আমার পাঁচ ছ’বছর বয়সে মা-ই আমাকে ঘুম পাড়াতেন। সন্ধ্যার পরে সেই আধঘন্টা সময়টার কথা কখনও ভুলবার নয়। আমার জীবনে সে এক অমূল্য সম্পদ।
ক্ষুদিরাম ও কানাইলালের ফাঁসির গল্প আর গান্ধীজীর “হিমালয়ের তলদেশে পাতালপুরীর অস্ত্রগারের” গল্প-এগুলি ছিল মায়ের ঘুম পাড়ানি কাহিনী। এ ঘুম পাড়ান গান ক্ষুদিরামের ফাঁসির উপর বাংলায় বাউলদের অমর সৃষ্টি :
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি
দেখবে ভারতবাসী।
ক্ষুদিরাম ও কানাইলালের গল্প ও গান শুনে আমি প্রতিদিন কেঁদে কেঁদে ঘুমাতাম। এজন্য মা কোন কোন দিন ঐ গল্প বলতে চাইতেন না। বলতেন, তুই কেবল কাঁদিস, এ ভাল নয়। কিন্তু তাঁকে বলতেই হতো। ক্ষুদিরাম-কানাইলালের গল্প শুনে না-কেঁদে আমার ঘুম আসতো না, তা মা খোকার চোখে চুমু খাবার জন্য ঘুম পাড়ানি মাসীপিসিকে যতই আহ্বান করুন না কেন।
ক্ষুদিরাম-কানাইলালের গল্পে শুনতাম যে আমাদের জন্মভূমি পরাধীন, বিদেশী ইংরেজ সাহেবরা আমাদের দেশ জবরদখল করে রেখেছে; সেই কারণেই আমাদের দেশবাসী গরীব-দুঃখী, তারা ভিক্ষা করে। গল্প শুনতে শুনতে মনে হতো যেন আমারই মত দুই শিশু ক্ষুদিরাম আর কানাইলাল ইংরেজদের মেরে তাড়িয়ে দেশকে স্বাধীন করে গরীবদের দুঃখ মোচন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। তাদের জন্য দুঃখে কাঁদতাম, আবার গর্বও হতো। এতটুকু বাঙালী ছেলে ইংরেজের সাথে লড়তে গেছে; কী সাহস! ইংরেজ যে দোর্দণ্ড শক্তি, সে জ্ঞান ঐ বয়সেও ছিল।
(হাতেখড়ি- অনিল মুখার্জি, পৃষ্ঠা, ৭)
উপরের কথাগুলো বলেছেন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী ও শ্রমিক নেতা অনিল মুখার্জি। মায়ের মুখে গল্প শুনতে শুনতে সেই ছেলেবেলাতেই ইংরেজদের প্রতি বিদ্বেষ জন্ম নেয় তাঁর মনে। আর ক্ষুদরিাম ও কানাইলালের গল্প শুনে তাঁদের মতো দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেন তিনি। সেকারণে স্কুলে পড়ার সময়েই জড়িয়ে পড়েন বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে। ব্রিটিশদের শোষণ ও নির্যাতন থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য একের পর এক আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে ছিনিয়ে আনেন স্বাধীনতার সূর্য।
অনিল মুখার্জির জন্ম ১৯১২ সালের ১০ অক্টোবর মুন্সিগঞ্জ জেলায়। স্কুল জীবনেই অনিল মুখার্জি জন রীডের সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উপর রচিত ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ পড়ে ব্যাপকভাবে আলোড়িত হন। ১৯২৯ সালে মুন্সিগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পাশ করেন । পরে মুন্সিগঞ্জ সরকারী কলেজে ইন্টার মিডিয়েট ভর্তি হন। এ সময় সারা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। ১৯৩০ সালে কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন তিনি। সেই আন্দোলনেই প্রথম গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর ব্রিটিশ সরকার প্রথমে তাঁকে মেদিনীপুর ও হিজলি জেলে আটক করে রাখে। পরে তাঁকে আন্দামান জেলে নির্বাসিত করা হয়।
আন্দামান তখন কালাপানির দ্বীপ। তখন সেখানে বন্দিদের পাঠানো হত ‘মহারাজ জাহাজে’ করে। ১৯৩৩ সালে আন্দামান সেলুলার জেলে থাকাবস্থায় সেখানকার বন্দিরা জেল জীবনের দুঃসহ জীবনের প্রতিবাদে চিফ কমিশনারের কাছে তিনদফা দাবীনামা পেশ করেন। এই তিন দফা দাবির মধ্যে ছিল-ভালো খাদ্য, জেলে আলোর ব্যবস্থা এবং বই ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ দেয়া। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে দাবি না মানলে বিপ্লবীরা অনশন শুরু করেন। অনশন অবস্থায় তিনজন বিপ্লবীকে জোর করে খাওয়াতে গিয়ে হত্যা করে জেল কর্তৃপক্ষ। এই খবর বাংলায় ছড়িয়ে পড়লে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে জেলের ভিতরে ও বাইরে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাহাত্মা গান্ধীসহ অনেক দেশবরেণ্য নেতাই বিপ্লবীদের অনশন থামানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। একটানা ৪৬ দিন অনশন করার পর বিপ্লবীদের দাবি মেনে নেয় কর্তৃপক্ষ।
আন্দামানকে তখন বলা হত বিপ্লবীদের মার্কসিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই মূলত বিপ্লবীরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়ে রাজনৈতিকভাবে শ্রেণী-সংগ্রামের ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলায় সচেষ্ট হন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৩৩ সালে অনিল মুখার্জিসহ ৩২ জন বিপ্লবী জেলখানায় কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গড়ে তোলেন। জেলখানায় এটিই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম শাখা। ১৯৩৭ সালের ২৫ জুলাই আন্দামান জেলের বন্দীরা পুনরায় তিন দফা দাবিতে অনশন শুরু করেন। এবারের তিন দফা দাবি ছিল- সকল রাজবন্দীদের মুক্তি, আন্দামান বন্দীদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত সব রাজনৈতিক বন্দীকে কমপক্ষে ডিভিশন ‘টু’-র বন্দী হিসেবে গণ্য করা। এতে বিভিন্ন জেলের অন্যান্য বন্দীরাও অংশ নেয়। একটানা ৩৭ দিন অনশন-আন্দোলনের এক পর্যায়ে বন্দীরা দেশে ফেরার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।
জেলে থাকার সময় এমিল জোলারের “জার্মিনাল” উপন্যাসটা পড়েন তিনি। এ বইটা পড়ার পর সর্বপ্রথম শ্রমিকদের সম্পর্কে তাঁর একটা আগ্রহের সৃষ্টি হয় এবং তাদের শক্তি সম্বন্ধে আস্থার সৃষ্টি হয়। এ বইটা তাঁকে যেভাবে শ্রমিকদের দিকে আকৃষ্ট করে, আর কোন বই তাঁকে এভাবে আকৃষ্ট করেনি।
বইটি পড়ার পর মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যে মুক্তি পেয়ে মজুরদের ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। তিনি মনে করেন শ্রমিক শ্রেণীকে সমগ্র দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের ও ভাগ্য নির্ণয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তাই দেশের সর্বত্রই মজুরদের সংগঠিত ও সচেতন করার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
১৯৩৮ সালে অনিল মুখার্জি মুক্তি পেয়ে সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। জেল হতে বেরিয়ে প্রথমেই মুজফ্ফর আহমদ ও সোমনাথ লাহিড়ীর সাথে কথাবার্তা বলেন তিনি। তাঁরা তাঁকে নারায়ণগঞ্জে কাজ করার জন্য উৎসাহ দেন। কয়েকদিন পরে তিনি মুন্সিগঞ্জে চলে আসেন। তাঁর বাবা-মা তখন মুন্সিগঞ্জে থাকতেন। মা-বাবা ভাই-বোনদের সাথে পুরো একমাস থাকার পর ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন।
মূলত তিনি কাজ করেন নারায়ণগঞ্জ শ্রমিকদের মধ্যে। নারায়ণগঞ্জে অনিল মুখার্জি এবং তাঁর দুজন বন্ধু প্রফুল্ল চক্রবর্তী ও বঙ্কিম চক্রবর্তী একত্রে মজুরদের মধ্যে যেতেন। প্রফুল্ল চক্রবর্তী ও বঙ্কিম চক্রবর্তী আগে থেকেই এ কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রথমে অনিল মুখার্জির কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না, এমনকি জীবনে কোন মজুরের সাথে পরিচয়ও হয়নি তাঁর। একমাত্র কিছুটা কেতাবি বিদ্যাই তাঁর সম্বল ছিল। প্রফুল্ল চক্রবর্তী ও বঙ্কিম চক্রবর্তীকে শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। যে কোন জায়গায় মজুরদের মধ্যে কোন বিক্ষোভের খবর পেলে ছুটে যেতেন তাঁরা। ধর্মঘট করে শ্রমিকের কিছু দাবি দাওয়া আদায় করা এবং শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠন করাই ছিল তখন তাঁদের প্রধান লক্ষ্য। ধর্মঘট করলেও ধর্মঘট টিকিয়ে রাখার জন্য পিকেটিং করার কাজে কোন মজুর এগিয়ে আসত না। তাঁরা শেষ রাত হতে বেলা দুপুর পর্যন্ত ঐ কাজ করতেন। তাঁরা যখন পিকেটিং করতেন তখন মজুরেরা কেউ কারখানায় ঢুকত না, তা না হলে সর্দার অথবা কোন অফিসারের ধমকে ভয় পেয়ে শ্রমিকরা কারখানায় ঢুকে পড়ত। কোন কোনদিন নারায়ণগঞ্জের কিছু কিছু রাজনৈতিক কর্মী তাঁদের সাথে ধর্মঘটে যোগ দিতেন। তাঁদের সংখ্যা বেশি হলে মজুররাও দু’চার জন তাঁদের সাথে যোগ দিত। বড় কোন ধর্মঘট হলে ঢাকা হতে গোপাল বসাক এবং আরও দু’চারজন কর্মী তাঁদের সাহায্য করতেন।
কয়েকমাসের মধ্যেই প্রায় সবগুলো বড় বড় পাট কোম্পানীতে ধর্মঘট হয়ে গেল। ধর্মঘটের হিড়িক পড়ে গেল। শ্রমিকরা নিজেরাই ধর্মঘট করে বসত, তারপর পিকেটিং করা এবং ধর্মঘট পরিচালনায় সাহায্য করার জন্য শ্রমিকরা অনিল মুখার্জিদের কাছে আসত। দিনরাত অনিল মুখার্জি ব্যস্ত থাকতেন। বইপত্রতো দূরের কথা, দৈনিক পত্রিকা দেখারও সময় পেতেন না। এতে তাঁর খুব মন খারাপ হতো। গোপাল বসাক ছিলেন অসম্ভব পড়ুয়া ব্যক্তি। তিনি বিখ্যাত মিরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলার বন্দীদের অন্যতম। তিনি ঢাকা জেলার মজুর আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। গোপাল বসাক নতুন নতুন বইয়ের কথা অনিল মুখার্জিকে বলতেন। তাঁর কথা শুনে অনিল মুখার্জির মন আরও খারাপ হতো। একদিন তাঁকে অনিল মুখার্জি সমস্যাটা বললেন। গোপাল বসাক উত্তর দিলেন, এর মধ্যেই পড়া যায় এবং পড়তে হবে। আন্দোলনের কাজ তো আর বই পড়ার অবসরের জন্য বন্ধ রাখা চলে না। অনিল মুখার্জি বললেন, সেকথাতো সত্য, কিন্তু পড়ব কখন? তিনি বললেন, বইয়ের মায়া ত্যাগ করুন। ছোট বইয়ের মলাট ছিঁড়ে ফেলে বই পকেটে রাখবেন, বড় বই হলে তার সেলাই কেটে একটা দু’টো করে পরিচ্ছেদ পকেটে রাখবেন। যতই কাজের মধ্যে ডুবে থাকুন, কাজের জায়গায় কাজের ফাঁকে ফাঁকে আধঘণ্টা একঘণ্টা সময় মাঝে মাঝে থাকেই, তখন ওগুলো পড়বেন। এভাবে পড়ার অভ্যাস না করলে আর পড়া হবে না। পড়ার জন্য অবসরের আশায় অপেক্ষা করলে আন্দোলনের কর্মীরা সব অজ্ঞই থেকে যাবে। গোপাল বসাকের এই উপদেশ অনিল মুখার্জির খুবই সাহায্যে লেগেছে। তখন হতে সব সময়ই পকেটে দু’তিনঘণ্টা পড়ার মত মশল্লা নিয়ে বাসা থেকে বের হতেন তিনি।
১৯৪৬ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ সুতাকল শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। কয়েক বছরের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের এই আন্দোলন সারা ভারতের অন্যতম ট্রেড ইউনিয়নের মর্যাদা লাভ করে।
কিশোর বয়সে রাজনীতিতে নামার পর থেকে নিজের জীবনের সুখ-সম্ভোগের চিন্তা অনিল মুখার্জির মনকে কোন দিন পীড়া দেয়নি। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার পূর্বে তাঁর নিজের মায়ের দুঃখ দেখে, পরিবারের অভাব দেখে, মনটা মাঝে মধ্যে বিগড়ে যেত, ঘরমুখো হতে চাইতো মনটা। দু’টা ঘটনা তাঁর মনে ভয়ানক তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।
তাঁর কনিষ্ঠ ভাই খুব রুগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে পড়াশোনা করেও আই.এস.সি পরীক্ষাতে খুব ভাল ফল করলেন। তাঁর পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছা ছিল । কিন্তু তাঁর বাবা বললেন, “ঢাকায় হোস্টেলে রেখে বি.এস.সি পড়াবার মত সঙ্গতি এখন আমার নেই। তাছাড়া ওদের পড়াবার জন্য সবাই মিলে এত কষ্ট করব কেন? ওরা লেখাপড়া শিখে সব স্বদেশী করবে, সংসার তো দেখবে না!”
বাবার একথা শোনার পর তাঁর ছোট ভাই খুব মন খারাপ করল । এ ভাইটি ছিল অনিল মুখার্জির খুব আদরের। সে চিররুগ্ন, বয়সেও তাঁর বার-তের বছরের ছোট। অনিল মুখার্জির মন খুব খারাপ হলো। কিছুতেই মনটাকে সুস্থির করতে পারছিলেন না। বিকালে ছোট ভাইকে নিয়ে বেড়াতে বেরুলেন। সোজাসুজিই তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, তুই কি এমন চিন্তা করিস যে তোর পড়া চালাবার জন্য মজুর আন্দোলন ছেড়ে আমি একটা চাকরি করি?” সে খুবই সুস্পষ্ট ও দৃঢ় জবাব দিল, “না, আমি কখনো তা চাইনে।” একথা শোনার পর অনিল মুখার্জি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
আর একদিনের ঘটনা। অনিল মুখার্জির মা হাঁপানি ও পেটব্যথার রোগী, চোখেও কম দেখেন। বৃদ্ধ বয়সে অতিরিক্ত রক্তচাপের ফলে মাথা ঘোরে, হাত কাঁপে। ব্রাহ্মণ বিধবা, আমিষ ছোঁয়া খান না। ফলে নিজেই রান্না করেন, সকালের দিকে হাঁপানির বেশী প্রকোপ থাকলে বা পেটব্যথা উঠলে রান্না করে খেতে খেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এ রকম অসুস্থ অবস্থায় রান্না করতে যেয়ে একদিন তাঁর ডান হাতের অনেকটা পুড়ে গেল। অনিল মুখার্জি তখন সামনে ছিলেন। তাঁর মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তুই যদি চাকরি করতি তা হলে আমার জন্য অন্তত একজন রাঁধুনি রেখে দিতে পারতি। সারা জীবনই তো কষ্ট করলাম। এখন এই বুড়ো বয়সে আর হাত পুড়ে পুড়ে ছাইভস্ম খেতে ইচ্ছে হয় না। আগে তবু রান্না করে সবাইকে খাওয়াতাম। এখন শুধু নিজের পেটে দেওয়ার জন্য রোজ রোজ হাত পুড়ে রান্না করা! নিজের পেটের উপযুক্ত সন্তান থাকতে অদৃষ্টের এই লিখন!” মার মুখ থেকে এই দুঃখ প্রকাশ হওয়ায় তাঁর মনটা খুব বিচলিত হয়েছিল। মনটা শান্ত করতে বেশ কয়েক দিন সময় লেগেছিল।
কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দেয়ার পর শত শত ভাইবোন ও মার সাথে তাঁর পরিচয় হয়। পরে আর কোনদিন তাঁর মন বিষন্ন হয়নি। তিনি ভাবেন, ওরাও তো তাঁর আপন ভাইবোন ও মায়ের চেয়ে কম নয়। এদের জীবনে দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা তাঁর মা ভাই-বোনের চেয়ে বেশী বই কম নয়। এরাও তাঁর নিকট আশা করে। এদের আকাঙ্খা পায়ে দলবেন? এদের উপর অত্যাচার, এদের দুঃখ-দারিদ্র্য সয়ে যাবেন? এদের ভুলে যাবেন? এদের ত্যাগ করবেন? একের জন্য সহস্রকে ভুলে যাওয়া, সহস্রকে ত্যাগ করা- তা হবে অন্যায়, অপরাধ, অতি ক্ষুদ্র হীন স্বার্থপরতা। তেমন জীবনে আনন্দ কোথায়, তৃপ্তি কোথায়। শত শত শোষিত নিপীড়িত ভাইবোন ও মায়েদের সংস্পর্শে আসার ফলে জীবনের একটা বৃহত্তর অর্থ পেয়েছেন তিনি। ত্যাগ, ধৈর্য, সাহস ও মমত্ববোধ যে কত মহৎ স্তরে পৌঁছুতে পারে তা এদের কাছেই শিখেছেন তিনি। এরাই তাঁকে শক্তি জুগিয়েছে। বিপ্লবী আদর্শে দৃঢ় রেখেছে, সংগ্রামী দৃঢ়তা শিখিয়েছে।
১৯৩৯ সালে ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘের শাখা গড়ে ওঠে। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, সোমেন চন্দ্র প্রমুখের সাথে অনিল মুখার্জি সেই সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রাখেন।
১৯৩৮ সালে জেল থেকে বেরুনোর পর অনিল মুখার্জি হাত দেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘সাম্যবাদের ভূমিকা’ লেখার কাজে। ১৯৪২ সালে রচিত এটি তাঁর প্রথম ও শ্রেষ্ঠ বই। এখন পর্যন্ত এর প্রায় দশ-বারোটি সংস্করণ বেরিয়েছে। এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমানভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এই বই খুব কঠোরভাবে বেআইনি করে রাখা হয়। তখন অনেকেই এই বইটি হাতে হাতে লিখে নিজেরা পড়তেন ও শ্রমিকদের পড়তে দিতেন। ১৯৬৫ সালে বইটি গোপনে প্রকাশ করা হয়েছিল। পরে ১৯৭০ সালে ‘সাম্যবাদের ভূমিকা’ ও ‘শ্রমিক আন্দোলনের হাতেখড়ি’ বই দু’টির প্রকাশ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
দেশভাগের পর এদেশের অনেক কমিউনিস্ট নেতাই দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তখন বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছিল। কিন্তু অনিল মুখার্জি দেশত্যাগ করতে করেননি। তাঁর পরিবারের অন্যান্যরা দেশত্যাগ করলেও তিনি থেকে গেলেন এদেশেই।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এদেশে কমিউনিস্ট পার্টি আবার নিষিদ্ধ হয়। কিছুদিন পর আবার গ্রেফতার হন অনিল মুখার্জি। এবার পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের হন ১৯৫৫ সালে। কিন্তু জেল থেকে বের হলেও তিনি সহ অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতারা প্রকাশ্যে পার্টির কোনো কাজ করতে পারতেন না। কারণ তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই পাকিস্তান সরকার হুলিয়া জারি করে রেখেছিল। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই সতের বছর তিনি একটানা আত্মগোপনে কাটিয়েছেন। ১৯৫৬ সালে পার্টির তৃতীয় সম্মেলনে তিনি কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে অনিল মুখার্জি প্রথমবার মস্কো সফর করেন। সেখানে তিনি বিশ্বের পঁচাত্তরটি দেশের পার্টির মহাসম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেন।
একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আত্মগোপন অবস্থা থেকেই ভারতে চলে যান। সেখানে তিনি পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সেসময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘মুক্তিযুদ্ধ’-এ লিখতেন ‘স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামের পটভূমি’। যা পরবর্তীকালে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে তিনি আবার ঝাপিয়ে পড়েন দেশ পুনর্গঠনের কাজে। পাশাপাশি পার্টিকে গড়ে তোলার কাজে নেমে পড়েন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় ও ১৯৮০ সালে পার্টির তৃতীয় সম্মেলনে অনিল মুখার্জি সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির অন্যতম রূপকার। সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি অনিল মুখার্জি প্রচুর লেখালেখিও করেছেন। তিনি সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক সংবাদ সহ অসংখ্য সংকলনে লিখেছেন। পাকিস্তান আমলে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘শিখা’য় তিনি আলীম ছদ্মনামে লিখতেন। এছাড়াও শিশুদের জন্য গল্প লিখেছেন যা ‘হারানো খোকা’ নামে গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয়েছে। অনিল মুখার্জি বেশ কিছু কবিতাও লিখেছেন। আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি ১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: ১৯৮৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে মতিউর রহমান রচিত ও একতায় প্রকাশিত ‘আমাদের রাজনীতির হাতেখড়ি’ ও ২০০৯ সালে বইমেলায় প্রকাশিত মাহফুজা খানম ও তপন কুমার দে রচিত ‘গণমানুষের মুক্তির আন্দোলনে’ এবং অনিল মুখার্জি রচিত ‘হাতেখড়ি’ বই থেকে তথ্য নিয়ে এই লেখাটি তৈরি করা হয়েছে। ‘গণমানুষের মুক্তির আন্দোলনে’ বইটি প্রকাশ করেছেন ডা. মাহফুজ শফিক। ‘হাতেখড়ি’ বইটির প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা এবং প্রকাশনী মুক্তধারা।
লেখক: মৌরী তানিয়া ও চন্দন সাহা রায়