“পাখিরা যেমন বিস্তৃত সীমাহীন আকাশে পাখা মেলে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায়। ঠিক তেমনি স্বাধীনভাবে মানুষও পাখির মতই বাঁচবে। সেখানে থাকবে না কোনো শোষণ, বৈষম্য অন্যায়-অবিচার, থাকবে না কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা। সব মানুষের একটি দেশ থাকবে, যার নাম হবে সাম্য- ভালবাসার পৃথিবী”। এমন একটি মতাদর্শ যে মানুষটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবার জন্য কখনো ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, রাশিয়া কখনো বা এশিয়ার পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন সেই বিপ্লবীর নাম এম. এন. রায়।
ভারত উপমহাদেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। তিনি একজন বিপ্লবী, তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ছিলেন। শুধু সর্বভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট রাজনীতিতেও তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমৃত্যু লড়াই করেছেন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে গড়ে তুলেছিলেন নিজেকে। মানবমুক্তির জন্য সারা জীবন কাজ করে গেছেন তিনি।
এম. এন. রায়ের প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৭ সালের ২২ মার্চ। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বেলিয়া গ্রামে। বাবা-মার চতুর্থ সন্তান তিনি। বড় হয়েছেন একটি কুসংষ্কার মুক্ত পরিবারে, যা তাঁর চিন্তা-প্রজ্ঞাকে বিকাশিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়তা করে।
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। বাবার কাছে প্রাইমারী পাঠ শেষ করেন। এরপর ১৮৯৭ সালে তাঁর স্কুল জীবন শুরু হয়। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি নানা বিষয়ে গভীর ভাবে পড়াশোনা করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন সারা ভারতবর্ষকে আলোড়িত করে, তখন দেশ, মা, মাটির প্রতি তীব্র ভালোবাসা নরেন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে। তাই পড়াশোনা ত্যাগ করে তিনি অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের বিপ্লবী দল অনুশীলন-এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। কিছু দিনের মধ্যে তিনি বিপ্লবী দলের তুখোড় সংগঠক হয়ে উঠেন।
পরিবারের অনুরোধে তিনি ১৯০৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর আর তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা করেননি। প্রবেশিকা পরীক্ষার পর তিনি সার্বক্ষণিক বিপ্লববাদী ‘অনুশীলন সমিতি’র কাজে যুক্ত হন। এই সময় তিনি উপলদ্ধি করেন, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করতে হলে অস্ত্রের প্রয়োজন। সেজন্য লাগবে অর্থ। একারণে বিপ্লবীরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার মধ্যে একটি পদক্ষেপ ছিল- ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারী অর্থ লুট করা। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তাই তাঁরই নেতৃত্বে ১৯০৭ সালে চিড়িং পোতা রেলস্টেশন লুট করা হয়। যা ছিল ভারত উপমহাদেশে প্রথম কোনো রাজনৈতিক ডাকাতি।
১৯১০ সালে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য গ্রেফতার হন। তাঁর বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণ উপস্থিত করতে না পারায় তিনি মুক্তি পান। জেল থেকে বের হয়ে কঠিন সংকটময় পথ পাড়ি দিয়ে ডাচ-ইষ্ট-ইন্দোচীন প্রভৃতি বহু অঞ্চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বৈপ্লবিক সংগঠনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ১৯১৩ সালে ইন্ডিয়া ইকুইটেবল ইনসুরেন্স কোম্পানীতে চাকরি নেন। পরে চাকরি ছেড়ে হোটেল খোলেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা। তিনি পৃথিবীর নানা স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে দক্ষিণ এশিয়ায় মজুত করেন। এ সময় তিনি বুঝতে পারেন দেশের মেহনতি কৃষক-শ্রমিকদের সুংসগঠিত না করে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব করা হবে ভুল।
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ১৯১৫ সালে সি মার্টিন ছদ্মনামে দেশ ত্যাগ করেন এবং জার্মান হয়ে আমেরিকায় আসেন। এখানে এসে তিনি অতীতের সকল নাম মুছে নতুন একটি ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। সে নামটি হচ্ছে এম. এন. রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায়)। আর এ নামেই তিনি বিশ্বের সমস্ত মানুষের কাছে আজ অবধি পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে তাঁর ভাবনার জগতে এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়। তিনি যুক্তিবাদ ও বুদ্ধির ওপর সুদৃঢ় আস্থা স্থাপন করে তাঁর জীবনকে বিকাশিত করেন। এ সময় তিনি আমেরিকা ও মেক্সিকোতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তখন ইভলিন ট্রেন্টের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। পরে তাঁকে বিয়ে করেন।
১৯১৬ সালে নিউইয়র্ক চলে আসেন এম. এন. রায় । সেখানে তাঁর সাথে দেখা হয় লালা লাজপতি রায়ের। লালাজি ছিলেন একজন মার্কসপন্থী। এখানে এসে রায় মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং মার্কসবাদ চর্চা শুরু করেন। এভাবেই তিনি পেয়ে যান মানবমুক্তির এক আলোকিত দিক-নির্দেশনা। মার্কসবাদ খুব সহজেই আত্মস্থ করেন তিনি। লালাজির সাথে তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেন। একদিন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে একটি সভা শেষ করে ফেরার পথে গ্রেফতার হন । জামিনে ছাড়া পাবার পর মার্কিন গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে মেক্সিকোতে পালিয়ে যান। এখানেও কিছু দিনের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি পান। তিনি যেখানে যেতেন সেখানকার ভাষা, সংস্কৃতি, সহজেই রপ্ত করে নিতে পারতেন। এটা তাঁর একটা অসাধারণ গুণ। তিনি স্প্যানিশ ভাষা শিখে মেক্সিকোর পত্রিকায় লেখা লেখি করেন। ফলে মেক্সিকোর বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাঁর নাম ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে এবং কিছুদিরে মধ্যে সেখানকার রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
১৯১৭ সালে মেক্সিকোতে মার্কিন আগ্রাসন মোকাবেলা করতে সোস্যালিষ্ট পার্টি গড়ে তোলেন এম. এন. রায় । সোসালিষ্ট পার্টি শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের জন্য কাজ করবে এটিই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এজন্য তিনি একটি ম্যানিফেষ্টো রচনা করেন। এই ম্যানিফেষ্টো সারা মেক্সিকোতে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। রাশিয়াতে ঐ সময় লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। ফলে সমাজতন্ত্র যে কেবলই স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব, এটা পৃথিবীর সকল মানব জাতির কাছে প্রমাণিত হয় এবং তা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পায়।
১৯১৮ সালে মেক্সিকোর সোস্যালিষ্ট পার্টির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বসম্মতি ক্রমে রায় পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। ঔ সম্মেলনে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ল্যাটিন আমেরিকান লীগ গঠন করা হয়। সেখানে আহবায়ক কমিটির সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। একই সালে রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির একজন নেতা মাইকেল বারোর সঙ্গে রায়ের পরিচয় হয়। রায় মাইকেল বারোর কাছ থেকে মার্কসবাদ, ইউরোপীয় দর্শন, ইউরোপীয় সভ্যতা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানার সুযোগ পান। ১৯১৯ সালে রায় বারোর সহযোগিতা নিয়ে সর্বসম্মতি ক্রমে সোস্যালিষ্ট পার্টিকে কমিউনিষ্ট পার্টিতে রূপান্তরিত করেন। এটাই ছিল রাশিয়ার বাইরে পৃথিবীর সর্বপ্রথম কমিউনিষ্ট পার্টি।
১৯২০ সালে রায় লেনিনের আমন্ত্রণে মস্কো আসেন। সেখানে রায়ের সঙ্গে লেনিন, ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ ও পরবর্তীতে স্তালিনের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। রায় ও লেনিনের সাক্ষাত একটি উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা। সাক্ষাতের সময় লেনিন তাঁর ঔপনিবেশিক সংক্রান্ত থিসিসটি রায়কে দেন এবং সমালোচনা ও পরামর্শ চান। উপনিবেশগুলোর বৈপ্লবিক কৌশল সম্পর্কে লেনিন যে থিসিস লেখেন তার সাথে রায় একমত পোষণ করেননি।
কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকতাবাদের দ্বিতীয় কংগ্রেসে রায় আলাদাভাবে লিখিত বক্তব্য কংগ্রেসে পাঠ করেন। এবং এ থিসিসটি কংগ্রেসে লেনিনের থিসিসটির পরিশিষ্ট হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু লেনিন কংগ্রেসকে রায়ের থিসিসটি গ্রহণ করার অনুরোধ করেছিলেন। এরপর এম. এন. রায় ভারতে ফিরে আসেন।
১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাশখন্দে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি গঠন করা হয়। যার সেক্রেটারী ছিলেন এম. এন. রায়। ১৯২২ সালে তৃতীয় বিশ্ব আন্তর্জাতিক অধিবেশন বসেছিল মস্কোতে। সেখানে গান্ধীকে নিয়ে লেনিন ও রায়ের মধ্যে মতপার্থক্য হয়। কারণ লেনিন গান্ধীকে বিপ্লবী ভাবতেন। লেনিনের ধারণা ছিলো ইউরোপের মধ্যযুগের বিপ্লবীদের মতো গান্ধীও একজন বিপ্লবী। আর রায় গান্ধী সম্পর্কে বলেন, “গান্ধীর ধর্মীয় ও সামাজিক আদর্শ নিতান্তই- প্রতিক্রিয়াশীল। সুতরাং লেনিনের এ ধারণা যুক্তি সংগত নয়।”
১৯২১ সালে তাশখন্দে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অনুমোদন পায়। এই পার্টির কাজ জার্মানিতেও সম্প্রসারিত হয়। এক্ষেত্রে এম.এন রায় ভূমিকা রাখেন। জার্মানি থেকে ১৯২২ সালের ১৫ মে পার্টির পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকা ডাকযোগে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পাঠানো হত। এক সময় এ পত্রিকা পুলিশের হাতে পড়ে। মুজফফর আহমদ তখন পত্রিকার নাম পরিবর্তনের জন্যে এম. এন. রায়কে লেখেন। এম. এন. রায় পত্রিকাটির নতুন নামকরণ করেন।
১৯২৪ সালে তিনি কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকের সভাপতি মন্ডলীর সম্পাদক হন। ১৯২৪-১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিম ইউরোপে ছিলেন। সেখানে থাকার সময় তিনি জার্মান ও ফ্রান্সে কমিউনিষ্ট আন্দোলন পরিচালনার কাজ করেন। ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকে কার্যকরী সমিতির এক সভা বসে। এ অধিবেশনে এম. এন. রায় আবারও সভাপতি নির্বাচিত হয়।
১৯২৭ সালের মে মাসে চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির পঞ্চম কংগ্রেসে তাঁর পরামর্শ গৃহীত হয়। চীন থেকে তিনি বার্লিন ও মস্কোতে যান। সেখানে এক বছর কাটান। এ সময় ইভলিন ট্রেন্টের সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তিনি মস্কোতে ফিরে আসেন। সেখানে আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট সংস্থার কার্যকরী সমিতির নবম সভাতে যোগদান করেন।
১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে তিনি ভারতে চলে আসেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনকে সংগঠিত করেন। ১৯৩১ সালের ২১ জুলাই বোম্বাইয়ের এক হোটেল থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে কানপুর যড়যন্ত্র মামলা (১৯২৪) দায়ের করেন। তাঁকে ১২ বছর কারাদন্ড দেওয়া হয়। পরে আপিল করা হলে তাঁর সাজা ৬ বছর হয়। এ সময় তিনি জেলখানাতে প্রচুর পড়াশুনা এবং লেখালেখি করেন। জেলখানাতে বসেই বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ ও বই রচনা করেন। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বোম্বাই থেকে ‘Independent India’ নামে একটি সাপ্তাহিক ইংরেজী পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকায় তিনি সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়ে লিখতেন।
১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে এম. এন. রায় কংগ্রেসে যোগদান করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন- “বুদ্ধিজীবী ও ধনীদের হাতে কংগ্রেসের নেতৃত্ব থাকলেও জনগণ কংগ্রেসকে সমর্থন করে। কংগ্রেস হলো ভারতীয়দের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। কমিউনিষ্টদের উচিত কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই কাজ করা এবং ধীরে ধীরে কংগ্রেসকে মাকর্সবাদী রাজনীতি গ্রহণ করানো”। কিন্তু তাঁর এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল তা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়। এম. এন. রায়ের সাথে গান্ধীর শুরু থেকেই মতপার্থক্য দেখা যায়। ফলে কংগ্রেসের মতো একটি বুর্জোয়া শ্রেণীর দল মার্কসবাদকে প্রত্যাখান করে।
১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে গান্ধীকে সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। ত্রিপুরী কংগ্রেসে সুভাষ বসু সভাপতি হয়। গান্ধীবাদীরা সুভাষ বসুর বিরোধিতা করেন। পরে সুভাষ বসু পদত্যাগ করেন কংগ্রেস থেকে। ১৯৩৯ সালের ২৬ মার্চ কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ‘লীগ অব র্যাডিক্যাল কংগ্রেসমেন’ নামে এক সংহতি গঠন করা হয়।
১৯৪০ সালের অক্টোবরে এম. এন. রায় কংগ্রেসকে ত্যাগ করেন। এ বছর ‘লীগ অব র্যাডিক্যাল কংগ্রেসমেন’- এর সিদ্ধান্ত হয় লীগের সমস্ত সভ্য কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করবেন এবং সংগঠনের নতুন নাম হবে ‘র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পিপলস পার্টি’।
১৯৪২ সালে কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের বিরোধিতা করার কারণে এম. এন. রায় ও র্যাডিক্যালদের অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। ১৯৪৪ সালে র্যাডিক্যাল পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলনে স্বাধীন ভারতের সংবিধানের খসড়া গৃহীত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতে যে পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় সেই আশংকার কথা এম. এন. রায় খসড়া সংবিধানের ভূমিকায় উল্লেখ করেন।
১৯৪৭ সালের আগষ্টে তিনি নতুন দার্শনিক মতবাদ রচনা করেন। যা নব্য মানবতাবাদ নামে পরিচিত। রায় নব্য মানবতাবাদের ২২টি সূত্র দেন। এ দর্শনের মূল কথা হলো বিকাশিত ব্যক্তিত্ববাদ। ব্যক্তিত্বকে বিকাশিত করে তোলার ক্ষেত্রে যে সকল বাধা রয়েছে তা এ দর্শন দূর করে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, নিজেকে শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা, অনুশীলিত করে বিকশিত করে গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে মানুষ মুক্ত হবে। কিন্তু তাঁর এ চাওয়া আজও সফল হয়নি।
১৯৫২ সালের জুন মাসে সকালে হাঁটতে গিয়ে পাহাড় থেকে ৫০ ফুট নিচে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন তিনি । মাসের পর মাস চিকিৎসা চলে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। আবার লেখার কাজে মন দেন। নেহেরু তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং রাষ্ট্রপতির তহবিল থেকে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
১৯৫৪ সালের ২৫ জানুয়ারী হঠাৎ তাঁর বুকে ব্যথা ওঠে। ঐদিন রাতেই এই কিংবদন্তী বিপ্লবী পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।
এম এন রায় একজন দার্শনিকও ছিলেন। তাঁর জীবনাদর্শন পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, জীবনের সংকটময় পরিস্থিতেও তিনি কারও দ্বারা প্রভাবিত হননি। তিনি স্বতস্ত্রভাবে চিন্তা করতেন। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী। কোনো বাধা বিপত্তি তাঁকে কখনও দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি মানবজীবনকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে দর্শনের এক নতুন দিক উন্মোচন করেছেন। তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল -মানুষের সার্বিক মুক্তি। তাঁর দেশপ্রেম ও বিপ্লবী কর্মপ্রচেষ্টা সমস্ত মানব জাতির কাছে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। ভারতের অস্ত্র বিপ্লব (১৯০২-১৯১৬): ডা. তাজুল হোসেন। মানবতাবাদী প্রকাশন, আজিজ সুপার মার্কেট, ঢাকা। প্রকাশকাল ২০০০।
২। এম এন রায়- শতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ: সম্পাদনায় বাসন্তী গুহ ঠাকুরতা। পরিবর্তন প্রকাশন সংস্থা, নয়া পল্টন, ঢাকা। প্রকাশকাল ১৯৮৭।
৩। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা। প্রকাশকাল ২০০৯ সাল।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)