ভাষাসৈনিক, কবি, প্রাবন্ধিক, আইনজীবী – মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একজন ভাষাসৈনিক, কবি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ এবং আইনজীবী। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবার পরেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। তাই সারাজীবন তিনি সর্বস্তরে রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়নে একজন ভাষা যোদ্ধার ভূমিকা পালন করে গেছেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার জংগীপুর মহকুমার দয়ারামপুর গ্রামে শিক্ষিত ও রাজনৈতিক এক পরিবারে জন্ম। বাবা মৌলভী জহিরউদ্দিন বিশ্বাস আইনজীবী ছিলেন। তিনি বি.এ. পর্যন্ত সংস্কৃতি পড়েন এবং পরে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। জহিরউদ্দিন বিশ্বাস প্রথমে আঞ্জুমান এবং পরে মুসলিম লীগ আন্দোলনের সাংগঠনিক পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ জেলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সূত্র ধরে বাড়িতে রাজনৈতিক নেতা-কমীদের আনাগোনা ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হাবিবুর রহমানের বাবা জাতীয় যুদ্ধ ফ্রন্টের বিভাগীয় নেতা ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে গ্রেফতার করে বহরমপুর কারাগারে পাঠায়। অবশ্য কয়েকদিন পরই জহিরউদ্দিন বিশ্বাস মুক্তি পান। এরপরই কংগ্রেস তাঁকে দলে যোগদানের জন্য ডাকলেও তিনি সাড়া দেননি। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে মুশির্দাবাদ ছেড়ে জহিরউদ্দিন বিশ্বাস রাজশাহীতে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হাবিবুর রহমানের মা গুল হাবিবা ছিলেন গৃহিণী।
শৈশবকাল
বাড়ির পাশেই ছিল একটি ছাপাখানা। এ নিয়ে বালক হাবিবুর রহমানের বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। তিনি প্রেসে ঢুকে দেখতেন কীভাবে অক্ষর ডালা সাজিয়ে সামনে রেখে কম্পোজের কাজ চলে, এরপর কীভাবে কাগজে সেসব হরফের ছাপ পড়ে। প্রেসটি থেকে বের হতো চার পাতার ছোট্ট একটি সাপ্তাহিক কাগজ। এর বেশির ভাগ জুড়ে থাকত নিলামের ইশতেহার ও বিজ্ঞাপন। আরও ছাপা হতো বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র, অভিনন্দন বার্তা, স্বাগতম, বিদায়ী পত্র ও বিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র। হাবিবুর রহমান লক্ষ্য করতেন এই সীমিত কাজ নিয়ে প্রেসের নিষ্ঠাবান মালিকরা কত খুশি ছিলেন।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বাবা জাতীয় যুদ্ধ ফ্রন্টের (ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্ট) বিভাগীয় নেতা হওয়ার পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বামপন্থীদের দ্বারা ‘জনযুদ্ধ’ নামে পরিচিত হলো। এসময় তাদের বাড়িতে ফ্যাসিবিরোধী প্রচার-পুস্তিকা আসতে থাকে। হাবিবুর রহমান বিভিন্ন মতাদর্শের পত্রিকাগুলো আগ্রহের সঙ্গে পড়তে শুরু করেন। একবার মাসিক ‘সোভিয়েত রাশিয়া’র ক্রোড়পত্র থেকে রুশ ভাষা শেখার চেষ্টা চালালেন। অবশ্য নিজের নাম লেখা ছাড়া আর কিছুই শিখতে পারেননি।
স্মৃতিময় শিক্ষাজীবন
প্রাথমিক পাঠ শুরু হয় বাংলা, আরবি, উর্দু ও ইংরেজি এই চার ভাষা নিয়ে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পান সতেন্দ্রনাথ বড়ালকে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে আই.এ. ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আই.এ. পাশ করে চলে আসেন রাজশাহী। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন সেখানে ইতিহাস বিষয়ের কয়েকজন ভালো শিক্ষক আছেন। তাই তিনি পাঠ্যবিষয় নির্ধারণ করলেন ‘ইতিহাস’। ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে রাজশাহী কলেজে বি.এ. ভর্তি হলেন হাবিবুর রহমান, শিক্ষক হিসেবে পেলেন অটলবিহারী ভট্টাচার্যকে। তাঁর উত্সাহে পড়াশুনা ও পরীক্ষা দুটোই ভালো হলো।
‘বং বঙ্গ বাঙ্গালা বাংলাদেশ’ বইটির ‘গরহাজির ইতিহাস-অনুরাগীর স্বগতোক্তি’ প্রবন্ধে মুহাম্মদ তাঁর ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি লিখেন, ”বাংলা’র স্যার সতুবাবু বলেছিলেন, ‘তুমি এম এ তে বাংলা নিও’। প্রেসিডেন্সি কলেজে ‘অর্থনীতি’ তখন বেশ আকর্ষণীয় বিষয়। কলকাতার দাঙ্গার পর রাজশাহী এসে শুনলাম ইতিহাসেই কিছু তখনও ভালো অধ্যাপক রয়ে গেছেন। শিক্ষক জেনে বিষয় নির্ধারণ করলাম। পিতৃতুল্য শ্রী অটলবিহারী ভট্টাচার্যেও উত্সাহে পরীক্ষা ভালোই হল।’
১৯৪৯ সালে বি.এ. পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। স্নাতক পাশ করে ভর্তি হন এম.এ. শ্রেণীতে। ১৯৪৯-৫১ সালের এম.এ. ক্লাশে প্রথম বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা শুরু হয়। এসময় মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এম.এ. ক্লাশের ছাত্র। তিনি প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠের সুযোগ পান। অবাঙালী অধ্যাপক ড. আহমেদ হাসান দানি ছাত্রদের বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় উত্সাহী ছিলেন না।
বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা তাঁদের সিলেবাসে প্রথম যুক্ত হওয়ায় পুরনো নোটের আদিখ্যেতা ছিল না। ফলে তিনি নিজের মতো করে নোট তৈরি করেন। সহপাঠীদের টেক্কা দেবার জন্য পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কঠিন প্রশ্নগুলো উত্তর দেবার জন্য বেছে নেন। সব প্রশ্নের উত্তরও সমান দক্ষতার সঙ্গে দেন। এরপরই ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি রাজশাহী চলে যান। কয়েক সপ্তাহ পরে ঢাকায় ফিরে এসে আইনের ক্লাশ করতে শুরু করেন।
হাবিবুর রহমান ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র। লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এবং কোনো ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তেমনভাবে জড়িত না থাকার পরও ছাত্রসমাজের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নিজের মতামত প্রকাশ করতেন। তাঁর বন্ধুরা ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তাঁরও প্রভাব ছিল। ইউনিয়নের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেই প্রভাব স্থায়ী হলো। ১৯৫১ সালে তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা ফজলুল হক হল ইউনিয়নের নির্বাচনে জয়ী হন। তিনিও নির্বাচনে অংশ নিয়ে সলিমুল্লাহ হলের সহ- সভাপতি নির্বাচিত হন। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নিখিল পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের যোগসাজশে হল ইউনিয়নের বাজেট পাশ করাতে ব্যর্থ হন।
১৯৫১ সালে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এলএলবি পাশ করেন তিনি। ১৯৫৬ সালে হাবিবুর রহমান ইতিহাস বৃত্তি নিয়ে উরস্টার কলেজ অক্সফোর্ডে যান, ‘আধুনিক-ইতিহাসে’ বিষয়ে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ছিল – বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকাবস্থায় কোনো শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসের বাইরে যেতে হলে শিক্ষকের অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় তাকে বহিষ্কার করা হবে। পরে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্থানীয় দৈনিক ‘অক্সফোর্ড মেল’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে। একজন ছাত্রী বিধি মোতাবেক ছুটি না নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন। কিউ গার্ডেনে এক কূটনীতিকের পুত্রের সঙ্গে তাঁকে দেখা যায় এবং পরে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।
আরেকটি ঘটনা ঘটে ক্যাম্পাসের ভেতরে। অক্সফোর্ড ড্রামাটিক সোসাইটি ‘হ্যামলেট’ মঞ্চস্থ করার মহড়া চালাচ্ছে। হঠাত্ করে খবর ছড়িয়ে গেল, যিনি হ্যামলেটের ভূমিকায় অভিনয় করছেন তাঁর ঘরে একজন ইতালীয় মেয়ে বাস করছেন। ‘হ্যামলেট’কে নোটিশ দেওয়া হয়, রাত বারোটার মধ্যে তাঁকে অক্সফোর্ড শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। ‘হ্যামলেট’ এতোটুকু ঘাবড়ালেন না। বরং অক্সফোর্ডের শেষ রাতটুকু স্মরণীয় করে রাখতে শ্যাম্পেন পার্টির আয়োজন করেন। খেলোয়াড়ি মন নিয়ে সেই পার্টিতে তাঁর অনেক সহপাঠী যোগ দেয়। একজন মহিলা গলায় পোষা সাপ ঝুলিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তৃতীয় ঘটনাটি ছিল আরো বেদনাদায়ক। সমকামের উদ্দেশ্যে একজনকে ফুসলানোর দায়ে একজন ছাত্রকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। অপরাধী ছাত্রটির জীবন যাতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে না ওঠে এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট অভিভাবক হিসেবে ছাত্রকে যথাযথ আইনি সাহায্য প্রদান করেন। আদালতকে তিনি এ অনুরোধও করেন যে ছাত্রটি এই প্রথম অপরাধ করেছে। তাই তার শাস্তি লাঘবের জন্য বিবেচিত হতে পারে।
আইন ভঙ্গ করে আইন ভাঙ্গার শাস্তি গ্রহণ করার সত্সাহস তিনি অক্সফোর্ডের শিক্ষাথীদের মধ্যে দেখেছেন। তবে এ নিয়ে তারা কখনও বিক্ষোভ, হরতাল, পাল্টা অভিযোগ, পাল্টা মোকদ্দমা বা তালাভাঙ্গার মতো ঘটনা ঘটায়নি। ‘স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন ও বোবার স্বপ্ন’ প্রবন্ধ বইয়ে ‘উচ্চ শিক্ষায় নিম্নচাপ’ প্রবন্ধে হাবিবুর রহমান এই তিনটি ঘটনার কথা লিখেছেন।
অক্সফোর্ডের পড়াশুনাও ছিল নিয়মমাফিক। পরীক্ষার বারো-তেরো জন শিক্ষক হাবিবুর রহমানের সাক্ষাত্কার নেন। তাঁরা একের পর এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন তাঁকে। ‘সব ছেড়ে তুমি মার্কিন গৃহযুদ্ধ কেন বেছে নিলে’? তিনি উত্তর দিলেন ‘ফেডারেল সংবিধানের দৌঁড় দেখার জন্য।’ আবার প্রশ্ন ‘তুমি ভারতীয় সংবিধানের কথা ভাবছ? তুমি কি বেঙ্গল থেকে এসেছ?’ তিনি বললেন, ‘বেঙ্গল, তবে সে অংশ এখন পাকিস্তানে।’ উত্তর শুনে অধ্যাপকরা নড়েচড়ে বসলেন। একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিলেবাসের বাইরে তিনি কি একটা প্রশ্ন করতে পারেন?’ হাবিবুর রহমান বললেন, ‘নিশ্চয়’। অধ্যাপক হাত একবার বাম দিক একবার ডান দিকে নির্দেশ করে বলেন,’এই পাকিস্তান, ঐ পাকিস্তান! তোমার কী মনে হয়? কতদিন এই পাকিস্তান টিকে থাকবে’? হাবিবুর রহমান জানতেন, ইংল্যাণ্ডের কয়েকজন অধ্যাপক পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেন। প্রশ্নটি কি কূটপ্রশ্ন? উত্তরটা তাই তিনি কূটনীতিকের মতোই দিতে চেষ্টা করলেন, ‘লোকে যতদিন চাইবে, ততদিন চলবে।’ আর কেউ কোনো প্রশ্ন করলেন না। ১৯৫৮ সালে তিনি উরস্টার কলেজ, অক্সফোর্ড হতে আধুনিক ইতিহাসে স্নাতক সম্মান এবং ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। এর আগেই ১৯৫৯ সালে লন্ডনের লিঙ্কনস ইন থেকে ব্যারিস্টার-এট-ল ডিগ্রি লাভ করে তিনি ইংলিশ বারে যোগ দিতে শুরু করেছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন
ছেলেবেলা কেটেছে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। একবার তাঁদের জঙ্গীপুর শহরে সুভাষ চন্দ্র বসু আসেন। সেবার মওলানা আজাদও জঙ্গীপুরে এসেছিলেন। এই প্রথম সুভাষ বসু এবং মওলানা আজাদকে তিনি স্বচক্ষে দেখলেন। এরপরই বহরমপুরে মুসলিম লীগ কনফারেন্স হলো। মোহাম্মদ জিন্নাহ কনফারেন্সে বক্তৃতা দিলেন। বয়সে ছোট হলেও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সেই কনফারেন্সে যোগ দেন এবং প্রথম জিন্নাহর বক্তৃতা শোনেন। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও তাঁর দু’জন বন্ধু তাতে অংশ নেয়। একদিন এক শোভাযাত্রায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে তা ভেঙ্গে দেয় এবং তাঁর ঐ দুই বন্ধুকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়।
ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনে অনেক বড়, গুরুগম্ভীর প্রশ্ন আলোড়ন তুলত। প্রতিদ্বন্দ্বী পেলেই তর্কে মেতে উঠতেন, এমনকি বাবাকেও ছাড়তেন না। একবার এক সভায় তাঁর বাবা সভাপতিত্ব করছিলেন। হাবিবুর রহমান হঠাত্ দাঁড়িয়ে মুসলিম লীগের কোনো কোনো নীতির সমালোচনা শুরু করেন। তাঁর বাবাও যথাযথ সৌজন্য প্রকাশ করে ছেলের প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেন। পিতা-পুত্রের বাগযুদ্ধে উপস্থিত দর্শকরা খুবই কৌতুক অনুভব করলেন।
কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ে হাবিবুর রহমান পার্ক, ময়দান ও ইন্সস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত প্রতিটি সভায় উপস্থিত হয়ে জিন্নাহ, নেহরু, আবুল হাশিম, সত্যেন মজুমদার, হীরেন মুখাজী প্রমুখ খ্যাতনামা বাগ্মীর বক্তৃতা অবাক বিস্ময়ে শুনতেন। একবার মহাত্মা গান্ধীর বক্তৃতা শোনার জন্য তিনি সৌধপুর আশ্রমে যান। কিন্তু সেদিন ছিল গান্ধীর মৌনব্রতের দিন। গান্ধীর বক্তৃতা আর শোনা হলো না। বিফল মনোরথে ফিরে এলেন কলকাতায়।
ভাষা আন্দোলন
রাজশাহী কলেজে বি.এ. পড়ার সময়ে মো. হাবিবুর রহমান পদার্থবিজ্ঞান ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে রেডিও সম্প্র্রচার থেকে জিন্নাহর ভাষণ শুনেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ ঘোষণাটি অনেকের মতো তিনিও মেনে নিতে পারেননি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে রাজশাহী কলেজে হরতাল পালিত হয়। বন্ধুদের সঙ্গে হাবিবুর রহমানও পিকেটিংয়ে অংশ নেন। এসময় মুহম্মদ সুলতান, গোলাম রহমান ও একরামুল হক ছাত্ররাজনীতিতে অত্যন্ত তত্পর হয়ে ওঠেন।
১৯৫২ সালে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ পরদিনই হাবিবুর রহমান তাঁর দলবল নিয়ে পুরনো কলাভবনের আমতলায় সভা ডেকে ঘোষণাটির নিন্দা করেন। সভায় তিনি বলেন, ‘শুনেছি ফ্যাসিস্ট ইতালিতে স্লোগান দেওয়া হত মুসোলিনি কোনোদিন ভুল করে না। দেখা যাচ্ছে অনুরূপভাবে আমাদের দেশেও আমাদের ওপর একটা সবক চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, জিন্নাহর কথাই অভ্রান্ত- তার নড়চড় হবে না।’ জিন্নাহকে কায়েদে আযম হিসেবে উল্লেখ না করায় দু’একজন ছাত্র তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
ঘটনার দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টাতে থাকে। ২০ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা। ঢাকা শহরে থমথমে পরিবেশ। সরকারী গাড়ি থেকে ১৪৪ ধারা জারির সংবাদটি প্রচার করা হচ্ছে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যখন শুনলেন, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন অনেকের সঙ্গে তিনিও রাগে ফেটে পড়েন। তাঁরা বুঝে গেলেন ভাষা আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য কেউ ষড়যন্ত্র করছে। রাত নয়টা-দশটার দিকে তাঁরা সাতআটজন বন্ধু ফজলুল হক হলের পুকুরের পূর্বপাড়ে মিলিত হয়। গোপন এই সভায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুহম্মদ সুলতান, আবদুল মতিন, জিল্লুর রহমান, কামরুদ্দিন শহুদ, গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান ও এম. আর. আখতার মুকুল। সভায় প্রশ্ন ওঠে, বিনা প্রস্তুতিতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে অযথা শক্তি ক্ষয় করা হবে কিনা? অবশেষে সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে হবে এবং আন্দোলন বন্ধ করা চলবে না। তবে কেমন করে আইন অমান্য করা হবে সে সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে যে যার গন্তব্যে চলে যান।
২১ ফেব্রুয়ারি সকালে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আর মুহাম্মদ সুলতান জগন্নাথ কলেজ ও পাশ্ববতী কয়েকটি বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান ধর্মঘট কেমন চলছে তা প্রত্যক্ষ করার জন্য। সে সুযোগে নওয়াবপুর আওয়ামী লীগের অফিসে একবার ঢুঁ মেরে দেখেন। সেখানেও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হবে কিনা তা নিয়ে কথাবার্তা চলছে। সারা শহরে একটা টান টান উত্তেজনা। কলাভবনে ফিরে এসে তাঁরা দেখেন সভা শুরু হয়েছে। গাজীউল হক দু’হাত তুলে সভা পরিচালনার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করেন। এমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়খ আবদুল মতিন অত্যন্ত প্রত্যুপন্নমতিত্বের সঙ্গে মতামত দেন, এক সঙ্গে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গলে পুলিশ লাঠিচার্জ করতে পারে। দশজন দশজন করে ছোট ছোট দল এগিয়ে যাবে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য। গাজীউল হক এই পরিকল্পনাকে সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘোষণা করেন। উত্তেজনায় ছাত্রসমাজ ফেটে পড়ে। ভাইস চ্যান্সেলার মোয়াজ্জেম হোসেন সকলকে একবার শান্ত করার চেষ্টা করেন।
আইন ভাঙ্গার পরিকল্পনায় এমন একটা অতর্কিত ভাব ছিল যে, অনেকে ভালো করে বুঝতেও পারেনি কী করবে, কী করতে হবে! আগের রাতে যাঁদের মধ্যে আইন ভাঙ্গার ব্যাপারে একটু ইতস্তত ভাব ছিল, এই উত্তেজনায় তাঁদের দোটানা ভাব কেটে যায়।
প্রক্টরের ফটকের কাছে ভিড় জমে যায়। চারদিকে একটা বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে কয়েকজন এগিয়ে এসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মুহম্মদ সুলতানের কাছে তাঁদের নাম লেখায়। এদিকে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে বেরিয়ে আসেন। তখন বেলা সোয়া একটা। পুলিশ তাঁদের দেখে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ফলে রাস্তার একধার ঘিরে রাখে। হাবিবুর রহমান দেখলেন কলাভবনের ওপর থেকে কয়েকজন ছাত্র এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছে। অন্যান্য ছাত্ররা ফটক পেরিয়ে রাজপথে নেমে আসে। ওদের বেরুতে দেখে পুলিশ সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করল না। তারা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের দলটিকে ট্রাকে তুলে নিল। ট্রাকটা তেজগাঁও এর দিকে চলতে শুরু করলে হাবিবুর রহমান মন্তব্য করেন, ‘দূরে কোথাও কোনো মজা পুকুরে আমাদের চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে ফেলা হবে।’ তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো তেজগাঁও পুলিশ স্টেশনে। দশ-বারোজনের দলটিকে ছোট একটা হাজত ঘরে রাখা হলো। সেখানে আগে থেকেই দু-একজন আসামি ছিল। ঘরে প্রস্রাবের গন্ধে টিকতে না পেরে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানসহ অন্য ছাত্ররা চেঁচামেচি শুরু করেন। এতে ফল হলো। তাঁদের এখান থেকে স্থানান্তর করা হয় একটি বড় খোলা ঘরে। রাতে পোড়া খিচুড়ি খাওয়ার পর দারোগার অফিস ঘরের মাটিতে ঘুমানোর ঢালাও বন্দোবস্ত হলো। রাত তিনটার দিকে ফিসফিস শব্দে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। শুনতে পেলেন ঢাকায় গুলি চলেছে। ধীরে ধীরে কথাটা সকলের কাছে ছড়িয়ে যায়। হাজত ঘরের আবহাওয়া ভারি হয়ে ওঠে।
সকালে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানসহ অন্যান্য গ্রেফতারকৃতদের পুলিশ ভ্যানে করে ঢাকা কোর্টে নিয়ে আসা হয়। আদালত চত্বর তখন লোকারণ্য। পুলিশ আর সেনাবাহিনী গ্রেপ্তারকৃতদের চারপাশ ঘিরে রাখে। জনতার মধ্য থেকে কেউ কেউ ছাত্রদের হাতে কিছু খাবার তুলে দিলেন। বন্ধুদের পরামর্শে অবাঙালী পুলিশ সৈন্যদের উদ্দেশে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান উদুতে কয়েক মিনিট বক্তৃতা দিলেন। আদালত চত্বরে কয়েকখানা ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকাও পোড়ানো হল। অবস্থা বেগতিক দেখে ঘন্টাখানেকের মধ্যে তাঁদের আদালতে হাজির না করেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। কারাগারে এসে তাঁরা জানতে পারলেন, খুনের চেষ্টা, মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রসহ দাঙ্গা, কর্তব্যরত সরকারী কর্মচারির বিরুদ্ধে হামলা ইত্যাদি অভিযোগে তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নতুন নামে পরিচিত হন। বিচারাধীন কয়েদি নম্বর ৪৭৭। কয়েকদিন পর কারাগারে ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে তাঁকে হাজির করা হয়। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘১৪৪ ধারা অন্যায়ভাবে জারি করা হয়েছিল। তাই আমরা এ ধারা ভঙ্গ করি।’
‘একুশের স্মৃতিচারণ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনের স্মৃতিচারণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সাধারণভাবে বাঙালী মুসলমান ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। কোলকাতায় ১৪৪ ধারা ভেঙে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণে তাঁর সামান্য অভিজ্ঞতা ছিল। এক্ষেত্রে তিনি মনে করেন, তাঁরও কিছু করার আছে। বন্ধু মুহম্মদ সুলতানকে বলেন, ‘তুই আমার ‘ময়ুরপঙ্খী’টা (সাইকেল) দেখিস, আমি চললাম।’ এরপর ১৪৪ ধারা অমান্য করে এগিয়ে যেতেই তার শরীর থেকে একটা গরম ভাপ বেরুতে থাকে।
কারাগারে ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতারকৃত বন্দিদের কোনো শ্রেণী মর্যাদা দেওয়া হয় না। একটা লম্বা ঘরে সাতাশ-আটাশ জন রাত কাটাতেন। প্রত্যেককে দেওয়া হলো দুটো করে কম্বল। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের এক পাশে এস. এ. বারি এটি আরেক পাশে নেয়ামেল বসির। ইকবালের একটা কবিতার বই থেকে নেয়ামেল বসির তাঁকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। তবে কারাগারেও তাঁরা নানা ধরণের স্লোগান দিতেন। স্লোগানের মধ্যে ‘নুরুল আমিন গদি ছাড়’ স্লোগানটিও ছিল। তবে এই স্লোগানটি নিয়ে কিছুটা আশঙ্কা কাজ করত। আর তা হলো ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে কেউ না আবার বাংলা ভাষার আন্দোলনকে বিপথে চালিত করে।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের গ্রেফতারের সংবাদ শুনে এদিকে তাঁর বাবা কারাগারে ছেলেকে দেখতে এলেন। শরীরে জেলখানার কম্বল জড়িয়ে মুখভরা দাঁড়ি নিয়ে হাবিবুর রহমান বাবার সামনে হাজির হলেন। সন্তানের এ চেহারা দেখে চোখ ছলছল করে ওঠে। অবশেষে বাবা জহিরউদ্দিন বিশ্বাস একাই ফিরে যান।
কর্মজীবন
ছাত্রজীবন শেষ করেই তিনি অধ্যাপক হালিমের আমন্ত্রণে ১৯৫২ সালের ১ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু বেশিদিন শিক্ষকতা করতে পারলেন না। সহকর্মীরা তাঁর হাজতবাসের তথ্য দিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের কান ভারি করে তুললেন। ৪ মে অধ্যাপক হালিম তাঁকে ডেকে সব কথা খুলে বলেন। তাঁকে চিন্তিত দেখে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমার জন্য যদি আপনার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অসুবিধা হয়, তবে আমি এক্ষুণি পদত্যাগ করছি।’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে একটি পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। পদত্যাগপত্রটি ভাইস চ্যান্সেলর ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে পৌঁছতেই অত্যন্ত ক্ষিপ্ততার সঙ্গে তিনি তা গ্রহণ করেন।
‘জাগো, ওঠো, দাঁড়াও বাংলাদেশ’ (২০০০) প্রবন্ধ গ্রন্থের ‘বাংলাদেশের পুরানিদর্শন’ প্রবন্ধে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর শিক্ষকতা জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার কারণে চারদিন পরই তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়।
এরপর হাবিবুর রহমান বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। প্রথমে সিরাজগঞ্জ কলেজে যোগ দিয়েছিলেন, সেখান থেকে চলে আসেন ঢাকায়, জগন্নাথ কলেজে। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬১ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে ইতিহাসের রিডার পদে উন্নীত হন। এর বছর চারেক পর ১৯৬৪ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও আইন বিভাগের শিক্ষকতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন।
ঢাকায় এসে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যোগ দিলেন হাইকোর্টে। ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টে যোগদান করেন। একই বছর তাঁকে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭২ সালে নির্বাচিত হন হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৬ সালের ৮ মে হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি হন। তিনি বরিশাল হাইকোর্ট বেঞ্চে’র দায়িত্ব পালন করেন।
এসময়ই তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিছু অ্যানডিফেণ্ডেড আপিল শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন। দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত কয়েদি আইনজীবী নিয়োগ করতে না পেরে জেলখানা থেকে সরাসরি যে আপিল হাইকোর্ট ডিভিশনে পাঠান তাঁকে জেল আপিল বা অ্যানডিফেণ্ডেড আপিল বলা হয়। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন কয়েদিরা এ ধরণের আপিলকে ‘ধর্ম-আপিল’ বলেন। এভাবেই তিনি জেল আপিলের বাংলা শব্দের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি দেখলেন ‘ধর্ম’ শব্দের বিচারমূলক ব্যঞ্জনাটুকু সাধারণ মানুষ কত সহজভাবে উপলব্ধি করেন। এমন সহজ ও ভাবপ্রকাশক শব্দ চয়নে তিনি বিস্মিত হন। এই প্রথম তিনি জানতে পারলেন গ্রামে-গঞ্জে কত মূল্যবান প্রকাশভঙ্গি ছড়িয়ে আছে।
১৯৮৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি পদে যোগদান করেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এরপর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এর পরের বছর ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নির্দলীয় তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
পারিবারিক জীবন
১৯৬১ সালে তিনি ইসলামা রহমানকে বিয়ে করেন। ইসলামা রহমান অধ্যাপনা করতেন। একমাত্র পুত্র সন্তান শাকিল বিন হাবিব জন্মের এক বছর পর ৬ আগস্ট মারা যায়। তিন মেয়ের মধ্যে বড় রুবাবা রহমান, মধ্যমা মেয়ে নুসরাত হাবিব ও ছোট মেয়ে রওনক শিরীন।
সংবর্ধনা, সম্মাননা ও স্বীকৃতি
তিনি বাংলা একাডেমী ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের একজন ফেলো। ইনস্টিটিউট অব ল এন্ড ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট। লিঙ্কনস ইন এর অনারারি বেঞ্চার এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উরস্টার কলেজের অনারারি ফেলো। ১৯৮৭ সালে তিনি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ও নাইজেরিয়ার আবুজাতে অনুষ্ঠিত আপিল বিচারকগণের এক সম্মেলনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে যান। ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গীয় চারুকলার তৃতীয় আন্তজার্তিক কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। ব্রাজিলের সাঁওপাওলো, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্লিংটন, এথেন্স, জর্জিয়া, ইংল্যাণ্ডের অক্সফোর্ড ও ভারতের নয়াদিলি্লতে আইন বিষয়ক ও মানবাধিকারের সম্মেলন ও সেমিনারে যোগ দেন। তিনি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশসমূহের প্রধান বিচারপতিদের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি পাকিস্তান, পাপুয়া-নিউগিনি ও অ্যান্টিগা বারবুডায় বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন।
পুরস্কার
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পান। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস গবেষণা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে দক্ষ প্রশাসক পুরস্কার, ইব্রাহিম মেমোরিয়াল পুরস্কার, অতীশ দীপংকর পুরস্কার, হিউম্যান ডিগনিটি সোসাইটি থেকে সরোজিনী নাইডু পুরস্কার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার-২০০৫ এবং স্পেশাল কনট্রিবিউশন টু হিউম্যান রাইটস পুরস্কার পান। এছাড়া সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পান একুশে পদক-২০০৭।
প্রকাশনা
আইন বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গনেও তাঁর পদচারণা রয়েছে। তাঁর প্রথম লেখালেখির হাতেখড়ি আইন ব্যবসা শুরুর দিকে। এ সময় Glanville Williams এর Learning the Law বইটি তাঁর হাতে আসে। এ নিয়েও রয়েছে এক মজার ঘটনা। হাইকোর্টের একজন আর্দালি তাঁকে আইনের বই ও জার্নাল সরবরাহ করতেন। আর্দালি একদিন তাঁকে বলেন, ‘সাহাব, একঠো কিতাব লিখিয়ে না।’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আমি আবার কিসের কিতাব লিখব?’ আর্দালি বললেন, ‘ছোটি সি এক কিতাব লিখিয়ে, রিকু্ইজিশান কি বারে মে।’ ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরের ২৯ কি ৩০ তারিখে সত্যিই হাবিবুর রহমান একটি বই লেখা শুরু করেন। দু’মাস পর ফেব্রুয়ারীর শেষদিকে লেখা শেষ হয়। পরবতী সময়ে পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কবিতা গ্রন্থের সংখ্যা ৪৮টি। তাঁর রচনাভঙ্গী সহজ ও সরল। ভাব অনুযায়ী গড়ে তোলেন তিনি রচনার কাঠামো এবং ভাষা। তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে অভিধান, নানাবিষয়ে রবীন্দ্র উক্তি সংকলন, বচন- প্রবচন সংগ্রহ, বিষয়ানুযায়ী কোরানের উদ্ধৃতি বিন্যাস, বঙ্গের ইতিহাস সম্পর্কিত বই, বাংলাদেশের ঘটনাপঞ্জি এবং ভাষণের সংকলন।
অভিধান
তাঁর ‘যথাশব্দ’ বাংলা ভাষার প্রথম ভাব অভিধান। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। প্রকাশকাল ১৯৭৪ সাল। যে শব্দ মনে আছে অথচ মনে আসছে না সেই বিস্মৃত শব্দের সূত্র সন্ধান কিংবা যে শব্দ মনে আসছে কিন্তু অর্থ মনে ধরছে না তার বিকল্প শব্দ অনুসন্ধান করা যায় এ অভিধানে। লেখক পাঠের সুবিধার্থে বিষয়ের ভাবকে আটটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। বইটি পড়ে সুনীতিকুমার চট্রোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এতে বাংলাভাষার একটা বড় অভাব পূরণ হলো।’ বইটি প্রথম প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী। পরবতীতে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড বইটি পুর্ণ সংস্করণ করে।
‘বাংলাদেশ সংবিধানের শব্দ ও খণ্ডবাক্য বাংলা-ইংরাজী : ইংরাজী বাংলা” একটি সংকলিত অভিধান গ্রন্থ। বইটি বের করেছে বাংলা একাডেমী।
তাঁর ‘যথাশব্দ’ বাংলা ভাষার প্রথম ভাব অভিধান। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। প্রকাশকাল ১৯৭৪ সাল। যে শব্দ মনে আছে অথচ মনে আসছে না সেই বিস্মৃত শব্দের সূত্র সন্ধান কিংবা যে শব্দ মনে আসছে কিন্তু অর্থ মনে ধরছে না তার বিকল্প শব্দ অনুসন্ধান করা যায় এ অভিধানে। লেখক পাঠের সুবিধার্থে বিষয়ের ভাবকে আটটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। বইটি পড়ে সুনীতিকুমার চট্রোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এতে বাংলাভাষার একটা বড় অভাব পূরণ হলো।’ বইটি প্রথম প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী। পরবতীতে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড বইটি পুর্ণ সংস্করণ করে।
‘বাংলাদেশ সংবিধানের শব্দ ও খণ্ডবাক্য বাংলা-ইংরাজী : ইংরাজী বাংলা” একটি সংকলিত অভিধান গ্রন্থ। বইটি বের করেছে বাংলা একাডেমী।
প্রবন্ধ গ্রন্থ
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রবন্ধ বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। এর মধ্যে আছে মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৩), রবীন্দ্র প্রবন্ধে সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিচার (১৯৮৩), কোরান সূত্র (১৯৮৪), রবীন্দ্র রচনার রবীন্দ্রব্যাখ্যা (১৯৮৬), রবীন্দ্রবাক্যে আর্ট, সঙ্গীত ও সাহিত্য (১৯৮৬), বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক (১৯৯৬), তেরই ভাদ্র শীতের জন্ম (১৯৯৬), কলম এখন নাগালের বাইরে (১৯৯৬), আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে (১৯৯৬), বাংলাদেশের সংবিধানের শব্দ ও খণ্ডবাক্য (১৯৯৭), বাংলাদেশের তারিখ (১৯৯৮), বং বঙ্গ বাঙ্গালা বাংলাদেশ (১৯৯৯), সরকার সংবিধান ও অধিকার (১৯৯৯), মৌসুমী ভাবনা (১৯৯৯), মিত্রাক্ষর (২০০০), কোরান শরিফ সরল বঙ্গানুবাদ (২০০০), চাওয়া-পাওয়া ও না- পাওয়ার হিসেব (২০০১), স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন ও বোবার স্বপ্ন (২০০২), রবীন্দ্র রচনায় আইনি ভাবনা (২০০২), বিষণ্ন বিষয় ও বাংলাদেশ (২০০৩), প্রথমে মাতৃভাষা পরভাষা পরে (২০০৪), রবীন্দ্রনাথ ও সভ্যতার সংকট (২০০৪), সাফদেলের মহড়া (২০০৪), দায়মুক্তি (২০০৫), উন্নত মম শির (২০০৫), এক ভারতীয় বাঙালীর আত্মসমালোচনা (২০০৫), একজন ভারতীয় বাঙালীর আত্মসমালোচনা (২০০৫), উন্নত মম শির (২০০৫), কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ (২০০৬), শিক্ষাথী ও শিক্ষাদাতাদের জয় হোক (২০০৭), বাংলার সূর্য আজ আর অস্ত যায় না (২০০৭), উদয়ের পথে আমাদের ভাবনা (২০০৭), যার যা ধর্ম (২০০৭), বাংলাদেশের তারিখ ২য় খণ্ড (২০০৭), রাজার চিঠির প্রতীক্ষায় (২০০৭) এবং জাতি ধর্মবর্ণনারীপুরুষ নির্বিশেষে (২০০৭)। শিক্ষাথী ও শিক্ষাদাতাদের জয় হোক (২০০৭), বাংলার সূর্য আজ আর অস্ত যায় না (২০০৭) ও স্বাধীনতার দায়ভার (২০০৭)।
বিষন্ন বিষয় ও বাংলাদেশ (২০০৩) প্রকাশনার ‘একুশের ফেব্রুয়ারির সুবর্ণ জয়ন্তীতে’ প্রবন্ধে হাবিবুর রহমান লিখেন, ‘ছয় বছর আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ ‘বাংলাভাষার সংগ্রাম এখনও অসমাপ্ত’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেছিলাম : ‘দেশের আদালতে যে দ্বৈতশাসন চলছে – নিচের আদালতে বাংলা ও উপরের আদালতে ইংরেজি তার আশু অবসান হওয়া প্রয়োজন। যতদিন না আমরা সাক্ষরতার আশীর্বাদ প্রতিটি নাগরিকের ঘরে পৌঁছে দিতে পারছি, যতদিন বকলম ও ঢেরা সহির রেওয়াজ উঠে না যাচ্ছে, যতদিন নির্বাচনের প্রতীক হিসেবে হুক্কা, ধানের শীষ বা নৌকার প্রচলন বন্ধ না হচ্ছে এবং নিচের কাঠামো থেকে সমাজের উপর কাঠামো সকল কর্মকাণ্ডে বিশেষ করে সর্বোচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে, ততদিন বাংলাভাষার সংগ্রাম আমি অসমাপ্ত বলে গণ্য করবো। উনিশ শ’ ছিয়ানব্বই ইংরেজি সালের এই অগৌরবের ফেব্রুয়ারীতে এসব কথা কে বা কারা শুনবে বা পড়বে?’
কাব্যগ্রন্থ
তাঁর কবিতাগ্রন্থ চারটি। এগুলো হলো কলম এখন নাগালের বাইরে (১৯৯৭), মনের আগাছা পুড়িয়ে (১৯৯৮), সাফ দেলের মহড়া (২০০৪) এবং মানুষের জন্য খাঁচা বানিও না (২০০৭)।
‘কলম এখন নাগালের বাইরে’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন ‘ছেলেবেলায় আমার কবিতা মুখস্থ হতো না, এখনও হয় না। আমি খুশিমতো শব্দ ও ছন্দ পালটে দেই। এখনও লিখিত বক্তব্য পড়ার সময় দেখি বাক্যের সিজিল মিছিল ভেঙে আগন্তুক শব্দের আবির্ভাব ঘটে। স্কুলে সঠিক আবৃত্তি না করার অপরাধে আমি বেত্রদণ্ডে দণ্ডিত হই। বেত্রাঘাতে বাম বাহু স্ফিতি লাভ করে। কেন্দ্রাপসারী বিকর্ষণে কবিতার অন্তর্ধান ঘটে।’
লোকসংস্কৃতি ও অন্যান্য
তাঁর বচন ও প্রবচন (২০০১) গ্রন্থে বাঙালীর নিজস্ব কথনভঙ্গি ধরা পড়েছে। গ্রাম বাংলার অশিক্ষিত মানুষের অক্ষর জ্ঞান না থাকলেও কথায় কথায় তারা সৃষ্টি করে বচন-প্রবচনের। এসব কথায় তাদের প্রজ্ঞা ও রসবোধের পরিচয় প্রকাশ পায়।
তাঁর ‘ডু নট বিল্ড এ কেজ ফর ম্যান’ অর্থাত্ ‘মানুষের জন্য খাঁচা বানিও না’ একটি দ্বিভাষিক বই (২০০৭)। ইংরেজি থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন ছু জি ওয়ে।
তিনি দৈনিক জাতীয় পত্রিকায় নিয়মিত কলামও লিখে থাকেন।
মৃত্যু : মুহম্মদ হাবিবুর রহমান ২০১৪ সালের ১১ই জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : রীতা ভৌমিক