ওবায়েদ উল হক সত্যিকার বহুমুখি প্রতিভাধর একজন মানুষ। কোনো একটি বিষয়ের বর্ণনা বা বিশেষ একটি পরিচয় দিয়ে তাঁকে খাটো করার সুযোগ নেই। একই সাথে তিনি লেখক, কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, সুরকার গীতিকার। আর সবচেয়ে বড় যে পরিচয়ে তিনি পরিচিত, তা হচ্ছে তিনি একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক। একই সাথে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অনন্য দক্ষতার অধিকারী একজন কৃতী ব্যক্তিত্ব। ওবায়েদ উল হক হচ্ছেন সেসব মানুষদের একজন, যাদের প্রতিভা সব দিকেই আলোর মতো বিচ্ছুরিত। যখন ইচ্ছে কলম নিয়ে আপন মনে লিখেছেন তিনি, আবার যখন চেয়েছেন তখন সেলুলয়েডে এঁকেছেন স্বপ্ন।
ওবায়েদ উল হক সেসব সংগ্রামী মানুষদের একজন, যাঁদের জীবনটাই কেটেছে শুধু সংগ্রামে। সময় বা বয়স তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনি বরং বারবারই সময়ই তাঁর কাছে পরাস্ত হয়েছে। কাজের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা আর ধ্যান এই বয়সেও এতোটুকু কমেনি। ৯৫ বছর বয়সেও তিনি নিয়মিত কলাম লিখেছেন।
জন্ম ও শৈশব
ওবায়েদ উল হকের জন্ম ১৯১১ সালে ফেনীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। অল্প বয়সেই শিল্প সাহিত্যের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিলো। স্কুলে থাকতেই লিখেছেন কবিতা। পড়ে ফেলেছেন অসংখ্য বই আর জড়িয়েছেন নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠে লিখেছেন বিভিন্ন ম্যাগাজিনে।
লেখা-পড়া ও কর্মজীবন
১৯৩৪ সালে দর্শনশাস্ত্রে মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। ১৯৩৬ সালে আইনশাস্ত্রে মাস্টার্স করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। স্বাভাবিকভাবেই চলছিলো সব কিছু। এর মধ্যে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ । তেতাল্লিশের মহা মন্বন্তর তাঁর ভাবনাকে প্রচণ্ড নাড়া দিলো। ভয়াবহ এ দুর্ভিক্ষে ৫০ লাখ লোক মারা যায়। বিশ্বের আর কোনো দুর্যোগে একসাথে এতো লোক মারা যায়নি। প্রলয় কি একেই বলে?
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি দেখলেন হাজার হাজার লোক না খেয়ে মারা যাচ্ছে। মানুষের জীবন যে এতো সস্তা, এতো অর্থহীন, এভাবে না খেয়ে মানুষ যে মারা যেতে পারে, তা দারুণভাবে বিচলিত করেছিল তাঁকে। এ দুর্ভিক্ষ যতোটা না ছিলো প্রাকৃতিক, তার চেয়ে বেশি ছিলো মানবসৃষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছিলো। আর এ সুযোগটাই কাজে লাগায় অসত্ ব্যবসায়ী। খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুত করে সৃষ্টি করা হলো কৃত্রিম সংকট। ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়লো হু হু করে। দরিদ্র লোকজন দু’মুঠো খাবার কেনার সামর্থ্যও হারালো। সেই সঙ্গে হারালো তাদের অমূল্য প্রাণ। মনুষ্য জাতি হারিয়ে ফেললো তার মনুষ্যত্ব।
এ দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি বই লেখেন ওবায়েদ উল হক। তিনি দেখান কী করে এ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হলো, আর কিছু মানুষই বা কী করে এ থেকে সুবিধা লুটলো। তিনি তাঁর এ অনুধাবনকে মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে দুঃখী মানুষের মধ্যে, ছড়িয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু এখানে তিনি অন্য এক সমস্যার মুখোমুখী হলেন। যাদের জন্যে বই লেখা, তাদের বেশিরভাগই পড়াশোনা জানে না। তিনি ভাবলেন এমন কোনো মাধ্যমের কথা, যাতে সহজেই মানুষের মাঝে তাঁর ভাবনাকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। অবশেষে আর্কিমিডিসের মতোই তিনি এর সমাধান খুঁজে পেলেন – চলচ্চিত্র বানাতে হবে। চলচ্চিত্রই একমাত্র শিল্প মাধ্যম যার ভাষা শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেরই সহজবোধ্য। সেই চলচ্চিত্রের ভাষায় লোকজনকে বোঝাতে হবে গণহারে মৃত্যুর কারণ এবং দুর্দিনে আত্মরক্ষার উপায়। যেই ভাবনা ওমনি কাজ, রাতারাতি লোভনীয় সরকারি চাকরিটা ছেড়ে দিলেন।
পরিবারের সদস্যরা বারণ করলো, আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবাই তাঁকে নিবৃত করতে চাইলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সেলুলয়েডের ডাক পেয়েছেন তিনি। সেলুলয়েডে বুনতে হবে স্বপ্ন। দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের দুঃখের শাপমোচনের স্বপ্ন। ওবায়েদ উল হক বলেন- ‘সেদিনই বোধ হয় আমার জীবনের সবচেয়ে সাহসী কাজটি করেছিলাম।’ তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলিম, যিনি শিল্পোদ্যোক্তা হিসাবে চলচ্চিত্র বানাতে এসেছেন। কাহিনী রচনা, চিত্র পরিচালনা এবং প্রযোজনার সার্বিক দায়িত্ব নিয়ে সেই কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি সর্বতোভাবে প্রস্তুত হলেন। মাঝে মাঝে সিদ্ধান্তের নির্ভুলতা সম্পর্কে মনে সন্দেহ উঁকিঝুকি দিলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর আত্ম্ববিশ্বাসে চিড় ধরেনি এতোটুকুও। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ছায়ানট পিকচার্স ও পরিবেশনা সংস্থা স্টান্ডার্ড পিল্মস্ – এর অফিস খুললেন কলকাতার ধর্মতলা স্ট্রীটে। শিল্পী নির্বাচন শুরু হলো নট সূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী, জনপ্রিয় চিত্র নায়ক জহর গাঙ্গুলী, চিত্র নায়িকা রেনুকা রায়, রাজলক্ষী, কিরন কুমার, সন্তোষ সিংহ ও আরো কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেলো। সঙ্গীতে চুক্তি হলো আবদুল আহাদ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কিন্তু সমস্যায় পড়লেন ফিল্ম স্টুডিওর সঙ্গে চুক্তি করতে গিয়ে। অবিভক্ত বাংলার চিত্র শিল্পে ওবায়েদ উল হক নবাগত, অপরিচিত। আনকোরা নতুন পার্টির সঙ্গে চুক্তি করার ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নয় কোন স্টুডিও মালিক। তীরে এসে তরী ডুববে? শক্তিশালী বেঙ্গল মোশন পিকচার্স এসোসিয়েশনের পেয়িং মেম্বার হয়েও এই ফ্যাসাদ? কিন্তু কিছুটা বিলম্বে হলেও তিনি কলকাতা স্টুডিও মহলের মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হলেন যে, তাঁর শিল্পানুরাগে (আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি উভয় অর্থেই) কোন কৃত্রিমতা নেই। ফলে অচিরেই টালীগঞ্জের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর সঙ্গে তিনি চুক্তিবন্ধ হলেন।
‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ ছায়াছবির দীর্ঘ ইনডোর এবং আউটডোর শুটিং শুরু হলো। নগদ অর্থ দিয়ে এবং বাকিতে কাজ করার সুবিধাও পেলেন তিনি। নির্বিঘ্নে চিত্রগ্রহণের কাজ চলছে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে গড়ের মাঠে মুসলিম লীগের পাকিস্তানের দাবিতে আয়োজিত জনসভা শেষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরম্ভ হলো। একটানা তিন মাস সব কাজ বন্ধ। এরপর দাঙ্গা থেমে গেলে বাকি কাজ সমাধা করা হয়।
১৯৪৬ সালে ছবিটি মুক্তি পায় বাংলা, বিহার, আসাম এবং বার্মায় (তৎকালীন film distribution zone)। সবাই তাঁর ছবি দেখে অভিভূত। সাধারণ মানুষকে দারুণভাবে টানলো ছবিটি। সিনে ম্যাগাজিন রূপমঞ্চের জরিপে সে বছর সেরা ১০টি ছবির একটি নির্বাচিত হলো তাঁর ছবিটি। ছবিটি পরে ঢাকার মানসী সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়। নিজের চলচ্চিত্রের এমন সাফল্য দেখে অভিভূত ওবায়েদ উল হক। যতোটা ভেবেছিলেন তার চেয়েও ভালো হয়েছে ছবি। তবে তাঁর এ আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। ‘৪৭-এর দেশবিভাগের সময় তাঁকে তাঁর চলচ্চিত্রাঙ্গন ছেড়ে চলে আসতে হলো ঢাকায়। চলচ্চিত্র নিয়ে তিনি যখন অনেক কিছু ভাবছেন ঠিক তখনই সেই অঙ্গণ ছেড়ে চলে আসতে হলো। এতে তিনি দারুন আঘাত পেলেন।
ওবায়েদ উল হকের কথা- ‘আমি গভীরভাবে কষ্ট পেলাম, মর্মাহত হলাম, শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। নিজেকে মনে হলো পরাজিত সৈনিক।’ পরের চারটি বছর নিভৃতেই ফেনীতে নিজের গ্রামের বাড়িতে কাটালেন। মাঝে মাঝে পাকিস্তান অবজারভারে লেখা ছাড়া আর কোনো কাজকর্ম করলেন না। এরপর হঠাত্ করেই এলো সেই দিন। আবারো জীবনের মোড় ঘুরলো তবে এবার অন্যদিকে। ১৯৫১ সালের এক সকালে পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক আব্দুস সালামের কাছ থেকে এলো এক চিঠি। লিখেছেন, এভাবে গ্রামে নিভৃতে কাটিয়ে যেন নিজের জীবনটা নষ্ট না করেন। তাঁর তো অনেক কিছু করার রয়েছে। সালাম সাহেব তাঁকে মাসে ৩০০ টাকা বেতনে পাকিস্তান অবাজারভারের সম্পাদকীয় বিভাগে চাকুরির আমন্ত্রণ জানালেন।
লেখালেখির অভ্যাস থাকলেও সাংবাদিকতা করবেন, এমনটি কখনোই তাঁর ভাবনায় ছিলো না। কাজেই পাত্তা দিলেন না ব্যাপারটি। এমনকি সেই চিঠিটি দ্বিতীয়বারের মতো পড়ারও প্রয়োজন মনে করলেন না। কিন্তু সাংবাদিকতা তাঁকে ছাড়লো না। এরপর আবার টেলিগ্রাম যতো দ্রুত সম্ভব, জয়েন করুন। এবার একটু ভাবলেন তিনি। মনে হলে ব্যাপারটি তো খারাপ হয় না!
এভাবেই সাংবাদিক হয়ে গেলেন তিনি। এরপর কেটে গেলো ৫০ বছর। এখন তো তাঁর নাম মানেই সাংবাদিক। ওবায়েদ উল হক বলেন, ‘সাংবাদিক আমি যতোটা না ইচ্ছেয় হয়েছি, তার চেয়ে বেশি হয়েছি ঘটনাচক্রে। ‘৪৭ সালে যদি দেশবিভাগ না হতো আমি হয়তো কখনোই সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিতাম না। আমি জ্ঞাতভাবে কখনো সাংবাদিক হতে চাইনি কিন্তু হলাম। এরপর পেশাটিকে ভালোবেসে ফেললাম। আর ভালোবাসলাম বলেই ৫০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করলাম।’
সাংবাদিক হিসেবে ওবায়েদ উল হকের জীবন ঘটনাবহুল এবং গৌরবময়। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়টাতে দেশের স্বাধীনতার জন্যে তিনি তাঁর কলমকে বানালেন অস্ত্র। পাকিস্তান অবজারভারে লিখলেন শত শত সম্পাদকীয়। বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে তিনি জড়ালেন ওতপ্রোতভাবে। এরপর দেশ স্বাধীন হলো পাকিস্তান অবজারভার হলো বাংলাদেশ অবজারভার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক হলেন ওবায়েদ উল হক। তাঁর নেতৃত্বে অবজারভার হয়ে উঠলো দেশের অন্যতম মানসম্মত এবং জনপ্রিয় দৈনিক। তিনি অবজারভারকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন অনেক দূর। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিকটির সম্পাদক ছিলেন। এরপর তিনি সম্পাদক হলেন নতুন প্রকাশিত ‘দৈনিক ডেইলি নিউজ’-এর। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিকটির সম্পাদক ছিলেন। এরপর ‘দৈনিক বাংলা’ এবং ‘বাংলাদেশ টাইমস’-এ বোর্ড অব ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেন। যখন যে দায়িত্বই নিয়েছেন সেটা নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন।
যে সরকারই যখন সাংবাদিকদের জন্যে ভালো মন্দ কিছু করতে গিয়েছেন, তখনই এগিয়ে এসেছেন ওবায়েদ উল হক। আর তাই সরকার যখন দেশে একটি প্রেস ইনস্টিটিউট করার চিন্তা করলো, তার আহ্বায়ক করা হলো ওবায়েদ উল হককে। তাঁরই চেষ্টা, পরিশ্রম এবং মেধার ফলে দাঁড়িয়ে গেলো পিআইবি (প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ)। তিনি পিআইবির প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেন। এ সময় আরো অনেক সংগঠনের জন্যে কাজ করেছেন তিনি। তিনি একাধারে ছিলেন এডিটরস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান, নজরুল ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। অর্ধশতাব্দির বেশি সময় ধরে তিনি জড়িয়ে রয়েছেন সাংবাদিকতায়। তাঁর কাজের একাগ্রতা, পরিশ্রম, সাহস, সততা, নিষ্ঠা ইত্যাদি কারণে তিনি আজ সাংবাদিকতার মডেল।
ওবায়েদুল হক একজন অসাধারণ সাহিত্যিকও। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় অবাধ পদচারণা তাঁর। সেটি হোক কবিতা বা নাটক কিংবা প্রবন্ধ। ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি ভালোবাসা ছিলো, কবিতা লিখেছেনও ছোটবেলা থেকে। যখন মাত্র ১০ বছর বয়স তখনই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘সওগাত’ পত্রিকায়। এরপর বিভিন্ন ম্যাগাজিন এবং লিটল ম্যাগে নিয়মিত তাঁর কবিতা ছাপা হতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে ‘দিগ্বিজয়ে চোরাবাজার’ নামে তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয়। তিনটি একাঙ্কিকা নাটক নিয়ে বইটি। এরপর একই ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হয় আরেকটি বই- ‘এই পার্কে’। দুটি বই-ই বেশ জনপ্রিয় হয়। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সাহিত্য সেমিনারে জনপ্রিয় নাট্যকার এবং ঔপন্যাসিক রশীদ করিম বলেন, ‘ওবায়েদ উল হক তাঁর দুটি কাজ- দিগ্বিজয়ে চোরাবাজার এবং এই পার্কে’র জন্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’
ওবায়েদ উল হক ১৪টি বই, ছয়টি নাটক, তিনটি উপন্যাস, তিনটি কাব্যগ্রন্থ এবং ইংরেজিতে একটি আত্মজীবনী লিখেছেন। তাঁর লেখা নাটকগুলো হলো- ‘এই পার্কে’, ‘দিগ্বিজয়ে চোরাবাজার’, ‘সমাচার এই’, ‘রুগ্ন পৃথিবী’, ‘ব্যতিক্রম’ এবং ‘যুগসন্ধি’। ‘দ্বৈত সঙ্গীত’, ‘সংগ্রাম এবং ঢোল’-এই তিনটি তাঁর উপন্যাস। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো হল- ‘দ্বিধার ফসল’, ‘ছায়ানগর সংলাপ’ এবং ‘গরিব হতে চাই’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তাঁর লেখা জীবনী গ্রন্থের নাম- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: অন্যরকম এক নেতা’। ওবায়েদুল হক তাঁর নিজের কাজগুলো সংগ্রহ রাখার ব্যাপারে উদাসীন। তিনি তাঁর ‘দিগ্বিজয়ে চোরাবাজার’ বইটির শেষ কপিও একজনকে দিয়ে দেন। বইটির একটি কপিও তাঁর কাছে ছিলো না। তাঁর ছেলে একদিন ফুটপাত থেকে বইটি কিনে আনেন।
পুরস্কার/ স্বীকৃতি
সাংবাদিকতায় অবদানের জন্যে ১৯৮৩ সালে তিনি একুশে পদক পান। মা ও শিশুদের বিষয়ে সম্পাদকীয়র জন্যে তিনি ১৯৮৩ সালে পান ইউনিসেফ স্বর্ণপদক। এছাড়া সাংবাদিকতার জন্যে পেয়েছেন আব্দুস সালাম স্বর্ণ পদক, জহুর হোসেন চৌধুরি স্বর্ণ পদক, অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণ পদক ইত্যাদি। নাটকে অবদানের জন্যে ১৯৬৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান।
এবং ওবায়েদ উল হক
ওবায়েদ উল হক বলেন, ‘গত ৫০ বছরে সাংবাদিকতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে সাংবাদিকতা ছিলো খুবই কঠিন কাজ। অনেক বেশি প্রতিকূলতার মাঝে তখন তাদের কাজ করতে হতো। একটি সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে আমাদের শব্দ নিয়ে বারবার ভাবতে হতো। কারণ অপছন্দ হলে সরকার অনেক কিছু করতে পারতো। এমনকি পত্রিকাও বন্ধ করে দিতে পারতো। আমাদের তাই ডিকশনারি খুঁজে বের করতে হতো যথোপযুক্ত সমার্থক শব্দ। আজ সাংবাদিকতা সে তুলনায় অনেক সহজ। কম্পিউটারসহ প্রযুক্তিগত নানা উন্নয়নে সংবাদপত্র শিল্প আজ অনেক উন্নত হয়েছে।’
ব্যক্তিজীবনে অসাধারণ অমায়িক এবং মার্জিত ওবায়েদ উল হক কখোনোই নিজেকে বড় কিছু ভাবেননি। সব সময় নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ ভেবেছেন এবং সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছেন। এই সাংবাদিকের জীবন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
ওবায়েদ উল হক ২০০৭ সালের ১৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : মীর মাসরুর জামান