মানুষের চোখের তারায় হরহামেশাই বন্দি হয় নানান রকম দৃশ্য। আবার তা মুছেও যায়। তবে এমন কিছু দৃশ্য বা প্রিয় মানুষের মুখ আছে যা ব্যক্তির হৃদয়কে আলোড়িত করে। আর তা হয়তবা আজীবন চিরসজীব হয়ে থাকে ব্যক্তির স্মৃতিপটে। তবে মনের ফ্রেমে আঁকা ছবি একান্তই নিজের। অন্য কারো সাথে এই ছবির সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, কষ্ট, ঘৃণা, ভালবাসা, আবেগ অনুভূতি ভাগ করা যায়না। কারণ সে ছবি কাউকে দেখানো যায় না। একারণেই কোন বস্তু বা ঘটনার সত্যতা, বাস্তবতাকে যুগের পর যুগ ধরে রাখতে, একটি ছবির আবেদন ব্যক্তি পরম্পরায় চিরন্তন করে রাখার চিন্তা থেকেই হয়ত ক্যামেরার উদ্ভব। ছবি যেমন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সংরক্ষণ করে তেমনি মানুষের আবেগ অনুভূতিও জাগ্রত করে। এমন কি মানুষের চিন্তা চেতনা, বোধবুদ্ধিকেও পাল্টে দিতে পারে। তবে এমন কোন বস্তু, ঘটনা বা কাহিনী যা ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বা মানবীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এমন ছবি ক্যামেরায় ধারণ করার জন্য চাই অনুসন্ধ্যিত্সু, সৌন্দর্যপিপাসু ও সৃজনশীল চোখ। এমনই এক অনুভূতিশীল শিল্পী মনের অধিকারী রশীদ তালুকদার। ক্যামেরার ফ্রেমে তিনি বন্দি করেছেন অনেক ইতিহাস, বাস্তবতা, মানবতা। ছবি দিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন অনেক সত্যকে। তাঁর ছবি বলেছে অনেক নির্যাতিতদের অব্যক্ত কথা। ক্যামেরার পেছনে থেকে যে মানুষটি দিনের পর দিন জাতির জন্য মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন নিরবধি তাঁর জীবন ঘিরেও রয়েছে নানান ঘটনার বৈচিত্র।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
১৯৩৯ সাল। ভারতের বজ বজ চব্বিশ পরগনায় সবেমাত্র শীতের শুষ্ক হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এমনই একদিন ২৪ অক্টোবর আব্দুল করিম তালুকদার ও রহিমা খাতুনের সূর্য সন্তান রশীদ তালুকদার জন্মগ্রহণ করেন। চাকুরীর কারণে স্টেশন মাস্টার বড় বাবু আব্দুল করিম তালুকদারের ছিল অনেকটা যাযাবর জীবন। তাই তাঁর পিতৃলয় মাদারীপুর হওয়া সত্ত্বেও রশীদ তালুকদারসহ তাঁর প্রতিটা সন্তানই ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন।
কাঞ্চনজংঘা পাহাড়ের চূড়ায় যখন সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে তখন চূড়াটাকে মনে হয় যেন এক টুকরো স্বর্ণখন্ড। বাবা আব্দুল করিমের মনে হয়েছিল তাঁর ছেলেও সূর্যের আলোয় এমনই সোনার টুকরো হয়ে উঠবে। তাই তাঁর বাবা তাঁকে কাঞ্চন বলে ডাকতেন। চার ভাই চার বোনের মধ্যে কাঞ্চন ছিল বড় ছেলে। তবে সবার বড় ছিল তাদের প্রিয় বোন মন্টু, যাকে তাঁরা দিদি বলে ডাকতেন।
তালুকদার বংশের ছেলে হওয়ায় খুব ছোটবেলায়, যখন তিনি ভাল করে কোন কিছু বুঝতেই শেখেননি, তখন তিনি একবার প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা তুলেছিলেন। যদিও সেই খাজনা তোলার আয়োজনে তিনি ছিলেন একটা শোপিস্ মাত্র। মাদারীপুর জেলার কালকীনি থানা, এরই একটা ছোট্ট গ্রাম দক্ষিণ রমজানপুর, তাঁর দাদার বাড়ি। বংশের ছেলে হিসেবে তিনি এখানেই খাজনা গ্রহণ করেছিলেন।
চার ভাই চার বোনের মধ্যে রশীদ তালুকদার ছিলেন সবার অত্যন্ত আদরের। তবে তিনি মনে করেন, তিনি বৃশ্চিক রাশির জাতক হওয়ায় তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের জেদি ও একরোখা ছেলে।
প্রথম স্কুলে যাওয়া
যশোরের ঝিকর গাছায় তাঁরা বছর খানেক ছিলেন। সেখানে ‘এম ই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ তিনি ভর্তি হন। রেললাইনের নিচ দিয়ে মাইলখানেক দূরে ছিল স্কুল। এখানে ছিল মাটির একটি ঘরর এই ঘরের চারপাশ ঘিরে ছিল অসংখ্য কলা গাছ। এই ঘরটাই ছিল এম ই স্কুল, শিশু রশীদ তালুকদারের প্রথম স্কুল। প্রাথমিক স্তরের সবগুলো ক্লাস এই একটি কক্ষেই হত। তিনি ছিলেন প্রধান শিক্ষকের অত্যন্ত প্রিয় ও স্নেহের পাত্র। তিনি প্রধান শিক্ষকের কাঁধে চড়ে স্কুলে যেতেন। কলার ছড়ায় যখন পাক আসত তখন তিনি তা স্কুলের আলমারীর সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতেন। সম্পূর্ণ পেকে গেলে সবাইকে খেতে দিতেন। প্রধান শিক্ষক ভীষণ রকম স্নেহপরায়ণ ছিলেন।
যশোরে এক বছর থাকার পর ১৯৪৫ সালে তাঁর বাবা বদলী হন গদখালী স্টেশনে। সেখানে তিনি টাওয়ার এম ই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি ঐ স্কুলেই পড়ালেখা করেন।
এরপর আবার বদলী হওয়ার পালা। তাঁর বাবা খুলনা দৌলতপুর স্টেশনে বদলী হয়ে আসেন। এখানে মহসীন উচ্চ বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন।
এভাবেই তাঁর পড়ালেখার প্রথম স্তর নানান বৈচিত্রময় ও বিচিত্র পরিবেশের ভেতর দিয়ে শেষ হয় এবং শুরু হয় তাঁর বেড়ে ওঠা।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়
বাবা স্টেশন মাস্টার হওয়ায় তাঁদের ছিল যাযাবর জীবন। বিভিন্ন জায়গায় বাসস্থান স্থানান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে তাঁদের স্কুলও পরিবর্তিত হত। ১৯৫২ সাল, রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া ১৩ বছরের এক দূরন্ত কিশোর রশীদ তালুকদার। সময়টা ভীষণ রকম বেয়াড়া আর ছটফটে। মনের পিঠে যেন পাখনা লাগানো, মনটাকে পোষ মানানো যায় না কোনমতেই। এবড়ো থেবড়ো রাস্তা, হেঁটেহেঁটে স্কুলে যাওয়া, দৌড়াদৌড়ি, দুষ্টুমি, বাঁদরামি সবই ভালো লাগে। শুধু স্কুলের বই’র পাতায় মন বাঁধা যায় না। এমনই করে দূরন্ত কৈশোরের সাথে ছুটে বেড়ায় মন। আর এভাবেই কেটে যাচ্ছিল সময়।
পড়ালেখায় জলাঞ্জলি ভেবে মূর্খ বোলো না
রাজশাহী শিউলের মাঝখান দিয়ে সাহেব বাজার হয়ে স্কুলে যেতে হত। স্কুলে যাওয়ার পথে আলুপট্টির এক পাশে ছিল কল্পনা সিনেমা হল। এর উল্টো দিকে ছিল তারাপদ’র বিখ্যাত চায়ের দোকান। ভাঙ্গা কিন্তু পাকা দোকান। এই দোকানের চিলেকোঠায় মরহুম মোতাহার হোসেন তার স্টার স্টুডিও গড়ে তুলেছিলেন। সেই সময়ে হিটার ছিল না, স্টুডিওতে কাচের সাথে ছোট ছোট ফটো লাগিয়ে রোদের মধ্যে শুকাতে দিত। এমনই একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে হঠাত্ ক্যামেরার সাটারের মত চোখের তারায় বন্দি হয়ে যায় সেই ছবিগুলো। কেমন করে একটা কাগজের উপর মানুষের প্রতিচিত্র হুবহু দৃশ্যায়িত হয় তা তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তাঁর উত্সুক মন ঝুঁকে পড়ে ফটোগ্রাফির দিকে। কৌতূহলী মনের তৃষ্ণা কেবল বেড়েই চলে। তাঁর খুব ইচ্ছা হয় ফটোগ্রাফী শেখার। কিন্তু তাঁর বাবা সেই সময়ে রাজি হন না। পিতাদের চিরন্তন চিন্তা থেকে তাঁর বাবার চিন্তাও ব্যতিক্রম ছিল না। ফটোগ্রাফী যে একটা আর্ট, একটা শিল্প তা ছিল সকলের অজানা। পড়ালেখাকেই তাঁর বাবা প্রাধান্য দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ মনে করত যারা বখাটে হয়ে যাওয়া, বেয়াড়া ছেলে তাঁরাই ফটোগ্রাফি শেখে। তাই আর দশটা বাবার মতই তাঁর বাবাও চেয়েছিলেন ছেলে পড়ালেখা শিখে মানুষের মত মানুষ হক।
প্রথম হাতেখড়ি
অবশেষে কিশোর কাঞ্চন (রশীদ তালুকদার ) তাঁর ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দিতে উদ্যোগী হয়। আলুপট্টির স্টার স্টুডিওর মালিক মোতাহার হোসেনের সাথে দেখা করেন। কিন্তু মোতাহার হোসেনকে রাজি করানোও সহজ ছিল না। প্রথম দিনেই তাঁর ওস্তাদ মোতাহার হোসেন তাঁকে বের করে দেন। যে ছেলের মুখের আদল জুড়ে শিশুতোষ ভাব ছড়িয়ে আছে তাঁকে কোন কাজ দিতে ওস্তাদের মন স্বীকৃতি দেয়নি। তাই তিনিও তাঁকে পড়ালেখায় মন দিতে বলেন। কিন্তু দুরন্ত সেই কিশোরও হাল ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। দিনের পর দিন সে তাঁর ওস্তাদের দারস্থ হতেই থাকল এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর মন নরম করতে সক্ষম হল। তবে তিনি শর্ত জুড়ে দেন, ‘যদি তুমি তোমার বাবাকে রাজি করাতে পার তাহলে এস’। কিন্তু বিষয়টি কিশোর কাঞ্চনের জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল। এক্ষেত্রেও সে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। প্রথমে মা’র মাধ্যমে বাবা কে রাজি করানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর সে অন্য উপায় খুঁজে বের করে। বড় বোন মন্টুর প্রতি বাবার হৃদয় ছিল বরাবরই আস্থাশীল। ভাইয়ের আবদার বোন ফেলতে পারে না। মন্টু আব্বার কাছে গিয়ে কাঞ্চনের ইচ্ছার কথা জানায় এবং শেষ পর্যন্ত তার বাবার মন গললো।
ইচ্ছা পূরণের আশায় এবার বালক কাঞ্চন নব উদ্যোমে আবার স্টার স্টুডিওতে যায়। ওস্তাদ মোতাহার হোসেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এরপরও ওস্তাদ তাঁকে ফিরিয়ে দেন, তার কথা বিশ্বাস করেন না ওস্তাদ। তখন তিনি সাক্ষ্য প্রমাণ হিসাবে বড় দিদিকে নিয়ে যান। বড় বোন মন্টু মোতাহার হোসেনকে জানান যে, বাবা কাঞ্চনকে কাজ শেখার অনুমতি দিয়েছেন। এবার তিনি কাজ শেখানোর প্রতিশ্রুতি দেন। তবে অবশ্যই লেখাপড়ার পাশাপাশি। এখান থেকেই প্রথম ফটোগ্রাফীতে তাঁর যাত্রা শুরু হয়।
শিক্ষানবীশ
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাস থেকে ভারতে আসা যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট প্রথা চালু হয়। এ কারণে ছবি তোলার প্রয়োজনীয়তা অনেক গুণ বেড়ে যায়। সংকট দেখা দেয় স্টুডিওর। এ সুযোগে প্রায় সবখানে নতুন নতুন স্টুডিও গড়ে ওঠে। কিন্তু অভাব রয়ে যায় কলাকুশলীর। শিক্ষিত লোকজনের এ পেশায় তেমন আগমন হয়নি। স্টুডিওর কাজ ছিল বাঁধাধরা নিয়মের। শিল্প সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে এর তেমন ব্যবহার তখন ছিল না। কলাকুশলী তৈরির ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠান নেই। ভরসা শুধু প্রবীণরা, তাঁদের কাছ থেকে অনুজরা হাতে কলমে ডার্করুম ও অন্যান্য কাজ শেখে। এ অবস্থায় ডার্করুমে-যে কাজ করছে সে আর অন্য কোন কাজ তেমন শেখেনি বা শেখানো হয়নি। একজন ডার্করুম কর্মীর কাছে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার পর্যায়ে উন্নীত হতে অনেক বছর সময় লেগে যেত।
স্টার স্টুডিও’র বিপরীত দিকে ছিল দৈনিক বার্তা নামে একটি সংবাদপত্রের অফিস। দৈনিক বার্তার পাশেই ছিল একটি পানির ট্যাংকি, যেটাকে পানির ঢোপ কল বলা হত। শুরুতে তাঁকে ওস্তাদের নির্দেশমত বালতিতে করে পানি নিয়ে আসতে হত পানির ট্যাংকি থেকে। সেই পানির বালতি টেনে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠায় উঠতে হত। এভাবেই কেবল পানি টানতে টানতে দুই বছর কেটে যায়। ছবি ধোয়ার কাজে পানি লাগতো। তখন এত প্রযুক্তি ছিলনা। ছবি ধুয়ে শুকাতে হত।
স্কুলের পড়াশুনাও একেবারে ছেড়ে দেননি। ১৯৫৪ সাল, তিনি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। পড়ালেখায় যথেষ্ট ভাটা পড়ে গিয়েছে। পড়ালেখা ঝিমিয়ে পড়লেও, এ বছরই প্রথম তাঁর কাজের শুরু হয়। তিনি ডার্ক রুমে প্রবেশ করার অনুমতি পান। তাঁর ওস্তাদ তাঁকে বলেন, ‘রশীদ, তুমি কালকে থেকে ডার্ক রুমে যেও’। তবে কাজের প্রথম দিনটা মোটেই সুখকর ছিল না। প্রথম দিনেই তিনি একটি অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন। প্রথম দিকে তাঁর হাত ততটা চালু ছিলনা। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় কেমিক্যালসের ভেতর থাকায় ছবি কালো হয়ে যায়। রাগ দমন করতে না পেরে তাঁর ওস্তাদ তাঁর গালে থাপ্পর দেন। এতে বালক মন অনেক অভিমানী ও জেদী হয়ে উঠে। সেই সাথে কাজের প্রতিও তিনি যত্নশীল হয়ে উঠেন। এদিকে ওস্তাদের মনও তাঁর প্রতি সদয় হয়ে উঠে এবং তখন প্রথমবার তাঁর বেতন হিসেবে ২০ টাকা নির্ধারিত হয়।
ভালবাসার পান্না হিরা
১৯৫৪ সালের দিকে তাঁর বাবা বদলী হয়ে ময়মনসিংহে চলে যায়, সঙ্গে যায় তাঁর পরিবার। কিন্তু পরিবার থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়ে গেল স্টার স্টুডিওতে। ততদিনে স্টার স্টুডিও সাহেব বাজার বড় মসজিদের কাছাকাছি বেশ বড় একটা জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। যেখানে ডার্করুম ছিল তার উপর একটি কাঠের দোতালা মতন ছিল। সেখানে তাঁর ওস্তাদ ও তিনি একসাথে রাত্রি যাপন করতেন। কল্পনা সিনেমা হলের পাশের গলিতে ছিল ওস্তাদের বাড়ি। সেখানেই তিনি খেতেন। ভালবাসা আর মায়ার প্রগাঢ় বাঁধনে ওস্তাদ তাঁকে জড়িয়ে ফেলেন। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও গড়ে ওঠে নিবিড় আত্মার সম্পর্ক। তিনি স্টুডিওর কর্মচারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। সবাই তাঁকে মোতাহারের ছোট ভাই বলেই জানত এবং মোতাহারের ছোট ভাই বলত। কিন্তু এখান থেকে একদিন বাঁধন মুক্ত হয়ে এক অজানার উদ্দেশে রওনা হন।
শহর থেকে শহরে
‘আমি এক যাযাবর,
পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর’
ভুপেন হাজেরিকার এই গানের মতই তাঁর আপন পর বলে কিছু ছিল না। পথ থেকে পথে, শহর থেকে শহরে-সকল মানুষই ছিল তাঁর আত্মার আত্মীয়। রাজশাহী থেকে এক বুক ব্যথা নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন তিনি। সমুদ্রের বুকে এই ব্যথা বিলীন করে দিতেই হয়ত নিজের অজান্তেই, মনের টানে পৌঁছে গেলেন কঙ্বাজার। পাহাড় আর সাগরের মাঝখানে ছোট্ট সবুজ সজিব একটি গ্রাম কলাতলি। সেখানে জ্যাঠা নামে পরিচিত এক দুধ বিক্রেতার বাসায় তিনি থাকতেন এবং বিনিময়ে জ্যাঠার ছেলে কুদ্দুসকে পড়াতেন। তিনি আবার নতুন করে কঙ্বাজার হাইস্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। দেড় মাইল হেঁটে স্কুলে যেতে হত। কিন্তু স্কুলের প্রথম দিনেই ঘটে যায় এক অপ্রীতিকর ঘটনা। তাঁর পাশে বসেছিল এক বার্মিজ মেয়ে ডলি। অংকের সমাধান না হওয়ায় তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে খাতা ছুড়ে ফেলতে গিয়ে তাঁর হাতের ধাক্কা লাগে ওই মেয়েটির গায়ে। মেয়েটি শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করে তাঁর বিরুদ্ধে। শাস্তি হিসেবে তার জন্য ১০০ বেত নির্ধারিত হয়। বেতের আঘাতে জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর ফলাফল অবশ্য তাঁর জন্য শুভ হয়। এই ঘটনার পর ওই বার্মিজ পরিবার তার প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে উঠে। তাঁরা বুঝতে পারে ঘর ছাড়া এই ছেলের মন শরত্কালের আকাশের মতই স্বচ্ছ আর পরিষ্কার। এরপর তিনি যতদিন কঙ্বাজার ছিলেন ওই বার্মিজ পরিবার হয়েছিল তাঁর অনেক আপনজন, অনেক প্রিয়, অনেক কাছের।
১৯৫৪ সালে তিনি কঙ্বাজার হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন কিন্তু তিনি অকৃতকার্য হন। ঐ সময়ে তাঁর ইপিআর-এর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয় যিনি ‘ঠাকুর’ নামে পরিচিত ছিলেন। পাঞ্জাবিরা বলত ঠাকরা। ঠাকুরা তাঁকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তার বাসস্থান ছিল সিলেটে। ঠাকুরা তাঁকে সিলেটের বলদী গ্রামে নিয়ে যান। সেখানে তিনি আবার রাজা হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঐ স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন। শুধু অংকে পাশ মার্কস না থাকায় তিনি কম্পারমেন্টাল চান্স্ পান। এরপর শুধু অংক পরীক্ষা দিয়ে তিনি তৃতীয় বিভাগ নিয়ে মেট্রিক পাশ করেন।
গৃহের প্রতি টান
মেট্রিক পাশের পর সিলেটের জীবন তার কাছে একঘেয়ে হয়ে ওঠে। মা-বাবা, ভাই-বোন আর বাড়ির জন্য তাঁর মন ভীষণ উতলা হয়ে ওঠে। রক্তের আর ভালবাসার এক তীব্র টান তাঁকে ব্যাকুল করে তোলে। চেনা দুঃখ, চেনা সুখ মাখা পরিবারের হারানো মানুষগুলোকে ফিরে পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে উঠেন। সিলেট স্টেশনের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে তিনি তাঁর পরিবারের খোঁজ পান। তিনি জানতে পারেন তাঁর বাবা খুলনা স্টেশনে আছেন।
সিলেট থেকে পালিয়ে, কাউকে কিছু না বলে তিনি খুলনা রওনা হন। এরপর খুলনা পৌঁছে স্টেশন কোয়ার্টারের বাসায় বাসায় তিনি তাঁর পরিবারের খোঁজ করতে থাকেন। ভাগ্য তাঁর সহায় হয়। মেজো বোন দেলোয়ারা চাল খেতে পছন্দ করত। চাল খেয়ে থুতু বাইরে ফেললে, থুতু গিয়ে পড়ে ঠিক তারই গায়ে। জানালা দিয়ে মেজ বোনের চাল খাওয়ার ভঙ্গি দেখেই তিনি বুঝে ফেলেন, তার বহু প্রতিক্ষিত, কাঙ্খিত আপনজনদের তিনি পেয়ে গেছেন।
এরপর কেবল আপনজনদের সাথে ভালবাসাবাসি। কান্নাকাটি আর সুখ দুঃখের বিনিময়। বাড়ির সবাই এমন আচরণ করতে লাগল যেন তাঁদের হারিয়ে যাওয়া অতি মূল্যবান কোন ধন রত্ন তাঁরা ফিরে পেয়েছে। মায়ের দৃষ্টিশক্তি ছিল না। তাই তিনি ছেলের শরীর, হাত, পা হাতরে হাতরে দেখতেন সত্যি এটাই তাঁর আদরের কাঞ্চন কিনা। ছোটবেলায় চিড়িয়াখানায় বাঘের খাচার সামনে দাঁড়ালে বাঘ তার হাতে খামচা দিয়ে জখম করেছিল। তার মা নেড়েচেড়ে দেখতেন সেই দাগটা আছে কিনা। অন্য ভাইবোনদের ডেকে দেখাতেন, দেখতো ওর পায়ের তিল আছে কিনা। তাঁর মা যদিও বুঝতে পারে এটাই তার কাঞ্চন তবুও বার বার তার মুখ, চোখ ধরে ধরে দেখতো।
ছিঁড়ে যায় আশা
১৯৫৭ সালে তাঁর বাবা আবার বদলী হয়ে খুলনা থেকে রাজশাহী চলে আসেন। এ যেন আবার পেছনে ফেরা। আবার তিনি তার ওস্তাদ মোতাহার হোসেনের সাথে দেখা করেন এবং স্টার স্টুডিওতে চাকরী নেন।
১৯৫৭ সালে (সম্ভাব্য) তিনি আবার স্টার স্টুডিওতে কাজে মন দিয়েছেন। হঠাত্ একদিন তাঁর চোখ আটকে যায় একটি দৈনিক পত্রিকার একটি বিজ্ঞপ্তিতে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ফটোগ্রাফার নিয়োগের জন্য সার্কুলার দেয়া হয়েছে। কিন্তু ময়মনসিংহ যাওয়ার মত পর্যাপ্ত টাকা তাঁর হাতে সেই মুহূর্তে ছিল না। মনের ইচ্ছা বাবা-মাকে জানালেন তিনি। অবশেষে তাঁর পরীক্ষা দিতে যাওয়ার খরচ যোগাতে তাঁর মায়ের দুল বন্ধক রাখতে হয়। দুল বন্ধক রেখে ১৩০ টাকা যোগাড় হয়। এক বুক আশা আর এই সঞ্চয় নিয়ে তিনি রাজশাহী থেকে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হন। পরীক্ষা দেন। পরীক্ষায় তিনি প্রথম হন। কিন্তু নিয়োগ দেয়া হয় নায়েব উদ্দিন সাহেবকে। এমন স্বজন প্রীতি, সাজানো নাটকের সাথে তাঁর ভেঙ্গে যাওয়া আশা আর মায়ের দেয়া কষ্টের টাকা তাঁর হৃদয়টাকে ভেঙ্গে খান খান করে দেয়। তিনি ভয়কে তুচ্ছ করে বোর্ড মেম্বারদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ধিক্কার জানিয়ে আসে নোংরা কাজের দোসরদের।
পথেই মেলে ঠিকানা
ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন কিভাবে জোড়া দেয়া যায় তাই যখন তিনি ভাবছিলেন, তখন পরিচয় হয় আর্কিওলজির ফটোগ্রাফার মতিউর রহমান, ফিসারির ফটোগ্রাফার দীন মোহাম্মদের সাথে। এই দুজনও ছিল ওই দিনের চাকুরীর প্রার্থী। মতিউর রহমান থাকতেন ঢাকায় ঢাকেশ্বরীতে একটা ম্যাচে। মতিউর রহমানের সাথে কথা বলে তার ভাল লাগে এবং দু’জনের মতের মিল হয়। তাঁদের ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত হয় তিনি বন্ধু মতির ম্যাচে গিয়ে থাকবেন। এরপর তাঁরা ঢাকায় ফিরে আসেন ময়মনসিংহ থেকে। কিন্তু তিনি ৫/৭ দিন ম্যাচে থাকার পর তাঁর থাকা খাওয়া নিয়ে আর সবার মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। তাঁর মনটা আবার ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।
মনের পীড়ায় তিনি যখন ভাবছেন কি করবেন, তখন দৈবক্রমে দেখা পেলেন তাঁর এক বন্ধুর। ১৭ নং পুরানা পল্টনের রিজভি নামে তাঁর এই বন্ধু ছিলেন টেলিফোন ডিপার্টমেন্টের সুপারভাইজার। এছাড়াও পুরানা পল্টনে রিজভি ফটোগ্রাফারস নামে তাঁর একটা স্টুডিও ছিল। এখানে তিনি কাজ শুরু করেন। স্টুডিওতে একটু ফাঁকা জায়গা ছিল সেখানে তাঁর থাকার বন্দোবস্ত হয়। এভাবেই সময় বয়ে চলে কিন্তু বেতন বাড়ে না। কয়েক মাস কাজ করার পর তাঁর আর ভাল লাগে না।
বিয়েবন্ধন আর ভালবাসা
ইতিমধ্যে তিনি ২০ বছরের যুবক হয়ে উঠেছেন। বাবা-মায়ের মনে হল ছেলেকে বিয়ে দিতে হবে। বাবা আর মায়ের মন রক্ষা করতে এক চাচার সঙ্গে তিনি যান বরিশালের তক্কানামক গ্রামে মেয়ে দেখতে। মেয়ে দেখা শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে এক বাড়িতে পানি খেতে গিয়ে সেই বাড়ির এক মেয়ে হালিমা খাতুনকে ভাল লেগে যায়।
মামার বাড়িতে মানুষ হওয়া পিতৃহীন হালিমা তিন ভাই বোনের মধ্যে বড়। আশ্রিত ছিল বলেই হয়ত বেকার রশীদ তালুকদারের সাথে বিয়ে দিতে আপত্তি করেনি। যদিও হালিমা দেখতে ছিল তাঁর মায়ের মতই অপ্সরা। অবশেষে ১৪ বছরের কিশোরী হালিমার সাথেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায় পারিবারিক সম্মতিতে। বিয়ের আগে যে মেয়ের রূপ দেখেই কেবল তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেই মুগ্ধতা ভালবাসায়, আস্থায়, মায়ায় রূপ নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি। দায়িত্ব, কর্তব্য, ভালবাসা, মায়া, স্নেহ দিয়ে তার স্ত্রী হালিমা রশীদ তার পরিবারকে বেঁধে রেখেছেন। তাঁর বিয়ের প্রথম জীবনে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে অনেক কষ্ট করেছেন। টাকা পয়সা ছিল না, থাকার তেমন কোন ভাল জায়গা ছিল না। এর মধ্যেই তাঁর স্ত্রী তিল তিল করে তাঁদের বর্তমান বাসস্থান গড়ে তুলেছেন।
তাঁদের ভালবাসার ফসল তাদের সোনার টুকরো তিন ছেলেমেয়ে। তবে ছেলেমেয়েরা কেউ তাদের বাবার পেশায় আসেনি।
তাঁর স্ত্রী হালিমা রশীদ ২৩ মে, ২০০৮ সালে পরলোক গমন করেন। দীর্ঘ ৫৫ বছর সংসার জীবনে একসাথে থাকার পর তাঁর স্ত্রী হালিমা খাতুনের এই চলে যাওয়াটা তাঁকে শোক সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
কর্ম জীবনে প্রবেশ এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া
প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট (পিআইডি)’এর ডিরেক্টর আনোয়ার সাহেবের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। ১৯৫৯ সালে তিনি আনোয়ার সাহেবের সহযোগিতায় ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজে প্রবেশ করেন ৮০ টাকা বেতনে।
১৯৬০ সাল সংবাদ পত্রের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ বছরে সংবাদপত্রসেবীদের জন্য ওয়েজ বোর্ড গঠন করা হয় অর্থাত্ সাংবাদিকসহ অন্যান্যদের জন্য বেতন কাঠামো স্থির করা হয়। ফলে নিজস্ব ফটোগ্রাফার পদ তৈরি হয়। রিপোর্টার ফটোগ্রাফার উভয়কে একই পদমর্যাদা দেয়া হয়। ফলে বেতনও একই গ্রেডে। ফটোগ্রাফারদের যোগ্যতার মাপকাঠি ছিল ফটো তোলাসহ ফিল্ম ডেভেলপ বা এক কথায় ডার্করুমের সব কাজ জানা। ফটো তুলতে জানার মধ্যে প্রকারভেদ থাকা স্বাভাবিক। এ কারণে সংবাদচিত্র ধারণের জন্য যথেষ্ট কষ্ট, ত্যাগ ও প্রচুর সময় ব্যয় করে তাদেরকে কাজের মাধ্যমে শিখতে হয়েছে।
১৯৬২ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি প্রথম দৈনিক পত্রিকা সংবাদে ফটো জার্নালিস্ট হিসাবে কাজ শুরু করেন। তখন সংবাদের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ছিলেন শহিদুল্লাহ কায়সার। প্রথম দিনেই শহিদুল্লাহ কায়সার তাঁকে একজন আহত মানুষের ছবি তোলার অ্যাসাইনমেন্ট দেন। কিন্তু সেই সময় ছবি তোলা ছিল অত্যন্ত কঠিনতর একটি কাজ। মোজাম্মেল হোসেন নামে এক ভদ্রলোক আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন। মুসলিম লীগের হাতে তিনি প্রহৃত হন। ঢাকা মেডিকেল থেকে আহত মোজাম্মেল হোসেনের ছবি তুলতে হবে। সংবাদের অন্য একজন ফটোগ্রাফার আব্দুল মতিন তাঁর সাহয্যে এগিয়ে আসেন। আব্দুল মতিন তাঁকে বলেন,’তুমি এভাবে পারবে না, মেডিকেল কলেজের একটি ছাত্র সংগঠন আছে ওদের সাথে কথা বল।’ তখন তিনি মেডিকেল ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি রুহুল হকের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর সহায়তায় রশীদ তালুকদার গলায় টেথিস্কোপ, গায়ে ডাক্তারী এ্যাপ্রোন পরে মেডিকেলের ভেতর প্রবেশ করেন। তাঁকে আগে থেকেই বলে দেয়া হয় ওয়ার্ডে ঢুকে প্রথমেই যাকে চিকিত্সা দেয়া হবে সেই মূল ব্যক্তি। কিন্তু ঝক্কি দেখা দিল ছবি তোলার সময়। তখন নিয়ম ছিল ফিল্মের ১ম ও ১২তম নং ছবিকে বিশ্বাস করা যাবে না। ১ম ছবিটা ঠিকমত তুলতে পারেন, তবে ২য় ছবি তোলার সময় প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ধর ধর বলে সবাই চারপাশ থেকে চিত্কার শুরু করে দেয়। প্রাণ বাঁচানোর জন্য তিনি দৌড়াতে শুরু করেন। কিন্তু তিনি কোথায় কিভাবে কোনদিকে দৌড়াচ্ছেন সে দিকে তাঁর কোন হুশ ছিল না। এক পর্যায়ে তিনি দেখেন গেটের কাছে পৌঁছে গেছেন। এভাবে তিনি তাঁর প্রথম এ্যাসাইনমেন্টে সফলকাম হন অনেক বিপদ অতিক্রম করে। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কেবল সামনে এগিয়ে যাওয়। তার কাজের প্রতি কর্তব্যবোধ, নিষ্ঠা ও সাধনা বিশেষ পরিচিতি এনে দেয়।
যুদ্ধের তান্ডবলীলা
১৯৭১-এ শুরু হয় মুক্তির লড়াই। চারপাশে কেবল ধ্বংস, ক্রন্দন, হাহাকার, আহাজারি আর জ্বালাও পোড়াও। পত্রিকা অফিসগুলোও সব পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় তিনি প্রফেশনাল কাজ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি তাঁকে নিয়োজিত করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আইডি কার্ড করে দিতেন। হাজার হাজার আইডি কার্ড করে দিয়ে তিনি মুক্তিসেনাদের পাকিস্তানীদের মরণফাঁদ থেকে বাঁচাতে সহযোগিতা করেছেন। এছাড়াও তিনি মুক্তিসেনাদের বাড়িতে থাকতে দিয়ে ও অন্যান্য সকল প্রকার সহযোগিতা করে মুক্তিযুদ্ধের সাথে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। আর তাঁর ক্যামেরা তো ছিল তার সকল সময়ের সঙ্গী।
যুদ্ধের পর তিনি ১৯৭৫ সাল থেকে প্রায় তিন দশক সিনিয়র প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আলোচিত ও বহুল প্রচারিত আলোকচিত্র
আজকের আলোকচিত্র আগামীদিনের ইতিহাসের পাতা। রশীদ তালুকদারের ছবিতে পাওয়া যায় জীবনের কথা, সমস্যার কথা, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং জনসাধারণের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিদর্শন। তাঁর ছবিতে বিষয়বস্তুর যে বিচিত্র সমাহার তা আর অন্য কোন আলোকচিত্র শিল্পীর ছবিতে তেমন দেখা যায় না। তাঁর ছবি দেখলে বোঝা যায় অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর কাজ করছে। ঠিক সময়মত তিনি তাঁর ক্যামেরার সাটার ক্লিক করেছেন।
তাঁর বিখ্যাত, বহুল প্রচারিত ও মুদ্রিত এমন কিছু ছবি রয়েছে যা ইতহাসের সত্যতাকে ধারণ করছে যুগ যুগ ধরে। তার অনেক ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবির কথা না বললেই না। তাঁর এমনই একটি আলোকচিত্র যা সময় এবং কালকে অতিক্রম করে বারবার ইতিহাসকে নাড়া দেয়, আমাদের অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় মিছিলে শ্লোগানরত নিহত টোকাই’এর ছবিটি। গণঅভ্যুত্থানের শেষ মিছিল ছিল এটি। আইয়ু্ব খানের ছবিতে জুতার মালা পড়িয়ে ছাত্র ইউনিয়নের এই মিছিলটি যখন শিক্ষা ভবনের মোড়ে এসে পৌঁছায় তখন রশীদ তালুকদারের চোখ আটকে যায় এই শীর্ণ টোকাই’এর উপর। টোকাইটির চোখের ও মুখের প্রতিবাদী ভাষা সারা দেশের নিপীড়নের কথা মনে করিয়ে দেয়, অন্যকে প্রতিবাদ করতে আহবান জানায় এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ডাক দেয়। এ ধরনের আহবান শাসকগোষ্ঠীর কোনভাবেই কাম্য নয়। তাই দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করে তিনি পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়াতেই শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ইপিআর কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে ছেলেটি নিহত হয়। কিন্তু তার ক্যামেরার ফ্রেমে সেই সময়ের নির্ভীক সাহসী প্রতিবাদ জীবন্ত হয়ে আছে, থাকবে।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর আঙুল উঁচিয়ে ভাষণ দানের মুহুর্তটিও তিনি অসাধারণ দক্ষতায় ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলেন। বঙ্গবন্ধুর ছবিটি তাঁর তেজোদীপ্ত আত্মপ্রত্যয়, দৃঢ় অবস্থান, কঠিন সংগ্রামের শপথকে যেন প্রকাশ করছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি এ ছবির মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়।
বাংলার মানুষের উপর হাত চালাতে যাদের বুক কাঁপেনি এতটুকুও, যুদ্ধের পর সেই রাজাকারদের ওপরে চলেছে প্রতিশোধের পালা। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর একজন রাজাকারকে হত্যার দৃশ্য তাঁর ক্যামেরায় বন্দি হয়ে যায়। তাঁর সাথে ছিলেন আরেকজন মার্কিন চিত্রগ্রাহক, তিনিও সেই দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করে পুলিত্জার পুরষ্কার অর্জন করেন। কিন্তু গুণগত ও আবেগগত দিক থেকে মার্কিন চিত্রগ্রাহক মিশেলের ছবিটি ছিল অনেক নিম্নমানের। সেই সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা না থাকায় ও প্রচারের অভাবে তাঁর আলোকচিত্রটি আড়ালে থেকে যায়।
উল্লেখিত ছবিগুলো ছাড়াও ঊনসত্তর সালের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ফলাফল, অসহযোগ আন্দোলন, একাত্তরের যুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তী হাহাকার, আহাজারী, কান্না, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মানবিক অনুভূতি, নারী আন্দোলন, বিভিন্ন সংগ্রাম ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়বস্তু তিনি তাঁর ক্যামেরার মাধ্যমে মানুষের সামনে আবেদনময় করে উপস্থাপন করে তুলেছেন। মানুষের আবেগ অনুভূতিকে জাগ্রত করে তুলেছেন। সেই সাথে তাঁর আলোকচিত্র ইতিহাসের সাক্ষী তথা প্রমাণিত দলিল হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।
ব্যবহৃত ক্যামেরা
তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন। তাঁর ব্যবহৃত প্রথম ক্যামেরা আইস্যুলেট ক্যামেরা। এছাড়া রোলিকর্ড, রোলিফ্লেঙ্ ক্যামেরা তিন ব্যবহার করেছেন।
ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে তিনি ১৩৫ মি.মি. ক্যামেরা ব্যবহার করেন। বলতে গেলে তিনি এ ধরণের ক্যামেরা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফটো জার্নালিস্টদের মধ্যে পথপ্রদর্শক। প্রেস ফটোগ্রাফারদের ধারণা ছিল ছোট ফ্রেমে (১৩৫মি.মি.) ছবি তোলা হলে উক্ত নেগেটিভ দিয়ে ছবি বড় করা যায় না। ছবির গুণাগুণ নষ্ট হয়, ছবির গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। তাই ১২০ রোল ফিল্ম দিয়ে ছবি তুলতো। সত্তর দশকের মাঝামাঝির পরে তাদের মধ্যে কেউ কেউ ১৩৫ মি.মি. ক্যামেরার প্রচলন শুরু করেন এবং দশক শেষ হওয়ার আগে প্রত্যেকেই ১৩৫ মি.মি. ক্যামেরা ব্যবহারে উত্সাহিত হয়ে উঠেন।
গুণীজন সংবর্ধনা
তাঁর কাজের মূল্যায়ন হিসেবে তিনি সর্বমোট ৭২টি সংবর্ধনা পান। বাংলাদেশের বিভিন্ন সোসাইটি ও সংস্থা কর্তৃক, জাপন, ইউনেস্কো, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ কর্তৃক একাধিকবার পুরষ্কার লাভ করেন। ফ্রান্সে জাতিসংঘ আয়োজিত ‘নিরাশ্রয়ের জন্য আশ্রয়’ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় এক সাথে ৬টি পুরষ্কার অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে মুসলিম ওয়ার্ল্ড শীর্ষক প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান, জার্মন ডিডিআর থেকে ডিপ্লোমা, জাপান ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও আসহাই সিমবুন পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় পর পর দুইবার পুরস্কৃত হন। পূরবী পদক-৯৩, ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠী-৯০ অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে বিজ্ঞান যাদুঘর, ১৯৮২ সালে বিপিএস তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদান করেন। জাতীয় যাদুঘর কর্তৃক দুইবার বিশেষ পুরষ্কার লাভ করেন। বাংলাদেশ প্রেস ইনষ্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় একাধিকবার পুরষ্কার লাভ করেন। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর রশীদ তালুকদারের কৃতিত্বের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রশংসাপত্র প্রেরণ করেন। এছাড়াও তিনি উল্লেখযোগ্য অনেক সম্মাননা অর্জন করেছেন।
১. পৃথিবীর শত বছর পুরাতন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাউথ ইষ্ট এশিয়ার উপর এন সাইক্লোপিডিয়াতে তার তোলা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক ছবিটি জুরি বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। তাঁর তোলা এই ছবিটি বাংলাদেশের ইতিহাসকে যেমন ধারণ করে রেখেছে তেমনি বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে এক অসামান্য গৌরব।
২. শেরেবাংলা স্মৃতি পুরস্কার কেন্দ্রীয় ইয়ুথফ্রন্ট, ঢাকা।
৩. কাপঃ রোটারেক্ট ক্লাব কসমোপলিটন, ঢাকা।
৪. বাংলাদেশ এ্যাষ্ট্রোলজি পামিষ্ট ফেডারেশন, ঢাকা।
৫. রংধনু, ললিতকলা একাডেমি।
৬. নাট্যসভা গুণীজন সংবর্ধনা।
৭. কথক একাডেমি কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা।
৮. আজীবন সদস্য বাংলাদেশ ফটোগ্রাফী সোসাইটি কর্তৃক সম্মানসূচক ফেলোশীপ প্রদান-৯২।
৯. এল পি বি এস (প্রফেশনাল যোগ্যতা বাংলাদেশ ফটোগ্রাফী সোসাইটি)।
১০. বাংলাদেশ ফটোগ্রাফী সোসাইটি কর্তৃক অনারী মেম্বারশীপ প্রদান।
১১. ১৯৮৯ সালে ‘রূপসি’ পুরস্কার লাভ ও ইন্দোসুয়েজ পুরস্কার লাভ।
১২. ময়মনসিংহ আলোকচিত্র সংসদের ৩য় জাতীয় প্রতিযোগিতায় ২টি পুরস্কার লাভ।
১৩. হিরাঝিল সংসদ কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা-৯১।
১৪. ইত্তেফাক সম্পাদক কর্তৃক দুইবার প্রশংসাপত্র প্রদান।
১৫. সংকলন গণঅভ্যুত্থান ধীপ্র গাথা, ঢাকা, ০১.১১.৬৯।
১৬. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ষোড়শ ব্যাচ কর্তৃক সংবর্ধনা জ্ঞাপন।
১৭. জাহানারা বেগম মেমোরিয়াল এন্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট কর্তৃক ফুটবলার আসলামের ক্রীড়া নৈপুণ্যের উপর আলোক গুণীজন সংবর্ধনা জ্ঞাপন (২৬.১১.৯১) চিত্র প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার-স্বর্ণপদক।
১৮. ইউনেস্কো কর্তৃক আয়োজিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে নারী নির্যাতন ও তার প্রতিকার প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ-৯৬।
১৯. নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি কর্তৃক প্রথম স্থান আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় রঙ্গীন বিভাগে দ্বিতীয় স্থান।
২০. চট্টগ্রামে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি কর্তৃক ২১শে পদক প্রদান-৯৬। ২১. সম্মিলিত নারী সমাজ কর্তৃক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে অধিকাংশ তাঁর ছবি স্থান পায়।
২২. ক্যামেরা রিক্রিয়েশন কর্তৃক ভাসাণীর বুকে বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রথম পুরস্কার লাভ করে।
২৩. বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন অব এশিয়া প্রেসফটো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ-২০০২।
২৪. বিপিএস রজত জয়ন্তী পদক লাভ-২০০২।
২৫. জেপিএস কর্তৃক ম্যান অব দি ইয়্যার-২০০২।
২৬. আমরা কুঁড়ি ফটোসাংবাদিকতার জন্য এওয়ার্ড-২০০৩।
২৭. অনন্যা পত্রিকা কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার লাভ-একমাত্র পুরুষ ব্যক্তিত্বকে এই পদক দেয়া হয়।
২৮. ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশন কর্তৃক ফটো সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পুরস্কার লাভ।
২৯. আমরা সূর্যমুখী কর্তৃক সংবর্ধনা ও গুণীজন সংবর্ধনা জ্ঞাপন-২০০৩।
৩০. বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রী সংবর্ধনা-২০০২ লাভ।
৩১. ঢাকা কমার্স কলেজ কর্তৃক যুগপূর্তি উত্যাপন-২০০১ সংবর্ধনা জ্ঞান।
৩২. ছবিমেলা কর্তৃক লাফই টাইম এ্যাচিভমেন্ট এওয়ার্ড, ইন্টারন্যাশনাল ফেসটিবেল অব ফটোগ্রাফি-২০০৬।
এছাড়াও বহু পুরস্কার তিনি দেশ বিদেশ থেকে সংগ্রহ করেছেন।
উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য
ক. বাংলাদেশ ফটোগ্রফিক সোসাইটি।
খ. ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ফটোগ্রাফিক সোসাইটি।
গ. বগুড়া ফটোগ্রাফিক সোসাইটি।
ঘ. বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা কনভেনর (প্রাক্তন)।
ঙ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বগুড়া ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও হলিক্রস কলেজের ওয়ার্কশপে ক্লাস গ্রহণ।
চ. বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট কর্তৃক দুইবার ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ।
এছাড়া ঢাকা নগর যাদুঘর সংগৃহীত বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশে প্রথম “স্বাধীনতা যুদ্ধের আলোকচিত্র ঢাকা ‘৭১” বইটিতে ৫২টি ছবি স্থান পায়।
১৯৫৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাঁর এই দীর্ঘ কর্ম জীবনে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের সমৃদ্ধশালী ফটো ডকুমেন্টেশন তাঁর মত এমন আর কারো নেই। কিন্তু এই বিপুল ভান্ডারের যথাযথ সংগ্রহ ও যত্ন না থাকায় অনেক দুর্লভ আলোকচিত্র হারিয়ে আমরা শূন্য হয়ে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে সকলের আরও বেশি মনোযোগী ও সচেতন হওয়া উচিত।
রশীদ তালুকদার ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর মারা যান।
গবেষক : কিমিয়া মারুশাত