১৯৫৫ সালের জুলাই মাস। রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তির পর কামাল লোহানী ফিরে এলেন পাবনায়। কিন্তু অভিভাবকদের সাথে তাঁর শুরু হলো রাজনীতি নিয়ে মতবিরোধ। অভিভাবকদের কথা “লেখাপড়া শেষে রাজনীতি করো, আপত্তি নেই”। কিন্তু কামাল লোহানী তখন রীতিমত রাজনীতি প্রভাবিত এবং মার্কসবাদের অনুসারী। চোখে তাঁর বিপ্লবের ঐশ্বর্য। আর তাই তিনি ছোট চাচা শিক্ষাবিদ তাসাদ্দুক লোহানীর কাছ থেকে মাত্র ১৫ টাকা চেয়ে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে ঢাকা অভিমুখে পা বাড়ালেন। জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলেন। আর সেই সঙ্গে শুরু হল তাঁর জীবন সংগ্রাম।
ঢাকায় এসে তিনি তাঁর চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সহযোগিতায় ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে দৈনিক ‘মিল্লাত’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন। হাতেখড়ি হল সাংবাদিকতায়। সেই থেকে তাঁর কলমের আঁচড়ে তৈরি হতে লাগল এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
কামাল লোহানী নামেই সমধিক পরিচিত হলেও পারিবারিক নাম তাঁর আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। তাঁদের বসতি ছিল যমুনা পাড়ে। খাস কাউলিয়ায়। আগ্রাসী যমুনা-গর্ভে তাঁদের বাড়িঘর জমি-জিরেত চলে যাওয়ার পর তাঁরা সিরাজগঞ্জেরই উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আর এই খান সনতলা গ্রামেই ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন ১১ আষাঢ় ১৩৪১ বঙ্গাব্দে কামাল লোহানী জন্মগ্রহণ করেন।
মাত্র ৬-৭ বছর বয়সে তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন। একান্নবর্তী পরিবারে বাস হওয়ায় বাবা তাঁকে গ্রামে না রেখে পাঠিয়ে দিলেন নিঃসন্তান ফুফু সালেমা খানমের কাছে কলকাতায়। এখানে এসে তিনি বেড়ে উঠতে লাগলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এক বিভীষিকাময় দুর্যোগের মধ্যে। কখনও ঘরে, কখনও-বা ট্রেঞ্চে। কিশোর কামাল লোহানী শিশু বিদ্যাপীঠে গেছেন কানে তুলো দিয়ে। যদি বোমা ফাটে ঘর থেকেই এ সতর্কতা। জাপানী বোমার ভয়ে বালির দেয়াল তৈরি করা আছে স্কুল প্রাঙ্গণে, সাইরেন বাজলেই ছুটে যেতে হবে ঐখানে, ওটা ছিল স্কুলের নির্দেশ। কাটে কাল……… মানুষের সৃষ্ট যুদ্ধ, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর দেশ বিভাগের উন্মাদনার মধ্য দিয়ে।
দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাবনা চলে এলেন। পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হলেন। থাকেন ছোট কাকা শিক্ষাবিদ ও লেখক তাসাদ্দুক হোসেন খান লোহানীর কাছে। ১৯৫২ সাল, মাধ্যমিক পরীক্ষার বছর। ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারির রক্ত ঢাকা থেকে ফিনকি দিয়ে যখন পাবনা পৌঁছল, তখন বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর আর দাঙ্গা দেখা তারুণ্যে উদ্দীপ্ত এই কিশোর ছুটে বেরিয়ে এলেন, কণ্ঠ উচ্চকিত করলেন মিছিলে, হত্যার প্রতিবাদে। রাজনীতিতে সবক নিলেন তিনি ঐ বায়ান্নর একুশ, বাইশ আর তেইশে ফেব্রুয়ারির রক্তধোয়া দিনগুলোর সংঘাতে।
১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। এরপর ভর্তি হলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে।এই কলেজে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে আন্দোলনে যোগদান এবং বারবার কারাবরণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে।
পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হওয়ার পর যখন কলেজ নির্বাচন এগিয়ে এলো তখন তাঁরা ক’জন সমমনা একজোট হয়ে বাঁধলেন জোট, নাম দিলেন ‘পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট’ অর্থ্যাৎ প্রগতিবাদী ছাত্র জোট। লড়লেন নির্বাচনে এবং নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেন। এই ফ্রন্টের সদস্যরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর গড়ে ওঠা প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এছাড়া তাঁরা রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়াও সেইসময় সাংস্কৃতিক কাজে বেশ সক্রিয় ছিলেন। সুতরাং কামাল লোহানীও এ থেকে বাইরে রইলেন না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে সক্রিয় ভূমিকা নিতে থাকলেন। উপস্থাপনা, গ্রন্থনা এবং আবৃত্তিতে পাঠ নিলেন তিনি।
১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এইখানে যোগদানের জন্য আসেন তৎকালীন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খুনী নুরুল আমিন, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সর্দার আব্দুর রব নিশতার, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতা খান আব্দুল কাউয়ুম খান, প্রাদেশিক লীগ নেতা মোহাম্মদ আফজাল প্রমুখ। ভাষা আন্দোলনে ছাত্র হত্যাকারী নূরুল আমিনের পাবনা আগমন ও মুসলিম লীগ সম্মেলনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় কামাল লোহানী পাবনার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের সাথে প্রথমবারের মত গ্রেফতার হলেন। ৭ দিন পাবনা জেলে আটক থেকে জামিনে মুক্তি পান।
১৯৫৪ সালের মার্চে পূর্ববাংলায় অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক নির্বাচন। কামাল লোহানী তথা সকল প্রগতিশীল ছাত্রই যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনা টাউন হলে মহান শহীদ দিবস উপলক্ষ্যে গণজমায়েত এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিপুল জনতার স্বতঃর্স্ফুত অংশগ্রহণে লীগ সরকার তটস্থ হয়ে পরদিন গ্রেফতার শুরু করে। ২২-ফেব্রুয়ারি সকালে কামাল লোহানী গ্রেফতার হন এবং যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ে নির্বাচনের পর মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু মার্কিনী মদদপুষ্ট পাকিস্তান সরকার এই বিজয়কে গ্রহণ করেনি। এবং শঙ্কিত হয়ে ১৯৫৪ সালের ২৯ মে ৯২-(ক) ধারার মাধ্যমে পূর্ববাংলায় ‘গভর্নরী শাসন’ চালু করে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববাংলায় গভর্নর হয়ে আসে এবং ব্যাপক ধরপাকড়ের নির্দেশ দেন।
কলেজ ছুটি থাকায় কামাল লোহানী গ্রামের বাড়ি চলে যান। এসময় খান সনতলা গ্রাম থেকে ১লা জুন পুনরায় গ্রেফতার হন তিনি এবং উল্লাপাড়া থানা হাজতে দিনভর থাকার পর রাতে তাঁকে পুলিশ পাহারায় পাবনা ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঈদের দিন পাবনা জেলে ‘রাজবন্দি’ হিসেবে কারাজীবন শুরু করেন কিন্তু কিছুদিন পর রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় এবং ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন তিনি।
১৯৫৫ সালে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি’-তে যোগ দেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে দেশ বিপন্ন হলে, কামাল লোহানী আত্মগোপন করতে বাধ্য হলেন। কিছুদিন পর গ্রেফতারের শঙ্কা কেটে গেলে আবার খবরের কাগজে যোগ দেন। বার বার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হবার কারণে পার্টির নির্দেশে ৫৮ সালে তিনি ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ ন্যাপে যোগ দিয়ে আবার প্রকাশ্য রাজনীতিতে রাজপথে নামেন।
এ সময় নৃত্যগুরু জি.এ. মান্নানের এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে দৈনিক পত্রিকায় তা প্রকাশ করেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনের নৃত্য অধ্যায়। এসময় বুলবুল একাডেমীতে জি. এ. মান্নান যখন ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ প্রযোজনা করলেন, তখন ছেলে চরিত্রে অংশ নিলেন কামাল লোহানী। ১৯৫৯ সালে এই নৃত্যনাট্য নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ সফর করেন তিনি। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে যান এবং ইরান, ইরাক সফর করেন।
পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং আন্দোলনের সাথী তাঁরই চাচাতো বোন সৈয়দা দীপ্তি রানীকে ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন। দীপ্তি তখন সমাজল্যাণে মাষ্টার্স করছিলেন। জীবিকার চাপ শুরু হল। কামাল লোহানী বনেদী সংবাদপত্র ‘দৈনিক আজাদ’-এ যোগ দিলেন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় শুরু হলো তোড়জোড়, কামাল লোহানী যুক্ত হলেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সাংগঠনিক কাজে। শতবর্ষের পালনের আয়োজনে “শ্যামা” নৃত্যনাট্যে তিনি বজ্রসেনের ভূমিকায় অংশ নিয়ে নন্দিত হলেন।
ষাটের দশকে পন্ডিত বারীণ মজুমদার প্রতিষ্ঠিত “মিউজিক কলেজ” এর সাথে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত না থাকলেও এর প্রতিটি কাজে তিনি যুক্ত থেকে বারীণ মজুমদারকে সর্বতো সমর্থন ও সহায়তা করে গেছেন আশির দশক পর্যন্ত। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে পন্ডিত বারীণ মজুমদারের একক প্রচেষ্টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে আয়োজিত “প্রথম পাকিস্তান সঙ্গীত সম্মেলন” এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে আয়োজিত “আলাউদ্দিন সঙ্গীত সম্মেলন” এ কামাল লোহানী অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, শিল্পী সংগ্রহ, উপস্থাপনাসহ বিভিন্ন দায়িত্বে সম্পৃক্ত থেকেছেন।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গর্জে উঠলো। কামাল লোহানীর নামে জারি হল হুলিয়া। ইতিমধ্যেই তাঁদের প্রথম সন্তান সাগরের জন্ম হল ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি। আর ঐদিনই গ্রেফতার হলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হল। ১৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ‘দৈনিক আজাদ’ থেকে ঘরে ফেরার পথে গ্রেফতার হলেন তিনি। এই সময় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ২৬ নম্বর সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, রনেশ দাশগুপ্ত, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াঁ, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই একসাথে ছিলেন। এ সময় ছাত্রনেতা শাহ মোয়াজ্জেম, শেখ মনি, হায়দার আকবর খান রনো, শ্রমিক নেতা নাসিম আলীও ছিলেন। সাড়ে তিন মাস পরে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দৈনিক ‘সংবাদ’-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দিয়ে অল্প দিনেই শিফট-ইন-চার্জ পদে উন্নীত হন। ১৯৬৬ সালে ‘পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেটে’ এবং ১৯৬৯ এর প্রথম দিকে কিছুদিনের জন্যে ‘দৈনিক পয়গাম’ এ যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের শেষ ভাগে কামাল লোহানী অবজারভার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় শিফট ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন। পরে চীফ সাব-এডিটর পদে উন্নীত হন। এই সময়কালে তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দুদফায় যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। নীতিগত কারণে ছায়ানট ছেড়ে মার্কসবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’। ১৯৬৭ সালের ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর উদ্বোধন হয় ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে। আয়োজন করেন গণসংগীতের অনুষ্ঠান “ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে”। নাটক “আলোর পথযাত্রী” পরিচালনা ও এতে অভিনয় করেন এবং শিল্পী আমানুল হক পরিচালিত নৃত্যনাট্য “জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে” বিবেকের ভূমিকায় নেচেছিলেন কামাল লোহানী। এই সময় তিনি আবৃত্তি ও উপস্থাপনায়ও যুক্ত করেন নিজেকে।
১৯৬৭ সালে যখন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন পার্লামেন্টে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে অবমাননা করে বক্তব্য দেন এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে কটুক্তি করে “তিনি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির কেউ নন” উচ্চারণ করলে তখন পুর্ব বাংলা ফুঁসে ওঠে। আপোষহীন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠক কামাল লোহানী ‘ক্রান্তি’র জরুরী সভা ডেকে প্রতিবাদ করলেন, এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাঠালেন। সেই প্রস্তাব থেকেই অত্যন্ত সাহসের সাথে সামরিক শাসনের মাঝেও পাকিস্তান অবজারভারের নিউজ এডিটর এ বি এম মুসা নিউজ করলেন ‘Regimentation of Culture?’। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে শুরু হল যুথবদ্ধ আন্দোলন ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা পরিষদ’ নামে যার আহবায়ক হলেন ওয়াহিদুল হক ও কামাল লোহানী। পরিষদ ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে তিনদিনব্যাপী রবীন্দ্র অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছিল এবং বিপুল দর্শক সমাগমে অবাঙালী গুন্ডাদের হামলার পরেও অত্যন্ত সফলভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল।
৬০ এর দশকের শুরুতে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভাজনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি’ এবং ১৯৬৭ সালে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ বিভক্ত হয়ে গেলে কামাল লোহানী দলীয় রাজনীতি ত্যাগ করেন এবং সাংবাদিক ট্রেড ইউনিয়ন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে তিনি তাঁর লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন।
১৯৭০ এর নির্বাচন পরবর্তী উত্তাল সময়ে তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় কয়েকটি অগ্নিগর্ভ প্রতিবেদন রচনা করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি জওয়ানদের বিদ্রোহ প্রসঙ্গে তাঁর রচিত প্রতিবেদন উল্লেখযোগ্য যা স্বরাজে প্রকাশিত হয় “বিদ্রোহ ন্যায়সংগত” ব্যানার হেডলাইনে। এই সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠনগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংঘবদ্ধ করে ‘বিক্ষুদ্ধ শিল্পী সমাজ’ গঠনে তৎপর ছিলেন।
২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর অবস্থার অবনতিতে অবশেষে এপ্রিলের শেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মে মাসের শুরুতে কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমান্তে পৌঁছোন এবং ঐ স্থানের থানা হাজতে নিরাপদে রাত কাটানোর পরের দিন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা গিয়ে উপস্থিত হন।
আগরতলা থেকে কামাল লোহানী অন্যদের সাথে ট্রেনযোগে কলকাতা যান। যাত্রাসঙ্গী প্রখ্যাত ফুটবলার প্রতাপ শঙ্কর হাজরাদের আত্মীয়ের আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সেখানে থেকেই কামাল লোহনী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সূত্র খুঁজতে থাকেন। এমন সময় তাঁর সাংবাদিক বন্ধু মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী তাঁকে ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় নিয়ে যান। ঐখানে কাজ করতে করতে তাঁর সাথে আমিনুল হক বাদশার দেখা হয় বাংলাদেশ মিশনের সামনে।
আমিনুল হক বাদশা অনেকটা ‘হাইজ্যাক’ করার মতো তাঁকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিয়ে যান বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে। সেখানে তখন আয়োজন চলছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার উদ্বোধনের। বালীগঞ্জের এই বাড়িটিতে মন্ত্রীরা (অর্থাৎ প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রীরা) বাস করতেন। তাঁরা বেতারের জন্য বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। এইখানেই প্রচলিত রীতির যন্ত্রপাতি ও স্টুডিও ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও এই শক্তিধর ট্রান্সমিশনটি উদ্বোধন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে কামাল লোহানী কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন।
আশফাকুর রহমান খান, টি এইচ শিকদার, তাহের সুলতান কেউই প্রকৌশলী ছিলেন না, তবু কোন ভারতীয়র সাহায্য না নিয়েই চালু হয়েছিল এই কেন্দ্রটি। চট্টগ্রামে যারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখনও তাঁরা কেউ পৌঁছাননি। সৈয়দ হাসান ইমাম ‘সালেহ আহমদ’ নামে সংবাদ পাঠ শুরু করেন। সাংবাদিক কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু বিপ্লবী বেতারে কি আর বসে থাকা যায়। যখন যে দায়িত্ব দেয়া হবে, তখন সেটা পালন করতেই হবে। তিনিও সংবাদ বিভাগ সংগঠন করা ছাড়াও সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা, শ্লোগান দেয়া ইত্যাদিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। বিদ্রোহী বেতারে সবাই কর্মী এবং প্রয়োজনে সকলকে সবকিছুই করতে হয়।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীন বাংলা বেতারে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রথম বার্তাটি লিখেছিলেন কামাল লোহানী এবং বিশ্ববাসীর কাছে সেই বিজয় বার্তা পৌঁছেছিল তাঁরই কন্ঠে।
১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকা চলে আসবে। এজন্য কামাল লোহানী চলে এলেন ঢাকায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঢাকা আগমনের ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী।
১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দায়িত্ব নিলেন ঢাকা বেতারের। দায়িত্ব নেয়ার পর বিধ্বস্ত বেতারকে পুনর্গঠনে ব্রতী হন তিনি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফর উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরে ধারাবিবরণীও দিয়েছিলেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হলেও প্রশাসনে পরিবর্তন আসেনি বলে অনেকটা নিরব প্রতিবাদেই বেতারের ট্রান্সক্রিপশন পরিচালক হিসেবে তিনি বেতার ত্যাগ করেন। ১৯৭৩ সালে ২০ জানুয়ারি পুনরায় সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন। যোগ দেন ‘দৈনিক জনপদ’ নামে একটি নতুন পত্রিকায়। তিনি এ বছরই ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭৪ সালে ‘দৈনিক জনপদ’ ছেড়ে ‘দৈনিক বঙ্গবার্তা’য় যোগ দান করেন। মওলানা ভাসানী সমর্থিত এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ। প্রায় তিনমাস পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে কামাল লোহানী ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ বছরই তাঁর নেতৃত্বে পুনরায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে কামাল লোহানী সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাংবাদিক আবেদ খান রচিত ‘জ্বালামুখ’ নাটক পরিচালনা ও নিপীড়ণে বিধ্বস্ত এক মানুষের চরিত্রে অভিনয়ও করেন। এবছরই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরী ও চেকোশ্লোভাকিয়া সফর করেন।
সরকার ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদপত্র এ্যানালমেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। নির্মল সেন ও কামাল লোহানী বাকশালে যোগ দানে অস্বীকৃতি জানান।
১৯৭৭ সালে ৬ জানুয়ারি সরকার রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’র নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত করে. কামাল লোহানী ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। ১৯৭৮ সালে তাঁকে সম্পাদক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সম্পাদক হবার পর জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকা-তে অনুষ্ঠিতব্য কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধান সম্মেলনে বাংলাদেশের একজন সম্পাদক হিসেবে প্রেসিডেন্সিয়াল এনট্যুরেজের সদস্য মনোনীত হন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের প্রস্তাবানুযায়ী চিরন্তন পরিধেয় পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহার করে স্যুট কোট পরতে অস্বীকার করেন। ফলে সামরিক সচিবের সাথে বাকবিতণ্ডা হয় এবং বিদেশ না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হলে ‘দৈনিক বার্তা’ ছেড়ে ‘বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট’ এর প্রকাশনা পরিচালক ও ‘ডেপথনিউজ বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক’মাস পরেই তিনি পিআইবি’র এসোসিয়েট এডিটর পদে নিযুক্ত হন।
১৯৯১ সালে তিনি প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ষোল মাসের মাথায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি পিআইবিতে ফিরে আসেন। পিআইবি’র মহাপরিচালক তাঁকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠান। এই সময় রাজনৈতিক অভিযাত্রার পাশাপাশি যুক্ত হল সংস্কৃতি সংগ্রাম। কামাল লোহানী ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটের বিজয়ের পর আবারও দু’বছরের জন্যে শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রধান সম্পাদক এবং উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত থেকেছেন এবং আছেন।
পঞ্চাশের দশকেই তিনি সে সময়ের অনুষ্ঠান সংগঠক, ধারাভাষ্যকার বদরুল হাসানের নজরে পড়েন। তাঁরই উৎসাহে কামাল লোহানী গ্রন্থনা, আবৃত্তি ও বিবরণী পাঠে আরো বেশী করে যুক্ত হয়ে পড়েন যা তাঁকে পুর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক চর্চায় প্রতিষ্ঠিত করে এবং তিনি সুদীর্ঘকাল এই ক্ষেত্রে বিচরণ করেন দাপটের সাথে।
ঢাকাই প্রথম বাংলা (এফডিসি কেন্দ্রিক) চলচ্চিত্র ফতেহ লোহানী পরিচালিত “আসিয়া” তে কামাল লোহানী মুখোশ নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। এরপর এহতেশাম পরিচালিত “এদেশ তোমার আমার” এ তিনি সমবেত নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। আজিজুর রহমানের পরিচালনায় “পাথরের কান্না” তে অভিনয় করেন কামাল লোহানী, তবে এই চলচ্চিত্র শেষ পর্যন্ত মুক্তিলাভ করেনি।
১৯৭৯ সালে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত ‘রাজশাহী আর্ট কলেজ’ এর প্রধান উদ্যোক্তাদের অন্যতম কামাল লোহানী ছিলেন ‘রাজশাহী আর্ট কলেজ’ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
কামাল লোহানী ৭২ এর সংবিধান পুণঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন । তিনি একুশের চেতনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীন বাংলা বেতার পরিষদের উপদেষ্টা, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা । ১৯৮৩ সালে কামাল লোহানী সরাসরি জড়িত হয়ে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা গঠন করেন এবং গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি হন। সবকিছুর পাশাপাশি কামাল লোহানী ‘আমার বাংলা’ নামে শিল্প-সংস্কৃতি গবেষণা ও অনুশীলন চক্র গঠন করেছেন। দেশের বৃহত্তম প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী’ -র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন একনাগাড়ে চার বছর। সর্বশেষ তিনি ‘ব্রতচারী বাংলাদেশ’ এবং ‘নবনাট্য সংঘ’ এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
তাঁর লেখা প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে, ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘আমরা হারবো না’, ‘সত্যি কথা বলতে কি’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘এদেশ আমার গর্ব’, ‘মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘যেন ভুলে না যাই’, ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘দ্রোহে প্রেমে কবিতার মত’ এবং কবিতার বই ‘শব্দের বিদ্রোহ’। প্রকাশিতব্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ভাষা আন্দোলনের কথকতা’, ‘সাংবাদিকতার সাতকাহন’, ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’. এছাড়াও তাঁর ঘটনাবহুল সাংবাদিক জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজের কথা লেখ্যরূপে প্রেস ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ প্রকাশ করেছে ‘অগ্রজের সঙ্গে একদিন’। তিনি স্মৃতি কথা লেখার কাজ শেষ করে তা সম্পাদনায় নিজেকে ব্যাপৃত করেছিলেন।
তিনি দেশে-বিদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক সম্মাননা লাভ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য, কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা, ১৯৯১ সালে; প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা; রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা; ক্রান্তি স্মারক – ২০০৩, ঋষিজ সম্মাননা। জাহানারা ইমাম পদক ও বাংলা একাডেমী ফেলো পান ২০০৮ সালে। কামাল লোহানী ২০১৫ সালে রাষ্ট্রীয় অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন।
২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বরে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের নীরব অনুপ্রেরণাদাত্রী স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর প্রয়াণে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন কামাল লোহানী। কামাল লোহানী ও দীপ্তি লোহানী দম্পতির এক পুত্র ও দুই কন্যা। প্রত্যেকেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং পেশায় পুত্র সাগর লোহানী সাংবাদিকতা এবং চিত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত, জ্যেষ্ঠ কন্যা বন্যা লোহানী চাকুরীর পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন এবং কনিষ্ঠ কন্যা ঊর্মি লোহানীও চাকুরীর সাথে সাথে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের জীবন ও কর্মের অনলাইন আর্কাইভ গুণীজন ডট কম পরিচালনায় সম্পৃক্ত।
গ্লুকোমার কারণে দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়েও তিনি কর্মোদ্যম হারাননি। ৩ বছর যাবৎ চালিয়ে গেছেন তাঁর শাণিত লেখনী অনুলেখকের সহযোগিতায়। বার্ধক্যজনিত বহুবিধ শারীরিক সমস্যাও তাঁকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। তাই ২০২০ সালের ৫ মার্চ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি সরাসরি চলে যান সিরাজগঞ্জ শহরে, যেখানে তাঁর ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন’ উদ্বোধনের কথা।
৬ মার্চ সে সম্মেলন উদ্বোধন শেষে ঢাকায় ফিরে আসেন। করোনার কারণে তিনি বন্দি হন বাড়ীতে। লকডাউন ও মহামারীকালে তাঁর নিয়মিত চিকিৎসা ব্যহত হতে থাকে। এক পর্যায়ে ১৭ মে ২০২০ শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এবং তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে কিডনী ও ফুসফুসের ব্যাপক অক্ষমতাকে জয় করে ২ জুন বাড়ী ফিরে আসেন। কিন্তু দুসপ্তাহের মধ্যে তাঁর শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিলে ১৭ জুন আবার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯ জুন সকালে জানা যায় তিনি করোনাক্রান্ত। স্থানান্তরিত হন কোভিড ১৯ হাসপাতাল ‘শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল’ এর আইসিইউ-তে। ২০ তারিখ ভোরে অবস্থার অবনতি ঘটলে লাইভ সাপোর্টে নেয়া হয় তাঁকে।
মৃত্যু: ২০ জুন ২০২০ সকাল ১০:২০ মিনিটে কামাল লোহানী দীর্ঘ ৮৫ বছর ১১ মাস ২৪ দিনের সংগ্রামমুখর, দ্রোহী জীবনের অবসানে শেষঃনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
(২৭ আগস্ট, ২০২০ –এ সংশোধিত)
লেখক: সাগর লোহানী