১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি দিকের ঘটনা। পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা আইয়ুব খান তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এদেশে তাঁর খাস চেলা ছিল মোনায়েম খাঁ। মানিক মিয়ার পত্রিকায় যেহেতু বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের খবর থাকে ফলে এই দু’জনই নাখোশ ছিলেন তাঁর উপর। তখন বাঙালিদের সবচেয়ে প্রিয় কাগজ ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু মানিক মিয়ার তাতে ‘কুচ পরোয়া নেহি’। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক নিয়ে যেমন পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন ঠিক তেমনি পত্রিকা ছাড়াও বেশ ভালভাবেই লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এরমধ্যেই একদিন মোনেম খাঁ ঘোষণা দেন, মানিক মিয়াকে ঢাকা শহরে খড়ম পা দিয়ে হাটিয়ে তবেই ছাড়বেন। মানিক মিয়া উত্তেজিত না হয়েই এর জবাব দিলেন। তিনি মোনেম খাঁর জবাবে বললেন, খড়ম পায়ে হাঁটা তার বরাবরের অভ্যাস। সুতরাং জুতা ছাড়া খড়ম পায়ে হাঁটতে একটুও খারাপ লাগবে না। তিনি ভাবলেন, মূল্যবোধের লড়াইয়ে আইয়ুব খান আর মোনেম খাঁকে বিনা যুদ্ধে ছেড়ে দেওয়া হবে না। তাতে জীবন যায় যাবে। সেবারের এই লড়াইটা ছিল সত্যিকার অর্থেই মানিক মিয়ার জন্য বাঁচা-মরার লড়াই। আইয়ুব খান যখন বুঝে ফেললেন এইভাবে মানিক মিয়াকে বশ করা যাবে না তখন তিনি ভিন্ন পথ নিলেন। মানিক মিয়ার পিছনে লাগিয়ে দিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক জাঁদরেল ব্রিগেডিয়ারকে। সেই ব্রিগেডিয়ার নানা কায়দা-কসরত করে মানিক মিয়াকে নিয়ে গেলেন ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে। সেখানে ব্রিগেডিয়ারের অতিথি হিসেবে মানিক মিয়াকে রাজার হালে চলল আদর-আপ্যায়ন। শেষে ব্রিগেডিয়ার মানিক মিয়াকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়ার মতলব খোলাসা করেন। ব্রিগেডিয়ার সাহেব মানিক মিয়ার কাছে প্রস্তাব করেন, তিনি যেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সাথে একটিবার দেখা করেন এবং ইত্তেফাকের ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলেন। আইয়ুব খান রাজি হয়েই আছেন, শুধু মানিক মিয়া একটু দেখা করলেই হয়। এই প্রস্তাব শুনে মানিক মিয়া ইংরেজি ভাষার সর্বোচ্চ শ্ল্যাংটি ব্যবহার করে ব্রিগেডিয়ারকে ‘ফ্রিজ’ করে দেন। আইয়ুব খানের সাথে দেখা করিয়ে দেয়ার ‘ব্রিগেডিয়ার প্রকল্প’ এখানেই শেষ হয়ে যায়। মানিক মিয়া তার পরের দিনই প্লেনে চড়ে ঢাকায় ফিরে আসেন।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জন্ম ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মুসলেম উদ্দিন মিয়া। শৈশবেই মানিক মিয়ার মা মারা যান। কিন্তু পরিবারের সকলের স্নেহে তিনি সেই অভাব কখনোই অনুভব করেননি। কচা নদীর তীরের গ্রাম ভেন্ডারিয়া। নদীর সাথে সরাসরি যোগ সাগরের। সেই নদী আর সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতোই অসম সাহস নিয়ে বেড়ে ওঠেন মানিক মিয়া।
গ্রামের পূর্ব ভান্ডারিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুলে মানিক মিয়ার শিক্ষা জীবনের শুরু। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর তিনি ভর্তি হন ভেন্ডারিয়া হাই স্কুলে। স্কুল জীবন থেকেই তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তখন থেকেই তিনি ছিলেন সহচর-সহপাঠীদের কাছে ক্ষুদে নেতা। ‘উঠন্ত মূল পত্তনেই চেনা যায়’-এই প্রবাদ বাক্যটি যেন মানিক মিয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সত্য। ভান্ডারিয়া স্কুলে মানিক মিয়া অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তারপর চলে যান পিরোজপুর সরকারী হাই স্কুলে। সেখান থেকেই তিনি কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৫ সালে মানিক মিয়া ডিস্টিংশন সহ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
পড়াশোনা শেষ করে মানিক মিয়া পিরোজপুর সিভিল কোর্টে চাকুরিতে যোগদান করেন। আগে থেকেই তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন মানুষ। নিজের ভিতরে ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান। চাকরি করার সময় তিনি একবার বরিশালে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান। সারা ব্রিটিশ ভারত জুড়ে তখন চলছে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন। সোহরাওয়ার্দীর সাথে পরিচিত হয়ে মানিক মিয়া মুগ্ধ হন। সোহরাওয়ার্দীও মানিক মিয়ার বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা, চিন্তাধারা, বিচক্ষণতা দেখে কাছে টেনে নেন। এভাবেই সোহরাওয়ার্দী-মানিক মিয়ার সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে গাঢ় হতে থাকে। এক পর্যায়ে তা রাজনৈতিক কারণেই আরো গভীরতর হয়। এই সম্পর্ক আজীবন অটুট ছিল দু’জনের মধ্যে।
পিরোজপুর সিভিল কোর্টে চাকরি করার সময় মানিক মিয়া কিন্তু আর দশজন চাকুরিজীবির মতো ছিলেন না। বইপত্রের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল নেশা, শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর ছিল নিত্য যাতায়াত, বিষয়-আশয়ের প্রতি যেন একটু বেশিই উদাসীন। এরই মধ্যে পত্রিকার পাতায় লক্ষ্য রাখতেন রাজনৈতিক গতিবিধি সম্পর্কে। একটু বেশিই কৌতুহলী ছিলেন যুব সম্প্রদায়ের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন আর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির রাজনীতির প্রতি। ফলে ভিন্নমাত্রার মানিক মিয়া নিজের আত্মসম্মানবোধ বজায় রেখেই জীবন-যাপন করতেন। ফলে এর জন্য চাকুরি স্থলে নানা ঝামেলায় পড়তে হত। কিন্তু তিনি কখনোই নিজের দৃঢ় অবস্থান থেকে সরে যেতেন না। একবার কোর্টের জনৈক মুন্সেফ একদিন তাঁর সাথে অবমাননাকর আচরণ করেন। মানিক মিয়া এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করে চাকুরি থেকে ইস্তফা দেন। তিনি কখনোই অন্যায়ের সাথে আপোষ করতেন না। মানিক মিয়ার এহেন আচরণে অনুতপ্ত হন মুন্সেফ। তিনি পরে মানিক মিয়ার চাচা অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দিন সাহেবের সহযোগিতায় তাঁকে পুনরায় চাকুরিতে ফিরিয়ে আনেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের কারণেই মানিক মিয়া তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় পিরোজপুর সিভিল কোর্টের চাকুরি ছেড়ে দেন। যোগদান করেন তদানীন্তন বাংলা সরকারের জনসংযোগ বিভাগে বরিশালের জেলা সংযোগ অফিসার হিসেবে। কিছুকাল সেখানে কাজ করার পর তিনি সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে সেই চাকুরিতেও ইস্তফা দেন। তখন সোহরাওয়ার্দীই মানিক মিয়াকে কলকাতার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেন। মানিক মিয়া কলকাতায় গিয়ে বেশ ভালভাবেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন।
এই সময়টি ছিল মানিক মিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময়েই তিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী নেতৃবৃন্দের সাথে গভীরভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান। আগে থেকেই তিনি নিজে যেহেতু ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন ফলে কর্মক্ষেত্রে তিনি বেশ সফলতার সাথে কাজ চালিয়ে যান। এসময় তাঁর নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শও একটি বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। তিনি যেহেতু ছিলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বিশেষ স্নেহধন্য ফলে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব মানিক মিয়ার উপর থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। বস্তুত কলকাতায় মানিক মিয়া সোহরাওয়ার্দী সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
রাজনৈতিক প্রচারকে জনগণের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে পার্টির নিজস্ব প্রচারপত্র প্রয়োজন। এই চিন্তা থেকেই মানিক মিয়ার উদ্যোগে ১৯৪৬ সালে আবুল মনসুর আহমেদের সম্পাদনায় বের হয় ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’। ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ তখন পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালায়। বাঙালি মুসলমানের স্বার্থ রক্ষাকারী একটি পত্রিকা হিসেবে জনগণের কাছে এটি গ্রহণ যোগ্যতা পায়। এর পিছনে মানিক মিয়ার কৃতিত্ব ছিল অসামান্য।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হয়। পাকিস্তানের দুই অংশ-পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবধান ছিল বারোশ মাইলের। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন এ নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। মুখ্য মন্ত্রীত্বের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হেরে যান। মানিক মিয়া তখন সোহরাওয়ার্দীর পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। ফলে তাঁর প্রতিপক্ষরা এতে মানিক মিয়ার প্রতি বিরাগ হন। কিন্তু এ অবস্থায় মানিক মিয়া কোনো কাজেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ফলে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারির পদটি ছেড়ে দেন। যোগ দেন ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে। ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’-এর সাথে মানিক মিয়া মাত্র দেড় বছরের মতো যুক্ত ছিলেন। এই পত্রিকার মাধ্যমেই তাঁর গণমাধ্যম জগতের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। দেশ বিভাগের পর থেকে পত্রিকাটি ঢাকায় নিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেন মানিক মিয়া। কিন্তু তিনবার পত্রিকাটিকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশে বাধা দেয়া হয় এবং এখানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বার বার এভাবে পাকিস্তানি সরকার কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন কর্তৃপক্ষ। মানিক মিয়াও তখন ঢাকায় চলে আসেন।
যে আশা ও আকাঙ্খা নিয়ে বাঙালি একদিন পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অচিরেই সেই আশা ভেস্তে যেতে থাকে। বাঙালির জাতীয় ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে ধ্বংস করে দেবার গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। প্রথম আঘাতটা আসে ভাষার ওপর। ১৯৪৮ সালেই পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নামে। এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাঙালির পাকিস্তান মোহ কিছুটা কাটতে থাকে। এ অবস্থায় ১৯৪৯ সালে মুসলীম লীগের বিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে। সেই বছরই এই রাজনৈতিক দলের মুখপত্র হিসেবে আবির্ভাব ঘটে সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’-এর। মাওলানা ভাসানী পত্রিকাটির আনুষ্ঠানিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। কিন্তু পেছন থেকে সব কাজই করতেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। অবশেষে ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে মানিক মিয়া এই পত্রিকার পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তানের শুরু থেকেই এদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির উপর চরম দমন-পীড়ন চালায়। এর প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে তখন দেশবরেণ্য অনেক নেতাকে বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে থাকতে হয়েছে। এই অবস্থায় দেশের মানুষকে আরো বেশি সত্য খবর প্রকাশের জন্য তিনি ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’কে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেন। আর তখন পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন ছিল সামনে। ফলে মানিক মিয়ার এমন প্রস্তাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁকে বেশ উৎসাহ দেন। এই অবস্থায় ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় মানিক মিয়া বের করেন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’। এবার তিনি নিজেই এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এর কিছুদিন পরেই অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী ছিলেন কায়েদে আযম জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ। সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগের ব্যাপক ভরাডুবি হয়। মুসলিম লীগের এই ভরাডুবির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও সেখানে মানিক মিয়ার ‘মোসাফির’ ছদ্মনামে লেখা ক্ষুরধার লেখনি। সেই ‘ইত্তেফাক’ কালে কালে বাঙালির মুক্তির মুখপত্রে পরিণত হয় একসময়। মানিক মিয়া সাংবাদিকতাকে কখনোই পেশা হিসেবে নেননি। তিনি একে নিয়েছিলেন জনগণের ‘খেদমতের’ অংশ হিসেবে। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘আমি আমার চিন্তাশক্তি ও কর্মদক্ষতা সর্বতোভাবে ইত্তেফাকের পিছনেই নিয়োজিত করিয়াছিলাম। সংবাদপত্রের মারফত দেশবাসীর যতটুকু খেদমত করা যায় তাহাই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য। এই দিক দিয়া আমি ‘ইত্তেফাক’কে শুধুমাত্র জীবিকা ও অর্থোপার্জনের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করি নাই। যে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে ‘ইত্তেফাক’ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, সেই জনগণের অভাব-অভিযোগ, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্খা প্রতিফলিত করাই ছিল আমার ব্রত।…কোনো প্রলোভন বা স্বার্থচিন্তা দ্বারা আমি কখনও প্ররোচিত হই নাই।”
কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র ইত্তেফাকের এই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে কখনই মেনে নিতে পারেনি। তারা বারবার আঘাত এনেছে এই পত্রিকাটি ও তার সম্পাদকের উপর। যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের পর থেকেই পাকিস্তানি শসকগোষ্ঠী যেন আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ১৯৫৫ সালেই যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে দিয়ে পাকিস্তানের শাসকেরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ৯২-ক ধারা জারি করে। এসময় অনেক রাজনৈতিক নেতাকে জেলে রাখা হয় এবং প্রথমবারের মতো ইত্তেফাকের প্রকাশনাও কিছুকাল বন্ধ রাখা হয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় একনায়কত্ব। আবার দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের উপর চালানো হয় চরম নিপীড়ন। ১৯৫৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন পর তিনি মুক্তি পান। ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হলে সারা পূর্ব পাকিস্তানে যে প্রতিবাদের ঢেউ উঠে তার প্রেক্ষিতে অনেক রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। সেইসময় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে আবার গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ছয় দফাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। আইয়ুব শাহীর চরমনীতি আরো স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। তিনি ছয় দফা যারা তৈরি করেছেন তাঁদের এবং এর প্রচারকারীদের মূলোৎপাটন করার জন্য উঠে-পড়ে লাগেন। পূর্ব পাকিস্তানে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি করা শুরু করেন। সেই সময় মানিক মিয়াকেও গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ‘নিউ নেশন প্রেস’ও বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে সরকার। আরো দু’টি পত্রিকা ‘ঢাকা টাইমস’ এবং ‘পূর্বাণী’ বন্ধ হয়ে যায়। অথচ পাকিস্তান সরকার যখন এই ঘটনাটি ঘটায় তখন মানিক মিয়া ছিলেন প্রেস কোর্ট অব অনার-এর প্রথম সেক্রেটারি।
প্রায় দশমাস কারাগারে আটক থাকার পর অসুস্থ অবস্থায় মানিক মিয়াকে ঢাকা পুলিশ হাসপাতাল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। তিনি পত্রিকা প্রকাশ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। মানিক মিয়ার সাফ জবাব, ‘ইত্তেফাক’ যদি এর ঐতিহ্য নিয়ে প্রকাশিত হতে না পারে, তবে তিনি ‘ইত্তেফাক’ প্রকাশনায় আগ্রহী নন। অবশেষে ‘৬৯-এর গণঅভ্যূত্থানের মুখে পাকিস্তান সরকার ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার প্রেস মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়। তিনি দীর্ঘ দু’বছর সাত মাস পর ১৯৬৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আবার ‘ইত্তেফাক’ সহ তিনটি পত্রিকা পুনঃপ্রকাশ করেন।
দীর্ঘ সংগ্রামের পর এই সময় এসে মানিক মিয়া কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়ে। এই অবস্থাতেই তিনি আবার ‘ইত্তেফাক’-এর জন্য লেখনি ধারণ করেন। ১৯৬৯ সালে ২৬ মে এই ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক কাজে রাওয়ালপিন্ডি যান। সেখানেই ১ জুন রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া পিরোজপুর সিভিল কোর্টে কর্মরত থাকাবস্থায় ১৯৩৭ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার অন্তর্গত গোয়ালদি গ্রামের অভিজাত পরিবারের মরহুম খোন্দকার আবুল হাসান সাহেবের কন্যা মাজেদা বেগমের সাথে বিাবহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। পরিবারের সদস্যরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ১৯৬৩ সালে আন্তর্জাতিক প্রেস ইন্সস্টিটিউটের পাকিস্তান শাখার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি কিছুকাল পাকিস্তান প্রেস অব অনার-এর সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। প্রায় দুই বছর তিনি পিআইএ-র ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন।
তথ্যসূত্র: এই লেখাটি তৈরির জন্য তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ‘পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর’ গ্রন্থটির সাহায্য নেয়া হয়েছে। যা ১৯৮৮ সালে ইত্তেফাক পাবলিকেশন্স থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। এছাড়াও দৈনিক ইত্তেফাকের ওয়েবসাইড থেকেও কিছু তথ্য নেয়া হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়