড়া তিনি কোনো সিদ্ধান্তই নিতেন না।
বেগম প্রকাশের প্রথম দিকে প্রতিটি সংখ্যা প্রকাশ করতে নূরজাহান বেগমকে খুবই পরিশ্রম করতে হয়। লেখিকার সংখ্যা কম, কবিতা নেই বললেই চলে, ছোট গল্প, উপন্যাস তো নেইই। এদিকে পত্রিকায় মহিলাদের ছবি তোলা এবং ছাপাতেও অনেক ঝামেলা। মহিলা ফটোগ্রাফার নেই। ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের ছবি সংগ্রহ করতে হয়। সেখানেও সমস্যা, নূরজাহান বেগম একা গেলে ছবি পান না। একারণে তাঁর সঙ্গে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকেও যেতে হয়। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে দেখে মেয়েরা সহজেই ছবি দিয়ে দেয়। এসব ছবি পত্রিকায় ছাপানো অনেক ঝামেলা। ছবি ব্লক দিয়ে করাও অনেক কষ্ট। সংগ্রহকৃত ছবি এবং দেশী বিদেশী পত্রিকা থেকে ছবি সংগ্রহ করে তিনি বেগম পত্রিকার কাজ চালিয়ে যান। এভাবেই নানা অসুবিধা প্রতিকূলতার মাঝে তিনি কলকাতা থেকে দীর্ঘ তিন বছর ‘বেগম’ প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। ১৯৪৭ সালে বেগম সুফিয়া কামাল কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাত্ ঢাকায় চলে আসার পর থেকে নূরজাহান বেগম ‘বেগম’-এর সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৪৮ সালে তিনি কলকাতায় প্রথম ‘ঈদ সংখ্যা বেগম’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা চরমে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের কোনো যোগাযোগ নেই। ফলে লেখিকাদের লেখা সংগ্রহ করা ভীষণ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি অনেক কষ্ট করে লেখা সংগ্রহ করে ‘ঈদ সংখ্যা বেগম’ প্রকাশ করেন। ১৯৪৯ সালে ‘বিশ্ব নবী সংখ্যা বেগম’ প্রকাশ করেন। এদিকে কলকাতার পরিবেশ ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক জটিলতার কারণে কলকাতায় মুসলমানদের জন্য নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সপরিবারে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকায় এসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন কোথাও একজায়গায় বাড়ি এবং প্রেস পেলেন না। পরে খবর পেলেন ঢাকার বিজয়া প্রেসের মালিক বিজয় চন্দ্র বসু তাঁর প্রেস কলকাতার কোনো প্রেসের সঙ্গে বদল করতে চান। সেই মোতাবেক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ঢাকায় এসে ৬৬ লয়াল স্ট্রীটের বিজয়া প্রেস দেখেন এবং সেই সঙ্গে ৩৮ নম্বর শরত্গুপ্ত রোডের বসত বাড়িটিও পছন্দ করেন। এবার পাকাপাকিভাবে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫০ সালে তাঁরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ‘বেগম’ পত্রিকার বয়স তখন মাত্র তিন বছর ছয় মাস। বুড়িগঙ্গার কাছে লয়াল স্ট্রীটের প্রেসটি ছিল চারদিকে খোলামেলা। তখন বিদ্যুত্ও ছিল না কিন্তু বুড়িগঙ্গা নদীর বাতাস ছিল। ঢাকায় এসে নূরজাহান বেগম ৩৮ নং শরত্গুপ্ত রোডের বাড়িতেই ‘বেগম’-এর কাজকর্ম দেখাশোনা শুরু করেন। এখানেই ‘বেগম’ পত্রিকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে বহু কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকের সমাগম ঘটে। এসময় ঢাকার মেয়েরাও লেখালেখিতে তেমন এগিয়ে আসেনি। মহিলা লেখিকাদের কাছ থেকে যে লেখাগুলো পাওয়া যেত তা একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিচালনা করার মতো যথেষ্ট ছিল না। ফলে আগের মতোই বিদেশী পত্রিকা থেকে অনুবাদ করে বিভিন্ন বিভাগ প্রকাশ করতে থাকেন। এরপর তিনি বাবার উদ্যোগে ১৯৫১ সালে ‘ঈদ সংখ্যা বেগম’ প্রকাশ করেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ‘বেগম’ পত্রিকা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের জন্য তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। তিনি বাবার সঙ্গে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে আনতেন।
নূরজাহান বেগম নানা প্রতিকূলতার মাঝে ধীরে ধীরে ‘বেগম’ পত্রিকা নিয়ে অগ্রসর হন। এসময় সাহিত্য কর্মে মুসলমান নারী সমাজও অংশগ্রহণ শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে সারা বাংলাদেশে ‘বেগম’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মহিলা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। নূরজাহান বেগমের অক্লান্ত পরিশ্রম, আন্তরিকতা, কর্মনিষ্ঠা এবং মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বেগম’ দ্রুত মহিলাদের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। ‘বেগম’-এ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নিবন্ধের পাশাপাশি রান্না, সেলাই, সৌন্দর্য চর্চা, শিশু বিভাগ প্রভৃতি প্রকাশিত হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মেয়েরাও ‘বেগম’ পত্রিকার লেখকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ছবিসহ লেখা ছাপানোর ব্যবস্থা থাকায় ঈদসংখ্যা ‘বেগম’-এ লেখিকাদের অংশগ্রহণ বিপুলভাবে বেড়ে যায়। ঈদ সংখ্যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় অনেক পুরুষ পাঠক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই বাংলার মানুষ প্রথম অবহিত হন, সাহিত্য ক্ষেত্রে মুসলমান মেয়েদের পদচারণা শুরু হয়েছে।
১৯৫৪ সালে প্রখ্যাত মার্কিন মহিলা সাংবাদিক সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী মিসেস আইদা আলসেথ ঢাকায় আসেন। একদিন তিনি ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পরিদর্শনে আসেন। তাঁর আগমন উপলক্ষে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও নূরজাহান বেগম কয়েকজন মহিলা কবি সাহিত্যিকদের বেগম অফিসে আমন্ত্রণ জানান। মিসেস আইদা আলসেথের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়। তিনি ‘বেগম’ পত্রিকার বিভিন্ন শাখা ঘুরে ঘুরে দেখেন এবং আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলাদের অনেক মাসিক পত্রিকা বের হয় কিন্তু মহিলাদের জন্য কোনো সাপ্তাহিক সাময়িকী এখনও প্রকাশিত হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমেরিকার নারী সমাজ যথেষ্ট বাধা বিপত্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে বর্তমান উন্নত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।’ তিনি সেখানকার মহিলাদের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরে পূর্ব পাকিস্তানেও এধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আহ্বান জানান। সে সঙ্গে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও নূরজাহান বেগমকে এমন একটি মহিলা ক্লাব গঠনের পরামর্শ দেন। যার মাধ্যমে মেয়েরা একসঙ্গে বসে মত বিনিময় করতে পারবে, নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে পারবে। তাঁর এই পরামর্শ এবং উত্সাহে উত্সাহিত হয়ে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ এবং কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে ক্লাব গঠন নিয়ে আলোচনায় বসেন। তাঁরা দু’জনেই ক্লাব কাব গঠনের পক্ষে রায় দেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বেগম ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ এবং সেক্রেটারি হন নূরজাহান বেগম। বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা। বেগম ক্লাবে কোনো কার্যনির্বাহী সদস্য করা হয়নি কারণ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন নিজেই অনুষ্ঠানের সব খরচ বহন করেছিলেন। বেগম ক্লাব-এর উদ্বোধন উপলক্ষে এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বহু মহিলা কবি সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীর সমাগম হয়। অল্প সংখ্যক সদস্য নিয়ে ক্লাবের উদ্বোধন হলেও প্রাথমিক সদস্য সংখ্যা ছিল ৬৪। বেগম ক্লাবের প্রাথমিক সদস্যবৃন্দ হলেন, বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ (প্রেসিডেন্ট), নূরজাহান বেগম (সেক্রেটারি), বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম মীজানুর রহমান, ড. সৈয়দা ফাতেমা সাদেক, কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, অধ্যাপিকা হামিদা খানম, মিসেস মহসীনা আলী, সাঈদা খানম, কবি হোসনে আরা মোদাব্বের, হুসনা বানু খানম, লুলু বিলকিস বানু, মালেকা পারভীন বানু, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, মিসেস সারা তৈফুর, মিসেস জাকিয়া রশীদ, মিসেস মাজেদা খাতুন, মিসেস সারা খাতুন, বেগম আব্বাসউদ্দীন আহমদ, জাহানারা আরজু, মিসেস এস. এ. মজিদ, মোমতাজ বেগম বি.এ, মিসেস শাহজাদী বেগম, বেগম রোকেয়া আলী রেজা, মিসেস মাজেদা আলী, মিসেস সুফিয়া রহমান, মিসেস লায়লা সামাদ, মিস লিলি খান, বেগম আফিফা হক, মিসেস সুফিয়া খানম, মিসেস খাতুন সুফিয়া, বেগম আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, মিসেস বদরুন্নেসা আহমদ, মিসেস সালেহা খান, মিসেস এন মজিদ, মিসেস সালমা রহমান, মিসেস মাহে মুনির আহমদ, মিসেস হান্না রহমান, মিসেস কুলসুম মজিদ, মিসেস আনোয়ারা চৌধুরী, অধ্যাপিকা খোদেজা খাতুন, মিসেস সাবেরা সাইদ, মিসেস বি.এ. খান, মিসেস আকিকুননেসা আহমদ, মিসেস ফাতেমা লোহানী, মিসেস সালেমা খাতুন, মিস তবা খানম, মিসেস নমিতা আনোয়ার, মিস সাফিয়া খাতুন, নীলুফার বেগম, মিসেস জাহানারা করিম, মিসেস রোকেয়া আনোয়ার, খালেদা ফ্যান্সি খানম, মিসেস সুলতানা ইসলাম, মিসেস মরিয়ম রশীদ, মিসেস নূরজাহান মোর্শেদ, মিসেস মাফরুহা চৌধুরী, মিসেস লতিফা হিলালী, কাজী লতিফা হক, মিসেস হোসনে আরা রশীদ, মিসেস নার্গিস জাফর, মিসেস মেহেরুনন্নেসা ইসলাম, মিস সেলিনা বাহার চৌধুরী ও আমিনা মাহমুদ।
প্রথমে একটি টিনশেডের ঘরে বেগম ক্লাবের কাজ শুরু হয়। তখন এর আসন সংখ্যা ছিল পঁচাত্তর থেকে আশি জনের। প্রথম অবস্থায় বেগম ক্লাবে শুধুমাত্র সাহিত্য বা অন্য নানা বিষয় আলোচনা চললেও পরবর্তীতে এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। নূরজাহান বেগম নিজেই সঙ্গীত শিল্পী হুসনা বানু ও লায়লা আর্জুমান্দ বানুকে সাংস্কৃতিক বিভাগের দায়িত্ব দেন। তাঁদের আন্তরিকতায় অন্যান্য নারী শিল্পীদের অভিভাবকরাও বেগম ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেয়েদের আসতে বাধা দিতেন না। দেশের বরেণ্য সমাজকর্মী ও শিল্পীরাও নিজ উত্সাহে বেগম ক্লাবে যোগ দেন। সেই সঙ্গে যোগ দেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যা রাজিয়া বানু, আশালতা সেন, দৌলতুন নেসা সহ আরো অনেকে। সর্বদলীয় মহিলারা স্বেচ্ছায় বেগম ক্লাবে এসে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। এই সংবাদ দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হলে চারদিকে বেশ সাড়া পড়ে যায়। এদিকে ঢাকায় যেসব বিদেশী মহিলা প্রতিনিধিরা আসেন তাদেরকেও বেগম ক্লাবের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এর কারণ বিদেশ থেকে মহিলা প্রতিনিধিরা ঢাকায় আসামাত্র সরকারি তথ্য বিভাগ থেকে নূরজাহান বেগমকে সংবাদ দেন তাঁদের বেগম ক্লাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নূরজাহান বেগম সানন্দে তাঁদের বেগম ক্লাবের আসার আমন্ত্রণ জানান। সুশৃঙ্খল ও সুন্দর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁদের সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়। এ ধরণের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহিলারা নিজেদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পথ খুঁজে পায়। এভাবে বেগম ক্লাব ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পি.এন. বা আন্তর্জাতিক লেখক সংঘের মহিলা প্রতিনিধি দল, ১৬ নভেম্বর হল্যান্ডস্থ পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত এবং নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাত্রী বেগম রানা লিয়াকত আলী খান, ৩ ডিসেম্বর গণচীনের মহিলা প্রতিনিধি দল, ১৯৫৬ সালের ১০ মার্চ শান্তিনিকেতনের শিল্পীবৃন্দ, ১৯৫৬ সালের ৯ এপ্রিল দশ সদস্যা বিশিষ্ট ইন্দোনেশীয় মহিলা প্রতিনিধি দলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানগুলোতে বেগম ক্লাবের সদস্যারাও অংশগ্রহণ করেন। বেগম কাবের মহিলা সদস্যরা যাতে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে পারে সেদিকটাও নজর দেওয়া হয়। সেই মোতাবেক এখানে একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়। লাইব্রেরীতে অনেক মহিলা এসে বই পড়া শুরু করেন। এতে বেগম ক্লাবের সুনাম আরো ছড়িয়ে পড়ে। নূরজাহান বেগমের অক্লান্ত পরিশ্রম, উদ্যম, নিষ্ঠা এবং দক্ষতায় বেগম ক্লাবের উন্নয়নের দিকে ধাবিত হলেও ষাটের দশকে এসে এর কর্মকাণ্ড ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে। ১৯৬৯ এর অসহযোগ আন্দোলনের পর বেগম ক্লাবের কর্মকাণ্ড একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
বেগম ক্লাব বন্ধ হয়ে গেলেও বেগম পত্রিকাটি কৃতিত্বের সঙ্গে চালু রেখেছেন নূরজাহান বেগম। ৬৬ লয়াল স্ট্রিটের বেগম অফিসের নিজস্ব কক্ষে বসে তিনি সম্পাদনার কাজ করে গেছেন।
নূরজাহান বেগমের পারিবারিক জীবন ছিল খুবই সুখের এবং আনন্দময়। প্রগতিশীল, উদারচেতা, সংস্কারমুক্ত বাবার স্নেহের ছায়ায় বেড়ে ওঠায় তাঁর চিন্তা ভাবনায়ও এর প্রতিফলন ঘটে। মা ফাতেমা খাতুনের নিত্য সাহচর্য, চিন্তাচেতনা, জীবনবোধ তাঁর ওপর প্রভাব ফেলে। একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে তিনি সবসময় মায়ের ছত্রছায়ায় থেকেছেন। বেগম পত্রিকার মাধ্যমেই রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এরপর ১৯৫২ সালে রোকনুজ্জামান খানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। স্বামীর উত্সাহ এবং সহযোগিতায় নূরজাহান বেগম কাজের গতিও বাড়িয়ে দেন। কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি ধাপে তিনি সবসময় বাবা ও স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন। তাঁর বড় কন্যা ফ্লোরা নাসরীন খান শাখী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অর্নাসসহ মার্স্টাস পাশ করেছেন। তাঁর বড় জামাতার নাম ড. ফজলুর রহমান খান। নাতির নাম গৌরব রহমান খান এবং নাতনীর নাম মুনিয়া খান। ছোট কন্যা রীনা ইয়াসমিন খান মিতি। ছোট জামাতার নাম ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ। দুই নাতনীর নাম সাবিত ফারিজমা ইফতেখার হৈমী ও প্রিয়তা ইফতেখার। ১৯৯৪ সালের ২১ মে বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন মারা যান। এর পাঁচ বছর পর ১৯৯৯ সালে মাও মারা যান। আপনজনের মৃত্যুতে নূরজাহান বেগম দিশেহারা হয়ে পড়েন। এরপর ১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্বর স্বামী রোকনুজ্জামান খান হঠাত্ অসুস্থ অনুভব করেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরই তিনি মারা যান।
ক্ষেত্র ভিত্তিক অবদান লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে পড়া শেষ করেই নূরজাহান বেগম বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কমতি ছিল না। প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুল রশীদের স্ত্রী জেরিনা রশীদের অনুপ্রেরণায় নূরজাহান বেগম সমাজসেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে খোলা একটি রিফ্যুজি ক্যাম্পের কাজের মাধ্যমেই তাঁর সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের যাত্রা শুরু হয়। তিনি রিফ্যুজি ক্যাম্পে দাঙ্গা বিধস্ত নারী ও শিশুদের সেবা করেন। এমনকি মহিলাদের প্রসবের সময়ে নূরজাহান বেগম ডাক্তারদের সঙ্গেও কাজ করেন। এসময়ে ‘মুসলিম অরফ্যানেজ ও উইমেনস হোম’ নামে একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হয়। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হন জেরিনা রশীদ আর সেক্রেটারি নূরজাহান বেগম। এর কাজ শুরু হয় কলকাতার দরগাহ রোডের বিশাল এক জমিদার বাড়িতে। সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে, সরকারী অনুদান, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও জেরিনা রশীদের আর্থিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হতে থাকে। এছাড়া দুস্থদের সাহায্যের জন্য নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকেন তাঁরা। ওয়াই ডব্লিউ সিএ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। এই নাটকটির পরিচালনার দায়িত্ব্ব পান নূরজাহান বেগম এবং রোকেয়া রহমান কবির। নাটক মঞ্চস্থ করে চাঁদা ওঠে একহাজার টাকা। এই টাকা থেকে ২৫০ টাকা তিনি কবি পত্নীর চিকিত্সার জন্য প্রমীলা নজরুলের হাতে তুলে দেন। ঢাকায় এসে তিনি প্রথমে ওয়ারী মহিলা সমিতিতে কাজ শুরু করেন। তিনি নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি এবং পরে গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সক্রিয়ভাবে সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হন। ১৯৫০ সালে বদরুনন্নেসা আহমদ ও আশালতা সেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরা তাঁকে সমাজসেবা কাজে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৫৬ সালে নূরজাহান বেগম নারিন্দা মহিলা সমিতি গঠন করেন। এই সমিতির প্রথম প্রেসিডেন্ট হন দৌলতুননেসা খাতুন। তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলে নূরজাহান বেগম এই পদে অধিষ্ঠিত হন। নারিন্দা মহিলা সমিতির মাধ্যমে তিনি প্রাইমারী বিদ্যালয় পরিচালনা, শিশুদের জন্য গঠনমূলক কর্মকাণ্ড, বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে করেন। দেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে তিনি নারিন্দা মহিলা সমিতি ও কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার পক্ষ থেকে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে কাজ করেন। ঢাকার ইসলামপুরের দোকান থেকে থান কাপড় সংগ্রহ করে পোষাক তৈরি করে তা সমিতির ছয়জন মহিলাকে দিয়ে চট্রগ্রামে ত্রাণকেন্দ্রে পাঠান। এভাবে তিনি আজীবন মানুষের সেবায় কাজ করে গেছেন। এছাড়াও তিনি আপওয়া, জোনটা ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ, মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সদস্যরূপে সমাজসেবা করেছেন।
বেগম সুফিয়া কামালের সম্পাদনা এবং নূরজাহান বেগমের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদনায় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই মেয়েদের প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক ‘বেগম’ প্রকাশনা শুরু হয়। প্রকাশনার শুরুতে ‘বেগম’-এর কার্যালয় ছিল ১২ নং ওয়েলেসলী স্ট্রিট, কলিকাতা। এর দাম ছিল প্রতি সংখ্যা চার আনা, বার্ষিক মূল্য ১২ টাকা। ‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা লেখালেখি চর্চায় প্রথম উত্সাহিত হন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এবং নূরজাহান বেগম সেই ব্যক্তি যাঁদের অনুপ্রেরণায় সামাজিক কুসংস্কারকে দূরে ঠেলে মেয়েরা এগিয়ে এসেছিলেন। এই মেয়েদের লেখা দিয়ে ‘বেগম’ পত্রিকা প্রকাশ সম্ভব হয়েছিল।
তিনি ১৯৪৮ সালে কলকাতায় প্রথম ‘ঈদ সংখ্যা বেগম’ প্রকাশ করেন। বেগমের প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সালের ২৫ জুলাই পর্যন্ত ৪৭শ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই এক বছরে বেগমে ৫১টি গল্প ছাপা হয়। তেরজন মহিলা কবি কবিতা লেখেন। বেগম ঈদ সংখ্যায় ৬২ জন মহিলা লেখকের লেখা ছাপা হয়। সে সঙ্গে মহিলাদের ছবি ছাপা হয় ইমিটেশন আর্ট পেপারে। এই সংখ্যায় ৬২টি বিজ্ঞাপন সংস্থা বিজ্ঞাপন দেয়। এর মূল্য ছিল ২ টাকা। ২য় বর্ষে বেগমের ৪৫শ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যাগুলোতে ২৬ জন লেখিকা গল্প লেখেন। দ্বিতীয় বর্ষে ৪২টি গল্প এবং ২৭টি কবিতা ছাপা হয়। ধর্ম সম্পর্কে মহিলাদের জ্ঞান লাভের জন্য ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয় বেগম বিশ্বনবী সংখ্যা। এই সংখ্যায় ২৪টি প্রবন্ধ, ৪টি কবিতা, ২টি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। ১৯৪৯ সালে বের হয় দ্বিতীয় ঈদ সংখ্যা ‘বেগম’। এই সংখ্যার কভার ছিল মোটা হোয়াইট প্রিন্টিং-এ। বিজ্ঞাপন ছিল নিউজ প্রিন্টে। লেখিকাদের ছবি ছাপা হয় ম্যাকানিক পেপারে, সাইজ ছিল ডিমাই ১/৪, মূল্য ২ টাকা। এতে ৬৩টি প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয়। ১৪ আগষ্ট ১৯৪৯ সালে কলকাতা থেকে বেগম তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা বের হয়। এ বছর মহিলা লেখিকাদের লেখা ২৩ টি গল্প প্রকাশিত হয়। এসময় ২০৭ নং পার্ক স্ট্রিটের নিজস্ব ভবনে বেগম অফিস ও সওগাত প্রেস ছিল। এদিকে দিনের পর দিন দেশের রাজনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে। পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে পূর্ব বঙ্গের যোগাযোগও বন্ধ। নানা প্রতিকূলতার কারণে লেখিকাদের লেখা সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দু’সপ্তাহের জন্য বেগম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঢাকা থেকে ১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর বেগম ৪র্থ বর্ষ: ১ম সংখ্যা বের হয়। ৪র্থ বর্ষে ৪৮শ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এ বছর মহিলাদের ৩৮টি গল্প এবং ৩৮টি কবিতা প্রকাশ হয়। পত্রিকার সাইজ ছিল ডবল ক্রাউন। বার্ষিক মূল্য ছিল ১২ টাকা, প্রতি সংখ্যা চার আনা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ‘বেগম’ পত্রিকাকে ধীরে ধীরে অন্তপুরের মেয়েদের মাঝে পৌঁছে দেওয়া। নূরজাহান বেগমের দূরদর্শীতায় মুসলমান নারী সমাজ ধীরে ধীরে বেগমে লিখতে শুরু করে। গ্রামাঞ্চলের মেয়েরাও ‘বেগম’-এ লিখতে শুরু করে। ফলে সারা বাংলাদেশে একমাত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে বেগম জনপ্রিয়তা পায়। আজও বেগমের সেই ধারা অক্ষুন্ন আছে।
নূরজাহান বেগম ২০১৬ সালের ২৩ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তথ্য সূত্র :
• তোমারি কথা বলবো রায়হানা হোসেন- কাজী মদিনা
প্রকাশক- জনান্তিকা, ৫০, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা- ১০০০।
প্রকাশকাল: ২০ জুলাই ২০০৩। • চারবেলা চারদিক ( সাপ্তাহিক পত্রিকা )।
• দৈনিক যুগান্তর ( সুরঞ্জনা ) , ৩০ অক্টোবর ২০০২।
• দৈনিক ইত্তেফাক ( মহিলা অঙ্গন ), ৪ ডিসেম্বর ২০০০।
• দৈনিক জনকন্ঠ ( অপরাজিতা ), ১ জুন ১৯৯৯।
• প্রথম আলো ( ছুটির দিনে ), ২৩ জুলাই ২০০৫।
• সাক্ষাত্কার – নূরজাহান বেগম তারিখ: ১৭.০৯.২০০৫, ০৮.১১.০৫। অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার ১৪০৯ নূরজাহান বেগম। • মাকু ( পাক্ষিক পত্রিকা ), ৫ অক্টোবর ১৯৯৭। বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ
লেখক : রীতা ভৌমিক