১৯৮১ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ ‘চলচ্চিত্র পত্র’-এর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র ওপর। সেখানে একটি লেখায় কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মন্তব্য করেছিলেন, “এই ছবির ক্যামেরার কাজ জীবন্ত শিল্পীর মতো। মনে হতে পারে যে, ক্যামেরাকে অগাধ স্বাধীনতা দিয়ে পরিচালকরা বসেছিলেন অনেক পেছনে। একটির পর একটি দৃশ্য সাজানো হয়েছে, পরিচালকদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। পেছনে বসে খুব শক্ত ও পরিশ্রমী এবং সর্বোপরি সৃজনশীল হাতে নিয়ন্ত্রণ না করলে ক্যামেরার স্বতঃস্ফূর্ততা এভাবে অনুভব করা যেত না।” ক্যামেরার পেছনের খুব শক্ত পরিশ্রমী এই সৃজনশীল হাতের মানুষটির নাম আনোয়ার হোসেন – যাঁর প্রতিভা ও কর্মকুশলতায় এ দেশের চলচ্চিত্র পেয়েছে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র মতো বেশ কিছু অসাধারণ চলচ্চিত্র।
জন্ম ও শৈশব
১৯৪৮ সালের ৬ অক্টোবর পুরান ঢাকার আগানবাব দেউড়িতে আনোয়ার হোসেনের জন্ম। বর্তমানে যেখানে তাজমহল সিনেমা হল, ঠিক তার পেছনে। বেড়ার সব ঘর, তার মধ্য দিয়ে চলে গেছে সরু গলি। এতটাই সরু যে, দুজন লোক একসঙ্গে সাইকেলে যেতে পারে না। এখানেই কেটেছে আনোয়ার হোসেনের শৈশব।
বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না কিন্তু লেখাপড়ায় আনোয়ার হোসেনের আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৪টায় উঠে পড়তে বসতেন। পড়া যখন সব তৈরি, ততক্ষণে সকাল হয়ে যেত। পাড়ার বাকি ছেলেরা আসত। হাফপ্যান্ট পরা, খালি গা-খালি পা। ওদের সঙ্গে একটা করে বস্তা নিয়ে চলে যেতেন হাটে। ওখানে কাঠ চেরা হতো, সেই কাঠের ছোট টুকরো জড়ো করে বস্তায় ভরতেন। বস্তা প্রতি দাম ছিল আট-ন আনা। এ পরিমাণ রান্নার কাঠ কিনতে গেলে ৩-৪ টাকা পড়ত। সেখান থেকে ফিরে বাজার করে দিয়ে যেতে হতো স্কুলে।
স্কুলে গিয়ে তাঁকে পড়তে হতো বিচিত্র পরিস্থিতিতে। যদিও বরাবর ফার্স্ট হতেন কিন্তু ক্লাসে রোল কলের সময় প্রায়ই তাঁর নাম ডাকা হতো না, কারণ বিভিন্ন স্কলারশিপ থেকে টাকা পেলেও সময়মতো মাসিক বেতন পরিশোধ করতে পারতেন না।
স্কুল জীবনে তাকে বেশ কয়েকবার বিব্রতকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘একবার হলো কি, আমাদের আরমানিটোলা স্কুলে নিয়ম করা হলো, অ্যাসেম্বলিতে সবাইকে সাদা কাপড় পরতে হবে। আমার তো সাদা কাপড় নেই। সাদা কাপড়ের পোশাক ম্যানেজ করাও সম্ভব না। শেষে বাবা এসে হেডস্যারকে বলে কয়ে আমার জন্য সেই নিয়ম শিথিল করালেন। এরকম আরো দু একজন ছিল। কিন্তু আমার নিজেরই খারাপ লাগত। সবার মধ্যে আমরা তিন-চারজন আলাদা, স্কুলড্রেসবিহীন।’
স্কুল থেকে ফিরে তিনি বাড়ির টুকটাক কাজ করতেন। এরপর সন্ধ্যা হলে পাড়ার বন্ধু সেলিম, দীন ইসলাম, পাশা সবাই মিলে উঠোনে একটা চৌকিতে গোল হয়ে বসে যেতেন লেখাপড়ায়। তাতে করে এক হারিকেনেই সবার কাজ চলত।
‘আমাদের এই পড়তে বসা নিয়ে মজার একটা ঘটনা আছে’। দুঃখের স্মৃতিচারণ করতে করতেই আনন্দ ঝিলিক দিয়ে ওঠে আনোয়ার হোসেনের চোখে। ‘স্কুলে কী একটা বিষয় নিয়ে রচনা লিখতে বলা হয়েছিল। তখন আমি আমাদের পড়তে বসার একটা বর্ণনা লিখেছিলাম, তাতে আমাদের কুয়োর মতো গোল হয়ে বসা, ওপরে একটা অন্ধকার, তার পরেও ওপরে আকাশ দেখা যাচ্ছে, পাশে একটা ডালিম গাছ, ওপর দিয়ে মেঘ যাচ্ছে, বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কত শিশুর সাধ-কল্পনা- এরকম একটা কিছু লিখেছিলাম আর কি? লেখাটা পড়ে আমাদের এক শিক্ষক খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘আমি অনেক রচনা পড়েছি কিন্তু এত সুন্দর রচনা কখনো পাইনি।’ মেধাবী ছাত্রের প্রতিভাকে যথাযথই উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। এটাই হয়েতো আনোয়ার হোসেনের সৃজনশীলতার প্রথম প্রকাশ এবং প্রথম সংবর্ধনা।
চলচ্চিত্রের রঙিন ভুবন এবং
বাবার সিনেমা অফিসের চাকরির সুবাদে দুটো সুবিধা পেতেন আনোয়ার হোসেন। প্রথমটি সিনেমা দেখার সুবিধা। আশপাশের তাজমহল, শাবিস্তানসহ কয়েকটি সিনেমা হলে নিয়ে গিয়ে বাবা সেখানকার গেটকিপারদের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘আমার ছেলেটা ইংরেজিতে ভালো, কাজেই ইংরেজি ছবি এলে ওকে একটু দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েন।’ সেই মতো সবগুলো ছবি দেখা হয়ে যেত। ‘কত যে ছবি দেখেছি তখন হিসেব নেই। ব্লু লেগুন (সাদা-কালো), ডিসিকা পরিচালিত সোফিয়া লরেনের একটি ছবি, রোমিও-জুলিয়েট, টারজান (সাদা-কালো)। বাংলা ও উর্দু ছবিও দেখা হয়েছে বেশ কিছু। ধারাপাত, সুতরাং, জাগো হুয়া সাবেরা… ।’ এইসব ছবি দেখতে দেখতেই অবচেতনে তৈরি হচ্ছিল আগামী দিনের এক আলোকচিত্রশিল্পীর সম্ভাবনা।
আরেকটা জিনিস পেতেন তিনি বিনে পয়সায়। সেটা হলো সিনেমার পোস্টার। তাদের ঘর ছিল বেড়ার। এসব পোস্টার দিয়ে ঘরের বেড়ার ফাঁক বন্ধ করা হতো যাতে করে ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকতে না পারে। কিছুটা আব্রুও রক্ষা হতো। এখনকার মোটা দাগের রং-চংয়ে অশ্লীল পোস্টার ছিল না ওগুলো। ছিল দৃষ্টিনন্দন, চিত্তহারী। পোস্টারের প্রায়োগিক দিক নয়, আনোয়ার হোসেনের নজর কেড়েছিল, বলা যায় তাঁর চিত্তকে আচ্ছন্ন করেছিল পোস্টারের ওইসব চমত্কার ছবি। ওসব দেখে দেখে আঁকার ভূতও মাথায় এসে ঢুকল তাঁর। ভেবেছিলেন চিত্রশিল্পী হবেন। ভর্তিও হয়েছিলেন শিশুকলা ভবনে। বেশ কিছুদিন চলেছিল ছবি আঁকা। পরপর দু’বার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন ছবি এঁকে। পুরস্কার পেলে বাসার সবাই খুশি হতো। ছবি আঁকার সরঞ্জাম কিনতে হতো না, শিশু কলা ভবন থেকেই পেতেন। তখন যে ছবিগুলো আঁকতেন সেগুলো ছিল নিতান্তই শিশুতোষ। একজন শিশুর পক্ষে যা আঁকা সম্ভব আর কি। ছোটবেলার ছবি আঁকার বিষয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে হেসে ফেললেন তিনি। হাসতে হাসতেই বললেন ‘বাংলাদেশের মাঠ-ঘাট-প্রকৃতি আর ওপরে সুপারম্যান উড়ে যাচ্ছে বা টারজান এসে হাজির হচ্ছে..এইসব ছিল আমার ছবির বিষয়বস্তু। এই নিয়ে শিক্ষকরা বেশ হাসাহাসি করতেন। আমার কাছে তখন কিন্তু বাংলার আকাশে টারজান বা সুপারম্যানকে অসম্ভব বা অদ্ভূত লাগেনি। বরং এরকমটা ভাবতে ভালই লাগত।’
অনুপ্রেরণা উত্সাহের অভাবেই হয়তো সে পথে আর বেশি দূর এগোনো হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশের দরিদ্র ঘরের এক ছাত্রের পক্ষে চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করা অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার। ষাটের দশক তো! বাসার সবার ইচ্ছা ভালো করে পড়াশুনাটা করা। তাই সেটাই করতে লাগলেন তিনি। লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো ছিলেন। এসএসসির রেজাল্টও ভালোই হলো। পাস করলেন ফিফথ স্ট্যান্ড করে। ভর্তি হলেন নটরডেম কলেজে।
ছবি তোলার শুরু
পাঠ্য বই পড়তেন নিয়মিত। কিন্তু পেইন্টিংয়ের বইগুলো পীড়া দিত। ভ্যানগগ, পিকাসো, রবী ঠাকুরের কাটাকুটি ইত্যাদি। তুলি, রঙ-এর জন্য শূন্য হাতটা নিসপিস করতো। কলেজে উঠে স্কলারশিপের টাকা দিয়ে ৩০ টাকায় এক বন্ধুর কাছ থেকে কিনে ফেলেন ‘আগফা ক্লাক’, একটা ক্যামেরা। শুরু হলো ছবি তোলার পালা। ছবি আঁকার অপূর্ণ ইচ্ছাই যেন ক্যামেরায় ছবি তোলার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেতে লাগল।
এর মধ্যে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ভর্তি হয়েছেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে। থার্ড ইয়ার পর্যন্ত ক্লাসে প্রথম হয়েছেন। কিন্তু ছবি তোলার নেশাটা যতো চালিয়ে যেতে থাকলেন, লেখাপড়ায় ততোই ভাটা পড়ল। ‘শুধু ছবি তোলার জন্য ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে সাইকেল নিয়ে চলে যেতেন বুড়িগঙ্গার ওপারে।’ কিন্তু পরিবার, আত্মীয়স্বজন সবার কাছ থেকে চাপ পড়াশুনাটা ভালো করে করতে হবে। তাদের চাওয়া নিশ্চিত একটা জীবন।
নিশ্চিন্ত একটা জীবন নাকি ভালোবাসা, এমনি এক দোদুল্যমান অবস্থায় প্রকৃত শিল্পী যেটা করেন, আনোয়ার হোসেনও তাই করলেন। ১৯৭৪-এ স্কলারশিপ নিয়ে আচমকাই সিনেমাটোগ্রাফির ওপর ডিপ্লোমা করতে চলে গেলেন ভারতের পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। পড়ে রইল আর্কিটেক্টের নিশ্চিন্ত জীবন, কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে পা বাড়ালেন অনিশ্চিত রোমাঞ্চকর এক জীবনে।
পুনার স্মৃতি
আনোয়ার হোসেনর জীবনে পুনা এক অসাধারণ অধ্যায়। ছোটবেলা পুরান ঢাকায় তাঁর জীবনটা ছিল : একসঙ্গে কাজ করা, লেখাপড়া, খেলাধুলা, হঠাত্ কাছের কোনো গ্রামে চলে যাওয়া কিংবা কাউবয় কোনো ছবি দেখে সবাই দল বেঁধে আগানবাব দেউড়ি থেকে ঘোড়ার মতো করে দৌড়াতে দৌড়াতে ননস্টপ চলে এসেছেন রমনা পার্ক, মাঝে মাঝে কার্জন হলের কাঠবিড়ালির সঙ্গে কথা বলে আবার ফিরে গেছেন। এত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও সবাই মিলে যে আনন্দ, এই আনন্দময় সময় আবার খুঁজে পেয়েছিলেন পুনাতে গিয়ে। যেন পুরান ঢাকারই একটা সেলুলয়েড রূপ।
আর একটা বিষয় ছিল। সেটা হলো শিক্ষকদের অফুরন্ত ভালোবাসা। দেশে যেমন সব জায়গায়, সব শিক্ষকের ভালোবাসা পেয়েছেন; পুনাতে গিয়েও ঠিক তেমনি প্রতিটি শিক্ষক তাঁকে ভালোবাসতেন। বিশেষ করে অধ্যক্ষ তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। অন্যদের চেয়ে একটু অগ্রসর ছিলেন, সে জন্যই হয়তো নজর কেড়েছিলেন সবার।
কুরাসাওয়ার সঙ্গে কিছুক্ষণ
প্রায় প্রতি মাসে একজন করে বিখ্যাত লোক আসতেন পুনায়, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হতো ইনস্টিটিউটের ছাত্রদের- এই অভিজ্ঞতাও ছিল বেশ মজার। একবার জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া এলেন ওখানে, তখন তাঁদের ডিন তাঁর সঙ্গে আনোয়ার হোসেনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এ বাংলাদেশ থেকে এসেছে, আমাদের একজন স্পেশাল ছাত্র। ও খুব ভালো ছবি তোলে, আমি অনুমতি দিয়েছি, এখন যদি আপনি একটু অনুমতি দেন তাহলে আজকের দিনটা আপনার সঙ্গে থেকে কিছু ছবি তুলবে।’
কুরোসাওয়া অনুমতি দিলেন। তাঁর ছবি তুলতে তুলতে একটা বিষয় নিয়ে খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন আনোয়ার হোসেন। সেটা হলো কুরোসাওয়ার চোখের চশমা। বাইরে তো বটেই, এমনকি প্রিন্সিপালের রুমে যখন আলাপ করছিলেন তখনও ওনার চোখে আঁটা ছিল কালো কুচকুচে ওই চশমা। মুহুর্তের জন্যও খুলছেন না। যেন ওটা তাঁর শরীরেরই একটা অংশ। আনোয়ার হোসেন এক পর্যায়ে তাঁকে বলেই ফেললেন, ‘এটা কেমন কথা, আপনি আপনার চোখ দিয়ে মানুষের হৃদয় দেখেন, ছবি বানান, অথচ নিজে চোখে সারাক্ষণ চশমা পরে থাকেন। এটা একটা খারাপ বিষয়। আপনি যদি চশমাটা খুলতেন, এটা আমি আমার ছবির জন্য চাচ্ছি, কারণ চোখ তো কথা বলে, চলচ্চিত্রে আপনার ক্লোজ-আপগুলোও কথা বলে…’ একটু মুচকি হেসে কুরোসাওয়া তাঁর দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর প্রিন্সিপালকে বললেন, ‘এই ছেলেটা তো বেশ, চলচ্চিত্র আর ভিজ্যুয়াল মাধ্যমটা বেশ ভালো বুঝেছে।’ তখন প্রিন্সিপাল বললেন, ‘এই জন্যই তো শুধু তাঁকেই আমরা আপনার সঙ্গে থেকে ছবি তোলার সুযোগ দিয়েছি।’ যাহোক, কুরোসাওয়া শেষ পর্যন্ত চশমা খুললেন না। বললেন, ‘আমারও তো কন্ডিশন থাকতে পারে বাছা। আমার একটা কারণ আছে যার জন্য আমি চশমা খুলব না। তুমি তোমার হৃদয় দিয়েই দেখ?। উনি চশমা না খুললেও ওনার সঙ্গ ছিল আনেয়ার হোসেনের জন্য এক অন্য রকম পাওয়া। আনোয়ার হোসেনের মতে, “সে সময়টা ছিল আমার জীবনের স্বর্ণযুগ। ওখানকার প্রতিটি দিন আমার কাছে স্বপ্নময় একেকটা দিন।”
সূর্যদীঘল বাড়ি এবং
ডিপ্লোমা শেষ করে পুনা থেকে দেশে ফিরে এলেন। কাজ শুরু করলেন মসিউদ্দিন শাকেরের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ আর বাদল রহমানের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ দিয়ে। পকেট তখন গড়ের মাঠ। সাত মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। ছোট ভাই আলী হোসেন বাবুর এস.এস.সি. পরীক্ষার ফি দিতে পারেননি বলে ওর আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। কিন্তু এতোসব কিছুর মাঝেও তাঁর ধ্যান তখন একটাই, ছবি দুটোর কাজ শেষ করতে হবে। চলচ্চিত্রকর্মের প্রথম দিককার কথা স্মরণ করে বললেন, ‘কাজ তো নয় যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র।’ সেই সব দিনের কথা ভাবতে এখনো গা শিউরে ওঠে তাঁর। এফডিসির ভেতরেই তখন নানারকম যন্ত্রণা।
আনোয়ার হোসেন স্মৃতিচারণ করেন, ‘আমাদের টিম যখন এফডিসিতে ঢুকত তখনই নানারকম টিটকারি শুরু হয়ে যেত; আমার মতো শাকের ভাইয়েরও দাড়ি ছিল, সেটা নিয়ে ওরা রঙ্গ করত, ওই যে দেখ, সূর্য দীঘল দাড়ি যায়। ছবির প্রয়োজনে তালগাছ কেটে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেজন্য ওরা শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে জোরে ‘ত’-এর জায়গায় ‘ব’ দিয়ে বলত ওই যে ‘…ল গাছ যায়’। এ রকম কত যে অপমান!’
প্রায় সময়ই সবচেয়ে বাজে ক্যামেরাটা জুটত তাদের ভাগ্যে। ‘মুস্তাফা মনোয়ার, খালেদ সালাহউদ্দিন যখন ছিলেন সেই সময় ভালো ক্যামেরা পেয়েছি। যে কারণে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ এবং ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীর’ অল্প কিছু কাজ ভালো ক্যামেরায় করা সম্ভব হয়েছে। বাকি কাজগুলো হয়েছে সবচেয়ে বাজে ক্যামেরায়। যে কেউ একটু খেয়াল করে দেখলেই সেটা বুঝতে পারবে।’
টেকনিক্যাল আরো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁদের। আনোয়ার হোসেনের ভাষায়, ‘সেদিন ছিল বেশ বৃষ্টি, ১৭টা ছবির সিডিউল ক্যানসেল হয়ে গেছে এবং আমাদের ভাগ্যে সেই অষ্টাদশী খারাপ ক্যামেরা। বর্ষার একটা দৃশ্য ছিল, আমরা সেই দৃশ্যটা ধারণ করব বলে বেরিয়েছি। দেখা গেল সবাই হইচই করে উঠছে, ব্যঙ্গ করছে।’ সবচেয়ে বড় বাধাটা পেলেন বার হাজার ফিট শুটিংয়ের পর ডেভলপ করতে গিয়ে। ‘সেদিন যদি খালেক সালাহউদ্দিন ভাই না থাকতেন তাহলে হয়তো সূর্য দীঘল বাড়ী আর আলোর মুখ দেখত না। পুরো ফিল্ম প্রায় ব্লাঙ্ক আসত।’ কারণ সেসময় মেশিনে গণ্ডগোল ছিল, কেমিক্যালে গণ্ডগোল ছিল। তবে তাদের উদ্ধার করেছিলেন ল্যাব চিফ খোকা ভাই।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সালাহউদ্দিন ভাই, খোকা ভাই মিলে পরামর্শ করে ল্যাব বন্ধ করে দেওয়া হলো। বলা হলো ল্যাব নষ্ট হয়ে গেছে। ১৫ দিন আমরা বন্ধ ঘরে সব ঠিকঠাক করে ল্যাব চালু করি। তারপর ডেভলপ করা হয়। অসাধারণ ইমেজ!’ যদি সেদিন তিনি চলে আসতেন, সাধারণত যেটা করা হয়; তাহলে পুরো ছবি ব্লাঙ্ক হতো। সেই সঙ্গে সূর্য দীঘল বাড়ীরও মৃত্যু হতো।
স্বেচ্ছা নির্বাসন
আনোয়ার হোসেনের মতে, “এই অঙ্গণে কাজ করতে এসে প্রথম দিন থেকে যে বাধা, সেই বাধার আজও শেষ হয়নি। ভাল কাজ করতে গেলেই বিভিন্ন সময় সেই বাধা নানামুখী হয়ে এসেছে।” এদেশের নানা প্রতিষ্ঠানে অরাজকতা এবং শিল্পীর অপমান তাঁকে ক্ষুদ্ধ করে নিয়তই। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৩ সালে অভিমান করে দেশ ছেড়ে চলেই যান। বসবাস শুরু করেন প্যারিসে। এ তাঁর এক ধরণের ‘স্বেচ্ছানির্বাসন’। কারণ হিসেবে সংক্ষেপে বেশ শীতল স্বরে বললেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্রে অনেকেই আছেন যারা চলচ্চিত্র তো বটেই অনেকে দেশও নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁদের জন্যই আমি আজ ফ্রান্সে এবং এই দেশের নাগরিক।’
দেশ ত্যাগের কারণ বিস্তারিতভাবে না বললেও তাঁর কয়েকটি আফসোসের কথা জানা গেল, “আমার প্রকাশিত চারটা বই থেকে পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে সবাই যার যেমন খুশি তেমন করে ব্যবহার করছে কিন্তু নিচে আমার নামটা লিখে সামান্য সৌজন্য দেখানোর প্রয়োজনও কেউ বোধ করে না। এবারের ১৬ ডিসেম্বরেও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সরকার যে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করলেন সেখানেও আমার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু নাম দেয়া হয়নি। সম্মানীও দেয়া হয় না কখনো। … আমি ‘অন্য জীবন’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক মনোনীত হলে সেই পুরস্কার আমি প্রত্যাখ্যান করি এবং কেন প্রত্যাখ্যান করলাম তা ই-মেইল করে এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটা দৈনিকে লিখিত বার্তা পাঠাই কিন্তু কেউ সেটা ছাপেনি। …এবারও দেখলাম ‘লালসালু’-এর চিত্রগ্রাহক হিসেবে যে পুরস্কার পাই সেটা আমার অজান্তেই এফডিসিরই একজন গ্রহণ করেছেন। যদিও সে পুরস্কারের খবর সরকারিভাবে আমার কাছে এখনো পৌঁছায়নি।” পুরস্কার-সম্মাননা ইত্যাদির প্রতি কোনোকালেই তাঁর আগ্রহ ছিলনা। তবে তাঁর পুত্র সন্তানের আগ্রহে এ যাবত্ পাওয়া পুরস্কারগুলো সংগ্রহে উদ্যোগী হয়েছেন।
তিনি যখন যাযাবর
একের পর এক দৃশ্য সাজান যিনি নিপুণ হাতে, সেই আনোয়ার হোসেনের ব্যক্তিজীবন কিন্তু মোটেও সাজানো-গোছানো ছবির মতো নয়। সেখানে রয়েছে নানা উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনা, মান-অভিমানের এক মহা-উপাখ্যান। সূর্য দীঘল বাড়ি করার সময় পরিচয় হয় অভিনেত্রী ডলি আনোয়ারের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেম, ১৯৭৯ সালে বিয়ে। এরপর বহু সময় কেটে গেছে, পরিবর্তন এসেছে অনেক কিছুরই। ‘৯১-এর জুলাইয়ে মারা গেছেন স্ত্রী ডলি আনোয়ার।৷ এরপর বছর পাঁচেক পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড। অবশেষে ১৯৯৬ সালে আবার বিয়ে। স্ত্রী মরিয়াম ফরাসি, ফ্রান্সেই থাকেন। বর্তমানে বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স দু দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন এক যাযাবর জীবন। তাঁর ভাষায়, “আমার সংসার আছে কিন্তু ঘর নেই।” এক ধরনের অভিমান থেকেই ১৯৯৩ থেকে অবস্থান করছেন প্যারিসে। সেখানে স্ত্রী ও দুই ছেলে আকাশ ও মেঘদূত রয়েছে। কিন্তু তারপরও কাজের অজুহাতে বারবার ফিরে আসেন এই দেশে।
এখনকার যে ঢাকা শহর তা তাঁকে টানে না মোটেই। বরং ঢাকার বাইরের যে বিশাল বাংলাদেশ সেটাই এখন তাঁর মূল আকর্ষণ। সেখানেই খুঁজে পান জন্মভূমি বাংলাদেশকে। ‘ফ্রান্সে আমার ছোট দুটো বাচ্চা আছে, স্ত্রী আছে তাদেরকে ছেড়ে সুযোগ পেলেই ছুটে আসি এখানে। ফেরার সময় খালি হাতেই ফিরতে হয়। কারণ যে টাকা পাই তা প্লেনের টিকিট কাটতে আর এখানে থাকতেই চলে যায়।’ তাতেও তাঁর আফসোস নেই। কিন্তু ঝামেলা বাধে তবু। অনেক সময় যে সিডিউল নিয়ে আসেন নানা বাধার কারণে কাজ সেভাবে এগোয় না। ফলে তাঁকে নানা ঝামেলায় পড়তে হয়। তবুও দেশের টানে বার বার ছুটে আসেন তিনি।
বাচ্চাদের জন্য খুব চিন্তা করেন আনোয়ার হোসেন কিন্তু কিছু করতে পারেন না বলে আফসোস করেন। তিনি বলেন, ‘তাদের বয়স যখন আঠারো হবে তখন হয়ত আমি বেঁচে থাকবো না। কিন্তু তারা আমার সিলকৃত ইনভেলাপ পাবে। তাতে অন্যান্য রোজনামচার মধ্যে থাকবে এই লেখাটির ফরাসি অনুবাদ এবং একটি কথা- তাদের বাবার মাতৃভূমি বাংলাদেশ।’
পুরস্কার
ক্যামেরা কেনার পর প্রথম দিনের প্রথম রিলের শেষ ছবির বিষয় ছিল ‘ধোপা কাপড় ধুচ্ছে’। ১৯৬৯ সালে এই ছবিটাই গোলাম কাশেম ড্যাডির ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব আয়োজিত প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় পুরস্কার পায়। তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানের আশাহি পেন্টিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে। চতুর্থ পুরস্কার পেয়েছিলেন সেবার। সেই মেডেল এবং সার্টিফিকেট করাচিতে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়েছিল।
তবে যে আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্তির কথা নানা কারণে এখনো তাঁর মনে দাগ কেটে আছে সেটি ‘৭৮ সালের ঘটনা। সেবার কানাডায় কমনওলেথ আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় ৯টির মধ্যে ৬টি মেডেলই জয় করে নেন তিনি। বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ইউসুফ কার্শ। এই অসাধারণ সাফল্যের সুবাদেই পরের বছর সাইপ্রাসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় একক বিচারক হিসেবে তাঁকে মনোনীত করা হয়। মাত্র ৩২ বছর বয়সে এমন মর্যাদা এর আগে অন্য কেউ পাননি।
তবে যে পুরস্কারটি তাঁর মনকে ভরিয়ে দিয়েছিল কানায় কানায় সেটি তার সেই আগানবাব দেউড়ির ছোটবেলার বন্ধুদের দেওয়া।৷ নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এক ঘরোয়া সংবর্ধনায় তারা তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন একটা সিলভার প্লেটের প্লাক। শৈশবের বন্ধুদের সেই উপহার তিনি অন্তরের মণিকোঠায় তুলে রেখেছেন।
প্রিয় আলোকচিত্রী
দেশে তাঁর প্রিয় আলোকচিত্রী আমানুল হক, নাঈবউদ্দিন আহমেদ ও হাসান সাইফুদ্দিন চন্দন। ভারতে রঘু রায় ও সুনীল জানা। ফ্রান্সের অঁরি কার্টিয়ের ব্রেসোঁ, ব্রাজিলের সেবাস্তিয়া সালগাদো। তবে সবার ওপরে তিনি শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রেখেছেন যে আলোকচিত্রশিল্পীকে তিনি আমেরিকার ইউজিন স্মিথ।
সূত্র: প্রথম আলো, ২০ ডিসেম্বর ২০০৩