১৮৭৯ সালে অশ্বিনীকুমার দত্ত বি.এল. পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ওই বছর তিনি শ্রীরামপুরের নিকট চাতরা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এই স্কুলের সার্বিক উন্নয়ন করতে সক্ষম হন। ১৮৮০ সালে বরিশালে এসে তিনি ওকালতি পেশা শুরু করেন।
৯ বছর ওকালতি করেন তিনি। কিন্তু এই পেশায় কোর্টে অনেক সময় মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় বলে ১৮৮৯ সালে তিনি ওকালতি পেশা ছেড়ে দেন। তারপর থেকে তিনি পিছিয়ে পড়া বরিশালবাসীকে অগ্রসর করার জন্য শিক্ষা ও সমাজ সচেতনতামূলক নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেন।
আধুনিক বরিশালের রূপকার অশ্বিনীকুমার দত্ত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন অন্যতম বিপ্লবী। তিনি আমৃত্যু রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বরিশালবাসীর জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন। আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি ১৮৮৪-১৯২৩ সাল পর্যন্ত শুধু বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদেরই মানুষ করেননি বরং সমাজের অনেক অশিক্ষিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বাউণ্ডুলে স্বভাবের বখাটে মুকুন্দদাসকে তিনিই দিনের পর দিন বাড়িতে ডেকে এনে আদর, স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে এক নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। যে কারণে মুকুন্দদাস একসময় চারণ সম্রাট মুকুন্দদাস হতে পেরেছিলেন।
১৯০৫ সালের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন চলার সময় বরিশালের টাউন হলে অশ্বিনীকুমার দত্ত এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে জোরদার করা প্রসঙ্গে তাঁর উপলব্দির কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “আমরা যে সব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি, যদি কেউ তা যাত্রাপালা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা আমাদের এরূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে”।
অশ্বিনীকুমার দত্তের এই বক্তব্য মুকুন্দ দাস খুবই গুরুত্বসহকারে নিলেন। মাত্র ৩ মাসের মধ্যে মুকুন্দদাস রচনা করলেন অসাধারণ যাত্রাপালা ‘মাতৃপূঁজা’। ‘মাতৃপূঁজা’র মূল বিষয় ছিল দেশপ্রেম। দেশমাতৃকাকে একত্রীকরণের লক্ষ্যে তার সন্তানরা প্রয়োজনে জীবন দিয়ে ভারতমাতাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করবে। শুধু মুকন্দ দাস নয়, শত শত মানুষকে সমাজ বদলের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন অশ্বিনীকুমার দত্ত।
অশ্বিনীকুমার দত্তের জন্ম ১৮৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারি। তৎকালীন বরিশাল জেলার পটুয়াখালী মহকুমা শহরে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলাধীন বাটাজোর গ্রামে। বাবা ব্রজমোহন দত্ত কর্মজীবনের শুরুতে বানারীপাড়ায় শিক্ষকতা করেন। এরপর দেওয়ানী আদলতে কিছুদিন ওকলাতি করেন। তারপর মুন্সেফ হন। মুন্সেফ থেকে জজ হওয়ার মধ্যবর্তী সময় তিনি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি একজন সাহিত্যানুরাগী ও মানবতাবাদী দেশপ্রেমিক ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত ছিলেন।
অশ্বিনীকুমার দত্তের মায়ের নাম প্রসন্নময়ী। প্রসন্নময়ী ছিলেন বানরীপাড়ার রাধাকিশোর গুহের মেয়ে। বাবার মতো মাও ছিলেন মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক। ব্রজমোহন দত্ত ও প্রসন্নময়ীর পরিবারে ৪টি ছেলে ও ২ টি মেয়ের জন্ম হয়। অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন ওই পরিবারের বড় ছেলে।
অশ্বিনীকুমার দত্তের শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর কাটে পটুয়াখালীতে। এরপর তিনি বাটাজোরে পৈতৃক বাড়ীতে ২ বছর কাটান। ওই সময় গ্রাম্য পাঠশালার গুরুমশাইয়ের কাছে তাঁর পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়। ৭ বছর বয়সে বাবার কর্মস্থল বনবিষ্ণুপুর গিয়ে সেখানকার একটি ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হন। বাবার সরকারি চাকরির কারণে বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন স্কুলে তিনি পড়াশুনা করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ১৪ বছর। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে ১৭ বছরের নিচে কেউ প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে পারবে না। তাই বয়স বাড়িয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন তিনি। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ. এ. ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে আইন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৮৭৮ সালে বি.এ. এবং ১৮৭৯ সালে এম.এ. পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর বি.এল. পরীক্ষা দেন এবং ১৮৮০ সালে বরিশালে এসে ওকালতি পেশা শুরু করেন।
সেসময় বরিশালের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা নানাদিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয় তা থেকে বরিশাল ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। গুটিকয়েক জমিদার ও সরকারি কর্মচারীর পরিবার ছাড়া বরিশালের প্রায় গোটা সমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে ছিল সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে।
১৮৮২ সালে অশ্বিনীকুমার ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হন। এ সময় তিনি বরিশালের ছাত্রসমাজের উন্নতির জন্য নিরলসভাবে নানাবিদ কাজ করতে শুরু করেন। বরিশালের যুবসমাজ অশ্বিনী কুমারের জীবনাদর্শ “সত্য প্রেম পবিত্রতা”র মন্ত্র গ্রহণ করে। ব্রাহ্মসমাজ ও অশ্বিনী কুমারের উদ্যোগে সেবক দল গঠন করা হয়। এই সেবক দল ছাত্রসমাজের শিক্ষাবিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এতে করে বরিশালের গণমানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের এক নবজাগরণ ঘটে। ফলে ধীরে ধীরে মানুষের চেতনা থেকে মধ্যযুগীয় চিন্তা ও বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটে।
১৮৮৪ সালে বরিশালে হাজারে মাত্র ৭ জন শিক্ষিত ছিল। তখন সমগ্র জেলায় ১৫ জনের মতো গ্রাজুয়েট ছিল। সমাজ জীবনে বিশেষত: অভিজাত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মধ্যে দুর্নীতি, ব্যাভিচার, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও অনৈতিকতা জেঁকে বসেছিল। অশ্বিনীকুমার দত্ত বরিশালের এই দুর্দশা দেখে মর্মাহত হন এবং এসব প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।
বরিশালের শিক্ষা ক্ষেত্রেও অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়। অশ্বিনীকুমারের আন্তরিকতাপূর্ণ কথাবার্তা, উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা ও সমাজ-সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে অল্পদিনের মধ্যে তিনি সবার প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন । ক্রমে ক্রমে তাঁর প্রচেষ্টা সফল হতে থাকে। তিনি নানাবিধ দুর্নীতি, অসামাজিক কার্যকলাপ, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা ও সংগীতের পাশাপাশি জনসাধারণের প্রতিনিধি সভা সংগঠিত করেন। ১৮৮৪ সালে আশ্বিনী কুমার দত্ত তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বাবার নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রজমোহন বিদ্যালয় । ব্রজমোহন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫ বছর পর ১৮৮৯ সালে তিনি ব্রজমোহন বিদ্যালয়কে কলেজরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। অশ্বিনীকুমারের সর্বত্যাগী নেতৃত্ব ও শিক্ষা আন্দোলনের ফলে কয়েক বছরের মধ্যে এই কলেজ ও বরিশাল সারাবাংলায় খ্যাতি অর্জন করে।
বরিশালের সমাজজীবনে তিনি প্রথম রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করেন। গঠন করেন বরিশাল জনসাধারণ সভা। এই রাজনৈতিক সংগঠনটিকে তিনিই ধীরে ধীরে শক্তিশালী রূপে গড়ে তোলেন। জাতীয় কংগ্রেসের আগে এই রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়। ১৮৮৬ সাল থেকে বরিশাল জনসাধারণ সভা কংগ্রেসের সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করে।
অশ্বিনী কুমার তাঁর বিচক্ষণতা দিয়ে অনুভব করেন গণশিক্ষা ছাড়া গণজাগরণ সম্ভব নয়। মানুষকে যদি প্রকৃত শিক্ষা প্রদান করা যায় তবেই তারা রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠবে। গণশিক্ষা বিস্তারে ব্রজমোহন স্কুল ও কলেজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা অশ্বিনী কুমারের স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করে গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ও শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরাই পরবর্তীকালে বরিশালকে এক বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত করেন।
মাত্র বক্তৃতা দিয়ে নয়, কাজের মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের নৈতিক চরিত্র গঠন করে দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। তিনি বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে Little Brothers of the poor (দরিদ্র বান্ধব সমিতি), Band of Hope (আশ্বাসী সম্প্রদায়), Band of Mercy (কৃপালু সম্প্রদায়), Friendly Union(বান্ধব সমিতি) গঠন করেন। এই সংগঠনগুলোর মাধ্যমে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করা, বিদ্যালয় স্থাপন, নারী শিক্ষা বিস্তার, দরিদ্রকে সহযোগিতা, দুর্নীতি, অন্যায়- অত্যচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মুক্তচিন্তা চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হয়। যে কারণে ১৯০০ সালে বরিশালে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫০ জন।
গণসচেতনতা সৃষ্টির তাগিদে এ সময় অশ্বিনীকুমার দত্ত সংবাদপত্রের অভাব বিশেষভাবে অনুভব করেন। তাঁর চেষ্টার কারণে বিকাশ, স্বদেশী, বরিশাল, বরিশাল হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বরিশাল হিতৈষী ও স্বদেশী পত্রিকা অসহযোগ আন্দোলনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকাগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শিক্ষাবিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
অশ্বিনীকুমারের একান্ত চেষ্টায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপিত হয়। জনপ্রিয়তার কারণে তিনি বরিশাল পৌরসভা ও লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এসময় তিনি এ কে ফজলুল হককে পৌরসভা ও জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত করেন। মূলত অশ্বিনীকুমারের হাতেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়।
অশ্বিনীকুমার দত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার ও চেতনায় আস্থাবান ছিলেন। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সারা জীবন লড়াই করেছেন তিনি। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে- এ দাবির সমর্থনে তিনি ১৮৮৫- ৮৬ সালে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশাল জনসভা করেন এবং আইনসভা বা পার্লামেন্ট গঠনের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। এ সময় তিনি ৪০ হাজার বরিশালবাসীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আইনসভা প্রতিষ্ঠার জন্য তা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরণ করেন।
অশ্বিনী কুমার ১৮৮৭ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সম্মেলনে ভারতে আইনসভা প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন। ওই বছর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি কংগ্রেসের আপোসকামিতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণসর্বস্ব রাজনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। অশ্বিনীকুমারই প্রথম ব্যক্তিত্ব, যিনি সর্বপ্রথম কংগ্রেসের প্রাসাদ রাজনীতিকে জনগণের দোরগোড়ায় আনতে ব্রতী হয়েছিলেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগের কারণে স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন গড়ে ওঠে। বয়কট আন্দোলন এক সময় স্বরাজলাভের আন্দোলনে রূপ নেয়। এসময় বাংলা বিভক্তির প্রতিবাদে অশ্বিনী কুমারের নেতৃত্বে বরিশালে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। বরিশালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যতটা তীব্র আকার ধারণ করেছিল বাংলার আর কোথাও তার নজির নেই। তিনি ছিলেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অগ্রনায়ক। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটান। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় অশ্বিনীকুমার যখন বরিশাল বা অন্যত্র বক্তৃতা দিতেন, তখন সেই বক্তৃতার আগে জাতীয় সংগীত গাওয়া হত। জাতীয় সংগীতের পরে দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হত। কিন্তু সেসময় তেমন দেশাত্মবোধক গান ছিল না। তাই এসময় তিনি বেশকিছু দেশাত্ববোধক গান রচনা করেন। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা শতাধিক। তাঁর একটি গান সেই সময় বরিশালবাসীর মনে দাগ কেটেছিল:
আয় আয়, ভাই, আয় সবে মিলে,
হিন্দু মুসলমান, জাতিভেদ ভুলে
কাপায়ে অবনী, ভারত-জননী, করিছেন সবে আহ্বান।
আয়রে সকলে, আয় দলে দলে, করিতে হবে দান
ধন জন মান প্রাণ।
এখনও কি তোরা সবে মড়া পড়ে রবি?
এখনও কি তোরা আপন সবি?
উঠে ভাই দাঁড়া, পড়েছে সাড়া,
ভারত ভুবনে উঠেছে ধ্বনি
‘বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম’।
মানুষ বলে, মোদের গণে না যে ভবে,
সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে,
(মোরা) পরমুখে চাই, পরে দিলে খাই,
এ দুঃখ যে আর সহে না প্রাণে,
‘বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম’।
পুরাতন মোদের শিল্পকলা যত,
জাগাব নূতন, আনিব কত,
নূতন প্রাণে, নূতন তানে, গাইব সকলে নিত্য নব নব—
‘বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম’।
আবার এদেশ ধন্য হবে ভবে,
জগতের আবার শিরোমণি হবে,
জয় জয় রবে ঘোষিবেরে সবে,
ভারতের নবীন জীবনকাহিনী;
‘বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম’।
১৯০৫-০৮ সাল পর্যন্ত বরিশালে অশ্বিনীকুমারের নেতৃত্বে যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন গড়ে উঠে তা বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এমন কি বাংলার বাইরেও অনেক প্রদেশে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে। অন্যান্য প্রদেশের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন জনসভায় অশ্বিনীকুমার ও বরিশালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উদাহরণ দিতেন।
অশ্বিনীকুমারের নেতৃত্বে স্বদেশবান্ধব সমিতি শহরে ও গ্রামে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করত। এই সমিতির কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সরকার অশ্বিনীকুমারসহ ৯ জন নেতাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন আইনে গ্রেফতার করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। এ সময় অশ্বিনীকুমারকে রাখা হয় লক্ষ্ণৌ জেলে।
১৯১০ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। মুক্তির পর তিনি জেলা স্বদেশবান্ধব সমিতির সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। সমিতির পক্ষ থেকে প্রচারক পাঠিয়ে তিনি গ্রামে গ্রামে নিম্ন বিদ্যালয় স্থাপন, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত গ্রামে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ১৯২১ সালে বরিশালে স্টিমার ধর্মঘটের সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং এ অবস্থায় তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের যাবতীয় কাজ দেখভাল করেন। ১৯২২ সালে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। অশ্বিনীকুমার দত্ত: তপংকর চক্রবর্তী। গতিধারা প্রকাশনী, ৩৮/২-ক বাংলাবাজার, ঢাকা। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০০৮।(ছবি)
২। স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল: হীরালাল দাশগুপ্ত। সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। প্রকাশকাল, ডিসেম্বর-১৯৯৭।
৩। জীবনী গ্রন্থমালা: অশ্বিনীকুমার দত্ত: তপংকর চক্রবর্তী। কথাপ্রকাশ, শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট, ঢাকা। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
৪। মুকুন্দদাস রচনাসমগ্র: সম্পাদনা-শেখ রফিক। র্যামন পাবলিসার্স, বাংলাবাজার, ঢাকা। প্রকাশকাল, ফেব্রুয়ারী ২০০৮।
লেখক: রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)