১৯৩৮ সাল। দীর্ঘ সাত বছর পর জেল থেকে মুক্তি পেলেন কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী। সশস্ত্র বিপ্লববাদী দলের সাথে যুক্ত থাকার সন্দেহে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করেছিল। কিন্তু পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ বা অভিযোগ দাঁড় করাতে না পারলেও জেলে বন্দি অবস্থায় দীর্ঘ সাত বছর তাঁকে দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হয়।
তিনি বকসা বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সরাসরি চলে আসেন কমিউনিষ্ট পার্টির ঢাকা কমিটির কার্যালয়ে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আর পরিবারে ফেরেননি। জেলে বন্দী অবস্থায় তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি আর জীবন-সংসারে ফিরবেন না। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ। বাবার অঢেল ধন-সম্পদ, জীবন- যৌবনের মোহ, আত্ম-সুখের মরীচিকা সবকিছু বাদ দিয়ে ৩৩ বছরের যুবকটি মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামে ফিরে আসেন। যুক্ত হন কমিউনিস্ট পার্টিতে। তবে সময় পেলে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নিতেন।
পার্টি কমরেড ও আত্মীয়-স্বজন তাঁকে বহুবার বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি কখনো বিয়েতে রাজী হন নি। কারণ তিনি ভাল করেই জানতেন পার্টি করার কারণে যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন। হয়তো যে কোনো সময়ে আত্মগোপনে চলে যেতে হতে পারে। বা সোমেন চন্দের মতো ‘বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পার্টি’র (আর.আস.পি.) গুণ্ডারা তাঁর উপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে পারে। এসব ভেবে তিনি বিয়ে করেননি।
ইতোমধ্যে ঢাকায় কমিউনিষ্ট পার্টির সংগঠন গড়ে উঠেছে। ওই সময় ঢাকা জেলায় কমরেড নেপাল নাগ ও কমরেড অনিল মুখার্জী শ্রমিক আন্দোলনের দায়িত্বে ছিলেন। কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী কমিউনিষ্ট পার্টি সংগঠন ও কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব নিলেন। রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গড়ে তোলেন পার্টি সংগঠন। কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ঢাকার বাইরে গিয়ে কৃষকদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার কাজ অব্যাহত রাখলেন।
মেহনতী মানুষের শোষণমুক্তির কান্ডারী কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শোষণ মুক্তির আন্দোলনে যে সকল মানুষ আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন, তাঁদের মধ্য কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী অন্যতম। বিত্ত-বৈভবের মোহ তাঁকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি বাবার অঢেল ধন-সম্পদ ও যশ-খ্যাতি ত্যাগ করে মেহনতি মানুষের কাতারে এসে তাদেরই একজন হয়ে সাধারণ জীবন যাপন করেছেন। গড়ে তুলেছেন শোষণমুক্তির জোরালো লড়াই-সংগ্রাম।
ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট আন্দোলনের কথা তাঁকে ছাড়া চিন্তাও করা যায় না। শুধু কমিউনিস্ট আন্দোলনই নয়, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি গরীব-দুঃখী, কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য ব্যয় করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অগ্রনায়ক ছিলেন তিনি।
কমরডে জ্ঞান চক্রবর্তী জন্মেছিলেন ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের গোবিন্দ দাস লেনে। তাঁদের আদিনিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। ঢাকা শহরের পাতলা খান লেনে এবং গেন্ডারিয়াতেও তাঁদের বাড়ি ছিল। জ্ঞান চক্রবর্তীর পিতার নাম যামিনী চক্রবর্তী। তিনি ঢাকা শহরের একজন নাম করা আইনজীবী ছিলেন। মা ছিলেন গৃহিনী। তাঁদের পরিবারে ৩ টি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। জ্ঞান চক্রবর্তী ছিলেন ৩ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। বিশেষ করে বাবার কাছে। তারপর প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হন। প্রাইমারী স্কুলের পড়াশুনা শেষে তাঁর বাবা যামিনী চক্রবর্তী তাঁকে জগন্নাথ স্কুল এণ্ড কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৯২৬ সালে তিনি এস.এস.সি. ও ১৯২৮ সালে জগন্নাথ স্কুল এণ্ড কলেজ থেকে আই.এস.সি. পাশ করেন। আই.এস.সি. পাশ করার পর তিনি বি.এস.সি.-তে পড়াশুনার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩০ সালে বি.এস.সি. পাশ করার পর তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এস.সি.-তে ভর্তি হয়েছিলেন।
১৯০৬-০৭ সালে ঢাকায় পুলিনবিহারী দাসের নেতৃত্বে অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়। ঢাকার অনুশীলন সমিতি ছিল ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান। এই সমিতির সভ্য হতে হলে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য জীবন উৎসর্গ করার মন্ত্র পাঠ করতে হতো। ঢাকা ‘অনুশীলন সমিতি’র আদর্শ ছিল সশস্ত্র বিপ্লব। মূল উদ্যোগ ছিল ইংরেজকে ভারতবর্ষ থেকে তাড়ানো। সশস্ত্র আন্দোলনকারীরা ইংরেজ আমলা নিধনের ব্রত গ্রহণ করেছিলেন আগ্নেয়াস্ত্র বা অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করে। ‘দেশের মুক্তি কোন পথে’ ও ‘বর্তমান রণনীতি’ বই দুটি প্রকাশ করা হয়েছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের জন্যে। সেই সময় বইদুটির দাম রাখা হয়েছিল মাত্র বারো আনা।
আর যাদেরকে জীবন উৎসর্গ করার মন্ত্র পাঠে অযোগ্য মনে হতো তাদেরকে জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী আন্দোলনের (অহিংস বা স্বদেশী আন্দোলন) সাথে যুক্ত করে দেয়া হতো। তখন ‘স্বদেশবাসীরা’ বাজারে বাজারে পিকেটিং করছিলেন বিদেশী দ্রব্য বর্জন করার জন্য।
১৯০৭ সালের ১০ আগস্ট। পুলিশ ঢাকার ‘অনুশীলন সমিতি’র বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালায়। এ সময় ‘অনুশীলন সমিতি’র বাড়ি থেকে পুলিশ সন্দেহজনক নথিপত্র, ইস্তেহার এবং নানা ধরনের বিপ্লবী পুস্তিকা নিয়ে যায়। এরপর ‘অনুশীলন সমিতি’কে ব্রিটিশ সরকার বেআইনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর থেকে সমিতির কার্যক্রম চলছিল খুবই সতর্কতার সাথে এবং গুপ্তভাবে। ঢাকার ‘অনুশীলন সমিতি’ নিষিদ্ধ হওয়ার পর ‘বাণী সংঘে’র মাধ্যমে এই সমিতির কার্যক্রম চলত।
১৯১৭ সাল। সমগ্র ভারত জুড়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সশস্ত্র বিপ্লববাদী দলগুলো ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে নিখিল ভারত থেকে স্ব-মূলে উৎখাত করার জন্য নানা রকম কার্যক্রমের পরিকল্পনা করে। ঠিক এই সময় মাত্র ১২ বছর বয়সে জ্ঞান চক্রবর্তী সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’র শাখা সংগঠন ‘বাণী সংঘে’র সাথে যুক্ত হন। তখন তিনি স্কুলে পড়তেন। স্কুলের পাঠ্য বইয়ের সাথে ‘বাণী সংঘে’র রাজনৈতিক বই-পুস্তক পড়াশুনা শুরু করলেন। এভাবে ধীরে ধীরে তিনি একজন তরুণ দেশপ্রেমিক বিপ্লবী হিসেবে গড়ে উঠলেন। তারপর শুরু করেন ব্রিটিশকে উচ্ছেদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। অনেক বছর পর ‘বাণী সংঘে’র গোপন কার্যকলাপ ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের চোখে পড়ে।
১৯৩০ সালে জ্ঞান চক্রবর্তীর মা মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় ‘বাণী সংঘে’র উপর ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি বহুগুণে বেড়ে যায়। যে কারণে তিনি তাঁদের ৯ নম্বর গোবিন্দদাস লেনের বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপনে চলে যাওয়ার মাস ছয়েক পর ওই বছর ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। আত্মগোপনে থাকাবস্থায় তিনি সকল কার্যক্রম এমন সর্তকভাবে চালাতেন, যেন পুলিশ তার কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ না পায়। তাই তাঁকে গ্রেফতার করার পর পুলিশ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ বা অভিযোগ দাঁড় করাতে পারেনি। যে কারণে তাঁকে বিনা বিচারে আটক করে রাজ বন্দী হিসেবে কোলকাতা প্রসিডেন্সী জেলে রাখা হয়। কিছুদিন পর তাঁকে বকসা বন্দী শিবিরে পাঠানো হয়। এই বন্দী শিবিরটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে, ভুটান সীমান্তে, কুচবিহার জেলার আলীপুর দুয়ারের কাছে পাহাড়ের উপরে। সেখান থেকে পরে তাঁকে সুদূর রাজপুতনার মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত দেউলী বন্দী শিবিরে পাঠানো হয়। এসব বন্দী শিবির তখন ব্রিটিশ সরকার নির্মাণ করেছিল স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের আটক রাখার জন্য।
এখানে তিনি বন্দি অবস্থায় ৭ বছর ছিলেন। এই বন্দি শিবিরে তখন অসংখ্য বিপ্লবী বন্দি ছিলো। বকসা বন্দি শিবিরের ভিতরেও তখন’অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তর’ এই দুই দলে বন্দিরা বিভক্ত ছিল। তাঁদের খাবার প্রস্তুত করার রন্ধনশালাও ছিল পৃথক পৃথক। এর বাইরে আরেকটি তৃতীয় রন্ধনশালা ছিল। এটি ছিল কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের। আর ‘অনুশীলন” ও ‘যুগান্তর’-এর উভয় দল থেকে কিছু কর্মীরা এসে যুক্ত হয়েছিল কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সাথে। জ্ঞান চক্রবর্তী কমিউনিস্ট দলে নিজেকে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন।
এ সময় তিনি যে সমস্ত কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন পশ্চিম বঙ্গের কৃষক নেতা আব্দুল রাজ্জাক, মণি সিংহ, সিন্দুর জামাল উদ্দিন বোখারী, হুগলী জেলার কালী সেন, ঢাকার নলীন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখ। এঁদের সান্নিধ্যে এসে তিনি সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত হন। কমিউনিজম ও রুশ বিপ্লব সম্পর্কে সামান্য কিছু বই-পত্র বকসা বন্দি শিবিরে আসতো। এই বই জ্ঞান চক্রবর্তীসহ অন্যান্য তরুণরা খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। এই বন্দি শিবিরে বসেই তাঁর রাজনৈতিক চেতনার পরিবর্তন আসে। তিনি বুঝতে পারেন যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে একমাত্র শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সম্ভব। এটিই শোষণ-বৈষম্য অবসানের একমাত্র বিজ্ঞানসম্মত পথ। মার্কসবাদের শিক্ষা থেকে তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে জনগণকে জাগ্রত ও সংগঠিত করে গণবিপ্লবের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারকে বিতাড়িত করতে হবে। তাই তিনি সশস্ত্র বিপ্লবী থেকে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীতে রূপান্তরিত হলেন।
১৯৩৭ সালে জ্ঞান চক্রবর্তীর বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর কারণে ওই সময় তাঁকে একবার কড়াপ্রহরা দিয়ে বকসা বন্দি শিবির থেকে ঢাকাতে আনা হয়েছিল।
১৯৩৮ সালে তিনি বকসা বন্দি শিবির থেকে মুক্তি পান। মুক্তি লাভের পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন। ইতোমধ্যে ঢাকায় কমিউনিষ্ট পার্টির সংগঠন গড়ে উঠেছে। কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হওয়ার ৮ মাস পরে তিনি পার্টির সদস্য পদ পান।
১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসেই তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। এই সময় কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তীর অক্লান্ত চেষ্টার ফলে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, অর্থাৎ সমস্ত ঢাকায় পার্টি শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে। সারা ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি তখন বেআইনী ছিল। পার্টি তখন প্রকাশ্য সংগঠনের পথ খুঁজতে থাকে। গোপনে গোপনে পার্টির কাজের ধারাও অব্যাহত থাকে। ১৯৩৬ সালে ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৯ সালে এই লেখক সংঘের শাখা গড়ে উঠে ঢাকায়। পার্টির কাজের পাশাপাশি এতে যুক্ত হন জ্ঞান চক্রবর্তী। ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি জ্ঞান চক্রবর্তী ও রণেশ দাশগুপ্তের উদ্যোগে ঢাকার গেণ্ডারিয়া হাইস্কুলে ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘে’র প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কাজী আবদুল ওদুদ। রণেশ দাশগুপ্ত সংগঠনের সম্পাদক ও সোমেন চন্দ সহসম্পাদক নির্বাচিত হন। জ্ঞান চক্রবর্তী ছিলেন ঢাকার সাহিত্যিক ও শিল্পীদের সমন্বয়কারী। তিনিই মূলত পেছন থেকে লেখক সংঘের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সত্যেন সেনও এই লেখক সংঘের সাথে যুক্ত ছিলেন। জ্ঞান চক্রবর্তী ও রণেশ দাশগুপ্তের উদ্যোগে ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘ ও গোপন কমিউনিস্ট পার্টির পাঠক্রম গড়ে উঠেছিল। এতে সোমেন চন্দ, কিরণশঙ্কর, অমৃত কুমার দত্তসহ আরো অনেকে যুক্ত হয়েছিলেন। এই পাঠক্রমের প্রশিক্ষক ছিলেন কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী।
১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে জ্ঞান চক্রবর্তী ঢাকায় ‘কংগ্রেস কর্মী সম্মেলন’ আহ্বান করেন। ওই বছর মে মাসে ‘কংগ্রেস কর্মী সম্মেলন’ আহ্বান করার অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। সে সময় তিনি ৮ মাস জেলে ছিলেন। ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে তিনি মুক্তি পাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান। ওই বছরের শেষের দিকে পুনরায় কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী ও অনিল মুখার্জীকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে। কারণ তাঁদের কাছে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিষ্ট পার্টির ইতিহাস’ বইটি ছিল। সে সময় কমিউনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। তাই এই বই রাখা এবং প্রচার করা অপরাধ। তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে। তাঁদের ৮ মাস জেল হয়। ১৯৪২ সালের মে মাসে তাঁরা মুক্তি পান।
১৯৩৮-৪২ সাল পর্যন্ত ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, রায়পুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় কমিউনিষ্ট পার্টির বিস্তারলাভের কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তীর অপরিসীম অবদান ছিল। তাঁর অবিরাম চেষ্টা আর শ্রমে গড়ে উঠেছিল রেল শ্রমিকদের সংগঠন রেল শ্রমিক ইউনিয়ন। এই রেল শ্রমিক ইউনিয়নে সোমেন চন্দ শ্রমিকদের সংগঠিতকরণের কাজ করতেন।
১৯৪২ সালের শেষের দিকে ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন গোপাল বসাক এবং জ্ঞান চক্রবর্তী এই কমিটির অন্যতম সংগঠক হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালে গোপাল বসাক অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার কারণে তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিলেন না। এ সময় ঢাকা কমিটি সর্বসম্মতি নিয়ে জ্ঞান চক্রবর্তীকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে।
১৯৪৩ সাল। বাংলা ১৩৫০ সন। এই সনটি ইতিহাসে মন্বন্তরের সন হিসেবে পরিচিত। এই সময় ইংরেজ শাসকদের অবহেলার কারণে সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয়। গ্রাম-বাংলার আনাহারী মানুষ খাবারের জন্য ছুটছে কলকাতার দিকে। ওলিতে-গলিতে, রাজপথে-ফুটপথে অগণিত মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। কাক ও কুকুরের সঙ্গে বুভুক্ষু মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খুঁজে ফিরছে ডাস্টবিনে- নর্দমায়। এ সময় কমিউনিষ্ট পার্টি সারা দেশব্যাপী লঙ্গরখানা খুলে বুভুক্ষু মানুষকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে। এই দুর্ভিক্ষ থেকে মানুষকে বাঁচাতে জ্ঞান চক্রবর্তী অমানুষিক পরিশ্রম করেন। সমস্ত ঢাকায় জনরক্ষা কমিটি করে লঙ্গরখানা চালু করেন।
জ্ঞান চক্রবর্তী ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দেশভাগের পর কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে চলে আসে। এ সময় ১৫ নম্বর কোর্ট হাউজ স্ট্রীটে পার্টি অফিস ও কারকুনবাড়ি লেনে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে পার্টির কমিউন স্থাপিত হয়। জ্ঞান চক্রবর্তী এই কমিউনে থেকে পার্টির কাজ করতেন। ওই সময় নবাবপুর রোডে পার্টির একটি বইয়ের দোকানও চালু হয়।
১৯৪৬, ১৯৫০ ও ১৯৬৫ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় জীবনবাজী রেখে অসীম সাহসিকতার সাথে তিনি দাঙ্গা মোকাবেলা করেন। পাকিস্তান আমলের পুরাটা সময় কেটেছে তাঁর জেল আর আত্মগোপনে। এ সময়কালে তিনি ৩ বার গ্রেফতারসহ ১৩ বছর আত্মগোপনে ছিলেন। আত্মগোপনে থাকাবস্থায় তিনি বিভিন্ন স্থানে পার্টি গড়ে তোলেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ভাষা আন্দোলনের ছাত্র নেতৃবৃন্দের পিছনে থেকে তাদেরকে এই আন্দোলন সংগঠিতকরণে পথ দেখিয়েছেন। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন, গাজীউল হকসহ প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মতো। এছাড়াও তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন প্রচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। জ্ঞান চক্রবর্তী ছিলেন প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন। ১৯৫৩ সালে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে প্রথম যে একুশের সংকলন বের হয়, এই সংকলনের মূল প্রবন্ধ তিনি ছদ্মনামে লেখেন।
১৯৬২ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এই কমিশন ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে একটি শিক্ষা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত এই রিপোর্টে আইয়ুব শাহীর ধর্মান্ধ, ধনবাদী, রক্ষণশীল, সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাসংকোচন নীতির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ করে এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। এই শরীফ কমিশন বিরোধী শিক্ষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে ও ‘৬৯ এর ১১ দফা আন্দোলনে একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে জ্ঞান চক্রবর্তীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তিনি। তরুণ ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক ও কৃষকদের রিক্রুট, ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি এবং কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর যোদ্ধাদের অন্যতম পরিচালক ও সংগঠকও ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে নবউদ্যমে আমৃত্যু কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির রক্ত পতাকা হাতে নিয়ে অগ্রসেনানী হিসেবে শোষণ মুক্তির লড়াই-সংগ্রামকে অগ্রসর করতে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর বিপ্লবী জীবন থেকে নতুন প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। কমিউনিস্ট কর্মীরা তো অবশ্যই। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ গড়ার জন্য তিনি আওয়ামীলীগ সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। এই হত্যার প্রতিবাদে প্রথম কমিউনিষ্ট পার্টি ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে মিছিল করে। জীবনবাজী রেখে এই প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিতকরণেও কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী ভূমিকা রেখেছিলেন।
১৯৭৭ সালের ১৯ আগষ্ট এই বীর বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১. কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী স্মরণে-প্রকাশক: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ১৯৭৭
২. সাপ্তাহিক একতা, ১৪ আগস্ট ১৯৮৭
৩. গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন-মাহফুজা খানম ও তপন কুমার দে, প্রকাশক: ডা. মাহফুজ শফিক, প্রকাশকাল: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)