সুফিয়া কামাল- সাহিত্য ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-নজরুলের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে উজ্জীবিত ও তাঁদের প্রশংসায় ধন্য হয়ে, নারী মুক্তি আন্দোলনে বেগম রোকেয়ার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতার গৌরব নিয়ে এবং দেশবাসীর মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে যিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠেছেন।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
মা সাবেরা খাতুন আর বাবা সৈয়দ আবদুল বারীর পরিবারে ১০ই আষাঢ় ১৩১৮, ২০শে জুন ১৯১১ সোমবার বেলা ৩টায় শিশু সুফিয়ার জন্ম। নানার দেওয়া নাম সুফিয়া খাতুন।
সুফিয়ার বাবা যখন সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন, তখন সুফিয়ার বয়স মাত্র সাত মাস। স্বামীর নিরুদ্দেশ যাত্রা, শ্বশুরবাড়িতে নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ , অনেকের বিরূপ মনোভাব সব মিলিয়ে সাবেরা খাতুন অনেকটা বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। সুফিয়া বড় হয়েছেন তাঁর নানার বাড়িতে ফলে তাঁর শৈশব স্মৃতি পুরোটাই মাতৃকেন্দ্রিক।
সুফিয়া কামালের মা তাঁর অপরিসীম ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে অপ্রত্যাশিত প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করেছিলেন। সাবেরা খাতুনের এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মেয়ে সুফিয়াকে রীতিমত অভিভূত করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুফিয়া কামাল তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ উত্সর্গ করেছেন তাঁর মাকে এবং এখানে মায়ের ধৈর্যের মহিমা বর্ণনার জন্যে বিবি হাজেরার উপমা দিয়েছেন ‘নির্বাসিতা হাজেরার মতো মহিমাময়ী আমার মাকে দিলাম। – সুফিয়া।’
শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা
সুফিয়ার শৈশব কেটেছে নবাবী ঐশ্বর্যের মাঝে। শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের কথ্য ভাষা ছিল উর্দু। অন্দর মহলে মেয়েদের আরবি-ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলার কোনো স্থান সেখানে ছিল না। শিশু সুফিয়া বাংলা শেখেন তাঁর মায়ের কাছে। তাঁর বড় মামার বিরাট লাইব্রেরীটি সর্বভারতে প্রসিদ্ধ ছিল। মায়ের উত্সাহ ও সহায়তায় এ লাইব্রেরির আওতায় শিশু সুফিয়া চুরি করে বই পড়তেন এবং বাংলা শেখার চেষ্টা করতেন। ছোটবেলা থেকেই সুফিয়ার মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ ও মমত্ববোধ এবং একই সাথে গ্রামের সাধারণ মানুষ ও গ্রামীণ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতি ভালবাসা দেখা যায়। সহজ সরল অনাড়ম্বর চালচলন ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পোশাকি কথাবার্তা, আচরণ তাঁর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতো।
সে সময় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার গুলোতে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার কোনো রীতি ছিল না। কিন্তু ব্যতিক্রম শিশু সুফিয়া বায়না ধরলো যে স্কুলে যাবেই। অগত্যা শিশুর ইচ্ছা পূরণের জন্যে পায়জামা আচকান পরিয়ে মাথায় টুপি দিয়ে রীতিমত ছেলে সাজিয়ে অভিভাবকরা স্কুলে পাঠালেন সুফিয়াকে। বাস্তবে স্কুলে যাওয়া আর কোনদিন সম্ভব না হলেও, স্কুলে পড়ার ঐকান্তিক বাসনা মন থেকে মুছতে পারেননি। অবদমিত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে বাড়িতে স্কুল-স্কুল খেলায়। মজার ব্যাপার, এই স্কুল-স্কুল খেলায় শিশু সুফিয়া বাংলা থেকে ইংরেজিতেই কৃতিত্বের পরিচয় দিতেন বেশি এবং ইংরেজিতে কৃতিত্বের কারণেই ‘সন্দেশ’ পত্রিকার গ্রাহক হবার অপূর্ব সুযোগ লাভ করেছিলেন। কিন্তু মেয়ের নামে পত্রিকা এসেছে, এটা কাউকে দেখানো যাবে না, এমনকি এ কথা ঘরে-বাইরে কাউকেও জানানো যাবে না। এই বৈরী পরিবেশের সমস্যার সমাধান করলেন জুবিলী স্কুলের পন্ডিত প্যারীলাল বাবু। স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি স্থানীয় পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টারের দায়িত্বও পালন করতেন। নবাব বাড়ির মেয়ের কাছে ডাকযোগে বই আসছে, এটা সকলের মধ্যে জানাজানি হলে লজ্জার কথা, উপরন্তু নিন্দা-সমালোচনার আশঙ্কা, তাই পোস্ট অফিসে সুফিয়ার নামে ‘সন্দেশ’ আসার সাথে সাথেই তিনি তা নিজ তত্ত্বাবধানে রেখে দিতেন। পরে সময় সুযোগ করে সুফিয়ার হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতেন। শিশু সুফিয়া বাংলা শিখছে শুনে প্যারীলাল বাবু খুশি হয়ে তাঁকে উত্সাহ দিতেন। এ সময় সুফিয়ার বড় ভাই সৈয়দ আবদুল ওয়ালী বরিশালে বেল ইসলামিয়া হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। বাংলার প্রতি আগ্রহের কথা শুনে ঐ হোস্টেলের পন্ডিত বাদশা মিয়া শিশু সুফিয়াকে উত্সাহ দেয়ার পাশাপাশি বাংলা বইও সংগ্রহ করে দিতেন। সাধারণভাবে প্রচলিত পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এ ভাবে অনেকের স্নেহছায়ায় ধীরে ধীরে শিশু সুফিয়া বাংলা রপ্ত করতে থাকেন।
মাত্র ৭ বছর বয়সে কলকাতায় বেগম রোকেয়ার সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। প্রথম সাক্ষাতেই বেগম রোকেয়া সুফিয়াকে তাঁর স্কুলে ভর্তি করে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব সমস্যার কারণে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের একেবারে প্রথম যুগের ছাত্রী হবার দুর্লভ সুযোগ হাতের মুঠোয় এসেও পিছলে গিয়েছিল। অনেকের ধারণা, পরিবারের রক্ষণশীলতার কারণেই সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে তাঁর ভর্তির সুযোগ হয়নি। এই সুযোগ না হওয়ার পশ্চাতে শুধু পারিবারিক রক্ষণশীলতা নয়, সে সময়ে কলকাতায় অবস্থানের সমস্যাও বহুলাংশে দায়ী ছিল।
সংসার জীবন
১৯২৪ সনে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাত ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে সুফিয়ার বিয়ে হয়েছিল। সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন প্রগতিবাদী ও নারী শিক্ষার সমর্থক। স্বামীর উত্সাহ ও অনুপ্রেরণায় বালিকাবধূ সুফিয়ার লেখার গতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। নেহাল হোসেনের ঐকান্তিক সহযোগিতায় সুফিয়ার লেখা পত্রিকায় প্রকাশের সুযোগ ঘটে, যা নববধূ সুফিয়ার জন্যে ছিল সত্যিই অকল্পনীয়। সুফিয়ার পরম সৌভাগ্য, এই বিবাহই তাঁর সুপ্ত-প্রায় প্রতিভাকে সযত্নে লালন করে বিকাশের ধারায় প্রবাহিত করেছিল। শুধু তাই নয়, সুফিয়ার লেখা প্রকাশের দায়িত্ব নেয়ায় সৈয়দ নেহাল হোসেনকে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রচুর গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। সময়ের বিচারে নেহাল হোসেনের এই পদক্ষেপ সত্যিই যুগান্তকারী ছিল। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে নিদারুণ বিষাদের ছায়া। স্বামী নেহাল হোসেন আক্রান্ত হলেন দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে। স্বামীর সেবা শুশ্রূষায় সুফিয়া রাতদিন অতিবাহিত করতে লাগলেন। বোম্বে, মাদ্রাজ, নৈনিতাল ঘুরে ফিরে হাওয়া পরিবর্তন করেও রোগ উপশমের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। শেষে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে চলে এলেন শায়েস্তাবাদের বাড়িতে। শত চেষ্টায়ও নেহাল হোসেনের জীবন রক্ষা করা গেলো না। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ১৯শে ডিসেম্বর ৬ বছরের একমাত্র কন্যাসন্তান (আমেনা খাতুন দুলু) রেখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগ। এই সময়ে সবকিছু বিবেচনা করে সুফিয়া নিজেই উপার্জনের সিদ্ধান্ত নেন। মূলত এখান থেকেই তাঁর ব্যক্তিজীবন ও সাংগঠনিক কর্মকান্ডে দুর্যোগ মুহূর্তে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সূত্রপাত। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় উপার্জনের উপায়ের প্রশ্নে। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্টিফিকেট তাঁর ছিল না। এরকম দুর্যোগময় দিনে তাঁকে দারুণভাবে সহায়তা করেন কলকাতা কর্পোরেশনের তত্কালীন এডুকেশন অফিসার শ্রীযুক্ত ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিজ উদ্যোগে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে সুফিয়াকে শিক্ষকতার চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। পঞ্চাশ টাকা মাইনের এই শিক্ষকতার চাকরি তখন সুফিয়ার জন্যে ছিল পরম পাওয়া। তিন মাসের মধ্যে সুফিয়া নিজ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষয়িত্রী পদে স্থায়ীভাবে বহাল হন। এ সময় কর্পোরেশনের শিক্ষকদের মধ্যে তিনি পান কবি আব্দুল কাদির, কবি খান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন, কবি জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ কবি সাহিত্যিককে। পুরা ত্রিশের দশকটা ছিল সুফিয়ার জীবনে রীতিমত দুঃস্বপ্নের মতো। এ দুঃসময়ে অভয়, আশ্রয় ও সমবেদনার বাণী নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন এক জ্ঞাতি-ভগ্নি বেগম মরিয়ম মনসুর। সে সময়ে বেগম মনসুর না থাকলে আজকের সুফিয়ার জীবন-ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো। সমস্ত দুঃখ, দারিদ্র্য ও মানসিক অশান্তির মধ্যে দেশের সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের সান্ত্বনা ও উত্সাহ তাঁকে নতুন প্রেরণায় নতুনভাবে বাঁচতে শেখায়। তাঁদের মধ্যে সাদত আলি আখন্দ, কাজী নজরুল ইসলাম, মাহবুব-উল-আলম ও আবুল ফজল অন্যতম। সাদত আলি আখন্দই সর্বপ্রথম সুফিয়াকে কবি হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেন।
১৯৩৯ সালের ৮ই এপ্রিলে চট্টগ্রামের কামালউদ্দিন খানের সাথে তাঁর পুনঃবিবাহ হয়। বিবাহের পর তিনি সুফিয়া কামাল নামে পরিচিত হলেন। উচ্চশিক্ষিত সুদর্শন কামালউদ্দিন খান ছিলেন অত্যন্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি। তিনি কবির কাব্য-প্রতিভার সম্মান করতেন। সুফিয়া কামালের প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল সাধারণভাবে সকলের অগোচরে, অনেকাংশে নেপথ্যে। সাহিত্যরসিক কামালউদ্দিন খান ছাত্রজীবনে কবিতা, প্রবন্ধ লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন। বিয়ের পর তিনি সুফিয়ার কাব্য প্রতিভা বিকাশের প্রতিই বেশি যত্নবান ছিলেন। তিনি কবির লেখা সংরক্ষণ, পান্ডুলিপি তৈরি ইত্যাদি সযত্নে করতেন।
এ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ছেলে শাহেদ কামাল (শামীম), আহমদ কামাল (শোয়েব), সাজেদ কামাল (শাব্বীর) এবং মেয়ে সুলতানা কামাল (লুলু) ও সাঈদা কামাল (টুলু)। শোয়েব ১৯৬৩ সালে ১৩ মে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৭ সালের ৩রা অক্টোবরে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সুফিয়া কামালের দ্বিতীয় স্বামী কামালউদ্দীন খান মারা যান।
সাহিত্য কর্ম
কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘হেনা’ সুফিয়ার মনে এক নতুন ভাবের উদ্রেক করে। গদ্য লেখার নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়ে কবিতার প্রতি মোহগ্রস্ত হন তিনি। বেগম রোকেয়া, বেগম সারা তাইফুর ও বেগম মোতাহেরা বানু প্রমুখের লেখাও তাঁকে উত্সাহিত করে।
বিয়ের সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন স্কুলের ছাত্র। বিয়ের পর বরিশাল বি.এম.কলেজ থেকে এন্ট্রাস ও এফ.এ. পাশ করে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। সেন্ট জেভিয়ার্স এ পড়ার সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন সস্ত্রীক কলকাতার তালতলায় এক বাসায় থাকতেন। কলকাতায় অবস্থান করার সুযোগে কাজী নজরুল ইসলাম, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লীলা রায়, শামসুন নাহার মাহমুদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সাক্ষাত্ লাভের অভূতপূর্ব সুযোগ তিনি লাভ করেন। যা তাঁকে সাহিত্য চর্চায় আরো অনুপ্রাণিত করে। শুধু তাই নয়, স্বামীর উত্সাহ উদ্দীপনা ও সর্বাত্মক সহযোগিতায় সুফিয়া বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করতে লাগলেন; এমনকি কংগ্রেস সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন।
প্রথম লেখা প্রকাশের পটভূমি
১৯২৩ সনে বিয়ের পর সুফিয়া ও নেহাল হোসেন বরিশাল শহরে চলে আসেন। বরিশালে সে সময় খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের পর এ.কে. ফজলুল হক ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রজারা আন্দোলনে মেতে উঠেছে। শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বরিশাল তখন অনেক অগ্রসর। এ সময় বরিশাল থেকে বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সাপ্তাহিক ‘তরুণ’। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের ভ্রাতুষ্পুত্র সরল কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘তরুণ’ পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন সে সময়ের তরুণ মেধাবী ছাত্র সৈয়দ নেহাল হোসেন। ‘তরুণ’ পত্রিকার জন্যে লেখা চাই। নেহাল হোসেনের মনে হলো তার নববধু সুফিয়ার কাঁচা হাতের কিছু লেখা আছে। তিনি সুফিয়ার ২/৩ টি লেখা সম্পাদকের কাছে নিয়ে গেলেন। সম্পাদক একটি গল্প ও একটি কবিতা মনোনীত করে প্রথমে গল্পটি ছাপার ব্যবস্থা করলেন। ‘তরুণ’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ ৩য় সংখ্যায় মিসেস এস.এন. হোসেন নামে সুফিয়ার প্রথম লেখা ‘সৈনিক বধূ’ প্রকাশিত হয়। আশ্চর্য ব্যাপার প্রথম লেখা প্রকাশের সাথে সাথে হিন্দু মুসলমান সকলে অত্যন্ত প্রশংসা করে আরও লেখার জন্য তাঁকে উত্সাহিত করেন। এ সময় বাংলার শ্রেষ্ঠ মহিলা গীতিকবি কামিনী রায় আসেন বরিশালে। একজন মুসলমান মেয়ে গল্প ও কবিতা লিখছেন এ কথা শুনে তিনি নিজে সুফিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁকে উত্সাহিত করেন।
সুফিয়ার ছোট মামা ফজলে রাব্বী সাহেব কাজী নজরুল ইসলামের সাথে দেখা করে ভাগিনী সুফিয়ার কবিতা লেখার কথা কবিকে অবহিত করেন এবং কিছু কবিতা তাঁকে পড়তে দেন। তাঁর কবিতা পড়ে নজরুল অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে ঢাকার ‘অভিযান’ পত্রিকায় কয়েকটি কবিতা ছাপার ব্যবস্থা করেন। তখন ‘অভিযান’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সুসাহিত্যিক মোহাম্মদ কাসেম। এভাবে কবিতার সূত্র ধরেই নজরুলের সাথে সুফিয়ার প্রথম পরিচয়। নজরুল কলকাতায় ফিরে গিয়ে ‘সওগাত’ পত্রিকায় লেখা পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে বরিশালে সুফিয়াকে চিঠি লেখেন। একই সাথে তাঁর ‘অঘ্রানের সওগাত’ কবিতাটি উপহার পাঠান। আনন্দ চিত্তে কবির আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুফিয়া ‘সওগাত’ – এ লেখা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ‘সওগাত’ – সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সুফিয়ার কাঁচা হাতের শিরোনাম বিহীন লেখাগুলো পান্ডুলিপি উদ্ধারের মতো যত্ন সহকারে পড়ে নিজের থেকে শিরোনাম দিয়ে ‘সওগাত’ – এ তা প্রকাশের ব্যবস্থা করতেন। এ সময় থেকেই কবি-সাহিত্যিক মহলে সুফিয়ার পরিচয়ের সূত্রপাত।
‘সওগাত’-এ প্রথম লেখা
১৩৩৩ সালে (১৯২৭ খ্রী:) সুফিয়া এন. হোসেন ‘সওগাত’-এ তাঁর প্রথম কবিতা পাঠান। ফাল্গুন মাসে তাঁর কবিতা ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরউদ্দীনের হাতে এসে পৌঁছে। পরের সংখ্যা অর্থাত্ চৈত্র সংখ্যায় তিনি তা ছাপার ব্যবস্থা করেন। তখনও নাসিরউদ্দীন সাহেব জানতেন না কে এই সুফিয়া এন. হোসেন, কোথায় তাঁর বাড়ি? তবে একজন মুসলমান মহিলা কবিতা লিখছেন এটিই ছিল তাঁর কাছে বড় কথা। নাসিরউদ্দীন সাহেব পরম যত্ন ও আন্তরিকতার সাথে ছাপার উপযোগী করে কবিতাটি (চৈত্র, ১৩৩৩) প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। চৈত্র সংখ্যায় কবিতা ছাপার পর এর পরের মাসেই আর একটি কবিতা ‘সওগাত’ অফিসে এসে পৌঁছে। এই কবিতার অবস্থাও তথৈবচ। নাসিরউদ্দীন সাহেব পূর্ববত্ প্রয়োজনীয় ঘষা-মাজা করে ‘বাসনা’ নাম দিয়ে ১৩৩৪ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় তা প্রকাশ করেন। বলতে গেলে এর পর সুফিয়া ‘সওগাত’ এর প্রায় নিয়মিত লেখিকায় পরিণত হন।
সওগাতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। এভাবে ‘সওগাত’ এ সুফিয়া এন. হোসেনের বেশ কিছু কবিতা প্রকাশের পর ১৩৩৪ সালের কার্তিক মাসে হায়দার ওরফে কানু নামে সুফিয়া এন. হোসেনের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সওগাত অফিসে এসে নাসিরউদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করে জানান যে, সুফিয়া তাঁর নিজের কবিতা পত্রিকা অফিসে পাঠাতে সংকোচ করেন, তাই তিনিই (কানু) সওগাত অফিসে কবিতাগুলো পাঠিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, নাসিরউদ্দীন সাহেবের অনুরোধে কানু পরের দিনই সুফিয়ার কবিতার খাতাটি ‘সওগাত’ অফিসে নিয়ে আসেন। নাসিরউদ্দীন সাহেব উত্সাহের সাথে সুফিয়ার কবিতার খাতাটি ‘সওগাত’ মজলিশে পেশ করে বলেন, ‘আমাদের নাকি মহিলা কবি নেই, এই দেখুন, নতুন কবির সন্ধান পেয়েছি। ইনি বয়সের দিক থেকে এখনও নবীন, উত্সাহ পেলে ক্রমে আরো ভালো লিখবেন।’
(১৯২৭ খ্রী:) ১৩৩৪ এর অগ্রাহায়ণ সংখ্যায়ও সুফিয়ার কবিতা প্রকাশিত হয়। অগ্রাহায়ণ সংখ্যা প্রকাশের কয়েকদিন পর বোরখা পরিহিতা সুফিয়া এন. হোসেন ‘সওগাত’ অফিসে এসে হাজির। উদ্দেশ্য, কবিতা ছাপানোর জন্য সওগাত সম্পাদককে তাঁর শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ জানানো। উল্লেখ্য, ‘সওগাত’ অফিসে একজন মুসলিম মহিলার আগমন ছিল এই প্রথম। সুফিয়ার বোরখা দেখে নাসিরউদ্দীন সাহেব একটু হাসির ছলে বলেছিলেন, ‘বোরখা পরলে আপনাকে কবি বলে মানায় না’। জবাবে সুফিয়া জানান, তিনি ব্যক্তিগতভাবে বোরখা পছন্দ করেন না, তবে বাড়ির রীতি-নীতির কারণে পরতে হয়। এর পর যখনই তিনি ‘সওগাত’ অফিসে আসতেন, দোতলার সিঁড়ির উপর উঠেই বোরখা খুলে রাখতেন। পরবর্তীকালে কবি সুফিয়া এন. হোসেন ও ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরউদ্দীন সাহেবের মধ্যে সম্পর্ক শুধু লেখক ও সম্পাদকের সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এ সম্পর্ক ভাই বোনে উন্নীত হয়। ‘সওগাত’ ও ‘সওগাত’ সম্পাদক উভয়েই সুফিয়ার অত্যন্ত আপন হয়ে ওঠেন। সুফিয়ার সাহিত্য ও ব্যক্তিজীবনের সুখ দুঃখের সাথে নাসিরউদ্দীন সাহেব ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েন।
প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং প্রগতি বিরোধীদের নানা সমালোচনা সত্ত্বেও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সৃজনশীলতা ও কৌশলী পদক্ষেপের কারণে সওগাতের প্রচার ও প্রসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে উত্সাহী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে তিনি ১৯২৯ সনে (বাংলা ১৩৩৬) লেখিকাদের ছবিসহ ‘মহিলা সওগাত’ প্রকাশ করার সংকল্প করেন। এ ক্ষেত্রে ছবি সংগ্রহের জন্যে নাসিরউদ্দীন সাহেব নিজেই সুফিয়া এন. হোসেনের বাসায় গিয়ে সৈয়দ নেহাল হোসেনকে তাঁর উদ্দেশ্যের কথা জানালেন। উল্লেখ্য, সুফিয়ার বাসায় সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীনের এই ছিল প্রথম আগমন। নাসিরউদ্দীন সাহেবের পরিকল্পনার কথা শুনে নেহাল হোসেন আশ্চর্য হলেও সম্মতি প্রদানে কোনো কুন্ঠাবোধ করেননি। ছবি তোলার জন্য সুফিয়াকে নিয়ে নাসিরউদ্দীন সাহেব কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার সি. গুহের স্টুডিওতে যান। মজার ব্যাপার হলো এর আগে সুফিয়া কোনোদিন ছবি তোলেননি এবং সি. গুহও তাঁর স্টুডিওতে কোনো মুসলিম মহিলার ছবি তোলেননি। সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন সাহেব পত্রিকার জন্য একজন মুসলিম মহিলার ছবি তুলতে এসেছেন একথা শুনে স্টুডিও কতৃর্পক্ষের চক্ষু তো চড়কগাছ। তার স্টুডিওতে প্রথম একজন মুসলমান মহিলা কবির ছবি তুলছেন বলে সি. গুহ সুফিয়ার ছবির কোন মূল্য নেননি, বরঞ্চ সযত্নে ছবিগুলো সওগাত অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সুফিয়া এন. হোসেনের ছবিসহ কবিতা (কবিতার নাম ছিল ‘বিড়ম্বিতা’) প্রথম সংখ্যা ‘মহিলা সওগাত’-এ (ভাদ্র ১৩৩৬) ছাপা হয়। এরপর অনেক মহিলাই সওগাতের মহিলা সংখ্যায় প্রকাশের জন্য তাঁদের ছবি দিতে সম্মত হয়েছিলেন। ক্রমে ক্রমে এ সম্পর্কে সমস্ত কুসংস্কার ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কেটে যায়।
১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর জীবনের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ ও ১৯৩৮ সালে কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’। কবি বেনজীর আহমদ নিজ খরচায় ‘কেয়ার কাঁটা’ ও ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং লেখক-সম্মানীর ব্যবস্থাও করেছিলেন। এভাবেই সাহিত্য সমাজে নতুন পরিচয়ে আবির্ভাব ঘটে সুফিয়ার। কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তিনি তাঁর ‘মন ও জীবন’ কাব্যগ্রন্থটি বেনজীর আহমদকে উত্সর্গ করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ‘সাঁঝের মায়া’র ভূমিকা লিখে সুফিয়ার সাহিত্যিক মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গায়ক কে. মল্লিক, হরেন ঘোষ প্রমুখের সাথে সুফিয়ার পরিচয় করিয়ে দেন। নজরুলের যে কোনো বই প্রকাশ হলেই তিনি সুফিয়াকে এক কপি উপহার পাঠাতেন। সাথে লিখতেন কবিতার কয়েকটি লাইন বা কোনো মন্তব্য। এই উপহারগুলো অমূল্য সম্পদ হিসাবে ছিল সুফিয়ার কাছে।
একই সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা ও আশীর্বাদ বাংলা সাহিত্যে তাঁকে একটি স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করে। রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়, যখন সুফিয়ার বয়স মাত্র ১৭/১৮। প্রথম পরিচয়ের পর কবির জন্মদিনে তিনি কবিতা লিখে পাঠালেন। কবিও তাঁকে কবিতায় উত্তর দিলেন। তারপর তাঁদের সাক্ষাৎ এবং চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের পর ১৯৪১ সালে কলকাতার নাগরিক শোকসভায় সুফিয়া কামালকে স্বরচিত কবিতা পাঠ করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের চিঠিগুলো ষাটের দশক পর্যন্ত সুফিয়া কামালের পরিবারের কাছে রক্ষিত ছিল। রবিউদ্দিন আহমদ নামে একজন সাহিত্য-গবেষক সেগুলো নিয়েছিলেন অসুস্থ নজরুলের চিকিত্সার জন্য প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে অর্থসংগ্রহের উদ্দ্যেশে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কলকাতায় তাঁর বাসায় বোমা হামলার কারণে সেসব চিঠি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে সুফিয়া কামাল শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গেলে রবীন্দ্র ভবনের পরিচালক ড. নরেশ গুহ শান্তিনিকেতনে রক্ষিত তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিসমূহের অনুলিপির একটি সেট উপহার দেন।
বেনজীর আহমদ-এর মাধ্যমে নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্ট্যোপাধ্যায়ের সাথে সুফিয়ার পরিচয় ঘটে। এই সূত্র ধরে তিনি-ই প্রথম মুসলমান মহিলা হিসাবে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে স্বরচিত কবিতা পাঠের সুযোগ লাভ করেছিলেন।
‘সওগাত’, বিশেষ করে সওগাত মহিলা সংখ্যার মাধ্যমে বেশ কিছু সংখ্যক মহিলা সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসায় আরও লেখিকা এবং সমাজকর্মী তৈরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ‘সাপ্তাহিক বেগম’ প্রকাশের পরিকল্পনা নেন। ‘সাপ্তাহিক বেগম’ প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৯৪৭ সালের ২০শে জুলাই। কলকাতায় ‘সওগাত’ অফিস থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বেগম’-এর প্রথম সম্পাদিকা মনোনীত হয়েছিলেন কবি সুফিয়া কামাল।
সুফিয়া কামাল ১৩৩৩ (১৯২৬) সাল থেকে ১৩৫৪ (১৯৪৭) সাল, ভারত ভাগের আগে পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ‘সওগাত’-এ লিখেছেন। ভারত বিভাগের পর ঢাকায় আসার পূর্বে ‘সওগাত’-এ বৈশাখ, ১৩৫৪ (১৯৪৭) সালে তাঁর সর্বশেষ লেখা ‘মালতীর প্রত্যাশা’ প্রকাশিত হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সুফিয়া কামালের সাহিত্য জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর সাহিত্য জীবনে একটি বিষয় নিয়ে এত বেশি লেখা আর কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় না। ১৯৯১ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘একুশের সংকলন : গ্রন্থপঞ্জি’-তে তাঁর একুশ ভিত্তিক ৬৫টি কবিতার উল্লেখ আছে।
সুফিয়া কামালের প্রথম লেখা ছিল গদ্য। তাঁর প্রথম গ্রন্থটিও ছিল গদ্যগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’। তাঁর মোট প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ সংখ্যা চার। অন্য তিনটি হল, ‘সোভিয়েতের দিনগুলি’ (ভ্রমণ), ‘একালে আমাদের কাল’ (আত্মজীবনীমূলক) এবং ‘একাত্তরের ডায়েরী’। অগ্রন্থিত গদ্যের মধ্যে রয়েছে একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস ‘অন্তরা’। বৈশাখ ১৩৪৫ থেকে পাঁচ কিস্তিতে ‘অন্তরা’ প্রকাশিত হয় কলকাতার মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। আরেকটি ছোট্ট উপন্যাস ‘জনক’ লিখেছিলেন ১৯৭৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রিমিয়ায় স্বাস্থ্য নিবাসে থাকাকালীন মাত্র ১৫ দিনে। যা সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকায় ১৯৭৭ -৭৮ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
১৯৭৫ – এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘মোর যাদুদের সমাধি পরে’ – কাব্যগ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ ‘Where my darlings lie buried‘ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৪ সালে মস্কো থেকে ‘সাঁঝের মায়া’-র রুশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মস্কোতে এক সংবর্ধনা সভায় বেগম সুফিয়া কামালকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এক রাশিয়ান তরুণ কবি বলেছিলেন, ‘আপনি গোর্কির মা উপন্যাসের জননী।’
এরোপ্লেনে কবি সুফিয়া
বিয়ের পর স্বামী নেহাল হোসেনের সাহস ও সহযোগিতা পেয়ে ১৯২৯ এর ডিসেম্বর মাসে তিনি বিমানে ওঠেন। বিমানের নাম ‘লেডী জ্যাকসন’, পাইলট মি: ওয়ার্নার। মাত্র একজন যাত্রী নিয়ে পাইলট আকাশে উড়ে কলকাতা শহর ও আশেপাশের স্থানগুলো ঘুরে দেখাতেন। অনেকের ইচ্ছা থাকলেও তখনকার দিনে সাহস করে কেউ এরোপ্লেনে উঠতো না। বিমানে ওঠার ক্ষেত্রে সুফিয়া দু’ধরনের সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। এক. ব্যক্তিগত মানসিক সাহস। দুই. পুরুষ পাইলটের সাথে একা ভ্রমণের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক অপ্রীতিকর সমালোচনাকে সহ্য ও অতিক্রম করার সাহস। স্বামীর বলিষ্ঠ সমর্থন সত্ত্বেও এ নিয়ে সুফিয়াকে অনেক অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। সৌভাগ্যক্রমে এ সময় বেগম রোকেয়ার অভিনন্দন ও উত্সাহ পরিস্থিতিকে অনেকটা স্বাভাবিক করে তোলে। বেগম রোকেয়া সুফিয়াকে অভিনন্দিত করে তাঁর ‘আঞ্জুমান-এ খাওয়াতীন-ই-ইসলাম’-র সঙ্গে যুক্ত করে নেন। পরিবারের বধূ অনাচারে লিপ্ত হয়েছে এ গুরুতর অভিযোগে বড় মামা সুফিয়াকে শায়েস্তাবাদের বাড়িতে এনে আটক করলেন। কিন্তু বরিশালের তত্কালীন জজ-ম্যাজিস্ট্রেট ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ যখন সুফিয়ার বিমান ভ্রমণ ও কবিত্বশক্তির প্রশংসা করতে লাগলেন, তখন ধীরে ধীরে বরফ গলতে শুরু করে -পারিবারিক অবরোধের শৃঙ্খল অনেকটা শিথিল হয়ে আসে।
সমাজসেবা
যখন সুকুমার দত্তের স্ত্রী সাবিত্রী দেবী কলকাতা থেকে বরিশালে এসে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত অসহায় মা ও শিশুদের কল্যাণে ‘শিশুসদন ও মাতৃমঙ্গল’ গঠন করলেন, তখন এই সংগঠনের মাধ্যমে সুফিয়ার সমাজসেবায় হাতেখড়ি হয়। এখানে মা ও শিশুদের সাথে কাজ করে সুফিয়া আনন্দ পেতেন। এ সময় ১৯২৫ সালে গান্ধীজী বরিশালে আসলে কিশোরী সুফিয়া হিন্দু মহিলাদের সাথে তাঁদের মতো কাপড় পরে কপালে সিঁদুর দিয়ে প্রকাশ্য সভায় নিজের হাতে-কাটা সুতা নিয়ে গান্ধীজীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
মাত্র চার বছর বেগম রোকেয়ার সংস্পর্শে থাকলেও সুফিয়া কামালের মানস-গঠনে, বিশেষ করে নারী মুক্তি আন্দোলনে, সর্বোপরি অনগ্রসর মহিলাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্যে কাজ করার যে শিক্ষা বেগম রোকেয়া থেকে তিনি পেয়েছিলেন, পরবর্তী জীবনে তাঁর সাংগঠনিক কর্মকান্ডে এর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখা যায়৷
১৯৪৬-এ কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সুফিয়া কামাল দাঙ্গা দমনের কর্মকান্ড এবং সেবাকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। নিজ কন্যা আমেনা খাতুন ও বেগম মরিয়ম মনসুরের কন্যা জাকিয়া মনসুরকে নিয়ে কলকাতা ব্রেবোর্ন কলেজ সেন্টারে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করেন। দাঙ্গার পর কামরুল হাসান, তাঁর ভাই হাসান জান ও অন্যান্য মুকুলফৌজ কর্মীদের নিয়ে সুফিয়া কামাল কংগ্রেস একজিবিশন পার্কের মধ্যেই ‘রোকেয়া মেমোরিয়াল স্কুল’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির স্কুল চালু করেন। এ সময় বিভিন্নমুখী কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে কামরুল হাসান ও জয়নুল আবেদীন এই দুই উদীয়মান তরুণ শিল্পী সুফিয়া কামালের অনুজ-সম স্নেহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
জয়নুল আবেদীন সুফিয়া কামালের বাড়ি যেতেন ট্রামে করে। আর ট্রামের টিকিটের উল্টো পিঠে খালি জায়গায় এঁকে ফেলতেন মনে যা চাইত। তাতে ছিল কবির ছেলে শামীম, কবি নিজে, কামালউদ্দিন সাহেব। ছিল পথে দেখা বিভিন্ন চরিত্র অথবা বিভিন্ন দৃশ্য।
দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল চলে আসেন ঢাকায়। সে সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাকল্পে গঠিত হয়েছিল ‘শান্তিকমিটি’। প্রখ্যাত নারীনেত্রী লীলা রায়ের অনুরোধে তিনি ‘শান্তিকমিটি’-র কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং সভানেত্রী মনোনীত হন। ১৯৪৮-এর আগস্টে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলার প্রগতিশীল মহিলা নেত্রী ও কর্মীদের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’। এই সংগঠনের সভানেত্রী নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল, যুগ্ম সম্পাদিকা যুঁই ফুল রায় ও নিবেদিতা নাগ। ১৯৫১ সালের শেষ দিকে সমাজ-সচেতন মহিলাদের এক সমাবেশে গঠিত হয় ‘ঢাকা শহর শিশু রক্ষা সমিতি’, সভানেত্রী নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল।
ভাষা আন্দোলনের পর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে ছাত্র সমাজ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। এ সময় এই আন্দোলনের প্রতি সুফিয়া কামাল পূর্ণ সমর্থনের ঘোষণা দেন। যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় লবণ ও তেলের দাম বাড়ানো হলে সকল স্তরের ও সংগঠনের মহিলারা মন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে রাস্তায় ঘেরাও করেছিলেন। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। ১৯৬০ সালে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীনিবাসের নাম ‘রোকেয়া হল’ রাখার প্রস্তাব করা হয়। ১৯৬১ সালে সামরিক শাসন, সরকারি ভয়ভীতি, নিষিদ্ধ রাজনীতির থমথমে পরিবেশে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। একই সালে ‘ছায়ানট’-র সভানেত্রী নির্বাচিত হন তিনি। প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী ‘মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১’-র বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালালে ১৯৬৩ সালে শামসুন্নাহার মাহমুদ ও সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারী মুক্তি আন্দোলনের বিভিন্ন সংগঠন এর প্রতিবাদ করে। ১৯৬৫ সালে তিনি ‘নারীকল্যাণ সংস্থা’ এবং ‘পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি’-র সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এ আইয়ুব বিরোধী মহিলাদের সমাবেশে সভানেত্রীত্ব ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তাঁর কর্মকান্ড গণঅভ্যুথানের আন্দোলনরত সংগ্রামী ছাত্র সমাজকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল। ১৯৭০ সালে গঠিত হয় ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’, যার সভানেত্রী হন তিনি। ‘৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণ বাংলায় রিলিফ বিতরণে নেতৃত্ব দেন তিনি।
১৯৬৫ সালে ঢাকায় ছাত্রসমাজের ভেতর তীব্র অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছে। এই সময়ে আইয়ুব খান ঢাকায় এসে বুদ্ধিজীবীদের সাথে বসলেন এর সমাধান করতে। সুফিয়া কামাল আইয়ুব খানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি সব শুনুন এবং এর একটা সমাধান করে দিয়ে যান।’ আইয়ুব খান উদ্ধত কন্ঠে তাঁর কথার জবাব দিলেন, ‘ওধার তো সব ইনসান হ্যায়, এধার তো সব হাইওয়ান (ওদিকে তো সব মানুষ, এদিকে তো সব জানোয়ার)।’ বেগম সুফিয়া কামাল আইয়ুব খানের মুখের উপর তীব্র ভাষায় উত্তর ছুঁড়ে দিলেন, ‘আপ তো উও হাইওয়ানকৌ প্রেসিডেন্ট হ্যায় (আপনিত সেই জানোয়ারদেরই প্রেসিডেন্ট)।’ পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের মুখের উপর এমন কড়া কথা বলা তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।
ব্যক্তি সুফিয়া কামালের মানসিক সাহস ও স্বদেশপ্রেমের সর্বোচ্চ পরিচয় পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে। মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের সময় ঢাকায় অনুষ্ঠিত মহিলাদের সমাবেশে ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন তিনি। পাকিস্তানের পক্ষে স্বাক্ষর দান প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুদিন আগে প্রেসিডেন্ট হাউসে ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠকে যে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন এবং মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন তা স্বয়ং ইয়াহিয়া খানকে পর্যন্ত বিস্মিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে পাকিস্তান বাহিনী তাঁর উপর কড়া নজর রেখেছিল। বাড়ির সামনে সব সময় সেনাবাহিনী থাকতো। দূরবীন দিয়ে নজর রাখতো। তাঁর বাসায় কেউ এলে তল্লাশী চালাতো, যানবাহনের নাম্বার লিখে রাখতো। তাঁর চলাচলের ব্যাপারে গোয়েন্দা বিভাগ তত্পর ছিল। এরমধ্যে মার্চ মাসেই গুজব রটে যায় যে, সুফিয়া কামালকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। বিদেশে এ খবরের প্রতিক্রিয়ার কারণে পাকিস্তান সরকারী প্রচার মাধ্যম তাঁর ছবি ও সাক্ষাত্কার নিতে চাইলো। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত কথা বলতে বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি শুধু বলবেন যে, তিনি জীবিত; এরপর আর কোন বিষয়ে কথা বলবেন না। অগত্যা কর্তৃপক্ষ তাতেই রাজি হতে বাধ্য হলো। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, ‘আপনি কেমন আছেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি মরিনি।’ প্রশ্ন করা হলো, ‘সাহিত্যকর্ম কেমন চলছে?’ তিনি বললেন, ‘এ অবস্থায় যেমন চলে।’ এরপর তিনি কোন প্রশ্নের জবাব দিলেন না। এ সময়ে তাঁর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে সোভিয়েত সরকার তাঁকে বিশেষ বিমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব পাঠালেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হলেন না, বললেন, ‘এখন আমি এ দেশ ছেড়ে বেহেশতেও যেতে রাজি নই। আমার দেশের মানুষেরা শান্তি পাক, সোয়াস্তি লাভ করুক – এ দেখে যেন আমি এ মাটিতেই শুয়ে থাকতে পারি।’ মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজস্ব বাসাতে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের অনেকে চলে যাওয়ার সময় তাঁর কাছে রেশন কার্ড রেখে যান। এই সমস্ত কার্ড দিয়ে তিনি চাল, ডাল ইত্যাদি তুলে নিজের বাসায় জমা করে রাখতেন। মুক্তিযোদ্ধারা সময় সুযোগ করে এসে নিয়ে যেতেন। পেছন দিয়ে দেওয়াল ডিঙিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল সংগঠক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর মাথায় করে বস্তাভর্তি খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যেতেন। জীবন-মরণের এই চরমতম সন্ধিক্ষণে প্রতি মুহূর্তে টেনশনের মধ্যে থেকেও তিনি নয় মাসে নয়টি কাঁথা সেলাই করেছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায় : ‘কাঁথা সেলাই করেছি নয়মাসে নয়টি। প্রত্যেকটি ফোঁড় আমার রক্তাক্ত বুকের রক্তে গড়া।’ এই নয় মাসে তিনি প্রতিদিনের ঘটনার বর্ণনা এবং তাঁর তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। যা পরবর্তীতে ‘একাত্তরের ডায়েরী’ নামে প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের আশ্রয় দিতে, নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে দিতে এবং নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে সুফিয়া কামালকে হত্যার উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ থেকে আল বদর বাহিনীর বিশেষ ক্যাডার নিয়ে আসা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর সতর্ক প্রহরার কারণে তিনি বেঁচে যান উল্টা তারাই মুক্তিবাহিনীর হাতে মারা যায়।
যুদ্ধ শেষে নির্যাতিত মহিলাদের পুনর্বাসনের কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। সেসময় ‘নারী পুনর্বাসন সংস্থা’-র সভানেত্রী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর তিনি ‘মহিলা পরিষদ’-র মাধ্যমে নারী সমাজের সার্বিক মুক্তির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ড তাঁকে আবার প্রতিবাদী করে তোলে। সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে সব ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে তিনি এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-র সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় আশি বছর বয়সে কার্ফূর মধ্যে মৌন মিছিলে নেতৃত্বদান ছিল তাঁর সংগ্রামী জীবনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা সে সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সংগ্রামরত দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছিল৷
শিশু আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাঁর ছিল বিরাট অবদান। অবিভক্ত বাংলার শিশু সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’-এর আদলে ১৯৫৬ সালের ৫ই অক্টোবর তাঁর বাসভবনে গঠিত হয়েছিল প্রগতিশীল শিশু সংগঠন ‘কচি কাঁচার মেলা’, যার উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। অন্য শিশু সংগঠন ‘চাঁদের হাট’-এর সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন।
মৃত্যু
১৯৯৯ সালে ২০শে নভেম্বর শনিবার সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে এই অনন্য নারী মৃত্যুবরণ করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ২৮শে নভেম্বর তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকা
কেয়ার কাঁটা (প্রথম গল্পগ্রন্থ) প্রথম প্রকাশ : ১৯৩৭ প্রকাশক : বেনজীর আহমদ দ্বিতীয় প্রকাশ : ১৯৬৭ প্রকাশক : শাহেদ কামাল মুদ্রক : বি. আর. চৌধুরী, জালারাবাদ প্রেস, ৩৪ নর্থ ব্রুকহল রোড, ঢাকা প্রচ্ছদ : হাশেম খান পরিবেশক : প্রিমিয়াম বুকস, ১৭০, নিউমার্কেট, ঢাকা উত্সর্গ : ‘নির্বাসিত হাজেরার মতো মহিমাময়ী আমার মা কে দিলাম’। তৃতীয় প্রকাশ : ১৯৯২ প্রকাশক : অনির্বাণ, ঢাকা মুদ্রক : আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা সাঁঝের মায়া (প্রথম কাব্যগ্রন্থ) প্রথম প্রকাশ : ১৯৩৮ প্রকাশক : বেনজীর আহমদ মুদ্রক : উমেশচন্দ্র দাস, দরবার প্রেস, ৬৩ নং কলীন স্ট্রীট, কলিকাতা উত্সর্গ : ‘আমার জেন্নাতবাসী স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের নামে’ ভূমিকা : কাজী নজরুল ইসলাম দ্বিতীয় প্রকাশ : ১৯৬৭ প্রকাশক : শাহেদ কামাল মুদ্রক : ওসমান গনি, আধুনিক প্রেস, ২৫৫ জগন্নাথ সাহা রোড, ঢাকা প্রচ্ছদ : সৈয়দ এনায়েত হোসেন পরিবেশক : প্রিমিয়াম বুকস, ১৭০, নিউমার্কেট, ঢাকামায়া কাজল (দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ) প্রথম প্রকাশ : ১৯৫১ উত্সর্গ : অসুস্থ কবি কাজী নজরুল ইসলামের আশু রোগমুক্তি কামনা করে কবিতা – ফরিয়াদ দ্বিতীয় প্রকাশ : ১৯৬৬ প্রকাশক : শাহেদ কামাল মুদ্রক : এম. এ. তাহের, তাহের আর্ট প্রেস, ৯৭ ঋষিকেশ দাস রোড, ঢাকা প্রচ্ছদ : সৈয়দ এনায়েত হোসেন পরিবেশক : প্রিমিয়াম বুকস, ১৭০, নিউমার্কেট, ঢাকামন ও জীবন (তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ) প্রথম প্রকাশ : ১৯৫৭ প্রকাশক : বায়েজীদ খান পন্নী মুদ্রক : এম. এ. তাহের, তাহের আর্ট প্রেস, ৯৭ ঋষিকেশ দাস রোড, ঢাকা উত্সর্গ : ‘দুঃখের দিনের বন্ধু অগ্রজোপম কবি বেনজীর আহমদ ও কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন শ্রদ্ধাস্পদেষু’উদাত্ত পৃথিবী (চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ) প্রথম প্রকাশ : জুন, ১৯৬৪ প্রকাশক : মোঃ ওহিদউল্লাহ্ মুদ্রক : এম. চৌধুরী, রিপাবলিক প্রেস, ২, কবিরাজ লেন, ঢাকা প্রচ্ছদ : নিত্য গোপাল কুন্ড পরিবেশক : স্টুডেন্ট ওয়েজ, বাংলা বাজার, ঢাকা উত্সর্গ : ‘যাঁর সতর্ক স্নেহছায়ায় আমার সাহিত্য-জীবনের বিকাশ-সওগাত-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সাহেব শ্রদ্ধাস্পদেষু’। ইতল বিতল দীওয়ান সোভিয়েতের দিনগুলি প্রশস্তি ও প্রার্থনা অভিযাত্রিক মৃত্তিকার ঘ্রাণ মোর যাদুদের সমাধি পরে নওল কিশোরের দরবারে একালে আমাদের কাল একাত্তরের ডায়েরী স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলন সাঁঝের মায়া – বলশেভনী সুমের্কী |
|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
প্রাপ্ত পুরস্কারের তালিকা | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
|