বাংলাদেশের সংবিধানে ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে জীবন ধারণের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে৷ কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিকদ্রব্য ব্যবহার, খাদ্যে ভেজাল ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আমাদের পরিবেশ দুষিত হচ্ছে, সেই সাথে লঙ্ঘিত হচ্ছে জীবন ধারণের সাংবিধানিক অধিকার। মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে যিনি প্রথম আইনী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন মোহিউদ্দীন ফারুক। জনস্বার্থে এধরনের মামলা করার পথিকৃত্ তিনি। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে পরিবেশ সংক্রান্ত কোনো মামলার নিস্পত্তি হবার নজির নেই। ১৯৯৪ সালে জানুয়ারীতে মোহিউদ্দীন ফারুক তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ এনভারমেন্টাল ল’ইয়ার্স এসোসিয়েশন (বেলা)’-এর মাধ্যমে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রথম মামলাটি দায়ের করেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে পরিবেশ দূষণের দায়ে নির্বাচন কমিশনসহ চারটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রীট পিটিশন করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মেয়র ও কমিশনার প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণার নামে যে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক আইন (সিভিল ল) ভঙ্গ করছে তা বন্ধ করতে এ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ। বেলার এই রীট পিটিশনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে রুলনিশি জারি করে। এই মামলা শুনানি শেষে হাইকোর্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে’ রায় প্রদান করে। এছাড়া ১৯৯৬ সালে ড. ফারুক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আরেকটি মামলা দায়ের করেন। গুঁড়ো দুধে তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে এই মামলার রায়ের পর আমাদের দেশে আমদানিকৃত সকল দ্রব্যের একাধিক নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করার নির্দেশ দেয়া হয়। এই রায়ের পূর্বে আমদানিকৃত দ্রব্য নির্দিষ্ট একটি স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হতো।
ড. মোহিউদ্দীন ফারুক ও তাঁর প্রতিষ্ঠান বেলা’র একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের পক্ষে তৃতীয় পক্ষের মামলা করার আইনগত অধিকার আদায়। সংবিধানের ১০২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেবলমাত্র সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা মামলা করতে পারতো। এর ফলে আমাদের দেশে জনস্বার্থে মামলা (পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন বা পিআইএল) করার ক্ষেত্রে আইনগত প্রতিবন্ধকতা ছিল। মূলত পরিবেশ বিনষ্টকারী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী প্রকল্প ‘ফ্লাড একশন প্ল্যান (এফএপি) ২০’ এর বিরুদ্ধে বেলা মামলা দায়ের করে কিন্তু সারাসরি ক্ষতিগ্রস্তরা মামলাটি না করার কারণে আদালতে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতে ড. ফারুক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ক্ষতিগ্রস্তের পক্ষে তৃতীয় পক্ষেরও (লোকাস স্ট্যান্ডি) মামলা করার অনুমোদন চেয়ে আপিল করেন এবং সুপ্রিম কোর্ট তাঁর এই আপিলের পক্ষে রায় দেয়। বৃহত্তর জনস্বার্থে আইনী সহায়তা লাভের ক্ষেত্রে এই রায় মাইলফলক হিসেবে কাজ করছে। মানবাধিকার রক্ষায় ড. মোহিউদ্দীন ফারুকের এই উদ্যোগ চিরদিন বাংলাদেশের মানুষের পাথেয় হয়ে থাকবে।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
মানবাধিকারকর্মী মোহিউদ্দীন ফারুক ১৯৫৪ সালের ২৫ জুন গোপালগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম হেমায়েত আহমেদ এবং মায়ের নাম আনোয়ারা আহমেদ। বাবা ব্যবসা করতেন এবং মা ছিলেন গৃহিণী। মা-বাবার মোট তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে মোহিউদ্দীন ফারুক দ্বিতীয় সন্তান। বর্তমানে তার দুই ভাই খালিদ সাইফুল্লাহ ও মেজবাহউদ্দিন আহসান ব্যবসা করেন। চার বোন ড. আইনুন আফরোজা, জোবায়দা গুলশান, ইসমাত জাহান ও কানিজ ফাতেমা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
শৈশব সময়
মোহিউদ্দীন ফারুকের শৈশব কেটেছে গোপালগঞ্জ শহরে। সংস্কৃতিমনা পরিবারে বেড়ে ওঠার সময় তিনি শিখেছেন সৃজনশীলতা। ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখে নজর কেড়েছিলেন পরিবারের বড়দের ও প্রতিবেশীদের। ভাই-বোনরা গান শিখতেন। ছোট ভাই খালিদ একজন কন্ঠশিল্পী। ভাই-বোনদের গানের রেওয়াজ দেখে মোহিউদ্দীন ফারুক ছোট বেলা থেকেই গান শিখতে শুরু করেন। গান শেখায় তাঁর উত্সাহ ছিল প্রচুর৷ সাধারণত তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে ভালোবাসতেন। পরিবারে, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গান গেয়েছেন। কবিতা লেখা ও আবৃত্তির জন্য স্কুলের শিক্ষকরাও তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। মেধাবী ফারুক ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত গোপালগঞ্জ স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। এরপর তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গোপালগঞ্জ ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হয় ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পাসে।
শিক্ষাজীবন
মোহিউদ্দীন ফারুক ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং লেখাপড়ার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। গোপালগঞ্জ জেলায় তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখার পর ৭ম শ্রেণীতে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে এস.এস.সি. পাশ করার পর মোহিউদ্দীন ফারুক গোপালগঞ্জে ফিরে আসেন। গোপালগঞ্জ মডেল কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. পাশ করেন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এল.এল.বি. অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এলএলবি অনার্স পাশ করেন এবং ১৯৮৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এলএলএম পাশ করেন।
দিল্লীতে অবস্থিত ইনিস্টিটিউশন অব কনস্টিটিউশনাল এন্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ থেকে ১৯৮১ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীতে ডিপ্লোমা ইন কনস্টিটিউশনাল ল সম্পন্ন করেন। এই ডিপ্লোমায় তাঁর থিসিস ছিল “Rules ofLaw and its Ascendancy Over the Constitution of India”। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৮১ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীতে পার্লামেন্টারি ইনিস্টিটিউশনস এন্ড প্রসিডিওর-এর ওপর আরেকটি ডিপ্লোমাএবং পার্লামেন্টারি ফেলোশীপ অর্জন করেন। এসময় তাঁর দুটি বিষয় থিসিস করতে হয়। থিসিস দুটির বিষয় হলো:Process ofLaw-Making in the Indian Parliament. এবং Suspension of Fundamental Rights During Emergency (With special reference to right to life and personal Liberty)। এছাড়া ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে তিনি আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণডিপ্লোমা ডিগ্রি পান। এসময় তাঁকে The Unacceptable Diplomatবিষয়ে একটি থিসিস তৈরি করতে হয়।
এই মেধাবী ও শিক্ষানুরাগী জীবনের অধিকাংশ সময় পড়ালেখার সাথে ছিলেন৷ আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি বেশ কয়েকটি ডিপ্লোমা অর্জন করেও পড়ালেখার তৃষ্ণা মেটাতে পারেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি ডক্টোরেট ডিগ্রিও তিনি অর্জন করে নেন। ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর পিএইচডি-এর থিসিস ছিল:Non-navigational Uses of the Waters of International Rivers: Right of Riparian States-Extent & Limits।
সংসার জীবন
মোহিউদ্দীন ফারুক ১৯৮৫ সালের ১৭ মে সেলিমা হক রিতার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পারিবারিকভাবে দেখাশোনার পর মোহিউদ্দীন ফারুক ও সেলিমা রিতার বিয়ে হয়। নববধূ সেসময় স্নাতক ডিগ্রিধারী ছিলেন। বিয়ের পর সেলিমা ফারুক রিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ, মতামতের গুরুত্ব এবং ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। দুজনে মিলে সংসারটা যখন কেবল গুছিয়ে নিলেন ঠিক সেই সময়- ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জগত্ সংসার ছেড়ে চলে যান মোহিউদ্দীন ফারুক। স্ত্রী রিতার কাছে রেখে যান একটি মেয়ে এবং একটি ছেলে শিশু। সেলিমা ফারুক রীতা শিক্ষকতা করেন। এক ছেলে এবং এক মেয়ে। সেলিমা ফারুক রিতা এখন তার ছেলেমেয়েদের স্বামীর মতো মেধাবী এবং পরোপকারী ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন।
কর্মজীবন
জ্ঞান অর্জনে মোহিউদ্দীন ফারুক যত সময় দিয়েছেন তার এক পঞ্চমাংশ সময় তিনি পেশাগত কারণে ব্যয় করতে পারেননি। আইনজীবী হিসেবে তিনি তাঁর পেশা শুরু করেন। তিনি ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন অ্যাডভোকেট। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ এনভারমেন্টাল ল ইয়ার্স এসোসিয়েশন (বেলা) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল সেক্রেটারীর দায়িত্বে ছিলেন।
এছাড়া তিনি কনসালটেন্সি করেছেন বহু প্রতিষ্ঠানের। ইউএনডিপির কনসালটেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনার কর্মপরিকল্পনা করেন। পরিবেশ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প প্রস্তাবনা ও পরিকল্পনাও তৈরি করেছেন তিনি। মোহিউদ্দীন ফারুক ইন্টারন্যাশনাল ইনিস্টিটিউটস অব এনভারমেন্টাল স্টাডিজ এন্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, ঢাকা এ প্রিন্সিপল এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করেছেন। পরিবেশ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা ও প্রশিক্ষণের জন্য তিনি দশটির মতো প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করেন। ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইনিস্টিটিউটস অব এনভারনমেন্টাল স্টাডিজ এন্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, ঢাকা এই প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দাতাসংস্থার কাছ থেকে অর্থ সংস্থানের জন্য যোগাযোগ করে প্রতিষ্ঠানটি সচল রাখেন।
১৯৯৩ সালে কেয়ার বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের কলসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। একই বছরে ফোর্ড ফাউন্ডেশন এর সহযোগিতায় পরিবেশ বিষয়ে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন প্রকল্পর সন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিছু দিন তিনি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ সেন্টারে দায়িত্বে ছিলেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল কনজারভেশন স্ট্রাটিজি-এর খসড়া তৈরি ও সম্পাদনা করেন৷ বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক পানি ব্যবস্থাপনা, শাল বন রক্ষাসহ পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। এছাড়া তিনি বিশ্বব্যাপী পরিবেশ, আইন, অভিবাসন, আন্তর্জাতিক পানি বন্টন, বনায়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মানবাধিকারের ওপর ২৫টির মতো আন্তর্জাতিক সেমিনার, ওয়ার্কশপ বা কনফারেন্সে যোগদান করেন। মোহিউদ্দীন ফারুকের মতো এত অল্পসময়ে এত ব্যাপক কর্মজীবনের প্রসারতা বাংলাদেশের খুব কম ব্যক্তি সম্পন্ন করতে পেরেছেন। কর্মক্ষেত্রে ব্যাপকতার কারণেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের বাংলাদেশে।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি
মানবাধিকারকর্মী মোহিউদ্দীন ফারুক যেসব স্বীকৃতি ও সম্মাননা পেয়েছেন তা দিয়ে তাঁকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়৷ তাঁর নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও অর্জনের জন্য তিনি বহু সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। নিচে তার একটি তালিকা উল্লেখ করা হলো-
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইজম্যান।
২. পার্লামেন্টারি ফেলোশীপ’র জন্য দিল্লীর ইনস্টিটিউট অব কনসটিটিউশনাল এন্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ থেকে পুরস্কার।
৩. ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য আইন বিষয়ে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিআর অ্যালিন রিসার্চ স্কলারশীপ।
৪. ব্রিটেনের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রিন্সিপালদের সমন্বয় কমিটি থেকে মোহিউদ্দীন ফারুক পেয়েছেন পিএইচডি’র টিউশন ফি এর জন্য ওআরএস পুরস্কার।
৫. ইংল্যান্ডে থাকা এবং পিএইচডি’র মৌখিক পরীক্ষার খরচ জোগানোর জন্য তাঁকে কিংসলে বারসারি (Kingsley Bursary) ফান্ড দেয়া হয়।
৬. ঝিনাইদহ এক্স-ক্যাডেট এসোসিয়েশন থেকে পুরস্কার পান। তিনি এই এসোসিয়েশনের একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন।
৭. জেনেভায় ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইন কমিশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ের একটি সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য মোহিউদ্দীন একটি ফেলোশীপ পান।
৮. নভেম্বর ১৯৯০ সালে নেদারল্যান্ডে আন্তর্জাতিক পানি আইন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি কোর্স সম্পন্ন করে ইইসি ফেলোশীপ অর্জন করেন।
৯. সুইডিশ ফেলোশীপ অর্জন করেন এছাড়া সুইডেনের উপ্সালা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯১সালে প্রায় দেড় মাস ব্যাপী দ্বন্দ্ব নিরসনের ওপর একটি কোর্স করেন।
১০. মোহিউদ্দীন ফারুক ১৯৯৫ সালে ইউএস-এইপি ফোলোশীপ পান। ১১. বাংলাদেশে তামাক বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি মাননীয় রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অধিকার পুরস্কার গ্রহণ করেন।
১২. হাই কোর্ট থেকে ফ্লাড একশন প্ল্যান ( কমপার্টমেন্টালাইজড পাইলট প্রকল্প) কেসে জেতার জন্য এসোসিয়েশন অব ডেভলপমেন্ট এজেন্সিস ইন বাংলাদেশ (এডব) এবং দি কোয়ালিশন অব এনভায়রনমেন্টাল এনজিওস (সিইএন) থেকে বিশেষ পুরস্কার পান।
১৩. ১৯৯৪-৯৫ সালে ঢাকা রোটারী ক্লাবের বেস্ট স্পিকার পুরস্কার পান।
১৪. তিনি অ্যামেরিকান বায়োগ্রাফিকাল ইনস্টিটিউট (এবিআই) থেকে ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্টরি অব ডিস্টিংগুয়েস্ট লিডরশীপ পুরস্কারের জন্য মননীত হন।
এই তালিকার বাইরেও তিনি আরো কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক অনেক সম্মাননা, পুরস্কার, ফেলোশীপ ও স্বীকৃতি পেয়েছেন।
সদস্যপদ
ড. মোহিউদ্দীন ফারুক সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত হয়ে বিভিন্নভাবে সমাজের উন্নয়ন ও মানবাধিকার রক্ষার কাজ করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বার এসোসিয়েশনের সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর ওয়াটার ল, ইটালি’র সদস্য, সোসাইটি ফর এনভারনমেন্ট এন্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড), অধিকার, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ এর সদস্যসহ দেশি বিদেশি প্রায় ৩০টি সংগঠন, কমিটি বা জোটের সদস্য ছিলেন।
প্রকাশনা
ড. মোহিউদ্দীন ফারুকের মানবাধিকার, পরিবেশ, আইনসহ অন্যান্য বিষয়ে ছোট বড় প্রায় ৭০টি প্রতিবেদন, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলো বেলা বুলেটিন, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বই ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে ৭টি বই। বইগুলো হলো-
ক. ল এন্ড কাস্টম অন ফরেস্ট্রি ইন বাংলাদেশ: ইস্যু এন্ড রেমিডিস (LAW AND CUSTOM ON FORESTRY IN BANGLADESH: ISSUE AND REMEDIES)(ইংরেজি ভার্সন)
খ. রেগুলেটরি রিজিম অন ইনল্যান্ড ফিশারিজ ইন বাংলাদেশ: ইস্যু এন্ড রেমিডিস (REGULATORY REGIME ON INLAND FISHERIES IN BANGLADESH: ISSUE AND REMEDIES)(ইংরেজি ভার্সন)
গ. এনভায়রনমেন্টাল রেগুলেটরি রিজিম(ENVIRONMENTAL REGULATORY REGIME, A Selected Bibliography Covering in the SAARC Region)(ইংরেজি ভার্সন)
ঘ. পরিবেশ: রাজনৈতিক দলের ভূমিকা৷ বইটি যৌথভাবে লিখেছেন মোহিউদ্দীন ফারুক, মেসবাহ আহমেদ ও ইকবাল কবির।
ঙ. এনভারনমেন্টাল রেগুলেটরি রিজিম (ENVIRONMENTAL REGULATORY REGIME)৷ বইটি যৌথভাবে লিখেছেন মোহিউদ্দীন ফারুক, এ জায়েদ মোহাম্মাদ, এহসানুল হাবিব।
চ. লোক সাহিত্যে পরিবেশ৷ বইটি যৌথভাবে লিখেছেন মোহিউদ্দীন ফারুক ও সাবিনা বারী লাকি।
ছ.পরিবেশ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। বইটি যৌথভাবে লিখেছেন মোহিউদ্দীন ফারুক, ফিলিপ গাইন, শফিক চৌধুরী।
সাক্ষাত্কার
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, লন্ডন; রেডিও অষ্ট্রেলিয়া, জার্মান রেডিও, বাংলাদেশ টেলিভিশন, চ্যানেল ফোর, যুক্তরাজ্য তে মোহিউদ্দীন ফারুকের সাক্ষাত্কার প্রচারিত হয়। ফিনল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন, ইন্ডিয়ার বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় মোহিউদ্দীন ফারুকের বিভিন্ন কাজের আলোচনা ও তাঁর সক্ষাত্কার ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশের যেসব জাতীয় দৈনিকে মোহিউদ্দীন ফারুকের সাক্ষাত্কার ছাপা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডেইলী স্টার, দৈনিক জনকন্ঠ, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ইত্যাদি।
শেষ দিনগুলো
১৯৯৭ সালের ১৭ নভেম্বর হঠাত্ করে ড. ফারুকের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্বাস্থ্যের অবনতি হলে ১৯ নভেম্বর তাঁকে সিঙ্গাপুরে উন্নত চিকিত্সার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু উন্নত চিকিত্সাও তাঁকে আমাদের মাঝে ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের জাতীয় হাসপাতালে ড. ফারুক বিকাল ৩টা ৫১ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ফুসফুসে ফাংগাস সংক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে চিকিত্সকরা জানান। ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ড. ফারুকের মরদেহ পৌঁছানোর পর বেলা’র কার্যালয়ে, সুপ্রিম কোট প্রাঙ্গণ ও তাঁর ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে নামাজ-ই-জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরের দিন ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ড. মোহিউদ্দীন ফারুককে সমাধিস্ত করা হয়।
ড. মোহিউদ্দীন ফারুক বাংলাদেশের পরিবেশ ও মানবাধিকার রক্ষার যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা এখনো চলছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এনভারমেন্টাল ল ইয়ার্স এসোসিয়েশন (বেলা) তাঁর কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। মোহিউদ্দীন ফারুক ছিলেন দুরদর্শী মানবাধিকারকর্মী; যিনি নিরলসভাবে পরিবেশ ও জনস্বার্থ রক্ষায় কাজ করে গেছেন। আজকের যে বিপন্ন বন ও পরিবেশ জাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সে বিষয়ে তাঁর ছিল গভীর উদ্বেগ। এবিষয়ে তাঁর অনেক লেখা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. ফারুক আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ আইন (International Water Law) বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পানিসম্পদ নিয়ে যে পরিবেশগত অন্যায় অবিচার চলছে সেবিষয়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি। সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশী দেশের সাথে নদীর পানি বন্টন ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে তিনি কাজ করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিবেশ সংক্রান্ত যেসব আইন প্রবর্তিত হয়েছে তা আমাদের মতো গরীব দেশের জনগণের জন্য কতটা কার্যকর হবে সে বিষয়ে তিনি বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর এসব কর্মকাণ্ডের পথ ধরে আগামীতে পরিবেশগত ন্যায় বিচার পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে। পরিবেশ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ড. মোহিউদ্দীন ফারুকের নাম এদেশের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : এস এ এম হুসাইন