“দৈনিক সংবাদের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী বাহারের খালাত ভাই, জহুরের মা মারা গেছেন জহুরের শৈশবে। জহুর নানী ও খালাদের সঙ্গে তখন কলকাতায়।… আমিও আছি সেখানে। বাহার মাঝে মাঝে জহুরকে সঙ্গে নিয়ে আসতেন। আর আমার সামনে ওকে দাঁড় করিয়ে বলতেন, বল দেখি কলকাতায় কী কী সংবাদপত্র আছে? সঙ্গে সঙ্গে জহুর তোতা পাখির মতো বলে যেত ‘স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার, আনন্দবাজার, বেঙ্গলি, ফরওয়ার্ড…’। কী কী মাসিক আছে বল দেখি, এবার শুরু হলো তোতাপাখির শেখানো বুলি, ‘প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতি, সওগাত, মর্ডান রিভিউ…’। সংবাদপত্রে নাম মুখস্থ করেই যার জীবনের শুরু, পরবর্তীকালে সে যে নির্ঘাত সম্পাদক হবে, এ বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়।” জীবনস্মৃতি ‘রেখাচিত্রে’ বইতে সাহিত্যিক আবুল ফজল উপরের এই কথাগুলো বলেছেন। জহুর হোসেন চৌধূরীর ছেলেবেলাতেই সাহিত্যিক আবুল ফজল যে ভবিষ্যত বাণী করেছেন তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক হিসেবে জহুর হোসেন চৌধুরী বিপুল সাফল্য ও কৃতিত্ব পেয়েছেন। ১৯৫৪ সালে ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক পদে যোগ দেয়ার পর তিনি ‘সংবাদ’কে দেশের অন্যতম ও জনপ্রিয় দৈনিকে পরিণত করেন। সব ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি পূর্ব বাংলার নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করে গেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর লেখনি ঝলসে উঠেছে।
১৯৬০ সালের মাঝামাঝি দিকের কথা। সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ব্রিটিশ কাউন্সিলের আমন্ত্রণে কয়েকদিনের জন্য লন্ডন যান। যাবার আগে তাঁর আশৈশব বন্ধু অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদকে চিঠি মারফত জানান। সালাহউদ্দিন আহমেদ লন্ডনে তখন শিক্ষা ছুটিতে ছিলেন। সেখানে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাজ শেষ করে জহুর হোসেন চৌধুরী আরো কয়েকদিন থেকে যান। কয়েকদিনের মধ্যেই সেখানে জুটে যান সালাউদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম, ব্যারিস্টার জাকারিয়া চৌধুরী, বদরুদ্দিন উমর প্রমুখ। এই পাঁচ বাঙালির সাথে যুক্ত হন পাকিস্তানী অর্থনীতিবিদ হামজা আলভী। এরা সবাই মিলে তুমুল গোপন রাজনৈতিক আড্ডা জমান। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে সেই আড্ডায় উঠে আসত পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নীপিড়নের কথা। এই আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী। তিনি সেসময় প্রায়ই বলতেন, ‘পাকিস্তান নামক কিম্ভূতকিমাকার রাষ্ট্র গঠন করে আমরা যে অন্যায়, ‘পাপ’ করেছি, তার জন্য আমাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সে জন্যই আমাদের এই ভোগান্তি।’ এর জন্য দুটি কর্তব্যের কথাও নির্ধারিত করে বলতেন জহুর হোসেন চৌধুরী। একটি হল- সমগ্র পাকিস্তান ভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা। অন্যটি-যদি প্রথমটি সম্ভব না হয় তবে, কেবল পূর্ব পাকিস্তানকে তার স্বাধীন অস্তিত্বের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া। পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরাচারদের ঘোর বিরোধী অর্থনীতিবিদ হামজা আলভী অবশ্য বাঙালিদের কথা বুঝতে পেরে বারবারই বলতেন, ‘তোমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যেও না।’ কারণ তাঁর মতে, একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানই সমগ্র পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা রাখে। পূর্ব পাকিস্তান যদি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যায় তবে পশ্চিম পাকিস্তানে সামন্তবাদী ও স্বৈরাচারী শক্তির দাপট আরো বহুগুণ বেড়ে যাবে।
এই আলোচনার ঠিক এগার বছর পরেই পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সত্যিকার অর্থেই তারপর থেকে পাকিস্তানে সামরিক শাসক ও সামন্তবাদী শ্রেণীর দাপট আজো অক্ষুন্ন আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার প্রাক্কালে জহুর হোসেন চৌধুরী ছিলেন ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক। যা তখন স্বাধীন বাংলাদেশের পটভূমি তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তার পেছনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী। প্রখ্যাত সংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরীর জন্ম ১৯২২ সালের ২৭ জুন চট্টগ্রামে। তাঁর পৈত্রিক আবাস ছিল ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া উপজেলার রামনগর গ্রামে। বাবা সাদাত হোসেন চৌধুরী ছিলেন তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর বাবা- চাচাদের প্রত্যেকেই ছিলেন শিক্ষিত। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন আইনজীবী। মা মোহসেনা খাতুন গৃহিনী। মোহসেনা ছিলেন তৎকালীন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আবদুল আজিজের কন্যা। তিনি চমৎকার কবিতা লিখতেন। মোহসেনার বড় বোন আসিয়া খাতুন। তিনি ছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার ও নারীনেত্রী বেগম শামসুননাহার মাহমুদের মা। জহুর হোসেন চৌধুরীর বয়স যখন মাত্র দু’বছর তখন তাঁর মা মারা যান। পরে তিনি তাঁর নানী রাবেয়া খাতুনের কাছে লালিত-পালিত হন।
জহুর হোসেন চৌধুরী তাঁর বাবার চাকুরি সূত্রে নানা জায়গায় তাঁর ছেলেবেলা কাটিয়েছেন ও লেখাপড়া করেছেন। তবে একটা বড় সময় কেটেছে চট্টগ্রামের নানা বাড়িতে। সেখানে ছিলেন পিতৃহারা হাবিবুল্লাহ বাহার ও শামসুননাহার বেগম। ওই পরিবারের প্রভাব ছিল জহুর হোসেন চৌধুরীর জীবনে ব্যাপক। এ সময়েই বাড়ি থেকে প্রকাশিত হত হাবিবুল্লাহ বাহার ও শামসুননাহার বেগম সম্পাদিত ‘বুলবুল’ সাহিত্য পত্রিকা। সেখানে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী, অন্নদাশংকর রায়সহ সকল প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিমান লেখকেরা। বাসায় সাহিত্য-সাংবাদিক জগতের লোকদের ছিল নিত্য আসা-যাওয়া। ফলে বাড়িতে শিক্ষা-সাহিত্য- সাংবাদিকতার এক অপূর্ব বলয় গড়ে উঠে। জহুর হোসেন চৌধুরী সেখানেই পান সাহিত্য চর্চার অনুপম পরিবেশ।
জহুর হোসেন চৌধুরী ১৯৩৮ সালে সিরাজগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। তাঁর বাবা সাদাত হোসেন চৌধুরী তখন সিরাজগঞ্জের ডেপুটি ম্যাজিস্টেট ছিলেন। এরপর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে আই.এ. পাশ করেন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪২ সালে ইতিহাসে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। এসময় তিনি প্রবলভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে মিশে যান। প্রেসিডেন্সি কলেজে এম.এ. পড়ার সময় তিনি মারাত্মকভাবে বাতজ্বরে অক্রান্ত হয়ে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন ফলে এম.এ. পড়া হয়নি তাঁর।
কলকাতাতে পড়াশোনার সময় জহুর হোসেন চৌধুরী থাকতেন তাঁর খালাতো বোন বেগম শামসুননাহার মাহমুদের বাসায়। সেসময় তিনি মূলত রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের অঙ্গসংগঠন মুসলিম ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন বিপ্লবী এম. এন. রায়ের অনুসারী। সেসময় কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা এম. এন. রায়কে সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলে উল্লেখ করতেন। কিন্তু এম. এন. রায়ের তথ্য ছিল, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দল-মত নির্বিশেষে এগিয়ে নেওয়া। রায় এজন্য সেসময় কংগ্রেসকে জাতীয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, এ সংগঠনে বেশ কিছু লোক আছেন যারা সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন ও মুসলিম বিদ্বেষী। তিনি কংগ্রেসকে এই জাতীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য অধিকসংখ্যক মুসলমানদের কংগ্রেসের জাতীয় প্ল্যাটফর্মে কাজ করার আহ্বান জানান।
জহুর হোসেন চৌধুরী মূলত এম. এন. রায়ের মতাদর্শে আকৃষ্ট হয়েই মুসলিম ছাত্রলীগে যোগ দেন। তাঁর কাজ ও উদ্দেশ্য ছিল ওই প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির স্বপক্ষে কাজ করা। বস্তুত সেসময় জহুরের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেশ কয়েকজন তরুণ মুসলিম ছাত্রনেতা এম. এন. রায়ের মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছিল। সেসময় অনেকের সাথেই তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় রায়টের সময় জহুর হোসেন চৌধুরী সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ভূমিকা পালন করেন। এই দ্রোহের মনোভাব তাঁর চিরকালই বজায় ছিল। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগে, সেটাকে রোধ করার জন্য জহুর হোসেন অন্যান্যদের সাথে যে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন সেটা অতুলনীয়।
জহুর হোসেন চৌধুরীর সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি ‘বুলবুল’ পত্রিকার মাধ্যমে। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন তাঁরই খালাত ভাই হাবিবুল্লাহ বাহার। ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতার বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ‘স্টেটসম্যান’-এ শিক্ষানবীশ সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৫ সালেই তিনি ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা ছেড়ে দেন। তখন কলকাতা থেকে সদ্য প্রকাশিত আজাদ গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স-এর ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘কমরেড’- এর সম্পাদক নিযুক্ত হন জহুর হোসেন চৌধুরী। এরপর তিনি কিছুদিন ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’-তে কাজ করেন।
দেশ বিভাগের কিছু পূর্বে তিনি সাংবাদিকতার জগত ছেড়ে দিয়ে সরকারী চাকুরিতে যোগ দেন। তিনি তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের সিভিল সাপ্লাই বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টর পদে কাজ করেন। দেশ বিভাগের পর জহুর হোসেন চৌধূরী স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন এবং সরকারের গণসংযোগ বিভাগের উপ-পরিচালক পদে কাজ করেন। কিন্তু সরকারী চাকুরির ধরাবাধা নিয়ম ও আমলাতান্ত্রিক পরিবেশ পছন্দ হয়নি তাঁর।
কিছুদিন সরকারী চাকুরি করার পর তিনি সেখান থেকে চলে আসেন আবার সাংবাদিকতা জগতে। ১৯৪৮ সালে যোগ দেন ঢাকার সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি দৈনিক ‘পাকিস্তান অবজারভার’-এ। সেখানে তিনি সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতেন। অবজারভারের মালিক হামিদুল হক চৌধুরী ছিলেন সম্পর্কে জহুর হোসেনের চাচা। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক কারণেই বনিবনা হচ্ছিল না। ১৯৫১ সালে জহুর হোসেন চৌধুরী ‘দৈনিক সংবাদ’-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। সেসময় ‘সংবাদ’ ছিল এদেশের বাংলা নামের প্রথম দৈনিক। এর আগে সব নামই ছিল আরবি, উর্দূ বা ফারসি। ‘সংবাদ’কে ঢাকার সাংবাদিক তৈরির সুতিকাগার বললেও অত্যুক্তি হবে না। ১৯৫৪ সালে তিনি ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক পদে যোগ দেন। সেসময় তিনি সংবাদকে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় দৈনিকে পরিণত করেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল সংবাদের স্বর্ণযুগ। সংবাদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন খায়রুল কবীর। পরে তিনি সরকারের প্রচার বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তখন পত্রিকাটির মালিক হন আহমেদুল কবির। আর সম্পাদক হন জহুর হোসেন চৌধুরী। সৈয়দ নুরুদ্দিন ও কেজি মোস্তাফা ছিলেন বার্তা সম্পাদক আর সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার ছিলেন যুগ্ম-সম্পাদক। সংবাদে দায়িত্ব পালনকালে নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে গিয়ে জহুর হোসেন চৌধুরী লিখেছেন, ‘সংবাদের নব পর্যায়ের নীতি সম্বন্ধে আহমদুল কবীর, সৈয়দ নুরুদ্দিন ও আমার মধ্যে যে অন্তহীন আলোচনা হয়েছিল তাতে ক’টা মোটা কথা স্থিরকৃত হয়েছিল। প্রথমত, ‘সংবাদ’ কোনো দল বা নেতার বাহন হবে না বা স্তাবকতা করবে না। দ্বিতীয়ত, কোনোরূপ কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে সংশ্রব রাখবে না। তৃতীয়ত, গণতন্ত্রের ও মাত্রা বুঝে বামপন্থী রাজনীতিকে সমর্থন দেবে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালির স্বাধিকার দাবির প্রতি সর্বশক্তি নিয়ে সমর্থন দেয়া হবে। পৃথিবীর সর্বত্র সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা করবে।”
এখানে তিনি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ২৮ মার্চ সংবাদের অফিস পুড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য সেদিনই সেখানে মারা যান লেখক সাংবাদিক শহীদ সাবের। আমৃত্যু জহুর হোসেন চৌধুরী ‘সংবাদে’র একজন পরিচালক ছিলেন।
১৯৬৬-৬৭ সালে ‘সংবাদে’র প্রথম পৃষ্ঠায় তাঁর লেখা সম্পাদকীয় ‘দেশ কোন পথে’ প্রকাশিত হলে তা পাঠক সমাজে ব্যাপক সাড়া জাগায়। একজন সৎ ও নিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে তিনি বিপুল সাফল্য ও কৃতিত্ব পান। ১৯৭৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জহুর হোসেন চৌধুরী ‘সংবাদ’-এ চালু করেন তাঁর বিখ্যাত ‘দরবারে জহুর’ কলাম। যা সেসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পঁচাত্তরের পর যখন দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে পাকিস্তানি ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাচ্ছে তখন তিনি তাঁর কলামে এসবের বিরুদ্ধে শাণিত কলম তুলে ধরেন। জাতীয় ও সামাজিক সমস্যাকে তিনি এতো কৌতুক ছলে পাঠকের সামনে তুলে ধরতেন যে তা পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দিত। তিনি সহজ ভাষায় সহজ করে পাঠকের মনের কথা তুলে ধরতে পারতেন।
সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ১৯৮১ সালে তাঁকে জেবেন্নেসা-মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণপদক এবং ১৯৮২ সালে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। জহুর হোসেন চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি, পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। তিনি পাক-চীন মৈত্রী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ১৯৮০ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তিনি হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে দ্বি-জাতি তত্ত্বকে কোনোদিনই মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি প্রবলভাবে লড়াই করে গেছেন। সব ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি পূর্ব বাংলার নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করে গেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর লেখনি ঝলসে উঠেছে। তবে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের রসিক। অফুরন্ত প্রাণ-প্রাচুর্যের মানুষ জহুর হোসেন চৌধুরীকে কোনোদিন বিষন্নতা গ্রাস করতে পারেনি। শিশুর মতো সরল-চঞ্চল-অনাবিল মানুষটি বারবার যেমন মানুষের সংস্পর্শ পছন্দ করেছেন ঠিক তেমনি পেয়েছেন মানুষের ভালবাসা আর শ্রদ্ধা। সমাজের সব শ্রেণী- পেশার মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অকৃত্রিম। জহুর হোসেন ছিলেন মানুষ অন্তপ্রাণ। সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে ছিল গভীর সখ্যতা। তাঁর বাড়িতে দেখা যেত নানা ধরনের মানুষের আড্ডা। সেখানে যেমন ছিলেন প্রবীন জননেতা মওলানা ভাসানী, তুখোড় রাজনীতিবিদ মোহন মিয়া, প্রবীন সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, প্রখ্যাত শিল্পী জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান, কথাশিল্পী শওকত ওসমান ও শহীদুল্লা কায়সার তেমনি ছিলেন জাঁদরেল পাঞ্জাবী আমলা আজগর আলী শাহ এবং আরো অনেকে। শুধু তাই নয়, কমিউনিস্ট আন্দোলনের আত্মগোপনকারী নেতা মনি সিংহ ও অন্যান্য নেতাদের সাথেও জহুর হোসেন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
জহুর হোসেন কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ইতিহাসবিদ ড. সালাহউদ্দীন আহমদ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই সম্পর্ক অটুট ছিল। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘জহুরের কথা মনে হলেই আমার মন দুঃখে বেদনায় ভরে ওঠে। তাঁর মধ্যে যে অসাধারণ প্রতিভা ছিল, তার পূর্ণ বিকাশ ঘটান সম্ভব হয়নি। তাঁর মধ্যে একটা উদার মানবতাবোধ ছিল, অসাধারণ রসবোধ ছিল, যার ফলে সে তাঁর প্রতিপক্ষের নিকট থেকেও শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এই প্রাণবন্ত মানুষটির মধ্যে সব সময় একটা অস্থিরতা ভাব লক্ষ্য করেছি, মনে হয়েছে জীবনপথে ও যেন এক অশান্ত যাত্রী।’
তথ্যসূত্র: এই লেখাটি তৈরির জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রকাশিত ‘বই’ ২০০৯- জুলাই সংখ্যা এবং ড. সালাহউদ্দীন আহমদ রচিত ‘বরণীয় ব্যক্তিত্ব স্মরণীয় সুহৃদ’, যা অনুপম প্রকাশনী থেকে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়