দাদা সাহিত্যিক সৈয়দ এমদাদ আলী আর নানা যদি কবি গোলাম মোস্তফা হন তাহলে তাঁদের নাতিটির কবি-সাহিত্যিক হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ছেলেটির মধ্যে সেরকম সম্ভাবনাও দেখছিলেন তাঁর চারপাশের মানুষজন। ভগ্নস্বাস্থ্যের ছেলেটি ছয়- সাত বছর বয়সেই যেন নিজস্ব একটা জগত্ গড়ে তুলেছিল। যে বয়সে স্কুলের বন্ধুদের সাথে দুরন্তপনায় মেতে থাকার কথা সে বয়সেই ছেলেটি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না পরিবারে অথবা বাইরে। মা ধরে নেন ছেলেটি নানার মতোই বিখ্যাত কবি হবে। আর ইতিহাসের শিক্ষক বাবা মনে মনে স্বপ্ন দেখেন ছেলেটি একদিন স্থপতি হবে। বাবা তাঁর সেই স্বপ্ন ছেলেটির মধ্যে সংক্রমিত করতে শুরু করেন নানা ভাবে। আর সেই ছেলেটিও বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ করেছিল। বাবার স্বপ্ন পূরণ করা সেদিনের সেই স্বল্পভাষী ছেলেটি দেশের বিখ্যাত স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে যাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি হিসাবে।
১৯৬৫ সাল। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে। সদ্য কৈশোরে পা রাখা (বারো-তোরো বছর) ছিপছিপে গড়নের ছেলেটি ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়। হাঁটতে তাঁর ভাল লাগে। ফরিদপুর জেলা স্কুল ছুটি হয়ে গেলে সহজ ও প্রচলিত পথে বাসায় না ফিরে পড়ন্ত বিকেলের রোদ অথবা ছায়া পড়া রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বাসায় ফেরে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শোনে যুদ্ধের কথা। ছেলেটি সম্প্রতি জানতে শুরু করেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা। দেশে দেশে দ্বন্দ্ব-বিবাদ হয়। এই দ্বন্দ্ব পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়। গুলি হয়, বোমা ফাটে, মানুষ মরে। বাচ্চা- বুড়ো, নারী-পুরুষ কেউ রেহাই পায় না। যুদ্ধের ভাবনা ছেলেটিকে ছাড়ে না। বাসায় যতক্ষণ থাকে চুপ করে থাকে। কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। রাতে পড়ার টেবিলে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে যুদ্ধের ছবি আঁকে। কিশোরের কল্পনায় যুদ্ধের ভয়াবহতা যতটুকু ধরা পরে ততটুকুই ফুটে ওঠে তাঁর আঁকা ছবিগুলোতে। কাউকে না দেখিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠার ভাঁজে লুকিয়ে রাখে সেই ছবিগুলো। বাবা-মায়ের কিছুটা দুশ্চিন্তা হতো দুই ভাই এক বোনের সংসারে বড় ছেলেটি কেন এত চাপা স্বভাবের। বাবা, মা কি সেদিন জানতেন, সাভার স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে তাঁদের এই চাপা স্বভাবের ছেলেটিকেই বাংলাদেশের মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে একদিন?
বাবা সৈয়দ মুজিবুল হক আর মা রাশিদা হকের তিন সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান সৈয়দ মাইনুল হোসেনের জন্ম ১৯৫২ সালের ১৭ই মার্চ। জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ীর দামপাড়া গ্রামে। বাবার পেশা ছিল অধ্যাপনা। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ইতিহাস পড়াতেন তিনি। সন্তানদের লেখাপড়া ও মননশীলতার কথা চিন্তা করে পুরো পরিবার নিয়ে নিজের কর্মস্থল অর্থাৎ ফরিদপুর শহরে বসবাস করতে শুরু করেন সৈয়দ মুজিবুল হক। তাই মুন্সীগঞ্জের দামপাড়া গ্রামের মাটি, আলো, বাতাস, মাইনুল হোসেনের কাছে অপরিচিতই থেকে গেছে সারা জীবন। তাঁর জীবনের অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে এই ফরিদপুর শহরে। ফরিদপুর মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু হয়েছিল তাঁর। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ১৯৬২ সালে ভর্তি হন ফরিদপুর জেলা স্কুলে। তখন থেকেই স্থপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। স্থপতি হলে মানুষ কী হয়, কী করতে হয়, এত কিছু বুঝতেন না। শুধু বুঝতেন বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। বাবা, মা তাঁকে অবিরত উৎসাহ আর সাহস দিয়ে গেছেন। তিনি বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করেন আর রাতে খুব গোপনে ছবি আঁকেন একান্ত নিজের জন্য। ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। অধ্যাপক বাবা নিজের কলেজে ছেলেকে ভর্তি করে দেন তাঁর সার্বক্ষণিক দেখাশুনার জন্য। বাবার প্রতিনিয়ত প্রেরণা তাঁর স্থপতি হওয়ার আকাঙ্খাকে আরও তীব্র করে তোলে। খুব ভাল ভাবে ১৯৬৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন।
তারপর বাবা তাঁকে পাঠিয়ে দেন ঢাকায় খালার বাসায়। ঢাকার অবস্থা তখন খারাপ। ঢাকায় সেই সময় ছাত্ররা শুধু পড়াশুনাই করে না, পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য মিটিং, মিছিল, আন্দোলনও করে। ১৯৬৯ সালেই ঢাকাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের রাজনৈতিক ঘটনা (গণঅভ্যুত্থান) ঘটে। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবার সময় ছিল না মাইনুল হোসেনের। বাবার স্বপ্ন পুরনের জন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই হবে, এটাই তাঁর একমাত্র ভাবনা।
১৯৭০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিদ্যায় (নকশা) ভর্তি হন সৈয়দ মাইনুল হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাসে সিট পেলেও সেখানে তাঁর মন টিকত না। সুযোগ পেলেই চলে যেতেন ধানমন্ডির খালার বাসায় , যেখানে মায়ের অভাব পূরণ হতো। কখনো ছাত্রাবাসে আবার কখনো খালার বাসায় থেকে এক বছর পার করেন তিনি। ১৯৭১ সালে দেশে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব চলছে। গ্রামেগঞ্জে খবর ছড়িয়ে পড়ে ঢাকায় ছাত্ররা পাকিস্তানীদের হটানোর জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। অধ্যাপক বাবা নিরীহ মানুষ। যুদ্ধে সস্তানদের হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন তিনি। বড় সন্তান ঢাকায় থাকলে কখন কী হয়ে যায় এই ভয় পেয়ে বসে সৈয়দ মুজিবুল হককে। তাই মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ঢাকা থেকে মাইনুল হোসেনকে ফিরিয়ে আনেন এবং পুরো পরিবার নিয়ে ফরিদপুর থেকে পৈতৃক বাড়ি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ীর দামপাড়া গ্রামে আশ্রয় নেন তিনি।
খুব ছোটবেলা থেকে ফরিদপুর শহরে বাস করায় তাঁর কাছে একেবারেই অপরিচিত লাগে দামপাড়া গ্রামটি, এর পরিবেশ ও মানুষগুলিকে। গ্রামের চারদিকে তখন গুঞ্জন আর আতংক, পাক সেনারা এগিয়ে আসছে। মুক্তিবাহিনীতে যাচ্ছে যুবকরা। মাইনুল হোসেন ভাবেন তাঁরও যুদ্ধে যাওয়া উচিত। কিন্তু বাবার নিষেধ ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। ১৯৬৫ সাল থেকেই যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁর মনে জায়গা করে নেয়। তাঁর কিছুই ভাল লাগে না দামপাড়া গ্রামে। ভয় এবং যুদ্ধে না যাওয়ার অনুশোচনা দুই-ই কাজ করে তাঁর মধ্যে। মাঝে মাঝে বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গ্রামে হাঁটতে বের হন। এখানেও পড়ন্ত বিকেলের রোদ অথবা ছায়া পড়ে থাকা পথে হাঁটতে হাঁটতে ১৯৬৫ সালে ফিরে যান তিনি। কিন্তু ১৯৬৫ সাল ছিল কল্পনার। আর ১৯৭১ সাল হচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। তাঁর বয়সের ছেলেরা রাতের অন্ধকারে জড়ো হয়ে ভারতে পালিয়ে যেত যু্দ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে।
১৯৭১ সালে দামপাড়া গ্রামে নয়টি মাস প্রচন্ড উৎকন্ঠার মধ্যেই কেটেছে তাঁদের। এই নয় মাস তাঁর পরিবারের সবাই এক সাথেই ছিলেন। তাঁর ভয় ছিল, যে কোন সময় পাক সেনারা গ্রাম আক্রমণ করতে পারে। কোনো রাতে খুব দূরে আবার কোনো রাতে খুব কাছাকাছি গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেতেন তাঁরা।
এভাবেই শেষ হয় মুক্তিযুদ্ধ। সৈয়দ মুজিবুল হকের পরিবারের সবাই অক্ষতই ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের পর তিনি তাঁর কর্মস্থল ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ফিরে আসেন। আর সৈয়দ মাইনুল হোসেন ফিরে যান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যায়ের সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাসে। নির্বিঘ্নে লেখাপড়া চলতে থাকল স্বাধীন দেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে খুব বেশি থাকতেন না তিনি। কারণ মাইনুল হোসেন কোলাহলময় জীবন পছন্দ করতেন না। তাই ধানমন্ডিতে খালার বাসায় থাকতেন অধিকাংশ সময়। ১৯৭৬ সালে প্রথম শ্রেণীতে স্থাপত্য বিদ্যা পাশ করেন তিনি।
১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে ‘EAH CONSULTANT LTD.’-এ জুনিয়র স্থপতি হিসাবে যোগদান করেন তিনি। কয়েক মাস পর ওই চাকরি ছেড়ে একই বছরের আগষ্টে ‘বাংলাদেশ কনসালট্যান্ট লিমিটেড’-এ জুনিয়র স্থপতি হিসাবে যোগদান করেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন। তাঁর কর্মজীবন ছিল বৈচিত্রময়।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। গণপূর্ত বিভাগ ১৯৭৮ সালে পরিকল্পিত জাতীয় স্মৃতিসৌধের জন্য নকশা আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সৈয়দ মাইনুল হোসেন তখন ২৬ বছরের তরুণ স্থপতি। কাজ করছিলেন ‘বাংলাদেশ কনসালট্যান্ট লিমিটেড’-এ জুনিয়র স্থপতি হিসেবে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যে নির্মমতা তিনি কল্পনায় অনুভব করেছেন সে উপলব্ধি থেকেই তিনি স্মৃতিসৌধের নকশা করে জমা দেন। কিন্তু কোন নকশাই পছন্দ না হওয়ায় গণপূর্ত বিভাগ দ্বিতীয় বার নকশা আহ্বান করে। দ্বিতীয় বারও নকশা জমা দেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন। সতেরো- আঠারো জন প্রতিযোগীর মধ্যে তিনি প্রথম হন। পুরস্কার হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেয় ২০ হাজার টাকা। আর তাঁর করা নকশা অনুসারে ঢাকার অদূরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়।
১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বাংলাদেশ কনসালট্যান্ট লিমিটেড’-এর চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। ১৯৭৯ এর জানুয়ারীতে যোগ দেন ‘স্থপতি সংসদ লিমিটেড’-এ জুনিয়র স্থপতি হিসাবে। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি আরো বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র হিসাবে কাজ করেন। ১৯৮১ সালের এপ্রিল মাসে তিনি যোগদান করেন ‘শহীদুল্লাহ এন্ড এসোসিয়েট লিমিটেড’-এ। এখানেও জুনিয়র স্থপতি হিসেবে কাজ করেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কাজ করেন।
১৯৮১ সালে স্থপতি হিসেবে নিজেকে অনেকটা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন। তখনো বিয়েটা করা হয়নি তাঁর। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন, ঢাকা মিউজিয়াম, জাতীয় স্মৃতিসৌধ সহ আরো অনেক কাজের নকশা বাস্তবায়ন করে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। বাবা- মা, আত্মীয়-স্বজন সবাই পাত্রী দেখছেন আর তাঁকে তাগাদা দিচ্ছেন বিয়ের জন্য। অনেক দেখাদেখির পর চট্টগ্রামের একটি মেয়েকে পছন্দ হয় তাঁর। ১৯৮২ সালের জানুয়ারীতে পারিবারিক আয়োজনের মাধ্যমে সৈয়দ মাইনুল হোসেনের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।
‘শহীদুল্লাহ এন্ড এসোসিয়েট লিমিটেড’-এ জুনিয়র স্থপতি হিসাবে কর্মরত থাকার সময় ১৯৮৫ সালে জীবনে প্রথম বার কর্মসূত্রে বিদেশ যাবার সুযোগ আসে তাঁর। এ বছরের ডিসেম্বর মাসে ‘AL-TURATH CONSULTING ENGINEERING BUREAU’ নামক এক কুয়েতী সংস্থায় যোগ দেন প্রজেক্ট স্থপতি হিসাবে। সেখানে ‘প্ল্যানিং এন্ড ডিজাইন’-এর উপর প্রায় চার মাস কাজ করেন তিনি। ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে দেশে ফিরে আসেন। এ মাসেই দ্বিতীয় বারের মতো যোগ দেন ‘শহীদুল্লাহ এন্ড এসোসিয়েট লিমিটেড’-এ। তবে এবার জুনিয়র হিসাবে নয়। যোগ দেন সিনিয়র স্থপতি হিসাবে।
১৯৮৮সাল। সৈয়দ মঈনুল হোসেন তখন কাজ করছিলেন ‘স্থাপত্য শিল্প লিমিটেড’-এ সিনিয়র স্থপতি হিসেবে। বয়স তখন মাত্র ছত্রিশ। পেশাদারিত্বের সৃষ্টিশীলতা ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করতে পারতেন না তখন। আর এ বছরেই অর্থাত্ ১৯৮৮ সালে তিনি পেয়ে যান জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মান একুশে পদক। জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি হিসাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরস্কার তাঁকে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হওয়াটা ছিল তাঁর জন্য বিষ্ময়কর। কারণ তিনি কখনও কল্পনা করতে পারেননি এই বয়সে এতো বড় রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হবেন। এরপর তাঁকে শেলটেক পদক-২০০৭ প্রদান করা হয়।
এই পদকে ভূষিত হওয়ার পরের বছর ১৯৮৯ সালে কিছুদিন সিনিয়র স্থপতি হিসেবে কাজ করেন ‘গৃহায়নবিদ কনসালটেন্ট লিমিটেড’-এ। মাঝে কিছু দিন বিরতি দিয়ে ১৯৯১ সালে আবারো যোগ দেন ‘শহীদুল্লাহ এন্ড এসোসিয়েট লিমিটেড’-এ এবং এখানে এসে সৈয়দ মাইনুল হোসেন থিতু হন।
১৯৯৬ সালে সৈয়দ মাইনুল হোসেনের পিতৃবিয়োগ হয়। অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে ছেলের সাথে বসবাস করছিলেন বাবা সৈয়দ মুজিবুল হক। বয়সী বাবা হঠাৎ কিডনী জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ঐ সময় সৈয়দ মাইনুল হোসেন খুব নিঃসঙ্গ বোধ করেন। এতো দিন তাঁর অভিভাবক ছিলেন বাবা। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর তিনি অনুভব করেন বিধবা মা, ছোটভাই সৈয়দ মেহেদী হোসেন, দুই মেয়ে এবং স্ত্রীসহ পুরো সংসারের অভিভাবক তিনি।
বাবার মৃত্যুর পর ‘শহিদুল্লাহ এন্ড এসোসিয়েট লিমিটেড’-এর হয়ে কাজ করে গেছেন ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তখন আর উচ্চাকাঙ্খাগুলো ছিল না তাঁর। শুধু পেশাগত কারণে কাজ করে যাওয়া। ১৯৯৮ সালে অবসর নিয়ে অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান তিনি।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সৈয়দ মাইনুল হোসেন ৩৮টি বড় বড় স্থাপনার নকশা করেছেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধ ছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হচ্ছে ওজউচ ভবন কারওয়ান বাজার, ঢাকা (১৯৭৬), ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইস্টিটিউট (১৯৭৭), বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন (১৯৭৮), চট্রগ্রাম ইপিজেড এর অফিস ভবন (১৯৮০), শিল্পকলা একাডেমীর বারো’শ আসন বিশিষ্ট অডিটোরিয়াম, বাংলাদেশ চামড়া জাত প্রযুক্তির কর্মশালা ভবন (১৯৮১), উত্তরা মডেল টাউন (আবাসিক প্রকল্প) (১৯৮৫), জউঅ ভবন বগুড়া, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার খাদ্য গুদামের নকশা (১৯৮১), কফিল উদ্দিন প্লাজা, মগবাজার (১৯৯৩), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস ভবন (১৯৯৮)। এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের বিভিন্ন বেসরকারী আবাসন প্রকল্পের নকশা করেছেন তিনি।
১৯৯৮ সালে অবসর গ্রহণ করার পর থেকে তিনি পরিবারের সাথেই অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। কোলাহল মুক্ত নিভৃত জীবন পছন্দ করতেন বলেই খুব বেশি বাইরে বের হতেন না। কিন্তু জাতীয় স্মৃতিসৌধের মতো একটি বৃহৎ ও মহৎ স্থাপনার স্থপতি বলেই ঝামেলা মুক্ত নিভৃত জীবন যাপন করতে পারেন না তিনি। কারণ ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার কর্মীরা তাঁকে বার বার পর্দায় আনতে চেয়েছে। কিন্তু এসব খুব বেশি পছন্দ করেন না সৈয়দ মাইনুল হোসেন এবং তাঁর পরিবার। স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবস এলেই প্রত্যেক বছর সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাত্কার আর ছবি নিতে চাইত। কিন্তু মাইনুল হোসেন এবং তাঁর পরিবার মনে করেন মিডিয়া কর্মীদের মধ্যে দুই ধরনের মানসিকতা বিরাজমান। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া গুলির অধিকাংশের মানসিকতা ইতিবাচক হলেও কোন কোন মিডিয়া তাঁকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে।
জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি মাইনুল হোসেন শেষ জীবনে তাঁর পরিবারের একান্ত সংস্পর্শে কাটিয়েছেন। আর কোন পেশাগত কাজে জড়াননি
তিনি ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
এক নজরে :
নাম : সৈয়দ মাইনুল হোসেন।
জন্ম তারিখ : ০৫ মে ১৯৫২।
জন্ম স্থান : দামপাড়া , টঙ্গীবাড়ী, মু্ন্সীগঞ্জ।
পিতা : সৈয়দ মুজিবুল হক।
মাতা : সেয়দা রাশিদা হক।
সন্তান : সৈয়দা তাহরিমা হোসেন ও সৈয়দা তানজিলা হোসেন।
উল্লেখযোগ্য কর্ম : জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশা (১৯৭৮)
ঢাকা যাদুঘর (১৯৮২)।
বিদেশ ভ্রমণ : কুয়েত (১৯৮৫-৮৬)।
পুরস্কার : একুশে পদক (১৯৮৮), শেলটেক পদক (২০০৭)।
মৃত্যু : ১০ নভেম্বর, ২০১৪।
তথ্যসূত্র : সৈয়দ মাইনুল হোসেন এবং সৈয়দ মেহেদী হোসেনের সাক্ষাৎকার।
লেখক : কামরান পারভেজ