১৯০৮ সালের ১লা মে, ওয়ার্নি স্টেশন থেকে গ্রেফতার করা হয় ক্ষুদিরাম বসুকে। ব্রিটিশ প্রশাসনের হাই-কমান্ড কলকাতার পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেয় ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর সাথে জড়িত সকলকে গ্রেফতার করার জন্য। ২ মে কলকাতার ব্রিটিশ প্রশাসনের পুলিশ আটটি স্থানে খানা-তল্লাশি চালায়। কলকাতার মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত ও নলিনীকান্ত গুপ্তসহ ১৪ জন বিপ্লবীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ৪৮নং গ্রে স্ট্রিট থেকে অরবিন্দ ঘোষ সহ তিনজন বিপ্লবীকে, ১৩৪নং হ্যারিসন রোড থেকে ৫ জন বিপ্লবীকে, রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে হেমচন্দ্র কানুনগোকে (হেম দাশ), গোপীমোহন দত্ত লেন থেকে কানাইলাল দত্তসহ দুইজন বিপ্লবীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এছাড়া ১৩৪নং হ্যারিসন রোডের বাড়ি থেকে পুলিশ প্রচুর পরিমাণে বোমা তৈরির মাল-মশলা ও সাজসরঞ্জাম উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। পুলিশ ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে মাটির তলায় পোঁতা কয়েকটি ট্রাঙ্ক উদ্ধার করে। এই সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বোমা ষড়যন্ত্র ও রাজদ্রোহের অভিযোগে মামলা। এই মামলাটিরই নামকরণ হয়েছিল ‘আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা’।
আলিপুর জজ আদালতে জেলা ও দায়রা জজ মি. চার্লস পোর্টেন বিচক্রফট এর আদালতে ‘আলিপুর বোমা মামলা’র সূচনা হয়েছিল ১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর। মামলায় অরবিন্দ ঘোষের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায় একমাত্র চিত্তরঞ্জন দাশ বিনা টাকায় লড়েন। আসামীদের বিরুদ্ধে এই মামলা চলে ১২৬ দিন। দু’শর বেশি সাক্ষীকে জেরা করা হয়। ৪০০০ কাগজপত্র এবং ৫০০ জিনিসপত্র প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর সওয়াল জওয়াবের সমাপ্তি বক্তব্য দেন ৯ দিন ধরে। আলীপুর মামলার শুনানী শেষ হয় ১৯০৯ সালের ১৩ এপ্রিল এবং মামলার রায় ঘোষণা হয় ৬ মে। মামলার রায়ে ৩৬ জন আসামীর মধ্যে বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ এবং বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। অন্য ১৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দ্বীপান্তর ও কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ও বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত ১৩ মে হাইকোর্টে আপীল করেন। আপিল মামলার বিচারক ছিলেন কার্নডফ ও জেনিকসন। ১৯০৯ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করে। উক্ত রায়ে বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ এবং বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির আদেশ রদ করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেয়া হয়।
সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যাঁরা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশ-শাসনকে উচ্ছেদ করতে চাইবে, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে রেহাই পাবে তাঁদের সকলকে আন্দামানে পাঠানো হবে। আন্দামান ছিল ব্রিটিশদের তৈরী করা সবচেয়ে ভয়ংকার জেল, যাকে বলা হত দ্বিতীয় মৃত্যুকূপ। আন্দামান সেলুলার জেল খোপ খোপ করা বিশাল এক কারাগার। দুর্ধর্ষ, সশস্ত্র বিপ্লববাদী বন্দীদের নির্যাতন করে মারার জন্য এখানে পাঠানো হতো। এখানে গেলে কেউ আর কোনো দিন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পারতেন না। কালাপানি, আন্দামান, দ্বীপান্তর এই তিনটি শব্দ দিয়ে মূলত “আন্দামান সেলুলার জেলকে” বুঝানো হয়। বর্তমানে এই সেলুলার জেলটি অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘরে পরিণত হয়েছে।
উল্লাসকর দত্ত ছিলেন অগ্নিযুগের উষালগ্নের সশস্ত্র বিপ্লবীদের মধ্যে অন্যতম বিপ্লবী। ভারতের স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজী রেখে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। যৌবনের শুরুতে সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল ‘যুগান্তরে’র সাথে যুক্ত হন। ব্রিটিশদেরকে মোকাবিলা করার জন্য উল্লাসকর দত্ত বাংলায় প্রথম বোমা তৈরি করেন। যে বোমা ক্ষুদিরাম কিংসফোর্টের গাড়ি লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করেছিলেন।
বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত জন্মেছিলেন ১৮৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল। ত্রিপুরার (বর্তমান ব্রহ্মণবাড়িয়া জেলা) কালীকচ্ছ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম দ্বিজদাস। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী। দেশপ্রেম ও মানবদরদী বাবার যোগ্য উত্তসূরী হতে পেরেছিলেন উল্লাসকর দত্ত। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর তিনি কলকাতার একটি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর উল্লাসকর দত্ত ১৯০৩ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও তিনি প্রচুর বই পড়তেন। সংগীতে এবং ক্যারিকেচারে (ব্যঙ্গচিত্রে) তাঁর ছিল দক্ষতা। এই কলেজে পড়ার সময় ইংরেজ অধ্যাপক ড. রাসেলের এক অপমানকর উক্তির প্রতিবাদ করায় তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখন থেকে লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে তাঁর। ১৯০৪ সালে শুরু হয় এক নতুন জীবন। এই সময় তিনি বিপ্লবীবাদী কর্মকাণ্ডের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং অল্পদিনের মধ্যে বারীন্দ্র ঘোষের বিপ্লবী দলে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে উল্লাসকর দত্ত বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে ওঠেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে উল্লাসকর দত্ত এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বিলাতী পোষাক ছেড়ে ধুতি পরা সাধারণ বাঙালির জীবনে ফিরে আসেন। ১৯০৬ সালের দিকে তিনি বেশ কিছু যুবক নিয়ে এলাকায় গড়ে তোলেন এক বিপ্লবী দল। এই দলটির ঘাঁটি স্থাপন করেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। বাড়িতেই রাখতেন পিস্তল, বোমাসহ বিপ্লবীদের বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র।
এসময় একদিন উল্লাসকর দত্তের ছোট ভাই তাঁর বিছানায় একটি বোমা পেয়ে তা বাড়ির সামনের বাগানে নিক্ষেপ করেন। ছোড়ামাত্র বিকট শব্দে বোমাটি ফেটে যায়। শব্দটি অদূর গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে শুরু হয় পুলিশী তৎপরতা। পুলিশী তৎপরতার কারণে উল্লাসকর দত্ত আত্মগোপন করে কলকাতার মানিকতলার মুরারীপুকুর পারের বাগানে চলে যান।
বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের অনুপ্রেরণায় ও তাঁর ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতার ৩২নং মুরারিপুকুরে তৈরি হয় সশস্ত্র বিপ্লবী ‘অনুশীলন সমিতি’। সশস্ত্র বিপ্লবী বারীন ঘোষ তাঁর দলের আখড়া গড়েছিলেন এই মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে। এই বাগানবাড়ির মাঝখানে ছিল ছোটো ধরনের একটি পাকাবাড়ি। বাড়িটির চতুর্দিকে ছিল গাছপালা। অরবিন্দ ঘোষ এবং অপর দুই ভাই মনোমোহন ঘোষ ও বিনয় ঘোষ এই বাগানবাড়িটিতে বসবাস করতেন। অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন বিপ্লবীদের শ্রদ্ধেয় তাত্ত্বিক নেতা ও স্বদেশি কাগজ ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেই বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, হেমচন্দ্র ঘোষ, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অবিনাশ ভট্টাচার্যর মতো বিপ্লবীরা দলের নীতি নির্ধারণ করতেন। ১৯০৭ সালে ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটি হয়ে উঠে সশস্ত্র বিপ্লবীদের মূল কেন্দ্র। এখানে বিপ্লবীদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হত। কুস্তি শিক্ষা, লাঠি খেলা, ছোরা চালনা, পিস্তল চালনা, বোমা তৈরীসহ বোমা ফাটানোর শিক্ষা দেয়া হত। এ কেন্দ্রে সব সময়ই বেশ কয়েকজন বিপ্লবী কর্মী স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন।
ওই সময় বিপ্লবীরা ভাবলেন, যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সহজে বহন করা যায় এবং যা নিয়ে সহজে চলাফেরা করা যায় তা দিয়ে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ করা সহজ হবে। তাই তাঁরা বোমা ও পিস্তলকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার জন্য বেছে নিলেন। কাজেই বিপ্লবীদের প্রচুর বোমার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর সেই বোমা তৈরীর কারখানা করা হয় মুরারীপুকুরের বাগান বাড়িতে। এসময় বেশ কয়েকজন বিপ্লবী বোমা তৈরী ও গবেষণার কাজে নিয়েজিত হন। মূল দায়িত্বে ছিলেন উল্লাসকর দত্ত ও হেমচন্দ্র দাশ। তাঁদের একাজে সহযোগিতা করেন প্রফুল্ল চন্দ্র। অনেক চেষ্টার পর ১৯০৮ সালের শুরুর দিকে উল্লাসকর দত্ত ও হেমচন্দ্র দাশ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বোমা তৈরী করতে সফল হন।
উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বোমা তৈরীর পর এটিকে ফাটিয়ে পরীক্ষা করে দেখার পালা। সিদ্ধান্ত হলো দেওঘরের নিকট একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ের উপর নির্জন স্থানে বোমার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে। ১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বোমাটি সাথে নিয়ে ৫ জন বিপ্লবী দেওঘর পাহাড়ে পৌঁছলেন। উক্ত বিপ্লবী দলে ছিলেন বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, প্রফুল্ল চন্দ্র চক্রবর্তী, বিভূতিভূষণ সরকার ও নলিনীকান্ত গুপ্ত। দিঘিরিয়া পাহাড়ের একেবারে মাথার উপর একটা পাথরের গায়ে ছুঁড়ে বোমা পরীক্ষা করার জন্যে প্রস্তুত হলেন বিপ্লবীরা। পরিকল্পনা করা হয় পাহাড়ের গায়ে বোমা ছুঁড়বে বিপ্লবী প্রফুল্ল চন্দ্র চক্রবর্তী আর তাঁর পাশে থাকবেন উল্লাসকর দত্ত। বোমা ছোঁড়ার সাথে সাথে বিকট শব্দ হয়ে তা ফেটে যায়। শব্দের সাথে সাথে জ্বলে উঠে আগুনের ফুলকী এবং কিছুটা ধোয়া। বেশ কিছু দূর থেকে অন্য ৩ জন বিপ্লবী বোমা ফাটার শব্দ শুনে এবং আগুন ও ধোয়া দেখে “সাকসেসফুল সাকসেসফুল” বলে চিৎকার দিয়ে উঠেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁরা এগিয়ে এসে দেখেন প্রফুল্ল চন্দ্রের মৃতদেহ পড়ে আছে উল্লাসকর দত্তের বুকের ওপর। তাঁর কপালের এক পাশ চৌচির হয়ে ঘিলু বের হয়ে পড়েছে। উল্লাসকর দত্তও আহত হয়েছেন। মৃত প্রফুল্লকে পাহাড়ে রেখে আহত উল্লাসকর দত্তকে নিয়ে বিপ্লবীরা চলে আসেন আস্তানায়। কলকাতায় বিপ্লবীদের একজন বিশ্বস্ত ডাক্তার ছিলেন ইন্দুমাধব মল্লিক। তাঁর চিকিৎসায় দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। বোমা তৈরীর পর বিপ্লবীদের তৎপরতা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। বোমার কার্যকারিতা পরীক্ষার পর ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীকে মজফফরপুরে পাঠানো হয় অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য। দুর্ভাগ্যক্রমে কিংসফোর্ডের বদলে তাঁদের বোমায় কেনেডি নামক এক ইংরেজ আইনজীবির পত্নী ও কন্যা নিহত হয়।
ফলে ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয়। মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িসহ কলকাতার অন্যান্য স্থান থেকে ৩৬ জন বিপ্লবীকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে। এদের নামে ‘আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়। উল্লাসকর দত্ত ও বারীন্দ্র কুমার ঘোষকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেওয়া হয়।
আন্দামান সেলুলার জেলে থাকার সময় বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তকে সরষে পেষার ঘানিতে কাজ করা, প্রচণ্ড রোদে মাটি কেটে ইট বানানো, গাছ কেটে লাকড়ি বানানোসহ আরো অনেক কাজ করতে হতো। এরপরও তাঁর উপর চলতো নানাধরনের নির্যাতন। দু’হাত ওপরের দিকে তুলে দেওয়ালে দাঁড় করিয়ে বেঁধে চালানো হতো জঘন্য অত্যাচার। এসমস্ত কারণে উল্লাসকর দত্ত শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ্ হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তাঁকে মাদ্রাজের পাগলা গারদে নিয়ে আসা হয়। সুস্থ্ হয়ে উঠার পর শাস্তির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। প্রতিদিন সকালে তাঁর মাথা চট দিয়ে ঢেকে লোহার দণ্ড দিয়ে আঘাত করা হত। এই আঘাতের কারণে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। ১৯২০ সালে তিনি মুক্তি পান।
মুক্তি পাওয়ার পর আর তিনি আর সক্রিয় বিপ্লববাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে পারেননি। তার মূল কারণ ছিল দীর্ঘ দিনের অত্যাচার-নির্যাতনে তিনি শারীরিক ও মানুষিকভাবে সুস্থ্ ছিলেন না। তিনি পুরোপুরি সুস্থ্ হয়ে উঠতে প্রায় এক দশক সময় চলে যায়। ১৯৩১ সালে আবারও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাঁকে বিনা বিচারে ১৮ মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আর রাজনীতিতে যুক্ত হননি। দ্বীপান্তরে যাওয়ার পূর্বেই বিপিন চন্দ্র পালের বিধবা মেয়ে লীলাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু আলিপুর মামলার রায়ের কারণে তাঁদের আর ঘর-সংসার করা হয়ে উঠেনি। ১৯৪৮ সালে নিজের ৬৩ বছর বয়সে ৫৮ বছরের লীলাদেবীকে নিয়ে জীবনের বাকী দিনগুলো কাটানো সিদ্ধান্ত নিলেন উল্লাসকর দত্ত। তাঁরা উঠলেন রামমোহন লাইব্রেরির বারান্দায়। কিছু দিন ছিলেন বৌ-বাজারের এক হোটেলে। স্বাধীন ভারত সরকার কর্তৃক স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদানের জন্যে ভাতা মঞ্জুর করলে তিনি তা গ্রহণে অস্বীকার করেন। তিন বছর পর ১৯৫১ সালে তাঁরা শিলচরে আসেন। শেষ জীবনের ১৪টা বছর এ শহরেই কাটান। তখন তিনি আর বিপ্লবী নন। ব্রিটিশের নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারানো এক উদাসী মানুষ। সঙ্গে তাঁর পক্ষাঘাতে পঙ্গু স্ত্রী। শিলচরের মানুষই তখন তাঁদের থাকা-খাওয়া-চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে লীলাদেবীর মৃত্যু হয়। ১৯৬৫ সালের ১৭ মে তিনিও চলে গেলেন আমাদের স্মৃতির পাতায়।
উল্লাসকর দত্ত ‘দ্বীপান্তরের কথা’ এবং ‘আমার কারাজীবন’ নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের জীবনকথা: তপন কুমার দে। জাগৃতি প্রকাশনী, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারী ২০০৫।
২। অগ্নিযুগের ইতিহাস: ব্রজেন্দ্রনাথ অর্জুন। প্রকাশক: মুক্তধারা। প্রকাশকাল; ডিসেম্বর ১৯৭৯। (ছবি)
৩। বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা: হেমচন্দ্র কানুনগো। চিরায়ত প্রকাশনী, কলকাতা। প্রকাশকাল: জুন, ১৯২৮।
৪। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা।
৫। বাংলার মুক্তি সন্ধানী: সব্যসাচী চট্টপাধ্যায় ও রাখী চট্টপাধ্যায়। প্রকাশকাল ২০০৫, কলকাতা।
লেখক: রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)