১৯০৫-০৬ সালের মধ্যে ভারতের সর্বত্র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন গড়ে ওঠে। বয়কট আন্দোলন ধীরে ধীরে স্ব-রাজলাভের আন্দোলনে রূপ নিতে শুরু করে। ঠিক এমন সময় বরোদা থেকে অরবিন্দ ঘোষ কলকাতায় চলে আসেন। তিনি বরোদার রাজ কলেজে ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসেবে চাকুরী করতেন। তখন তাঁর বেতন ছিল ১৫০০ (পনেরশত) টাকা। এত বড় অংকের বেতনের চাকরি পরিত্যাগ করে তিনি কলকাতায় এসে অনেক কম বেতনে ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে চাকুরী নেন। এখানে তাঁর বেতন ছিল মাত্র ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) টাকা। এর পিছনে মূল কারণ ছিল বরোদা থেকে বিপ্লবী দল পরিচালনা করতে তাঁর খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। বারবার কলকাতায় আসা-যাওয়া করে বিপ্লবী কাজ যথা সময়ে সম্পাদন করা যেত না। মাতৃভূমির বুকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে মেনে নিতে পারছিলেন না অরবিন্দ ঘোষ। তাই সুবিধামত বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সংগঠিত করে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার জন্য তিনি কলকাতায় চলে আসেন।
অরবিন্দ ঘোষ জন্মেছিলেন ১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট, কলকাতায়। তাঁর বাবা কৃষ্ণধন ঘোষ এবং মাতামহ রাজনারায়ণ বসু। ছোটবেলায় অরবিন্দ ঘোষ সেণ্টপলস্ স্কুলে পড়াশুনা করেন। সেণ্টপলস্ থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক লেখাপড়া শেষ করেন। তারপর তিনি পড়াশুনা করার জন্য ইংল্যান্ডে যান। ইংল্যান্ডে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ফার্স্ট-ক্লাশ ফাস্ট হয়েছিলেন ক্লাসিক্সে। আই.সি.এস.-এর সব পরীক্ষায় ভালো ফল করা সত্ত্বেও একটি পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারায় তিনি আই.সি.এস. হতে পারেননি। চৌদ্দ বছর বয়স থেকে তিনি দেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেন এবং আঠারো বছর বয়সে পৌঁছানোর মধ্যেই তাঁর মনে এই বিশ্বাসই দৃঢ় হয়ে ওঠে যে, ব্রিটিশদের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে ভারতের মুক্তি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে অর্জন করতে হবে।
ছাত্র জীবন থেকে তিনি ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ফরাসি বিপ্লবের নেতা দাঁতে এবং রোবসপিয়ার তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, পিটিশনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা লাভ করা যাবে না, বিপ্লবের মাধ্যমেই দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। ইংল্যান্ডে থাকার সময় তিনি বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির প্রতি আকৃষ্ট হন।
১৯০১ সালে অরবিন্দ ঘোষ ১৫ বছর বয়সী কলকাতার ব্রাহ্ম বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী মৃণালিনী দেবীকে হিন্দুশাস্ত্র মতে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের বিবাহিত জীবন ছিল প্রায় ১৭ বছর। ১৭ বছরের বিবাহিত জীবনে মৃণালিনী দেবী খুব কম সময়ই স্বামী সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। বেশিরভাগ সময় দেশের কাজে ব্যস্ত থাকায় অরবিন্দ ঘোষ স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন চিঠিপত্রের মাধ্যমে।
তিনি দেশের কাজে কবে কোথায় থাকতেন, তার কোনও ঠিক ছিল না। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী স্বামী সান্নিধ্য না পাওয়ায় মাঝে মাঝে মানসিকভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পড়তেন। অরবিন্দ ঘোষ তাঁর অবস্থাটা চিঠির মাধ্যমে পরিস্কার করে দিয়ে লিখেছিলেন, ‘আবার সেই কথা বলি, তুমি একজন সাধারণ লোকের স্ত্রী হও নাই, তোমার বিশেষ ধৈর্য ও শক্ততার দরকার। এমন সময়ও আসিতে পারে যখন একমাস কিংবা দেড়মাস নয়, ছমাস পর্যন্তও আমার কোনও খবর পাইবে না। এখন থেকে একটু শক্ত হইতে শিখিতে হয়, তাহা না হইলে ভবিষ্যতে অনেক দুঃখভোগ করিতে হইবে।’
১৯০২ সালে বারীন্দ্র কুমার ঘোষ লন্ডন থেকে কলকাতায় আসেন। কলকাতায় এসে তিনি ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহের বহ্নি ছড়াতে থাকেন। কিন্তু বাঙালী ভদ্রলোকেরা মোটেই সাড়া দেয়নি। বিফল হয়ে তিনি বরোদায় বড়ভাই অরবিন্দ ঘোষের নিকট যান। বারীন্দ্র কুমার ঘোষ বরোদায় বসে অনুধাবন করেন, রাজনীতিকে ধর্মের সঙ্গে একীভূত না করলে কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনে কাজ হবে না। এজন্য তিনি গীতা পাঠের সঙ্গে রাজনীতির পাঠ দেবার উদ্দেশ্যে অনুশীলন সমিতির পরিকল্পনা করেন ও উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন।
এরপর অরবিন্দর অনুপ্রেরণায় ও বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতার ৩২নং মুরারিপুকুরে তৈরি হয় সশস্ত্র বিপ্লবী অনুশীলন সমিতি (দল)। ৩২নং মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়িটি ছিল বারীন্দ্রকুমার ঘোষদের পৈত্রিক সম্পত্তি। সশস্ত্র বিপ্লবী নেতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ তাঁর দলের আখড়া গড়েছিলেন এই মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে। এই বাগানবাড়ির মাঝখানে ছিল ছোটো একটি পাকাবাড়ি। বাড়িটির চতুর্দিকে ছিল গাছপালা। অরবিন্দ ঘোষ এবং অপর দুই ভাই মনোমোহন ঘোষ ও বিনয় ঘোষ এই বাগানবাড়িতে বসবাস করতেন। অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে পরামর্শ করেই বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, হেমচন্দ্র ঘোষ, অবিনাশ ভট্টাচার্যর মতো বিপ্লবীরা দলের নীতি নির্ধারণ করতেন। এক সময় ওই ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটি হয়ে উঠে সশস্ত্র বিপ্লবীদের মূল কেন্দ্র।
১৯০৩ থেকে ১৯০৫ সাল ছিল বাংলাদেশে বিপ্লবের বাণী প্রচারের অধ্যায়। এই সময় প্রকাশিত হতে থাকে সন্ধ্যা, বন্দেমাতরম, যুগান্তর প্রভৃতি পত্রিকা। সখারাম গণেশ দেউস্কর, পি মিত্র, যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নানা তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে বিপ্লবী যুবকদের শিক্ষাদান পর্ব চলতে থাকে।
১৯০৩ সালে কলকাতায় প্রমথ মিত্র ও চিত্তরঞ্জন দাস ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রমথ মিত্র ১৯০৫ সালে বিপিন চন্দ্র পালের সঙ্গে ঢাকায় এসে অনুশীলন সমিতির একটি শাখা স্থাপন করেন এবং ঢাকা অনুশীলন সমিতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন পুলীন বিহারী দাস। এই সমিতির কেন্দ্র ছিল ঢাকার উয়াড়িতে। বহু দেশপ্রেমিক যুবক স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যোগ দিয়েছিলেন এই বিপ্লবী অনুশীলন দলে। দলের সদস্যরা বিদেশি শাসকের বুকে আঘাত হানতে লাঠি খেলা, ছোরা ও আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। ১৯০৬ সালের দিকে বিপ্লবীদের দ্বিতীয় দল যুগান্তর সমিতির জন্ম হয় কলকাতায়। অরবিন্দ ঘোষ ও বারীন্দ্র ঘোষ যুগান্তর সমিতি পরিচালনার দায়িত্ব নেন।
১৯০৫ সালে কার্জন সাহেবের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা সমগ্র বঙ্গদেশকেই আলোড়িত করে তোলে। বিক্ষুব্ধ বঙ্গবাসীরা বিদ্রোহের ধ্বজা নিয়ে আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়। ১৯০৬ সালে অরবিন্দ ঘোষ বাংলাদেশে আসেন এবং বঙ্গবাসীকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করার অভিযান শুরু করেন। এই সময় বারুইপুরে ও উত্তরপাড়ায় তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ ইতিহাস হয়ে রয়েছে। তাঁর ভগিনী নিবেদিতাও তখন বিপ্লববাদী যুবকদের সাহায্য করতেন। এই সময় বিপ্লববাদীদের প্রচারের ধারার নিদর্শন হিসাবে ১৯০৬ সালের একটি লেখার উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলার বিপ্লবীদের মুখপত্র যুগান্তর ১৯০৬ সালে বরিশালে ব্রিটিশ শাসকদের নিষ্ঠুর দমনপীড়নের পর ২৬ এপ্রিল সম্পাদকীয়তে খোলাখুলি লিখে: “দেশের ৩০ কোটি মানুষ যদি তাদের ৬০ কোটি হাত প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞায় তুলে ধরে তবেই বন্ধ হবে এ অত্যাচার। একমাত্র শক্তি দিয়েই শক্তির প্রকাশকে স্তব্ধ করা সম্ভব।”
ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য বাংলার যুবকরা তখন জেগে উঠেছে। যেখানেই ইংরেজের অত্যাচার দেখছে সেখানেই তাঁরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এই প্রতিবাদের জন্য তাঁরা নির্যাতিত হতে থাকে। এই নির্যাতনের প্রতিবাদে বাংলার দিকে দিকে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত রূপ দেবার জন্য অরবিন্দ ঘোষের বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত যুবকরা সংঘবদ্ধ হন। ব্রিটিশ শাসকদের নির্যাতন যতই বাড়তে থাকে, বাংলাদেশে সশস্ত্র বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বিষয়টি ততই প্রবল হয়ে উঠে। ঝামাপুকুর ও মানিকতলায় বোমা তৈরির কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা করে বিপ্লবীরা। বিপ্লবের এই গোপন আয়োজন ক্রমে ক্রমে মেদিনীপুর, চন্দননগর, কৃষ্ণনগর, শ্রীহট্ট, বগুড়া, রংপুর, বরিশাল, ঢাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। অনুশীলন সমিতির শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে উঠে ঢাকায়।
১৯০৫ সালে অরবিন্দ ঘোষ বরোদা থেকে একটা চিঠি লিখেছিলেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে। চিঠির একাংশে লিখেছিলেন, ‘তুমি কি কোণে বসিয়া কাঁদিবে মাত্র, না তার সঙ্গেই ছুটিবে, পাগলের উপযুক্ত পাগলি হইবার চেষ্টা করিবে? অন্ধ রাজার মহিষী চক্ষুদ্বয়ে বস্ত্র বাঁধিয়া নিজেই অন্ধ সাজিলেন। হাজার ব্রাহ্মস্কুলে পড়িয়া থাক, তবে তুমি হিন্দু ঘরের মেয়ে, হিন্দু পূর্বপুরুষের রক্ত তোমার শরীরে, আমার সন্দেহ নাই, শেষোক্ত পথই তুমি ধরিবে।’ এই চিঠিটিরই অপর অংশে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি স্বদেশকে মা বলিয়া জানি, ভক্তি করি, পূজা করি। মার বুকের উপর বসিয়া যদি একটা রাক্ষস রক্তপানে উদ্যত, তাহা হইলে ছেলে কি করে? নিশ্চিন্তবোধে আহার করিতে বসে? স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আমোদ করিতে বসে? না, মাকে উদ্ধার করিতে পৌরোহিত্য করে?’
১৯০৭ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে স্বদেশি ইংরেজি ‘দৈনিক বন্দেমাতরম্’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বিপ্লবী যুবকদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেন।
অরবিন্দ ঘোষের সাথে যোগাযোগ ছিল ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপপাধ্যায়ের। এই স্বদেশি পত্রিকাগুলোর মূলমন্ত্র ছিল বিদেশির হাত থেকে যে কোনও মূল্যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া। সশস্ত্র বিপ্লবীরা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছিলেন এই স্বদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত জ্বালাময়ী নিবন্ধ পড়ে। বিপ্লবী যুবকরা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াতে বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের বিপ্লবী আখড়া গড়ে তোলেন।
রাজদ্রোহের অভিযোগে ১৯০৭ সালে ‘বন্দেমাতরম্’ পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করে ইংরেজ প্রশাসন। আসামি করে গ্রেপ্তার করা হল অরবিন্দ ঘোষ, হেমচন্দ্রনাথ বাগচি ও অপূর্বকৃষ্ণ বোসকে। ‘বন্দেমাতরম্’ পত্রিকার ম্যানেজার ছিলেন হেমেন্দ্রনাথ বাগচি আর অপূর্বকৃষ্ণ বোস ছিলেন পত্রিকার মুদ্রাকর।
সেই সময় কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. কিংসফোর্ড। অভিযুক্ত আসামি তিনজনকে তোলা হয়েছিল মি. কিংসফোর্ডের আদালতের আসামির কাঠগড়ায়। সাক্ষ্যসাবুদ নেওয়া হয়েছিল ১৯০৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। এই মামলাটির নামকরণ হয়ে গিয়েছিল ‘বন্দেমাতরম্ মামলা’। প্রমাণাভাবে মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল অরবিন্দ ঘোষ ও হেমেন্দ্রনাথ বাগচিকে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারায় দণ্ডিত করা হয়েছিল অপূর্বকৃষ্ণ বোসকে।
‘বন্দেমাতরম্’ মামলায় সরকার পক্ষ থেকে সাক্ষী মানা হয়েছিল বিপিনচন্দ্র পালকে। সেইমত চিফ্ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেব বিপিনচন্দ্র পালের নামে সমন পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বিপিনচন্দ্র পাল সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করায় আদালত অবমাননা করার জন্য তাঁকে ছয়মাসের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
মি. কিংসফোর্ড সাহেবের আদালতে যখন ‘বন্দেমাতরম্’ মামলাটির শুনানি চলছিল তখন একদিন ১৪/১৫ বছরের বালক সুশীল সেন আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলেছিল, ‘বন্দেমাতরম্! বন্দেমাতরম।’
‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে নির্দয় কিংসফোর্ড বালক সুশীল সেনকে ১৫ ঘা বেত্রদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এক দেশপ্রেমিক বালককে বেত্রদণ্ড দেওয়ায় বিপ্লবীরা ক্রোধে ফুঁসে উঠলেন। এঘটনায় শুধু ভারতবাসী নয়, অনেক ইংরেজও ক্ষুব্ধ হলেন। এই ঘটনায় বিপ্লবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে কিংসফোর্টকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই হত্যার দায়িত্ব নিলেন ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী।
ব্রিটিশ প্রশাসকেরা বুঝতে পারেন মজফ্ফরপুরে কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীকে কলকাতা থেকে পাঠানো হয়েছিল । তাই কলকাতার পুলিশ প্রশাসন আর অপেক্ষা না করে বিপ্লবীদের ডেরাগুলিতে হানা দিল। তল্লাসী শুরু হল ব্যাপকভাবে। পুলিশের কাছে আগে থেকেই অনেক গুপ্ত খবর ছিল। গুপ্তচরদের মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবীদের গতিবিধি লক্ষ্য করে যাচ্ছিল ব্রিটিশ প্রশাসন।
১৯০৮ সালের ২রা মে কলকাতার ব্রিটিশ প্রশাসনের পুলিশ আটটি জায়গায় খানা-তল্লাশি চালায়। মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত ও নলিনীকান্ত গুপ্তসহ ১৪ জনকে। ৪৮নং গ্রে স্ট্রিট থেকে অরবিন্দ ঘোষসহ তিনজনকে, ১৩৪নং হ্যারিসন রোড থেকে ৫ জনকে, রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে হেমচন্দ্র দাস কানুনগো, গোপীমোহন দত্ত লেন থেকে কানাইলাল দত্তসহ দুইজনকে গ্রেফতার করে। ১৩৪নং হ্যারিসন রোডের বাড়ি থেকে পুলিশ প্রচুর পরিমাণে বোমা তৈরির মাল-মশলা ও সাজসরঞ্জাম উদ্ধার করে। এ ছাড়াও পুলিশ ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে মাটির তলায় পুঁতে রাখা কতিপয় ট্রাঙ্ক উদ্ধার করে। এই ট্রাঙ্কগুলি থেকে পাওয়া যায় বেশ কিছু তাজা বোমা, কতকগুলি বোমা তৈরির খোল, বৈপ্লবিক পুস্তক-পুস্তিকা ও চিঠিপত্র। কিছু ডিনামাইট ও একটি রিভলভারও পাওয়া যায়।
এই সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বোমা ষড়যন্ত্রের ও রাজদ্রোহের অভিযোগে মামলা। এই মামলাটিরই নামকরণ হয়ে গিয়েছিল ‘আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা’। মোট ৩৭ জন অভিযুক্ত আসামিকে বিচারের জন্য চালান দেওয়া হয়। অচিরেই দেশের সাধারণ মানুষ জানতে পারেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, নির্মল রায়, কবিরাজ ধরণীধর গুপ্ত, ইন্দুভূষণ সরকার, শচীন সেন, কুঞ্জলাল সাহা প্রমুখ বিপ্লবী নেতৃত্ব রাজদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। স্বাধীনতা-পিপাসু মানুষ এই সব দেশবরেণ্য বিপ্লবীদের গ্রেফতারের কথা জেনে ক্ষেপে উঠলেন। বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অগ্নিরোষ আরও গভীর হল। দিকে দিকে আওয়াজ উঠল ‘বন্দেমাতরম্’। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।
১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর আলিপুরের জেলা ও দায়রা জজ মি. চার্লস পোর্টেন বিচক্রফট্-এর আদালতে ‘মুরারিপুকুর বোমা মামলা’র সূচনা হয়েছিল। মামলায় অরবিন্দ ঘোষের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। একমাত্র চিত্তরঞ্জন দাশ বিনা টাকায় এই মামলায় লড়েন। তখন তাঁর মাসিক আয় ছিল পাঁচ হাজার টাকা। আর এই মামলা পরিচালনা করতে তাঁকে চল্লিশ হাজার টাকা দেনা করতে হয়েছিল। অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে এই মামলা চলে ১২৬ দিন। দু’শর বেশী সাক্ষীকে জেরা করা হয়। ৪০০০ কাগজপত্র এবং ৫০০ জিনিসপত্র প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর সওয়াল জওয়াবের পরিসমাপ্তি বক্তব্য দেন ৯ দিন ধরে। এই মামলায় তিনি যে সওয়াল করেছিলেন তা জ্ঞান ও দেশপ্রেমের অপূর্ব নিদর্শন। বিচারের রায়ে অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পান।
বিচার চলার সময় আরবিন্দ ঘোষ এক বছর ছিলেন নির্জন কারাগারে বন্দী। এই নির্জন বন্দীদশা তাঁর জীবনে এনে দিয়েছিল এক পরম আশীর্বাদ। কারাগার তাঁর কাছে কারাগার ছিল না, হয়েছিল আশ্রম। যোগ আর তপস্যার একাগ্রতার মধ্য দিয়ে অরবিন্দ ঘোষ সেই বন্দীদশাতেই ভগবানের দর্শন লাভ করেছিলেন। এক বছরের হাজত বাস অরবিন্দ ঘোষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনে দিল। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ রূপান্তরিত হলেন সাধক অরবিন্দ ঘোষ রূপে।
তবে তিনি দেশসেবার ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি। ধর্মপথে দেশসেবার ব্রত গ্রহণ করেন। তাঁর লেখনীতে তখন শুধু জাতীয়তার বাণীই থাকত না, আধ্যাত্মিক তত্ত্বও থাকত। কিন্তু সেই সময় হঠাৎ জানা গেল যে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করার চক্রান্ত করছে। কলকাতার নানা পরিচিত জনের বাড়িতে তখন তিনি আত্মগোপন করে থাকতে লাগলেন। ভগিনী নিবেদিতার বাড়িতেও রইলেন একদিন। শেষে নিবেদিতাই তাঁকে চন্দননগরে চলে যাবার সুযোগ করে দেবার জন্য গঙ্গায় একটি নৌকায় তুলে দিলেন। তখন চন্দননগর ছিল ফরাসী অধিকৃত এলাকা। সেখান থেকে তিনি চলে গেলেন পন্ডিচেরীতে। সেটাও ছিল ফরাসী অধিকৃত রাজ্য। ১৯১০ সালের ৪ এপ্রিল তিনি পন্ডিচেরীতে যান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন।
তাঁর পন্ডিচেরীর জীবন ছিল যোগ সাধনার জীবন। সেখানে তিনি একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে দীর্ঘ চল্লিশ বছর সাধনা করে তিনি সিদ্ধি লাভ করেন ও অমৃতময় জীবনের সন্ধান পান। তাঁর সাধনায় আকৃষ্ট হয়ে দেশী বিদেশী বহু ব্যক্তি তাঁকে দর্শন করতে ও তাঁর আশ্রম পরিদর্শন করতে যেতেন। অনেকে স্থায়ীভাবে সেখানে বাস করেন।
অরবিন্দ ঘোষ পন্ডিচেরী আশ্রমে সাধনায় বসার পর বাইরের কোন লোক তাঁর দর্শন পেতেন না। শেষ দিকে বছরে তিন দিন মাত্র তিনি জনসাধারণকে দর্শন দিতেন। ১৯৫০ সালের ২৪ নভেম্বর তিনি তাঁর ভক্তদেরকে জীবনের শেষ দর্শন দিয়ে যান। তারপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে ৪ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অরবিন্দ ঘোষের রচিত ৩২ টি গ্রন্থের মধ্যে বাংলা গ্রন্থের সংখ্যা ৬টি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ: The Life Divine; Essays on Gita; Savitri, Mother India; The Hero and the Nymph Urvasie; Song of Myrtilla and other Poems; The age of Kalidasa; A System of National Education; The Renaissance in India; Speeches of Aurobinda
বাংলা গ্রন্থ: কারাকাহিনী; ধর্ম ও জাতীয়তা; অরবিন্দের পত্র
তথ্যসূত্র:
১। অগ্নিযুগে বোমা ষড়যন্ত্রে অরবিন্দ: চিন্ময় চৌধুরী। পুনশ্চ প্রকাশনী, কলকাতা। প্রকাশকাল, ১৯৯৯।
২। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ জীবন ও কর্ম: রচনা সম্পাদনা-অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী, মনির হোসাইন মনি, নাসিমা খাতুন, জান্নাতুল ফেরদৌসি স্নিগ্ধা। প্রকাশক: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ গবেষণা পরিষদ। প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০০০।
৩। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত। প্রকাশকাল ১৯৯০ সাল, কলকাতা।
৪। আমি সুভাষ বলছি: শ্রীশৈলেশ দে। রবীন্দ্র লাইব্রেরী, কলকাতা। প্রকাশকাল- রথযাত্রা-১৩৮১ প্রথম খন্ড, রথযাত্রা -দ্বিতীয় খণ্ড ১৩৮৪, রথযাত্রা -তৃতীয় খণ্ড ১৩৮৯।
৫। শতাব্দীর শ্রেষ্ট মনীষীর কথা: সম্পাদনা-মাহফুজ উল্লাহ। প্রভাত প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা। প্রকাশকাল: ১৯৯৭।
৬। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা। প্রকাশকাল ২০০৯ সাল।
৭। ছবির সূত্র: উইকিপিডিয়া।
লেখক: রফিকুল ইসলাম ( শেখ রফিক)