‘‘ছেলেমেয়ে ছোট থেকে বড় হলো, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হলো, তারপর বিয়ে হলো। আমার এসবে কোন ভূমিকা নেই। মাসের শেষে রোজগারের টাকা দশভুজার হাতে তুলে দিয়েই আমি খালাস। ছেলেমেয়ের কারও কারও জন্মদিনে স্ত্রীর তাগাদায় বাচ্চাদের জন্য কাপড় কিনতে গেছি। দোকানদার যখন তাদের ‘সাইজ’ জিজ্ঞেস করল, তখন বিপাকে পড়লাম। দুহাত দুদিকে মেলে ধরে বললাম, ‘এত বড়।’ মানে কোলবালিশের ধরনের ‘সাইজ’ দেখালাম। পরিচিত দোকানদার অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, বুঝলেন না, আমি যখন কাজে যাই তখন তারা শোয়া। রাতে যখন ফিরি তখন তারা ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই পাশ দেখালাম, কারণ উচ্চতার কোন আন্দাজই নেই।’’
উপরের কথাগুলো বলেছেন এদেশের প্রখ্যাত ও ব্যাস্ততম সাংবাদিক এবিএম মূসা। সাংবাদিক জীবনের গূঢ় দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করার কারণে স্ত্রী-সন্তান-সংসারের জন্য সময় দিতে পারেননি তিনি। আর তাইতো ছেলেমেয়ের উচ্চতা ও বয়স সম্পর্কে কোন ধারনা ছিল না তাঁর।
প্রায় সাত দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি যুক্ত ছিলেন এদেশের সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে। একজন সাধারণ প্রতিবেদক থেকে শুরু করে পৌঁছেছিলেন প্রাপ্তির সর্বোচ্চ স্থানে। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি স্রষ্টা, দ্রষ্টা। তাঁর এই জগত শুধু সংবাদপত্রের বিষয়ের মতোই নানা বিচিত্র ও বৈচিত্রময়তায় ভরা। রাজনীতি-খেলাধুলা- সংস্কৃতির ভুবন-পেশাজীবী আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের এক নিপুণ ইতিহাসগাঁথা যেন এই এক জীবনের পরিভ্রমণ। দেশ-বিদেশের নানা অলিগলির অম্র-মধুর অভিজ্ঞতায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক নিজস্ব ভুবন। পরিণত হয়েছিলেন এদেশের সংবাদপত্র জগতের একজন স্তম্ভ হিসেবে। এদেশে সংবাদপত্র শিল্পে যার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
এবিএম মুসার জন্ম ১৯৩১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার দক্ষিণ ধর্মপুর গ্রামের এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা মৌলভী আশরাফ আলী ছিলেন ব্রিটিশ আমলের সরকারি চাকুরে, ডেপুটি ম্যাজিস্টেট। তিনি কলকাতা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন স্থানে চাকরি করেছেন। তাদের প্রচুর জমি ও প্রজা ছিল। মা সাজেদা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। পারিবারিকভাবে লেখাপড়ার হাতেখড়ি গ্রামে হলেও সাত বছর বয়সে বাবার সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন মূসা। মা বাড়িতেই থাকতেন। নানারবাড়িও ছিল অবস্থাসম্পন্ন। বারো বছর বয়সে মাকে হারান। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেই ছোট বয়সেই চট্টগ্রামে স্কুলের পাশাপাশি পেয়ে যান একটি লাইব্রেরি, যেটিকে স্থানীয়রা ‘বাকল্যান্ড সাহেবের লাইব্রেরি’ বলেই চিনত। সেখানে নানা ধরনের বইয়ের পাশাপাশি কলকাতা থেকে নিয়মিত আসত খবরের কাগজ। সেখানেই বালক মূসা প্রথম বই পড়ার স্বাদ পান। পড়াশোনা করতেন চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেই সময়ে মুসলমানরা বেশ অনগ্রসর ছিল। তবে মূসার পরিবার ছিল শিক্ষায়-দীক্ষায় বেশ অগ্রসর। চট্টগ্রামে থাকা অবস্থাতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সেই ছোটবেলায় তিনটি ঘটনা মূসাকে খুব আলোড়িত করে। একটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয়টি বাংলার দুর্ভিক্ষ আর তৃতীয়টি ভারত উপমহাদেশের নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির অভ্যূদয়। টানা প্রায় নয় বছর তিনি সেখানে ছিলেন। এরপর অবশ্য তিনি বিভিন্ন সময়ে হাটহাজারী হাই স্কুল, নোয়াখালী জিলা স্কুল, ফেনী কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন। এর মধ্যে ১৯৪৬ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে তৎকালীন প্রবেশিকা অর্থাৎ মাধ্যমিক পাস করেন। ফেনী কলেজে ভর্তি হলেও সেখানকার পড়াশোনা ভাল লাগল না। পরে ১৯৪৮ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। মুসার দীর্ঘজীবনের বন্ধু এবং প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘মূসা তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। আমি বরিশালের এ কে স্কুলের ছাত্র। দুজনই আমরা রেভল্যুশনারী সোশালিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।’
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই গ্রেপ্তার হন। পরে ঢাকায় এসেও ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। নোয়াখালীতে থাকার সময়টা মূসার জন্য বৈচিত্রহীন হলেও সেখানেই তিনি সাক্ষাত পেয়েছিলেন উপমহাদেশের অহিংস আন্দোলনের নেতা গান্ধীর। দেশবিভাগের পর প্রচণ্ড দাঙ্গার মধ্যে কংগ্রেস নেতা গান্ধি নোয়াখালীতে এসেছিলেন। বালক মূসা গান্ধীর দাঙ্গাবিরোধী মিছিলে পা মেলান। চৌমুহনী কলেজ থেকে বিএ প্রাইভেট পরীক্ষা দেন। ছাত্র জীবনেই মূসার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হয় চৌমুহনী থেকে প্রকাশিত ‘কৈফিয়ত’ পত্রিকার মাধ্যমে। এ সময় তিনি সাপ্তাহিক ‘সংগ্রাম’-এ লিখতেন।
কিন্তু এবিএম মূসা পেশাগতভাবে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন ১৯৫০ সালে, যখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। সে সময় তিনি যোগ দেন ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায়। মুসা যে সময়টায় সাংবাদিকতায় আসেন তখন কেউ এই পেশায় আসতেন না। এ সম্পর্কে এবিএম মূসা বলেন, ‘পেশা নির্বাচনে কোনো শিক্ষিত যুবকের পক্ষে তখন সাংবাদিকতাকে বেছে নেওয়া অকল্পনীয় একটা ব্যাপার ছিল। তবু অনেকে সাংবাদিক হয়ে যেতেন অথবা সাংবাদিকতার জগতে পা রাখতেন অদম্য কোনো ইচ্ছাশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে, বলা যায়, কোনো এক নেশায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে অথবা কেউ সরকারি চাকরি না পেয়ে।’
এই অবস্থার মধ্যেই ‘পেশার চমকের’ টানে মুসা চলে আসেন সাংবাদিকতায়। কিন্তু ‘ইনসাফের’ মালিকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে সেই বছরই তিনি চলে যান ‘দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকায়। সেখানে তিনি একজন প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করতেন। তখন তিনি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান ব্রাদার্স ইউনিয়নের সঙ্গেও ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত হয়েছেন।
দেশ বিভাগের কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে মোহভঙ্গ হতে শুরু করে। তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, ব্রিটিশের গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যাঁতাকলে আটকে পড়ে যাচ্ছেন। বাঙালিদের পদে পদে বাধা। পশ্চিম পাকিস্তানের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তানের মূল নিয়ন্তা তারাই। বাঙালিদের কোনো অধিকার নেই। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসত নির্যাতনের খড়গ। এই অবস্থার মধ্যেই সারা দেশে বাঙলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। টগবগ করে ফুটছে এদেশের তরুণ সমাজ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে ১১ ফেব্রুয়ারি নুরুল আমিন সরকার তুচ্ছ অজুহাতে এই পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। বেকার অবস্থায় কিছুদিন কাজ করেন ফরিদপুরের ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়ার ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকায়। সেখানে নিয়মিত চাকরি করলেও বেতন মিলতো কদাচিৎ। পরে কাজ নেন ‘দৈনিক সংবাদে’। সংবাদ তখন প্রগতিশীলদের অন্যতম প্রধান কাগজ। সেখানে বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন সৈয়দ নুরুদ্দিন। তাঁকে এবিএম মূসা ‘গুরু’ বলে মানতেন। তবে সংবাদে কাজ নেওয়ার পর তাঁকে ঢাকা ছাড়তে হয়। তাঁকে চট্টগ্রামের ব্যুরো প্রধান করে পাঠায় সংবাদ কর্তৃপক্ষ। তবে চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিজয়ের পর আবার ‘দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার’ চালু হয়। তখন মূসা দৈনিক সংবাদ ছেড়ে আবার পুরনো কর্মস্থলে ফিরে আসেন। এবার অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দিয়ে বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতেই পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাব গঠনের পাশাপাশি গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে যুক্ত হন জাগো আর্ট সেন্টারের সঙ্গে। প্রেসক্লাবে বেশ কয়েকবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তখন এবিএম মূসার সাংবাদিক জীবনের প্রায় ১৫ বছর কেটে গেছে। এই সময়টার মোটা দাগে তিনি একটা মূল্যায়ন লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। তিনি লিখেছেন, ‘… আমার সাংবাদিক জীবনের শুরু থেকে দু-চার বছর বাদ দিয়ে বাকি বছরগুলো অতি চালাকি আর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কুমির আর হাঙর এড়িয়ে সাঁতরাতে হচ্ছে। সেই সাঁতরানো শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের মুসলিম লীগের আমলে। তাঁদের মতে, আপত্তিকর সংবাদ প্রকাশের কারণে জননিরাপত্তা আইনে (ব্রিটিশ আমলের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালের ইন্ডিয়ান সেফটি অ্যাক্ট) ভাষা আন্দোলন ও বিরোধী রাজনীতি বন্ধ করতে সব সাপ্তাহিক বন্ধ করে দেওয়া হলো। বন্ধ করে দেওয়া হলো ঢাকায় ‘সৈনিক’, ‘ইনসাফ’, ‘ইসলাম ও জিন্দেগি’, সিলেটের ‘নও- বেলাল’, ফেনীর ‘সংগ্রাম’, বাকি পত্রিকাগুলোর নাম মনে পড়ছে না। ১৯৫২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ‘পাকিস্তান অবজারভার’ এর সম্পাদক আবদুস সালাম ও মালিক হামিদুল হক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হলো। ভাষা আন্দোলনের সময় জগন্নাথ কলেজের বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের মিছিল মুসলিম লীগের সমর্থক ‘মর্নিং নিউজ’ পুড়িয়ে দিল। ‘পাকিস্তান অবজারভার’ সম্পাদক ও মালিককে আগুন দেওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।’
১৯৬১ সালের এপ্রিলে কমনওয়েলথ ফেলোশিপ নিয়ে লন্ডনে যান। ইন্টার্নশিপের অংশ হিসেবে হাতেকলমে কাজ করেন ওয়েলসের কার্ডিফের ‘ওয়েস্টার্ন মেইল’ পত্রিকায়। ফেলোশিপের আওতায় টমসন ফাউন্ডেশনে প্রতিদিন দু-চার ঘণ্টা বইপত্রও পাঠ করতে হতো। এই সময়ে সাংবাদিকতার ‘সবচেয়ে ফলপ্রসূ জ্ঞানার্জন’ করেন মধ্য ইংল্যান্ডের ডার্লিংটনের ‘নর্দান ইকো’তে। সেখানে বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক হ্যারি ইভান্সের কাছেই তিনি যেন নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন সংবাদপত্রকে, উন্মেষ ঘটান সাংবাদিক জীবনের। পরে সেই ‘ব্রিটিশ বিদ্যাই’ এদেশে এসে কাজে লাগিয়ে সংবাদপত্র জগতে যুগান্তর এনে দিলেন।
পাকিস্তান আমলেই ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থায়নের প্রেস ফাউন্ডেশন অব এশিয়ার উদ্যোগে জাপানে একটি প্রশিক্ষণে যান এবিএম মূসা। সেখানে প্রশিক্ষক শেষে ব্রিটিশ দৈনিক ‘সানডে টাইমস’ এর ঢাকা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর তিনি ‘বিবিসি’র ঢাকা প্রতিনিধি হিসেবেও নিয়োগ পান। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রনাঙ্গণ থেকে দায়িত্ব পালন করেন একজন কলমযোদ্ধা হিসেবে। জীবন বাজি রেখে তিনি সে সময় বিদেশি পত্রিকা ‘লন্ডন টাইমস’, ‘সানডে টাইমস’ ও ‘বিবিসি’-তে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খবর পাঠাতেন। ষাটের দশকে উত্তাল বাঙালির স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে গড়ে উঠা গণআন্দোলনের সময় থেকেই এবিএম মূসার সঙ্গে বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের সখ্যতা তৈরি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও স্নেহধন্য হন তিনি। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন এবিএম মূসা ‘মুজিব ভাই’।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে একদিন বঙ্গবন্ধুই মূসাকে ডেকে নিয়ে যান তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে। সেখানেই তিনি একরকম জোর করে বাংলাদেশ টেলিভিশনের দায়িত্ব নিতে বলেন। তারপর তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘মনিং নিউজ’ এর সম্পাদক পদে। ১৯৭৩ সালে দেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই নোয়াখালী-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন এবিএম মূসা। সেই নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন।
স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তা ও সদস্য। জাতির জীবনে আরেক কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়। দেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট সেই ভোরে বাড়ির পেছনের দেয়াল টপকে বেরিয়ে যান এবিএম মূসা। তারপর কিছুদিন ঢাকায় চিকিৎসক আবু আহমদ চৌধুরীর বাসায় ছিলেন। সেখান থেকে আগস্টের শেষ নাগাদ চলে যান লন্ডনে। সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেন বন্ধু সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর বাসায়। পরে সেখানে ছয় মাসের জন্য ‘সানডে টাইমসে’ খণ্ডকালীন গবেষণা সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান।
জিয়াউর রহমানের সময়ে দেশে ফিরে আসেন। তখন বেশ কিছুদিন বেকার ছিলেন। পরিবার নিয়ে তাঁকে কষ্টের মধ্যেই কাটাতে হয়েছে। এর মধ্যেই একদিন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সপ্তাহিক ‘নিউ নেশন’ পত্রিকায় উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে এই পত্রিকাটি দৈনিকে পরিণত হয়।
বৈরি রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই ১৯৭৮ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে জাতিসংঘ পরিবেশ কার্যক্রমের (ইউনেপ) ব্যাংককে অবস্থিত আঞ্চলিক কার্যালয়ে যোগ দেন। পরে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় কেনিয়ার নাইরোবিতে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মের ব্যাপ্তি ছিল অনেক। ফলে এই সময়ে জাপান, দু্ই কোরিয়া থেকে ইরান পর্যন্ত মধ্যবর্তী প্রায় ১৮টি রাষ্ট্রের সবকটিতেই তিনি সফর করেন। জাতিসংঘের এই কাজে তিনি ছিলেন প্রায় তিন বছর। যদিও জীবনের নানা সময়ে সাংবাদিকতা সূত্রে ইউনেসকো ও ইউনিসেফের আমন্ত্রণে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সব দেশেই যাওয়া হয়েছে তাঁর। পিআইএর অতিথি হয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। ১৯৬৪ সালের পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে যান চীনে।
এবিএম মূসা ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা- বাসসের মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে তিনি কিছুদিন ‘দৈনিক যুগান্তর’ এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখতেন, পাশাপাশি বিভিন্ন টিভি টকশোতেও অংশ নিতেন। পাঠক ও দর্শক মহলে বেশ নন্দিত ছিলেন তিনি।
‘পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে সোনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নকে ভেঙে সাংবাদিকদের অটুট ঐক্য ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিলেন ও পেশোয়ারে নিয়োজিত পাকিস্তান অবজার্ভারের সিনিয়র সংবাদ প্রতিনিধি আসকর আলী শাহকে আহ্বায়ক করে আইয়ুব খান ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস (এনইউজে) প্রতিষ্ঠার সুযোগ গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায়ও দৈনিক ‘পাসবান’ পত্রিকার বহুল আলোচিত চিফ রিপোর্টার ওয়াহিদ কায়সার নদভীকে এনইউজের প্রতিনিধি নির্বাচন করে শাখা গঠনের প্রয়াস নিয়েছিলেন। তাঁরা দু’জনই পূর্ব-পশ্চিমে খুবই বন্ধু মানুষ ছিলেন প্রখ্যাত ইউনিয়ন নেতা ও দক্ষ সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব খোন্দকার গোলাম মুস্তফা সংক্ষেপে কে জি মোস্তফা।
নদভী ও পেশোয়ারের শাহ সাহেব ওই সামরিক সরকার বিশেষ করে আইয়ুব খানের নির্দেশ অমান্য করতে না পেরে এই সংগঠনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানা সত্ত্বেও মুসা ভাই একদিন প্রেসক্লাবে নদভী সাহেবকে দেখতে পেয়েই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন এবং তাঁকে ধমক ও ভয় দেখিয়ে সোজা-সাপটা বলে ফেললেন : নদভী, তুমি যদি এখানে ওই এনইউজে প্রতিষ্ঠার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করো, তবে তোমাকে ক্লাবের দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেব। তখন বুঝবে! প্রখ্যাত ও পরিচিত উর্দুভাষী সাংবাদিক নদভী এবার সত্যিই একটি পা-ও ফেলেননি ওই ইউনিয়ন করার জন্য।
খালেদা জিয়ার আমলে সাংবাদিক ইউনিয়নকে ভেঙে দুই টুকরো করা হয়েছিলো, তাকে জোড়া লাগানোর জন্য মূসা ভাই আবার ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলেন এবং কে জি মুস্তফা, নির্মল সেন আর আমি বসলাম। কিন্তু সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিলো।’
সাংবাদিকতা পেশা আর সংবাদকর্মীদের অধিকার আদায়ে এবিএম মূসার অনন্যতা তুলে ধরার জন্যই সমসাময়িক কামাল লোহানী ‘অনন্য মূসা ভাই’ লেখায় এই কথাগুলো বলেছিলেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যে আর এক হতে পারেননি এ নিয়েও খেদ ছিলো মূসার মধ্যে। শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন দুই-কে এক করার।
সাংবাদিকতার মতো পারিবারিক জীবনেও সফল ছিলেন এবিএম মূসা। তিনি সারাজীবনই এর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন স্ত্রী সেতারা মুসার প্রতি। সেতারা মুসাও সাংবাদিক। তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকা দিয়ে তার সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু। পরিবার পরিকল্পনা সমিতি ও রেডক্রসের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ মহিলা সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৮৬ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা আসনের কমিশনার ছিলেন। বিয়ের পর সংসার সামলানোর পাশাপাশি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। সেতারা মূসা ছিলেন অবজারভারের তৎকালীন সম্পাদক আব্দুল সালামের মেয়ে। সেতারা সম্পর্কে মুসার আপন মামাত বোন। এবিএম মূসা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আত্মজীবনী লিখেছিলেন ‘আমার বেলা যে যায়’। সেই আত্মজীবনী তিনি শেষ করেছিলেন পরিবারের ইতিবৃত্ত টেনে। সেখানে তিনি জীবনের সেই রোমান্টিক দিনগুলোর বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘ঢাকায় এলাম ১৯৫০ সালে, উঠলাম সেই বড় মামার (আবদুল সালাম) বাসায় টিকাটুলিতে। সেখানেই ১৯ বছরের যুবকটির সঙ্গে প্রথম দেখা হলো ১০ বছরের খুকিটির। একসময় যুবকের বয়স হলো ২৪ বছর। মামার বাসা ছেড়ে সে ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জন্ট জহুরুল হক হল) গিয়ে উঠলাম। ইতিমধ্যে খুকিটি হলো ১৫ বছরের কিশোরী। যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ছেড়ে চলে এল কাছেই গোপীবাগে। প্রথমে চোখের ইশারা, চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে খুঁটিনাটি কৃত্রিম ঝগড়া, তারপর ভালোবাসাবাসি। একদিন মেয়েটি স্কুল পালিয়ে এল, ছেলেটি তাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল তার ব্রাদার্স ইউনিয়নের দুই সাথিসহ নারিন্দা কাজি অফিসে। রেজিস্ট্রি বিয়ের পর মেয়েটি স্কুল ছুটির পর বাসায় গেল। খবরটি বেশিদিন চাপা দেওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত ছোট মামার ঘটকালিতে দুই পক্ষের সম্মতিতে সামাজিক বিয়ে হলো।’
এবিএম মূসা আর সেতারা মূসার তিন মেয়ে, এক ছেলে। সবার বড় মেয়ে মরিয়ম সুলতানা। কাজ করতেন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। মেজো মেয়ে পারভিন সুলতানা ঝুমা। সাংবাদিক। ছোট ছেলে চিকিৎসক। সবার ছোট মেয়ে শারমিন মূসা সুমি পড়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবিএম মূসা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন মানুষের পাশে থেকে মানুষকে সাহায্য করার। কিন্তু এর জন্য কোনো প্রচার তিনি চাননি। মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের জন্য দুটি বৃত্তি চালু করেন। প্রথিতযশা সাংবাদিক আতাউস সামাদ এবং আবদুস সালামের নামে এ দুটি বৃত্তি চালু করে তিনি মোট ৪০ লাখ টাকা দান করেন। কিন্তু শর্ত ছিল, এর কোনো প্রচার করা যাবে না। এবিএম মূসা জীবিত থাকাকালে সেটি কেউ জানতই না। মৃত্যুর পর অনুরাগীরাই সেটি সামনে নিয়ে আসেন।
তথ্যসূত্র : আমার বেলা যে যায়- এ বি এম মুসা, প্রকাশক : প্রথমা, প্রকাশকাল : ২০১৪। এবং ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত।
লেখক: চন্দন সাহা রায়