বিগত শতাব্দীর ত্রিশের মধ্যভাগ। ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা তখন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। কংগ্রেসের রাজনীতি আবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অহিংস গান্ধীবাদী ধারায়। ঠিক তখনই সিলেটের এক সাধারণ গৃহবধূ পারিবারিক গন্ডি অতিক্রম করে যুক্ত হলেন সেই রাজনৈতিক ধারার সাথে। স্রেফ চরকা দিয়ে খদ্দর কাপড় বুনতে গিয়ে সিলেট শহরের জামতলা পাড়ার এই গৃহবধূটি কংগ্রেসের মহিলা সংগঠনের সদস্য হলেন। সেই সাধারণ বধূটিই পরবর্তীকালে বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা সুহাসিনী দাস। তখন তাঁর ধারণা ছিল এই খদ্দরের মোটা কাপড় তৈরি করে তিনি দেশের জন্য কিছু একটা করবেন। পরবর্তীকালে সেই কিছু একটা করতে চাওয়া নারীই সক্রিয় কংগ্রেসকর্মী হিসেবে আবির্ভুত হলেন। ১৯৪২ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন হলো। তখন কারাবরণ করলেন তিনি। ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করলেন। নোয়াখালীর দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় মহাত্মা গান্ধীর সাহচর্য লাভ করার সুযোগও হয়েছে তাঁর। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তাঁর সুযোগ ছিল ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে নানা সুবিধা লাভের। কিন্তু তা না করে দেশের টানে রয়ে গেলেন সে সময়ের দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে।
১৯৪৭ উত্তর পাকিস্তানে কংগ্রেস রাজনীতির ক্ষীণধারাকে বেগবান রাখার ক্ষেত্রে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেন। উল্লেখ্য ভাষা আন্দোলনে রাজনৈতিকভাব কংগ্রেস ধারার অবদান আছে। পার্লামেন্টে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য রাখেন কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আপন প্রতিভায় সুহাসিনী সাধারণ এক গৃহবধূ থেকে সক্রিয় কংগ্রেস কর্মী এবং পরবর্তীকালে নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কুলাউড়ার রঙ্গিরকুল পাহাড়ে ইংরেজ আমলে কংগ্রেস কর্মীরা এক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই আশ্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন পূর্নেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত, নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী, দুর্গেশদেব প্রমূখ। এরা সবাই এক কালের প্রথিতযশা কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। কালক্রমে সুহাসিনী দাস সেই আশ্রমেরই অধ্যক্ষার দায়িত্ব নেন। বিশেষ করে ১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দুর্যোগময় দিনগুলোতে তিনি তাঁর প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে আশ্রমটিকে রক্ষা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে যুক্ত হন সমাজ সেবায়। বিশেষ করে নারীদের স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে পালন করেন বিশেষ ভূমিকা। ১৯৭৩ সালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে সংবর্ধিত হন। তখনো তাঁর সুযোগ ছিল সসম্মানে সেখানে থেকে যাওয়ার। কিন্তু তা-না করে তিনি ছুটে এসেছেন দেশের দুঃখী অসহায় মানুষদের পাশে। বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষকে শুনিয়েছেন অভয়বাণী। বিশাল বিষয় সম্পত্তির অধিকাংশই বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের কল্যাণে। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য উত্সর্গ করেছেন তাঁর সারাজীবন।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
আজীবন সংগ্রামী নারী সুহাসিনী দাসের জন্ম ১৩২২ বাংলা সনের ভাদ্র মাসে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম প্যারীমোহন রায় আর মায়ের নাম শোভা রায়। সুহাসিনী তাঁর বাবার প্রথম কন্যা। তাঁর দুই ভাই ছিলেন পবিত্র রায় ও রাধা বিনোদ রায়। দু’জনেই বর্তমানে প্রয়াত। একমাত্র ছোট বোন সুলতানা চৌধুরী। জন্ম তারিখের ব্যাপারে সুহাসিনী দাস নিজেই স্পষ্ট করে লিখেছেন তাঁর নিজের জবানীতে। ‘সেকালের সিলেট’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ”বিগত শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে পহেলা ভাদ্র সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর গ্রামে আমার জন্ম। সেকালের নিয়ম অনুসারে সামাজিকতার অংশ হিসেবে আচার্যের মাধ্যমে অনেকের মতো আমারও ‘ঠিকুজি’ লেখানো হয়েছিল। সেখানে ভবিষ্যতে অমঙ্গলের ইঙ্গিত থাকায় আমার ঠাকুমা প্রায়ই কাঁদতেন। লোকাচারের জন্য ঘটা করে ‘ষষ্ঠী দিবস’ পালন করা হয়েছিল বলে মায়ের কাছে শুনেছি।” নিজ গ্রাম জগন্নাথপুর সম্পর্কেও তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সেকালে বর্ষার দিনে ২২ মাইল হেঁটে বা নৌকায় জগন্নাথপুর থেকে সিলেট যেতে হতো। জগন্নাথপুরে একটি থানা ছিল। একটা ডাক্তারখানা ছিল আর ছিল একটা ডাকঘর। তখন গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভারত রায়, গজেন্দ্র রায়, পেয়ারি রায়, হৃদয় চৌধুরী, পার্থ চৌধুরী প্রমুখ।’
পঞ্চবর্ণের লোকের সহাবস্থানের জন্য জগন্নাথপুর গ্রাম প্রসিদ্ধ ছিল। ভৌগোলিকভাবে অঞ্চলটি ছিল সুনামগঞ্জের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট শহরের কাছে। এ গ্রামে একদিকে যেমন অনেক জ্ঞানী-গুণী লোকের বসবাস ছিল, তেমনি স্বদেশী আন্দোলনের বাতাসে সেখানে দেশপ্রেমের একটি আবহও পুষ্ট হয়ে উঠেছিল। গ্রামের বেশির ভাগ লোক কৃষিকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যে অল্প ক’জন ব্যবসায়ী ছিলেন, তাদের একজন হচ্ছেন তাঁর বাবা প্যারীমোহন রায় বা পেয়ারি রায়। তিনি বেশ শিক্ষানুরাগী ছিলেন। গ্রামের মেয়েরা তখন বিশেষ পড়াশুনা করতো না। একটি মেয়েদের পাঠশালা স্থাপিত হয়েছিল যেখানে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হতো। সুহাসিনী দাসের মায়ের পরিবার সম্পর্কে আলাদা করে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। তবে অনুমান করা যায় তিনিও ব্যবসায়ী পরিবারেরই মেয়ে ছিলেন।
পারিবারিক জীবন
পারিবারিক জীবন বলতে সাধারণত যা বোঝায়, সুহাসিনী দাসের জীবন সেরকম নয়। তিনি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। সেকালের গ্রামীণ স্কুলে অল্প স্বল্প লেখাপড়াও করেছেন। তখনকার বাস্তবতায় বিয়েটা কিছুটা দেরিতে হলেও প্রাপ্তবয়স্কা হবার আগেই তাঁর বিয়ে হয়েছে। মাত্র ষোল বছর বয়সে সিলেট শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কুমুদ চন্দ্র দাসের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু সুখের সংসার বেশিদিন টিকলো না। বিয়ের মাত্র চার বছর না যেতেই তাঁর স্বামী কুমুদ চন্দ্র হঠাত্ করে মারা যান। কোলে তখন দেড় বছরের কন্যাশিশু নীলিমা। সংসার সমুদ্রের এই বিশাল তরঙ্গে তাঁর পারিবারিক জীবন ভেসে যাবার উপক্রম হয়। এ অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি সংসারের হাল ধরেন। তারপর প্রথমে সমাজ সেবা কালক্রমে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর পারিবারিক জীবন তখন শুধু সন্তানকে ঘিরে আবর্তিত নয়; সারাদেশের প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষই তখন তাঁর পরিবারের সদস্য। সুহাসিনী দাসকে যারা কাছে থেকে দেখেছেন, তারা অকপটে তাঁর একটি গুণের কথা বলেন। সেটি হলো ব্যক্তিগত শোককে লুকিয়ে রেখে সামাজিক কর্তব্য পালনে নিজের শক্তি প্রদর্শন করা। স্বামীর মৃত্যুতে যেমন তিনি ভেঙে পড়েননি, তেমনি জীবনে আরো বহু কাছের মানুষের মৃত্যুতেও ছিলেন অবিচল। এমনকি জীবনের শেষ সময়ে এসে যখন তাঁর বিদেশ প্রবাসী কন্যার একমাত্র বংশধর পুত্র সন্তানটির অকাল মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন, তখনো একেবারেই ভেঙে পড়েননি বরং সেই ব্যক্তিগত শোককে লুকিয়ে হাসিমুখে বিভিন্ন উত্সবে যোগ দিয়েছেন। সেসব উত্সবের আনন্দ বহুগুণ বেড়ে গেছে তাঁর হাসিমুখ দেখে। তিনি সাধারণ গৃহবধূদেরও পারিবারিক জীবনের ব্যাপারে উপদেশ দিতেন। তিনি বলতেন, ‘সংসারে কিছু লোক আছে শুধু পারিবারিক কর্তব্য পালন করেই জীবন শেষ করে দেয়। আর কিছু লোক আছে যারা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। তাঁদেরকে সমাজের কাজ করে যেতে হয়। আর সেকাজ করতে গিয়ে তাঁরা পরিবারের প্রতি অতটা মনোযোগী হতে পারেন না। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ ব্যক্তিটি যদি পুরুষ হন তাহলে তাঁর স্ত্রীকেই সংসারের হাল ধরতে হবে। যতটা সম্ভব পারিবারিক দিকটা এই স্ত্রীর দ্বারাই পূরণ করা সম্ভব।’ রাজনীতি ও সমাজসেবায় আপাদমস্তক সমর্পিত হলেও সুহাসিনী দাস তাঁর নিজের পরিবারের ব্যাপারে একেবারে উদাসীন ছিলেন না। সেকারণে তার একমাত্র কন্যা নীলিমা দাস উচ্চশিক্ষিতা হতে পেরেছেন। নীলিমা যখন সিলেট মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপিকা তখন অধ্যাপক যতীন সাহার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সেটা ১৯৬২ সালের ঘটনা, যতীন সাহা তখন নটরডেম কলেজের অধ্যাপক। পরবর্তীকালে এই দম্পতি পিএইচডি করার জন্য যুক্তরাজ্যে যান এবং লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হন। স্বাধীনতার পর সুহাসিনী দাস লন্ডনে গেছেন। মেয়ে, জামাই, নাতী, নাতনীরা তাঁকে ছাড়তে চায়নি। কিন্তু দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করার স্পৃহা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছে দেশের মাটিতে।
শতবর্ষ ছুই ছুই বয়সেও তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন। সিলেটের উমেশচন্দ্র নির্মলবালা ছাত্রাবাসে তিনিই মধ্যমনি ছিলেন। সিলেট শহরের সর্বজন শ্রদ্ধেয়া সুহাসিনী দাস শ্বশুরের পরিবার থেকে অঢেল সম্পত্তি পেয়েছিলেন। এর অল্পকিছু নিজের খরচের জন্য রেখে বাকি সব বিলিয়ে দিয়েছেন জনকল্যাণমূলক কাজে। পরহিতব্রতী এই মহিলার পারিবারিক জীবন একারণেই অনন্য।
শৈশবকাল
সুহাসিনী দাসের শৈশবকাল কেটেছে জগন্নাথপুরে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে। তখন জগন্নাথপুর গ্রামে মেয়েরা জামা পরতো না। এখনকার মতো জামা পরার রেওয়াজও তখন ছিল না। সুহাসিনীও তখন জামা না পরে ঘাগরাই পরতেন আর পায়ে পরতেন চটি জুতো।
গ্রামে তখনো মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তিনি যখন ছয় বছর বয়সে পা রাখেন, সে সময়ই গ্রামের একমাত্র মেয়েদের পাঠশালাটি হৃদয় চৌধুরী ও বিপিন চৌধুরীর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপিন চৌধুরীর স্ত্রী সুশীলা দেবী মেয়েদের এই পাঠশালায় পড়াতেন। হৃদয় বাবু ও বিপিন বাবু পায়ে হেঁটে হেঁটে ছাত্রী সংগ্রহ করতেন। এটা সুহাসিনীর শৈশবকালে দেখা ঘটনা। ওই সময় গ্রামের মধ্যে তারুণ্যের নায়ক হয়ে দেখা দিয়েছিলেন সুশীলা দেবীর একমাত্র ছেলে বিনয় চৌধুরী। তিনি এমসি কলেজে পড়তেন। বিনয় ছুটিতে বাড়ি এলে গ্রামের ছেলে মেয়েদের কবিতা, গান, চিত্রাঙ্কন শেখাতেন। জগন্নাথপুরের বাসুদেব বাড়ির এই চৌধুরীরা ছিলেন বাসুদেবের সেবক। তারা নিজেদের বিজয় সিংহ রাজার বংশধর বলে দাবি করতেন। বাসুদেবের বাড়িতে আজও একটি কালীবাড়ি ও একটি জগন্নাথবাড়ি আছে। জগন্নাথপুরের এই বাসুদেব বাড়িটি ছিল খুব ঐতিহ্যবাহী। এই বাড়িকে কেন্দ্র করে দোলপূর্ণিমা ও বারুণী মেলায় প্রচুর লোক সমাগম হতো।
জগন্নাথপুরে তখন পাকাবাড়ির সংখ্যা ছিল খুব কম। এমনকি টিনের ঘরও ছিল না। সুহাসিনী তাঁর স্মৃতিচারণে সেই সময়ের কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ‘রেডিও, সাইকেল, ঘড়ি আমরা খুব কমই দেখেছি। এ সমস্ত সামগ্রী দু’এক পরিবারে সীমাবদ্ধ থাকায় তাদের স্থান ছিল সমাজে অতি উঁচুতে। লোকজন কৌতূহলী দৃষ্টিতে এসব দেখে বিস্ময়বোধ করে নানা প্রশ্ন তুলে চারদিকে ছড়িয়ে দিতো। ফলে সাধারণ ঘটনাও অল্প সময়েই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সর্বত্র প্রচারিত হতো।’ তিনি বলেন ‘আমাদের ছোটবেলায় খেলার সামগ্রী ছিল খুবই কম। মাটি, ইটের টুকরো, নারিকেলের ঠালি, ছেঁড়া, তেনার পুতুল এই যা। তদ্রুপ বাড়িকে শোভা বর্ধনের জন্য রকমারি আসবাবপত্রের বাহারও দেখিনি। চেয়ার, টেবিল, চৌকি, আলনা, সিন্দুক, আলমারি যা শুধু উচ্চবিত্তের ঘরের শোভাবর্ধক ছিল। পাইনগায়ের জমিদার বাড়িতে বহু মূল্যবান জিনিস ছিল বলে শুনতাম।’
সে সময়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘সুনামগঞ্জ ভাটি অঞ্চল হওয়ায় বছরের অর্ধেক সময়ই থৈ থৈ পানিতে ভাসতো গ্রামটি। দ্বীপের মতো গ্রামগুলোতে মানুষের নিত্যকর্মের অভাব থাকায় ধর্ম ও লোকসংস্কৃতির মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতো। ফলে বারো মাসে তেরো পার্বণ ছিল সাধারণ বিষয়। আজকের দিনে ঘোষণা প্রচার করে যেমন অনুষ্ঠান হয়, সে সময় ঘোষণা ব্যতিরেকেই প্রতিদিনকার অনুষ্ঠানে বাউল-ধামাইল, জারি ও ধর্মীয় বিভিন্ন গান চলতো। তখনও মানুষের মনোজগত্ জটিল যান্ত্রিকতা দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। বরং মানুষ তৃপ্তিতে ও সুখে ছিল। পরস্পরের মধ্যে অকৃত্রিম প্রীতিভাব, অকৃপণ সাহায্য-সহযোগিতার কথা মনে হলে দেখি যেন রক্তের বাঁধনে অটুট একটি পরিবার। বর্তমান অবস্থার নিরিখে বলা যায়, গ্রামে লোকসংখ্যা ছিল কম। মুরুব্বী লোকেরা নৌকায় কিংবা কর্দমাক্ত পথ মাড়িয়েও একে অপরের বাড়ি গিয়ে দীর্ঘসময় গল্প করে অতিবাহিত করতেন।’
তবে সেই স্মৃতিচারণে সুহাসিনী আবার একথাও বলেছেন যে, ওই সুন্দর শান্তিপূর্ণ সময়ে ঝগড়া, ফ্যাসাদ কম থাকলেও গোষ্ঠীপতি, মাতব্বর বা সমাজপতিদের প্রতাপ কম ছিল না। তারা কোন চরম সিদ্ধান্ত নিলে তা অগ্রাহ্য করা খুব কঠিন ছিল। এ রকম পরিবেশে সুহাসিনীর শৈশবকাল কেটেছে এবং তিনি বেড়ে উঠেছেন।
সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যেতো। ১২-১৩ বছর বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ে না হলে গ্রাম্য সমাজে নানা কথা রটতো। সুহাসিনীর বয়স চৌদ্দ পার হলেও তাঁর বিয়ে না হওয়ায় বাড়ির বাইরে যাওয়া তাঁর জন্য নিষিদ্ধ ছিল। বিশেষ করে ঠাকুমা তাঁকে এ ব্যাপারে খুব শাসন করতেন। তবুও এই অবরোধের মধ্যেও তিনি স্বদেশী আন্দোলনের খবর পেতেন। জগন্নাথপুরের মতো অজগ্রামেও তখন আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৩৩৭ বাংলা সনে সুহাসিনীর বিয়ে হয় সিলেট শহরের জামতলার সে সময়ের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী কোটি চাঁদ দাসের তৃতীয় ছেলে কুমুদ চন্দ্র দাসের সঙ্গে। তাঁর বয়স তখন ১৬ বছর।
শিক্ষা জীবন
সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল মেয়েদের পড়াশুনা করা ছিল কঠিন ব্যাপার। মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে পুরনো রীতিনীতি মানবে না। আর তা যদি না মানে তাহলে হয়তো তাদের বিয়েও হবে না। এ রকম নারী শিক্ষা বিরোধী জটিল পরিস্থিতিতে সুহাসিনীর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। পাঠশালায় ৪র্থ মানের বেশি শিক্ষা লাভ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি নিজেই তাঁর শিক্ষা জীবনের একটি সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন, “আমাদের সময় গ্রামে মেয়েরা পড়ালেখার কথা চিন্তা করতো না। কালের নিরিখে দেখলে সেটা অস্বাভাবিক ছিল না। অনেকটা মেনে নেয়াও স্বাভাবিক। প্রাচীন মহিলারা বলতেন, ‘না না মেয়েদের লেখাপড়ার প্রয়োজন নাই’। পুরাতনপন্থিদের আচরণের ওপর ছড়াও বেরিয়েছিল। বুড়ি আছে কুড়ি ছয়/তাহাদের শাস্ত্রে কয়/এই সব ধিঙ্গি আচরণ (তিড়িং বিড়িং)৷ বয়স্কদের বেশভূষাও সাধারণ ছিল। পুরুষরা ছোট গামছা পরিধান করতেন কিন্তু শরীর উদোম থাকতো। হাটবাজার, আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে যাওয়ার সময় পাঞ্জাবি বা নিমা কাঁধে রেখেই ওই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার একটু আগে তা গায়ে জড়িয়ে নিতেন। অবস্থাপন্ন লোকদেরই ধুতি ছিল। মহিলারা শাড়ি, সেমিজ পরলেও ব্লাউজ এবং পেটিকোট বিশেষ উপলক্ষেই থাকতো। এই রকমারি বা বাহারি পোশাক নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। আমাদের সময় ‘প্রেম’ বা ভালবেসে বিয়ে করার প্রচলন প্রায় ছিলই না। সাধারণত উকিলের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব আসতো।”
শ্রীহট্ট সম্মিলনীর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় সিলেটে নারী শিক্ষার সূচনা ঘটে সেই ১৮৭৬ থেকে। এখানকার কলকাতা পড়ুয়া ব্রাহ্মচিন্তার যুবকরাই ছিলেন স্ত্রী শিক্ষা বা নারী শিক্ষার পক্ষে। পরবর্তী সময় রাজনৈতিক আন্দোলনে মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণেই নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের পর যে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়ে সম্ভবত তারই স্পর্শ জগন্নাথপুরের স্তব্ধ জনজীবনে আঘাত হানে। গ্রামে মেয়েদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বয়স্কদের মাঝে প্রচার হতে লাগলো। তখন প্রাচীনপন্থিদের মতামত অন্যদিকে প্রবাহিত হয়েছিল অর্থাত্ বেশি শিক্ষা নয়, অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত। কারণ গ্রাম শহরের নব্য শিক্ষিত ছেলেদের নতুন চাহিদা হলো অন্তত নাম দস্তখত জানা ও পাঁচালি পড়ুয়া মেয়ে। “আমার মনে আছে আমাদের গ্রামে পাঠশালা তৈরির জন্য সভা হয়েছিল আমাদের বাড়িতেই। বিশিষ্ট জমিদার ও কংগ্রেস নেতা ব্রজেন্দ্র নায়ারণ চৌধুরী সহসে সময়ের বেশ ক’জন নামী লোক এসেছিলেন। আমরা বেশ কিছু মেয়ে সেই পাঠশালায় ভর্তি হলাম। বিপিন চৌধুরীর স্ত্রী সুশীলা চৌধুরী শিক্ষিকা নিযুক্ত হয়ে শিলচর থেকে গুরু ট্রেনিং নিয়ে আসেন। তিনি আমাদের খুব আদর করতেন। আমি ডাকতাম ‘দিদিমা’। আমাদের ছিল একটি মাত্র বই, তাছাড়া সেলাই ও চিত্রাঙ্কন শেখান। মাঝে মধ্যে তাঁর ছেলে বিনয় আমাদের গান শোনাতো। স্কুলে ৪র্থ মান পর্যন্ত পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল। এভাবে একটু একটু পড়ালেখা করে আমার শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি এখানেই ঘটলো। বিদ্যালয়ে আর না গেলেও বিদ্যাদেবীর আরাধনা করেছি সারা জীবন।”
কর্মজীবন
বিদ্যালয়ে বেশি দূর শিক্ষা লাভ তাঁর হয়ে ওঠেনি তবু কর্মজীবন হয়ে উঠেছে অসাধারণ। সেটা যেন রূপকথার গল্পের মতো। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন তিনি। মাত্র বিশ বছর বয়স তখন, কোলে দেড় বছরের শিশু। ১৯৩৪ সালে আকস্মিকভাবে তাঁর স্বামী কুমুদ চন্দ্র দাস মৃত্যুবরণ করেন। সংসারের অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ার মতো অবস্থা তখন। এ সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন দেবর ফনীন্দ্রচন্দ্র দাস। ধীরে ধীরে স্বামী হারানোর শোক কাটিয়ে ওঠেন সুহাসিনী। মন দেন পড়াশুনায়। তবে সেটা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা নয়। কোটি চাঁদ লাইব্রেরির যাবতীয় বই তাঁর পড়া হয়ে যায়। অন্যান্য লাইব্রেরি থেকেও বইপত্র এনে দিতেন ফনীন্দ্র দাস। এভাবেই সুহাসিনীর কর্মজীবনের প্রস্তুতি চলে। আর সে জীবনের দিকে তাঁকে টেনে নিয়ে যান শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের কর্মী নরেশ নন্দিনী দত্ত, সরলা বালা দেবী এবং দেবর ফনীন্দ্র দাস।
সিলেটে শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৯ সালে। সেই অনুষ্ঠানে তাঁকে নিয়ে যান পাড়ার একজন মহিলা। সেখানেই তিনি প্রথম মহিলাদের চরকা দিয়ে সুতো কাটতে দেখেন। এই দৃশ্যটিই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। অকাল বৈধব্যের কষ্টকে ভুলে থাকার জন্য তিনি চরকা দিয়ে সুতো কাটার কর্মকেই প্রথমে একটি মহত্ কাজ হিসেবে বেছে নেন। সম্মেলন শেষে বাড়ি ফিরেই তিনি ‘বিদ্যাশ্রম’ এর দোকান থেকে একটি বাক্স চরকা ও তুলার পাঁজ আনিয়ে নেন। শ্বশুরবাড়ির কর্মচারী বলাই দাস চার টাকা দিয়ে একটি বাক্স চরকা ও দুই টাকা দিয়ে তুলার পাঁজ নিয়ে আসে বাড়িতে। কিন্তু তারপরও সুতা কাটতে সমস্যা দেখা দেয়। চরকা ব্যবহার না শিখে কাজ করা যায় না। এ কারণে সম্মেলনের দু’দিন পর মহিলা সংঘের কর্মী নরেশ নন্দিনী দত্তকে ডেকে আনেন বাড়িতে। তাঁর কাছ থেকে চরকা কাটতে শেখেন সুহাসিনী। শুরু হয় নিয়মিত এই কাজ। আর তাঁর দেখাদেখি সমবয়সী পাড়ার মেয়েরাও এ কাজে উদ্বুদ্ধ হয়। কালক্রমে সাতজন মেয়ে তাঁর সঙ্গে সুতা কাটায় যোগ দেন। তাঁরা শুধু সুতাই কাটতেন না এর পাশাপাশি পত্রিকা পড়তেন এবং নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। তাঁদের কাটা সুতো পাঠানো হতো ‘বিদ্যাশ্রম’ এর দোকানে আর বদলে তাঁরা পেতেন থান কাপড়। সেই কাপড় দিয়ে সুহাসিনী ও অন্যরা মিলে পর্দা, চাদর প্রভৃতি তৈরি করতেন।
বিদ্যাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। তিনি স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। একদিন তিনি দোকানে বসে আছেন এমন সময় সুহাসিনী দাসের কর্মচারী বলাই দাসের মাধ্যমে সাড়ে পাঁচ সের সুতো আসে। পরিমাণ দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। কৌতূহলী হয়ে তিনি খবর নেন এবং এক পর্যায়ে বলাই দাসের কাছে পেয়ে যান সুহাসিনী দাসের পরিচয়। তারপর ফনীন্দ্র বাবুর মাধ্যমে জামতলার বাড়িতে গিয়ে সুহাসিনী দাসের সঙ্গে দেখা করেন। এভাবেই সুহাসিনীর কর্ম পারিবারিক গণ্ডিকে অতিক্রম করে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছরেই মহিলা সংঘের কর্মীরা এসে ফনীন্দ্র বাবুর স্ত্রী ও সুহাসিনী দাসকে পঁচিশ পয়সা চাঁদার বিনিময়ে কংগ্রেসের সদস্য করে নেন। বাড়ির বাইরে সিলেট শহরের মধ্যে তখন তাঁর কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হয়। সভা-সমিতিতে যোগ দেয়া, সদস্য বাড়ানো, সংগঠন গড়ে তোলা সব কিছুই তাঁর দায়িত্বের মধ্যে এসে পড়ে।
১৯৪০ সালের ২৬শে জানুয়ারি সিলেট জেলার মহিলা সংঘের এক আলোচনা সভায় সুহাসিনী দাস সারাজীবন খদ্দরের কাপড় পরিধান করার সংকল্প ঘোষণা করেন। মহিলা সংঘের একটা শিল্প স্কুল ছিল। এতে তাঁতের কাজ, চরকায় সুতা কাটার কাজ, চামড়ার ব্যাগ তৈরি, স্যান্ডেলের ফিতা তৈরি এসব কাজ করতো শিল্পীরা। মহিলা সংঘের নেত্রীরা সুহাসিনীকে সেই শিল্প স্কুলের শিক্ষার্থী করে নেন।
সিলেট মহিলা সংঘ তখন কংগ্রেসের একটি অঙ্গসংগঠন হিসেবে নানা কাজ করতো। যার ওপর যে কাজ দেয়া হতো সংঘের কর্মীরা তা পালন করতো অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। ত্রিশের দশকে সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গণে উল্লেখযোগ্য যেসব ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে ছিল ভানুবিলের মণিপুরী কৃষকদের আন্দোলন। শুরুতে এটা শুধু মণিপুরী ও কৃষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে কংগ্রেসও জড়িয়ে পড়ে। কংগ্রেসের নেতারা কারাবরণ করেন। সুনামগঞ্জে লালাশরদিন্দু দে, চিত্তরঞ্জন দাস ও করুণাসিন্ধু রায়ের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন হয়। এছাড়া বিয়ানীবাজার-শানেশ্বর-রণকেলি অঞ্চলের নানকার বিদ্রোহও ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা। এ সময় সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন বিপ্লবী দলও গড়ে উঠেছিল। ১৯৩৪ সালের ২রা জুলাই বিপ্লবী অসিত ভট্টাচার্যের ফাঁসি ছিল সিলেটের ইতিহাসের একমাত্র রাজনৈতিক ফাঁসির ঘটনা। এসব ঘটনা সুহাসিনীর মনে নাড়া দিয়েছিল কিন্তু তিনি সরাসরি এসবে অংশ নেননি।
১৯৪২ সালে গান্ধীজীর ডাকে সারা ভারতবর্ষে শুরু হলো বৃটিশবিরোধী আন্দোলন। ‘ডু অর ডাই’ অর্থাত্ ‘করো অথবা মরো’ এই স্লোগানে কংগ্রেস কর্মীরা বৃটিশবিরোধী ভারত ছাড় আন্দোলনে নামলো। আন্দোলনের কারণে গ্রেপ্তার হলেন এদের অনেকে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ সময় মহিলা সংঘের কর্মী হিসেবে গ্রেপ্তার হলেন সুহাসিনী দাস। তাঁদেরকে আটকে রাখা হয় কারাগারে। জেলের মেয়াদ সবার সমান ছিল না। সিলেটের জেলে তখন প্রায় ৫শ’ রাজবন্দি ছিল। তবে দু’বছরের মধ্যে এদের প্রায় সবাই মুক্তি পান। সুহাসিনীও জেল থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এসে আবার পুনরুদ্যমে কাজ শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে জওয়াহেরলাল নেহরু শিলং থেকে ডাউকি হয়ে সিলেট শহরে আসেন। মহিলা সংঘ সিদ্ধান্ত নেয় ডাউকিতে গিয়ে নেহরুকে অভ্যর্থনা জানানোর আর সে দায়িত্ব দেয়া হয় স্নেহলতা দেব ও সুহাসিনী দাসকে। ১৯৪৪ সালে ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নেয়। বিশেষ করে ১৯৪৬ সাল থেকে দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা চলতে থাকে। প্রথমে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ডাকা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। এরপর নোয়াখালীতে জ্বলে ওঠে দাঙ্গার আগুন। এতে শত শত মানুষ মারা গেল, ঘরবাড়ি পুড়লো। মহিলা সংঘের উদ্যোগে তখন খোলা হলো রিলিফ ক্যাম্প। সুহাসিনীও তখন তাদের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আর্তমানবতার সেবায়। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এক সময় তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। এ সময় সঙ্গী-সাথী নিয়ে তাঁকে দেখতে গেলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। সুস্থ হয়েই আবার তিনি কাজে লেগে যান। সেখানে তিনমাস অবস্থানের পর ওই বছরই সুহাসিনী নোয়াখালী থেকে সিলেট যান। এরপর কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ে তিনি দাঙ্গা বিধ্বস্ত বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার কয়েকটি গ্রামে গিয়ে কাজ করেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এসব এলাকার লোকদের পুনর্বাসনের জন্য টাকা দেয়া হলো। মাছ ধরার জাল দেয়া হলো। শুধু রিলিফ বিতরণ করেই তাঁরা দায় সারলেন না। দুর্গত মানুষকে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা নিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলো। সিলেট জেলা গণভোটের মাধ্যমে খণ্ডিত হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে এলো। করিমগঞ্জ মহকুমাসহ সাড়ে তিন থানা পড়লো ভারতের ভাগে। এই দেশ ভাগ ছিল সুহাসিনী দাসের জন্য বড় কষ্টের বেদনার। কারণ তাঁর স্বজন ও ঘনিষ্ঠদের অনেকেই তখন ভারতে চলে যান। কেউ কেউ আবার কংগ্রেসের রাজনীতিই ছেড়ে দেন। দেশভাগ উত্তরকালে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর কিছুদিন আগে আততায়ীর হাতে মহাত্মা গান্ধী নিহত হয়েছেন। সম্মেলনটি ছিল মুলত গান্ধীপন্থিদের নিয়ে। সুহাসিনী দাস সেই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু, সর্দার বল্লব ভাই প্যাটেল, বিনোবাভাবে, রাজেন্দ্র প্রসাদ, ড. জাকির হোসেন প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হন। সাত দিনব্যাপী এ সম্মেলন শেষে ভারতের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান দেখে এবং মানবসেবার উপযোগী বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি ফিরে আসেন সিলেটে। কুলাউড়ার রঙ্গিরকুলে কংগ্রেস কর্মীদের আশ্রমে কাজ শুরু করেন। ওই সময় ঢাকায় কংগ্রেস কর্মীদের কনভেনশনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় পাকিস্তান কংগ্রেস।
১৯৫০ সালে সারা পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগলো। সিলেটের হিন্দুরা প্রাণভয়ে দলে দলে দেশ ত্যাগ করলেন। সুহাসিনী সেই দাঙ্গার একজন প্রত্যক্ষদর্শী । তিনি দেখলেন কংগ্রেস কর্মীরা সর্বশক্তি নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং মানুষের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছে। সুহাসিনী দাস চাইলেই তখন ভারতে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি আর্তমানবতার সেবায় নিজের জীবন উত্সর্গ করে দিলেন। রঙ্গিরকুল আশ্রমে থেকে এর আশপাশের এলাকার প্রতিটি মানুষের আপনজন হয়ে উঠলেন। বিশেষ করে চা শ্রমিকদের পরিবারগুলোর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তাঁর ছিল তীক্ষ্ম নজর।
সুহাসিনীসহ কংগ্রেস কর্মীদের কাজের কারণে লেবার ইউনিয়নের ওপর কংগ্রেসের বিশাল প্রভাব সৃষ্টি হয়। ১৯৬৪ সালে কুলাউড়া-রাজনগর আসনে সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস নেতা পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত বিপুল ভোটে পাস করেন। শ্রমিক এলাকা থেকেও পাস করেন কংগ্রেস নেতা জীবন সাঁওতাল। এতে কংগ্রেসীরা আশাবাদী হলেও মুসলিম লীগপন্থিরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাদের চক্রান্তের কারণে এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার ‘চা শ্রমিক ইউনিয়ন’ বাতিল ঘোষণা করে। তখনকার পরিস্থিতিতে তিনি কুলাউড়ার কর্মীভবন ও রঙ্গিরকুল আশ্রম – দুটো প্রতিষ্ঠানেরই তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেন। সরকারের তীব্র বিরোধিতার কারণে এ সময় তাঁদের অর্থ সঙ্কটে পড়তে হয়েছে। প্রচণ্ড মনোবল নিয়ে সুহাসিনী সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। ১৯৫৬ সালে রঙ্গিরকুল আশ্রমে একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও প্রাদেশিক মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে তিনদিনব্যাপী এক আড়ম্বরপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেটা ছিল পূর্ববাংলার গঠনকর্মীদের সম্মেলন।
পরবর্তীতে যখন মন্ত্রিসভা বাতিল করে সামরিক শাসন জারি হয় এবং আইয়ুব খান পাকিস্তানের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন, তখন কংগ্রেসের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। শ্রমিক ইউনিয়ন বাতিল হয়ে যায় এবং কর্মী ভবনে ঝুলিয়ে দেয়া হয় তালা। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তো দূরের কথা সেবাকার্য চালানোই তখন দুরূহ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় কংগ্রেস নেতা ও কর্মীদের পক্ষে রঙ্গিরকুলে থাকা আর সম্ভব হয় না। তখন সুহাসিনী এর সম্পূর্ণ দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নেন।
১৯৬৩ সালে মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠজন কংগ্রেস নেতা বিনোবাভাবে আসাম থেকে পশ্চিমবঙ্গ যাওয়ার পথে উত্তরবঙ্গে সে সময়কার পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় ১৬ দিনব্যাপী পদযাত্রা করেন। সুহাসিনী সেই পদযাত্রায় ছিলেন তাঁর সহযোগী। ১৯৬২ সালে কংগ্রেস কর্মী নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামীর উদ্যোগে সিলেটের চালিবন্দরে উমেশচন্দ্র-নির্মলাবালা ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সুহাসিনী সেখানেও কিছু কাজ করেন। রঙ্গিরকুল তাঁর স্থায়ী ঠিকানা হওয়ার পরও তিনি মাঝেমধ্যেই ছাত্রাবাসে এসে থাকতেন।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। তখন সরকার বড় বড় সব কংগ্রেস নেতাকে গ্রেফতার করে। এমনকি সুহাসিনী দাসকেও করে নজরবন্দি। তিনি তখন রঙ্গিরকুল আশ্রম নিয়েই ব্যস্ত। আর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেই আশ্রমেই তাদের ঘাঁটি গাড়লো। কয়েকদিন ভয়ে-আতঙ্কে কাটানোর পর একদিন তিনি আশ্রমের অনাথ বালক-বালিকাদের নিয়ে পালিয়ে যান সেখান থেকে। এক সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ফিরে আসেন এবং পূনরুদ্যমে কাজে লেগে যান। এরপর ছয় দফার আন্দোলন হলো। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হলো। সবশেষে এলো ১৯৭০-এর নির্বাচন। সুহাসিনী তখন রঙ্গিরকুল আশ্রমে সেবাকার্য চালানোর পাশাপাশি এসব খবরই রাখতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী যখন নির্বিচারে গণহত্যা চালায়, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় সুহাসিনী তখন অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে। রঙ্গিরকুল আশ্রমে থেকে তখনও তিনি মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। তাঁর পেছনে ছিল আশপাশের গ্রামগুলোর জনসমর্থন। তাঁর সেবাপরায়ণতার কারণে মুসলিম লীগ কর্মীরা পর্যন্ত ভক্ত হয়ে ওঠেছিল। একাধিকবার পাকিস্তানিরা আশ্রমে অভিযান চালিয়েছিল। উপস্থিত বুদ্ধি এবং জনসমর্থনের কারণে তিনি প্রতিবারই রেহাই পেয়েছেন। ওই বছর ১৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নিল। এবার দেশ গড়ার পালা। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি নিয়ে বাঙালীরা আবার দেশে ফিরে এলেন। যুদ্ধ অনেকেরই সর্বস্ব লুটে নিয়েছে। এদের প্রায় সবারই শূন্য ভিটা, ঘর পুড়ে গেছে, মালামাল হয়েছে লুন্ঠিত। ঘরে ঘরে ধর্ষিতা নারীর করুণ আহাজারি। অনেকেই স্বামী সন্তান পরিজন হারা নিরাশ্রয়। এদের উদ্ধার ও রক্ষা করার জন্য চালিবন্দরের ছাত্রাবাসেই একটি নারী আশ্রম স্থাপিত হলো। অর্ধশতাধিক বিপন্ন নারীকে এই আশ্রমে আশ্রয় দিয়ে সমাজে পুনর্বাসিত করা হয়। সুহাসিনী রঙ্গিরকুল থেকে প্রায়ই ছুটে এসে এদের দেখাশুনা করতেন।
১৯৭৩ সালে বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এক মহাসম্মেলন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়। নিকুঞ্জ গোস্বামী ও সুহাসিনী দাস সেখানকার আহ্বানে ওই সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লিতে যান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরি তাঁদের অভ্যর্থনা জানান। সম্মেলনে তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা তুলে ধরেন।
এরপর তিনি সমাজসেবা ও ধর্মীয় কাজেই নিবেদিত হয়ে থাকেন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আর তেমনভাবে ছিলনা। ১৯৮৮ সালের ২২ মার্চ তিনি নেপালে বিশ্ব হিন্দু ধর্মীয় মহাসম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৯০ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের গুজবে বাংলাদেশে একদল দুষ্কৃতিকারী হিন্দুদের জানমাল ও মন্দিরের ওপরে হামলা করেছিল। এসব দেবস্থলির পুনর্নির্মাণ, হিন্দুদের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য সুহাসিনী দাস পরিক্রমা ও হরিসভায় সক্রিয় অংশ নেন।
সুহাসিনী দাস ২০০৯ সালের ৩০ মে সিলেটে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : সৌমিত্র দেব