১৯৫২ সাল, পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনমুখর। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন মিছিলে গুলিবর্ষণ হলো। ভাষার জন্য জীবন দিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে ভাষা শহীদদের মৃতদেহ দেখার জন্য ছাত্র-জনতার ভিড় জমে গেল। শহীদ বরকতের মৃতদেহ দেখে সেদিন ঢাকা কলেজের এক ছাত্রের ভাবান্তর হলো অন্যরকম। তাঁর মনে হলো, বরকত তো আর অন্য কেউ নয় সে যেন তাঁরই ভাই। মনের ভেতর তৈরি হলো তাঁর কবিতার লাইন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ এভাবেই লেখা হয়ে গেল একটি দীর্ঘ কবিতা। সেদিনের কলেজ পড়ুয়া মাত্র আঠারো বছর বয়সী ওই তরুণের নাম হচ্ছে আবদুল গাফফার চৌধুরী। তার সেই দীর্ঘ কবিতাটিতে প্রথমে সুর দেন আবদুল লতিফ। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরে ওই কবিতাটি প্রভাত ফেরির গান হিসেবে অমর একুশের ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে। যতদিন একুশে ফেব্রুয়ারি থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবে ওই গান আর বাঙালী জাতি স্মরণ করবে একজন আবদুল গাফফার চৌধুরীকে।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৩৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর বরিশাল জেলার এক জলবেষ্টিত গ্রাম উলানিয়ার চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হাজী ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মত্ জহুরা খাতুন। গাফফার চৌধুরীরা তিন ভাই, পাঁচ বোন। বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম।
এক সাক্ষাত্কারে গাফফার চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের পরিবারটা ছিল একটি জমিদার পরিবার। সবাই বলত উলানিয়ার জমিদার বংশ। তখন বরিশালে মুসলিম জমিদার তেমন ছিল না বললেই চলে। শায়েস্তাবাদের নবাব বংশও ছিল আর একটি দুর্লভ মুসলিম জমিদার বংশ। পারিবারিকভাবে এদের সঙ্গে যুক্ত ডক্টর কামাল হোসেন। উলানিয়ায় আমাদের পারিবারিক জমিদারিটা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক জমিদারি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ট্যাগোর এস্টেটের অংশ ছিল। ১৯৫৪ সালে জমিদারি উচ্ছেদের সঙ্গে তাদের ভূ-স্বামিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়।’ তবে এর অবক্ষয় শুরু হয়েছিল আগে থেকেই। উলানিয়া গ্রামটি ছিল বেশ সম্পন্ন ও সমৃদ্ধ। সেখানে ছিল একটি জুনিয়র মাদ্রাসা, একটি ইংলিশ হাই স্কুল, সুন্দর একটি জামে মসজিদ ও একটি ঈদগাহ। মুসলিম প্রধান এলাকা হলেও স্কুলে আরবি শিক্ষক ছাড়া আর সব শিক্ষকই ছিলেন হিন্দু। হেডমাস্টার প্রতাপ চন্দ্র গুহ ছিলেন এম.এস.সি., বি.এল.। অন্য শিক্ষকদের সবাই ছিলেন গ্র্যাজুয়েট।
শিক্ষা জীবন
আবদুল গাফফার চৌধুরীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় স্থানীয় মাদ্রাসায়। উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে তিনি হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে এই হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে অনার্স পাস করেন। গাফফার চৌধুরী তাঁর শিক্ষা জীবন সম্পর্কে বলেছেন, ‘মাদ্রাসায় আমার শিক্ষা জীবন শুরু হলেও সেখানে বাংলা ও ইংরেজিও পড়ানো হতো। সেখানকার পরিবেশটা ছিলো অনেক খোলামেলা।’ ১৯৪৬ সালে পিতার মৃত্যুর পর তাঁকে চলে আসতে হয় বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে। সেসময়ে আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। বরিশাল শহরে তিনি কিছুদিন একটি মার্কসবাদী দল আরএসপি’র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্র জীবনেই তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয়। বরিশালের সন্তান শামসুদ্দীন আবুল কালামের লেখা তখন কলকাতার প্রধান পত্রিকাগুলোতে ছাপা হতো। তিনিও গাফফারকে লেখালেখিতে উত্সাহিত করতেন। তাঁদের মধ্যে প্রায়ই সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা চলতো।
কর্মজীবন
১৯৪৭ সাল থেকে স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করলেও ১৯৫০ সালেই গাফফার চৌধুরীর কর্মজীবন পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন বেতন পেতেন ৭০ টাকা। মহিউদ্দিন আহমদ ও কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ তখন ’দৈনিক ইনসাফ’ পরিচালনা করতেন। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। জুনিয়র ট্রান্সলেটর হিসেবে মাসিক বেতন পেতেন ১শ’ টাকা। এরপর তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফফার চৌধুরী। এসময় তিনি ‘মাসিক নকীব’ও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছরই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা ‘মেঘনা’র সম্পাদক হন। ১৯৫৮ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ এর সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুক’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু কিছুদিন পর সামরিক শাসন চালু হলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি মাওলানা আকরম খাঁ’র ‘দৈনিক আজাদ’-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদীর’ও স্বল্পকালীন সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি দৈনিক ‘জেহাদ’-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামেন এবং ”অনুপম মুদ্রণ’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দু’বছর পরই আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে ‘দৈনিক আওয়াজ’ বের করেন। সেটা বছর দুয়েক চলেছিল। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে সহিংস বিবাদ শুরু হলে তিনি আবার যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে’। ১৯৬৯ সালের পয়লা জানুয়ারি ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া মারা গেলে তিনি আগস্ট মাসে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক ‘পূর্বদেশ’-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপাত্র ‘সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’য় লেখালেখি করেন। এসময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘দৈনিক জনপদ’ বের করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে চিকিত্সার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাঁকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এরপর তাঁর প্রবাস জীবনের ইতিহাস শুরু হয়। বিলেত যাওয়ার পর প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি ‘বাংলার ডাক’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ‘সাপ্তাহিক জাগরণ’ পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সাতজন অংশীদার নিয়ে ‘নতুন দিন’ পত্রিকা বের করেন। এরপর ১৯৯০ সালে ‘নতুন দেশ’ এবং ১৯৯১ সালে ‘পূর্বদেশ’ বের করেন। প্রবাসে বসে এখনও গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন।
পারিবারিক জীবন
আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সেলিমা আফরোজকে বিয়ে করেন। তাঁর এক ছেলে অনুপম আহমেদ রেজা চৌধুরী ও চার মেয়ে তনিমা, চিন্ময়ী, বিনীতা ও ইন্দিরা।
সম্মাননা, স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা
আবদুর গাফফার চৌধুরী ১৯৬৩ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার পান। এছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমী পদক, একুশে পদক, শেরেবাংলা পদক, বঙ্গবন্ধু পদকসহ বাংলাদেশের প্রধান পুরস্কারের প্রায় সব ক’টিই পেয়েছেন। সাংবাদিকতায় যেমন তাঁর অবদান আছে তেমনি একজন সুসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান হয়েছেন । দেশে-বিদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছে, সম্মাননা দিয়েছে।
ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
পেশায় সাংবাদিক হলেও আবদুল গাফফার চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীকালে আর সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির সঙ্গে সবসময়ই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছেন। এছাড়া সাহিত্যকর্মী হিসেবে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কাজ করেছেন সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়। তরুণ বয়সে প্রচুর কবিতা লিখেছেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ও তখনই লেখা। এছাড়া গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাস ও রাজনৈতিক প্রবন্ধও লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে আছে ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’, ‘বাঙালি না বাংলাদেশী’ প্রভৃতি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় তিরিশটি।
এছাড়াও তিনি কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখেছেন। এর মধ্যে আছে ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’, ‘একজন তাহমিনা’ ও ‘রক্তাক্ত আগস্ট’। ডকুড্রামা ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’ তুমুল আলোচনার ঝড় তুলেছে। প্রবাসে বাস করলেও আবদুল গাফফার চৌধুরী বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন।
লেখক : সৌমিত্র দেব