রাণী হামিদ-দাবার রাজ্যের একেশ্বরী
দাবার রাজ্যে তিনি হচ্ছেন রাণী। সাদা-কালোর লড়াইয়ে একের পর এক জয় করে চলছেন বিভিন্ন সাম্রাজ্য। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে দাবা খেলছেন তিনি। এ সময়ের মধ্যে অর্জন করেছেন অনেক শিরোপা, দেশের জন্য বয়ে এনেছেন বিরল সম্মান। দাবার রাণী আমাদের রাণী হামিদ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলছেন এখনও। পেশা হিসেবে দাবাকে গ্রহণ না করেও সংসার ও পড়ালেখার পাশাপাশি একজন নারী কীভাবে দাবার জগতে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন তা রাণী হামিদের জীবন থেকে জানা যায়। বাংলাদেশে নারীদের জন্য রাণী হামিদ এক অনুকরণীয় নাম।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
রাণী হামিদের জন্ম সিলেটে। ১৯৪৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ মমতাজ আলী পেশায় পুলিশ কর্মকর্তা ও মা মোসাম্মাত্ কামরুন্নেসা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে রাণী হামিদ তৃতীয়। চার ভাই যথাক্রমে সৈয়দ আমীর আলী, শমসের আলী, সৈয়দ দেলোয়ার আলী ও সৈয়দ মোতাহের আলী। তিন বোন সৈয়দা জমীরুন্নেসা খাতুন, সৈয়দা লুত্ফুন্নেসা খাতুন এবং মিনু মমতাজ। রাণী হামিদের পুরো নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন ডাক নাম রাণী। বিয়ের পর তিনি স্বামীর নাম যুক্ত করে রাণী হামিদ হন। ক্রীড়াজগতে তিনি রাণী হামিদ নামেই পরিচিত। তাঁর এই সুবিশাল পরিচয়ের আড়ালে সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন নামটি হারিয়ে গেছে। এখন রাণী হামিদের নামেই পরিবারের অন্যরা পরিচিত হন। এই সম্মান যেমন রাণী হামিদের তেমন আমাদের সমাজের সকল নারীদেরও।
শৈশবকাল
বাবার বদলি চাকরির সুবাদে রাণী হামিদের শৈশবকাল কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। বাবা সৈয়দ মমতাজ আলী ছিলেন রাণী হামিদের প্রিয় ব্যক্তি। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় বাবার উত্সাহ ও আগ্রহ ছিল প্রবল। শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে রাণীর মনে ভেসে ওঠে-স্কুলের স্পোর্টস এর সময় প্রত্যেক খেলায় আগে যেয়ে নাম লেখাতেন। দৌড়সহ অন্যান্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হওয়া ছিল স্বাভাবিক বিষয়। সেসময় স্কুলের খেলাধুলায় জগ, গ্লাস, প্লেট, টাওয়াল ইত্যাদি পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো। রাণী হামিদ বলেন, “স্কুলের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার হিসেবে এতো টাওয়াল বাড়িতে জমেছিল যে মা বলতেন, ‘তোর বিয়ের সময় টাওয়াল কেনা দরকার হবে না। শ্বশুর বাড়িতেও এসব টাওয়াল নিয়ে যেতে পারবি।’ সত্যিই বিয়ের সময় টাওয়াল কেনার প্রয়োজন হয়নি। আমার মনে আছে আমি অনেক টাওয়াল শ্বশুর বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম।”
রাণী হামিদ ছোট বেলায় গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, কাঁচা আম খাওয়া, ভাই বোনদের সাথে দুষ্টুমি করা এখনো ভুলতে পারেন না। সেসব স্মৃতি তাঁকে এখনও শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। নিজের অজান্তে হারিয়ে যান গ্রামের পথে প্রান্তরে। প্রতি বছর বর্ষাকালে নানা বাড়ি থেকে পানসী নৌকা পাঠানো হতো মাকে নাইওর নেওয়ার জন্য। রাণী হামিদ সারা বছর অপেক্ষা করতেন কবে ভরা নদীর বুকে নৌকা চড়ে নানা বাড়ি বেড়াতে যাবেন। তারপর নানা বাড়িতে ‘মামার বাড়ির’ সুখতো ছিলই!
পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলার চর্চা ও আগ্রহ নিয়ে রাণী হামিদের শৈশব পার হয়। শৈশব থেকেই রাণী হামিদ দাবার রাণী হবার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলেন। সেসময়ে বাঙালী মুসলিম পরিবারে দাবার রাণী হবার প্রস্তুতি নেওয়া সহজ ছিল না। তবে খেলাধুলার প্রতি প্রবল আগ্রহ তাঁকে সফল হতে সাহায্য করে।
শিক্ষা জীবন
বাবার কাছ থেকেই দাবার হাতে খড়ি নিয়েছিলেন রাণী। বাবার বদলির চাকরির সাথে সাথে তাঁর স্কুলও পরিবর্তন করতে হয়েছে বারবার। রাণীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় চট্টগ্রাম নন্দনকানন গার্লস হাইস্কুলে। ১৯৫২ সালে তিনি সরাসরি ২য় শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেসময় প্রায়ই স্কুলের ওপরের শ্রেণীর ছাত্রীরা তাঁদের মিছিলে ডেকে নিয়ে যেতেন, তবে রাণী বুঝতে পারতেন না কিসের মিছিল। পরে জানতে পারেন, তা ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের মিছিল। তিনিও ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের একজন অংশগ্রহণকারী, এ অনুভূতি তাঁকে সবসময় নাড়া দেয়। না জেনে হলেও সেই সব মিছিলে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন বলে এখন তিনি গর্ব বোধ করেন।
১৯৫৪ সালে বাবার বদলির সাথে সাথে রাণীকেও স্কুল বদল করতে হয়। তিনি কুমিল্লা মিশনারি স্কুলে ৪র্থ শ্রেণী এবং ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণী পড়েন কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলে। এরপর বাবার সাথে কুমিল্লা থেকে রাজশাহী চলে আসেন। ৮ম ও ৯ম শ্রেণী পার করেন রাজশাহীর একটি স্কুলে। সেসময় রাজশাহীতে মেয়েদের আলাদা স্কুল না থাকায় একটু সমস্যা হয়। পরে আবার ফিরে আসেন সিলেটে। সিলেট বালিকা বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণীতে ভর্তির নিয়ম না থাকলেও বাবার অনুরোধে তাঁকে ভর্তি করে নেওয়া হয়। ১৯৬০ সালে তিনি ওই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর আর কলেজে ভর্তির সুযোগ হয়নি। কিন্তু থেমে থাকার ব্যক্তি নন রাণী। ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরে একই কলেজ থেকে প্রাইভেট ডিগ্রি পরীক্ষা দেন এবং পাস করেন। সেসময় মুসলিম পরিবারে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ আজকের মতো ছিল না। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থাকায় প্রতিকূল সময় ও পরিবেশ কাটিয়ে রাণী হামিদের গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রেও আজকের নারীমুক্তি আন্দোলনের নারীদের জন্য রানী হামিদ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সংসার জীবন
মাত্র পনের বছর বয়সে ১৯৫৯ সালে নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আব্দুল হামিদের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি তত্কালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর একজন সাঁতারু হিসেবে পাকিস্তানে রেকর্ড করেছিলেন। মোহাম্মাদ আব্দুল হামিদ বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশন এর সভাপতি ছিলেন। আব্দুল হামিদ বহুল আলোচিত ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বই এর লেখক। এছাড়া তিনি আরো চারটি বই লিখেছেন। সবগুলো বই পাঠক সমাদৃত হয়েছে।
রাণী হামিদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। কৃতি দাবাড়ু রাণী হামিদ সংসার পরিচালনায় রেখেছেন অসামান্য কৃতিত্ব। তিনি সন্তানদের সুশিক্ষিত ও সময়ের উপযুক্ত করে তৈরি করেছেন। সন্তানরা তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেছেন। বড় ছেলে কায়সার হামিদ বাংলাদেশের একজন তারকা ফুটবলার। বাংলাদেশের ফুটবলার হিসেবে দেশে ও বিদেশে তার খ্যাতি রয়েছে। মেজ ছেলে সোহেল হামিদ স্কোয়াস ফেডারেশনের সম্পাদক ও একজন ক্রিকেটার এবং ছোট ছেলে শাহজাহান হামিদ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। এক মেয়ে জেবিন হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তিনি লেখালেখি করেন।
দাবার জগতে রাণী হামিদ
দাবা খেলাকে রাণী হামিদ পুরোপুরি পেশা বলে মনে করেন না। তারপরও কোনো কিছু অর্জনের জন্য পেশাদারী হতে হয়, বিষয়টি মাথায় রেখে ১৯৮০ সাল থেকে রাণী হামিদ বিমান বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে দাবা খেলছেন। তিনি বলেন, ‘ভালো খেলার জন্য পেশাদারিত্বের সুযোগ দরকার। তবে আমি দাবা খেলাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে পারিনি। দাবার প্রতি দুর্বলতা থেকেই আমি দাবা খেলতে আগ্রহী।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন দাবা খেলা এবং সংসার দুটোই আমার কর্মক্ষেত্র। এই দুটো কর্মক্ষেত্র আমাকে সমানভাবে সামলাতে হয়। একটি ছাড়া অন্যটি আমার জীবনে অসম্পূর্ণ।’
ছোটবেলা থেকেই রাণী হামিদের খেলাধুলার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। শৈশবে তিনি দৌড়ে খুব ভালো ছিলেন। তিনি যখন কুমিল্লা কলেজের ছাত্রী, তখন তার শিক্ষকদের খুব আগ্রহ ছিল যেন তিনি জাতীয় পর্যায়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। সুযোগ পেলে তিনি হয়তো একজন নামকরা অ্যাথলেট হতে পারতেন। কিন্তু পরিবারের মেয়ে দৌড়ানোর জন্য ঘরের বাইরে যাবে, এটা তাঁর বাবা মায়ের পছন্দ ছিল না। পরিবারের অনুমতি না পাওয়ার কারণে তিনি দৌড়বিদ হওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন।
রাণী হামিদের বাড়িতে দাবা ও টেনিস খেলার চর্চা ছিল। বিশেষ করে এ দুটো খেলার প্রতি তাঁর বাবার ছিল বিশেষ আগ্রহ। বাবার আগ্রহ থেকেই রাণী হামিদের দাবার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সুযোগ পেলেই তিনি ছোট ভাইয়ের সাথে দাবা খেলতেন। সব সময় দাবা খেলা যেত না। বিশেষ করে বাবা যখন বাড়িতে থাকতেন না তখন রাণী ভাইদের সাথে দাবা খেলতেন। সব সময় দাবা খেলা বাবা মা পছন্দ করতেন না। দাবা খেলার প্রতি আগ্রহ থাকলেও পর্দাপ্রথা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিয়ের আগে রাণী দাবা খেলার জন্য বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি।
মূলত রাণী পেশাদারী দাবা খেলা শুরু করেন বিয়ের পরে। খেলাধুলার প্রতি তাঁর স্বামীর আগ্রহ ও উত্সাহ থাকায় তিনি দাবা খেলার প্রতি জোর দেন। রাণী বলেন, ‘আমাদের সময় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এত সহজলভ্যতা ছিল না। এজন্য দাবা বিষয়ে কোন তথ্য জানা খুব কঠিন ছিল। তাছাড়া দাবার বই বা কোচিং দেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যেত না। কিন্তু আমার স্বামী আব্দুল হামিদ প্রতিকূল পরিবেশ কাটিয়ে আমাকে দাবা অনুশীলনের সুযোগ করে দিয়েছেন। বিয়ের পর স্বামীর অনুপ্রেরণায় আমি দাবাড়ু হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছি। তিনি সহযোগিতা ও সুযোগ সৃষ্টি না করে দিলে হয়তো আমাকে আজকের স্থানে আসতে অনেক কষ্ট করতে হতো। এজন্য আমি আমার স্বামী আব্দুল হামিদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’
১৯৭৪/৭৫ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট-এর কোয়ার্টারে থাকার সময় রাণী হামিদ জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন ড. আকমল হোসেনের প্রতিবেশি ছিলেন। তাঁর সংস্পর্শে সহযোগিতায় তিনি ১৯৭৬ সালে প্রথম মহসিন দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁর সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী দীপ্তি ও বীথিসহ কয়েকজন নারী দাবা খেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭৭ সালে নবদিগন্ত সংসদ দাবা ফেডারেশন নারীদের জন্য প্রথমবারের মতো আলাদাভাবে দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এই অয়োজন ‘৭৮ ও ‘৭৯ সালেও করা হয়। তিনবারেই রাণী হামিদ চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৭৯ সনে ঢাকায় উন্মুক্ত দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে রাণী হামিদ চ্যাম্পিয়ন হন। অর্থাত্ একই বছর তিনি দু’বার চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর থেকেই তিনি একের পর এক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং কৃতিত্ব অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক মানের কোনো কোচিং ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রথমবারের মতো তিনি ১৯৮১ সালে ভারতের হায়দারাবাদে প্রথম এশিয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে সুনাম অর্জন করেন। তিনি কমনওয়েলথ এর একজন শীর্ষ দাবা খেলোয়াড়। আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার, জাতীয় ও বৃটিশ নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন। তিনি এ পর্যন্ত তিনবার বৃটিশ নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেছেন। এই গৌরব অর্জন বাঙালী নারীদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কারণ ব্রিটিশ মহিলা দাবা খোলোয়াড়রা যখন বাঙালী নারী রাণী হামিদের কাছে পরাজিত হচ্ছিলেন তখন তাদের মধ্যে এক প্রকার হীনমন্যতা কাজ করে। তারা দাবি তোলে, ব্রিটিশ মহিলা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অন্যদেশের নারীরা খেলতে পারবে না। পরে অন্যদেশের নারীদের ব্রিটিশ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে খেলা বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন শুধু ব্রিটিশ নারীরা খেলে এবং তারাই চ্যাম্পিয়ন হয়। রাণী হামিদ তিনবার বৃটিশ ওমেন দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়ে গর্বিত। এই গর্ব বাংলাদেশেরও।
রাণী হামিদ দাবা অলিম্পিয়াডে ৫ম মহিলা যিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে অলিম্পিয়াডে জাতীয় পুরুষ দলের হয়ে খেলেছেন। ১৯৮৯ সনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাসেদ আন্তর্জাতিক মহিলা দাবায় যৌথ চ্যাম্পিয়ন হন রাণী হামিদ। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছয়বার জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হন এছাড়া ১৯৮৮, ‘৯০, ‘৯২, ‘৯৬, ‘৯৮, ‘৯৯, ২০০১,’০৪ ও ‘০৬ এ জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হন। ২০০৬ পর্যন্ত তিনি মোট ১৫ বার জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ এতবার চ্যাম্পিয়ন হবার রেকর্ড আর নেই।।২০০৫ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে রাণী অংশগ্রহণ করেন। এই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে তিনি বাংলাদেশের সুনাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরো বৃদ্ধি করেন।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি
দাবা খেলার স্বীকৃতি হিসেবে অলিম্পিয়াড, কমনওয়েলথ ও বিশ্ব গিনিস রেকর্ড বুকে তাঁর নাম অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। ১৯৮৫ সালে রাণী হামিদ দাবা খেলায় কৃতিত্ব অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার উপাধি পান এবং আন্তর্জাতিক রেটিং লাভ করেন। রাণী হামিদ বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এসবের হিসাব রাণী হামিদ না রাখলেও বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা তাঁর অন্তরে গেঁথে রেখেছেন। একজন সফল মা এবং সুগৃহিনী রাণী হামিদ সংসার পরিচালনা ও দাবা খেলার পাশাপাশি লেখালেখিও করেন। ‘মজার খেলা দাবা’ শীর্ষক বহুল পরিচিত বইটি তিনি লিখেছেন। এটি আধুনিক দাবা খেলার ওপর বাংলাদেশে প্রথম বই। বর্তমানে বইটির ১০ম সংস্করণ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ‘দাবা খেলার আইন কানুন নামে’ আরো একটি বই তিনি লিখেছেন।
বাংলাদেশের যে ক’জন নারী তাঁদের কৃতিত্ব ও কর্ম দিয়ে দেশকে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছেন রাণী হামিদ তাঁদের অন্যতম। এই অসামান্য গুণীজন বহুমুখী প্রতিভা ও যোগ্যতার অধিকারী। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ করে ক্রীড়া জগতে তার নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি আজীবন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে ‘দাবার রাণী’ হয়ে বাস করবেন।
(তথ্যসূত্র: রাণী হামিদের সাক্ষাত্কার ও বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন)।
লেখক : এস এ এম হুসাইন