বাংলাদেশের ফুটবল জগতে এক চিরস্মরণীয় নাম কাজী সালাউদ্দিন। বাংলাদেশের ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন ১৯৭১-এ দেশের জন্য খেলেছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে। তিনিই প্রথম বাঙ্গালী ফুটবলার যিনি পেশাদার লীগ খেলার জন্য হংকং গিয়েছিলেন।
জন্ম ও পারিবারিক জীবন
২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন কাজী সালাউদ্দিন। কাজী সালাউদ্দিনের পিতা কে এম শফি ব্যবসায়ী ছিলেন। মাতা সিমকী শফি গৃহিনী। ২ ভাই ১ বোন। ১৯৭২ সালে বিয়ে করেছেন। স্ত্রী ইমা সালাউদ্দিন গৃহিনী। ১ ছেলে ১ মেয়ের জনক কাজী সালাউদ্দিন। সন্তান দুজনই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
শৈশবকাল
খেলা থেকে আলাদা করে উল্ল্যেখযোগ্য তেমন কোন শৈশব নেই কাজী সালাউদ্দিনের। খেলা অন্তপ্রাণ সেই ছোটবেলা থেকেই। খেলার পোকা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকতো সারাক্ষণ। স্কুলে থাকলে স্কুলের খেলার মাঠ ছিল তাঁর সঙ্গী। সালাউদ্দিন পড়াশুনা করতেন রাতে আর দিন ছিল খেলার জন্য বরাদ্দ। তখনকার দিনে ওই বয়সে কেউ নির্দিষ্ট খেলার খেলোয়াড় হয়ে ওঠতো না। স্কুলে সবই খেলতেন। অ্যাথলেটিকস করতেন। পরপর তিন বছর স্কুল অ্যাথলেটিকসের সেরা অ্যাথলেট ছিলেন সালাউদ্দিন। ক্রিকেট দলে টপ অর্ডারে ব্যাটিং করার জন্য জায়গা বাঁধাই ছিল। স্কুলের দলে প্রথম সুযোগ পেলেন ক্লাস সেভেনে। সেই দলের সবচেয়ে ছোট খেলোয়াড় ছিলেন সালাউদ্দিন।
শিক্ষাজীবন
বিএএফ শাহীন স্কুলে পড়াশুনার শুরু। ১৯৬৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ঢাকা কলেজ, পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পড়াশুনা শেষ করেন।
কর্মজীবন
খেলা জীবনের পাশাপাশি কাজী সালাউদ্দিন পারিবারিক ব্যবসায় জড়িয়ে পরেন। ব্যবসাটাই তাঁর পেশা। সেই ১৯ বছর বয়স থেকেই তিনি সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। বর্তমানেও নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
খেলা জীবনের শুরু
সেইসময় বিএএফ শাহীন স্কুলে খেলাধুলাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। আর সময়টাও ছিল ফুটবলের। সেইসময় যখন তাঁরা একেকটা ম্যাচ খেলতেন, তখন স্কুলে যেন উৎসব শুরু হয়ে যেত। ম্যাচ খেলতো ১১ জন। খেলার কয়েকদিন আগে থেকেই সাজ সাজ রব শুরু হয়ে যেত স্কুলে। ১৯৬৮ সাল সালাউদ্দিন তখন ক্লাস নাইনে পড়েন। একদিন স্যার তাঁকে ডেকে বললেন, ‘তূর্য ক্লাবে ফুটবল খেলবি?’ কথাটা শুনে প্রথমে হতভম্ব ও পরে আনন্দিত হলেন সালাউদ্দিন।
দিলকুশা ক্লাবে যখন যোগ দিলেন তখন একবারেই নড়বড়ে অবস্থা তাদের। অস্তিত্বের সঙ্গে লড়াই করছে যেন। এদের হয়ে মাঠে নেমে ঠিকমত খেলতে পারবেন কিনা এব্যপারে সন্দিহান ছিলেন সালাউদ্দিন। ভয়ে ভয়েই শুরু করলেন তিনি। শুরু হল তাঁর ক্লাব ফুটবলের জীবন। সালটা ১৯৬৯। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্র ৪দিন আগে। পরীক্ষার গন্ধ শরীর থেকে মুছতে না মুছতেই নেমে গেলেন তিনি ওয়ারীর হয়ে খেলতে। শুরু হলো তাঁর প্রথম বিভাগ ক্যারিয়ার। চলতে থাকলো। আর একটু একটু করে ঢাকার মাঠে পরিচিত হতে লাগলো সালাউদ্দিনের নাম। এর মধ্যে অবশ্য তাঁর ক্রিকেটার জীবনও শুরু হয়ে গেছে। এখানেও একটা উল্লেখ করার মতো গল্প হচ্ছে ফুটবলের আগেই তাঁর ক্রিকেটের প্রথম বিভাগ অভিষেক হয়ে গেছে। ১৯৬৮ সালেই ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেছেন আজাদ বয়েজের হয়ে। তখনকার আজাদ বয়েজ মানে আসলে প্রায় পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দল।
খেলা জীবনের শেষ
আশির দশকের শুরু থেকেই তিনি বুঝতে শুরু করলেন, এটাই তাঁর সেরা সময়। আগে থেকেই একটা বিষয় ঠিক করে রেখেছিলেন, সেরা সময় পার করে আর মাঠে থাকবেন না তিনি। ১৯৮৪ সালে ফুটবল ছাড়লেন। লীগের শেষ ২টি ম্যাচ ছিল তাঁর ভাগ্য নির্ধারণী ম্যাচ। শেষ ম্যাচের আগের ম্যাচে করলেন হ্যাটট্রিক। আর শেষ ম্যাচে আবহানীর সাথে মোহামেডানের বিপক্ষে খেললেন এবং সেরা হয়েই মাঠ থেকে বিদায় নিলেন তিনি।
ফুটবল মাঠের যুদ্ধক্ষেত্রে ১৯৭১
২৬ মার্চের সেই বীভৎস, সেই নারকীয় ধ্বংসলীলার পর সারা ঢাকা ছেয়ে যায় আতংকিত মানুষের নীরবতায়। রাস্তায় গাড়ি নেই, রিকশা নেই, মাঝেমধ্যে শুধু দানবের মতো চোখের পাকসেনারা আর প্রাণভয়ে কোনক্রমে বাসায় ফিরতে থাকা কিছু চেহারা। এই পরিস্থিতিতে বাসা থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে তাঁকে লন্ডন পাঠনোর। আর তিনি খোঁজ নিচ্ছেন ‘ওপারে ট্রেনিং’ নেয়ার। তিনি বাবাকে বললেন, ‘আমি যুদ্ধে যেতে চাই। প্রাণ নিয়ে লন্ডন পালানো আমাকে দিয়ে হবে না। পালাতে পারবো না আমি।’ মা বললেন, ‘তোমার ছেলে যুদ্ধে যেতে চাইছে, তুমি নিষেধ করবে না?’ তাঁর বাবা আস্তে আস্তে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা হল, ‘ও যুদ্ধে না গেলে কে যাবে বল তো? ওরা যুদ্ধে না গিয়ে লন্ডন চলে গেলে দেশটা কী করে স্বাধীন হবে?’ বুঝে গেলেন বাবা কী চাইছেন। আর কোন বাধা রইলো না। পেছনে রইলো তাঁর ঢাকা, তাঁর বাংলাদেশ। তাঁরা তিন বন্ধু রওনা দিলেন আগরতলা। বহু কষ্টের পর স্বপ্নের আগরতলা পৌঁছলেন তাঁরা। ওখানে তখন মহাযজ্ঞ চলছে। বিশাল শরণার্থী শিবির আর ট্রেনিং ক্যাম্প। পৌঁছেই দেরি না করে নাম লিখিয়ে ফেললেন ট্রেনিংয়ে। ট্রেনিং এর জন্য অপেক্ষা করছেন তাঁরা এমন সময় কলকাতা থেকে এক আলোকচিত্র-সাংবাদিক এসে খুঁজে বের করলেন সালাউদ্দিনকে। তার মুখেই খবর পেলেন তিনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করা হয়েছে। সেই সাংবাদিক সালাউদ্দিনকে বললেন, ‘তোমার বন্ধুরা সব তোমার জন্য আপেক্ষা করছে কলকাতায়। তুমি সেখানে যেয়ে ফুটবল দলে যোগ দাও।’ সালাউদ্দিন বললেন, ‘কিন্তু আমি তো যুদ্ধ করতে এসেছি।’ ‘কে বলল ওটা যুদ্ধ নয়? যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করাটা এখন অস্ত্র ধরার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এই যোদ্ধাদের কাছে খাবার আর অস্ত্র পৌছানোর জন্য টাকা সংগ্রহ করা। এই কাজটা করার লোকের অভাব আছে। তোমাকে তাই এখানকার চেয়ে ওখানেই বেশি দরকার।’ উত্তর দিলেন সেই সাংবাদিক। সালাউদ্দিন বুঝলেন, ফুটবল মাঠের যুদ্ধক্ষেত্রই তাঁর আসল জায়গা। তাঁকে কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন সেই সাংবাদিকই। মালবাহী বিমানে করে রওনা দিলেন তিনি। বদলে গেল তাঁর পথ। তবে লক্ষ্য বদলালো না। আবার যুদ্ধে চললেন তিনি, তবে এটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে।
তাঁদের পুরো ঢাকা দলটাই যেন হাজির কলকাতায়। ততদিনে গঠিত হয়ে গেছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। তিনি গিয়ে যোগ দিলেন সেই দলে। ঢাকায় বাবা-মার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সালাউদ্দিন তাঁর নিজের নাম ব্যবহার না করে তূর্য হাজরা নাম ব্যবহার করলেন। সেই সময় কখনও এক বেলা খেয়েও দিন কাটিয়েছেন। কিন্তু হাজারো কষ্টের মধ্যে ভারতীয়দের যে ভালোবাসা তাঁরা পেয়েছেন তা সারা জীবনেও ভোলার না। প্রথম ম্যাচটা খেলেছিলেন মোহনবাগানের বিপক্ষে। মাঠ লোকে লোকারণ্য। ভারতে শুধু কলকাতার মানুষই নয় আসাম থেকে হায়দরাবাদ যেখানেই গেছেন সকল মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তাঁরা।
স্বাধীন বাংলাদেশ
একদিন ম্যাচ খেলে ফিরলেন আসাম থেকে। কলকাতা এসে বিশ্রাম নিয়েই সবাই মিলে হাঁটতে বেরিয়েছেন রাস্তায়। চারদিকে উড়তে থাকা খবর তখন ঠিকমতো সব জানেনও না তাঁরা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ব্ল্যাক আউটের মধ্যে দুই হাত দূরের মানুষকেও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারে আর এদিক ওদিক ঘুরবেন না ঠিক করে ফিরতি রাস্তা ধরেছেন সবাই। এর মধ্যে যেন চোখ দুটো ঝলসে গেল। একসঙ্গে যেন পুরো পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠল। সব আলো জ্বলে উঠেছে কলকাতার রাস্তায়। পাশের পাড়া থেকে সমুদ্রের গর্জনের মতো ভেসে আসছে মিছিলের শব্দ। কী হয়েছে শোনার জন্য দৌড়ে এগুলেন তাঁরা। কে কাকে উত্তর দেয় সবাই নাচছে আনন্দে। মিছিল থেকেই একজন বলল, ‘স্বাধীন হয়ে গেছে বাংলাদেশ!’ আত্মসর্মপণ করেছে নিয়াজি! নিজের কানকেই তাঁদের বিশ্বাস হচ্ছিল না, সত্যিই স্বাধীন হয়ে গেছেন তাঁরা। তাঁরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন!
সদ্য স্বাধীন দেশে আবাহনীর যাত্রা
পাকিস্তানীরা বাংলাদেশ ছেড়ে গেছে। কিন্তু দেশের সব জায়গাতেই রেখে গেছে নিজেদের চিহ্ন। ব্যাপারটা ঢাকায় পা দিয়েই টের পেলেন তিনি। রীতিমতো ধসে পড়া একটা অবকাঠামো, এটাকে দাঁড় করানো সোজা কাজ হবে না। তারপরও জীবন থেমে থাকে না। তিনি তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। শরীর ও মন দুটোকেই প্রস্তুত করেছেন পরের মৌসুমে মাঠে নামার জন্য। বড় বড় প্রায় সব কটি দল থেকে প্রস্তাব আসা শুরু করেছে। মোহামেডানেই যোগ দেওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু খেলা পাগল বন্ধু শেখ কামাল নতুন একটি দল করার কথা জানালেন তাঁকে এবং বন্ধু কামালের ইচ্ছেতেই তিনি সেই দলে যোগ দেন । কামালের প্রতিষ্ঠিত এই দলটিই হল আবাহনী । যোগ দেওয়ার পর সেই দলই হল তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। শুরু হলো নতুন স্বপ্ন- নতুন দল আবাহনীকে বড় দলে পরিণত করতে হবে, শিরোপা জেতাতে হবে-রাতদিন এই চিন্তা। এই স্বপ্ন নিয়েই মাঠে নামলেন। আর পাগলের মতো খেলতে শুরু করলেন।
স্বাধীন দেশে প্রথম আর্ন্তজাতিক ম্যাচ
১৯৭৫ সালে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে গেলেন মালয়েশিয়ায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখিয়েই শুধু নয়, বাংলাদেশের ফুটবলকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে মালয়েশিয়া আমন্ত্রণ জানালো ওদের মারদেকা কাপে। মারদেকা মানে ওদের ভাষায় স্বাধীনতা। তখন মারদেকা কাপে বিশ্ব ফুটবলের অনেক বড় বড় শক্তি অংশ নিত। তাই প্রথম আন্তর্জাতিক সফরে মারদেকা কাপ খেলতে যাওয়াটা বিরাট একটা গৌরবের ব্যাপার ছিল তাঁদের জন্য। এরপর অনেকবার অনেক দেশে গেছেন ফুটবল খেলতে, অনেক বড় বড় দেশের সঙ্গে খেলেছেন, অনেক বড় বড় ফুটবল কিংবদন্তির সঙ্গে বসে আড্ডা দিয়েছেন-কিন্তু কোন কিছুই এই মারদেকা কাপের মতো ছুঁয়ে যায়নি। প্রথমবারের মতো নিজেদের জাতীয় পতাকা নিয়ে একটি স্বাধীন দেশের হয়ে খেলতে নামা, ভিনদেশে নিজেদের জাতীয় সংগীত শোনার অনুভূতিই আলাদা। তখন মারদেকা টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচ খেলছিলেন আর ভেসে যাচ্ছিলেন অসাধারণ সেই অনুভূতিতে।
হংকং-এ পেশাদার লীগ
১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট পরবর্তী শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চলে এলেন হংকং-এ। হংকং পেশাদার ফুটবল লীগ থেকে আগেই প্রস্তাব ছিল এখানে এসে খেলার। হংকং-এ তাঁর ক্লাবের নাম ক্যারোলিন হিল এফসি। এখানকার নিয়ম-কানুনের সঙ্গে ঢাকার ফুটবলের আকাশ পাতাল দূরত্ব। এখানে প্রাকটিসকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হতো। তখন ইউরোপীয় লীগের অনেক খেলোয়াড়ই এখানে চলে আসতো অবসর নেয়ার ঠিক আগের সময়ে। ফলে আবহটা ছিল ইউরোপীয় ফুটবলের। এখানকার ফুটবলের গতি, শক্তি, দক্ষতা অনেক বেশি। তবে এখানে যেটা সবচেয়ে বেশি সেটা হচ্ছে- নিয়মানুবর্তিতা। খেলছিলেন ভালোই। মৌসুমের মাঝামাঝি আসতেই বুঝতে পারলেন পরের মৌসুমে আরও ভালো দলে খেলার সুযোগ পাবেন। কিন্তু ঝামেলা বাঁধল একটি ইনজুরি। পায়ের ইনজুরিটা এমনই ছিল যে, বেশ বড় একটা সময় বিশ্রাম নিতে হল তাঁকে। লন্ডনে পায়ের অপারেশন শেষে চলে এলেন ঢাকায়। বিদায় নিয়ে আসেননি তিনি। বিশ্রাম শেষে আবার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এবার বাদ সাধলেন তাঁর বাবা। বললেন, ‘যা খেলার ঢাকাতেই খেলো আর ফিরে যেতে হবে না হংকং।’ তাই মেনে নিলেন তিনি।
ম্যানেজার সালাউদ্দিন
ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পর কাজী সালাউদ্দিন তাঁর ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায় শুরু করলেন। আবাহনীর ম্যানেজার হিসেবে ১৯৮৫ সালে তিনি কাজ শুরু করেন। তাঁর নেতৃত্বে আবাহনী ১৯৮৫ সালে সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল টিমে উন্নীত হয়। সে বছরই তিনি বাংলাদেশ টিমের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি আবাহনীর কোচ হন। এশিয়ান কাপ ফুটবলের দায়িত্ব পান ১৯৮৮ সালে। আবুধাবীতে এটি অনুষ্ঠিত হয়। কিছুদিন বিরতির পর তিনি আবার আবাহনীর কোচ হিসেবে কাজ করেন ১৯৯২ সালে। ১৯৯৪ সালে তিনি আবাহনী থেকে অবসর নেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন। সেটাই তাঁর জীবনের কোচ হিসেবে শেষ কাজ।
এবারও জেতার গল্প
কোচিং-এর কাজটা উপভোগ করতেন তিনি। ১৯৮৬-র মৌসুমেও আবাহনীর দায়িত্ব নিতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে মৌসুমটা শেষ করতে পারেননি। ১৯৮৮ সালে আবার জাতীয় দলে কাজ করলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল না আবার ফেরার, কিন্তু ফিরতে হলো একটা ইচ্ছে পূরণ করতে। ১৯৯২ সালে আবার আবাহনীর দায়িত্ব নিয়ে লীগ শিরোপা জিতলেন। পরের বছর আবার একই ঘটনা ঘটল। আবাহনীর দায়িত্ব নিয়েও মৌসুম শেষ করা হলো না। তত দিনে মন থেকেই তাঁর আর ইচ্ছে করছিল না ফুটবলে জড়িয়ে থাকার। কোচিংটাও ছেড়েই দিয়েছিলেন বলে নিজেকে বোঝাতে চাইলেন। কিন্তু মন তো মানে না। এমন অসমাপ্তভাবে শেষ করবেন ফুটবল? সুযোগটা এলো মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের মাধ্যমে। ওরা নতুন দল। শিরোপা জিততে চায়। ১৯৯৪ সালে ওদের নিয়ে শুরু করলেন তাঁর শেষ যুদ্ধ। দায়িত্ব নিলেন ফেডারেশন কাপের জন্য। প্রতিপক্ষ আবাহনী। বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য অটুট। আবাহনীকে তাঁর দল হারালো ৩-২ গোলে। মুক্তিযোদ্ধা চ্যাম্পিয়ন। এবার বিদায় নেয়া যায়। স্বপ্ন পূরণের পর কাংক্ষিত বিদায়।
সংগঠক সালাউদ্দিন
২০০৩ সালে কাজী সালাউদ্দিন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট এবং ন্যাশনাল টিমের ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে চেয়ারম্যান হন।
হার না মানা স্বপ্ন
ফুটবল ছাড়লেও ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি সালাউদ্দিন। ফুটবলকে সোনালি সময় এনে দেয়ার তপস্যায় নিমগ্ন তিনি। আর এ জন্য কাজও করছেন বহু দিন থেকে। একটা বিপ্লবের আশায় দৌড়ে ফিরেছেন সারা বিশ্ব। কোথায় লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন। প্লাতিনির সঙ্গে দেখা হয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইয়ে। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের ফুটবল আবেগটাকে। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বেকন বাওয়ারকে। চেষ্টা করেছেন ইংলিশ লীগের ক্লাব চেলসিকে বাংলাদেশের ফুটবলের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে জড়াতে। কিছুটা আলোচনা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর এগোয়নি। বাংলাদেশের আজকের ফুটবলের ভেঙ্গে পড়া অবস্থার জন্য তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে দায়ী করেন। যখন যে সরকার এসেছে তখন সে সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী চাপানো নানা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ফুটবলের খেলোয়াড়ারদের পেশাদারিত্বকে নষ্ট করে দিয়েছে। ফুটবল ফেডারেশনের নেতৃত্ব যারা দিয়েছেন তারা খেলাকে সামনে রেখে নিজেদের স্বার্থকে সুরক্ষিত করেছে। আর এসব কারণেই ফুটবল আজ জীর্ণদশায় এসে র্পৌছেছে। এ থেকে ফুটবলকে বাঁচানোর জন্য সুস্থ ফুটবল ফেডারেশন দরকার, দরকার সরকারের সার্বিক সহায়তা।
লেখক : কামরুন ঝুমুর