এমিরেটাস সুলতানা সারওয়াত আরা জামান, যিনি বাংলাদেশে একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, মুক্তমনা, মুক্তিকামী, সমাজ সংস্কারক হিসেবেই অধিক সমাদৃত ও সম্মানিত। একজন মহীয়সী এবং আলোকিত মানুষ, যিনি সমাজসেবী সুলতানা জামান হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত।
৯ জুন ১৯৩২, চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সুলতানা জামান। বাবা খানবাহাদুর মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম। পেশায় মুনসেফ। অনেক বছর তিনি কর্মরত ছিলেন ঝিনাইদহে। মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের বাবা আব্দুল খালেক ছিলেন চট্টগ্রামের সাবজজ। বাবা আব্দুল খালেক চাইতেন তাঁর ছেলেও তাঁরই পেশায় আসুক। আর তাই ছেলে সিরাজুল ইসলামকে তিনি ওকালতি পড়ালেন।
ওকালতি পাশ করে মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম ঝিনাইদহে মুনসেফ হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি ঝিনাইদহ থেকে চলে যান কোলকাতায় রাইটরস বিল্ডিং-এ। সেখানে তিনি এসিস্ট্যান্ট জুডিশিয়াল সেক্রেটারি হিসেবে বহুদিন কর্মরত ছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে দেশ ভাগ হওয়ায় এবং অন্যান্যদের সাথে কিছু বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন পৈত্রিক বাড়ি চট্টগ্রামে। ভেবেছিলেন সেখানে গিয়ে ওকালতি পেশা ছেড়ে ব্যবসা করবেন।মা রাহাত আরা বেগম। পেশায় একজন লেখিকা। তিনি উর্দু ভাষায় লিখতেন। রাহাত আরা বেগমের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রেমি’, ‘ডাকঘর’ এবং আরও অনেক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ গল্পটি তিনি উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই অনুবাদ পড়ে ভীষণ খুশী হয়েছিলেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর খুব সুন্দর একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ ঘটে।বাবা খানবাহাদুর মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম এবং মা লেখিকা রাহাত আরা বেগমের ৮ সন্তানের মধ্যে সুলতানা জামান চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই সুলতানা ছিলেন ভাইবোনদের মধ্যে একটু অন্যরকম। খুব শান্ত ছিলেন সেটা বলা যায় না, তবে যেকোন কাজের প্রতি উদ্যোগ ও উদ্যম ছিল ভীষণ দৃঢ়। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহটা ছিল যেন আরও একটু বেশী। বড় হয়ে ওনার সবসময়ই মনে হয়েছে ঈশ্বর তাঁকে পাঠিয়েছেন লেখাপড়া করতে। তিনি বলেন, “আমি শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতাম। কেমন যেন মনে হত আমি নিজেকেই নিজে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি, পড়ছি, সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারতাম।”পড়ালেখার প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিল সুলতানার সেই ছোটবেলা থেকেই।
আর তাই মাত্র ৬ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে বাবা সিরাজুল ইসলাম তাঁকে ভর্তি করে দেন কোলকাতার উচ্চমানের ইংলিশ মিডিয়াম ‘ডাইওসেসন’ বোর্ডিং স্কুলে। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই তিনি মায়ের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেন। তাঁর বাবা তাদের তিন বোনকে একই বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। বাকী দুই বোনই সুলতানার চেয়ে বড় এবং দুজনই তাঁকে কান্নাকাটি না করার জন্য বিভিন্ন ভাবে বোঝাতে থাকেন। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয় না। সুলতানা কেঁদেই যান তাঁর মায়ের জন্য এবং এই বন্দী জীবন থেকে পরিত্রাণের জন্য। খবর পৌঁছায় বাবা-মার কাছে। বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিলেন তারা মেয়েকে ফিরিয়ে আনবেন। বাবা আদরের মেয়েকে ফিরিয়ে আনলেন ঝিনাইদহে। এরপর বাবা-মা যখন আবার কোলকাতায় এলেন, সুলতানাও সাথে এলেন। এবার তাঁকে ভর্তি করা হল ‘লিটিল ফ্লাওয়ার ডে স্কুল’-এ। স্কুলটি পরিচালনা করতেন একজন বিদেশী, নাম মিস ভিনসেন্ট। মিস ভিনসেন্টকে ভীষণ ভাল লেগে গেল সুলতানার। স্কুল বিল্ডিংটি ছিল অনেক বড়। পার্ক ষ্ট্রিটের পার্কের ঠিক উল্টো দিকে, নাম সিদ্দিক ম্যানশন। পার্ক স্ট্রিটের ঐ স্কুল থেকে প্রতিদিন সামনের পার্কে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া হত এক ঘন্টার জন্য। সব বাচ্চারা সেই এক ঘন্টায় ইচ্ছে মত খেলাধুলা করত। স্কুলে লেখাপড়াটাও অনেক ভাল ছিল। সুলতানা বলেন, “সব মিলিয়ে এতো ভাল লাগা ছিল এবং যেহেতু লেখাপড়ার আগ্রহটা আমার অনেক বেশী ছিল, তাই খুব অল্পদিনেই ইংরেজী বিষয়টি আমি খুব ভাল ভাবে আয়ত্ত করতে পেরেছিলাম।”এরপর ১৯৪৫ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে সুলতানা এবং তাঁর এক সহপাঠী একদিন ঠিক করলেন তাঁরা সাখওয়াত মেমোরিয়াল হাই স্কুলে যাবেন এবং সেখানে ভর্তি হবেন। সুলতানা বলেন, “তখন আর ছোটদের স্কুলে পড়ালেখা করতে আমাদের ভালো লাগছিল না। তাই আমরা দুই বান্ধবী মিলে ঠিক করলাম বড়দের স্কুলে ভর্তি হব।” দু’জন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে অফিস রুমে প্রবেশ করে জানালেন তাঁরা এই স্কুলে লেখাপড়া করতে চান।
প্রধান শিক্ষিকা তাঁদেরকে তাঁর কক্ষে ডেকে পাঠালেন এবং জানালেন বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভর্তি করার সমস্যা আছে। তারওপর সাথে বাবা মা কেউ যাননি। সুলতানা জানালেন বাড়ি গিয়ে বাবা মাকে জানালেই হবে। বাবা মা কিছুই বলবেন না। প্রধান শিক্ষিকা জানতে চাইলেন ইংরেজির পার্টস অফ স্পিচ জানা আছে কিনা। তিনি এক শর্তেই ভর্তি নেবেন যদি পার্টস অফ স্পিচ দিয়ে একটি বাক্য গঠন করতে পারেন। সুলতানা চট করেই একটি বাক্য গঠন করলেন যেখানে সবগুলো পার্টস অফ স্পিচ বিদ্যমান ছিল। প্রধান শিক্ষিকা যার পর নেই বিস্মিত হলেন এবং সাথে সাথেই তাঁদেরকে ভর্তি করে নিলেন। লেখাপড়া ভালই চলছিল সাখওয়াত মেমোরিয়াল মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে।দেশ ভাগ হল। সাখওয়াত মেমোরিয়াল মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে লেখাপড়ার দুবছরের মাথায় বাবা একদিন বললেন সবাইকে চট্টগ্রাম ফিরে যেতে হবে। সুলতানার বিস্ময় যেন কাটে না। তাই অবাক হয়ে বাবার কাছে জানতে চাইলেন “কি চট্টগ্রাম যাব? চট্টগ্রাম আবার কি? আমরা কোত্থাও যাব না।” বাবা বুঝিয়ে বললেন, তাদের যেতেই হবে। দেশ ভাগ হয়েছে। না যেয়ে কোন উপায় নেই। ভাইবোনদের সবারই খুব মন খারাপ হল কথাটা শুনে। এই বাড়ি, এই কোলকাতা শহর ছেড়ে কোথায় কোন চট্টগ্রামে যেতে হবে, কেউ যেন তা মনে মনে মানিয়ে নিতে পারছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতেই হল।চট্টগ্রামে দাদার বাড়িতে পৌঁছে দেখলেন আগের থেকেই এক চাচা এবং তাঁর পরিবার সেখানে বাস করেন, সাথে দাদা দাদীতো আছেনই। এদিকে সুলতানাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যাও খুব কম নয়। দাদা আব্দুল খালেক বাড়ির পেছনে বেশ বড় একটি জায়গায় তাদের থাকতে দিলেন। অল্প সময়ে পাকার দালান ওঠানো সম্ভব নয় সে জন্য বাবা সিরাজুল ইসলাম বাঁশ দিয়ে বেশ বড়সড় একটি বাড়ি বানালেন এবং তাঁর নাম দিলেন ‘ব্যাম্বু প্যালেস’।
সেই ব্যাম্বু প্যালেস এতোটাই মনোরম হল যে সব ভাইবোন ঐ বাড়িতে থাকতে একটুও আপত্তি করলেন না। বরং নতুন ধরনের অভিজ্ঞতায় সবাই অনেক বেশী খুশী হলেন এবং ওই অঞ্চলে এই ব্যামবু প্যালেসের বেশ নামডাকও হল। এর অল্প কিছুদিন পরেই বাবা সিরাজুল ইসলাম জয় পাহাড় নামের একটি পাহাড়ে তৈরী করলেন এক মনোরম পাকা বাড়ি।চট্টগ্রামে এসে অপর্ণাচরন গার্লস স্কুলে ভর্তি হন সুলতানা। ঐ বছরই ম্যাট্টিকুলেশন (এস.এস.সি.) পাশ করেন। সুলতানা দুই বাংলা মিলিয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকায় বোর্ডে নবম স্থান অধিকার করেন। এরপর ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে এবং সেখান থেকে এইচ.এস.সি. পাশ করেন।চট্টগ্রাম থেকে এইচ.এস.সি. পাশ করে সুলতানা চলে আসেন ঢাকায় এবং ভর্তি হন ঢাকা টিচার্স কলেজে। সেখান থেকে বিএড পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগ থেকে এমএড পাশ করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সাফল্যের সাথে মাস্টার্স পাশ করেন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।ডঃ. মিক্যানলেস তখন আইইআর ডিপার্টমেন্ট একটু একটু করে গুছাচ্ছিলেন। লেখাপড়ার প্রতি সুলতানার গভীর আগ্রহ দেখে তাঁকে ডক্টরেট করার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন সুলতানা এবং সেখান থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথমে ইন্টারভিউ দিতে হল তাঁকে। অনেক শিক্ষকদের সামনে তিনি ইন্টারভিউ দিলেন। লেখাপড়া করতে গিয়ে প্রথমবারের মত তিনি জানলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স এবং থিসিস একই সাথে করতে হবে। শুরু হল নতুন জীবন। স্বামী ও সন্তানদের দেশে রেখে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর সবাই বলত স্যালোয়ার কামিজ পরতে।
সুলতানা বলেন, “কিন্তু আমি কোনদিন পরিনি। সারা জীবনই আমি শাড়ী পরেছি। তাই সবাইকে জানিয়ে দিলাম আমি বাঙালী, আমি শাড়ি-ই পরব।” সেসময় সবাই ক্যাফেটেরিয়াতে খেত, কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই সে খাবার আর তাঁর ভাল লাগছিল না। তাই তিনি ছোট একটি স্টোভ ও কিছু রান্নার সরঞ্জামাদি কিনলেন এবং ডর্মের রুমে নিজেই রান্না শুরু করলেন। সুলতানা বলেন, “খুব যে ভাল হত তা না, কিন্তু খবরটা রটে গেল দ্রুতই। এরপর ভারতীয় কিছু বন্ধু ছুটির দিন করে চলে আসত একটু ভাত খাবার জন্য। বেশ ছিল সেই সময়টাও।”১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে যে জলোচ্ছ্বাস হয় সেখানে সুলতানা জামান হাত বাড়িয়ে দেন সহায়তার। পটুয়াখালী চলে যান নিজের দুই মেয়ে ও সমমনা কয়েকজন বন্ধু ও তাদের সন্তানদের সাথে নিয়ে। ঢাকা থেকে বেশ কিছু সহায়তা জোগাড় করে এবং নিজেদের পক্ষে যতটুকু সহায়তা করা সম্ভব সেই ভাণ্ডার নিয়ে পৌঁছে যান পটুয়াখালীতে। কবি সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, আলেয়া আমিন বেবী, ফিরোজা বেগম (কবি গোলাম মোস্তফার মেয়ে), লুবনা মারিয়াম, শহীদ রুমি, নায়লা খান সবাই মিলে যান ত্রাণ দিতে। কবি সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, লুবনা মারিয়াম এবং নায়লা খান সাত দিন পরেই ফিরে আসেন ঢাকায়। কিন্তু বাকীরা সবাই থেকে যান এবং দু’মাস ঐ এলাকায় অবস্থান নেন। এসময় দুরগতগ্রস্থ নারী ও শিশুদের তাঁরা বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করেন। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন এবং সরকারি বিভিন্ন সহায়তা পেতেও সাহায্য করেন। পরবর্তীতে ঢাকায় ফিরেই তাঁরা দুস্থ নারী ও ছিন্নমূল শিশুদের পূণর্বাসনের লক্ষ্যে ‘সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’-র যাত্রা শুরু করেন। এরপর শুরু হল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি। সেসময় সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কাজ তেমন ভাবে না চললেও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সুলতানা জামান লক্ষ্য করলেন সমাজে দুস্থ নারী ও ছিন্নমূল শিশুদের সংখ্যা যেমন অনেক বেশী বেড়েছে, তেমনি সদ্য জন্ম নেয়া একটি দেশের সে অবস্থা নেই যে তাদের পুণর্বাসন করবে। এই দুস্থ নারী ও ছিন্নমূল শিশুদের পূণর্বাসনের লক্ষ্যে সেসব সমমনা বন্ধুদেরকে নিয়েই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘দ্বীপশিখা’ বিদ্যালয়।
এখানে দুস্থ, অবহেলিত নারী ও শিশুদের নানারকম সেবা দেয়া শুরু হল। যেমন, সেলাই প্রশিক্ষণ, শিশুদের জন্য একটি স্কুল ইত্যাদি। প্রথম দিকে বিভিন্ন জায়গায় মিটিং হত। কিন্তু কোন স্থায়ী জায়গা ছিল না। পরে বন্ধু ফিরোজা বেগম তাঁর নিজস্ব একটি জমি দান করেন দ্বীপশিখাকে। এরপর শুরু হয় আরও অনেক কাজ। ফান্ড যোগাড়, স্কুল ভবন নির্মান, ছাত্রছাত্রী সংগ্রহসহ ছোট বড় অনেক অনেক কাজ।দুস্থ নারী ও ছিন্নমূল শিশুদের পূণর্বাসনের পাশাপাশি তিনি লক্ষ্য করলেন সমাজে আরেক শ্রেণীর মানুষ ভীষণ ভাবে অবহেলিত। যাদের জন্মই যেন আজন্ম পাপ হিসেবে বিবেচিত হয় সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে এবং অনেকক্ষেত্রে এই সব মানুষের পরিবারেও। তারা আর কেউ নন, এই সমাজেরই একটি অংশ, প্রতিবন্ধী মানুষ। যাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের নেই সহমর্মিতা, আছে শুধু চরম অবহেলা এবং নানান রকমের ভ্রান্ত ধারনা ও কুসংস্কার। সুলতানা জামানই দুই বাংলায় প্রথম একটি শব্দের প্রচলন শুরু করলেন ‘প্রতিবন্ধী’। এর আগে মানুষ কালা, বোবা, পাগল ইত্যাদি অমানবিক শব্দগুলি খুব স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবহার করত।আমেরিকা থেকে ডক্তরেট সম্পন্ন করে এসে সুলতানা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে নেমে পরলেন এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে। আর তারই ভিত্তিতে ১৯৮২ সালে তিনি ও তাঁর সমমনা কিছু বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সোসাইটি ফর দ্যা কেয়ার এন্ড এডুকেশন ফর মেন্টালী রিটায়ার্ড চিলড্রেন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যা বর্তমানে ‘সুইড বাংলাদেশ’ হিসেবে পরিচিত।সুলতানা জামান লক্ষ্য করলেন শুধু মানসিক ভাবে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কাজ করলেই হবে না, পাশাপাশি শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী ও অবহেলিত মানুষের জন্যও কিছু করা প্রয়োজন। যাদেরকে একটু প্রশিক্ষণ সহায়তা দিলেই তারা বিভিন্ন বিষয় আয়ত্ত করতে পারবে এবং নিজেরা আয় করতে পারবে। এই চিন্তাধারা থেকেই ১৯৮৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন’ যা তার দক্ষ পরিচালনায় সারা বিশ্বেই যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেছে।
এখানে শুধু প্রতিবন্ধী শিশুদেরই দক্ষ করে তোলা হয়না, পাশাপাশি এসব শিশুদের পরিবারের সদস্যদেরও কাউন্সেলিং দেয়া হয়ে থাকে।সুলতানা জামান দেখলেন দেশে শিক্ষিত মানুষ অনেক আছে, কিন্তু প্রতিবন্ধী শিশু বা তাদের পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং বা লেখাপড়া শেখানোর জন্য যথেষ্ট দক্ষ মানুষ নেই। কারণ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের নিয়ে কেউ চিন্তাই করেননি কখনও। তাই সুলতানা শুরু করলেন তাঁর নতুন সংগ্রাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্ধ্বতন মহলে যোগাযোগ করে তাদের বোঝাতে সক্ষম হলেন প্রতিবন্ধী শিশুদের যারা লেখাপড়া শেখাবেন, তাদের মূলধারার লেখাপড়ার বাইরেও বিশেষায়িত শিক্ষার প্রয়োজন। তাঁর যৌক্তিক কথায় সবাই সম্মত হলেন এবং আইইআর ডিপার্টমেন্টে যাত্রা শুরু হল ‘স্পেশাল এডুকেশন’ বিভাগটি।যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন সুলতানা জামান ও তাঁর পরিবার আর হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। তাঁর স্বামী বীর উত্তম কাজী নুরুজ্জামান পরিবারকে টাঙ্গাইলের এক অজপাড়াগাঁয়ে তাঁর ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে রেখে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে। নিযুক্ত হলেন সাত নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। গ্রামে তখন অনেকেই পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গ্রামে ওনাদের যেখানে থাকত দেয়া হয়েছিল সেটা ছিল বিশাল বড় একটা বেড়ার ঘর। ঘরের ভেতরে একপাশে একটা বিশাল ধানের গোলা আর এক পাশে একটা বিশাল চৌকি। গ্রামের বাড়িতে গোসল করার কোন ঘর ছিল না। গোসল করতে হত পাশের একটা মজা পুকুরে। সুলতানা এবং তাঁর সন্তানদের এ অভিজ্ঞতা একদম নতুন। গোসল করতে গিয়ে মজা পুকুরের পানিতে গোসল করে শরীরে র্যাশ উঠে গিয়েছিল সবার। এরপর একটা কুয়ো দেখতে পাওয়া গেল বাড়ির পেছন দিকে যেটা বহুদিনের অব্যবহারে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। সুলতানা তাঁর দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কুয়োর পানি তুলে তুলে একসময় দেখলেন সেখান থেকে ভাল পানি বেরিয়ে আসছে।
এই কুয়ো পরে সবাই ব্যবহার শুরু করে।প্রায় সকলেই অল্প কিছু জামাকাপড় নিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়েছিলেন। বেশ কিছুদিন পরে সবারই জামাকাপড়ের প্রয়োজন পড়ল। এমন কি গ্রামের মানুষেরও জামাকাপড়ের তীব্র সংকট দেখা দিল। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে কাপড় পাওয়া অসম্ভব হয়ে পরেছিল। সুলতানা বলেন, “তখন আমি সবাইকে বলেছিলাম লুঙ্গীর কাপড় কিনে আনতে।” তিনি গ্রামে ঘুরে ঘুরে একটা সেলাইমেশিন যোগার করলেন এবং লুঙ্গীর কাপড় দিয়ে শুধু সন্তানদের জন্য নয়, পাশাপাশি গ্রামে আশ্রয় নেয়া মানুষদের জন্যও জামা বানিয়ে দিতে শুরু করেন।যুদ্ধের মধ্যে স্বামীর খবর ঠিক মত পাচ্ছিলেন না। কিন্তু বেশ কিছুদিন পরে সুলতানাদের এক পারিবারিক বন্ধু এলেন তাঁদের ঐ জায়গা থেকে নিয়ে যেতে। কারন যুদ্ধের করাল থাবা তখন শহর ছেড়ে একটু একটু করে গ্রামের দিকেও অগ্রসর হচ্ছিল। তারওপর সুলতানার দুই মেয়ে নায়লা খান ও লুবনা মারিয়াম সাথে, যাদের বয়স তখন ১৮ এবং ১৬। গ্রামের হাট থেকে তিন জনের জন্য তিনটি বোরখা কেনা হল। তারপর সেই বোরখা পরে মা ও দুই মেয়ে এলেন সুলতানার সেজ জায়ের বাড়িতে। এক্কা গাড়ি, নৌকায় করে নদী পেরোন, অভিজ্ঞতাগুলো প্রথমবারের মত হল তাঁদের। এরপর সেখান থেকে চলে গেলেন ভারতের শরনার্থী শিবিরে।শরনার্থী শিবিরে গিয়ে সুলতানা ও তাঁর মেয়েরা লেগে গেলেন মানুষের সেবা করতে। স্বামী কাজী নুরুজ্জামান তখনও যুদ্ধক্ষেত্রে।১৯৫০ সালে সুলতানা জামানের বিয়ে হয় কাজী নুরুজ্জামানের সাথে। কাজী নুরুজ্জামান ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা। এরপর ঘর আলো করে আসে তিনটি সন্তান। নায়লা খান, লুবনা মারিয়াম এবং একমাত্র ছেলে নাদিম ওমর। মেয়ে প্রোফেসর নায়লা খান পেশায় ডাক্তার এবং শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে বাংলাদেশে পরিচালিত ৭৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্রের সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন। ছোটমেয়ে লুবনা মারিয়াম, স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী এবং যিনি বাংলাদেশের নৃত্যকে সাফল্যের সাথে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। একমাত্র ছেলে নাদিম ওমর, যিনি ১৯৭৯ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মারা যান।খুব ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে পরার অভ্যাস সুলতানা জামানের প্রায় সারাজীবনেরই। সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা একটু নাস্তা দিয়ে দিন শুরু হয়।
বয়সের কারণে চলার গন্ডিটা ছোট হতে হতে শুধু বাড়ির ভেতরেই রয়ে গেছে এখন। সময় কাটে হাতের কাছের গানের খাতা থেকে গান বের করে আপন মনে গান গেয়ে, পত্রিকা পড়ে বা একটুআধটু টিভি দেখে। নাতনী আনুশে আনাদিল জনপ্রিয় ব্যন্ড শিল্পী ও তাঁর সন্তানরা থাকেন ওপরের তলার ফ্ল্যাটে। । আনুশের এতো নামডাক খুব ভাল লাগে নানী সুলতানার। আনুশের দুই ছেলেমেয়ে আরাশ ও রাহা সারাক্ষণই ঘুরে ফিরে আসে সুলতানার বাড়িতে। বাচ্চারা এসে চোখের সামনে খেলাধুলা করে, সুলতানা চুপ করে দেখেন। বাচ্চাদের বিভিন্ন রকম খেলা দেখতে তাঁর ভীষণ ভাল লাগে। বাচ্চা দুটি তাঁকে ডাকে বিবি। হাসতে হাসতে সুলতানা বলেন, “ওরা আমাকে ডাকে বিবি আর আমার স্বামীকে ডাকত মিঞা। মানে আমরা হলাম মিঞা-বিবি।” সুস্মিতা মন্ডল গান শেখাতে আসেন সপ্তাহে দুই দিন। সুস্মিতা এলে সময়টা অনেক ভাল কাটে তাঁর। সুস্মিতা এসে গান শেখায়, বেশীর ভাগই রবীন্দ্র সংগীত। শুক্রবারটা সুলতানার আরও একটু বেশী ভাল কাটে। এদিন মেয়েরা, মেয়ে জামাইরা, নাতিনাতনিরা, তাদের ছেলেমেয়েরা, অনেক সময় তাদের বন্ধুরা, সবাই আসে সুলতানার বাড়িতে। সবাই একসাথে দুপুরের খাবার খান। চলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আড্ডা। এটা অনেকদিন থেকে চলে আসছে। সুলতানা বলেন, “সারা সপ্তাহে সবাই যে যার মত ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এই একটি দিন দুপুরের সময়টা সবাই চায় আমাকে দিতে। আমি সবার জন্য অপেক্ষায় থাকি। সবাই আসলে নানান গল্প হয়। স্মৃতিচারণ হয়। সব মিলিয়ে খুব চমৎকার সময় কেটে যায়।” তিনি আরও বলেন, “মাঝে মাঝে কোলকাতার জীবন খুব মনে পরে। একবার গিয়েছিলাম আমাদের কোলকাতার সেই বাড়িটা দেখতে। বিল্ডিংটা আগের মতই আছে, কিন্তু সেই প্রাণটা যেন হারিয়ে গেছে।”এ জীবনে যত কাজ করেছেন সুলতানা জামান তার জন্য তাঁকে যত সম্মাননাই দেয়া হোক না কেন, কর্ম ও প্রাপ্তির হিসেব কষাটা খুব কষ্টকরই হয়ে যাবে।
তারপরও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাঁকে বিভিন্ন সময় সম্মাননা দিয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু সম্মাননার কথা এখানে তুলে ধরা হল:
1. ১৯৮৩ ও ১৯৮৯ সালে সেবার জন্য ইন্টান্যাশনাল রোটারী এওয়ার্ড পান।
2. ১৯৯৬ সালে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে অবদানের জন্য রিহেবিলিটেশন ইন্টারন্যাশনাল থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুপ্রসিদ্ধ ‘হেনরী কেসলার এওয়ার্ড’-এ ভূষিত হয়।
3. ১৯৯৪ শিশু প্রতিবন্ধিতা বিষয়ের উপর বাংলাদেশে ১ম আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেন ও বিশেষভাবে সম্মানিত হন। ২০০৪ সালে ২য় আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজক ছিলেন তিনি।
4. ১৯৯৬ সালে সমাজের প্রতিবন্ধী দুঃস্থ শিশু ও মহিলাদের উন্নয়নের অবদানের জন্য ‘সাপ্তাহিক অনন্যা’ কর্তৃক পুরস্কৃত হন।
5. ২০০২ সনে ‘আউট ষ্ট্যানডিং সার্ভিস ফর ডিসাবিলিটি’-এর জন্য ‘রোটারী ডিষ্ট্রিক মিলিনিয়াম এওয়ার্ড’ লাভ করেন।
6. গালর্স স্কাউটে ন্যাশনাল কমিশনার হিসেবে কাজ করার জন্য স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ স্কাউটস্-এর সর্বোচ্চ এওয়ার্ড ‘সিলভার টাইগার’ পুরস্কার পান।
7. সমাজসেবায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় প্রফেস ড. এম আর খান এর আনোয়ারা ট্রাষ্ট কর্তৃক স্বর্ণপদক লাভ করেন।
8. ওমেন্স ভলানটারী এসোসিয়েশন কর্তৃক সম্মাননা পদক লাভ করেন।
9. ২০০৩- এ দেশের শিশু ও প্রতিবন্ধীদের সেবার ক্ষেত্রে ‘গতিশীল চালিকা শক্তি’ হিসেবে শিশু বিকাশ নেটওয়ার্ক কর্তৃক অগ্রদূত পুরস্কার পান।
10. ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক মা দিবসে বাংলাদেশের মায়েদের প্রতীক হিসেবে অ্যাংকর এবং প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে সম্মাননা লাভ করেন।
11. ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ শিক্ষা বিভাগের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ‘প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপক’ হিসেবে সম্বর্ধনা পান।
12. গণপ্রজান্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বেগম রোকেয়া পদক-২০০৮ সম্মানে ভূষিত হন।
13. ২০০৮ সনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন প্রশিক্ষক (Professor Emeritus) হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেনসুলতানা জামানের প্রকাশিত গবেষণা/ গ্রন্থ:1. Research on Mental Retardation in Bangladesh, 1990
2. Early Intervention and Community Based Rehabilitation Programme and current trends of Education for children with special needs in Bangladesh – 2003
3. Scientific Study on developmental disabilities in Bangladesh
4. মানব বিকাশে মনোবিজ্ঞান-১৯৯৪
5. From Awareness to Action – Ensuring Health, Education and Rights of the Disabled
6. ব্যতিক্রমধর্মী শিশু-১৯৯৮
7. আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিবন্ধী শিশু সনাক্তকরণে ১০টি প্রশ্নমালা প্রস্তুতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন এবং বিশেষজ্ঞ দলের নেতৃত্ব দেন তিনি।
8. Creating Barrier Free Inclusive Community and Right Based Society for children with disability-2005
9. Mother-child Interactions as a Function of Child’s Level of Adjustment and Intelligence, Emory University, 1975
10. Psychological and Socio-cultural Factors as Related to Attitudes Towards Family Planning Among Women in Bangladesh, SS Zaman and Wahidur Rahman Wahid, Bangladesh Institute of Development Studies, 1978
লেখক : আতিকা বিনতে বাকী