স্কুলে উঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়। বিশেষ করে ‘প্রার্থনা’ কবিতাটি খুব ভাল লেগে যায়।
‘বল দাও মোরে বল দাও,
প্রাণে দাও মোরে শক্তি,
সকল হৃদয় লুটায় তোমারে করিতে প্রণতি।
সরল সুপথে ভ্রমিতে, সব অপকার ক্ষমিতে,
সকল গর্ব দমিতে, খর্ব করি যে কুমতি।’
এটি একটি বাক্ষ্র উপাসনা-সংগীত। এই সময়ের একটি ঘটনা সালাহ্উদ্দীনের আজো মনে আছে। তখন তিনি মার কাছে নামাজ শিখছেন। হঠাৎ তাঁর একদিন খেয়াল হল, নামাজের শেষে তো প্রার্থনা করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই প্রার্থনাটি অনেক ভাল, তাহলে এটা পাঠ করলেই তো হয়। তিনি মাকে বললেন, ‘তুমি যেভাবে আমাকে নামাজ শিখিয়ে দিয়েছ সেভাবেই শুরু করব কিন্তু শেষ করব রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি দিয়ে। এটাও তো প্রার্থনা।’ মার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। মা ছেলের কথা শুনে অবাক হলেন। প্রথমে তিনি কিছুই বললেন না। পরে একটু স্মিত হেসে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘তোমার যা ভাল লাগে সেভাবে কর। আমার কিছুই বলার নেই। আমি যা জানতাম সেভাবেই তোমাকে শিখিয়েছি।’
তাঁর মার এ কথা থেকে তাঁর পরিবারের উদারতার পরিচয় পাওয়া যায়। এরকম উদার পরিবেশেই বড় হয়ে উঠেছেন তিনি এবং সারা জীবন সেই মুক্ত পরিবেশের জন্য মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে গেছেন। আর এই উদার পরিবেশে বেড়ে ওঠা সালাহ্উদ্দীন আহমেদ পরবর্তী জীবনে হয়েছেন একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ।
ড. সালাহ্উদ্দীন আহমেদের জন্ম ১৯২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে। কিন্তু একাডেমিক সার্টিফিকেটে তাঁর জন্ম সাল দেয়া আছে ১৯২৪। তাঁর পুরো নাম আবুল ফয়েজ সালাহ্উদ্দীন আহমেদ। ফরিদপুরে পূর্ব পুরুষদের বাড়ি এবং সেখানে জন্ম হলেও পিতার চাকুরির কারণে খুব বেশি সময় সেখানে কাটেনি তাঁর। ছেলেবেলা ও শিক্ষাজীবনের অধিকাংশ সময়টাই কেটেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। বাবা ফয়জুল মহিন ছিলেন সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর দাদাও ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ফলে বাবার চাকুরির সূত্রেই ঘুরে বেরিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। নানা স্থানে ঘুরে বেড়ানো, নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষের সাথে মেশাকে জীবনের অনেক বড় সঞ্চয় বলে মনে করেন ড. সালাহউদ্দীন আহমেদ। তিনি জীবন কাটিয়েছেন একেবারে নিজের মতো করে মুক্ত বিহঙ্গের মতো। কোনো পিছুটান ছিল না। বরং এতে উৎসাহই দিতেন মা আকিফারা খাতুন। মা ছিলেন খুবই ধার্মিক। তাঁর কাছেই সালাহ্উদ্দীন আহমেদ ছোটবেলায় কোরাণ শরীফ পড়া শিখেছেন। সাত-আট বছরের মধ্যেই তিনি কোরাণ মুখস্থ করে ফেলেন। বাড়িতে চল ছিল উর্দু আর বাংলা ভাষার। তাঁদের পরিবারটি ছিল ধর্মের প্রতি অনুরক্ত, কিন্তু কোনো গোঁড়মি কারো মধ্যে ছিল না। বাড়িতে একটা মুক্ত পরিবেশ সবসময়ই ছিল। সালাহ্উদ্দীন আহমেদরা তিন ভাই ও তিন বোন। তিনি সবার বড়। অন্য ভাই-বোনরাও উচ্চশিক্ষিত।
সালাহ্উদ্দীন আহমেদের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি নিজের বাড়িতেই। গৃহশিক্ষক ছিলেন কবি কাজী হাসমত উল্লাহ। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের আত্মীয় ছিলেন। তিনি মূলত বাংলা ও ইংরেজি পড়াতেন। হাসমত উল্লাহ নিজে যেহেতু কবি ছিলেন সেকারণে খুবই সুললিত উচ্চারণে পড়াতেন। এটা সালাহ্উদ্দীনকে খুব টানত। পরে ১৯৩০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া জেলা স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ভর্তির দিন পরিবারের কেউ তাঁকে স্কুলে নিয়ে যায় নি। বন্ধুবান্ধবদের সাঙ্গে তিনি গিয়েছিলেন তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হবেন বলে। কিন্তু মাস্টারমশাই পরীক্ষা নিয়ে বললেন, চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে যাও।
সেসময় রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ নামের কবিতাটি তাঁর জীবনবোধ বদলে দিতে সাহায্য করে। এই কবিতাটি তিনি একেবারে মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। এর মধ্যেকার দেশপ্রেম আর মানবতাবোধগুলোই পরে সালাহ্উদ্দীন আহমেদকে সমাজতন্ত্রের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। নিপীড়িত মানুষের প্রতি মমত্ববোধ সেখান থেকেই অর্জন করা। আর সেইসাথে সারা জীবনের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন তিনি।
এক-দেড় বছর পরেই বাবা বিষ্ণুপুর বদলি হয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিনি এমন এক শিক্ষকের দেখা পান যিনি তাঁকে গল্প উপন্যাস পড়তে শিখিয়েছেন। সেই মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে ছিল বিশাল লাইব্রেরি। সেখান পাওয়া যেত সব ধরনের বই। তারপর ১৯৩৫ সালে কিছুদিনের জন্য ফরিদপুর চলে যান তাঁরা। তখন তিনি ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে প্রায় এক বছর পড়ার পর আবার কলকাতায় চলে যান। ছেলেবেলায় তিনি কমপক্ষে দশটি স্কুলে পড়েছেন। শেষ পর্যন্ত কলকাতার আলিপুরের তালতলা হাই স্কুল থেকে ১৯৩৮ সালে মেট্রিক পাশ করেন।
একই বছর তিনি ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন কলকাতার রিপন কলেজে। সেসময় এই কলেজেই অধ্যাপনা করতেন বাংলা সাহিত্যের অনেক দিকপাল। এদের মধ্যে ছিলেন বাংলা বিভাগে প্রমথনাথ বিশী, ইংরেজি বিভাগে বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে, ইতিহাস বিভাগে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এই শিক্ষকদের অনেকের সাথেই তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ বোধ করলেন হীরেণ মুখার্জির প্রতি। শুধু সালাহ্উদ্দীন নয়, আরো অনেককেই সেসময় হীরেণ মুখার্জি বেশি আকৃষ্ট করতেন। তার কারণ তাঁর পড়ানোর ভঙ্গি ছিল অনবদ্য। তাঁর তীক্ষ্ণ সমাজ সচেতনতা এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি গভীর অনুরাগও ছিল অন্যতম প্রধান কারণ। সালাহউদ্দীন তখন নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং তার নেতাদের সাথেও যোগাযোগ করতে শুরু করেন।
এই সময়েই অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে তিনি সাক্ষাৎ পান ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত মানবেন্দ্রনাথ রায়ের। যিনি এম. এন. রায় হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তখন সবে জেলখানা থেকে বেরিয়েছেন। তারপর কংগ্রেসে যোগ দেন। তাঁর নীতি ছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ভিন্ন। যে কারণে কমিউনিস্টরা তাঁকে সেসময় ‘কংগ্রেসের দালাল’ বা ‘ব্রিটিশের দালাল’ বলে গালাগাল দিত। কিন্তু এম. এন. রায়ের সাথে আলাপ করতে গিয়ে সালাহ্উদ্দীন তাঁর পথের প্রতিই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এম. এন. রায়ের নীতি ছিল কংগ্রেস একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্ম এখান থেকেই গণমানুষের কর্মসূচীকে অগ্রসর করে নিতে হবে। একে ব্যবহার করতে হবে। গণমানুষের সাথে সম্পর্ক ছাড়া কোনো নীতি বা আদর্শ টিকতে পারে না। কমিউনিস্ট পার্টি যেহেতু নিষিদ্ধ তাই সবার কংগ্রেসেই কাজ করা উচিত। সালাহউদ্দীন আহমেদ যখন কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় আসেন তখন একবার এম. এন. রায় – এর সাথে তাঁর দেখা হয়েছিল। তখন এম. এন. রায়ের একটি সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন সালাহ্উদ্দীন আহমেদ।
১৯৪০ সালে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাস বিভাগের অনার্স শ্রেণীতে। সালাহ্উদ্দীনের মনে হল অন্যান্য জায়গার তুলনায় এটা একেবারেই নতুন জগত। এই কলেজে এসে পেলেন ইতিহাসের আরেক দিকপাল অধ্যাপক সুশোভন সরকারকে। কলকাতায় তখন নানা সময়ে দাঙ্গা হচ্ছে। একই সঙ্গে তুঙ্গে উঠেছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। এর মধ্যেই ১৯৪২ সালে অনার্স পরীক্ষা দেয়ার কথা কিন্তু সে বছর আর পরীক্ষা দিলেন না। ১৯৪৩ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে ইতিহাসে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৪৫ সালে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন।
এম.এ. পাশ করার পর সালাহ্উদ্দীন রাজনীতির প্রতি গভীর টান থেকেই কোনো চাকুরিতে না গিয়ে যোগ দেন শ্রমিক আন্দোলনে। শ্রমিকদেরকে সংগঠিত করতে কাজ শুরু করেন কলকাতার খিদিরপুরে পোর্ট ট্রাস্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন-এ। তিনি এই সংগঠনটির সহকারী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে কাজ করতেন পোস্ট ও টেলিগ্রাফ শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যেও। বেঙ্গল পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন অনেক দিন। পরে শ্রমিক আন্দোলন ছেড়ে দিয়ে ভারতীয় রেডক্রস সোসাইটির পূর্ণকালীন কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা কোনোদিন তিনি ভুলতে পারবেন না।
এই দাঙ্গার পর ১৯৪৬ সালেই বন্ধু জহুর হোসেন চৌধুরীর সুবাদে পরিচয় হয় ফরিদপুরের মেয়ে হামিদা খানমের সাথে। হামিদা খানম তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. করে লেডি ব্রেবোন কলেজের দর্শনের অধ্যাপিকা। সালাহউদ্দীন ইন্ডিয়ান রেডক্রস সোসাইটিতে কাজ করেন, কুমিল্লায় থাকেন। ১৯৪৭ সালে আগষ্ট মাসে হামিদা খানম উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডন যাওয়ার আগেই বিয়ের কথা হয় দু’জনের। কিন্তু লন্ডন থেকে ফিরে এসে বিয়ে করার কথা জানান হামিদা। দু’জনের সম্পর্ক ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো। শেষে ১৯৪৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় বিয়ে করেন তাঁরা। পরে হমিদা খানম ঢাকার হোম ইকনোমিক্স কলেজের অধ্যক্ষা হিসেবে অবসর নেন। তাঁরা নিঃসন্তান।
১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে সালাহ্উদ্দীন আহমেদ ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ইতিহাস বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। এখানে প্রায় ছয় বছর একটানা কাজ করেন। এখানে পড়ানোর সময়েই ঘটে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। তখন জগন্নাথ কলেজে ‘জগন্নাথ কলেজ বাংলা সংস্কৃতি সংসদ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। অজিত গুহ ছিলেন এই সংগঠনটির প্রাণ। সালাহ্উদ্দীন আহমেদসহ অন্যান্য শিক্ষকরা এখান থেকেই ছাত্রদের ভাষা আন্দোলনে উৎসাহিত করতেন। এর জন্য অবশ্য তাঁদেরকে কলেজের পাকিস্তানপন্থী শিক্ষকদের নানা কটু কথা শুনতে হতো। ১৯৫৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবার পর সেখানে তিনি ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন। পরে পর্যায়ক্রমে তিনি ওই বিভাগের রিডার ও প্রফেসর-এর পদে উন্নীত হন। ইতোমধ্যেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। সালাহ্উদ্দীন আহমেদ যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তখন সেখানে আরো একঝাঁক প্রতিভাবান মানুষ তাঁর সহকর্মী হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তখন সত্যিকার অর্থেই সাহিত্যের তীর্থভূমি। কবি ও সাহিত্যিক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তাফা নুরউল ইসলামের সম্পাদনায় বের হয় ‘পূর্বমেঘ’-এর মতো বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা। লোক গবেষক কবি মযহারুল ইসলাম বের করেন ‘উত্তর অন্বেষা’। রাজশাহী থেকে বের হয় আরো তিনটি সাহিত্য পত্রিকা ‘সুনিকেত মল্লার’, ‘বনানী’ ও ‘একান্ত’। আর অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক বদরুদ্দীন উমর, অধ্যাপক মশাররফ হোসেন, হাসান আজিজুল হক, গোলাম মুরশিদ, সনৎ কুমার সাহা, আবদুল হাফিজ, আলী আনোয়ার সবাই মিলে যেন এক শিল্প-সাহিত্যের রাজত্ব তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এদিকে তখন আইয়ুবের আমল চলছে দেশে। সেসময় ছাত্ররা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ পুষ্ট হতে শুরু করেছে। প্রায়ই তাঁদের বিভিন্নভাবে শেল্টার দেয়া, পুলিশের গ্রেফতার এড়ানো, তাদেরকে ঠিকমত পরিচালনা করা এসব দায়িত্ব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক আজিজুর রহমান মল্লিক, ড. সালাউদ্দিন আহমদ, ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী, ড. মোশারফ হোসেন, ড. রাকিব, ড. মোস্তাফা নূর-উল-ইসলামসহ অন্য শিক্ষকরা কম-বেশি পালন করতেন। এজন্য শিক্ষকদের বেশ ঝুঁকিও নিতে হয়। প্রিয় ছাত্রদের জন্য ঝুঁকিও নিয়েছেন তাঁরা। সেসময় পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের কারণে অনেককেই ‘দেশবিরোধী’ ও ‘সরকার বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হতো। আর বরাবরই গণতন্ত্রপন্থী-প্রগতিশীল শিক্ষকদেরকে কোর্টে গিয়ে ছাত্রদের জন্য জামিনদার হতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সহ অন্য অনেক শিক্ষক এ ব্যাপারে তাঁদের নিরুৎসাহিত করলেও প্রগতিশীল শিক্ষকরা একাজ করতেন নিজের তাগিদেই। শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে আবার অনেকেই সরকারের গোয়েন্দা হিসেবেও কাজ করতেন। ১৯৫৬ সালে সালাহ্উদ্দীন আহমেদ কিছুদিনের জন্য জাপানের ‘ইউনেস্কো কালচারাল ফেলো’ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে গোটা ষাটের দশক উত্তাল রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে। ‘৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৪-র শ্রমিক আন্দোলন, ‘৬৬-র ছয় দফা, ছাত্র সমাজের এগার দফা নানা দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিপুষ্ট হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ স্বায়ত্বশাসনের দাবি বাদ দিয়ে সরাসরি স্বাধীনতার দাবিই উত্থাপন করেন। আইয়ুব খান তখন পাকিস্তানের শাসক। পশ্চিম পাকিস্তানে থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করেন মৌলিক গণতন্ত্রের নামে। এ দেশে তার চেলা মোনায়েম খাঁ আর নূরুল আমীন। পূর্ব বাংলায় তখন গোটা দেশ উত্তাল বিক্ষোভ-মিছিল-মিটিংয়ে। প্রায় প্রতিদিন টানটান উত্তেজনা। উত্তপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও। তার মধ্যেই আসে ১৯৭১ সাল। সালাহ্উদ্দীন আহমেদ রাজশাহী থেকে চলে আসেন ঢাকায় স্ত্রীর কাছে। হামিদা খানম তখন হোম ইকনোমিক্স কলেজের অধ্যক্ষ। ক্যাম্পাসের ভিতরেই কোয়াটারে থাকেন। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ।
২৫ মার্চ গভীর রাতে নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। প্রথম হত্যাকান্ড চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারকীয় তান্ডব তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ইকবাল হলের আশেপাশে গুলি, মেশিনগান, মর্টারের শব্দে কান পাতা দায়। সারা ক্যাম্পাস জুড়ে শুধুই আগুন। যেন মৃত্যু উপত্যকা। তাঁরা সবাই ঘরের বাইরে কান পেতে বসে থাকেন। সারা রাত মৃত্যু আতঙ্কে কাটে সবার। ভোরে কয়েকজন পাকিস্তানি আর্মি তাঁদের বাড়ির গেইটে এসে আঘাত করতে শুরু করে। ভিতর থেকে তখন গেইট খুলে দেওয়া হয়। জোয়ানরা তেমন কিছু না করেই চলে যায়। এরপর আরো একদিন আসে পাকিস্তানি হানাদাররা। কিন্তু সেদিনও মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যায় সালাহ্উদ্দীন আহমেদের পরিবার। শেষে তাঁরা হামিদা খানমের কলেজ কোয়ার্টার ছেড়ে চলে আসেন ইস্কাটনে বিখ্যাত শিল্পী আব্দুল আহাদের বাসায়। আব্দুল আহাদ ও হামিদা খানম ছিলেন আপন ভাই-বোন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো মাসটিই জীবন-মৃত্যুকে সাথী করে ঢাকাতেই ছিলেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে ড.সালাহ্উদ্দীন আহমেদ যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে। সেখানে প্রায় ছয় বছর কাজ করে ১৯৭৮ সালের শেষদিকে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত চাকুরি থেকে অবসর নেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো কয়েক বছর সংখ্যা অতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। কিছুদিন কাজ করেন বেসরকারি ইন্ডিপেন্ডেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়াও সালাহ্উদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের সদস্য-পরিচালক।
ড. সালাহ্উদ্দীন আহমেদ শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন-যাপন করছেন। সালাহ্উদ্দীন আহমেদের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ‘Social Ideas and Social Change in Bengal 1818-1835′, ‘Bangladesh : Traditional and Transformation’, ‘বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ’, ‘স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব বরণীয় সুহৃয়’ প্রভৃতি।
সালাহ্উদ্দীন আহমেদ ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: ড. সালাহ্উদ্দীন আহমেদের জন্ম ১৯২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে। কিন্তু একাডেমিক সার্টিফিকেটে তাঁর জন্ম সাল দেয়া আছে ১৯২৪। তাঁর পুরো নাম আবুল ফয়েজ সালাহ্উদ্দীন আহমেদ। বাবার নাম ফয়জুল মহিন। মার নাম আকিফারা খাতুন।
পড়াশুনা: সালাহ্উদ্দীন আহমেদের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি নিজের বাড়িতেই। পরে ১৯৩০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া জেলা স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ছেলেবেলায় তিনি কমপক্ষে দশটি স্কুলে পড়েছেন। শেষপর্যন্ত কলকাতার আলিপুরের তালতলা হাই স্কুল থেকে ১৯৩৮ সালে মেট্রিক পাশ করেন। একই বছর তিনি ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন কলকাতার রিপন কলেজে।
ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর তিনি ১৯৪০ সালে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাস বিভাগের অনার্স শ্রেণীতে। এর মধ্যেই ১৯৪২ সালে অনার্স পরীক্ষা দেয়ার কথা কিন্তু সে বছর আর পরীক্ষা দিলেন না। ১৯৪৩ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে ইতিহাসে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৪৫ সালে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
বিয়ে: ১৯৪৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর হামিদা খানমের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতি নিঃসন্তান।
চাকরি জীবন: ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে সালাহ্উদ্দীন আহমেদ ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ইতিহাস বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। এখানে প্রায় ছয় বছর একটানা কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবার পর সেখানে তিনি ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন। পরে পর্যায়ক্রমে তিনি ওই বিভাগের রিডার ও প্রফেসর-এর পদে উন্নীত হন। ইতোমধ্যেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে সালাহ্উদ্দীন আহমেদ কিছুদিনের জন্য জাপানের ‘ইউনেস্কো কালচারাল ফেলো’ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন।
দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে ড. সালাহ্উদ্দীন আহমেদ যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে। সেখানে প্রায় ছয় বছর কাজ করে ১৯৭৮ সালের শেষদিকে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত চাকুরি থেকে অবসর নেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো কয়েক বছর সংখ্যা অতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। কিছুদিন কাজ করেন বেসরকারি ইন্ডিপেন্ডেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়াও সালাহ্উদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের সদস্য-পরিচালক।
মৃত্যু : ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর।
তথ্যসূত্র: এই লেখাটি তৈরি করার জন্য জানুয়ারী, ২০১০ এ ড. সালাহউদ্দীন আহমেদের সাক্ষাৎকার এবং তাঁর প্রকাশিত বিভিন্ন পুস্তকের সাহায্য নেয়া হয়েছে।
লেখক : চন্দন সাহা রায়