সালমা সোবহান, পুরো নাম সালমা রাশেদা আক্তার বানু। বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যারিস্টার বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সালমা সোবহান একাধারে শিক্ষক, আইনবিদ, গবেষক, মানবাধিকারকর্মী, সমাজকর্মী, সর্বোপরি একজন মানবহিতৈষী ব্যক্তি ছিলেন। একজন বৈচিত্র্যময় মানুষ হিসেবে কর্ম, জ্ঞান ও সংবেদনশীলতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। এত গুণের অধিকারী হয়েও সালমা সোবহান ছিলেন নিভৃতচারী। নিজেকে নিয়ে কোনো ধরনের প্রচার তিনি পছন্দ করতেন না। নীরবে কাজ করে যাওয়া ছিল তাঁর স্বভাব।
অত্যন্ত রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে বড় হয়েও সালমা সোবহান ছিলেন একজন প্রগতিশীল ও আধুনিকমনস্ক মানুষ। কোনো রকম সংস্কার তাঁর মধ্যে ছিল না। সালমা সোবহান ছিলেন একাধারে একজন কৃতি সংগঠক এবং উন্নত জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। কর্মী সালমা সোবহান এবং মানুষ সালমা সোবহান উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অনন্য অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয়। সালমা সোবহানের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি কখনও Value Judgment করতেন না। তিনি কখনও বলতেন না, এটি করা উচিত হয়নি, এটি করা উচিত বা এটি করতে হবে। তিনি বলতেন, এটি করলে কেমন হয়? সকল বিষয়ে অন্যের মতামত নেয়া ছিল তাঁর স্বভাবজাত। অত্যন্ত ধার্মিক সালমা সোবহানের মধ্যে কোনো রকম ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না।
বংশপরিচয়, জন্ম ও মৃত্যু
উপমহাদেশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৩৭ সালের ১১ আগস্ট সালমা সোবহান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলেন তিন বোন এবং এক ভাই। তাঁর বাবা মো. ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যে দায়িত্ব পালন করেছেন। মা শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম মহিলা সংসদ সদস্যদের অন্যতম। এছাড়া শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ মরোক্কোয় পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাত্ মা-বাবা দু’জনই রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, সালমা সোবহানের শ্বশুরও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরকম নজির ইতিহাসে বিরল। সালমা সোবহানের স্বামী বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান। সালমা সোবহানের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল অতুলনীয়। উপমহাদেশের অবিসংবাদিত নেতা ও তত্কালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তাঁর মামা। চাচা বিচারপতি হেদায়েত উল্লাহ ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি। সালমা সোবহানের পূর্ব পুরুষরা প্রথমে ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং পরে মধ্য প্রদেশের অধিবাসী ছিলেন।
২০০৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ৬৬ বছর বয়সে সালমা সোবহান তাঁর গুলশানের বাসভবনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই মৃত্যুতে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হলো তা এক কথায় অপূরণীয়।
শৈশবকাল
সালমা সোবহানের শৈশব কেটেছে রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের আবহে। রক্ষণশীল পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে বড় হলেও সালমা সোবহান উদার এবং সংস্কারমুক্ত আধুনিকমনস্ক মানুষ হিসেবেই বেড়ে উঠেছিলেন। দু’বছর বয়স পযর্ন্ত সালমা সোবহান কোনো কথা বলতে শেখেননি। শিশু সালমার প্রথম কথা ছিল,” I want my barley water (আমি বার্লি জল চাই)”৷
ছোটবেলা থেকেই সালমা সোবহান খুব বুদ্ধিমতি ছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত অল্প বয়সে তাঁর চোখের ক্ষীণদৃষ্টি ধরা পড়ে। ফলে বই পড়ার ব্যাপারে তাঁর ওপর কিছুটা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল। শৈশবে তাঁকে স্কুলে পাঠানো হয়েছিল শুধু সামাজিকতার কারণে, সত্যিকার অর্থে পড়াশুনার জন্যে নয়। ছোটবেলায় খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সালমার অনীহা ছিল প্রবল। শুধু ডিম ছাড়া কিছুই খেতে চাইতেন না, দুধ খেতে মোটেও পছন্দ করতেন না। একবার মা তাঁকে বোঝানোর জন্যে তাঁর বান্ধবী গীতার উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখো গীতা কত লম্বা, কারণ সে নিয়মিত দুধ খায়।’ উত্তরে ছোট সালমা বলেছিলেন, ‘গীতা লম্বা কারণ, তার মা লম্বা। আমি কখনও লম্বা হব না কারণ, তুমি তা নও।’
মাত্র চার বছর বয়সে সালমা নিজে নিজে পড়তে ও বুঝতে শেখেন। প্রথম যে বইটি তিনি পড়তে এবং বুঝতে পারেন, সেটি ছিল ‘Gutta Perchas Adventures Under The Sea’. তিনি প্রথম পড়তে পারার আনন্দে এতই উদ্বেলিত ও উত্তেজিত হয়েছিলেন যে, দৌড়ে বাবা-মা’র কাছে ছুটে যান এবং বলতে থাকেন- ‘আমি পড়তে পারি।’ এ ঘটনায় তাঁর বাবা-মা খুশী হওয়ার চেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন, সালমার চোখ নিয়ে। কারণ, দৃষ্টিশক্তির সমস্যার কারণে সালমার বেশি পড়াশুনা করা নিষেধ ছিল। সালমার পুরো শৈশব কালটাই খুব বেশি পড়াশুনা করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে পড়ার ব্যাপারে সালমার ঝোঁক ছিল প্রচণ্ড। হাতের কাছে যা পেতেন, তা-ই লুকিয়ে লুকিয়ে ক্ষুধার্তের মতো পড়তেন। তার ধরা পড়ার কাহিনীও ছিল অসংখ্য। সালমা সোবহান ছিলেন অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ। ছোটবেলায় তিনি মজার মজার খেলা আবিষ্কার করতেন এবং বোনদের নিয়ে খেলতেন। ছোটবেলা থেকেই সালমা সোবহানের গল্প লেখার ঝোঁক ছিল। মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর লেখা প্রথম গল্প ছাপা হয় কলকাতার শিশু ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক শংকর’-এ। কৈশরে তিনি উর্দু ম্যাগাজিন ‘বানাট’ (Banaat)-এ লিখতেন। সালমা সোবহান উর্দু কবিতা পছন্দ করতেন এবং প্রচুর উর্দু শায়েরি (Verses) তাঁর মুখস্থ ছিল। রোমাঞ্চকর কাহিনী (Thriller) এবং শিশুদের কল্পকাহিনীর (Childrens Fiction) ভক্ত ছিলেন তিনি।
শিক্ষা জীবন
সালমা সোবহানের শিক্ষা জীবন শুরু হয় ইংল্যান্ডের ওয়েস্টনবার্ট স্কুলে। পরবর্তীকালে ১৯৫৮ সালে কেমব্রিজের গির্টন কলেজ থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে লিংকন’স ইন থেকে বার এট’ ল সনদপ্রাপ্ত হন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬২ সালে। ১৯৫৮ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ব্যারিস্টার ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন
সালমা সোবহানের কর্মজীবন ছিল বর্ণাঢ্য। কর্মজীবনের শুরুতেই ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তানের মেসার্স সারিজ অ্যান্ড বিচেনো ল’ ফার্মে লিগ্যাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে কর্মরত ছিলেন ১৯৬১ সাল পর্যন্ত। ১৯৬২ সালে প্রফেসর রেহমান সোবহানের সাথে বিয়ে হওয়ার পর তিনি ঢাকা চলে আসেন।
সালমা সোবহান ১৯৬২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। আইন বিভাগের একেবারে শুরুতে যেসব আইনবিদ শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সালমা সোবহান তাদের অন্যতম। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া)-র গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷
বিলিয়া দেশের বিভিন্ন জেলার জজদের জন্যে আইন বিষয়ে যে প্রশিক্ষণ (Judicial Training) আয়োজন করে, তাতে সালমা সোবহান ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ Resource Person। সালমা সোবহানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং ধারণা নিয়েই প্রথম এধরনের প্রশিক্ষণের পাঠক্রম তৈরি করা হয়।
সালমা সোবহান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং মহিলা পরিষদের প্রথম যে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি হয়, সেই কমিটির অত্যন্ত সক্রিয় একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ‘ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড’ তৈরির কাজে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন। সালমা সোবহান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন এবং আমৃত্যু উপদেষ্টামণ্ডলীর একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত তিনি কোর্ট ল’ রিপোর্টসের সম্পাদক ছিলেন। সালমা সোবহান ১৯৮৫ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকে যোগদান করেন। তিনি ব্র্যাকের পরিচালনা পরিষদ সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৮৬ সালে তিনি এবং আরও আটজন মানবাধিকার কর্মী মিলে ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)’ নামে মানবাধিকার সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন। তাঁর কর্মকালে মানবাধিকার এবং বঞ্চিত নারীদের আইনি সহায়তার ক্ষেত্রে আসক বাংলাদেশের একটি প্রধান সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে আসক এর কর্মী সংখ্যা দু’শ এবং এটি এখন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একটি সংস্থা।
আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) প্রতিষ্ঠায়ও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এছাড়া অসংখ্য মানবাধিকার ও পেশাজীবী সংগঠনের সাথে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন অসংখ্য মানবাধিকার কর্মীর নিরন্তর অনুপ্রেরণার উৎস, তাদের জন্যে তিনি অক্লান্তভাবে পথ-নির্দেশ যুগিয়ে গেছেন।
অসংখ্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও নারী অধিকার বিষয়ক সংগঠনের সাথে তাঁর একান্ত সংশ্লিষ্টতা ছিল। Asia Pacific Forum for Women, Law and Development (APWLD)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন সালমা সোবহান। পরবর্তীকালে তিনি সংগঠনের আঞ্চলিক পরিষদ সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। Women Living Under Muslims Law (WLUML)– এর কর্মকাণ্ডের অগ্রগতিতে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তাঁর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল এমন অন্য সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে Match- Canada, Baobab-Nigeria ইত্যাদি। মৃত্যুর কিছু আগে তিনি জেনেভায় জাতিসংঘের Research Institute for Social Development– এর বোর্ড সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আইনি শিক্ষা প্রসারে সালমা সোবহানের অবদান ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের বঞ্চিত নারীদের আইনগত অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে সালমা সোবহান ছিলেন পথিকৃত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইন শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে সালমা সোবহান ব্র্যাকের হয়ে একটি প্যারালিগ্যাল প্রকল্প প্রণয়ন করেন এবং এর বাস্তবায়ন সরাসরি তদারক করেন। সমাজের বিভিন্ন স্তর এবং বিভিন্ন মতাদর্শ ও চিন্তাধারার মানুষের সঙ্গে একাত্ম হতে পারার দারুণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। তিনি সবার কথা শুনে সবার সঙ্গে মিলে কাজ করতেন। তিনি তাঁর কর্মময় জীবনে দেখিয়েছেন আইন কীভাবে ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হয়। সাধারণ মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি কাজ করতেন। গ্রাম-গঞ্জে পায়ে হেঁটে তিনি নারীদের কাছে গিয়ে বসতেন বা আইন সম্পর্কে ধারণা দিতেন; কেউ বুঝতেই পারতো না, সকলের পরিচিত, সহজ ও সাদাসিধে মানুষ এই সালমা আপা একজন ব্যারিস্টার।
মূলত সালমা সোবহানের হাতেই শুরু হয় ব্র্যাকের প্যারালিগ্যাল প্রোগ্রাম। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি দেশের বৃহত্তর জনসমাজ ও গ্রামের দরিদ্র নারীদের সংস্পর্শে আসেন। প্যারালিগ্যাল প্রোগ্রামের মাধ্যমে তিনি গ্রামের গরিব মানুষের মধ্যে অত্যন্ত সহজ ভাষায় আইন শিক্ষার উপকরণ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। যখন এই প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করা হয়, তখন ঠিক হয়েছিল কিছু প্যারা প্রফেশনাল তৈরি করা হবে। তারা গরিব মানুষকে আইন সহায়তা করবে। কিন্তু সালমা সোবহান এতে তীব্র আপত্তি জানান। তিনি বলেন, ‘এতে গ্রামে গ্রামে লিগ্যাল টাউট তৈরি হবে।’ এ থেকে সালমা সোবহানের দূরদর্শিতা ও জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়। ব্র্যাক থেকে যখন বলা হলো, ‘কোন পদ্ধতিতে কাজটা শুরু করা যায়? আইনতো খুব কঠিন জিনিস। লোকজনকে সহজে বোঝানো যাবে না। তখন আরো জগা-খিচুড়ি হয়ে যাবে।’ এর উত্তরে সালমা সোবহান বললেন,’ আমরা সহজ ভাষায় আইন শিক্ষার বই ও উপকরণ তৈরি করতে পারি। যা থেকে গ্রামের লোকজন সহজেই আইন সম্পর্কে জানতে পারবে।’ তারপর তিনি নিজেই দু’জন উকিলকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের গরিব নিরক্ষর মানুষদের উপযোগী করে সহজ ভাষায় আইন শিক্ষার বই ও উপকরণ তৈরির কাজে লেগে পড়েন। এভাবে তৈরি হয়ে যায় সহজ ভাষায় আইন শিক্ষার বই।
সালমা সোবহানের চিন্তা ছিল একেবারে নির্ভুল। তিনি যথার্থই বুঝেছিলেন, গ্রামের নিরক্ষর গরিব মানুষদের জন্যে সহজ সরল ভাষায় আইন শিক্ষার উপকরণ তৈরি করতে হবে। আর কাজটা তিনি অতি গুরুত্বের সাথে সম্পন্ন করেছেন। এখন দেশ জুড়ে ব্র্যাকের কার্যক্রমের আওতায় ২০ লক্ষ লোককে আইন শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ এবং অবাক হওয়ার মত বিষয়, সালমা সোবহানের নির্দেশনায় রচিত এই আইন শিক্ষা গ্রামের দরিদ্র মানুষ পয়সা দিয়ে গ্রহণ করছে। কারণ এতে তাদের উপকার হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের উপ-পরিচালক আমিনুল আলম বলেন, ‘শহরের মানুষ জানবে না, কিন্তু গ্রামের মানুষ জানবে- কী অবদান তাঁর, তাদের জন্যে কী অসাধারণ কাজ তিনি করে গেছেন! আইনের মত জটিল ও কঠিন বিষয়কে তিনি সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন।’
সালমা সোবহান শুধু কাজ করার জন্যে কাজ করতেন না। যা তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, তাই করতেন। কোনো কাজ দায়সারাভাবে করাও তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। প্রতিটি কাজের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে তিনি ছিলেন সজাগ। নিজ উদ্যোগে তিনি সকল কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। কোনো আইন যাতে গরিব মানুষের কাছে ভুলভাবে ব্যাখ্যা না হয়, সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ এবং তত্পর। তিনি যখন ব্র্যাকের আইন কর্মসূচির সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, তখনও বিভিন্ন সময় এই প্রকল্পের নানা বিষয়ে তদারকি করতেন।
একবার ব্র্যাকের আইন শিক্ষার বইগুলো পর্যালোচনা করে নতুনভাবে মুদ্রণ করা হয়। সালমা সোবহান তখন আইন ও সালিশ কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। একদিন তিনি এসে বললেন, ‘তোমরা যে বইগুলো পর্যালোচনা করে ছেপেছো, সেগুলো আমাকে দাও।’ বইগুলো আইন ও সালিশ কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে তিনি ইংরেজি অনুবাদ করিয়ে সমস্তটা পড়লেন। পড়ে তিনি চমকে উঠে বললেন- ‘এটা কী করেছ তোমরা? এগুলোতে তো অনেক ভুল রয়েছে। এই ভুল শিক্ষা দেওয়া তো মোটেই ঠিক হবে না। আমি অন্য কারো বই নিয়ে চিন্তা করি না, কেউ ১০টা বই লিখলেও বেশি লোক পড়বে না। কিন্তু তোমরা (ব্র্যাক) যে বই তৈরি করেছো, প্রত্যেকটা গ্রামে এগুলো যাবে, শিগগির ভুলগুলো শুধরে নাও।’ সালমা সোবহান শুধু এ কথা বলেই দায়িত্ব শেষ করেননি, তিনি নিজে ব্র্যাকের কর্মীদের সাথে বসে ভুল সংশোধনে সাহায্য করেছেন। এ থেকে কাজের প্রতি, এদেশের সাধারণ মানুষের প্রতি সালমা সোবহানের অঙ্গীকার এবং ভালোবাসা যে কত গভীর ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সালমা সোবহানের সুক্ষ্ম রসবোধ ছিল অসাধারণ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এরকম একটি ঘটনার উল্লেখ করেন৷ ‘সালমা আপার একটি বিরাট গুণ ছিল, তিনি অনেক ছোট ঘটনায় উদ্বেলিত হতে পারতেন। অনেক ছোট ছোট বিষয় থাকে, যেগুলো তাঁর চোখে পড়তো এবং সেসবের মধ্য দিয়ে মানুষকে আনন্দ দিতে পারতেন। কীভাবে মানুষকে একটু খুশিতে রাখা যায়, সেই চেষ্টা করতেন এবং সেটি করতে গিয়ে সালমা আপা অনেক সময় এমন ভাষা ব্যবহার করতেন, যেটি কখনো কখনো হিতে বিপরীত হতে পারতো। কারণ তিনি ভালো বাংলা বলতে পারতেননা। এ কারণে মানুষের কাছে তার রসিকতা অন্যরকম ব্যঞ্জনাও তৈরি করতো। সালমা আপা নিজেকে নিয়েও হাসতে পারতেন। একবার গাড়িতে উঠতে গিয়ে হাতে ব্যথা পেলেন। ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো ‘আপনি কি ভারি কিছু তুলেছেন’? সালমা আপা তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একটুখানি চুপ করে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ তুললাম তো’! – ‘কী তুললেন’?- ‘আমার নিজের শরীরটাই। নিজের শরীরটাকে বাসে তুলতে গিয়ে…’ এভাবে অনেকের সাথে তিনি কথা বলতেন, যাতে সুন্দর একটা রসবোধ ছিল। নিজেকে নিয়ে হাসতে, অন্যকে হাসাতে পারতেন।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পপুলার থিয়েটার ইউনিটের কো-অর্ডিনেটর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন, যা থেকে সালমা সোবাহানের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং প্রতু্ত্পন্নমতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘তখন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কোনো পোস্টার ছিল না। প্রথম পোস্টার যখন বের করবো, তখন আমরা ২৯টি মিটিং করলাম, কিন্তু সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলাম না যে, পোস্টারটা কী হবে? বক্তব্য কী হবে? আর ছবি কী হবে? তো, সালমা আপা শেষ পর্যন্ত একটা আইডিয়া দিলেন। সালিশে নারীর অংশগ্রহণ খুবই জরুরি; কিন্তু তারা কোথায়?- তারা কোথায় আমরা পোস্টারে দেখাবো কেমন করে? তখন আপা বললেন,’কেন নারীর ছবিটা Blank করে দেবে!’ তখন আমাদের এক সহকর্মী বললেন, ‘আপা তাহলে তা ভূতের মতো দেখা যাবে।’ আপার তাত্ক্ষনিক উত্তর, ‘ভূতের মতো দেখা যাবে কেন? ওইটার মধ্যে আমরা Sign of Question দিয়ে দিব, অন্য একটি কালার দিয়ে।’ সেটি যে কত কমিউনিকেটিভ হয়েছিল, তা বোঝা গেল শ্রীলংকায় এক কর্মশালায়। সেখানে অন্য কিছুতেই যখন আমরা বিষয়টি বোঝাতে পারছিলাম না, তখন পোস্টারটি দেখেই তারা বুঝে নিয়েছিলেন- এখানে নারীদের একটি অংশগ্রহণ দরকার, কিন্তু তারা কোথায়?- এ প্রশ্নটি করা হচ্ছে। তাঁর এই যে দূরদর্শিতা, এটি এসেছিল সম্ভবত তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষের কাছ থেকে শেখার ক্ষমতা থেকে।’
সালমা সোবহান ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং অন্যের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি নিজের অবদানকে কখনো বড় করে দেখতেন না বরং অন্যকে সকল কাজের স্বীকৃতি দিয়ে দিতেন। সম্মিলিতবোধ ছিল তাঁর স্বভাবজাত। তিনি দলীয় কাজে সকলকে উত্সাহিত করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, ‘ আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। একা কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। আমরা যদি হাতে হাত ধরে একসঙ্গে কাজ করি, তবেই একটি ভালো কাজ করা সম্ভব।’ কোনো কাজের কৃতিত্ব তিনি নিজে নিতেন না। তিনি সবসময় বলতেন, ‘এটাতো আমার একার কাজ না, এটা আমরা সবাই করেছি।’ তিনি নিউইয়র্কের Lawyers for Human Rights এর দেওয়া পুরস্কার নিতে গিয়ে বলেছেন, ‘এটি কিন্তু আমার অবদান না, আমরা যারা আইন ও সালিশে আছি, এতে সবারই অবদান রয়েছে। শুধু আইন সালিশের কর্মীই নয়, যারা মানবাধিকারকর্মী সবারই এতে অবদান আছে। আমি সবার পক্ষে এই পুরস্কারটা নিচ্ছি। নিজের পক্ষে আমি নিচ্ছি না।’
সালমা সোবহানের আত্মমর্যাদা এবং আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রখর। তিনি কখনও চাইতেন না বিদেশী টাকা নিয়ে কার্যক্রম চালাতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, নিজেদের উন্নয়ন নিজেদের প্রচেষ্টায়ই হওয়া উচিত। দাতাসংস্থার লোকদেরও তিনি খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন না, যা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ব্যতিক্রম। সালমা সোবহানের এক সহকর্মী এ সম্পর্কে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “আমি রুমে বসে আছি, দেখি একজন বিদেশী মহিলা এসে বসে আছে রিসিপশনে। দেখলাম অনেকক্ষণ বসে আছে। আমি সালমা আপা যে রুমে বসে তার পাশের রুমে ছিলাম। আমি গিয়ে রিসিপশনে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কে? জানলাম, তিনি একটি দাতাসংস্থা থেকে এসেছেন। দাতাসংস্থা থেকে এসেছেন অথচ তাকে এমন জায়গায় এতক্ষণ বসিয়ে রাখা হয়েছে- এরকম ঘটনা আমি জীবনে দেখিনি। আমি আপাকে জিজ্ঞেস করলাম, এরকম করলে তারা টাকা দেবে? বললেন, ‘না দিলেই বাঁচি। ওরা দিতে চায়। আমাদের দরকার নেই। ওরা কাকে টাকা দেবে আমাদের না দিয়ে, কেন চিন্তা করছো? আমাদের দেখিয়েই তো ওরা টাকা আনে। এভাবে চিন্তা করো, আমাদের টাকা না দিতে পারলে ওদেরও চলবে না।’ এটিও ছিল আমার জন্যে একটি নতুন কথা। এরকম কথাও আমি আগে শুনিনি।”
আসক এর নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল এ প্রসঙ্গে বলেন, “সালমা আপার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসম্মানবোধ ছিল, যিনি দাতার কাছে সমস্ত জীবন সঁপে দেওয়ার বিরোধিতা করতে পারতেন, শক্তভাবে দাঁড়িয়ে বলতে পারতেন, ‘না, আমার জীবন আমি নিয়ন্ত্রণ করবো।’ সালমা আপা জানতেন, দাতাদের সাথে আমাদের কী সম্পর্ক। একবার সালমা আপা নিউইয়র্কে দাওয়াত পেয়েছেন, তিনি যাবেন কি যাবেন না চিন্তা করছেন। বললাম, ‘আপা আপনার বোধহয় যাওয়া উচিত কারণ ওরা আন্তরিকভাবে আপনাকে চাইছে।’ সালমা আপা বলেছিলেন,’ অবশ্যই ওরা আমাকে চাইবে। কেননা আমরাই ওদের Project Proposal.’ সালমা আপার অসাধারণ দূরদর্শিতা ছিল। এত সুন্দর করে বর্ণনা দিতে পারতেন! এত সুন্দর করে বলতে পারতেন! তিনি নিজের আত্মসম্মানবোধ দিয়ে, আত্মবিশ্বাস দিয়ে দাতাদের সঙ্গে সংস্থার সম্পর্কটিকে সম্মানজনক করে রাখতেন।”
ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
মানবাধিকার কর্মী সালমা সোবহান
সালমা সোবহান সকল পর্যায়ে মানবাধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর বহুমাত্রিক কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। তিনি বলতেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের ধারণ করতে হবে ক্রোধ- সেই ক্রোধই আমাদের চালিত করবে মানবাধিকার রক্ষার নিরলস অভিযাত্রায়। মানবাধিকারের কাজ শুধুমাত্র নয়টা-পাঁচটায় শেষ হয় না, একাজ চালাতে হয় প্রতিনিয়ত, প্রতিটি মহূর্তে, ঘরে-বাইরে, অন্তরে-বাহিরে।’ তাঁর এক সহকর্মী তাঁকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপা, আমরাতো তথ্যানুসন্ধান করি, মানবাধিকার বিষয়ে কাজ করি। ধরুন, ক্রুদ্ধ জনতা একটি মানুষকে ধাওয়া করেছে, লোকটি আমার ঘরে ঢুকে পড়লো। জনতা এসে বললো, লোকটি ডাকাত। ওকে আমাদের হাতে তুলে দাও। তখন আমার করণীয় কী? তিনি বললেন, ‘ওই মুহূর্তে কাজ হচ্ছে, তাকে রক্ষা করে বিচারের ব্যবস্থা করা। অর্থাত্ লোকটির জীবন রক্ষা করা এবং বিচারের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।’
সালমা সোবহান ছিলেন অত্যন্ত মানবিক। তিনি মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ করতেন না। তিনি যেমন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করতেন, তেমনি নিজের জীবনে নিরন্তর মানবাধিকার চর্চা করতেন। তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের বহু ঘটনা থেকে এর প্রমাণ মেলে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র কম্পিউটার অপারেটর মোহসিন আলী এক স্মরণসভায় স্মৃতিচারণ করে বলেন, “জরুরি কাজ থাকলে সালমা আপা আমাকে বলতেন, ‘মোহসিন তুমি ৫টার পরে একটু থেকো, কিছু জরুরি কাজ আছে।’ একদিনের ঘটনা খুবই মনে পড়ছে। সালমা আপা বললেন, ‘মোহসিন তুমি কি খুব ক্লান্ত? যদি ক্লান্ত হয়ে থাকো তাহলে একটু বিশ্রাম নাও। আমি তোমার জন্যে চা নিয়ে আসি।’ সালমা আপা নিজেই চা বানাতে যাচ্ছিলেন। আমি অনেক কষ্টে তাঁকে বাধা দিয়েছিলাম৷ বলেছিলাম, ‘না আপা, এটি অসম্ভব। আমি নিজেই চা বানিয়ে নিয়ে আসি।’ বললেন, ‘না, তুমি কাজটা কর, কাজটা তাড়াতাড়ি দরকার। একথা আমার খুব মনে পড়ে। আমি সবাইকে বলি, সালমা আপার মতো লোক আমাকে চা বানিয়ে খাওয়াতে চেয়েছিলেন।”
সালমা সোবাহান সকল মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। শুধু তাই নয়, সকলের অংশগ্রহণকেও তিনি সমান গুরুত্ব দিতেন। দেখা যেত স্টাফ মিটিংয়ে তিনি অফিসের পিয়নসহ সাপোর্ট স্টাফদের কাছে ডেকে নিয়ে তাঁর পাশে বসাচ্ছেন।
এরকম ক্ষুদ্র অনেক ঘটনা থেকে প্রকৃত সালমা সোবহানের স্বরূপ কিছুটা চেনা যায়। ব্র্যাকের মেসেঞ্জার সেকেন্দার আলী স্মৃতিচারণ করে কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, “সালমা আপা ব্র্যাকে জয়েন করার দু’দিন পর আমাকে বললেন, ‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি৷ মিটিং আছে। আমার টিফিন বক্সে কিছু রুটি আছে, আপনি খেয়ে নেবেন।’ বললাম, আচ্ছা। পরে আমি বক্সটা এনে দেখলাম লাল একটা রুটি আর আলু-মূলা মেশানো ভাজি। আমি খেয়ে নিলাম। পরে দু’তিন দিন পরে আমাকে বলছেন, ‘আপনি লাঞ্চ করেছেন? আপনিতো বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসেন। দেখি, আপনার বক্সে কী খাবার আছে?’ আমি শুঁটকি ও কালোজিরা এবং সরিষার ভর্তা খেতাম। উনি বললেন, ‘আচ্ছা আমি আপনার সাথে খাব।’ আরেকদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘আপনার সাথে একটু বসবো, একটু বসেন তো।’ তো বসলাম। তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের সাথে কথা বলে খুব আনন্দ পাই। আপনাদের জন্যে কী করতে পারি, বলুন তো?’ আমি বললাম, ব্র্যাকে আমরা যারা ছোট পদে চাকরি করি, তাদের কোনো ওভারটাইম দেওয়া হয় না। শুধু খাবারের পয়সা দেওয়া হয়৷ তো আপা যদি একটু ব্যবস্থা করতেন। তিনি বললেন,’আচ্ছা, ঠিক আছে দেখবো।’ তিনি পরে ঠিকই ব্যবস্থা করেছিলেন।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পপুলার থিয়েটার ইউনিটের কো-অর্ডিনেটর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন, যা থেকে সালমা সোবহানের আরেকটি অনন্য মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। মানুষ হিসেবে যে তিনি অনন্য ছিলেন, তা এ ঘটনা থেকে তা অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, “আমি একটি প্রশিক্ষণের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। সেসময় প্রশিক্ষণকালীন খাবারে নতুন ধরনের কী মেনু্ দেওয়া যায়, তার প্রাণপণ প্রচেষ্টা ছিল। এই মেন্যুতে একদিন কবুতরের মাংস ছিল এবং আমি আপাকে বিশেষভাবে ডেকে নিয়ে গেলাম খাওয়ানোর জন্যে। খেতে বসে আমি খুব আবেগ আপ্লুতভাবে বললাম, ‘আপা এটি কিন্তু কবুতরের মাংস।’ আপা চমকে উঠে বললেন, ‘যেগুলো উড়ে উড়ে বেড়ায় ওগুলো?’ আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমাদের বাইরের Trainer এটি তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক করতে চাইলেন। তিনি বললেন, ‘আপা এটি তো সবাই খায়। আমরাও খেতে পারি, কোনো অসুবিধা নেই।’ আপা বললেন,’ এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না, সবাই খায় বলে আমাকেও খেতে হবে। কিন্তু অন্য সবগুলো আইটেম কিন্তু খুব মজা হয়েছে।’ আমি আপার পাশেই বসে ছিলাম। খাবারের শেষের দিকে এসে আপা বললেন, মেনু্টা অনেক ভালো হয়েছে। আমি একটু ঝোলটা খাই। তুমি মনে করো না, আমি কবুতর খাচ্ছিনা বলে ঝোল খাচ্ছি। আমি কিন্তু মাংস খাই; কিন্তু আমার অ্যালার্জি সমস্যা আছে বলে কবুতর খাব না। আর কবুতর যদি চাষ করা হয়, তাহলে হয়তো খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু উড়ন্ত কবুতর ধরে এনে যদি কেউ রান্না করে, সেটি খাওয়া বোধ হয় ঠিক হবে না।’ আমাকে বিব্রতকর অবস্থা থেকে তোলার চেষ্টাটা আমি ভুলতে পারি না। এখনো যদি কেউ কবুতর হাতে নিয়ে যায়, সাথে সাথে আমার সালমা আপার কথা মনে পড়ে।”
শিশুদের জন্য সালমা সোবহান
সালমা সোবহান শিশুদের অত্যন্ত ভালবাসতেন। দীর্ঘদিন তিনি আইন ও সালিশ কেন্দ্রে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন এবং অনেক সময় তিনি যা উপার্জন করেছেন, তা বাচ্চাদের জন্যে ব্যয় করেছেন। তিনি বাচ্চাদের সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করতেন। দরিদ্র, ছিন্নমূল ও শ্রমজীবী শিশুদের জন্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে তিনি গড়ে তুলেছেন আশ্রয়কেন্দ্র। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে শ্রমজীবী শিশুরা হেসে খেলে সঙ্গীদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পায়। সেখানে তারা গান গায়, ছবি আঁকে এবং অভিনয় করে নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটায়।
সালমা সোবহান মনে করতেন, শুধু নারীদের বিষয় নিয়ে কাজ করলেই চলবে না, সেই সাথে পথশিশু, শিশু শ্রমিক এবং নানাভাবে নির্যাতিত শিশুদের সহায়তার জন্যে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলতেন, শিশুদের ভাবতে শেখাতে হবে, তাদের নিজেদের পছন্দ বেছে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নারী ও শিশু সংশ্লিষ্ট এক বক্তৃতায় তিনি শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা এবং নিজেদের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, “রুক্ষ শোনালেও এগুলোই সত্য কথা। আমরা শিশুদের নিরাপত্তা দিতে পারি না, কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র চালাই মাত্র। যদি কোনো শিশু আমাদের কাছে আসে আমরা তার দেখাশোনা করি, যদি সে অসুস্থ হয় এবং তার মা আমাদের কাছে আসে, তখন আমরা তার জন্যে কিছু করার চেষ্টা করি; কিন্তু আমরা যা করি, তা সামান্য। যতক্ষণ না আমরা আমাদের কর্মসমূহ পরস্পরের সাথে যুক্ত করছি, এই সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা দরিদ্র শিশুদের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে পারবো না’৷
দেশ, সমাজ ও সমাজের মানুষ নিয়ে সালমা সোবহানের ছিল অবিরাম ভাবনা। তবে শুধু ভাবনার মধ্যেই তার কাজ সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি চমত্কারভাবে আমাদের সমাজের ক্ষত চিহ্নিত করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন এবং সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আয়েশা খানম স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘২০০৩ সালের ১৯ নভেম্বর আমাদের একটি সভা হলো- তিনি আমাদের সম্মানিত একজন চেয়ারপারসন হিসেবে এখানে অনেকগুলো কথা বলেছেন। আমি এখানে দু’তিনটি লাইন উল্লেখ করছি- ১১ বছর আগে আন্দোলন করে আমরা ডেমোক্রেসিকে ফেরত নিয়ে আসলাম। যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা আন্দোলন করলাম, সেই স্বপ্ন আমরা পূরণ করতে পারছি না। কেন এটি হচ্ছে? আমরা সকলেই কাজ করছি, আমরা প্রতিবাদ করছি। কিন্তু, আমার মনে হয়, আমাদের কৌশলের বিষয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করছি, সবকিছু করছি। তবে কেন সবকিছু আসছে না? আমি আজকাল হোমিওপ্যাথ নিজের ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগের চেষ্টা করছি। আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে এমন কিছু বিষ ভেতরে ঢুকে গেছে, যেগুলো বের না করলে আমাদের সমাজের এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না এবং আমার মনে হয়, আমরা এগুচ্ছি না, পেছাচ্ছি। সামনে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের আরও কাজ করতে হবে।’
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন সোচ্চার। তখন তাঁর সহকর্মী, যারা Law-এর ইস্যুতে কাজ করতো, তাদের তিনি উত্সাহিত করতেন বলতেন, সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে Movement এ থাকা দরকার। তিনি চিন্তা করতেন-আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি কীভাবে জনগণকে সচেতন করে তার মধ্য দিয়ে আন্দোলন তৈরি করা যায় এবং সেখান থেকে কীভাবে জনগণকে ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।
পারিবারিক জীবন
১৯৬২ সালে তিনি প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর বড় ছেলে তৈমুর সোবহান ১৯৮১ সালে আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মেজো ছেলে বাবর সোবহান অর্থনীতিবিদ। কনিষ্ঠ ছেলে জাফর সোবহান সাংবাদিক হিসেবে ঢাকায় দায়িত্বরত আছেন।
সালমা সোবাহানের পারিবারিক জীবন তাঁর নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছার চেয়ে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি দ্বারা বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। মাত্র একুশ বছর বয়সে পাকিস্তানের প্রথম নারী ব্যারিস্টার সালমা সোবহান কর্মজীবন শুরু করেন এবং একজন প্রখ্যাত আইনজীবী হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে সমর্থ হন। কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় রেহমান সোবহানের সাথে বিয়ের পর একবারও তাঁর উজ্জ্বল আইন পেশার দিকে না তাকিয়ে তিনি স্বামীর সাথে করাচি থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বয়স তাঁর চেয়ে বেশি ছিল।
তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানান, সালমা সোবহান মূলত চেয়েছিলেন স্বামী-সন্তান, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে একটি সুখের নীড় গড়ে তুলবেন। তিনি রেহমান সোবহান এবং ব্যারিস্টার কামাল হোসেনের চাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল, একটি সুন্দর সংসার গড়ে তোলা এবং লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করা। কারণ তিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন, কিছু অমর উপন্যাস রচনা করা ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য৷
ষাটের দশকে ঢাকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ছিল উত্তপ্ত। রেহমান সোবহান তখন দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে নানাভাবে সম্পৃক্ত। তাঁদের বাসায় বিরোধীদলীয় সাংসদ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষক-ছাত্রদের উপস্থিতিতে সরগরম থাকতো। ১৯৬৬ সালে রেহমান সোবহান একাডেমিক গবেষণার কাজে লন্ডন চলে যান। সেসময় সালমা সোবহান স্বামী এবং প্রথম সন্তান তৈমুরকে নিয়ে একান্ত সময় কাটানোর সুযোগ পান। সেখানে তিনি আইন গবেষণার ওপর ইনস্টিটিউট অব কমনওয়েলথ স্টাডিজ-এর ফেলোশিপ পান। কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক মুহূর্তে রেহমান সোবহান তাঁর পিএইচডি গবেষণা পরিত্যাগ করে দেশে ফিরে আসলে আবারও সালমা সোবহানকে তার সাজানো সংসার থেকে বিচ্যুত হতে হয়। তখন তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান বাবরের জন্ম হয়েছে। তিনি দু’সন্তান নিয়ে রেহমান সোবহানের সঙ্গে দেশে চলে আসেন। দেশের অবস্থা তখন খুবই নাজুক। ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর গণহত্যা শুরু হলে ২৮ তারিখ সকালে রেহমান সোবহান মুক্তি সংগ্রামে যোগ দিতে বাসা থেকে পালিয়ে যান। সেদিনই বিকেলে তাঁকে গ্রেফতারের জন্যে পাক বাহিনী তাঁর বাসায় হানা দেয়। সালমা সোবহানকে জিম্মি হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নেয়ার মহূর্তে তাঁদের প্রতিবেশী এবং বন্ধু আলীজুন এবং আমিনে ইস্পাহানির হস্তক্ষেপে তিনি বাসায় থাকার অনুমতি পান। এরপর তিনি কোনো রকমে তিন সন্তানসহ ঢাকা থেকে অক্সফোর্ডে চলে যেতে সমর্থ হন। তাঁদের ছোট ছেলে জাফরের বয়স তখন মাত্র দশ মাস। ১৯৭১ সালের নয় মাস রেহমান সোবহান যখন বাংলাদেশ সরকারের দূত হিসেবে স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে ব্যস্ত, তখন সালমা সোবহান অক্সফোর্ডের একটি ছোট্ট কুটিরে তার তিন সন্তানকে মাতৃস্নেহে লালন পালন করেছেন এবং অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট অব এক্সটার্নাল এডুকেশন-এ আইন শিক্ষক হিসেবে কাজ করে সামান্য আয় করেছেন। সালমা সোবহানের ইচ্ছে ছিল অক্সফোর্ডের কুইন এলিজাবেথে তাদের প্রিয় বাড়িতে সুখের নীড় গড়ে স্থিত হবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতের স্ত্রী হিসেবে সুখে শান্তিতে জীবন কাটিয়ে দেবেন। কারণ তাঁর স্বামী রেহমান সোবহান ইতোমধ্যে সেখানে একটি ফেলোশিপ পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার তাঁকে রেহমান সোবহানের সঙ্গে দেশে ফিরে আসতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে অংশ নিতে। এরপর কেটে যায় বেশ কিছু সময়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের একটি। স্বামীর সাথে সালমাকে আবারও ফিরে আসতে হয় অক্সফোর্ডের কুইন এলিজাবেথ এর বাড়িতে। এবার তিনি অক্সফোর্ডে পাঁচ বছর কাটিয়ে দেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনগুলো এখানে কাটে যেমনটি কেটেছিল বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রথম দিনগুলোতে। অক্সফোর্ড ও লন্ডনে তার পুরানো বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ছিল তাঁর জগত। এদের অনেকেই ছিলেন ঢাকার। সন্তানরা আপন নিয়মে মাতৃস্নেহে বড় হচ্ছিল। তিনি আবারও তাঁর প্রিয় শখ লেখালেখি শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আবারও তাঁকে নীড়চ্যুত হতে হয়। রেহমান সোবহান ১৯৭৯ সালে যখন মাটির টানে স্বদেশ ফিরে আসেন তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। সেইসাথে পঞ্চম বারের মত তাঁর সংসার জীবনের স্থানচ্যুতি ঘটে। এবার তিনি ছেলে তৈমুরকে অক্সফোর্ডে রেখে আসেন এ লেভেল শেষ করার জন্যে। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না ছেলের সাথে তাঁর এই বিচ্ছেদই চিরস্থায়ী হবে। বড় ছেলের মৃত্যু সালমা সোবহানের জীবনে সবচেয়ে বড় আঘাত। কারণ ছেলে তৈমুর ছিল তাঁর জীবন। তিনি সকল শোক সামলে ওঠার জন্যে দুই ছেলে বাবর এবং জাফরকে আঁকড়ে ধরেন এবং তাদের মানুষ করতে থাকেন।
এরপর সালমা সোবহান ধীরে ধীরে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করতে থাকেন, যা ছিল তাঁর স্বভাব-বিরুদ্ধ। তিনি ব্যক্তি জীবনের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করতেন। যদিও সমাজের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সালমা সোবহানের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনা ছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতেন, আমাদের দেশে আইন না জানার কারণে মেয়েরা, বিশেষ করে দরিদ্র মেয়েরা অবিচারের শিকার হচ্ছে। তিনি অনুভব করেন, এ দেশের নারীদের আইন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া দরকার। বিষয়টি নিয়ে তিনি ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদের সাথে কথা বললে তিনি তাঁকে ব্র্যাকে যোগদানের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ব্র্যাকে যোগদান করে আইন শিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেন, যা এখন ব্র্যাকের একটি অন্যতম কার্যক্রম। এরপর তিনি হামিদা হেসেন এবং খুরশিদ আহম্মেদের সাথে আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই তিনি ব্যক্তি জীবন থেকে প্রবেশ করেন জন-জীবনে।
সম্মাননা, স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা
- একাডেমিক ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সালমা সোবহানকে প্যারিস ইউনিভার্সিটি ফ্রান্স সরকারের ফাকুলতে দ্য দ্রোয়া স্কলারশিপ প্রদান করে (১৯৬১-১৯৬২)। লন্ডন ইউনির্ভাসিটির রিসার্স ফেলোশিপও (১৯৬৬-‘৬৭)পান তিনি।
- মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অবদানের জন্যে তিনি পেয়েছেন পাক্ষিক অনন্যা প্রদত্ত অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার (২০০০)। নিউইয়র্কের Lawers Commitee for Human Rights প্রদত্ত Human Rights Award (2001)- এও তিনি ভূষিত হয়েছিলেন।
- বেআইনিভাবে ফতোয়া প্রদানের ওপর ভিত্তি করে তাঁর নির্মিত ডকুমেন্টারি Eclipse VH-1 Witness Award- পুরস্কারে ভূষিত হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে ভিডিওটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
- প্রকাশনা ও সৃষ্টিকর্মের বিবরণ
সালমা সোবহানের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- Legal Status of Women in Bangladesh, BILIA (1975)
- Peasants Perception of Law, BRAC (1981)
- No Better Option Women Industrial Workers, (Co- authored), UPL (1988).
এ ছাড়াও সালমা সোবহান একটি উপন্যাস এবং তিনটি ছোট গল্প রচনা করেছিলেন। আইন এবং অন্যান্য বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লেখাগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি, সূত্র: সংলাপ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, আগস্ট ১৯৯৫, অনুবাদ-সুমন রহমান। মনের জানালা খুলে দেয়া, সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার-এর উইমেন ইন দ্য মুভ সম্পাদকের বরাবর সালমা সোবহানের চিঠি, ১০ জানুয়ারি ১৯৯৪, অনুবাদ- সুমন রহমান।
- লাল হেরিং, সূত্র: Fatwas Against Women in Bangladesh, Women Living Under Muslim Laws (WLUML), ১৯৯৬, অনুবাদ- সুমন রহমান।
- বাংলাদেশে আইনি শিক্ষা এবং গোষ্ঠী উন্নয়ন, সূত্র: এই লেখাটি United Nations Development Fund for Women (UNIFEM) প্রকাশিত Legal literacy: A tool for Womens Empowerment,(1992) – এ ব্র্যাক প্যারালিগ্যাল কর্মসূচি মূল্যায়নের ভূমিকা।
- অন্তর্বর্তীকালীন বিবাহ এবং হিল্লা প্রসঙ্গে, দ্য ডেইলি স্টার, ৯ জুন ১৯৯৪, অনুবাদ- সুমন রহমান।
- সার্বজনিন পারিবারিক আইনের যৌক্তিকতা, সূত্র:Papers on Gender Inequality and Personal Laws in Bangladesh, Unpublished, (Ain o Salish Kendra (ASK), July 1995 , অনুবাদ- সুমন রহমান।
- বাস্তবতায় জেগে ওঠা: সমাজ কিভাবে শিশুদের শোষণ করে, সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার, ২৬-২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫, অনুবাদ- সুমন রহমান।
- গৃহকর্মী: কম শোষিত শিশুশ্রম? সূত্র: Philipine Human Rights Information Centre (PhiRights)কর্তৃক প্রকাশিত Human Rights Foeum, January-June, 1996. Vol.V, No.2. অনুবাদ- নাসিরউদ্দিন খোকন।
- এটা খুব বাজে অবস্থা, সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার, ২৩ জুন ১৯৯৪, অনুবাদ- সুমন রহমান।
- শান্তি ও নিরাপত্তা: দক্ষিণ এশিয়ায় নারী আন্দোলন প্রসঙ্গ, অনুবাদ- শিবব্রত বর্মণ।
- ‘খুব সামান্যই আমাদের পক্ষে করা সম্ভব, যদি না আমরা ক্ষোভের আগুনে জ্বলে উঠি’, সূত্র: মানুষ পাচার এবং এইচআইভি/এইডস সহিংসতা বিষয়ক দক্ষিণ এশীয় নারী আদালতের জুরি সদস্য সালমা সোবহানের প্রদত্ত বক্তৃতা, ১২ আগস্ট ২০০৩, ঢাকা, ২ জানুয়ারি ২০০৪ দৈনিক নিউ এজ- এ প্রকাশিত এই নিবন্ধটি অডিও ক্যাসেট থেকে শ্রুতি লিখন, অনুবাদ- সুমন রহমান। এই ভাষ্যটি সালমা সোবহানের দেখে দেওয়ার কথা থাকলেও দুর্ভাগ্যবশত তিনি তা করে যেতে পারেননি।
- মারাত্মক অসুখ, ছোট গল্প, সূত্র: দ্য ডেইল স্টার, ২৩ জানুয়ারি ২০০৪, অনুবাদ-সুমন রহমান।
- Role of Religion, Custom and Tradition in advancing or inhibiting the Legal Rights of Women in Bangladesh, Source: WLUML.
- Political Hiostory in the India Sub-continent: A Summary, Source: WLUML, This lecture was delivered by Salma Sobhan at a seminar on `Women, Islam and development` arranged by the Ministry of Foreign Affairs, The Hague, Netherlands on 15 September 1993
- Womens Issues in Bangladesh, Source: Lawasia, 1982-83,WLUML. At the time she wrote this article Salma Sobhan was editor of the Supreme Court Law Reports published by the Bangladesh Institute of Law and International Affairs, Dhaka
- Bangladesh: Women and the Law- A Case Study, source: Mahbub ul Haq Human Development Review, Vol. 1, No.2, 2001.
প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দিয়ে মানবাধিকার ও আইন গবেষণায় সালমা সোবহানের অবদান পরিমাপ করা যাবে না। একজন শিক্ষক, লেখক এবং মানকাধিকারকর্মী হিসেবে, বিশেষ করে নারীসমাজের অধিকার রক্ষায় তাঁর ভূমিকা দেশে ও দেশের বাইরে স্বীকৃতিলাভ করেছে। গবেষণার ক্ষেত্রেও উত্তর প্রজন্মকে দীক্ষিত করা এবং আজীবন তাদের দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে যাওয়ার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর প্রকৃত অবদান।
লেখক : মীর মাসরুর জামান