কোটি মানুষের স্বপ্নকে যিনি নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন
দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাক। ব্র্যাকের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যে মানুষটির চিন্তা, চেতনা এবং পরিশ্রম অবিচ্ছেদ্য সূত্রে জড়িয়ে রয়েছে, তাঁর নাম ফজলে হাসান আবেদ। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের সংগ্রামে তিনিই প্রধান পথিকৃত্। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষের মধ্যে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি এই কার্যক্রমের সূত্রপাত করেছিলেন। তারপর গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক বিস্তৃত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে ব্র্যাক অনুসরণযোগ্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। বর্তমানে দেশের মাটি ছাড়িয়ে বিদেশেও এর কার্যপরিধি বিস্তৃত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্যনির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্ষুদ্র পরিসরে কার্যক্রম শুরু করলেও বর্তমানে ব্র্যাক স্বাধীন এবং স্ব-অর্থায়নে পরিচালিত স্থায়িত্বশীল মানব উন্নয়নের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধের ফসল ব্র্যাক, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভের পর বাংলাদেশে যত ভাল এবং বড় কাজ হয়েছে তার অনেকগুলোই করেছে ব্র্যাক। এই সাফল্য কিন্তু একবারে আসেনি। নানা ঘাত-প্রতিঘাত এবং প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে লক্ষ্য অর্জনের সংকল্পে স্থির ও একাগ্র থেকে ফজলে হাসান আবেদ আজ ব্র্যাককে এই অবস্থানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন।
দারিদ্র্য বিমোচন ও দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন–এই দুই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ব্র্যাক তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুদ্রঋণ তথা উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্র্যাক যে বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, তা এদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সংগ্রামে উজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে থাকবে। ব্র্যাকের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে ফজলে হাসান আবেদের কঠিন পরিশ্রম, নিরন্তর উদ্ভাবনা এবং আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত বারবার উন্মোচিত হয়।
ব্র্যাকের সূচনাপর্বের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, “মানুষের জন্য কাজ করতে হবে ব্র্যাক শুরু করার সময় এই ছিল একমাত্র চিন্তা। কখনও ভাবিনি যে, ব্র্যাক হবে পৃথিবীর সবচাইতে বড় এনজিও, এও ভাবিনি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়বে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। আমি একটা বিষয়ে সবসময় সচেতন থাকার চেষ্টা করেছি। এমন কোনো কাজ আমি করতে চাইনি, যে কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারব না। যে কাজই করিনা কেন, ভালভাবে করব, এটাই আমার নীতি। ব্র্যাক শুরু করার সময়ও কথাটা আমার মাথায় ছিল। নিজেদের অর্থ দিয়ে ব্র্যাকের কাজ শুরু করেছিলাম। আমাদের অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়, কিন্তু তা দিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। সেজন্যই আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। পরবর্তী সময়ে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো আমাদের কার্যক্রমে তহবিল জোগান দিয়েছে। ফলে কাজ করা সহজ হয়েছে। প্রথম যে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাককে অর্থ প্রদান করেছিল, সেটি হল, অক্সফাম-জিবি। অক্সফাম প্রায় দুই লক্ষ পাউন্ড দিয়েছিল। এই অর্থ দিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছিলাম। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে আমি লন্ডন গেলাম। অক্সফামের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করলাম। লক্ষ্য করলাম তাঁরা আমাদের কাজে খুবই খুশি। তাঁরা বললেন, ‘সারা পৃথিবীতে আমাদের প্রায় সাতশ প্রোজেক্ট আছে। এর মধ্যে যে প্রোজেক্টগুলো সবচাইতে ভাল চলছে, ব্র্যাক তার অন্যতম। অল্প সময়ের মধ্যে ব্র্যাক অনেক কাজ করেছে, যে কাজগুলো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ছিল খুবই জরুরি।’ অক্সফামের কর্তাব্যক্তিদের এই সন্তুষ্টির যথাযথ কারণ ছিল।”
ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্নের ব্র্যাক আজ বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে। এদেশের সব কয়টি জেলায় ব্র্যাক সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। দেশের ৭৮ শতাংশ গ্রামে এর কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। এ ছাড়া স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে ব্র্যাককে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফগানিস্তানেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আফগানিস্তানে ব্র্যাক সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
জন্ম ও বংশপরিচয়
১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে ফজলে হাসান আবেদের জন্ম। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন ঐ অঞ্চলের অনেক বড় জমিদার। তাঁরা ছিলেন দুই পরগনার মালিক। ফজলে হাসান আবেদের পরিবারের সবাই ছিলেন শিক্ষিত। দাদারা ছিলেন চার ভাই। তাঁরা সকলেই কলকাতা গিয়ে পড়াশুনা করেছেন। এফএ পাশ করে সরকারী চাকরি করেছেন। ফজলে হাসান আবেদের দাদা খানবাহাদুর রফিকুল হাসানের চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে তাঁর বাবা সিদ্দিক হাসান ছিলেন সবার বড়। তাঁর মেজ চাচা রাশিদুল হাসান ছিলেন জেলা জজ। আরেক চাচা ওবায়দুল হাসান ছিলেন নামকরা ডেন্টিস্ট। দেশভাগের আগে তিনি আসামের শিলচরে প্র্যাকটিস করতেন, পরে ঢাকায় চলে আসেন। ছোট চাচা একাত্তরের শহিদ সায়ীদুল হাসান। ফজলে হাসান আবেদের মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। বাবা-মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা ছিল অনেকটা ফরমাল, তবে বাবার চাইতে মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক বেশি। ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক বেশি। মায়ের প্রতি আমার দুর্বলতাও ছিল বেশি। আমার মায়ের কিছু বিশেষ গুণ ছিল। আর এই গুণগুলোই তাঁকে অন্য অনেকের চেয়ে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট করে রাখত। তাঁর মনটা ছিল খুব দয়ালু। মানুষের জন্য গভীর মমতা ছিল তাঁর। তিনি সর্বদাই দুঃস্থ মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। কারও ঘরে খাবার নেই এ খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য চাল পাঠিয়ে দিতেন। কারও অসুখ হলে চিকিত্সার ব্যবস্থা করতেন। রাতের বেলা কারও ঘরে হয়ত আলো জ্বালার কেরোসিন নেই। খবর পেয়ে ঐ বাড়িতে কেরোসিন পাঠিয়ে দিতেন। এভাবে নানা উপায়ে তিনি অসহায় দরিদ্র লোকদের সাহায্য করতেন। এজন্য এলাকায় তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। মনে হয় মায়ের এই প্রবণতাগুলো কিছুটা হলেও আমি পেয়েছি।’
ফজলে হাসান আবেদের বাবার মামা অর্থাত্ তাঁর নানা নওয়াব জাস্টিস স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা কলকাতার প্রথিতযশা উকিল ছিলেন। পরে তিনি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নরের নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। এই কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল চার জন। তাঁরা এখনকার মন্ত্রিসভার মত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সরকার চালাতেন। সৈয়দ শামসুল হুদা ছিলেন এই কমিটির প্রথম ভারতীয় সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের বিরোধিতা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি ব্রিটিশ সরকারের সম্মতি লাভে সমর্থ হন। কলকাতায় তিনি ছিলেন খুবই পরিচিত মুখ। তাঁর নামে কলকাতায় একটি সড়ক রয়েছে। সড়কটির নাম সৈয়দ শামসুল হুদা রোড। এটি এখনও বিদ্যমান। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। নিজের একমাত্র বোনের চার সন্তানকে তিনি মানুষ করেছেন।
ফজলে হাসান আবেদের নানা খানবাহাদুর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর নানাবাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে। নানা ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মন্ত্রিত্ব করেছেন। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কৃষিমন্ত্রী, পরে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
ফজলে হাসান আবেদের বাবা এবং চাচারা লেখাপড়া করেছেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল অ্যান্ড কলেজে। তাঁর বাবা পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি ফিরে সংসারের হাল ধরেন। তিনি ছিলেন হবিগঞ্জের ডিস্ট্রিক্ট সাবরেজিস্ট্রার।
শিক্ষাজীবন
ফজলে হাসান আবেদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় হবিগঞ্জে। তিনি হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। দেশভাগের ঠিক আগে তাঁর বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন। স্থানীয় হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা থাকলেও পরিবারের অনেকের অমতের কারণে তাঁকে মেজ চাচা কুমিল্লার জেলা জজ রাশিদুল হাসানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি ভর্তি হন কুমিল্লা জেলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। এরপর চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হয়ে যান। চাচার সঙ্গে তাঁকেও পাবনা যেতে হয়। তিনি সেখানে ভর্তি হন পাবনা জেলা স্কুলে। সেখান থেকেই ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
এরপর ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য তিনি পাবনা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে সে বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন।
তাঁর চাচা সায়ীদুল হাসান তখন লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসের বাণিজ্য সচিব ছিলেন। তিনি ফজলে হাসান আবেদকে স্কটল্যান্ডে গিয়ে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হতে বলেন। চাচার কথামতো ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্কটল্যান্ডে গিয়ে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। বিদেশে পড়তে গেলেও লেখাপড়া শেষে দেশে ফিরে আসবেন, এই ছিল তাঁর সিদ্ধান্ত। তাঁর ভাষায়, ‘যখন নেভাল আর্কিটেকচারে পড়তে গিয়েছিলাম তখন একটা রোমান্টিসিজম ছিল। স্বপ্নের হাতছানি ছিল, দেশের প্রথম নেভাল আর্কিটেক্ট হব আমি। এরকম একটা ভাবনা আমাকে আলোড়িত করত। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, দেশে ফিরে আমি লেখাপড়াটা কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারব না, তখন আর নেভাল আর্কিটেকচারে পড়বার আগ্রহ থাকল না। সিদ্ধান্ত নিলাম, এ বিষয়ে পড়ব না। নেভাল আর্কিটেকচারের কোর্স ছিল চার বছরের। দুবছর লেখাপড়া করে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি ছেড়ে লন্ডন চলে এলাম। ভর্তি হলাম অ্যাকাউন্টিংয়ে। ভাবলাম, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে দেশে ফিরে যাব। কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের উপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স শেষ করলাম। পাশ করলাম ১৯৬২ সালে।’
কর্মজীবন
চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৫৮ সালে ফজলে হাসান আবেদের মায়ের মৃত্যু হয়। মায়ের অবর্তমানে তাঁর দেশে ফিরে আসার তাগিদ কমে যায়। তিনি লন্ডনে চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর চলে যান কানাডা। সেখানেও একটি চাকরিতে যোগ দেন। পরে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ক্রমাগত দেশান্তর ও পেশাবদল করতে করতে এক সময় তিনি বিদেশে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে তিনি শেল অয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স পদে যোগদান করেন। এখানে চাকরির সময় সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। ফজলে হাসান আবেদ উপদ্রুত এলাকা মনপুরায় গিয়ে ত্রাণকাজ পরিচালনা করেন। এর চারমাস পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি আর চাকরিতে ফিরে যাননি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য তিনি ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন।
‘হেলপ’ নামক সংগঠনের জন্ম
মূলত ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় অঙ্কুর আকারে ব্র্যাকের সূচনা হয়েছিল। সে বছর ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকা এবং সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মনপুরা এই তিনটি স্থানে অগণিত মানুষের মৃত্যু হয়। দ্বীপগুলো পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মনপুরা দ্বীপে বেঁচে যাওয়া তের হাজার মানুষের কোন সহায়-সম্বল ছিল না।
ঘূর্ণিউপদ্রুতদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাঁরা কয়েকজন মিলে গড়ে তোলেন ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন। এ সময় ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, শেলে তাঁর সহকর্মী কায়সার জামানসহ আরও কয়েকজন। ‘হেলপ’-এর মাধ্যমে তাঁরা মনপুরাতে কাজ করতে থাকেন। এসময় তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনদের রিলিফ দেওয়া, তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করা প্রভৃতি কাজ করেছেন। শুরুতে নিজেরা টাকা তুলে সেই টাকা দিয়ে কাজ করেছেন। পরে জার্মানির একটি সংস্থা ত্রাণ কাজ চালানোর জন্য তাঁদেরকে ৩ মিলিয়ন ডয়েচ মার্ক অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা আকবর কবীর (পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর জন্ম
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফজলে হাসান আবেদ চলে যান লন্ডনে। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য একটা সংগঠন তৈরি করা। এ সময় তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে চাকরি করছিলেন। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানীরা সর্বাত্মক সামরিক হামলা চালায়। ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একসময় চট্টগ্রাম শহর হানাদারদের দখলে চলে যায়। ১২ এপ্রিল চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ পুনঃস্থাপিত হলে ফজলে হাসান আবেদ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন।
তিনি বলেন, “দু-তিনদিন চেষ্টা করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এলাম। তখন শেল কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন জেনারেল আবদুর রহিম। তিনি ঢাকায় এসে হোটেল রূপাসী বাংলায় (পূর্বতন ইন্টারকন্টিনেন্টাল) উঠলেন। আমি ঢাকায় আছি জেনে তিনি আমাকে হোটেলে ডাকলেন। তিনি বললেন, ‘টিক্কা খানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তেল কোম্পানিগুলো থেকে একজন অফিসারকে নিয়ে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের অফিসে বসানো হবে। তিনি লিয়াজোঁ অফিসারের কাজ করবেন এবং আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, আপনিই হবেন আমাদের লিয়াজোঁ অফিসার।’ সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের অফিস ছিল গভর্নর হাউজে (এখনকার বঙ্গভবন)। তেল কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হল। আমার কাজ তেলের জাহাজ কখন আসবে, কোথা থেকে আসবে, কোন্ জাহাজের তেল কোথায় শোধন করা হবে এসব বিষয় তদারক করা। সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষাই আমার দায়িত্ব। আমি প্রথম দিন অফিসে গেলাম। এপ্রিল মাসের শেষভাগে কোনো একটি দিন হবে। একটি কক্ষে আমি এবং এক কর্নেল বসলাম। এই কর্নেলের কথাবার্তা শুনে আমার গা জ্বলে যেতে লাগল। খুব কষ্ট করে নিশ্চুপ থাকতে হল। আমাকে বাঘের ছাপওয়ালা পরিচয়পত্র দেওয়া হল। এই পরিচয়পত্র পাওয়ার পর যে কোনো জায়গায় যাওয়া-আসার ব্যাপারটি অনেক সহজ হয়ে গেল। যখন খুশি গভর্নর হাউজে যেতে-আসতে আমার কোনো বাধা থাকল না। পরপর দু-তিনদিন অফিসে গেলাম। কিছু কাজকর্ম করলাম। কিন্তু ঐ কর্নেলের কথাবার্তা শুনে মনে হল এখানে থাকা যাবে না। কর্নেল সবসময় বাঙালীদের নিয়ে অযৌক্তিক, অশালীন কথা বলত। ‘এইবার ঠিক হয়ে যাব’, ‘বাঙালীরা শক্তের ভক্ত নরমের যম’-এমনি আরও নানা ধরনের কথা। মুখ বুজে সব সহ্য করতে হত।”
ফজলে হাসান আবেদ সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশত্যাগ করতে হবে। ইংল্যান্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কাজ করতে হবে। ফজলে হাসান আবেদের ভাষায়, ‘মে মাসের প্রথম দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম, ইংল্যান্ডে চলে যাব। আগে থেকেই সেখানে আমার জানাশোনা ছিল। আমি ভাবলাম, ইংল্যান্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য একটি সংগঠন তৈরি করব।’ সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রথমে করাচি গিয়ে সেখান থেকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল হয়ে তিনি লন্ডন পৌঁছালেন। আবেদ বলেন, “লন্ডনে পৌঁছে দেখি, আমাদের বন্ধুরা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন তৈরির চেষ্টা করছেন। লন্ডনে আমার অনেক বন্ধু ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিদেশীও ছিলেন বেশ কয়েকজন। তাঁরা বিপদের দিনে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতার হাত। তাঁদের অকুন্ঠ সাহায্য-সহযোগিতার ফলেই আমাদের জন্য কাজ করা সহজ হয়েছিল। এঁদের মধ্যে আমার বান্ধবী মারিয়েটা এবং পল কনেট নামে এক ভদ্রলোক সবচাইতে ত্যাগী মনোভাব নিয়ে নিরলসভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছিলেন। ততদিনে আমার বন্ধু ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী লন্ডনে চলে এসেছেন। আমরা সবাই মিলে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ শুরু করলাম।”
‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর সদস্যরা উপলব্ধি করলেন, পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের মানুষের উপর যে নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে, তা পৃথিবীর মানুষকে জানানো প্রয়োজন। নাহলে বিশ্ববাসী প্রকৃত ঘটনা উপলব্ধি করতে পারবে না। তাঁরা প্রথমেই ‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকায় বড় আকারের একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলেন। বিজ্ঞাপনে বলা হল, বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে। এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ও জাতিসংঘের উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন।
আবেদ বলেন, ‘আমরা শুধু ইংল্যান্ডেই আমাদের কার্যক্রম সীমিত রাখতে চাইছিলাম না। ইউরোপের দেশগুলো মানবিক বিষয়ে খুবই সহানুভূতিশীল এবং সহমর্মী। জানতাম, তাঁদের কাছে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে পারলে তাঁরা সক্রিয় হয়ে উঠবেন। প্রথমে আমরা সেখানকার মিডিয়ার লোকজনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করলাম। রেডিও-টেলিভিশনে সাক্ষাত্কার দিয়ে বাংলাদেশের ভয়াবহ নৃশংস পরিস্থিতির কথা তুলে ধরলাম। ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানত না। ওখানকার রেডিও-টিভিতে সাক্ষাত্কার প্রচার করার জন্য আমাদেরকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, ঘটনার প্রেক্ষাপট কী, এসব বিষয় তাঁদেরকে বোঝাতে হয়েছে। …আমি প্রথম টেলিভিশনে সাক্ষাত্কার দিয়েছিলাম কোপেনহেগেনে। তাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। বাংলাদেশে যে নির্মম গণহত্যা চলছে, সে বিষয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেছিলাম। সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্নের জবাব আমাকে দিতে হয়েছিল। বাংলাদেশ কি স্বাধীন হয়ে টিকে থাকতে পারবে? দেশটিতে কী পরিমাণ সম্পদ আছে? বছরে কী পরিমাণ পণ্য রফতানি করতে পারবে? বৈদেশিক মুদ্রা কীভাবে আয় করবে বাংলাদেশ? এরকম অসংখ্য প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে আমাদের। আমরা তাঁদেরকে বোঝাতে পেরেছিলাম যে, স্বাধীনতা পেলে আমরা টিকে থাকতে পারব। আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হবে না। মিডিয়ায় সাক্ষাত্কারগুলো প্রচারিত হওয়ায় বাংলাদেশে যে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে, বাঙালীরা যে মরণপণ সংগ্রাম করে যাচ্ছে, ইউরোপের দেশগুলো সে বিষয়ে আস্তে আস্তে জানতে শুরু করল। এরই মধ্যে আমার বন্ধু কায়সার জামানকে আমরা পাঠিয়ে দিলাম যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি সেখানে গিয়ে কাজ শুরু করলেন। ঢাকায় আমাদের কয়েকজন মার্কিন বন্ধু ছিলেন। জন রোডি, লিঙ্কন চেন, রিচার্ড ক্যাশসহ আরও কয়েকজন। এঁরা কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে (বর্তমানে আইসিডিডিআর’বি) কাজ করতেন। যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই নাগরিকদের ২৮ কি ২৯ মার্চ বিশেষ বিমানে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবার পর সিনেট হেয়ারিং-এ তাঁরা সাক্ষ্যপ্রদান করেন। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে। হত্যাকাণ্ডের বেশ কিছু ছবিও তাঁরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। সিনেটরদের তাঁরা ঐসব ছবি দেখিয়েছিলেন।’
‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ব্যানারে তাঁরা মূলত প্রচারমূলক কাজগুলো করছিলেন। পরে তাঁরা উপলব্ধি করেন, কেবল প্রচারমূলক কাজেই তাঁদের তত্পরতা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। সীমান্তবর্তী মুক্তাঞ্চলগুলোতে সাহায্য পাঠানোর জন্য তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন আরেকটি সংগঠন ‘হেলপ বাংলাদেশ’।
‘হেলপ’, ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’-এর ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় ব্র্যাক
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি ফজলে হাসান আবেদ দেশে ফিরে আসেন। সেই সময় ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী তাঁকে সিলেটের শাল্লা এলাকার কথা জানান। তিনি জানালেন, পুরো এলাকাটাই পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে ফেলেছে। ফজলে হাসান আবেদ শাল্লায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসবাসরত লোকজনকে দেখতে গেলেন। সেখানে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি শাল্লায় কাজ করবেন। এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের দরিদ্র, অসহায়, সবহারানো মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে শুরু করলেন ‘Bangladesh Rehabilitation Assistance Committee‘ সংক্ষেপে ‘BRAC‘। ১৯৭৩ সালে সাময়িক ত্রাণ কার্যক্রমের গণ্ডি পেরিয়ে ব্র্যাক যখন উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করে, তখন ‘BRAC‘-এই শব্দসংক্ষেপটির যে ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়, সেটি হল ‘Bangladesh Rural Advancement Committee‘ । বর্তমানে ব্যাখ্যামূলক কোনো শব্দসমষ্টির অপেক্ষা না রেখে এই সংস্থা শুধুই ‘BRAC‘ নামে পরিচিত।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ব্র্যাকের জন্ম। সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবি বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কাজী ফজলুর রহমান, আকবর কবীর, ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, এস আর হোসেন এবং ফজলে হাসান আবেদ– এই সাতজনকে নিয়ে ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ড গঠিত হল। বোর্ড ফজলে হাসান আবেদকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল হলেন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সৈয়দ হুমায়ুন কবীর ২০০১ সাল পর্যন্ত ব্র্যাকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের চেয়ারপারসন পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। ব্র্যাকের পরিচালনা বোর্ড সম্পর্কে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘পরিচালনা বোর্ডে সদস্য নিযুক্তির ব্যাপারে আমি আগাগোড়া সতর্ক ছিলাম। সবসময় এমন কৃতী মানুষদের আনতে চেয়েছি যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে সংগঠনের জন্য কাজ করবেন। যাঁরা ব্র্যাকের কাছে কিছুই চাইবেন না। কিন্তু দেবেন অনেক কিছু। … ব্র্যাকের পরিচালনা বোর্ডের সদস্যগণ কখনও কোনো চাহিদা নিয়ে ব্র্যাকের কাছে আসেননি। বোর্ডের কোনো সদস্য কোনোদিন বলেননি, আমার গাড়ি লাগবে বা আমার আত্মীয়কে চাকরি দিতে হবে। এখনও যাঁরা ব্র্যাকের পরিচালনা বোর্ডে রয়েছেন, তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন। ব্র্যাক যে আজ এত বড় হয়েছে, তার অনেকটা কৃতিত্ব বোর্ডের সদস্যদের। যে কোনো অবস্থায় বোর্ড আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।’
যেভাবে ব্র্যাকের কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন ফজলে হাসান আবেদ
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড শুরু করলেন। কিন্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথায়? লন্ডনে ফজলে হাসান আবেদের একটি ছোট ফ্ল্যাট ছিল। একাত্তরে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কাজ করার সময় তিনি নিজের খরচ চালানোর জন্য ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দেন। বিক্রি করে পেয়েছিলেন ৬৮০০ পাউন্ড। লন্ডনের একটি ব্যাংকে এই অর্থ তিনি রেখে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ঐ অর্থ দিয়ে তাঁর পরবর্তী তিন-চার বছরের খরচ চলে যাবে। এবার ব্র্যাকের কাজ শুরু করার জন্য ফজলে হাসান আবেদ লন্ডনের ব্যাংক থেকে ঐ অর্থ তুলে দেশে নিয়ে এলেন। এ ছাড়া কলকাতার ব্যাংকে ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর অ্যাকাউন্টে ছিল ২৫ হাজার রুপি। এই ৬৮০০ পাউন্ড এবং ২৫ হাজার রুপি দিয়ে শুরু হল শাল্লার মানুষের জন্য ‘রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন’ কর্মসূচি। সুতরাং বলা চলে, ব্র্যাকের প্রথম ‘ডোনার’ হচ্ছেন ফজলে হাসান আবেদ। শাল্লায় কাজ শুরু করার প্রথম অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা শাল্লায় গিয়ে প্রথম দিনই দশ-বারজন তরুণকে খুঁজে বের করলাম, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বসে আছে। কোনো কাজ নেই। দিনপ্রতি ১০ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাদেরকে জরিপের কাজে লাগিয়ে দিলাম। কিছু ছেলেকে কাজে লাগালাম যারা এস.এস.সি. পাশ। তাদের পারিশ্রমিক দিনে ৫ টাকা। সে সময় ১০ টাকা বা ৫ টাকা একেবারে কম নয়। তারা কাজ করতে থাকল। জরিপের মাধ্যমে কত বাড়িঘর নষ্ট হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন আগে কী ধরনের কাজ করত, এখন কী কাজ করতে পারবে, তার সমস্ত তথ্য-উপাত্ত পেয়ে গেলাম। …জরিপের তথ্য-উপাত্ত হাতে পাওয়ার পর যোগাযোগ করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান ও অর্থনীতি বিভাগের সঙ্গে। তাঁদের কয়েকজন শিক্ষক এবং পাশকরা ছাত্রছাত্রী জরিপের তথ্য-উপাত্তগুলো বিশ্লেষণের কাজে লেগে গেলেন। তার উপর ভিত্তি করে আমি ব্র্যাকের প্রথম প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করলাম। এভাবে শাল্লার সবহারানো মানুষদের মধ্যেই সূচিত হল ব্র্যাকের কার্যক্রম। ঢাকায় ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর আইন ব্যবসার অফিস ছিল ৯৫ মতিঝিলে। সেখানেই দুজন সেক্রেটারি আর আমি এই তিনজন মিলে ব্র্যাকের দাপ্তরিক কাজ চালাতাম। এটাই ব্র্যাকের প্রথম অফিস।
১৯৭২ সালের শুরু থেকেই ব্র্যাক কাজ করে আসছিল শাল্লায়। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের পাশাপাশি কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ চলছিল। ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। রংপুরের রৌমারিতে অনেক শিশু মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছিল। ফজলে হাসান আবেদ ভাবলেন, ক্ষুধার্ত মানুষকে বাঁচাতে হবে। শিশুদের রক্ষা করতে হবে। তাঁর ভাষায়, এত বড় আত্মত্যাগের বিনিময়ে একটা দেশ স্বাধীন হল, আর সেই দেশের শিশুরা না খেয়ে মারা যাবে এটা মেনে নেওয়া যায় না।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে দুর্ভিক্ষপীড়িত রৌমারিতে ব্র্যাক কাজ শুরু করল। এভাবেই শাল্লার পর ব্র্যাকের দ্বিতীয় প্রজেক্ট হল রৌমারিতে। পনের বছর বয়স পর্যন্ত যত ছেলেমেয়ে ছিল তাদের সবাইকে এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল। পঁয়ত্রিশ হাজার ছেলেমেয়ে সকালে এবং রাতে দুবেলা খাবার পেত। দুর্ভিক্ষে মৃত্যু ঠেকাতে তাঁরা প্রথমে সেখানে খাদ্যপ্রাপ্তিটা নিশ্চিত করেছিলেন। তারপর অপুষ্টির শিকার হয়ে যারা মৃত্যুমুখে এসে দাঁড়িয়েছিল, তাদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন পুষ্টিকেন্দ্র। ঐ কেন্দ্রগুলোতে অপুষ্ট, মুমূর্ষু শিশুদের ভর্তি করে তাদেরকে সুস্থ করে তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছয়মাস ধরে তাদেরকে খাদ্য প্রদান করা হল। ঐ এলাকায় অনাহারে শিশুমৃত্যু বন্ধ হল।
জীবন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে এগিয়ে গেছেন ফজলে হাসান আবেদ
রৌমারিতে কাজ করতে গিয়ে ব্র্যাক অনেক কিছু শিখেছিল। তাঁদের অভিজ্ঞতাও হয়েছিল অনেক। ফজলে হাসান আবেদের পর্যবেক্ষণে উঠে এল : দুর্ভিক্ষের সময় পুরুষেরা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু মহিলারা চলে যেতে পারে না। মহিলারা সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যায়। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন, বাংলাদেশের সামাজিক জীবনধারায় মহিলাদের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের যে কোন বিপর্যয়ে মহিলারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করে বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতাম, যে মহিলারা বাচ্চাদের নিয়ে পুষ্টিকেন্দ্রে এসেছে, তারা নিজেরাই অপুষ্টির শিকার। তাদেরকে দেখতাম বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। বাচ্চার খাবার থেকে কোনো মহিলা নিজে একটু খেয়েছে এমন দৃশ্য কোনোদিন দেখিনি। পুরো ব্যাপারটি আমার মধ্যে এক আলোড়ন এনে দেয়। আমি ভাবতে থাকি, কোনো একটি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এই মহিলাদের যদি সহযোগিতা করা যায়, তাহলে তারা অনেক কিছু করতে পারবে। তারাই পারবে বাংলাদেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে। সে যোগ্যতা তাদের আছে। তবে তাদের সুযোগ করে দিতে হবে। …এরকম ভাবনার পেছনে আরও কিছু বিষয় আমার মধ্যে কাজ করেছিল। চার-পাঁচ বছরের একটা মেয়েশিশু তার ছোটবোন বা ভাইকে দেখাশুনা করে, কিন্তু একটা ছেলেশিশু এটা করে না। আসলে ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা তুলনামূলকভাবে অনেক দায়িত্বশীল। মেয়েশিশুরা রান্নার কাজে মাকে সহযোগিতা করে, গরু-ছাগল দেখাশুনা করে। ছয়-সাত বছর বয়স হলে লাকড়ি কুড়োতে যায়। ক্ষেত থেকে শাক তুলে আনে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলে চোদ্দ-পনের বছর বয়সে সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়েও হবে আরেক দরিদ্র পরিবারে। অল্পদিনের মধ্যেই সে দু-তিনটি সন্তানের মা হবে। স্বামীর রোজগারে সংসার চলবে না। পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে বা কাজ করে তাকেই বাচ্চাদের খাবার জোগাড় করতে হবে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে তাদেরও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই হল আমাদের সামাজিক চিত্র, কঠোর জীবনবাস্তবতা। আমি দেখেছি, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারেও অভাব-অনটন মোকাবেলা করে মহিলারা। …আমি গভীরভাবে একটা বিষয় ভেবেছি, মহিলারা যদি তাদের পারিবারিক তথা সাংসারিক জীবনে এ ধরনের জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে তাঁরা উন্নয়নকাজও করতে পারবে সমান দক্ষতায়। এজন্যই ব্র্যাকের সব কর্মক্ষেত্রে আমরা মহিলাদের অগ্রাধিকার দিয়েছি।’
কিন্তু ফজলে হাসান আবেদ একসময় রৌমারিতে কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ত্রাণসামগ্রী বিতরণে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতির প্রতিবাদ করেও যখন কোনো ফল হল না, তখন তারা রৌমারি থেকে ব্র্যাকের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়ে চলে আসেন। এরপর ব্র্যাক কাজ শুরু করে মানিকগঞ্জে। মানিকগঞ্জে হল ব্র্যাকের তৃতীয় প্রজেক্ট।
যেভাবে ব্র্যাকের কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন ফজলে হাসান আবেদ
ব্র্যাকের সবচেয়ে বড় কার্যক্রম ‘মাইক্রোক্রেডিট’ বা ‘ক্ষুদ্রঋণ’। ১৯৭৩ সালে ব্র্যাক ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি শুরু করে। সেই সময় ব্র্যাক শাল্লায় কাজ করছিল। শাল্লা অঞ্চলে অনেক মত্স্যজীবী ছিলেন। তাঁদের প্রয়োজন ছিল নৌকা এবং জালের। কিন্তু সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে তাঁদের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। জাল নেই, নৌকা নেই। ফজলে হাসান আবেদ তখন তাঁদেরকে জাল এবং নৌকা কিনে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। জাপান থেকে জাল বানানোর নাইলন সুতা কিনে আনা হল। নৌকা বানানোর কাঠ আনা হল আসাম থেকে। জেলেদের জাল তৈরি করার জন্য সুতা দেওয়া হল। নৌকা তৈরি হল সাত-আটশ। তারপর জেলেদের গ্রাম ধরে ধরে গ্রুপ তৈরি করে নৌকাগুলো তাঁদের মধ্যে বিতরণ করা হল। এভাবে জেলেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হল। তাদের অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হল।
একদিন শাল্লার জেলেদের একটি দল এল ফজলে হাসান আবেদের কাছে। তাঁরা বললেন, এখানকার একটা বিলের নিলাম ডাক হবে, ডাকে অংশ নিয়ে তাঁরা যদি বিলটি লিজ নিতে পারেন, তাহলে তাদের অনেক লাভ হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে তাঁরা রক্ষা পাবেন। ১০ হাজার টাকা হলেই বিলটা তারা লিজ নিতে পারবেন। ফজলে হাসান আবেদের ভাষায়, ‘এই প্রথম কেউ আমাদের কাছে ঋণ চাইলেন। …ঋণের প্রথম ধারণাটা এভাবে জেলেদের কাছ থেকেই এল।’
এটা ১৯৭৩ সালের ঘটনা। জেলেদেরকে বিনা সুদে ১০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল। এক বছর পর জেলেরা টাকাটা শোধ করে দিয়েছিলেন। এরপর আরও অনেকেই ঋণ চাইলেন। গ্রুপ ধরে নয়, এককভাবে। এক, দুই বা তিন হাজার টাকার ঋণ। সুনির্দিষ্ট কাঠামো ছাড়াই একক ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু যথাযথ মনিটরিং না থাকায় বেশ কিছু টাকা ফেরত এল না। এমতাবস্থায় ঋণদানের কৌশলে পরিবর্তন আনা হল।
ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘সিদ্ধান্ত নিলাম, এককভাবে নয়, গ্রুপ করে ঋণ দেওয়া হবে। মহিলাদের গ্রুপ তৈরি করা হল। একেকটা গ্রুপকে তিন হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হল। তাদের স্বামীরা এই টাকা দিয়ে বাজার থেকে ধান কিনে আনবেন। মহিলারা সেই ধান সিদ্ধ করে ঢেঁকিতে ছাঁটবেন। স্বামীরা বাজারে চাল বিক্রি করে আবার ধান কিনে আনবেন। এ থেকে তাঁদের আয় হবে। ঠিক হল, একবারে নয়, প্রতিমাসে কিস্তিতে তাঁরা এই টাকা শোধ করবেন। এই ঋণের জন্য দশ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করলাম। এই প্রথম সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে ঋণ দেওয়া শুরু হল। এবার ঋণের টাকাটা আমরা ভালমত ফেরত পেতে শুরু করলাম। এই পদ্ধতিটা সফল হল।’
গ্রুপ ঋণ এবং একক ঋণ–প্রাথমিকভাবে এই দুটি ধারাতেই ব্র্যাক ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শুধু গ্রুপ ঋণ দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হল একক ঋণ। এবার দেখা গেল, গ্রুপ-ঋণের তুলনায় একক ঋণ বেশি সফল হচ্ছে। ঋণের টাকা ঠিকমত ফেরত আসছে। মানিকগঞ্জে কাজ শুরুর পর ব্র্যাক বুঝতে পারল, এখানে কৃষির বাইরেও আরও অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। যেমন রিকশা ও ভ্যান চালানো, হর্টিকালচার, গবাদি পশুপালন, ছোট ব্যবসা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে ব্র্যাক একক ঋণ দিতে শুরু করল। গরিব মানুষের জীবনে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এল। এই সাফল্যে উদ্দীপ্ত হয়ে ব্র্যাক ভাবতে লাগল, আর কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। এই ভাবনার ফলস্বরূপ ব্র্যাক ১৯৭৯ সালে শুরু করে রুরাল ক্রেডিট অ্যান্ড ট্রেনিং প্রোগ্রাম (আরসিটিপি)। ঋণদান এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন–এই দুটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাঁরা একসঙ্গে ১৮টি থানায় আরসিটিপি চালু করলেন। আরসিটিপি-র অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, সব কাজের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। যিনি ধান ভানছেন, তাঁর তো এ কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছেই। …তাঁর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন অন্য জায়গায়। তিনি যখন ঋণ নিয়ে ধান কিনে আনবেন, চাল বিক্রি করে টাকা নেবেন, তখন তাঁর টাকা পয়সার হিসাব জানতে হবে। কত টাকা ঋণ নেওয়া হল, কত টাকার ধান কেনা হল, চাল বিক্রি হল কত টাকার, কত টাকা লাভ হল, এর থেকে কত টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হবে, এই হিসাবগুলো তো তাঁর জানা দরকার। গ্রামের অধিকাংশ মহিলাই নিরক্ষর, তাঁরা এসব হিসাব রাখতে পারেন না। দেখা গেল, অনেক পরিবারে একটি-দুটি মেয়ে আছে, তারা হয়ত পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। তাদেরকে আমরা প্রশিক্ষণ দিলাম। এই প্রশিক্ষণের জন্য একটা খরচ ধরা ছিল। তখন সার্ভিস চার্জ নেওয়া হত দশ শতাংশ। কিন্তু এই ঋণের পেছনে যা খরচ হত, সার্ভিস চার্জ নিয়ে সেটা উঠে আসত না। কিছু লোকসান থেকেই যেত। অবশ্য দরিদ্র মানুষেরা ঋণের টাকা ঠিকমত ফেরত দিচ্ছিলেন। তারপরও কিছু ভর্তুকি দিয়ে কর্মসূচি চালাতে থাকলাম। দাতাদের ভর্তুকিতে চলবে–তখন পর্যন্ত এই ছিল আমাদের চিন্তাভাবনা। আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ লোক গড়ে তুলছিলাম, দরিদ্র মানুষ কোন্ ব্যবসা করলে ভাল হবে, তার পথ দেখিয়ে দিচ্ছিলাম। তৈরি হচ্ছিল সংগঠন।’
২০০৫ সালের ব্র্যাক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি ৪৮ লক্ষ ৪০ হাজার দরিদ্র ও ভূমিহীনকে সংগঠিত করে ১,৬০,১৯৭টি গ্রাম সংগঠন তৈরি করেছে এবং ঋণ কার্যক্রমের আওতায় ১,৬৫,৭৯৪ মিলিয়ন টাকা বিতরণ করেছে। বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্পের বিকাশে ব্র্যাক অগ্রণী এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হাঁসমুরগির রোগ প্রতিরোধে টিকাদানের কাজও শুরু করে ব্র্যাক। গ্রামবাংলার তত্কালীন প্রেক্ষাপটে এটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ। হাঁসমুরগির টিকাদান কার্যক্রম কীভাবে শুরু হল, সে অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন ফজলে হাসান আবেদ। একদিন একজন মহিলা মুরগি পালনের জন্য পাঁচশ টাকা ঋণ চাইলেন। ফজলে হাসান আবেদ তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, মুরগিগুলো যদি অসুখ হয়ে মারা যায়, তাহলে তিনি কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন? মহিলা নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। ফজলে হাসান আবেদ সিদ্ধান্তে এলেন, হাঁস-মুরগি পালনে লাভবান হতে হলে আগে গ্রামে হাঁস-মুরগির টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ঠিক হল, প্রতিগ্রামে ব্র্যাকের মহিলা সংগঠনের একজনকে ভ্যাকসিনেটরের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপর ভ্যাকসিন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিগ্রামে একজন সদস্যকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভ্যাকসিনেটর বানানো হল। তাঁরা থানা সরকারি পশুপালন কর্মকর্তার কাছ থেকে ভ্যাকসিন নিয়ে আসবেন। ভ্যাকসিন দিতে হবে খুব সকালে। কেননা সূর্য ওঠার আগেই হাঁস-মুরগি খোঁয়াড় থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রত্যুষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাঁরা ভ্যাকসিন দেবেন, তাঁরা কেন এত পরিশ্রম করে কাজটি করবেন? ভ্যাকসিনেটর হিসেবে যাঁদের তৈরি করা হবে, তাঁরা যাতে ব্র্যাকের অনুপস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে না পড়েন, সেই দিকে লক্ষ্য রেখে কর্মপ্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হল। ঠিক হল, একটি মুরগিকে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য ভ্যাকসিনেটর পঁচিশ পয়সা পাবেন। ৪টি মুরগিকে ভ্যাকসিন দিলে তিনি পাবেন ১ টাকা, ৮টিকে দিলে ২ টাকা। এভাবে দিনে তিনি অন্তত ২৫-৩০ টাকা আয় করতে পারবেন। যথারীতি কাজ শুরু হল। কিন্তু অচিরেই সমস্যা দেখা দিল। সরকার থেকে বলা হল, সরকার যেখানে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিচ্ছে, সেখানে ব্র্যাকের ভ্যাকসিনেটররা ভ্যাকসিন দিয়ে টাকা নিচ্ছেন কেন? ভ্যাকসিন দিয়ে টাকা নেওয়া যাবে না। ব্র্যাকের উত্তর ছিল : ‘ভ্যাকসিনেটর মেয়েটি যদি টাকা না পান তাহলে তিনি কাজ করবেন কেন?’ কিন্তু সরকারের একটাই বক্তব্য : ব্র্যাক কেন টাকা নেবে? প্রায় এক বছর ধরে সরকারের সঙ্গে তাদের দেনদরবার চলতে থাকল। অবশেষে ব্র্যাক সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হল যে, তারা কোন টাকা নিচ্ছেন না, ভ্যাকসিনেটররা তাঁদের পারিশ্রমিক নিচ্ছেন। কিন্তু একসময় সরকার বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। এবার ভ্যাকসিনেটররা ভ্যাকসিন কিনে আনতে শুরু করলেন। ভ্যাকসিনের মূল্য নির্ধারণের ফলে মুরগি প্রতি ভ্যাকসিন দেওয়ার চার্জ বেড়ে গেল। ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের আওতায় দেশের অনেক থানা অন্তর্ভুক্ত হল, ফলে মুরগির মড়ক বন্ধ হয়ে গেল। হাইব্রিড মুরগি পালন কার্যক্রম শুরু করার পর ভ্যাকসিনেটরদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে লাগল। দু’শ মহিলাকে দিয়ে ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের সূচনা হয়েছিল, কিছুদিনের মধ্যেই সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল চল্লিশ হাজারে।
ব্র্যাকই সর্বপ্রথম গ্রামের মহিলাদের হাইব্রিড মুরগি পালনে উত্সাহিত করেছিল। শুরুতে সাভারস্থ ফার্ম থেকে হাইব্রিড মুরগির ডিম সংগ্রহ করা হত। সেই ডিম দেশি মুরগির ওমে রেখে বাচ্চা ফোটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তখন সরকারের বেশ কয়েকটি হাইব্রিড মুরগির ফার্ম ছিল। কিন্তু তাদের তেমন কোন প্রচার ছিল না। মানুষ তাদের কথা জানত না। ব্র্যাক সরকারি ফার্ম থেকে প্রতি মাসে এক লাখ হাইব্রিড মুরগির বাচ্চা কিনে গ্রামে গ্রামে সরবরাহ করত।
পোলট্রি শিল্পের বিকাশের জন্য মুরগির খাদ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিদেশ থেকে পোলট্রি খাদ্য কিনে এনে পোষানো সহজ নয়। পোলট্রি খাদ্যের প্রধান উপাদান হচ্ছে ভুট্টা। ফজলে হাসান আবেদ সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেরাই ভুট্টার চাষ করবেন। ১৯৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে ভুট্টার বীজ আনা হল। প্রথম বছর ভুট্টা চাষ হল দুশ একর জমিতে। প্রথমে কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী ছিলেন না। কৃষকদের বলা হল, প্রতিকেজি ছয় টাকা দামে সব ভুট্টা ব্র্যাক কিনে নেবে। এর বেশি দাম পেলে কৃষকরা তা বাজারে বিক্রি করে দেবেন। প্রথমে দুশ একর জমিতে ভুট্টাচাষ করা হল। কৃষকরা উত্পাদিত ভুট্টা বাজারে নিয়ে গেলেন বিক্রি করতে। প্রতিকেজি সাত-আট টাকা দামে বিক্রি হল। এক কেজি ভুট্টাও ব্র্যাককে কিনতে হল না। পরের বছর আরও অনেক কৃষক নিজে থেকেই ভুট্টা চাষে এগিয়ে এলেন। এভাবে বছর বছর ভুট্টার আবাদ বাড়তে থাকল। প্রথম বছর যেখানে দুশ একর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছিল, দেশে এখন সেখানে এক লাখ আশি হাজার একর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়। ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ”আমরা ঠিকই ভেবেছিলাম, পোলট্রি খাদ্য যদি আমরা সহজলভ্য করে দিতে পারি, তাহলে ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবেন। হয়েছেও তাই। এখন দেশে পোলট্রি শিল্প মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমরা প্রথমে পোলট্রি খাদ্যের উত্পাদন নিশ্চিত করেছি, অন্যরা বিনিয়োগ করেছেন। ব্র্যাক পোলট্রি খামার করেছে অনেক পরে।”
হাঁস-মুরগির অসুখের মত গরুর অসুখও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এক বড় ধরনের সমস্যা। ব্র্যাক এই সমস্যার দিকেও নজর দিল। গ্রামের এস.এস.সি. পাশ বা ফেল করা কিছু ছেলেমেয়ে জোগাড় করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্যারাভেটেরিনারিয়ান হিসেবে তৈরি করা হল। গরুর কী ধরনের অসুখ হয়, কোন্ অসুখের লক্ষণ ও উপসর্গ কী, কোন্ অসুখে কী ইনজেকশন দিতে হয়, কীভাবে গরুর কৃত্রিম গর্ভধারণ করাতে হয়, এসব বিষয় তাদেরকে শেখানো হল। একটি ইউনিয়নের দায়িত্ব দেওয়া হল তিনজন প্যারাভেটেরিনারিয়ানকে। একটা ব্যাপার দেখা গেল, এ কাজে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক ভাল করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ছেলেরা সমস্যা করতে লাগল। যে বিষয়টি তাদের জানা নেই, তারা সেটাও পরীক্ষানিরীক্ষা করতে লাগল। কিন্তু মেয়েরা যতটুকু জানে, তার মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রেখেছিল। প্রথম ব্যাচের পর ছেলেদের আর প্যারাভেটেরিনারিয়ান হিসেবে নেওয়া হয়নি, শুধু মেয়েদেরকেই এ কাজে নির্বাচিত করা হয়েছিল।
শিশুদের জন্য ফজলে হাসান আবেদ
১৯৭৯ সাল ছিল আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষ। বাংলাদেশের তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিয়াউর রহমান। সে সময় ‘সুপ্রিম কাউন্সিল অন উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’ নামে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। সেই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। জিয়াউর রহমান ছিলেন চেয়ারম্যান। একদিন বঙ্গভবনে সেই কমিটির সভায় জিয়াউর রহমান জানতে চাইলেন, ‘শিশুদের জন্য আমরা কী করতে পারি?’ ফজলে হাসান আবেদ বললেন, ‘আমাদের দেশে শিশুমৃত্যু হার অনেক বেশি। আর যে দেশে শিশুমৃত্যুর হার বেশি, সে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও বেশি। দেখা গেছে, একটি দেশে শিশুমৃত্যু হার কমার কয়েক বছরের মধ্যেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে আরম্ভ করে। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানোটা খুবই জরুরি। আর এজন্য শিশুমৃত্যুর হার আগে কমানো দরকার।’
সেই সময় ঢাকাস্থ কলেরা রিসার্চ ল্যাব (বর্তমান আইসিডিডিআর’বি)-এ কর্মরত ছিলেন ফজলে হাসান আবেদর বন্ধু ড. লিঙ্কন চেন। পরবর্তীতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একদিন ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে ড. লিঙ্কন চেনের কথা হচ্ছিল। ড. চেন বললেন, ‘যদি বাংলাদেশের সন্তানসম্ভবা সমস্ত মায়েদের টিটেনাস ইনজেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে নবজাত শিশুদের টিটেনাস হবে না। অনেক শিশু মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাবে।’ পরিসংখ্যান সংগৃহীত হল। তাতে দেখা গেল, বাংলাদেশে প্রতিবছর এক বছর বয়সের মধ্যে যত শিশু মারা যায়, তার সাত শতাংশ মারা যায় টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে। তার মানে সন্তানসম্ভবা মায়েদের টিটেনাস টাইফয়েড ইনজেকশন দেওয়া হলে শতকরা সাত জন শিশুকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো যাবে। শিশুদের প্রাণঘাতী অন্যান্য অসুখেও টিকাদানের কথা উঠল। কিন্তু সেজন্য টিকাগুলোকে ‘কোল্ড চেইন’ তথা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার মধ্যে সংরক্ষণ ও সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু দেশব্যাপী বিদ্যুত সুবিধা না থাকায় তখন টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য অন্য চিন্তাভাবনা চলতে থাকল। ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘আমাদের জানা ছিল, বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ ডায়রিয়া। ঠিক করলাম, এই জায়গাটাতেই আমরা কাজ করব। শিশুমৃত্যু রোধ করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু হল ব্র্যাকের ডায়রিয়া প্রতিষেধক কর্মসূচি। ১৯৬৮ সালে কলেরা রিসার্চ ল্যাব (বর্তমানে আইসিডিডিআর’বি) লবণ, গ্লুকোজ ও পটাশিয়ামের মিশ্রণে ডায়রিয়া প্রতিষেধক ওরাল স্যালাইনের ফর্মুলা উদ্ভাবন করেছিল। কিন্তু এই স্যালাইনের ব্যবহার সম্পর্কে দেশের মানুষ তখনও অবগত হয়নি। আমরা ভাবলাম, চিকিত্সার এই সহজ পদ্ধতিটি সাধারণ মানুষের কাছে পেঁছে দেওয়া প্রয়োজন। আমরা আইসিডিডিআর’বি-র সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করলাম। আইসিডিডিআর’বি থেকে বলা হল, খাওয়ার স্যালাইন যদি প্যাকেট করার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে সহজেই তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে। …খাওয়ার স্যালাইন কীভাবে প্যাকেট করা যায়, তা জানার জন্য স্যালাইনের নমুনা নিউইয়র্কের একটা ল্যাবরেটরিতে পাঠালাম। …লিঙ্কন আমাকে বললেন, খাওয়ার স্যালাইন প্যাকেটজাত করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। স্যালাইনের মূল বিষয় হচ্ছে পানি। এক প্যাকেট স্যালাইন কতটুকু পানির সঙ্গে মেশাতে হবে, সেটাই আসল কথা। পানির পরিমাণ যদি ঠিক না হয়, স্যালাইনে কাজ হবে না। …আরও অসুবিধা আছে। ডায়রিয়া হওয়ার পর প্যাকেট স্যালাইন কিনতে বাজারে যেতে হবে। রাতে যদি ডায়রিয়া হয়, তখন স্যালাইন পাবে কোথায়? আমি বললাম, তাহলে কী করা যায়? লিঙ্কন বললেন, আপনারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাওয়ার স্যালাইন বানানো শেখানোর ব্যবস্থা করুন। মানুষের কাছে স্যালাইন ব্যবহারের সুফল পৌঁছাতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্র্যাকের সেই ক্ষমতা আছে। …তাঁর কথা আমার পছন্দ হল। সিদ্ধান্ত নিলাম, এদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে গিয়ে বাড়ির মহিলাদের স্যালাইন তৈরি করাটা শিখিয়ে দেব। পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের শাল্লা থানা বেছে নিলাম। এই থানার বিশ হাজার বাড়িতে লবণগুড়ের স্যালাইন তৈরির পদ্ধতি এবং আনুষঙ্গিক কিছু স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান করা হবে। প্রথমে ব্র্যাককর্মীদের স্যালাইন তৈরির প্রক্রিয়া এবং স্যালাইন খাওয়ানোর পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হল। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শেখাতে শুরু করল। …১৯৮০ সালে আমরা পাঁচটি বৃহত্তর জেলাকে (সিলেট, ফরিদপুর, বরিশাল, যশোর, খুলনা) স্যালাইন কর্মসূচির আওতায় নিয়ে এলাম। …আমরা স্যালাইন কর্মসূচি নিয়ে তিনটি পর্যায়ে কাজ করেছিলাম। প্রথম পর্যায় ১৯৮০-১৯৮৩, দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৮৪-১৯৮৬ এবং তৃতীয় পর্যায় ১৯৮৭-১৯৯০। সারা বাংলাদেশে প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে একজন মহিলাকে লবণগুড়ের স্যালাইন বানানো শেখাতে সময় লেগেছিল দশ বছর। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ জানে স্যালাইন কী এবং তা কীভাবে বানাতে হয়।’
খাওয়ার স্যালাইন কর্মসূচির পাশাপাশি ব্র্যাক শিশুদের প্রাণঘাতী ৬টি রোগ প্রতিরোধে ইউনিভার্সাল চাইল্ড ইমু্নাইজেশনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দেশের বিরাট এলাকা জুড়ে সফল টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করেছে। কার্যক্রম চালাবার জন্য সরকার এবং ব্র্যাক দেশের এলাকা ভাগ করে নিয়েছিল। এই কর্মসূচি চলেছে ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। সবগুলো বিভাগে পুরোপুরি সফল না হলেও এই কর্মসূচিতে বাংলাদেশ চমত্কার তত্পরতা দেখিয়েছিল। যেখানে শিশুদের টিকা দেওয়া হত না বললেই চলে, সেখানে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ শিশুকে এ সময় টিকা দেওয়া হয়েছিল। কোনো কোনো এলাকায় টিকাদানের হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
ব্র্যাকের খাওয়ার স্যালাইন ও টিকাদান কর্মসূচির প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ দেশজুড়ে শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। ১৯৮০ সালে নবজাতকের মৃত্যুর হার ছিল হাজারে ১৩৫ এবং শিশুমৃত্যুর হার ছিল ২৫০। ১৯৯০ সালে এসে নবজাতকের মত্যুর হার দাঁড়াল হাজারে ৯০ এবং শিশুমৃত্যুর হার ১২০। এভাবে শিশুমৃত্যুর হার প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। জনসংখ্যা হ্রাসের ক্ষেত্রেও এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।
ব্র্যাক ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শুরু করে। বর্তমানে দেশের ৪২টি জেলার ৮ কোটি ৩২ লক্ষ মানুষকে এর আওতায় আনা হয়েছে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে যারা কাজ করেন, তাঁদেরকে বলা হয় ‘স্বাস্থ্যসেবিকা’। স্বাস্থ্যসেবিকারা সকলেই তাদের এলাকার ব্র্যাক গ্রামসংগঠনের সদস্য। এরা এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান করেন, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও স্বাস্থ্যসামগ্রী বিক্রয় করেন, সাধারণ অসুখ-বিসুখে চিকিত্সা প্রদান করেন, মৌলিক স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা তথ্য সংগ্রহ এবং প্রয়োজনে রোগীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে বলেন। স্বাস্থ্যসেবিকাদের কাজে সহায়তা জুগিয়ে তাকে আরও জোরদার করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী থেকে ‘কমিউনিটি হেলথ প্যারামেডিক’ নিয়োগ দান করা হয়েছে এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এঁদেরকে বলা হয় ‘স্বাস্থ্যকর্মী’। স্বাস্থ্যকর্মীরা কর্মসূচির আওতাধীন খানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিষয়ক সেবা পরিবীক্ষণ এবং গর্ভবতী মায়েদের সেবা প্রদানের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবিকাদের কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান করেন। গর্ভবতী মায়েদের প্রসবপূর্ব এবং প্রসবপরবর্তী পরিচর্যা প্রদানের কার্যক্রম থেকে সারাদেশের মহিলারা উপকৃত হচ্ছেন। ব্র্যাক ৩৭টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছে। স্বাস্থ্য কর্মসূচির অন্য উদ্যোগগুলোর মধ্যে নবতম উদ্যোগ হচ্ছে এইচআইভি/এইডস কর্মসূচি। এই ভয়াবহ ব্যাধি সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, উচ্চঝুঁকির জনগোষ্ঠীর মধ্যে কনডম বিতরণ, যৌনবাহিত সংক্রমণ এবং প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণের ক্ষেত্রে উপসর্গ চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে চিকিত্সা প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে এইচআইভি সংক্রমণ হ্রাসের প্রয়াস চালানো হচ্ছে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচির অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে সমাজভিত্তিক আর্সেনিক নিরসন প্রকল্প, নবজাতকের জীবনরক্ষা কার্যক্রম এবং ক্ষুদ্র স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প। এ ছাড়া ২০১০ সালের মধ্যে পয়ঃনিষ্কাশন ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্যলাভের জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্র্যাক সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।
উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম
১৯৮৫ সালে এককক্ষবিশিষ্ট ২২টি স্কুল নিয়ে এই কর্মসূচির সূচনা হয়। ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী এর আওতায় ৩১,৮৭৭টি প্রাথমিক স্কুল এবং ১৬,০২৫টি প্রি-স্কুল রয়েছে। এই কর্মসূচি আনুষ্ঠানিক স্কুলগুলোতে যেতে-না-পারা কিংবা ঝরে-পড়া ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ দানের মাধ্যমে ব্র্যাকের দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যকেই পূরণ করছে। সরকারী স্কুলগুলোতে যেসব যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, ব্র্যাক স্কুলের পাঠক্রমও সেই একই যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। সাধারণভাবে শিক্ষার প্রবেশাধিকারবঞ্চিত শিশুদেরই ব্র্যাক স্কুলগুলোতে অধিক হারে ভর্তি করা হয় এবং তারা যাতে ঝরে না পড়ে তা নিশ্চিত করা হয়। এই শিক্ষার্থীদের ৬৫ শতাংশই মেয়েশিশু। শুরুতে ব্র্যাক স্কুলে ১৪,৪৭১ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে এবং তাদের দৃষ্টি, বাক ও শ্রবণ বৈকল্য উত্তরণে সহযোগিতা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অন্তর্গত ছেলেমেয়েদেরও ব্র্যাকের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এ যাবত্ এই জনগোষ্ঠীর ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে ব্র্যাক স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। এদের ৫৬ শতাংশই মেয়ে।
গ্রামবাংলার কারুশিল্পীদের পণ্য বিপণনের মাধ্যমে এই কারুশিল্পের বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্য ফজলে হাসান আবেদ গড়ে তুলেছিলেন ‘আড়ং’। ১৯৭৬ সালে মানিকগঞ্জে কাজ করতে গিয়ে তাঁর মাথায় ‘আড়ং’ গড়ে তোলার ভাবনা এসেছিল। মানিকগঞ্জে প্রাকৃতিকভাবেই ভেরেণ্ডা গাছ জন্মায়। আর ভেরেণ্ডা রেশমপোকার খাদ্য। এই পাতা খেয়ে পোকা যে রেশম তৈরি করে, তার নাম ‘এনডি সিল্ক’। রেশমসুতা তৈরির উদ্দেশ্যে ঐ এলাকায় ভেরেণ্ডা গাছ লাগানো শুরু হল। দরিদ্র মহিলাদের রেশমপোকা পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হল। প্রায় দু-তিনশ মহিলা এনডি রেশমের গুটি তৈরি করতে লাগলেন। এগুলোর গুটি থেকে স্পিনিং করে সুতা বানিয়ে রেশমের কাপড় তৈরির কাজ শুরু হল। এসব কাপড় বাজারজাত হতে থাকল। ঢাকার কয়েকটি দোকানে এগুলো বিক্রি হত। কিন্তু পণ্য সরবরাহের পর টাকা পেতে পেতে দু-তিন মাস কেটে যেত। এমতাবস্থায় পণ্য সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে অর্থপ্রাপ্তি দ্রুত নিশ্চিত করার ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় ‘আড়ং’। ১৯৭৮ সালের প্রথম দিকে ‘আড়ং’-এর কার্যক্রম শুরু হয়। এখন ‘আড়ং’ ব্র্যাকের সফল প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি।
ব্র্যাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্ট ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’। ১৯৮৩ সালে এই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় মানিকগঞ্জে। ‘আড়ং’-এর কারুপণ্যের একটি বৃহত্ অংশের জোগান দেয় ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামীণ মহিলাদের হাতের কাজ তথা কারুপণ্য তৈরির কার্যক্রম দেশের অনেকাংশ জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে। ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে বহু গ্রামীণ নারী কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। যাঁরা হাতের কাজ জানেন, তাঁদেরকে এখানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা হয় এবং হাতেকলমে কাজ শেখানো হয়। মানিকগঞ্জের পর জামালপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, শেরপুর, পাবনা এসব স্থানে ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’ গড়ে তোলা হয়েছে। এখন দেশব্যাপী এই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে।
অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসূচি
২০০২ সালের জানুয়ারী মাসে ব্র্যাক অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে Challenging the Frontiers of Poverty Reduction – Targeting the Ultra Poor (CFPR-TUR) কর্মসূচি চালু করে। সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থানকারী পরিবারকে চিহ্নিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট নির্ণায়ক রয়েছে। এই পরিবারগুলো অতি দারিদ্র্যের কারণে প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির আওতায় ঋণ গ্রহণ করতে পারে না। এদের জন্য ব্র্যাক একটি কার্যকর ও গতিশীল ভর্তুকিনির্ভর কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। এই কর্মসূচি ইতিমধ্যে দেশ ও বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং অন্য উন্নয়ন সংগঠনগুলোর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
দেশের মাটি ছাড়িয়ে ব্র্যাক
ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্নের ব্র্যাক দেশের মাটি ছাড়িয়ে এখন বিদেশেও কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্র্যাকের অভিজ্ঞতা প্রযোজ্য হতে পারে এই উপলব্ধি থেকে ব্র্যাক আফগানিস্তান কার্যক্রম শুরু হয়। বিশ্বব্যাপী ব্র্যাকের সুনাম এবং বাংলাদেশে পরিচালিত তার কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করে আফগান সরকার সেদেশের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করার জন্য ব্র্যাককে আমন্ত্রণ জানালে ফজলে হাসান আবেদ সেখানে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। কীভাবে এই কর্মকাণ্ডের সূচনা হল এ প্রসঙ্গে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘আমি যখন ২০ লক্ষ আফগান শরণার্থীকে স্বদেশে ফিরে যেতে দেখলাম, তখন আমার ১৯৭২ সালের কথা মনে পড়ল। তখন মুক্তিযুদ্ধ শেষে এককোটি বাংলাদেশী শরণার্থী ফিরে আসছিল। আমি ভাবলাম, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের সব ধরনের অভিজ্ঞতা তো আমাদের রয়েছে। ভাবলাম, আমাদের জনাপঞ্চাশেক কর্মীকে আফগানিস্তানে পাঠালে কেমন হয়। আমরা প্রাথমিকভাবে আমাদের পঞ্চাশজন কর্মীকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে পাঠালাম। তারা গিয়ে স্থানীয় আফগানদের মধ্য থেকে কর্মীদল জোগাড় করল। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে আফগানিস্তানের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে প্রথমে আমাদের কিছুটা সমস্যা হয়েছিল, তবে তা তেমন বড় কিছু নয়।’
বর্তমানে ব্র্যাক আফগানিস্তানে ক্ষুদ্রঋণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আয়বর্ধক কার্যক্রম এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক উদ্যোগে সেদেশের জনসাধারণকে সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে।
ব্র্যাকের অন্যান্য কার্যক্রম
ফজলে হাসান আবেদ উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে জাতীয় ক্ষেত্রে অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়ে ২০০১ সালে শুরু করেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। সমাজের চাহিদা এবং প্রয়োজনের প্রতি সজাগ দৃষ্টিপাত, সৃজনশীল নেতৃত্ব তৈরি, শিক্ষা এবং জ্ঞানসৃষ্টিকে সামনে রেখে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি তার কার্যক্রম শুরু করে। ব্র্যাকের আরেকটি উদ্যোগ ব্র্যাক ব্যাংক। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক ব্যাংক। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের বিকাশে সহায়তা প্রদান করাই এই ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য। বর্তমানে এই ব্যাংকের ১২টি শাখা অফিস এবং ২৯০টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ ইউনিট (এসএমই) রয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক সর্বাধিকসংখ্যক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সেবা প্রদান করছে এবং প্রতিবছর সেবার আওতাবহির্ভূত সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের প্রতি সেবার হাত প্রসারিত করে কার্যক্রমের পরিধি বাড়িয়ে চলেছে।
নিজের কাছে ফজলে হাসান আবেদ
নিজের সম্পর্কে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘মানুষ হয়ত মনে করে, আমি একজন সফল মানুষ। আমি নিজের কাজে খুশি কিন্তু আত্মতৃপ্ত নই। এটা ভাবতে ভাল লাগে যে, আমি মানুষের জন্য কাজ করছি। যাদের কথা কেউ ভাবে না আমি তাদের কথা ভাবছি। তাদের জন্য কিছু করতে পেরেছি। বাংলাদেশে বাস করে কারও পক্ষে আত্মতৃপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। মানুষের দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র্য দেখে আত্মতৃপ্ত হওয়া যায় না। মানুষ যে কত অসহায় হতে পারে আমি কাজ করতে গিয়ে তা দেখেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই মানুষগুলোর জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারলাম কই? তারপরও আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে আমরা সামান্য হলেও অবদান রাখতে পেরেছি। আমরা দরিদ্র মানুষের জন্য অনেক কাজ করেছি, এখনও করছি। তবে এও বলি, এখনও অনেক মানুষ দরিদ্র রয়ে গেছে, তাদের জন্য আমরা এখনও কিছুই করতে পারিনি।’
সম্মান, স্বীকৃতি, সংবর্ধনা
ফজলে হাসান আবেদ তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক সম্মান পেয়েছেন, পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। আন্তর্জাতিকভাবে তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। তিনি র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, ইউনেস্কো নোমা পুরস্কারের মত বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন।
ক্রমিকনং | বছর | পুরস্কারের নাম | প্রদানকারী সংগঠন |
১ | ১৯৮০ | র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার | ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড ফাউন্ডেশন, ম্যানিলা |
২ | ১৯৮৫ | ইউনেস্কো নোমা পুরস্কার | ইউনেস্কো |
৩ | ১৯৯০ | এ্যালান শন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার | ব্রাউন ইউনিভার্সিটি |
৪ | ১৯৯২ | ইউনিসেফ মরিস পেট পুরস্কার | ইউনিসেফ |
৫ | ২০০১ | ওলফ পামে পুরস্কার | ওলফ পামে ফাউন্ডেশন, স্টকহোম |
৬ | ২০০২ | সোশ্যাল অন্ট্রেপ্রেনিওরশিপ পুরস্কার | ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম, জেনেভা |
৭ | ২০০৩ | গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার | |
৮ | ২০০৪ | গেটস গ্লোবাল হেলথ পুরস্কার এবং ইউএনডিপি মাহবুবুল হক মানব উন্নয়ন পুরস্কার (এই পুরস্কার প্রবর্তনের পর তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি এটি অর্জন করেন। এর আগে এই পুরস্কারটি অর্জন করেছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট কার্ডোসো) | গ্লোবাল হেলথ কাউন্সিল ইউএনডিপি |
৯ | ২০০৪ | জাতীয় আইসিএবি |
এ ছাড়া তিনি ১৯৯৪ সালে কানাডার কুইনস ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব ল’ এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব এডুকেশন’ ডিগ্রি লাভ করেন।
২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারীতে ফজলে হাসান আবেদকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছ থেকে তিনি এই উপাধি গ্রহণ করেন।
মৃত্যু-২০ ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে (বয়স ৮৩) তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : মাকসুদা বেগম