‘একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী।
কলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো,
বড়লাটকে মারতে গিয়ে
মারলাম আরেক ইংল্যান্ডবাসী।
শনিবার বেলা দশটার পরে
জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো
হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি
দশ মাস দশদিন পরে
জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো
তখন যদি না চিনতে পারিস দেখবি গলায় ফাঁসি’
এই গানের মধ্যে দেশমাতাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য যাঁর আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে এবং যাঁর কথা উঠে এসেছে তিনি এ উপমহাদেশেরই সূর্যসন্তান, ক্ষুদিরাম। এই গানটি আজও বিভিন্ন গণ আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগায়, উৎসাহিত করে দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে শপথ নিতে। এই গানের কিংবদন্তি অগ্নিযুগের অগ্নিজিতা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম।
ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের কারণে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী যাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল, যিনি ফাঁসির মঞ্চে হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন, তিনি আর কেউ নন, বাংলার বিপ্লবী ক্ষুদিরাম।
ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর হয় ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট। ঘড়িতে তখন ভোর ৪টা। সে সময় ক্ষুদিরামের পক্ষের আইনজীবি ছিলেন শ্রী উপেন্দ্রনাথ সেন। তাঁর ভাষ্যমতে -“ফাঁসির মঞ্চে ক্ষুদিরাম নির্ভীকভাবে উঠে যান। তাঁর মধ্যে কোন ভয় বা অনুশোচনা কাজ করছিল না। এদেশের নবীন যৌবনের প্রতীক হয়ে হাসিমুখে তিনি উঠে যান ফাঁসির মঞ্চে।”
বিপ্লবী ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি চেতনার আয়নায় চিত্রায়ন করে, সেটি গান হিসেবে রচনা করেছিলেন বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস। এই বিপ্লবীর আত্মত্যাগের উপাখ্যানকে কেন্দ্র করেই গানটি রচিত হয়েছে। বাউল শিল্পী ঝুমুরের বাউল সুরে গাওয়া গানটি সারা বাংলার জনগণের অন্তরে গেঁথে রয়েছে।
ক্ষুদিরাম জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর। অবিভক্ত বাংলার মেদিনিপুর জেলার বহুভাইনি গ্রামে। ক্ষুদিরামের বাবা- ত্রৈলক্যনাথ। মা- লক্ষ্ণী দেবী। অপরূপা, সরোজিনী, ননীবালা তাঁর তিন বোনের নাম। ক্ষুদিরামের জন্মের পূর্বে দুই ভাই মারা যায়। ছেলে সন্তান না বাঁচার কারণে লক্ষ্ণী দেবী ক্ষুদিরামের জন্মের পর সেযুগের প্রথা অনুযায়ী তাঁকে তিন মুঠো চালের ক্ষুদের বদলে অন্যের কাছে ঠেলে দেন। তাই তাঁর নাম রাখা হয় ক্ষুদিরাম।
ক্ষুদিরামের বয়স যখন সাত বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার ছমাস পরে তাঁর মা মারা যান। এরপর তাঁর আশ্রয় হয় দুর সম্পর্কের এক দাদা ও বৌদির কাছে। কিন্তু সেখানে তাঁকে অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। অশান্তিতে তাঁর মন ভরে উঠে। সঙ্গী হয় দুঃখ আর একাকীত্ব। তবু পেটের দায়ে ৮/৯ বছরের এই ছেলেটিকে সবই সহ্য করতে হতো। এ সকল কারণে পড়াশোনায় তাঁর মন বসত না। তবে সুযোগ পেলেই খেলাধুলা আর ব্যায়াম করতেন। এ্যাডভেঞ্চার জাতীয় কাজের প্রতি তাঁর প্রচুর আকর্ষণ ছিল।
দিনের পর দিন দাদা-বৌদির নিষ্ঠুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লেন একদিন। বোনের বাড়ি যাবেন কিনা ভাবতে ভাবতে মেদিনীপুরে এসে পৌছলেন। সেখানে একজনের সাথে তাঁর পরিচয় হয় যিনি ক্ষুদিরামের বোনের বাড়ি চিনতেন, তিনি তাঁকে সেই বাড়িতে পৌছে দিলেন। বোনের বাড়িতে যাওয়ার পর তিনি মেদিনীপুর হ্যামিলটন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। এরপর ভর্তি হন কলেজিয়েট স্কুলে। এই স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
ক্লাস ফাঁকি দেয়া ও পড়াশোনা না করার জন্য স্কুলের শিক্ষকরা তাঁকে বিভিন্ন শাস্তি দিতেন। ক্ষুদিরাম তাঁর মতো বাউণ্ডুলে স্বভাবের ছেলেদের নিয়ে ভূত ধরা এবং তাড়ানোর দল গড়লেন। তখনকার দিনের কুসংস্কার তাঁকে মোটেও স্পর্শ করতে পারেনি। বরং সমাজের মানুষের মধ্য থেকে কুসংস্কার দূর করার জন্য চেষ্টা চালান তিনি। এজন্য তাঁকে অনেকের বকাবকি খেতে হয়েছে। এক পর্যায়ে স্কুল ছেড়ে দিলেন। মেধাবী, দুরন্ত এবং কিছুটা বাণ্ডুলে স্বভাবের কিশোর ক্ষুদিরাম ১৯০৩ সালে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে পড়াশুনা বন্ধ করে দেন। এ সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডে। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সংকল্প গ্রহণ করেন তিনি।
স্কুলের অদূরে ভবানী মন্দির প্রাঙ্গনে গিয়ে সময় কাটাতেন। সেখানে সাক্ষাৎ হলো সত্যেন বসুর সাথে। ১৯০৩ সালে ক্ষুদিরাম তাঁর কাছে গুপ্ত সমিতির (সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন) শিষ্য হিসাবে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। এতো দিন পর ক্ষুদিরাম মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারলেন। ইচ্ছে মতো পড়াশুনা, খেলাধুলাসহ নানা কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হলেন। বিপ্লবীদের আদর-স্নেহ-ভালবাসায় সিক্ত করলেন নিজেকে। রাজনৈতিক পড়াশুনা ক্রমান্বয়ে বাড়াতে থাকলেন। শপথ গ্রহণ করলেন দেশমাতৃকাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য।
১৯০৫ সালের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন চলার সময় বরিশালের টাউন হলে অশ্বিনী কুমার বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে জোরদার করা প্রসঙ্গে তাঁর উপলব্দির কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন-“আমরা যে সব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি, যদি কেউ তা যাত্রাপালা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা আমাদের এরূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে”।
অশ্বিনী কুমার দত্তের এই বক্তব্য মুকুন্দ দাস খুবই গুরুত্ব সহকারে নিলেন। মাত্র তিন মাসের মধ্যে রচনা করলেন অসাধারণ যাত্রাপালা ‘মাতৃপূজা’। ‘মাতৃপূজা’র মূল বিষয় ছিল দেশপ্রেম। দেশের সন্তানরা প্রয়োজনে জীবন দিয়ে ভারতমাতাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করবে। পুলিন দাস, অশ্বিনী কুমার দত্ত, মুকুন্দ দাস দারুণ দেশপ্রেমের উন্মাদনা সৃষ্টি করলেন তরুণ সমাজের মধ্যে।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বদেশি আন্দোলন। যে আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে ছাত্ররা। বিশেষ করে স্কুলের কিশোররা। আর এই দুই আন্দোলনের সমর্থনে সক্রিয় অহিংস সংগ্রাম যেমন পরিচালিত হয়, তেমনি সহিংস কর্মকাণ্ডভিত্তিক গোপন সংগঠনেরও জন্ম হতে থাকে।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন ক্ষুদিরাম বসু। এ সময় ক্ষুদিরাম সত্যেন বসুর নেতৃত্বে গুপ্ত সংগঠনে যোগ দেন। এখানে তিনি শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখানে পিস্তল চালনার শিক্ষাও হয়। এই গুপ্ত সংগঠনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্ষুদিরাম ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় জ্বালিয়ে দেন এবং ইংল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত লবণবোঝাই নৌকা ডুবিয়ে দেন। এসব কর্মকান্ডে তাঁর সততা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে ধীরে ধীরে গুপ্ত সংগঠনের ভেতরে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
১৯০৬ সালের দিকে দেশপ্রেমের একটা ছোট বই ছাপা হয়েছে, এগুলো বিক্রির জন্য তরুণদের উপর দায়িত্ব পড়ল। ক্ষুদিরাম তাদের মধ্যে অন্যতম। মেদিনীপুর মারাঠা কেল্লায় প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে ক্ষুদিরাম বই হাতে বলছেন- ‘আসুন পড়ুন। দেশের দুর্দশার খবর জানুন। অত্যাচারী রাজশক্তির নির্মমতার নজির – এই বই আপনাদের জন্য’।
এমন সময় একজন হাবিলদার এসে ক্ষুদিরামের হাত চেপে ধরল। শক্তি ও বয়সে তার চেয়ে অনেক বেশি। তবুও ক্ষুদিরামের কাছে- কুছ পরোয়া নেহি। হাবিলদারের মুখের মধ্যে এক ঘুষি মেরে দিলেন সমস্ত শক্তি দিয়ে। তৎক্ষনাৎ নাক ফেঁটে রক্ত বেরুলো। সত্যেন বসু ঠিক ওই সময় এসে হাজির হলেন। দেখলেন বিষয়টি। সান্ত্বনা দিলেন হাবিলদারকে। ক্ষুদিরাম মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া। কয়েকদিন আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করে রইলেন। তাতে কি আর একজন দেশপ্রেমিক শান্তি পায়? দেশ জোড়া বিপ্লবের ঢেউ। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে জড়িয়ে আছে দেশমাতৃকার কাজে। পুলিশ ধরার ভয়ে আর কত দিন পালিয়ে থাকা যায়? মনস্থির করলেন পুলিশের কাছে ধরা দেবেন। তাই আলীগঞ্জের তাঁতশালায় চলে এসে ধরা দিলেন। পুলিশ মারা ও নিষিদ্ধ বই বিলির অপরাধে ক্ষুদিরামের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা করা হল। বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষ এই প্রথম ক্ষুদিরামকে চিনলো। ১৩ এপ্রিল ক্ষুদিরাম মুক্তি পেলেন। খানিকটা শাস্তি পেলেন সত্যেন বসু। ক্ষুদিরাম এবার গুপ্ত সমিতির কাজে আরো উঠে পড়ে লাগলেন।
“ভারতের ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার মধ্য দিয়ে। বৃটিশদের শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার অদম্য মানসিকতা সেদিনের ছাত্র সমাজকে আপসহীন বিপ্লবী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বহু যুবক বিপ্লবী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বহু যুবক বিপ্লবী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এমনকি আমরা দেখেছি শিক্ষকদের প্রেরণাতেও বহু মেধাবী ছাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষক-ছাত্রের এক অনুকরণীয় সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিল সে সময়। ক্ষুদিরামেরা সেই অগ্নিগর্ভ সময়েরই সৃষ্টি। সে সময়ে তারুণ্যের প্রাবল্য আঘাত হানে অত্যাচারী শাসকের দুর্গে। ‘বোকা’ ক্ষুদিরামরাই নতুন পথ দেখান”- নির্মল সেন।
ইতোমধ্যে বিলেতী পণ্য বর্জনের পালা শুরু হলো। বিলেতী পণ্য নৌকায় দেখলে ক্ষুদিরামসহ বাংলার অসংখ্য ক্ষুদিরাম বাহিনী তা ডুবিয়ে দিত। ১৯০৭ সালের শেষের দিকে কালী পুজার সময় একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে তিনি ডাকহরকরাকে ছুরি মেরে গুপ্ত সমিতির জন্য টাকা সংগ্রহ করে আনেন। সারাদেশে চলতে থাকে ব্রিটিশ শাসক আর সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের সংঘর্ষ, ধড়পাকড় আর নির্যাতন। বিপ্লবীরাও সুযোগ বুঝে গুম করে দেয় ব্রিটিশ শকুনদের। ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্র করে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়।
স্বাধীনতাকামী বিপ্লববাদী দলগুলোকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠে। তারা একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে ধরে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রুজু করে এবং তাঁদেরকে আন্দামান, আলীপুরসহ বিভিন্ন জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে পাঠানো শুরু করে। জেলে নেয়ার পর তাঁদের উপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন।
ব্রিটিশ বিচারক ছিলেন কিংসফোর্ট। এক নিষ্ঠুর বিচারক। ১৩ বছরের ছেলে সুশীল সেন পুলিশ সার্জেন্টকে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেয়ায় সুশীল সেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। কিংসফোর্ট বিচারক। বিচারে ১৫টি বেত্রাঘাত মারার হুকুম দিলেন তিনি। রক্তাক্ত হলেন সুশীল সেন। দুঃসহ যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। খবরটি দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়লো। সকল তরুণ বিপ্লবী এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজকে বিতাড়িত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলেন। বিপ্লববাদী দলের সুবোধ মল্লিক, হেমচন্দ্র, চারুদত্ত, বারীন ঘোষ ও অরবিন্দ সিদ্বান্ত নিলেন কিংসফোর্টকে হত্যা করার। মিটিংয়ে প্রশ্ন উঠলো একাজের দায়িত্ব কাকে দেয়া হবে? প্রফুল্লচাকী বলে উঠলেন-আমি প্রস্তুত। বলুন কি করতে হবে আমাকে। কিন্তু সবাই ভাবলেন, একাজের জন্য আরো একজন দরকার। ভেবেচিন্তে ক্ষুদিরাম বসুর নাম ঠিক হলো।
ক্ষুদিরামের অভিভাবক সত্যেন বসুর কাছে চিঠি লিখে পাঠানো হলো। চিঠি অনুযায়ী ১৯০৮ সালের ২৫ এপ্রিল ক্ষুদিরাম কলকাতায় এসে পৌছালেন। গোপীমোহন দত্তের ১৫ নম্বর বাড়ি ছিলো বিপ্লবীদের তীর্থক্ষেত্র। এখানে বসেই হেমচন্দ্র ও উল্লাসকর শক্তিশালী ‘book bomb’ তৈরী করলেন। এ বোম বইয়ের ভাঁজে রাখা যেত। বেশ কৌশলে একটি বই কিংসফোর্টের কাছে পাঠানো হলো। কিন্তু কিংসফোর্ট বই না খোলার কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন।
শুরু হলো আবার নতুন প্রস্তুতি। প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম কলকাতা রেলস্টেশনে পৌছার পর বারীণ ঘোষ তাঁদের কাছে কিংসফোর্টকে মারার জন্য বোমা পৌছে দিলেন। বোমার সঙ্গে রিভলবার কেনার জন্য কিছু টাকা ও মজঃফরপুরে যাওয়ার মানচিত্র দেয়া হলো তাঁদেরকে। প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম প্রথম একত্রিত হলেন রেলস্টেশনে। এর আগে কেউ কাউকে চিনতেন না। কথা হলো। কিংসফোর্টকে হত্যা করার জন্য ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প করলেন তাঁরা। এরপর সতর্কতার সাথে চলে যান মজঃফরপুরে। কারণ এখানেই বাস করেন কিংসফোর্ড। প্রতিদিন ক্লাব হাউজ থেকে সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িতে করে নিয়মিত বাড়ি ফিরে আসেন কিংসফোর্ট। পাঁচ দিন অতিবাহিত হলো, কিন্তু তাঁকে হত্যা করার উপযুক্ত সুযোগ পেলেন না। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল, ষষ্ঠ দিন এলো সেই সুযোগ। ক্লাব হাউজ থেকে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত যে পথ, সেই পথের মাঝখানে ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা একটি জায়গায় ওঁত পেতে ছিলেন তাঁরা। সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িটি তাঁদের কাছে পৌছামাত্র গাড়িটি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু ওই গাড়িতে সেদিন কিংসফোর্ট ছিলেন না। ছিলেন দু’জন বিদেশী। বিদেশী দু’জন মারা গেলেন। অতিদ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করলেন তাঁরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না তাঁদের, কারণ কিছুদূর যাওয়ার পর পথে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী। প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ার সাথে সাথে নিজের মাথায় রিভলবারের গুলি ছুঁড়ে আত্মহত্যা করেন। এর প্রায় তিন মাস দশ দিন পর ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন ক্ষুদিরাম।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১. বিদ্রোহী ভারত – নীহাররঞ্জন গুপ্ত; প্রকাশকাল : ১৩৯১ বাংলা
২. বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী – শহীদ আশরাফ
৩. ফাঁসীর মঞ্চে গেয়ে গেল যাঁরা – চিন্ময় চৌধুরী; প্রকাশকাল – ১৯৯৮।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)