টেবিল টেনিস কন্যা জোবেরা রহমান লিনু
গোল বলটির দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে দেখছেন তার আসা-যাওয়া। পরম মমতামাখা চোখে এ যেন সখ্যতা আর প্রতিযোগিতার লড়াই, টেবিল টেনিস খেলায় নিমগ্ন জোবেরা রহমান লিনু, যার নামে বাংলাদেশ গর্বিত। এই খেলার প্রতি ছোট্টবেলা থেকেই তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। খেলতে খেলতেই একদিন খেলোয়াড় হওয়া। বাবার অনুপ্রেরণা ছিল সব সময়েই আর তাই নিষেধের বেড়ি ডিঙ্গোতে হয়নি তাঁকে। আর দশটি মেয়েকে যখন বাবা-মা বা পরিজনের খরদৃষ্টির সামনে গৃহবন্দী হতে হয়েছে ঠিক তখন লিনু দূরন্ত তারুণ্য নিয়ে খেলেছেন তাঁর প্রিয় খেলা টেবিল টেনিস। ১৯৭৭ থেকে ২০০১ এর মধ্যে ১৬ বার জাতীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ তাঁর নাম উঠেছে। খেলা আর খেলা এই নিয়েই তাঁর জীবন। সত্যিই কি তাই? না তা নয়, তিনি মানুষের জন্যও নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। মানবতার জন্য তাঁর নিবিড় কর্ম আয়োজন। সামাজিক কল্যাণমূলক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হওয়ার গৌরব লাভ করেছেন। বাংলার মাটিকে ভালোবেসে তার জন্য কাজ করে যাওয়াই লিনুর লক্ষ্য।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
৯ জুন ১৯৬৫ সালে জোবেরা রহমান লিনু জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ আবদুর রহমান ও মা আঁখি রহমান । বাবা ছিলেন সরকারি ইঞ্জিনিয়ার আর তাই খুলনাবাসী আব্দুর রহমানকে ঘুরতে হতো সারা বাংলাদেশেই। লিনু জন্ম নেন চট্টগ্রামের কাপ্তাইতে। সেই সুবাদে ছোটবেলার কিছু স্মৃতি তাঁর পাহাড় আর অরণ্য ঘেরা। সেই স্মৃতি যেন আজো লিনুকে ঘিরে আছে ।
শৈশবকাল
শৈশব লিনুর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়। এই সময়টা তিনি সিলেটে কাটান। বাড়ি থেকে স্কুলে যেতেন মায়ের হাতের গরম ভাত খেয়ে আর স্কুল থেকে ফিরে কোনোমতে কিছু খেয়েই দে ছুট খেলার মাঠে। মাঠ থেকে বন বাদাড় সবটুকুই ঘুরে ফিরে আসতেন। বরই তুলতে চলে যেতেন বহুদূর পাহাড়ের ঢালে। কোঁচড় ভরে তুলে আনতেন টক মিষ্টি বরই। দারিয়াবান্ধা, গোল্লাছুট খেলা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিন্তু একটু বড় হওয়ার পরই সঙ্গীর অভাবে এইসব খেলায় বাধা পড়ল। সেই সময়, মেয়েরা বড় হলে আর খেলাধুলা করত না। তিনি ও তাঁর বড় বোন দু’জনেরই বিকেলটা কাটত নিঃসঙ্গভাবে। বাবা খেলতে যেতেন অফিসার্স ক্লাবে। তখন তাঁদের মন খারাপ হত। বড় মেয়ের নিঃসঙ্গ অবস্থা দেখে বাবা তার সঙ্গে খেলা দেখতে যেতে বললেন। ভালো লাগলে বড় বোনও টেবিল টেনিস খেলতে শুরু করলেন। প্রতিদিন বাবা আর বড় বোনকে যেতে দেখে লিনুরও ইচ্ছা হলো তাদের সঙ্গে ক্লাবে যাওয়ার। প্রথম যেদিন তিনি গেলেন তখন দেখলেন ভাঙা পা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি টেবিল আর তার উপরই টেবিল টেনিস খেলার টেবিল। ভাঙা টেবিলের মাথা আর লিনুর মাথা প্রায় ছুঁই-ছুঁই। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে গিয়ে লিনু বলেন, ‘ওখানটাতে যাওয়ার সাথে সাথে আমার মনের মাঝ থেকে কেউ যেন বলল এই খেলাটি তুমি খেলতে পারবে।’ আপন মনের আগ্রহেই তিনি টেনিসের বলটিকে ভালোবেসে ফেললেন। তিনি তাঁর বাবাকে বললেন, তিনি এই খেলা খেলবেন। বাবার হাসির কথা লিনুর আজও মনে পড়ে। তিনি লিনুকে বললেন, ‘তুমি এই খেলা খেলতে পারবে না কারণ তুমি এখনও ছোট।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। লিনু সেই যে গো ধরলেন খেলার টেবিলে না গিয়ে তা আর ছাড়লেন না। বাবাও মেয়ের এত আগ্রহ দেখে শেখাতে বসে গেলেন টেবিল টেনিসের রীতিনীতি।
এই দুরন্তপনার মাঝেই টেবিল টেনিস খেলার হাতেখড়ি। সিলেটে থাকাকালীন সময় শাহজিবাজার অফিসার্স ক্লাবে বড় বোনের সঙ্গে খেলতে যান তিনি এবং টেবিল টেনিস খেলাটাকে ভালোবেসে ফেলেন। ৯ বছরের ছোট্ট লিনুকে তাঁর বাবা শিখিয়ে দিতেন খেলার সব কলা-কৌশল। দুপুরে খাওয়ার পর বিকেল বেলাটা তারা ডাইনিং টেবিলকে টেনিস কোর্ট তৈরি করে নিয়ে প্র্যাকটিস করতেন। সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে আজও লিনুর মনের মাঝে ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়ে।
শিক্ষা জীবন
কাপ্তাই স্কুল থেকেই লিনুর শিক্ষা জীবনের শুরু। তারপর সিলেটে পড়াশোনা করেছেন বেশ কয়েক বছর। নরসিংদী থেকে এস.এস.সি. পাশ করে ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. ও ডিগ্রী পাশ করেছেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে মনোবিজ্ঞানে দ্বিতীয় বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
কর্মজীবন
দশটা-পাঁচটার বাঁধাধরা জীবন থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন বলেই কখনও চাকুরি করার কথা ভাবেননি। আর খেলার নেশায় সেটা করেও উঠতে পারেননি। তবে খেলাকে তিনি কখনো পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি কারণ এটি তাঁর নেশা ও ভালোবাসা। নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত রেখেছেন সামাজিক কর্মকান্ডে। মাদকাশক্তির বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, বন্যার সময় উদ্বাস্তু মানুষদের সাহায্য করেছেন, শীতের সময় শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। এসব কাজের জন্যই তাঁকে ২০০৫ সালের ২৭ অক্টোবর ‘ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুভেচ্ছা দূত হিসেবে তিনি কাজ করছেন শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ নিয়ে । অর্থাত্ গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন অবস্থা থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের বিকাশের সময়টা সঠিকভাবে শিশুকে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো গ্রহণের ব্যবস্থা বিষয়ক কাজ করছেন। একটি সুস্থ ও সুন্দর বাংলাদেশ দেখার স্বপ্নেই তিনি এই কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও তিনি আবাহনী ক্লাবের টেবিল টেনিসের জেনারেল সেক্রেটারী। এছাড়াও ১৯৯৩ সালে তিনি আজিমপুরে সাইক্লিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন।
পারিবারিক জীবন
বাবা আর মাসহ চার বোন এক ভাই নিয়ে লিনুদের পরিবার। মা এক সময় চাকুরি করলেও বর্তমানে গৃহিনী। বড় বোন মনিরা মোর্শেদ হেলেন ১৯৭৪ সালে ঢাকা প্রেসক্লাবে টেবিল টেনিসের উন্মুক্ত টুর্নামেন্টে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তবে পরবর্তী সময়ে তিনি খেলা ছেড়ে দেন, বর্তমানে গৃহিনী। ছোট ভাই তাশদিকুর রহমান পাইলট। নাদিরা রহমান নিপু ও নভেরা রহমান চিনু যার যার মতো ব্যস্ত। লিনু তাঁর বাবা মায়ের সঙ্গে উত্তরার বাড়িতেই থাকেন। তাঁর নিজের মনের মত করে সাজিয়ে নিয়েছেন তাঁর নিজস্ব জীবনযাত্রা।
নারী স্বাধীনতা ও লিনুর ভাবনা
আমাদের দেশে মেয়েরা নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে আসছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা সফল ভূমিকা রাখছে আর তার সঙ্গে সঙ্গে নারী স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামও চলছে। লিনুর মতে ‘নারী স্বাধীনতা’ বলে কোনও শব্দ থাকা উচিত নয়। নারীর প্রাপ্য সম্মান তাকে দিতে হবে। লিনু মনে করেন এর জন্য পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। যারা নারী অধিকার না সমঅধিকার এই প্রশ্নে দ্বিধান্বিত, তাদের জন্য লিনু বক্তব্য হলো, ‘একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে যদি একই বিষয়ে পড়াশুনা করে একই রকম যোগ্যতা অর্জন করে তবে কর্মক্ষেত্রে তাদের একই রকম সম্মান প্রাপ্য। এটি যদি মেয়েটি না পায় তবে মনে হবে তার যোগ্যতা অনুযায়ী তার প্রাপ্যটা সে পাচ্ছেনা। এজন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়াটা জরুরি। নারীরা একটু মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে গেলে নিজেদের শালীনতা যদি ঠিকভাবে বজায় রেখে চলতে পারে তবে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হবে এবং পরিবার থেকেও কাজ করার ব্যাপারে সমর্থন পাবে। মেয়েদের খেলাধুলার বিষয়ে বাবা-মায়ের আগ্রহ সবচে’ বেশি থাকতে হবে। বাবা-মা যদি মনে করে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও ফিট থাকার প্রয়োজন তবে কেন তাকে খেলতে বারণ করবেন? বরং পরিবারের উত্সাহেই মেয়েরা খেলাধুলায় নিজেদের অবস্থান গড়ে নিতে পারবে। অনেকেই ভাবেন ছেলেদের মাসল হওয়া ভালো কিন্তু মেয়েদের মাসল থাকলে তাকে ছেলে ছেলে ধরনের মনে হয়। এই ভাবনাটা মোটেও ঠিক নয়। মেয়েরা যদি ফিট থাকতে চায় তবে ব্যায়াম তাকে করতেই হবে আর এর ফলে মাসল হবেই। তাই সবার আগে আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন প্রয়োজন। এজন্য মেয়েদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। পোশাক-আশাকের বিষয়েও অনেকে ভুল ধারণা করেন, যেমন- হাফ প্যান্ট বা হাফ শার্ট পরলে তাকে সহজভাবে নিতে পারেন না, ভাবেন খেলোয়াড়রা সব সময়েই এমন পোশাক পরেন। কিন্তু খেলোয়াড়রা খেলা ছাড়া সাধারণত মেয়েদের মতোই সাজ সজ্জা করেন। নিজের মতো করে নিজেকে প্রকাশ করেন। আসলে সব কিছুই নির্ভর করে মেয়েটির মানসিকতা ও মননশীলতার ওপর।’
টেবিল টেনিস খেলা ও গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ডস রেকর্ডস
রাত তখন দেড়টা, পরিবারের সঙ্গে ভারত থেকে ফিরেছেন লিনু। দরজা থেকে বলল, চিঠি এসেছে তাঁর কাছে। কিসের চিঠি হতে পারে ভাবতে ভাবতে তিনি সিঁড়ি ভেঙে নিজের ফ্ল্যাটে উঠলেন। রুমে ঢুকে চিঠি খুলে দেখেন ভেতরে সার্টিফিকেট। তাও আবার গিনিস বুক অব ওয়র্ল্ডস্ রেকডর্স-এ তাঁর নাম ওঠানো হয়েছে সেই সার্টিফিকেট। বুকের মাঝে আনন্দের ঝড় নিয়ে বাড়ির সবাইকে খুশির সংবাদটি দিয়েছিলেন সেদিন। আনন্দের মাঝে তাঁর তৃপ্তিও ছিল পূর্ণ মাত্রায়। এত দিনের চেষ্টার পর এবার দেশকেও কিছু দিতে পেরেছেন এই আনন্দেই তিনি ছিলেন বিভোর। সারা জীবনের কষ্ট নিমেষেই মুছে গিয়েছিল তাঁর জীবন থেকে। সেই ছোট্ট ৯ বছরের মেয়েটির জীবনের স্বপ্ন ছিল একদিন বড় হয়ে সারা দেশে বাবা-মায়ের নাম উজ্জ্বল করবে আর সত্যি একদিন শুধু বাংলাদেশ না বরং সারা পৃথিবীতেই তিনি নিজের ও দেশের নাম সমুজ্জ্বল করলেন টেবিল টেনিস খেলা দিয়ে। ১৯৭৭ সালেই তাঁর লক্ষ্য স্থির হয়ে গিয়েছিল। তিনি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বড় একটা কিছু করার আর তাঁর প্রচেষ্টার সফলতাই আজ তিনি উপভোগ করছেন। টেবিল টেনিস খেলার বর্তমান প্রেক্ষাপট ও মানোন্নয়ন নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে খেলার জন্য স্পন্সর পাওয়া যায় না। যারাও বা স্পন্সর করে তারা শুধু ফুটবল বা ক্রিকেটকেই প্রাধান্য দেয়। এই মনোভাবকে পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া সরকারিভাবে বেশি বেশি টুর্নামেন্টের আয়োজন করলে বর্তমান পরিস্থিতি উন্নত হতে পারে। আমাদের পাশের দেশ ভারতে বছরে ৪০ থেকে ৫০টি টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয় আর বাংলাদেশে হয় ৫ থেকে ৬টি। এটা সত্যিই দুঃখজনক অবস্থা। এই অবস্থার পরিবর্তন না করতে পারলে ভালো খেলোয়াড় তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। একজন ভালো খেলোয়াড়কে সব সময় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তৈরি করতে হয়। আর এখানে একজন খেলোয়াড় বছরের ৩-৪ মাস বসে থাকে বা অন্য কোনও কাজ করে তাই দেখা যায় তারা ভালো খেলতে পারছেন না। আসলে অনুশীলন জিনিসটিই এমন যে তা সবসময় চালিয়ে যেতে হয়।’
বাংলাদেশের এই টুর্নামেন্ট সমস্যার কারণেই লিনু টেবিল টেনিস খেলার অবসরে সাইক্লিং করতেন। সাইক্লিং এবং টেবিল টেনিসে তিনি একই সঙ্গে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। পরবতীর্তে তিনি দেখলেন সাইক্লিং বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক ক্ষেত্র নয়। বাইরে প্রাকটিস করলে মানুষ নানা ধরনের মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় যা অত্যন্ত অস্বস্তিকর এবং মানসিক চাপের কারণ হয়। এছাড়া তখন থেকে তিনি গিনিস বুকে নাম ওঠানোর স্বপ্নও দেখতে শুরু করেন। সবসময় টেবিল টেনিস প্রাকটিস করার জন্য তিনি সাইক্লিং ছেড়ে দেন। সেই সময় পরপর দুই বছর অর্থাত্ ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে টুর্নামেন্ট বন্ধ থাকে বিধায় তার গিনিস বুকে নাম দেওয়া পিছিয়ে যায়। গিনিস বুকে তিনি নিজেই নাম পাঠান এবং পরবর্তীতে অর্থাত্ ২০০২ সালের মে মাসে তিনি গিনিস বুকে নাম ওঠাতে সক্ষম হন। তাঁর খেলার প্রতি একাগ্রতা আর নিষ্ঠাই তাঁকে এই সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে। বর্তমান খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এই খেলাটি খেলার জন্য প্রচুর অধ্যবসায় চাই। আজ একটু খেললাম আর কাল একটু খেললাম এরপর কিছুদিন বিরতি দিলাম এমন করলে এই খেলায় ভালো করা যাবে না। সবসময় অনুশীলন করতে হবে এবং ফিট থাকতে হবে। আনফিট ফিগার নিয়ে খেলাধুলা করা যাবে না। এজন্য নিয়মিত জিমে যেতে হবে এবং প্রপার ডায়েট করতে হবে।’ তিনি নিজেও সবসময় জিমে যেতেন এবং প্রপার ডায়েট করতেন। ডায়েটের চেয়ে তিনি বেশি প্রাধান্য দেন ব্যায়ামকে। ব্যায়াম ও ফিটনেস একে অপরের পরিপূরক বলে তিনি মনে করেন। বর্তমান সময়ে যারা টেবিল টেনিসে সাফল্য পেতে চান তাদের জন্য অনুশীলন, ফিটনেস আর খেলার জন্য অবশ্যই ভালোবাসা থাকতে হবে।
শখ
জোবেরা রহমান লিনুর শখ ঘুরে বেড়ানো। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি। শৈশব থেকেই প্রচুর বেড়িয়েছেন। চীন, যুক্তরাজ্য, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, সিংগাপুর, মিয়ানমার, ব্যাংকক, মালায়শিয়া ঘুরেছেন। মরুপ্রান্তর থেকে বরফের রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। আর এই কাজটি করতে তাঁর মোটেও খারাপ লাগে না বরং শখের তালিকায় এটাই প্রথম। ঘুরে বেড়ানোর মাঝে পৃথিবীর যে রূপ তিনি দেখেন, প্রকৃতির যে সৌন্দর্যকে তিনি উপভোগ করেন তাই ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করে রাখেন। এটা তাঁর আর একটি শখ। ফটোগ্রাফিকে ভ্রমণের আনন্দ হিসেবে মনে করেন তিনি।
ক্ষেত্র ভিত্তিক অবদান
১৯৭৭ থেকে ২০০১ এর মধ্যে ১৬ বার জাতীয় টেবিল টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস্-এ তাঁর নাম উঠেছে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা প্রেসক্লাবে টেবিল টেনিস এর উন্মুক্ত টুর্নামেন্টে রানার আপ হয়েছেন। এটাই তাঁর প্রথম কোনো টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ। তিনি বাংলাদেশ গেমস্- এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনবার। ১৯৮০ সালের এশিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছেন। এছাড়াও ভারতে অনুষ্ঠিত পাঁচ জাতি টুর্নামেন্টে দ্বৈত ও দলীয়ভাবে রানার আপ হয়েছেন। ১৯৭৮, ১৯৭৯, ১৯৮০ সালে জাতীয় সাইক্লিং-এও তিনি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।
প্রথম কোন বাংলাদেশী নারী ক্রীড়াবিদের নাম ‘গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ডস্ রেকর্ডস’-এ ওঠার জন্য লিনুকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্বর্ধনা দেওয়া হয় ২০০২ সালে। জোবেরা রহমান লিনু মনে করেন তাঁর এই উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের পেছনে পরিবারের অবদান ছিল ১০০ ভাগ। তিনি তাঁর পরিবারের আকুন্ঠ সমর্থনে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছেন। জীবনের যে মুহূর্তে একটু চাপ অনুভব করেছেন সে সময়ই বন্ধুর মতো পাশে পেয়েছেন তাঁর বাবাকে। তাঁর সাফল্যের পেছনে বাবার অবদানই প্রথম বলে মনে করেন, এর পরই রয়েছে মায়ের ভূমিকা। একজন মা-ই তার সন্তানকে সঠিক পথচলার প্রেরণা দিতে পারেন। নারী ক্রীড়াবিদদের নিয়ে ‘স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভলপমেন্ট’ একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে। “শিখর থেকে শিখরে” (ফ্রম স্ট্রেইথ টু স্ট্রেইথ) নামক ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয় নারীদের খেলাধুলা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। টেবিল টেনিস সম্রাজ্ঞী জোবেরা রহমান লিনুও এখানে তাঁর খেলোয়াড় জীবনের কথা বলেন, মেয়েদের জন্য খোলাধুলা কতটা জরুরী এ বিষয়েও তিনি কথা বলেন। ২৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের ডকুমেন্টরিটি পরিচালনা করেন সামিরা হক এবং উন্মুল খায়ের ফাতেমা।
প্রকাশনা
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই-‘কাননে কোরক’, উপন্যাস-‘নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে তুমি’ ও ‘আমার বসন্ত দিন’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। এছাড়াও খেলার জীবন, ভ্রমণ কাহিনী ইত্যাদি নিয়ে পত্রিকায় বেশকিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যতে তিনি লেখালেখির পাশাপাশি দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আশা রাখেন।
লেখক : কামরুন ঝুমুর
সম্বর্ধনা, সম্মাননা, স্বীকৃতি
ক্রমিক | পুরস্কারের নাম | পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থা | বছর |
১. | বাংলাদেশ স্পোর্টস রাইটার্স এসোসিয়েশন এ্যাওয়ার্ড | বাংলাদেশ স্পোর্টস রাইটার্স এসোসিয়েশন | ১৯৮০, ১৯৯১ |
২. | বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন এ্যাওয়ার্ড | বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন | ১৯৯১ |
৩. | বাংলাদেশ ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিল এ্যাওয়ার্ড | বাংলাদেশ ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিল | ১৯৯৫ |
৪. | বাংলাদেশ ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড | ১৯৯৯ | |
৫. | ‘অনন্যা’ শীর্ষ দশ | ২০০২ | |
৬. | শেখ কামাল মেমোরিয়াল গোল্ড মেডেল | ২০০৩ | |
৭. | নারীকন্ঠ ফাউন্ডেশন এ্যাওয়ার্ড |
নারীকন্ঠ ফাউন্ডেশন |
২০০৫ |