অ্যাথলেটিক্স ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র শামীম আরা টলি
‘তখন আমি খুব ছোট, ৬ষ্ঠ বা ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী। একদিন পাকিস্তানের বিশিষ্ট অ্যাথলেটিক্স কোচ মেজর হামিদ এসেছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির মাঠে। উদ্দেশ্য ছেলে এবং মেয়েদের অ্যাথলেটিক্সে পরীক্ষা নেয়া। সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য অন্যান্য অনেকের মত আমিও উপস্থিত হই সেখানে। পরীক্ষার নিয়ম ছিল কোচ ‘আপ’ শব্দটি বলার পর প্রত্যেকের হাতে একটি করে ব্যাটন (লাঠি) দিবে এবং প্রত্যেককে ব্যাটন নিয়ে দৌড়াতে হবে। কিন্তু আমি ‘আপ’ বলার পর ব্যাটন না নিয়েই দৌড় দিয়েছিলাম এবং প্রথম হয়েছিলাম। কোচ মেজর হামিদও সেদিন ছুটেছিলেন আমার পিছনে পিছনে কিন্তু আমাকে ধরতে পারেননি’ – গল্প করতে করতে তিনি যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জীবনের সেই ভালোলাগার মুহূর্তগুলোর মাঝে। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ থেকে শুরু, ছোট সেই মেয়েটিই ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার আসরে ঢাকা স্টেডিয়াম মাঠে জনপ্রিয় ইভেন্ট প্রমিলাদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টারে মাত্র ১৩.৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। পেয়েছিলেন ‘দ্রুততম মানবী’ হওয়ার খেতাব। একই বছর ২০০ মিটার স্প্রিন্টারে মাত্র ২৮.৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে নতুন রেকর্ডও গড়েছিলেন তিনি। আর তাইতো ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি তাঁকে শ্রেষ্ঠ মহিলা অ্যাথলেট এর স্বীকৃতি দিয়েছিলো।
সেই ৬ষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণী থেকে শুরু এরপর আর থেমে থাকেনি তাঁর সামনে এগিয়ে চলা। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত অ্যাথলেটিক্স এর আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলেছিল তাঁর নাম। শুধু দেশের মাটিতেই নয়, পুরুষ অ্যাথলেটদের পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও তিনি বিস্ময়কর রেকর্ড গড়েছিলেন। শুধু ১০০ মিটার স্প্রিন্টারেই নয়, ২০০ মিটার স্প্রিন্টারে। এবং ৪০০ মিটার স্প্রিন্টারেও বেশ কয়েকবার প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছেন তিনি। সেই সময়ের ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের মূল আকর্ষণই ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের অ্যাথলেটিক্স জগতে তিনি ছিলেন নিজের অবস্থানে অদ্বিতীয়, সেই সময়ে তাঁর চেয়ে বয়সে বড় অনেকেই খেলতে গিয়ে হেরে গিয়েছেন বহুবার। এরপরে বিয়ে করে তিনি খেলা ছেড়ে দেন। কোচ হিসেবেও সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক বছর, সেই সাথে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার।
শুধু দৌড়েই নয়, তিনি দীর্ঘলম্ফ খেলেও প্রথম হয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। দৌড়বিদ হলেও খেলতে ভালো লাগতো বলেই দীর্ঘলম্ফ খেলতেন এবং সেখানেও তাঁর সফলতা ছিল দৌড়ের মতই। তাইতো ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে আন্তঃস্কুল দীর্ঘলম্ফ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। এছাড়া তিনি উচ্চলম্ফ ও হার্ডেলসও খেলতেন। এসব কিছুর বাইরে অবসরে গান শুনতে, গান গাইতে এবং তিনি কবিতা আবৃত্তি করতে খুব পছন্দ করেন।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
শামীম আরা টলির জন্ম এমনই এক পরিবারে যে পরিবারের সকলেই খেলাধুলা পছন্দ করতেন। ১৯৫৭ সালের ১৭ আগষ্ট ঢাকার শান্তিনগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এরপর বাবার চাকরির সুবাদে বাল্যকালেই চলে আসেন ঢাকার এজিবি কলোনিতে। ছোটবেলায় যখন খেলাধুলা করতে শিখেছেন, পারিবারিকভাবে তখন থেকেই খেলার জন্য মাঠে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। বাবা ওয়াজেদুল হক খান খেলাধুলা পছন্দ করতেন এবং ভালোবাসতেন, সে কারণেই তিনি মেয়েদের খেলাধুলাকে সবসময় উদ্বুদ্ধ করতেন। বাবাই তাঁকে খুব ছোট বেলায় আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের মুক্তা ভাইয়ের কাছে খেলা শেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর প্র্যাকটিস করার সময়গুলোতে বাবা এবং বড় ভাই সবসময় সাথে থাকতেন। ফলে তাঁকে কখনই পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়নি।
শামীম আরা টলির জন্ম এমনই এক পরিবারে যে পরিবারের সকলেই খেলাধুলা পছন্দ করতেন। ১৯৫৭ সালের ১৭ আগষ্ট ঢাকার শান্তিনগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এরপর বাবার চাকরির সুবাদে বাল্যকালেই চলে আসেন ঢাকার এজিবি কলোনিতে। ছোটবেলায় যখন খেলাধুলা করতে শিখেছেন, পারিবারিকভাবে তখন থেকেই খেলার জন্য মাঠে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। বাবা ওয়াজেদুল হক খান খেলাধুলা পছন্দ করতেন এবং ভালোবাসতেন, সে কারণেই তিনি মেয়েদের খেলাধুলাকে সবসময় উদ্বুদ্ধ করতেন। বাবাই তাঁকে খুব ছোট বেলায় আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের মুক্তা ভাইয়ের কাছে খেলা শেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর প্র্যাকটিস করার সময়গুলোতে বাবা এবং বড় ভাই সবসময় সাথে থাকতেন। ফলে তাঁকে কখনই পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়নি।
শৈশব কাল
শামীম আরা টলির বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকার এজিবি কলোনিতে কাটে তাঁর শৈশব কাল। তাঁর নয় ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। শৈশবের দিনগুলো সম্পর্কে শামীম আরা টলি বলেন, ‘ছোটবেলায় ঢাকার এজিবি কলোনিতে দিনগুলো ছিল খুব বেশি ভালোলাগায় ভরা। অনেক ভাইবোনের একটি আনন্দময় সংসার ছিল আমাদের। আমি অথবা আমার বড় বোন যখন প্রতিযোগিতায় জিততাম তখন বাবা, মা, ভাই, বোনের উত্সাহ ও ভালোবাসার কথা মনে পড়লে এখনও শিহরিত হই।’ ছোটবেলায় শামীম আরা টলি দেখতেন, বড় বোন কোয়েল বিভিন্ন সময় খেলায় জিতে পুরস্কার নিয়ে আসতেন। তখন বাবা-মায়ের খুশি হওয়া দেখে নিজেও বড় বোনের মত চিন্তা করতেন। ভাবতেন একদিন তিনি নিজেও বড় বোনের মত পুরস্কার নিয়ে আসবেন। তাঁকে নিয়েও পরিবারের সবাই আনন্দে মেতে উঠবেন। বড় বোনই তাঁর মধ্যে অ্যাথলেটিক্সের বীজ বুনে দেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশের নাম করা একজন অ্যাথলেট হবার স্বপ্ন দেখতেন।
শামীম আরা টলির একজন ভাইও গোলক ও চাকতি নিক্ষেপ খেলতেন। সব সময় তিনি যার নামটি খুব বেশি করে স্মরণ করেন তিনি হচ্ছেন তাঁর বড় বোন কোয়েল। কারণ কোয়েলও ভালো অ্যাথলেট ছিলেন। তিনি বড় বোনকে দেখে অ্যাথলেটিক্সের দিকে মনোযোগ দেন। তিনি জয়ী হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই জীবনের প্রতিটি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। স্কুল থেকে শুরু করে যেখানেই তিনি খেলেছেন, কখনও তাঁকে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়নি। যখন শামীম আরা টলি একের পর এক প্রতিযোগিতায় জিততে থাকেন, তখন তিনি মাত্র ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী। শৈশব থেকেই খেলার জগতে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। স্কুল জীবনে তিনি প্রতিবছরই স্কুলের পক্ষ হয়ে খেলে পুরস্কার নিয়ে আসতেন। এজন্য তিনি স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও সবসময় প্রিয় ছিলেন। তাঁর সাফল্যের জন্য তাঁকে স্কুল থেকে গোল্ড মেডেল দেয়া হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন দুরন্ত। যে বড়বোনের হাত ধরে তিনি অ্যাথলেটিক্সের জগতে আসেন, সেই বড়বোন কোয়েল ছোট বোনের খেলা দেখে ১৯৬৬ সালে নিজে খেলা ছেড়ে দেন। বড় বোন প্রসঙ্গে শামীম আরা টলি বলেন, ‘কোয়েল আপার ভয় ছিল তিনি যদি আমার সাথে হেরে যান তাহলে হয়তো আমি খুব কষ্ট পাবো এবং হয়তো আর কখনোই খেলবো না। তাই আমি যখন থেকে প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে থাকি তখন তিনি খেলা ছেড়ে দেন।’ তাঁর বড় বোন কোয়েল যখন প্র্যাকটিস করার জন্য মাঠে যেতেন, তিনি তখন টলিকে সাথে নিয়ে যেতেন। এভাবেই বড় বোনকে দেখতে দেখতে একদিন তিনি যোগ দেন অ্যাথলেটিক্সে।
বড় বোন কোয়েল আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর বাবাও একই ক্লাবের সাথে জড়িত ছিলেন। একদিন স্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হন টলি। অন্য কোথাও দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেও তাঁকে পেছনে ফেলে কেউ উঠতে পারতেন না। যেখানেই দৌড়াতে নামতেন সেখানেই সবার সামনে থাকতেন তিনি। আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায়ও তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে যান। এভাবে শুরু হওয়া দেখেই বাবাও বুঝতে পেরেছিলেন টলি একদিন অ্যাথলেটিক্স ইতিহাসের একজন কিংবদন্তি হয়ে উঠবেন। বাবা মেয়ের এ সাফল্য দেখে তাঁকে নিয়ে যান আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের মুক্তা ভাইয়ের কাছে। মুক্তা ভাইয়ের সহযোগিতায় এবং নিজের চেষ্টায় তিনি বাবার এ ধারণাকে একদিন সত্যিই বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন। আর তাইতো ১৯৭০ সালে পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিত অ্যাথেলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে তৃতীয় এবং চতুর্থ ও ১০০ মিটার রিলেতে দ্বিতীয় হয়ে বাংলাদেশের (তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তান) মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। এর আগে ‘৬৭ সালে তিনি প্রাদেশিক প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার স্প্রিন্টারে তৃতীয় এবং ‘৬৮ সালে ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে তৃতীয়, ২০০ মিটারে দ্বিতীয় এবং ৮০ মিটার হার্ডলসে তৃতীয় স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন।
শৈশবের অধিকাংশ সময় তাঁর কাটতো লেখাপড়া এবং প্র্যাকটিস করে। তখন স্কুলের সময়েও ছুটি নিয়ে তাঁকে প্র্যাকটিসে আসতে হতো। তাঁর ভাষায়, ‘সবসময় স্কুলে ক্লাস করতে পারতাম না। কিন্তু তাতে আমার লেখাপড়ার কোন সমস্যা কখনও হয়নি। পরিবারের সবার মত আমি আমার শিক্ষক ও সহপাঠিদের কাছ থেকেও সহযোগিতা পেয়েছি। আমার শিক্ষকরা আমাকে খুব সাহায্য করেছেন। তাঁরা আমাকে সব সময় উত্সাহ দিয়েছেন।’ শামীম আরা টলি যখন কোথাও খেলতে যেতেন, তখন তাঁকে উত্সাহ দেয়ার জন্য তাঁর সাথে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যেতেন। শুধু মাত্র পশ্চিম পাকিস্তানে বা ভারতে খেলতে গেলে সাথে কেউ যেতেন না। বড় বোন কোয়েল সেই সময়ের স্মৃতি হাতড়িয়ে বলেন, ‘প্রতিবারই আমরা টলির সাথে মাঠে যেতাম। প্রতিযোগিতা শুরু হলে আমি অপেক্ষা করতাম কখন টলি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। আমি যতবারই ওর সাথে গিয়েছিলাম, ততবারই টলি খেলা শেষ হবার পর দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, কারণ প্রতিবারই টলি প্রথম হতো, টলি যখন আমাকে জড়িয়ে ধরতো আমার খুব ভালো লাগতো। আমার বড় ভাইও আমাদের সাথে থাকতেন, তিনি সেই সময় আমাদের ছবি তুলে রাখতেন। সেই সময়গুলোর কথা মনে পড়লে এখনও খুব ভালো লাগে। আমি টলির চেয়ে বয়সে অনেক বড়, আমি যখন খেলা ছেড়ে দেই সেই সময়ে টলি খেলা শুরু করে। কিন্তু আমি প্রায় প্রত্যেক প্রতিযোগিতার সময় টলির সাথে যেতাম। ছোটবেলা থেকেই ও খুব ভালো অ্যাথলেট ছিল।’ টলি বলেন, ‘প্রতিযোগিতার সময় কোয়েল আপা আমার সাথে না থাকলে আমি খেলায় মন বসাতে পারতাম না।’
শিক্ষা জীবন
তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় ঢাকা স্টাফ ওয়েলফেয়ার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। সেখানেই প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্ব শেষ করেন তিনি। এরপর মাধ্যমিক স্তর পার করেন টি এন্ড টি হাইস্কুল থেকে এবং সেখান থেকেই ১৯৭৩ সালে এস.এস.সি. পাশ করেন। পাশ করার পর ভর্তি হন ইডেন কলেজে, কলেজে থাকা অবস্থায় আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতায় বহুবার তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। সে সময় তিনি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের পাশাপাশি মতিঝিলের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে অ্যাথলেটিক্স-এ অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৭৫ সালে ইডেন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে তিনি ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। ১৯৭৭ সালে জগন্নাথ (পরবর্তীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেন। শিক্ষা জীবনের পুরো সময়টিতে তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি অ্যাথলেটিক্স প্র্যাকটিস এবং প্রতিযোগিতা চালিয়ে গেছেন। তিনি লেখাপড়ার সময়কালেই সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন।
কর্মজীবন
শামীম আরা টলির কর্মজীবন শুরু হয় বিয়ের পর থেকেই। তখন থেকে তিনি আর খেলায় অংশগ্রহণ করেননি। ১৯৭৭ সালে তিনি অ্যাথলেটিক্সে অংশগ্রহণ করা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। এরপর শুরু হয় তাঁর কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। তবে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময়ও মাঝে মাঝে তিনি রিলে খেলতেন। বিটিএমসি (বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন)’র অ্যাথলেটিক্স কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। জন্ম হয় একজন কোচ শামীম আরা টলির। সেখানেও তিনি সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক বছর। সেই সময় জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড কর্তৃক আয়োজিত রেফারি ও আম্পায়ার প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে সনদপত্র লাভ করেন। তারপর ১৯৯৭ সালে তত্কালীন সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় অবসরে যেতে বাধ্য হন। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমস- এ তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় তাঁকে বিচারকের দায়িত্ব পালন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
পারিবারিক জীবন
‘দুই প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন এ্যাথলেট রতন-টলির বিয়ে হল’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটির একটি কপি এখনও সযতনে রেখে দিয়েছেন শামীম আরা টলি। ১৯৭৮ সালে যেদিন শামীম আরা টলি এবং জহরুল হক রতনের বিয়ে হয় তারপর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায়। অনেক ক্রীড়াপ্রেমীদের ভালোবাসায় সিক্ত শামীম আরা টলি বিয়ে করেন আর একজন জনপ্রিয় অ্যাথলেট জহরুল হক রতনকে। স্বামী রতনও ম্যারাথনে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত পর পর পাঁচ বছর প্রথম হওয়া বাংলাদেশের একজন নামকরা অ্যাথলেট। বিয়ের পূর্বেই স্বামী রতনের সাথে পরিচয় ছিল তাঁর। একই মাঠে তাঁরা প্র্যাকটিস করতেন। টলির দুটি সন্তানের মধ্যে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। মেয়ে শায়লা নাসরীন ডালিয়া এবং ছেলে মঞ্জুরুল হক পলাশ। নিজে এবং স্বামী অ্যাথলেট হলেও সন্তানদের তিনি অ্যাথলেট হিসেবে তৈরি করেননি। খেলাধুলার পরিবেশ না থাকার কারণেই তিনি সন্তানদের অ্যাথলেট হিসেবে তৈরি করেননি বলে জানান। শামীম আরা টলির স্বামী এবং সন্তানরা সব সময় তাঁকে নিয়ে গর্ব করেন। তিনি যেমন একজন ভালো অ্যাথলেট ছিলেন তেমন সাংসারিক জীবনে একজন ভালো স্ত্রী এবং একজন আদর্শ মা-ও। ‘সহধর্মিনী হিসেবে শামীম আরা টলি অসম্ভব ভালো একজন নারী’ এক বাক্যে এ কথাটিই বলেন স্বামী জহরুল হক রতন।
ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতে অ্যাথলেটিক্সে যাঁর নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে, সেই মেয়েটি হচ্ছেন শামীম আরা টলি। ১৯৭৩ সাল থেকে বিশ্বের অ্যাথলেটিক্স ইতিহাসে বাংলাদেশের নামের সাথে সাথে তাঁর নামও বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত ছিল। অ্যাথলেটিক্স প্রেমীরা সকলেই তাঁর ক্রীড়া নৈপুণ্যের কথা জানেন। তিনি তাঁর খেলার সময়গুলোতে সবসময় নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাইতো শামীম আরা টলি মানেই অ্যাথলেটিক্সের সেই মেয়েটি। অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি যেমন গিয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আবার তেমনি নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করেছেন দেশের বাইরের মাটিতেও। খুব ছোটবেলায় পাকিস্তানের করাচিতে যাওয়ার পাশাপাশি তিনি ভারতের দিল্লীতেও খেলতে গিয়েছেন বেশ কয়েকবার এবং প্রতিবারই জয়ের গৌরব অর্জন করে ফিরে এসেছেন বাংলাদেশের মাটিতে। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স দলের প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশের যে তিনজন কৃতি খেলোয়াড় জয়ের গৌরব অর্জন করেছিলেন, শামীম আরা টলি তাঁদের একজন।
বাংলদেশের প্রথম ‘দ্রুততম মানবী’ হওয়ার খেতাব অর্জন করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে বছর ঢাকায় প্রথম অ্যাথলেটিক্স এর আসর বসেছিল, আমি খেলেছিলাম আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে এবং তিনটি স্প্রিন্টারে প্রথম হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দ্রুততম মানবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। একই ইভেন্টে দ্বিতীয় হয়েছিলেন দেশের আর এক কৃতি অ্যাথলেট সুলতানা আহমেদ খুকি আর তৃতীয় হয়েছিলেন দিনাজপুর থেকে আসা শামীমা আক্তার মিমু। একই সময়ে যখন নতুন রেকর্ডের জন্ম দিয়ে ২০০ মিটার ইভেন্টে জয়ী হই আমি, তখন রিলেতে আমার সহযোদ্ধা ছিলেন হাসিনা, রোজী আর অনু। তাঁদেরকে সাথে নিয়েই স্বর্ণ জিতেছিলাম।’
টলির ক্রীড়াজীবনের শুরুতে তাঁর পাশাপাশি খেলতেন বাংলাদেশের আরও বেশ কয়েকজন প্রমিলা অ্যাথলেট। অনেক সময় তিনি তাঁদের কাছে হেরে যেতেন আবার ফিরে আসতেন নিজের অবস্থানে। এমনই একটি ঘটনা ঘটে ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৪ সাল জাতীয় অলিম্পিকে বিটিএমসি’র (বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন) হয়ে লড়েন শামীম আরা টলি। কিন্তু ১০০ এবং ২০০ মিটার স্প্রিন্টার দুটোতেই তিনি শীর্ষ পদ হারিয়ে দ্বিতীয় হন। দ্রুততম মানবী হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া খাতুন। এতে তিনি সামান্যও ভেঙে পড়েননি বরং উত্সাহের সাথে প্র্যাকটিস চালিয়ে গেছেন। ফলে ১৯৭৫ সালে যশোরে অনুষ্ঠিত জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আবার নিজের শীর্ষস্থান পুনরুদ্ধার করেন। ১৯৭৭ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায়ও একই ফলাফল করেন তিনি। তাঁর আদর্শ অ্যাথলেট সুফিয়া খাতুন তাঁর নিকট বেশ কয়েকবার হেরে গেছেন বলে তিনি জানান।
অ্যাথলেটিক্স এর প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি স্মরণ করেন আর একজন অ্যাথলেট সুলতানা আহমেদের কথা। সুলতানা ছিলেন তাঁর কাছে আর একজন আদর্শ অ্যাথলেট। সুলতানা আহমেদ ছিলেন বয়সে তাঁর চেয়ে অনেক বড়। সুলতানা আহমেদের সাথে তাঁর দেখা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তিনি ৬ষ্ঠ কিংবা ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী। সেই থেকেই সুলতানা আহমেদ তাঁকে খুব আদর করতেন। বয়সে বড় হলেও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সুলতানা আহমেদকে তাঁর কাছে অনেকবার পরাস্ত হতে হয়েছে। তিনি মনে করেন সুলতানা আহমেদর কাছ থেকে তিনি অ্যাথলেটিক্সে অনেক কিছু শিখতে পেরেছিলেন। এখনো প্রিয় অ্যাথলেট সুলতানাকে খুব মনে পড়ে। এছাড়া তাঁর সময় অন্যান্য যারা খেলতেন তাদের সকলকেই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। সেই সময়ে তিনি যাদের সাথে ঢাকায় এবং বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে গিয়েছেন, যাদেরকে সাথে করেই স্বর্ণ জিতেছেন তাদের মধ্যে কয়েকজন হচ্ছে সহযোদ্ধা হাসিনা, রোজী, অনু, সুফিয়া, কামরুন্নেসা লিপি। একই সাথে তাঁরা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছিলেন।
টলি তাঁর ক্রীড়া জীবনে বহু পুরষ্কার জিতেছেন। প্রতিটি খেলায় স্বর্ণ এবং রৌপ্য ছিনিয়ে এনেছিলেন তিনি। সেসব সাফল্যের মধ্যে রয়েছে ১৯৭৩ এবং ‘৭৫ সালে তিনটি ইভেন্টেই স্বর্ণপদক লাভ। ‘৭৪ সালে ২টি রৌপ্য এবং ১টি স্বর্ণপদক লাভ। ‘৭৩ সালে তিনি ১০০ মিটার, ২০০ মিটার এবং ৪x১০০ মিটার রীলে স্প্রিন্টারে ৩টি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। ‘৭৫ সালে তিনি তিনটি ইভেন্টেই স্বর্ণপদক এবং ‘৭৬ সালে ২টি রৌপ্য এবং ১টি স্বর্ণপদক লাভ করেন। তাঁর রয়েছে বহু সংখ্যক মেডেল, এছাড়া প্রতিটি প্রতিযোগিতায় জয়ী হবার পর তাঁকে দেয়া সার্টিফিকেটগুলোও রয়েছে। ক্রীড়া লেখক সমিতি কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মহিলা অ্যাথলেটিক্সের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে দেয়া হয় একটি ক্রেষ্ট। জীবনে জয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ এই পুরস্কারগুলো তাঁর অত্যন্ত প্রিয়।
এখন প্রমিলা অ্যাথলেট বেশি নেই বলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। যখন থেকে তাঁর অ্যাথলেটিক্স জীবন শুরু হয় তখন বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক জেলার মেয়েরা সামাজিক অবস্থানের কারণে অ্যাথলেটিক্স এ আসার কথা চিন্তাও করতে পারতেন না। ধর্মীয় গোঁড়ামীতে আচ্ছন্ন একটি সময়ে তাঁকে খেলতে হয়েছে। সেই সময়ে খেলতে যেয়ে তাঁকে এবং তাঁর বড় বোনকে বহু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল তাঁদের প্র্যাকটিস করার মত কোন স্থান ছিল না। এ প্রসঙ্গে শামীম আরা টলি’র বড় বোন কোয়েল বলেন, ‘এখনতো প্র্যাকটিস করার মতো মাঠ আছে। আমাদের সময় কোথাও একটি মাঠ ছিল না। মতিঝিলের একটা মাঠে ছেলেরা খেলতো, সেই মাঠের এক কর্ণারে আমরা প্র্যাকটিস করতাম। সেই সময় টলি অনেক ছোট, তবুও আমরা দুই বোন একসাথে খেলতে যেতাম, আর আমাদের সাথে যেতেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের মুক্তা ভাই। মুক্তা ভাই ছাড়া সে সময় অ্যাথলেট কোচ কাজী আবদুল আলীম ভাইও অনেক সাহায্য করেছেন। আলীম ভাইয়ের বোনরাও সে সময় খেলতেন। একদিন নটরডেম কলেজের মধ্যে খেলতে গিয়েছিলাম কিন্তু কলেজের ফাদার আমাদের খেলতে দেয়নি। কারণ সকালে নাকি মেয়েদের মুখ দেখা যাবে না। স্কুলের মাঠেও ক্লাস ছুটির পর খেলা যেতো না। কারণ তখন স্কুল খালি থাকে। তাই প্রতিদিন সকালে আমরা দুই বোন ফজরের আজানের আগে রাস্তায় দৌড়াতাম। তখন আমাদের সাথে বাবা আর বড় ভাই থাকতেন। ফজরের আজান দিলে সবাই নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে আমরা প্র্যাকটিস শেষ করে ঘরে ফিরতাম।’
খেলাকালীন সময়ে যে বিষয়টি টলির খারাপ লাগতো সেটি হল তাঁরা যখন প্র্যাকটিস করতেন চারিদিকে ভীড় করে তখন সবাই তাঁদের দেখতো। সেই সময়ে যেসব মেয়েদের পারিবারিক অবস্থান ভালো ছিল তারাই বেশি এই খেলায় আসতো। তাঁদের সময় শহুরে মেয়েরাই অ্যাথলেটিক্সে নাম লেখাতো। এখন শহরের মেয়েদের অংশগ্রহণ না থাকায় যোগ্য প্রমিলা অ্যাথলেট তৈরী হচ্ছে না। তার সময়ের প্রতিকুলতা সম্পর্কে টলি বলেন, ‘এখন মেয়েদের বিকেএসপি’র মত একটি স্থানে অ্যাথলেটিক্স শেখানো হয়, এছাড়া রয়েছে অন্যান্য অনেক সুবিধা। আমাদের সময় একজোড়া ভালো রানিং সু পাওয়া যেতো না। আমার সু জোড়া আমার বাবা এনে দিয়েছিলেন। আমরা একজন ভালো প্রশিক্ষক পাইনি। আমাদের সময় সামাজিক, অর্থনৈতিক অনেক ধরনের সমস্যার মধ্যেও প্রমীলা অ্যাথলেটের সংখ্যা কম ছিল না, এখন যত দিন যাচ্ছে ততই প্রমীলা অ্যাথলেটের সংখ্যা কমে আসছে। এখন সবাই টার্ফে দৌড়ালেও আমাদের সময়ে টার্ফ ছিল না। তারপরও মেয়েরা অ্যাথলেটিক্স এ নাম লেখাতো। আমাদের সময় আন্তঃস্কুল, ইন্টার-কলেজ, ইন্টার-বিভাগ প্রতিযোগিতা হতো। এখন সেই প্রতিযোগিতা না হওয়ায় প্রমীলা অ্যাথলেট ও তৈরি হচ্ছে না।’
সম্মান, স্বীকৃতি, সংবর্ধনা
১৯৬৭ সনে প্রাদেশিক প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করেন, ‘৬৮ সনে ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে তৃতীয়, ২০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয়, ও ৮০ মিটার হার্ডলস-এ তৃতীয় হন তিনি। ১৯৭০ সনে পাকিস্তানের পাঞ্জাবে প্রথম জাতীয় মহিলা অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে প্রথম এবং ব্যক্তিগত চ্যাস্পিয়ন হন। ১৯৭৩ সনে আন্তঃকলেজ অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড় এবং দীর্ঘ লম্ফতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। ওই বছরই বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়, ২০০ মিটার দৌড় এবং ৪x১০০ মিটার রিলেতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করে এবং দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার এবং ২০০ মিটার দৌড়ে তৃতীয় হন। ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয় এবং ১০০ মিটার হার্ডলস-এ তৃতীয় হন। একই বছরে আন্তঃকলেজ অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে এবং দীর্ঘ লম্ফতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।।১৯৭৫ সনে তৃতীয় জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার দৌড় এবং ১০০ মিটার রিলেতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং এই বছরই আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে তিনি প্রথম হন।। একই বছর বাংলাদেশ লেখক সমিতি তাঁকে শ্রেষ্ট মহিলা অ্যাথলেটের স্বীকৃতি দেন। ১৯৭৬ সালে ৪র্থ জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে তিনি দ্বিতীয় হন। এছাড়া ১৯৭৫ সালে প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রশিক্ষণ কোর্সে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বোর্ড কর্তৃক আয়োজিত রেফারি ও আম্পায়ার প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে সনদপত্র লাভ করেন এবং জাতীয় খেলাধুলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে জিমন্যাষ্টিকস্-এ সনদপত্র লাভ করেন।
এত সফলতা যাঁর, সেই মানুষটিকে যখন জাতীয় পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তখন সকলেই স্বীকার করবেন যে তাঁর উপরে অন্যায় করা হয়েছে। বাংলাদেশে অনেককেই জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হলেও শামীম আর টলি অনেকদিন জাতীয় পুরস্কার পাননি। অথচ তাঁর অর্জনই বলে দেয় তিনি এ পুরষ্কারের জন্য যোগ্য ছিলেন। তিনি শুধু বাংলাদেশেই দ্রুততম মানবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেননি, যখন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান একত্রে ছিল, তখনও তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে প্রতিবারই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিলেন। অবশেষে তিনি অ্যাথলেটিক্স-এ জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার-২০০৯ পান।
যতবারই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে খেলতে গিয়েছেন ততবারই তিনি জয়ী হয়েছেন। সে দিক থেকে হলেও তিনি জাতীয় পুরস্কারের একজন দাবিদার ছিলেন। তাঁর কৃতিত্বের কথা মাথায় রাখলে অ্যাথলেটিক্স প্রথম যে প্রমীলা অ্যাথলেটকে পুরস্কার দেয়া উচিত ছিল সে মানুষটি তিনি। দেশের প্রথম দ্রুততম মানবী-এই খেতাবই তাঁকে সব সময় অনুপ্রাণিত করে আসছে। এই অনুপ্রেরণা নিয়েই তিনি বেঁচে ছিলেন। তাঁর নিজের মধ্যে রাগ বা কষ্ট না থাকলেও তার স্বামী জহুরুল হক রতন স্ত্রীর এই অবমাননা মেনে নিতে পারেননি, তাইতো রাগে, অভিমানে তিনি টলির সমস্ত ক্রেষ্ট এবং মেডেলগুলো বস্তাবন্দি করে রেখেছেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের অ্যাথলেটিক্স প্রথম যে মেয়েটির জাতীয় পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল সে হচ্ছে তার স্ত্রী টলি। অথচ টলির পরে যাঁরা খেলেছেন তাঁদের অনেককেই জাতীয় পুরস্কার দেয়া হলেও টলিকে অনেক পরে পুরস্কার দেয়া হয়েছে। স্ত্রী হিসেবে টলিকে পেয়ে তিনি গর্ববোধ করেন। স্ত্রী সম্পর্কে স্বামী জহুরুল হক রতন বলেন, ‘একজন অ্যাথলেটের যেসব গুণ থাকা উচিত টলির মধ্যে তার কোনটির অভাব নেই। ওঁর খেলা দেখেই আমি ওকে পছন্দ করা শুরু করেছিলাম, টলি জাতীয় পুরস্কার না পাওয়ায় আমার অনেক সময় খারাপ লাগত কিন্তু টলির এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ নেই। অনেক বড় মনের মানুষ না হলে কেউ তাঁর উপরে করা এই অন্যায়কে মেনে নিতে পারেন না।’
সর্বোচ্চ স্বীকৃতি প্রাপ্ত কাজের বিবরণ
শামীম আরা টলি তাঁর যে স্বীকৃতির জন্য চিরকাল বেঁচে থাকবেন সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম দ্রুততম মানবী হওয়ার গৌরব। মাত্র ১৩.৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে ১০০ মিটার এবং ২৮.৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে ২০০ মিটার স্প্রিন্টারে প্রথম হয়ে স্বর্ণ জিতে তিনি ‘দ্রুততম মানবী’ হওয়ার খেতাব অর্জন করেছিলেন। সেটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায়। সেই সময়েই তিনি তিনটি স্বর্ণপদক অর্জন করেন।
কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকদিন অসুস্থ থাকার পর ২০১১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
শামিম আরা টলির একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাত্কার
- আপনার খেলোয়াড়ি জীবনের সাফল্যের কথা জানাবেন কি ?
‘১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম মহিলা অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয় স্থান লাভ ও ১০০ মিটার দৌড়ে তৃতীয় হই। স্বাধীনতার পর ‘৭৩ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০, ২০০ ও রিলেতে স্বর্ণপদক, ‘৭৫’এ ১০০, ২০০ও রিলেতে স্বর্ণপদক এবং ঐ বছরই ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা মহিলা অ্যাথলেট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করি।। - ভারতীয় গ্রামীণ ক্রীড়ায় সফলতার অনুভূতি কেমন ছিলো ?
অনুভূতিটা ছিল কষ্টের। কেননা ১০০ মিটার স্প্রিন্টারে আমি প্রথম থেকে সবার আগে ছিলাম।ফিনিশিং পয়েন্টে গিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখছিলাম কতটা এগিয়ে। ব্যাস ঘটলো বিপত্তি, দেখতে না দেখতেই আমার পেছনের দুজন ফিনিশিং পয়েন্টে পৌঁছে গেলো। প্যাভেলিয়নে ফেরার পর সবাই আমাকে খুব ধমক লাগিয়েছিল। - অ্যাথলেটিক্সে সেকাল আর একাল সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
আসলে তখনকার সময়ে আমাদের কোন প্রশিক্ষক ছিল না। ভালোভাবে প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাইনি। এখন সুযোগ সুবিধা বেড়েছে। মেয়েরা বেশি করে খেলাধুলায় ঝুকছে এটা ভালো লক্ষণ। তাছাড়া খেলার মানও অনেক বেড়েছে। আগে আমি ১০০ মিটার ১৩ সেকেন্ডে দৌড়াতাম, এখন ফিরোজারা ১২ কিংবা এরও কম সময়ে দৌড়াচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই শুভ লক্ষণ। - খেলোয়াড় হতে পেরে আপনি নিজেকে কি গর্বিত মনে করেন?
অবশ্যই, আমি খেলোয়াড় হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করি।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকাল – ২০০৬ সাল
লেখক : মাকসুদা বেগম