ছোটবেলা থেকেই তিনি ও তাঁর আরো তিন ভাইবোন পড়াশোনা করতেন ময়মনসিংহ শহরে মামার বাড়িতে থেকে। মামা বাড়িটি ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ঘেরা। খোকা রায়ের দাদামশাই শ্যামাচরণ রায় ছিলেন শহরের বিখ্যাত আইনজীবি ও রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন মডারেটপন্থী বা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর অনুসারী। পাঁচ মামার সবাই ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থক, ‘যুগান্তর’ দলের সক্রিয় সদস্য। ফলে বাড়িতে সবসময়ই পুলিশের আনাগোনা ছিল। খোকা রায় দেখেছেন, পুলিশ বাড়ি থেকে তাঁর মামাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর মামারা আবার জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন। এই বাড়ির মেয়েরাও ছিলেন সাধারণভাবে ব্রিটিশ-বিরোধী। এ রকম পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে খোকা রায় রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত হন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং বিপ্লবী খোকা রায় নামে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন।
খোকা রায়ের জন্ম ১৯০৭ সালে ময়মনসিংহ জেলায়। তাঁর আসল নাম সুধীন্দ্র রায়। তাঁর বাবার নাম নরেন্দ্র কিশোর রায়। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন আইনজীবী, পরবর্তীতে আইন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তিনি ব্যাংকের চাকুরিতে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থক।
১৯২১ সালে সারা ভারত জুড়ে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ময়মনসিংহ শহরেও সেই আন্দোলন খুব শক্তিশালী হয়। উকিল-মোক্তাররা কোর্ট-কাচারি এবং ছাত্র- ছাত্রীরা স্কুল-কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। গ্রাম- শহরের শ্রমজীবী মানুষরাও এতে অংশ নেন। অসহযোগ আন্দোলনের সেই ঢেউয়ে খোকা রায়ও স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্যাপকভাবে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করতে থাকে। ‘আন্দোলনে অহিংসার মৌলিক নীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে’ এই অজুহাতে কংগ্রেস এই আন্দোলন খুব বেশিদিন চলায়নি। এতে বিপ্লবীদের সাময়িক কর্মকাণ্ড কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়ে। সেসময় খোকা রায় প্রায় ৪/৫ বছর পাড়ায়-পাড়ায় লাইব্রেরি ও ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালান।
১৯২৪ সালে খোকা রায় সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯২৬ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯২৮ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ইতিহাস বিভাগে এম.এ. ভর্তি হন। থাকতেন জগন্নাথ হোস্টেলে। ১৯২৯-৩০ সালে বিপ্লবী কার্মকাণ্ডের পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজে নামেন। এই সময় তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা ইউনিটের সম্পাদক নিযুক্ত হন।
১৯৩০ সালে কংগ্রেস দেশব্যাপী ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালনের ডাক দেয়। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে অনেক স্থানেই তা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। জগন্নাথ ছাত্রাবাসের প্রভোস্ট কয়েকজন কর্মচারীকে সাথে নিয়ে এসে ছাত্রদের ‘স্বাধীনতা দিবস’-এর কর্মসূচি বাতিল করার কথা বলেন। কিন্তু ছাত্ররা সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ‘স্বাধীনতা দিবস’-এর কর্মসূচি পালন করেন। এই অপরাধে খোকা রায়সহ আরো একজনকে হোস্টেল থেকে বহিস্কার করা হয়। ঢাকায় তখন খোকা রায়ের থাকার তেমন কোনো জায়গা ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তিনি ময়মনসিংহে ফিরে যান। ফলে তাঁর আর এম.এ পরীক্ষা দেয়া হয়ে ওঠেনি।
ময়মনসিংহে ফিরে আবার কংগ্রেসের আন্দোলনে যোগ দেন। কংগ্রেস কর্মীরা তখন শহরে মদ ও গাঁজার দোকান বন্ধের জন্য আন্দোলন করছিলেন। এই আন্দোলনের জের ধরেই খোকা রায়কে গ্রেফতার করার জন্য জামালপুর থেকে শেরপুর যাওয়ার পথে পুলিশ গোদারা ঘাটে ওৎ পেতে থাকে। খোকা রায়ের সাথে তখন আরো কয়েকজন বিপ্লবী সহকর্মী ছিলেন। পুলিশকে দেখা মাত্র বিপ্লবী দলের সদস্যরা তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন। পুলিশ বিপ্লবীদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। তবে ওই বছরের (১৯৩০ সাল) নভেম্বরের ৩০ তারিখে আরো এক সহকর্মীসহ ময়মনসিংহ থেকে পুলিশ খোকা রায়কে গ্রেফতার করে। জামালপুরে এক বিশেষ আদালতে খোকা রায়ের ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
কারা কর্তৃপক্ষ প্রথমে খোকা রায়কে জামালপুর সাবজেল ও পরে ময়মনসিংহ জেল, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল এবং সবশেষে আন্দামান সেলুলার জেলে নির্বাসন দেয়। ১৯৩৩ সালে আন্দামান সেলুলার জেলে থাকাবস্থায় সেখানকার বন্দিরা জেল জীবনের দুঃসহ জীবনের প্রতিবাদে চিফ কমিশনারের কাছে তিনদফা দাবীনামা পেশ করেন। এই তিন দফা দাবির মধ্যে ছিল-ভালো খাদ্য, জেলে আলোর ব্যবস্থা , বই ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে দাবি না মানলে বিপ্লবীরা অনশন শুরু করেন। অনশন অবস্থায় জোর করে খাওয়াতে গিয়ে তিনজন বিপ্লবীকে হত্যা করে জেল কর্তৃপক্ষ। এই খবর বাংলায় ছড়িয়ে পড়লে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে জেলের ভিতরে ও বাইরে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধীসহ অনেক দেশবরেণ্য নেতাই বিপ্লবীদের অনশন থামানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। একটানা ৪৬ দিন অনশন করার পর বিপ্লবীদের দাবি মেনে নেয় কর্তৃপক্ষ।
রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এর প্রভাবে বাংলার বেশকিছু রাজনৈতিক নেতা তখন কমিউনিস্ট মতাদর্শ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯২৫ সালেই ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। সোভিয়েত বিপ্লব ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব তখন জেলখানার বন্দিদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। আন্দামানও এর ব্যাতিক্রম ছিল না। বন্দিরা অনেকেই সেসময় গোপনে জেলের ভিতর মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের রাজনৈতিক সাহিত্য পাঠ শুরু করেন। খোকা রায় আন্দামান জেলে থাকা অবস্থাতেই প্রথমে ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ ও পরে মার্কসের ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থ পড়ে ফেলেন। সেসময় তিনি মানসিকভাবে কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এসব কারণেই আন্দামানকে তখন বলা হত বিপ্লবীদের মার্কসিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই মূলত বিপ্লবীরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়ে রাজনৈতিকভাবে শ্রেণী-সংগ্রামের ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলার দীক্ষা নেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৩৩ সালেই ৩২ জন বিপ্লবী জেলখানায় কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গড়ে তোলেন। জেলখানায় এটিই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম শাখা। ১৯৩৭ সালের ২৫ জুলাই আন্দামান জেলের বন্দীরা পুনরায় তিন দফা দাবিতে অনশন শুরু করেন। এবারের তিন দফা দাবি ছিল- সকল রাজবন্দীদের মুক্তি, আন্দামান বন্দীদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত সব রাজনৈতিক বন্দীকে কমপক্ষে ডিভিশন ‘টু’-র বন্দী হিসেবে গণ্য করা। এতে বিভিন্ন জেলের অন্যান্য বন্দীরাও অংশ নেন। একটানা ৩৭ দিন অনশন-আন্দোলনের এক পর্যায়ে বন্দীরা দেশে ফেরার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। অনেককেই এসময় আন্দামান থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন কারাগারে বদলি করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে কর্তৃপক্ষ খোকা রায়কে আন্দামান থেকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে আসে। আলিপুর জেল থেকে তিনি ১৯৩৬ সালের শেষের দিকে তিনি যেদিন ছাড়া পান সেদিনই জেল গেইটে তাঁকে আবার গ্রেফতার করে পুলিশ। বিনা বিচারে বন্দী হিসেবে তাঁকে প্রেসিডেন্সি কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অক্টোবর মাসে পাঠিয়ে দেয়া হয় নদীয়া জেলা কারাগারে। ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে তিনি মুক্তি পান। এই সময়টা খোকা রায়ের বিপ্লবী জীবনের এক বিরাট বড় পরিবর্তনের সময়। তিনি বলেছেন-“১৯৩০ সালে যখন জেলে গিয়েছিলাম তখন ছিলাম একজন বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী কর্মী। ১৯৩৮ সালে যখন জেল ও অন্তরীণ থেকে মুক্ত হয়ে এসেছিলাম তখন হয়েছিলাম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শে দৃঢ় বিশ্বাসী একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী। ১৯২১ সালে আমার যে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল, ১৯৩৮ সালে তার সার্থক পরিণতি হয়েছিল।”
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর খোকা রায় ময়মনসিংহ শহরে ফিরে আসেন। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী তখনও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। খোকা রায় প্রথমে গোপনে গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কৃষক-শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষের সংগ্রাম গড়ে তোলায় সচেষ্ট হন। ১৯৩৮ সালের মে-জুন মাসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম দিকে কমিউনিস্টরা এই যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কোনো ভারতীয় যেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ না দেন সেকারণে তখন তাঁরা শ্লোগান তোলেন ‘নয় এক পাই, নয় এক ভাই’। এই শ্লোগান ব্রিটিশদের খুবই ক্ষিপ্ত করে তোলে। ব্রিটিশ সরকার সারাদেশে কমিউনিস্টদের গ্রেফতার করার এক আদেশ জারি করে। তখন খোকা রায় আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু নাৎসি জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে তখন যুদ্ধের পরিস্থিতি পুরো পাল্টে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন, ফ্রান্স মিলে জার্মান বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানায়। তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে সোভিয়েত বাহিনীকে সহযোগিতার ঘোষণা দেয়। ফলশ্রুতিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উপর থেকে ব্রিটিশ সরকার নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়। ১৯৪২ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বৈধ বলে গণ্য হয়। ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে খোকা রায় পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সদস্য তথা প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি ময়মনসিংহ জেলায় কৃষক-ছাত্র-যুব আন্দোলন গড়ে তোলায় অবদান রাখেন। ১৯৪৫-৪৬ সালে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে যে দাঙ্গা হয় সেই দাঙ্গার বিরুদ্ধে খোকা রায় সেসময় পার্টির পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরে নোয়াখালিতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পরলে সেখানেও তিনি ছুটে যান। যদিও সেসময় কমিউনিস্টরাও এই দাঙ্গার শিকার হন।
এই সময় বাংলায় যুগ যুগ ধরে শোষিত ও নির্যাতিত বাংলার মেহনতি কৃষক ও ক্ষেতমজুররা তেভাগা ও টঙ্ক আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামন্তবাদী শোষকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সেই আন্দোলনে কমরেড খোকা রায় কখনো ময়মনসিংহ, কখনো শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা প্রভৃতি স্থানে গিয়ে জঙ্গি কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই সংগ্রামের কারণে তখন ব্রিটিশ শাসকদের মসনদ নড়ে উঠেছিল। সংগ্রামের সরাসরি বিরোধীতা করেছিল তৎকালীন মুসলিম ও কংগ্রেস নেতৃত্ব। ফলে তিনমুখী বিরোধীতার মুখে সংগ্রাম গড়ে তুলতে গিয়ে সেদিন এদেশে কমিউনিস্টদের কী পরিমাণ নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তার বর্ণনা পওয়া যায় নিম্নলিখিত তথ্যগুলো থেকে-
১. আন্দোলনের এলাকাগুলোতে পুলিশ ২২ দফায় অসংখ্য রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। সে গুলিতে বাংলার ৭০ জন কৃষক নরনারী নিহত হয়েছিলেন। বাংলার সবুজ মাঠ সমিরউদ্দিন, শিবরাম, চিয়ার সাঁই, রাশমণি, সুরেন্দ্র, তৎনারায়ণ প্রমুখ শহীদদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল।
২. কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির ৩ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে পুরেছিল।
৩. দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, ২৪ পরগনা, মেদেনিপুর প্রভৃতি জেলার বহু কৃষক রমণী পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছিলেন।
৪. আন্দোলনের সময় বহু গ্রামে কৃষকদের শত শত কুটির পুলিশ ধুলিস্যাৎ করেছিল। পুলিশ কৃষকদের অনেক বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি আবার নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আবার কমিউনিস্টদের উপর নেমে আসে দমন-পীড়ন। এই অবস্থায় বাংলার অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি এক গভীর সমস্যার মধ্যে পড়ে যায়। তখন খোকা রায় দেশত্যাগ না করে গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে জোরদার করতে এদেশেই থেকে যান। খোকা রায় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থেকে প্রায় এক দশক বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সংগঠিত করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন, যা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণতা পায় সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে খোকা রায়ের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী মানুষের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনিই সেসময় প্রথম লিখিত এক প্রবন্ধে দাবি জানিয়েছিলেন। সেসময় তিনি আলী আশরাফ ছদ্মনামে ‘পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যা সেসময় খুবই সাড়া জাগিয়েছিল।
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কাজের ক্ষেত্র কিছুটা প্রসারিত হয়। এসময় দলীয় বক্তব্য প্রচারের জন্য একটি মুখপত্র বের করার চেষ্টা করেন নেতৃবৃন্দ। ‘জনতা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ডিক্লারেশনও পাওয়া যায়। সেই পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব ছিল খোকা রায়, বারীণ দত্ত, কেজি মোস্তফা, আলী আকসাদ ও জহির রায়হানের উপর। কিন্তু এই পত্রিকাটি বের হবার সাথে সাথেই পাকিস্তান সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে দেয়। তখন খোকা রায় ও বারীণ দত্ত মিলে ‘যুগের দাবি’ ও ‘মার্কসপন্থী’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এর কিছুদিন পর পাকিস্তান সরকার ৯২ (ক) ধারা জারি করে। ফলে ১৯৫৪ সালের ৪ জুলাই আবার পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এর তিন সপ্তাহ পর পশ্চিম পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। খোকা রায় আবার আন্ডাগ্রাউন্ডে চলে যেতে বাধ্য হন।
১৯৫৬ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক শাখার তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে খোকা রায় পার্টির প্রাদেশিক কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক শাসন জারি করে। ফলে সারা দেশে আবার রাজনীতি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৪-৬৫ সালে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে ‘মস্কো-পিকিং’ দ্বন্দ্বের সূচনা হওয়ায় এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও তাঁর ঢেউ লাগে। এখানেও কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে যায়। খোকা রায় তখন কমিউনিস্ট পার্টির ‘মস্কো- পন্থীদের’ সাথে অবস্থান নেন। উভয় পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা মিলে ১৯৬৭-৬৮ সালে কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করেন। খোকা রায় সেই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এরপর খোকা রায়ের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকলে সেই দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে আসেন বারীণ দত্ত।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে খোকা রায় পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে ভারতে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেন। পার্টির উদ্যোগে তখন নিজস্ব ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে এসময় খোকা রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সেসময় ভারতের কোচিনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস হচ্ছিল। সেই কংগ্রেসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে কমরেড মণি সিংহ, খোকা রায়, বারীণ দত্ত প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র বিষয়ে আলোচনা করেন এবং এব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সমর্থ হন। দেশ স্বাধীন হবার পর কমিউনিস্ট পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। খোকা রায়সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ দেশ পুনর্গঠনে অবদান রাখেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ঘাতকরা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আবার অবনতি হতে থাকে। এসময় খোকা রায় সহ পার্টির নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে চলে যান। তাঁর শরীরও খারাপ হতে থাকে। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি কলকাতায় চলে যান। সেখানেই ১৯৯২ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
খোকা রায় ১৯৪৩ সালে জুঁইফুল রায়কে বিয়ে করেন। জুঁইফুল রায় ছিলেন পার্টির একজন সার্বক্ষণিক নেত্রী। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। ১৯৪০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এদেশের নারী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অনন্য। পরে তিনি ১৯৫৯ সালে কলকাতায় চলে যান। সেখানে দীর্ঘদিন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে কাজ করেন। জুঁইফুল রায় ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁদের এক কন্যা জয়শ্রী গাঙ্গুলি।
এই লেখাটি তৈরির জন্য খোকা রায়ের লিখিত ‘সংগ্রামের তিন দশক’ বইয়ের সাহায্য নেয়া হয়েছে। খোকা রায়ের একমাত্র মেয়ে জয়শ্রী গাঙ্গুলির উদ্যোগে যা ২০০৮ সালের আগষ্ট মাসে কলকাতা থেকে বর্ধিত সংস্করণ হিসেবে প্রকাশ করেছেন অমূল্য গাঙ্গুলি। বইটিতে ভূমিকা লিখেছেন সিপিআই (এম) পশ্চিমবঙ্গ শাখার সাবেক রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। ছবিও এই গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে
লেখক: চন্দন সাহা রায়