১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর অনশনের সময় একদিন জ্যোতি বসু স্কুলে না গিয়ে অনশনে যোগ দেন। ঐদিন তিনি খদ্দর পরে শহীদ মিনার ময়দানে সুভাষ বসুর ভাষণ শুনতে যান। একসময় পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। জ্যোতি বসু পালানোর পরিবর্তে পুলিশকে মোকাবেলা করেন । আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘সেটাই বোধহয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে আমার প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ’।
ছোটবেলা থেকে তিনি বিপ্লবীদের জীবনী পড়তে খুব পছন্দ করতেন। একের পর এক জানতে শুরু করেন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের সংগ্রামী জীবনের কথা। আর এভাবে বিপ্লবীদের জীবনী পড়তে পড়তে একসময় নিজেই জড়িয়ে পড়েন লড়াই-সংগ্রামে। মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আমৃত্যু লড়াই করেন তিনি। মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে গড়ে তুলেছিলেন নিজেকে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সর্বভারতীয় রাজনীতিতেই অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব জ্যোতি বসু।
জ্যোতি বসু ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই কলকাতার হ্যারিসন রোডের একটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদি বাসস্থান বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বারোদি গ্রামে। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় জ্যোতিকিরণ বসু। স্কুলে ভর্তির সময় তাঁর নাম থেকে ‘কিরণ’ শব্দটি ছেঁটে দেওয়া হয়। কিন্তু মেধা ও কৃতিত্বের কারণে কিরণ শব্দটি তাঁর জীবনেরই সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদর করে তাঁকে ডাকা হতো ‘গনা’। বাবা নিশিকান্ত বসু। মা হেমলতা বসু। নিশিকান্ত বসু ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চতর শিক্ষালাভ করে তিনি কলকাতায় এসে প্র্যাকটিস শুরু করেন। এই সময় তাঁদের পরিবার বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন ধর্মতলায় হিন্দুস্থান বিল্ডিং-এর ভাড়া বাড়িতে। ১৯২৪ সালে নিশিকান্ত বসু হিন্দুস্থান পার্কে নিজে বাড়ি তৈরি করে সেখানে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন।
জ্যোতি বসুর পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক পাঠ শেষে তাঁর বাবা তাঁকে ১৯২০ সালে কলকাতার লরেটো স্কুলে ভর্তি করে দেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৬ বছর। লরেটো স্কুলের পাঠ্যক্রম ছিল চার বছর মেয়াদী। খুব মেধাবী হওয়ায় তিনি ‘ডাবল প্রমোশন’ পেয়ে তিন বছরে এই স্কুলের পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করেন।
১৯২৫ সালে তাঁকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়ার সময় ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। ঐ বিদ্রোহের বিরোধিতা করে স্কুলে লিফলেট বিতরণ করা হয়। জ্যোতি বসু তাঁর প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, বিপ্লবীরা তো দেশের স্বার্থেই বিদ্রোহ করেছেন। তাহলে তাঁরা অন্যায়টা কী করেছেন? এই স্কুল থেকেই তিনি নবম শ্রেণী পাস করেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে প্রেসিডেন্সী কলেজে অনার্স ভর্তি হন । ১৯৩৫ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ. অনার্স পাস করেন।
রাজনীতির সঙ্গে তাঁর পরিবারের তেমন সংযোগ ছিল না। তবে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহমর্মিতা ছিল সব সময়। ১৯১৩-১৪ সালে বিপ্লবী মদনমোহন ভৌমিক নিশিকান্ত বসুর বাড়িতে বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে ছিলেন। এখানে অস্ত্রও লুকিয়ে রাখতেন। পুলিশের তল্লাশীর সময় জ্যোতি বসুর মা তাঁর শাড়ীর ভাঁজে অস্ত্রটি লুকিয়ে রেখেছিলেন।
এই ঘটনাটি জ্যোতি বসু ছোট বেলা থেকে মা-বাবার কাছে প্রায়ই শুনতেন। এই বিপ্লবীর জীবন কাহিনীও জ্যোতি বসুর মানস-চেতনায় দেশপ্রেমের বীজ বোনে। সেই স্কুল জীবন থেকে ভাবতে থাকেন দেশ ও দেশের মানুষের কথা। চিন্তা করতে থাকেন কি করে মানুষের কল্যাণ করা যায়। ১৯২৬ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয় শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’। ওই বছরই সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এসময় তিনি ‘পথের দাবী’ গোপনে সংগ্রহ করে পড়েন।
ব্রিটিশ-ভারতে বিলেতি শিক্ষার সামাজিক ও পেশগত মূল্য ছিল অসীম। তাই ১৯৩৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অনার্স পাস করার পর তাঁর বাবা ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তাঁকে বিলেত পাঠান। বিলেতে এসে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ১৯৩৬ সালে ভূপেশ গুপ্ত পড়তে এলেন এখানে। এখানকার একটি বাড়িতে ভূপেশের সঙ্গে জ্যোতি বসুর প্রথম পরিচয় হয়। দেশ থেকে ভূপেশ গ্রেট ব্রিটেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে লিখিত একটি চিঠি সঙ্গে করে নিয়ে যান। ভূপেশের সঙ্গে জ্যোতি বসুও দেখা করলেন ব্রিটেনের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা হ্যারি পলিট, রজনী পাম দত্ত, বেন ব্র্যাডলে প্রমুখের সঙ্গে। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ ইন্ডিয়া লীগ এবং ভারতীয় ছাত্রদের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা করতেন।
মূলত এ সময় থেকেই জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিলেতে ‘ভারত লীগ’ ও ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস ইন গ্রেট বৃটেনে’র সদস্য ও ‘ভারত মজলিসে’র সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে তা যথাযথভাবে পালন করেন তিনি। ১৯৩৭ সালেই তিনি ‘ভারত লীগে’র সদস্য হন। ১৯৩৮ সালে জ্যোতি বসু ও তাঁর সহকর্মীদের উদ্যোগে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর বিলেত সফরের সময় এক সভার আয়োজন করা হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিলেত সফরকালেও একই ধরনের উদ্যোগ নেন জ্যোতি বসু। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে জনমত গঠনই ছিল ‘ভারত লীগে’র মুখ্য কাজ। এই সময় বিলেত, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডে তৈরি হয় কমিউনিস্ট গ্রুপ। কিন্তু ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ায় তখন প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি করা যেত না। ১৯৪০ সালে তিনি ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন।
দেশে ফিরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। একপর্যায়ে পার্টি থেকে তাঁকে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়। শুরু করেন শ্রমিক আন্দোলন। অল্প দিনের মধ্যে তিনি শ্রমিক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
এসময় বিশ্বযুদ্ধের চরিত্র পরিবর্তিত হয়। হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে বিশ্বযুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপ নেয়। কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সোভিয়েত সুহৃদ সঙ্ঘ’ ও ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক সঙ্ঘ’। জ্যোতি বসু হন এসব সঙ্ঘের সম্পাদক।
১৯৪১ সালে জ্যোতি বসু বিয়ে করেন বাসন্তী ঘোষকে। বিয়ের অল্পদিন পর ১৯৪১ সালেই টাইফয়েডে মারা যান বাসন্তী ঘোষ। কিছুদিন পর তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি গড়ে তোলেন ‘বেঙ্গল আসাম রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’। তিনি এই ইউনিয়নের সম্পাদক নির্বাচিত হন। জ্যোতি বসু ১৯৪৬ সালের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় কংগ্রেসের হুমায়ুন কবীরকে আট হাজার ভোটে পরাজিত করে বিধায়ক নির্বাচিত হন তিনি। এই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি মোট তিনটি আসন পেয়েছিল। জ্যোতি বসুর সঙ্গে দার্জিলিং কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন অপর কমিউনিস্ট নেতা রতনলাল ব্রাহ্মণ ও রূপনারায়ণ রায়।
নৌ-বিদ্রোহ, ডাক ধর্মঘট, বন্দী মুক্তি আন্দোলন, রশিদ আলি দিবস সব মিলিয়ে উত্তপ্ত পরিবেশ। এহেন পরিবেশে ১৯৪৬ সালের ১৪ মে নবগঠিত প্রাদেশিক আইনসভার প্রথম বৈঠক বসে। এই দিন রাজবন্দীদের মুক্তির বিষয়ে জ্যোতি বসু একটি মুলতুবি প্রস্তাব দেন। এই বৈঠকে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হলেও পরবর্তীতে সোহ্রাওয়ার্দী এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১৫ আগস্টের মধ্যে রাজবন্দীদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন। বন্দীরাও মুক্তি পান। এই বন্দীমুক্তির ব্যাপারে জ্যোতি বসু ও কমিউনিস্ট পার্টিই মূলত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং আইনসভায় তাঁরা কংগ্রেসের সহায়তাও পেয়েছিলেন।
জ্যোতি বসু ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিধানসভায় ভাষণ দেন। তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিবারণে কাজ করেন। স্নেহাংশু আচার্যের সঙ্গে ছুটে যান ময়মনসিংহে হাজং যোদ্ধাদের পাশে। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে জ্যোতি বসু দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন কমলা বসুকে।
স্বাধীন দেশে বিধানসভা অধিবেশনের প্রথম দিনেই জনসাধারণের উপর কংগ্রেসী সরকারের পুলিশী দমন-পীড়নের সমালোচনা করেন জ্যোতি বসু । কিছুদিন পর কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ঘোষিত হলে গ্রেপ্তার করা হয় জ্যোতি বসুকে। বিনা বিচারে ৩ মাস আটক থাকার পর মুক্তি পান। এরপর তিনি পার্টির পরামর্শে আত্মগোপনে চলে যান। ‘বকুল’ ছদ্মনামে গোপনে পার্টির সংবাদ পৌঁছে দেন নেতৃত্বের কাছে। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে রান্না করা, ঝাঁট দেওয়া, বাসন ধোওয়া ইত্যাদি কাজও করেন তিনি। তেলেঙ্গানার সংগ্রামীদের মুক্তির দাবিতে ছুটে যান জওহরলাল নেহরুর কাছে। বিধায়ক হিসাবে প্রাপ্য অর্থ তুলে দেন পার্টি তহবিলে এবং পার্টির ভাতায় সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে কাজ করেন শৃঙ্খলার সঙ্গে।
১৯৫১ সালে দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার যাত্রা শুরু হয় এবং জ্যোতি বসু এই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হন। স্বাধীন ভারতে ১৯৫২ সালে প্রথম নির্বাচনের পর কমিউনিস্টদের আসন সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ জন।
জ্যোতি বসুর একমাত্র ছেলে চন্দন বসু জন্ম নেন ১৯৫২ সালে।
১৯৫৩ সালের ট্রামভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের সময় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ঐ সময় শিল্পে শান্তিরক্ষার নামে কালাকানুন আনার কঠোর বিরোধিতা করেন জ্যোতি বসু। ১৯৫৪ সালে বিধানসভায় বসে শিক্ষক আন্দোলনের উপর দমন-পীড়নের নিন্দা জানিয়ে জ্যোতি বসু শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারপক্ষকে আহবান জানান। বিধানসভা থেকে বেরোতেই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে দু’দিন জেলে আটকে রাখে। ১৯৫৩-৫৪ সাল পর্যন্ত ষষ্ঠ রাজ্য সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
১৯৫৭ সালের নির্বাচনে বরানগরে কংগ্রেস প্রার্থী কানাইলাল ঢোলকে পরাস্ত করে তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচিত হন জ্যোতি বসু। ১৯৫৮ সালে তিনি প্রথম কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের দাবিতে বিধানসভায় আলোচনা করেন। খাদ্য আন্দোলনের সময় কংগ্রেস সরকারের নৃশংস বর্বরতা ও ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেন। ১৯৫৯ সালে কংগ্রেসী গুন্ডারা বরানগরে তাঁর উপর হামলা করে। সহকর্মীরা তাঁকে হামলা থেকে রক্ষা করতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছিলেন।
১৯৬১ সালে অন্ধ্র প্রদেশের বিজয়ওয়াদাতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ডাঙ্গের নেতৃত্বাধীন সংশোধনবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে বত্রিশজন জাতীয় পরিষদ সদস্য ওয়াকআউট করেছিলেন জ্যোতি বসু তাঁদের মধ্যে ছিলেন। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে জ্যোতি বসু চতুর্থবারের জন্য নির্বাচিত হন।
১৯৬৩ সালে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ সম্পর্কে পার্টির বক্তব্যকে দৃঢ়তার সঙ্গে উপস্থিত করেন । তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবেই দু’দেশের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে নিতে হবে। এজন্য কংগ্রেস সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। প্রায় এক বছর পর তিনি মুক্তি পান। জেলে থাকার সময় তাঁর বাবা মারা যান।
১৯৬৪ সালে অনুষ্ঠিত তেনালী কনভেনশনেরও অন্যতম শীর্ষ সংগঠক ছিলেন জ্যোতি বসু। কলকাতায় পার্টির সপ্তম কংগ্রেসের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন তিনি। এই কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটি তথা পলিট ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে সি পি আই (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র পিপলস ডেমোক্র্যাসি আত্মপ্রকাশ করলে জ্যোতি বসু হন তাঁর প্রথম সম্পাদক। ১৯৬৭ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে যে বাম হঠকারিতার বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত হয়েছিল বসু ছিলেন তার সামনের সারিতে। ১৯৬৭ সালে বরানগর কেন্দ্রে কংগ্রেসের অমরেন্দ্র ভট্টাচার্যকে হারিয়ে তিনি নির্বাচিত হন। তাঁর জনপ্রিয়তার কারণে ১৯৭০ সালে পাটনা স্টেশনে আনন্দমার্গীরা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি।
১৯৭১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে শ্যামপুকুরে হত্যা করা হয় জননেতা হেমন্ত বসুকে। ওই বছর অজয় মুখার্জিকে পরাজিত করে আবারো জ্যোতি বসু নির্বাচিত হন। কিন্তু সর্বাধিক আসন পাওয়া সত্ত্বেও সি পি আই (এম)-কে সরকার গঠনের জন্য ডাকলেন না রাজ্যপাল। ১৯৭২ সালে কংগ্রেস নির্বাচনের নামে পুরোপুরি প্রহসন শুরু করে। জ্যোতি বসু ওই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তিনিই নির্বাচনে জয়ী হন।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আবির্ভাব হয়। সাতগাছিয়া কেন্দ্রে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বিধানসভায় ফিরে এলেন জ্যোতি বসু। এবার তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেন। তখন তাঁর বয়স ৬৩ বছর।
মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। নকশালপন্থীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১৭,০০০ রাজনৈতিক বন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়। ১০,০০০ মামলা প্রত্যাহার করা হয়। রাজনৈতিক কারণে কর্মচ্যুত প্রত্যেক সরকারী কর্মচারীর চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
অগ্রাধিকার পেয়েছিলো ভূমি সংস্কারের কাজ। চালু হয় অপারেশন বর্গা। ফিরিয়ে দেওয়া হয় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার। বসু ঘোষণা করেন, শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে পুলিশ হস্তক্ষেপ করবে না। তাঁরই মন্ত্রিসভা নিয়মিত পঞ্চায়েত ও পৌরসভা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন।
১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হয়। এই বন্যা মোকাবিলায় আশ্চর্য সাফল্য দেখিয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস পুনরায় দিল্লিতে ক্ষমতায় যায়। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের প্রশ্নটি সর্বভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে তুলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জ্যোতি বসুর বিরাট ভূমিকা ছিলো। বৃহৎ শিল্প স্থাপনে কেন্দ্রের লাইসেন্স প্রথা, মাসুল সমীকরণ নীতি, রাজ্যগুলোর আর্থিক সামর্থ্যকে শুকিয়ে মারার চক্রান্তের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সরব। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮৩ সালে সরকারি কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়। ১৯৮৫ সালেই বামফ্রন্ট সরকার যৌথ উদ্যোগে বৃহৎ শিল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৮৬ সালে দার্জিলিং জেলায় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নেয়। এই সময় জ্যোতি বসুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় রাজ্যভাগ প্রতিহত করা যায় এবং গঠিত হয় ‘দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ’। তিনবিঘা চুক্তি সম্পাদন ও ফারাক্কা জল চুক্তির বিষয়ে জ্যোতি বসুর ভূমিকা ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
১৯৯৬ সালে যুক্তফ্রন্টের আমলে জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব উঠলে তিনি দলের সিদ্ধান্তে তা প্রত্যাখান করেন অকপটে। পরে তাঁকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তাতেও সায় দেয়নি তাঁর দল।
২০০০ সালের নভেম্বরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নেন। তখনই তিনি বলেছিলেন, “আমি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নিচ্ছি – তবে রাজনীতি থেকে নয়। কমিউনিস্টরা অবসর নেয় না। যতদিন শরীর অনুমতি দেবে ততদিন মানুষের মুক্তির সংগ্রামে কাজ করে যাবো”।
২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউ পি এ সরকার গঠিত হয় বামপন্থীদের বাইরে থেকে সমর্থনের ভিত্তিতে। এই সরকার গঠনের ক্ষেত্রে জ্যোতি বসু ও হরকিষেণ সিং সুরজিতের বিশেষ ভূমিকা ছিলো। ২০০৫ সালে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত সি পি আই (এম)-র অষ্টাদশ কংগ্রেসে জ্যোতি বসু পলিট ব্যুরোয় পুননির্বাচিত হন। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও তিনি প্রচারাভিযানে অংশ নেন। ২০০৮ সালে কোয়েম্বাটোরে অনুষ্ঠিত সি পি আই (এম) ঊনবিংশ কংগ্রেসে তিনি পলিট ব্যুরোর স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তাঁর শরীর ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। ২০০৯ সালে ইন্দিরা ভবনের বাইরে বেরনোর মতো অবস্থা ছিল না তাঁর। তবু সেখানে বসেই পার্টির তথা সরকার পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন, নানা ধরনের আনুষ্ঠানিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। জ্যোতি বসু অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘যত দূর মনে পড়ে’।
কমরেড জ্যোতি বসু ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি ৯৭ বছর বয়সে সল্ট লেকের ‘AMRI Hospital’ – এ মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। জ্যোতি বসু: যতদূর মনে পড়ে: রাজনৈতিক আত্মকথন, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা. লি. কলকাতা, ভারত; ২০০৬ সাল।
২। রাজনীতির জ্যোতি বসু: রেহমান শামস, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা, বাংলাদেশ; ২০০৪ সাল।
৩। বাংলার বিধানসভা ও সংসদীয় রাজনীতি (১৮৬২-১৯৫১), সত্যব্রত দত্ত, বুক সিন্ডিকেট প্রা. লি., কলকাতা, ১৯৯৫ সাল।
৪। দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা, ২৬ জানুয়ারী ২০১০ সংখ্যা।
৫। সাপ্তাহিক একতা, ২৩ জানুয়ারী ২০১০ সংখ্যা।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)