মায়ের দুধের সঙ্গে শিশুর যে সম্পর্ক সঙ্গীতের সঙ্গে সেই সম্পর্ক ছিল পণ্ডিত রামকানাই দাশের। তিনি নিজেই বলতেন, ‘মায়ের দুধের সাথেই গান আমার রক্তে মিশে গেছে।’ ছোটবেলায় কিছু বুঝে উঠার আগেই গান গাওয়া শুরু রামকানাই দাশের। বাবা, মা, বোন, মামা- সবাই হয় গায়ক, না হয় বাদক ছিলেন। পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণেই ছোটবেলায় কথা শেখার আগেই তিনি শিখেছিলেন গুণগুণ করতে। প্রতিবেশি ও আত্মীয়রাও ছোটবেলায় আদর করে তাঁকে বলত, ‘গাও, বাবু, গাও, একটা গান গাও তো।’ সেই অল্প বয়সেই তাঁকে গানের মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিত তারা।
একাধারে গায়ক, রচয়িতা, সুরকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও লোকসঙ্গীত সংগ্রাহক পণ্ডিত রামকানাই দাশের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৫ এপ্রিল। সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে নানা বাড়িতে জন্ম রামকানাই দাশের। শৈশব কেটেছে সেখানেই। পরে চলে আসেন পিতৃপুরুষের ভিটা দিরাই থানার পেরুয়া গ্রামে। পেরুয়া গ্রাম তখন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এক গ্রাম। উত্তর- দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম যেদিকে যাওয়া যাক বিশ মাইল যাওয়ার পর লঞ্চের (যন্ত্রচালিত সাধারণ নৌকা) দেখা মিলত, এরপর দেখা মিলত পৃথিবীর। যে কারণে সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলটি হয়ে উঠেছিল শত সীমাবদ্ধতা নিয়েও এক পরিপূর্ণ পৃথিবী। রামকানাই দাশ সেই জন্মস্থানকে বলতেন ‘পল্লীর রাজধানী’।
সুনামগঞ্জসহ ভাটিবাংলার হাওর অঞ্চল ছয়মাস থাকে বলতে গেলে পানির নিচে। জলমগ্ন সেই সমাজের মানুষের তখন গান গাওয়া, ছড়া কাটা, গল্প করা কিংবা এই ধরনের কাজকর্ম ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। এই কারণে বাংলাদেশের হাওর- বাওর সমৃদ্ধ ভাটি অঞ্চল লোক- ঐতিহ্যেরও সমৃদ্ধ ভূমি। লোকসঙ্গীতে বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্রও ভাটি অঞ্চল। এ ব্যাপারে রামকানাই দাশ বলতেন, ‘আমি তো মূলত মাটির গান করি। মাটি থেকে এসেছি। কলকাতার বাউল, দিল্লির বাউল আর ভাটিবাংলার বাউল এক জিনিস না। কারণটা যেটা, ভাটিবাংলাতে, আমার যেখানে জন্ম, সেখানটা ছয় সাত মাস থাকে জলের নিচে। জলের নিচে থাকতে থাকতে মাটি কাদা হয়ে যায়, এই কাদা শুকাতে শুকাতে তিন মাস লেগে যায়, আর দুতিন মাস একটু রোদ থাকে। এই জায়গার গানগুলোও এই মাটির মতো নরম কোমল, সেজন্য এত ভালো লাগে।’
রামকানাই দাশের ছোটবেলার সেই অঞ্চল ছিল ধান ও গানে ভরা। কথায় কথায় সেখানে গান ফলে উঠত। রামকানাই দাশের বাবা রসিকলাল দাশ ও মা দিব্যময়ী দাশ ছিলেন পল্লী গায়ক। বাউল গানের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মিলনে বাংলার গানে নতুন এক ধারা গড়েছিলেন রসিকলাল দাশ। রসিকলাল ও দিব্যময়ী কৃষিকাজের পাশাপাশি গান রচনা করতেন, সুর করতেন। সেই অঞ্চলের হাটে-মাঠে গান গেয়ে আসর মাত করতেন তাঁরা। রামকানাই দাশের গানের এই পারিবারিক ধারা শুরু প্রপিতামহের বাবা রাধাচরণ তালুকদার থেকে। প্রপিতামহ রামচরণ তালুকদার এবং পিতামহ প্রকাশচন্দ্র তালুকদারও গানের সঙ্গেই ছিলেন। পুরো পরিবারে ছিল সঙ্গীতচর্চা। পুরো গ্রামে ছিল গান, নানা ধরনের লোকগান। রামকানাই দাশের স্ত্রী সুবর্ণা দাশও শিল্পী এবং সঙ্গীত রচয়িতা। পূর্বসূরিদের মতো রামকানাই দাশের উত্তরসূরিরাও সঙ্গীতেরই মানুষ।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে রামকানাই দাশ ছিলেন দুই বোনের ছোট। রামকানাই দাশের ছোট আরো তিন ভাই। বোন সুষমা দাশ প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী। ২০১৭ সালে একুশে পদক লাভ করেছেন তিনি। ছেলেবেলায় রান্নাঘরে মায়ের কোলে বসে রামকানাই দাশ অবাক হয়ে দেখতেন, বাইরের ঘর থেকে বাবা একটা গান গাইছেন আর মা রান্নাঘর থেকে সেই গানের জবাব দিচ্ছেন। যখন একটু বড় হয়েছেন তখন টিনের ঢোলক বানিয়ে তা গলায় ঝুলিয়ে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে গান গাইতে বেরিয়ে পড়তেন তিনি।
নানা বাড়ি সুনামগঞ্জের শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে থাকার সময়ই গান তাঁর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে। তখন বয়স দশ-বারো বছর। সেই সময় ওই গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না যে তিনি পড়াশোনা করবেন। ১২ বছর বয়সে দেড় মাইল দূরে পাশের গ্রামে একটি নতুন স্কুল চালু হয়। সব ছেলেমেয়ের স্কুলে যেতে হবে। একদিন সকালে মাথায় সরিষার তেল মেখে সেজেগুজে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েন স্কুলের উদ্দেশ্যে। স্কুলে যাওয়ার সেই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি রামকানাই দাশের। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরই পারিবারিক অনটন আর গানের টানে স্কুল ছেড়ে দেন।
রামকানাই দাশ পনের বছর বয়সেই শুরু করেন সঙ্গীতে তাঁর পেশাগত জীবন। ১৯৪৭ সালের নির্বাচনী প্রচারের জন্য গান বাঁধেন তিনি। সেই গানই তাঁর জীবনের প্রথম পেশাগত গান। যোগ দেন যাত্রাদলে। প্রতিবেশী এক স্কুলশিক্ষক কাকার (রাধাকান্ত সরকার) গড়া যাত্রাদলে যদুপতির পালায় সুবাহু’র চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাঁকে বাছাই করা হয়। কিছুদিন পর যাত্রাদল ভেঙে গেলে ফেরেন বাড়িতে। পরের বছর আবার আঙ্গারুয়ার গ্রামের আরেক যাত্রাদলে যোগ দেন তিনি। পারিবারিক অনটন আর যাত্রাপালা ও গানবাজনায় আগ্রহ দেখে কৃষিকাজ আর যাত্রাপালা নিয়েই ছেলেকে থাকতে দেন রসিকলাল দাশ। কিনে দেন এক জোড়া তবলাও। তবলা, গান ও যাত্রাপালায় তখন একেবারে মত্ত হয়ে পড়েন রামকানাই দাশ। এমনও হয়েছে যে যাত্রাপালা শোনার জন্য পাঁচ মাইল দূরের গ্রামে যেতে রাতের বেলায় একা একা সাঁতরে পাড়ি দিয়েছেন হাওরের বিস্তীর্ণ জলাভূমি।
বিশ-পঁচিশ বছর বয়সে এলাকায় গায়ক হিসেবে ব্যাপক সুনাম ছড়িয়ে পড়ে রামকানাই দাশের। নিজেই গঠন করেন পালাগানের দল। পরে আবার যোগ দেন যাত্রা দলে তবলাবাদক হিসেবে। সেই দলের হয়ে বাজানোর সময়ই তালিম নেন আজমিরিগঞ্জের কালীমোহন চক্রবর্তীর কাছে। ১৯৫৬ সালে তবলা শেখার জন্য চলে যান ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায়। সেখানে তপন নন্দীর কাছে তবলা শেখা শুরু করার পরপরই ফিরে আসতে হয় মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে। মায়ের জন্য ওষুধ আনতে যেতে হতো হাওর এলাকার নৌবন্দর আজমিরিগঞ্জে। হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জে ডাক্তার কৃষ্ণধন রায় ও অন্যদের সহযোগিতায় শুরু করেন গানের টিউশনি। চার- পাঁচ বছর সেখানেই ছিলেন তিনি। এই সময় ডাক আসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যাত্রাদল ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরা থেকে। তবলাবাদক ও সুরকার হিসেবে যোগ দেন সেই দলে। বারবার যাত্রাদলে যোগ দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল বাংলার নানা অঞ্চলের লোকগানের সঙ্গে পরিচিতি হওয়া। যাত্রাদল তখন সারা দেশে ঘুরে ঘুরে পালা করত। তিনিও তখন দেশের নানা অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে নিজেকে বাংলাদেশের লোকগানের সঙ্গে পরিচিত করে তোলেন। পরিচয় ঘটতে থাকে সঙ্গীতের নানা গুণীর সঙ্গেও।
রামকানাই দাশ ১৯৬৭ সালে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন সিলেট বেতার কেন্দ্রে। সেখানে তিনি তবলবাদক এবং নজরুল ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের শিল্পী। সিলেট বেতারে তাঁর কর্মজীবন মাত্র নয় মাস। নিজের অস্থিরতা আর পেশাগত জটিলতার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে সিলেট বেতারের চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। তবে তখনই সিলেটের উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, শিশু একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। শুরু করেন সঙ্গীতে খণ্ডকালীন প্রশিক্ষকের কাজ। এরপর বহুদিন সিলেট বেতারে সঙ্গীত শিক্ষার আসর পরিচালনা করেন।
উনসত্তরের গণ- অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ অন্য সব বাঙালির মতো তাঁকেও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নাড়া দিয়েছে। ওই সময় তিনি বাঙালির জাতীয় জাগরণে অবদান রাখেন তাঁর নিজের সঙ্গীত দিয়েই। গণচেতনার গান নিয়ে চষে বেড়ান গ্রাম-গঞ্জ ও হাট- বাজার। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেট ছেড়ে চলে যান ভারতের মেঘালয়ে। সেখানেও একটা দল গঠন করে গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে গেয়েছেন গণসঙ্গীত। মুক্তির উপায় খোঁজা মানুষকে, শরণার্থী শিবিরের অসহায় ও হতাশ মানুষকে উদ্দীপিত ও আলোড়িত করে সেই সঙ্গীত। তখন তিনি উদীচীর সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। সিলেটের কবি দিলওয়ার তখন অনেক গান লিখেছেন দেশাত্ববোধ আর সংগ্রামী চেতনার। সেসব গানে সুর দিয়েছেন ও গেয়েছেন তিনি।
রামকানাই দাশের সঙ্গীতের মূল গুরু তাঁর পরিবারিক বলয়। তাঁর গ্রাম ও অঞ্চলের গানের পরিবেশ। গুরু হিসেবে বাবা ও মাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি। বাবা-মা এবং স্বজন ও প্রতিবেশি গায়কদের কাছেই তিনি শৈশবে শুনেছেন কবি, ঘাটু, উড়ি, বিয়ের গীত, বাণ্ধা, গাজী, ত্রিনাথ, বাউল, টপ্পাসহ নানা ধরনের গান। মা নিজেই অসংখ্য গান রচনা করেছেন। শৈশবে প্রতিরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মায়ের লেখা ও সুর করা গান আর ওই অঞ্চলের লোকগীতির এক বিশাল সুর-সঙ্গীতের রাজ্যে প্রবেশ করতেন তিনি। মায়ের কাছে গান শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়তেন। সকালে সেই ঘুম ভাঙতও আবার গানে গানেই। মায়ের গাওয়া, মায়ের রচিত ও সুর করা গান তিনি বার্ধক্যেও মনে রেখেছিলেন। যেকোনো আসরে বসলেই সেসব গানের দু,একটা তিনি গাইতেন।
রামকানাই দাশ সঙ্গীতের ওস্তাদের কাছে প্রথাগত তালিম নেন অনেক দেরিতে। যখন আসলে সঙ্গীতে তাঁর অধ্যবসায় ও প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গীতের গুরু হিসেবে তিনি প্রথম তালিম নেন সঙ্গীতশিল্পী হবিগঞ্জের জলসুখা গ্রামের কালীমোহন চক্রবর্তীর কাছে (১৯৫২ সালের দিকে)। এরপর ১৯৭৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওস্তাদ উমেশচন্দ্র রায়ের কাছে একাধারে ১২ বছর গান শেখেন তিনি। তাঁর কাছে শতাধিক বন্দিশ ও রাগ শিখেছেন। প্রথমদিকে মাসে একদিন গিয়ে হোটেলে থেকে তিনি তাঁর তালিম নিতেন। আগ্রহ দেখে এক সময় উমেশচন্দ্র তাঁকে পুত্রের মতো স্নেহ করতে শুরু করেন। নিজ বাড়িতে রাখতেন, ভালো খাওয়াতেন এবং বলতেন, ‘ভালো না খেলে গান করবে কীভাবে?’ রামকানাই দাশ তবলার তালিম নেন সুরেন্দ্রমোহন সূত্রধরের কাছে।
রামকানাই দাশ নিজের পেশাগত জীবন ও কর্মজীবনকে বলতেন পাগলামি। গানের জন্য তাঁর এই পাগলামি তাঁকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছে তা তিনি অনেক সময় নিজেও খেয়াল করেননি। ১৯৬৭ সালে সিলেট বেতারে থাকার সময় তিনি সান্নিধ্য পেয়েছেন বারীন মজুমদার, আখতার সাদমানী, নীলুফার ইয়াসমিন ও খোরশেদ খানের মতো গুণী সঙ্গীতব্যক্তিত্বের। একই সময়ে পাকিস্তানের প্রখ্যাত ওস্তাদ আমানত আলী খান ও সালামত আলী খানের সাথেও সঙ্গীত করার সুযোগ হয় তাঁর।
রামকানাই দাশ বলতেন, ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যদি কেউ বলে তাহলে অশাস্ত্রীয় একটা ব্যাপারও থাকে। অশাস্ত্রীয় কোনো গান নাই।’ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের নিবিড় সম্পর্ক দেখেছিলেন তিনি। রেডিওতে এ টি কাননের কণ্ঠে শুদ্ধ কল্যাণে যেদিন শুনেছিলেন ‘বাজো বাজো রে মান্দালারা’ সেদিন তাঁর মনে পড়েছিল শৈশবে দাদু মারা যাওয়ার পর মা ও মাসির সেই কান্না- ‘ও গো বাবা গো, ও বাবা তুমি না কইলাই আমারে আয়া দেখবাই গো।’ এই কান্নার মধ্যে তিনি খুঁজে পান শুদ্ধ কল্যাণের শাস্ত্রীয় বিশুদ্ধতা। যখন তিনি এই রহস্য উন্মোচন করেন তখন তাঁর বয়স ২৫। রামকানাই দাশের ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। ওই বয়সে পৌঁছে তিনি প্রথম রেডিও শোনেন। রেডিও শুনে শুনেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় শুরু হয় তাঁর। এই পরিচয়ের সূত্রে তিনি ভাটিবাংলার পল্লীর গান আর প্রাচীন লোকসঙ্গীতকে আবিষ্কার করতে থাকেন নতুন রূপে। সঙ্গীতে শাস্ত্রীয় আর অশাস্ত্রীয় বলে যে বদ্ধমূল ধারণা সেটির অন্তঃসারহীনতা তাঁর মনে বাজতে থাকে। পল্লীর প্রাচীন ও প্রচল গানের মধ্যেও তিনি শাস্ত্রের উপস্থিতি স্পষ্ট দেখতে পান। জীবনে বারবার তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের মধ্যে যে সামঞ্জস্য ও ব্যবধান সেটি তুলে ধরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বদ্ধমূল সংস্কার ভেঙে দিতে চেয়েছেন।
গান গাওয়া আর গান শেখানোর মধ্যেই জীবন কাটিয়েছেন রামকানাই দাশ। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে তাঁর শিক্ষার্থীরা। তাঁদের অনেকেই অনেক বড় শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ। ১৯৮৮ সালে সিলেটে তিনি গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান সঙ্গীত পরিষদ। পরে নিউইয়র্কে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য সেটির একটি শাখা খোলেন তাঁরই কন্যা সঙ্গীতশিল্পী কাবেরী দাশ। সেখানে তিনি বছরে ছয়মাস গান শেখাতেন (২০০৫ সাল থেকে)। বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা ভাষাভাষীদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ ও ভাষার মানুষও সেখানে সঙ্গীত শিক্ষা নিয়েছে। বিদেশিদের বাংলার সঙ্গীত শেখার আগ্রহ দেখে তাঁর একটি উপলব্ধি হয়েছিল, তিনি বলতেন, ‘৫০ বছর পর হয়ত আমাদের সংস্কৃতি যেটা, সেটা সেখানে গিয়ে শিখতে হবে।’ সঙ্গীত পরিষদ ছাড়াও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন এবং বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছেন তিনি।
সঙ্গীতে কোনো বাছবিছার ছিল না রামকানাই দাশের। সব সঙ্গীতকে তিনি সমান গুরুত্বের সঙ্গে নিতেন। রবীন্দ্র, নজরুল, লোক, গণ, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত- সব ধরনের সঙ্গীতে সহজ ও অনায়াস ছিলেন রামকানাই দাশ। রামকানাই দাশ সঙ্গীতে তাঁর অবদানের জন্য পেয়েছেন দেশে- বিদেশে অনেক সম্মাননা ও স্বীকৃতি। ২০১৪ সালে তিনি লাভ করেন অন্যতম রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক। দেশ ও বিদেশের অনেক মাধ্যমে তাঁকে উপস্থাপন করা হয়েছে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। তাঁকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে তথ্যচিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নীরঞ্জন দে’র ‘সুরের পথিক’। তাঁর গান ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন চলচ্চিত্রে। প্রয়াত কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদ ‘ঘেটুপুত্র কমলা’য় রামকানাই দাশের সংগ্রহ ও সুরে শীতালং শাহের গান ‘শুয়া উড়িল উড়িল রে’ ব্যবহার করেছেন। রামকানাই দাশের সংগ্রহ ও সুর করা অনেক গান সমকালে তো অবশ্যই, পেয়েছে কালোত্তীর্ণ জনপ্রিয়তাও। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’ গানটির কথা।
স্বশিক্ষিত রামকানাই দাশ জীবনের শেষ দিকে এসে শুরু করেছিলেন গ্রন্থ রচনা। সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের জন্য সহজবোধ্য গ্রন্থ ‘সরল সঙ্গীত শিক্ষা’ প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘সঙ্গীত ও আমার জীবন’। রামকানাই দাশ বলতেন, ‘লোকসঙ্গীত বলতে এখন বোঝায় লালন, হাসন আর রাধারমণের মতো কয়েকজনের গান। কিন্তু এর বাইরে রয়েছে বাংলার লোকসঙ্গীতের এক বিশাল জগৎ।’ যেখানে রয়েছে, জারি, সারি, পালা, কবি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, ঘাটু, লেটু, ত্রিনাথ, বাউল, টপ্পা, উড়ি, বান্ধা, মেয়েলি গান ও বিয়ের গানসহ বিভিন্ন ধারার গান।
সত্তর বছর বয়সে প্রাচীন লোকগীতি নিয়ে রামকানাই দাশের গানের প্রথম অ্যালবাম ‘বন্ধের বাঁশী বাজে’ (২০০৪) প্রকাশিত হয়। এরপর প্রকাশিত হয় ‘সুর ধনির কিনারায়’ (২০০৫), ‘রাগাঞ্জলি’ (২০০৬), ‘অসময়ে ধরলাম পাড়ি’ (২০০৬) এবং ‘পাগলা মাঝি’ (২০১০) অ্যালবাম। তাঁর বিশাল ভাণ্ডারে যে সঙ্গীত-সম্পদ ছিল তার খুব সামান্যই এসেছে অ্যালবাম আকারে। তাঁর নিজের লেখা ও সুর করা শতাধিক গান, যেটাকে আজ বলা হচ্ছে ‘রামকানাইগীতি’, সেই গানেরও সংগ্রহ নেই বলতে গেলে। এক্ষেত্রে ‘ও মন মাঝি রে, তুমি সন্ধান করিয়া নাও বাইয়ো’, ‘আজানের বয়ানে শোনো’, ‘বৈরাগীর বাজারে চলো যাই’, ‘একখান পান চাইলাম পান দিলে না’, ‘আমি যে ডালে ধরি’ এবং ‘আমি আর যাবো না জলে’র মতো বেশ কিছু গান পেয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। বাবা রসিকলাল দাশের মতোই তিনিও বাংলা গানের লোকধারা আর শাস্ত্রীয় ধারাকে অভিন্ন ব্যঞ্জনায় বাজিয়ে তুলতে চেয়েছেন তাঁর নিজের রচনা ও সুরের গানে।
২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট সিলেট শহরের করেরপাড়ায় নিজ বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন রামকানাই দাশ। তখনই তাঁকে ভর্তি করানো হয় স্থানীয় একটি হাসপাতালে। সেখানেই তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের বিষয়টি ধরা পড়ে। পরদিনই নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ভর্তি করানো হয় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। এ সময় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বেড়ে যায় তাঁর। ৩০ আগস্ট জরুরি ভিত্তিতে তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু চিকিৎসা চলার সময়ই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। অবস্থার আরো অবনিত ঘটে। ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাত সোয়া ১১টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামের নিজ বাড়িতেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম ও পরিচয়:
পণ্ডিত রামকানাই দাশের জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে নানা বাড়িতে ১৯৩৫ সালের ১৫ এপ্রিল। পূর্বপুরুষের ভিটা একই জেলার দিরাই থানার পেরুয়া গ্রামে চলে আসেন পরে। বাবা রসিকলাল দাশ এবং মা দিব্যময়ী দাশ। কৃষিকাজের পাশাপাশি দুজনেই ছিলেন পেশাদার গায়ক। রামকানাই দাশের পাঁচ ভাইবোন। বড় বোন সুষমা দাশও সঙ্গীতে একুশ পদক (২০১৭) লাভ করেছেন।
শিক্ষা:
লেখাপড়া করার সৌভাগ্য হয়নি। নানা বাড়িতে থাকার সময় স্কুলে গিয়েছিলেন কিছুদিন। পাশের গ্রামে তখন নতুন স্কুল হচ্ছিল। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর পারিবারিক অভাব অনটনে আর পড়ালেখা হয়নি।
পেশা:
গ্রামের কৃষিজীবী পরিবার হওয়ায় প্রথমত তিনি কৃষিকাজ করেছেন। পরে তবলাবাদক ও সুরকার হিসেবে যাত্রাদলে যোগ দেন। কিছুদিনের জন্য কাজ করেন সিলেট বেতারে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে। সারাজীবন সঙ্গীত বিষয়ক নানা পেশায় জড়িত ছিলেন। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, ছায়ানট বিদ্যায়তন এবং নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান সঙ্গীত পরিষদে সঙ্গীত বিষয়ক শিক্ষকতা করেছেন।
পারিবার:
রামকানাই দাশ বিয়ে করেন ১৯৫৭ সালে। সহধর্মিনী সুবর্ণা দাশ সঙ্গীতেরই মানুষ। অনেক গানের রচয়িতা তিনি। এই দম্পতির এক মেয়ে দুই ছেলে। মেয়ে কাবেরী দাশ নিউইয়র্কে সঙ্গীত পরিষদের শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠাতা। বড় ছেলে অরুণচন্দ্র দাশ বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ী। ছোট ছেলে পিনুসেন দাশ তবলাশিল্পী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন।
গ্রন্থ:
সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের জন্য সহজবোধ্য গ্রন্থ ‘সরল সঙ্গীত শিক্ষা’ প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘সঙ্গীত ও আমার জীবন’।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
২০১৪ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি। ২০১৩ সালে লাভ করেন মেরিল- প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা। এর আগে ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, ২০০৭ সালে ওস্তাদ মোশাররফ হোসেন পদক, ২০০৫ সালে নিউইয়র্কে হাসন রাজা ফোক ফেস্টিভ্যালে ‘লোকসঙ্গীত সম্রাট উপাধি’, ২০০০ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের ‘রবীন্দ্রপদক’, ১৯৯৯ সালে ভারতের আসামের শিলচরের সংগঠন সঙ্গীতচক্রের সম্মাননা এবং ১৯৯৭ সালে ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন পদক লাভ করেন তিনি।
অ্যালবাম:
সত্তর বছর বয়সে প্রাচীন লোকগীতি নিয়ে তাঁর গানের প্রথম অ্যালবাম ‘বন্ধের বাঁশী বাজে’ (২০০৪)। এরপর প্রকাশিত হয় ‘সুর ধনির কিনারায়’ (২০০৫), ‘রাগাঞ্জলি’ (২০০৬), ‘অসময়ে ধরলাম পাড়ি’ (২০০৬) এবং ‘পাগলা মাঝি’ (২০১০) অ্যালবাম।
তথ্যচিত্র:
২০১১ সালে নির্মাতা নীরঞ্জন দে পণ্ডিত রামকানাই দাশের জীবন ও কর্ম নিয়ে ‘সুরের পথিক’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়া দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল তাকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে।
মৃত্যু:
২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট সিলেটের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে ঢাকায় এনে অস্ত্রোপচার করা হয়। চিকিৎসা চলার সময়ই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি। ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
তথ্যসূত্র:
এবিসি রেডিও, লোকগানের সরাসরি অনুষ্ঠান হাওয়া বদল, সম্প্রচার ২০১২।
মাছরাঙা টেলিভিশন, সরাসরি সঙ্গীতানুষ্ঠান তোমায় গান শোনাবো, সম্প্রচার ২২ ডিসেম্বর, ২০১১।
টিবিএন ২৪ এর সুহৃদ অনুষ্ঠানে গোলাম সারোয়ার হারুনের নেওয়া ভিডিও সাক্ষাৎকার, ২০১৪।
রামকানাই দাশকে নিয়ে জিটিভি ও বৈশাখী টিভির তথ্যচিত্র।
কলকাতাভিত্তিক টিভি চ্যানেল তারা মিউজিকের অনুষ্ঠান ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’, সম্প্রচার ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩।
দেশটিভিতে প্রচারিত সাক্ষাৎকার।
নীরঞ্জন দে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘সুরের পথিক’ (২০১১)।
শ্রদ্ধাঞ্জলি: রামকানাই দাশ, অপূর্ব শর্মা, কালিকলম, অক্টোবর, ২০১৪।
সংগীত ও আমার জীবন, রামকানাই দাশ, ঢাকা ২০১১।
‘যন্ত্রের সাহায্যে চলেছি’, দৈনিক কালের কণ্ঠে ২৭ মে ২০১০-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকার।
রামকানাই দাশের নন্দনভুবন, অন্তরঙ্গ আলাপ, সুমনকুমার দাশ, সিলেট, ২০১৪।
লেখক: ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ