১৯২১ সালে জিতেন ঘোষ অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে কলেজ ত্যাগ করে ওই আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হন এবং স্কুল-কলেজের শত শত ছাত্রকে এই অসহযোগ আন্দোলনে শামিল করেন। এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে দেড় বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে ঢাকা জেলহাজতে পাঠায়।
তখন জেলখানাগুলোতে দেশপ্রেমিক কয়েদীদের উপর ব্রিটিশ সরকার সীমাহীন নির্যাতন চালাত। কয়েদীদেরকে ঘানি টানতে বাধ্য করা হতো। দুর্গন্ধযুক্ত, পাথর মেশানো ভাত, জঙ্গলের তরিতরকারী ও ছোবলাসহ ডাল ছিল কয়েদীদের খাবার। আর কথায় কথায় দৈহিক নির্যাতন তো রয়েছেই। কিন্তু এর কোনোকিছুই জিতেন ঘোষকে দুর্বল করতে পারেনি। তিনি জেলের এসব নিয়ম-কানুন পরোয়া করতেন না। এজন্য তাঁকে বহুবার প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছে। তবু তাঁর এক কথা তিনি ইংরেজ জেলের নিয়ম-কানুন মানবেন না। একদিন তাঁকে ঘানি টানার জন্য নেয়া হল। তিনি প্রথম থেকেই একাজ করতে অস্বীকৃতি জানান। জেলের কর্মকর্তা তাঁকে প্রচণ্ড মারধর শুরু করেন। জিতেন ঘোষও হাতের কাছে যা পেলেন তা দিয়ে মার প্রতিরোধ করলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ পাগলাঘন্টি বাজায়। তৎক্ষণাৎ লাঠি, বন্দুকধারী সিপাহীরা এসে তাঁকে প্রচণ্ডভাবে মারতে শুরু করে। তাঁর নিজের বিবরণ থেকে বোঝা যায় মারের রূপ কি ভয়াবহ ছিল।
“চলল মার। উঃ কি দারুণ সে মার”। “আমার গা দিয়ে রক্ত বেরুল। নাক দিয়ে রক্ত ছুটল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে নিয়ে ডিক্রীতে বন্ধ করে দেওয়া হল। আমি মেঝেতেই পড়ে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে জেগে দেখি পানির কলসিটাও নেই। সরানো হয়ে গেছে। একটু পানিও খেতে পেলাম না। ডাক্তার আসাতো দূরের কথা, একফোঁটা ঔষধও পেলাম না। পানির অভাবে নাক-মুখের রক্তও ধোয়া গেল না। কম্বলটা বেশ করে বিছিয়ে শুয়ে পরলাম” (জেল থেকে জেলে-পৃষ্ঠা:-১৩)।
এত অত্যাচারের পরও তিনি জেলের নিয়ম-শৃঙ্খলা মানলেন না। এর ফলে সদা সন্ত্রস্ত কয়েদীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেন এক অসাধারণ মানুষ। দুর্ধর্ষ কয়েদীরা এসে তাঁকে সালাম দিতে শুরু করে।
জিতেন ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ সালে। মুন্সিগঞ্জ জেলার কুমারভোগ গ্রামে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিক্রমপুরের স্থান ছিল অনন্য। ব্রিটিশসাম্রাজ্যের পূর্বে মোগল সম্রাটদের বিরুদ্ধে বারো ভূঞাদের সংগ্রামের একটা প্রধান কেন্দ্র ছিল এই বিক্রমপুর। এখানে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য দেশপ্রেমিক বিপ্লবী, যারা দেশ-বিদেশে তাঁদের ত্যাগ ও বীরত্বে অপূর্ব নিদর্শন রেখেছেন।
মা, বাবা, ভাই-বোনের সাধারণ পরিবারে জিতেন ঘোষ ছিলেন কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। বাল্যকাল সম্পর্কে তিনি লিখেছেন- “রাজনীতিতে তখনও নাম লিখাইনি। কিন্তু মনে মনে এদেশে ইংরেজ রাজত্ব পছন্দ করতাম না। একটু অপমান ও লজ্জা বোধ করতাম ইংরেজদের অধীনে আছি বলে” ( জেল থেকে জেলে-পৃষ্ঠা:-১)। কৈশোরের প্রথম থেকেই তিনি গীতা, চন্ডী পাঠ করে আত্মিকশক্তি ও সংগ্রামী মনোভাবকে উদ্দীপ্ত করেন এবং সাধারণ মানুষকে সেবা করার জন্য সেবাশ্রম ও লাইব্রেরী গড়ে তোলেন। এখান থেকে তিনি দেশপ্রেমের ভাবধারাকে সহপাঠী তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় তাঁকে বিপ্লবীদের একজন মনে করে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন আটক রেখে মারধর ও জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ছেড়ে দেয়। আগুনে ঘৃতাহুতির মতো, একারণে জিতেন ঘোষের মনে স্বাধীনতার আগুন জ্বলে উঠে।
প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ করার পর তাঁকে কাজিরপাগলা অভয়কুমার তালুকদার হাই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। স্কুলে পড়ার সময় তিনি বিপ্লববাদী দল ‘যুগান্তরে’র সাথে যুক্ত হন। বিক্রমপুরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদেরকে নিয়ে বিপ্লবী গ্রুপ গঠন করেন তিনি। ১৯১৭ সালে এই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর আই.এ. ভর্তি হন। এসময়ও তিনি বিপ্লবী দলে কলেজ ছাত্রদেরকে টেনে আনার কাজে যুক্ত থাকেন। ১৯১৯ সালে আই.এ. পাশ করার পর ১৯২০ সালে বি.এ. ভর্তি হন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হন এবং এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
দেড় বছর কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার কারণে ছ’মাস পরেই তিনি মুক্তি পান। কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতে দু’বছরের সাজা নিয়ে আবার জেলে যান। এই জেলে তিনি সাক্ষাৎ পান মাদারীপুরের বিপ্লবী নেতা পূর্ণদাসের। জেলের ভিতরে বসে এম.এন. রায় সম্পাদিত কয়েকটি গোপন পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। তাতে তিনি সমাজতন্ত্রের ধারণা পান। তখন থেকে তাঁর মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিতে শুরু করে। ওই বছর শেষের দিকে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। তারপর ঢাকা শহরে কিছুদিন কাটিয়ে কলকাতা যান। তখন গান্ধীজীর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের মনে হতাশা চলে আসে। একমাত্র কংগ্রেস নেত্রী হেমপ্রভা কিছু কর্মীকে নিয়ে পিকেটিং চালিয়ে যাচ্ছেন। জীতেন ঘোষ এদলে যুক্ত হওয়ায় তাঁকে ছ’মাসের কারাদন্ড দিয়ে হুগলি জেলে পাঠানো হয়। এখানে তিনি দেখা পেলেন বিপ্লবী যতীন দাসের। যতীন দাস জেলখানার অবিচারের বিরুদ্ধে ৬১ দিন অনশন করে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর ধারাবাহিকতায় একসময় জিতেন ঘোষ জেলখানার অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। যার ফলে তাঁকে আবারও নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
১৯২৪ সালে তিনি মুক্তি পেয়ে কলকাতায় কিছু দিন থাকার পর ঢাকায় চলে আসেন। এর কিছুদিন পর তিনি গ্রামে চলে যান। গ্রামে গেলেও তাঁর উপর পুলিশের নজরদারি থাকায় তিনি বিপ্লবী তৎপরতা চালাতে পারছিলেন না। তাই তিনি বার্মায় যেয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২৪ সালের শেষের দিকে বিপ্লবী পার্টির সংগঠক হিসেবে বার্মা যান। সেখানে তিনি রেলওয়ের হিসাব বিভাগে চাকুরী নেন। তখন বার্মার অধিবাসী বাঙ্গালীদের ভিতরে গোপন বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠে। তিনি সেই বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দেন এবং ওই বিপ্লবী গ্রুপটিকে শক্তিশালী বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন। বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
১৯৩০ সালে বার্মায় এক কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়। এই কৃষক বিদ্রোহে জীতেন ঘোষের বিপ্লবী দল সমর্থন জানায়। বার্মা সরকার এসময় অর্ডিনেন্স জারি করে জিতেন ঘোষসহ কয়েকজন বাঙ্গালী যুবককে গ্রেফতার করে ইনসিন জেলে পাঠায়। কিছুদিন পর সেখান থেকে তাঁকে রেঙ্গুনের একটি ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯৩১ সালে তিনি মুক্তি পান।
মুক্তির চারমাস পর বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ আবার তাঁকে কলকাতা থেকে গ্রেফতার করে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠায়। প্রেসিডেন্সি জেল ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পীঠস্থান। এখানে তাঁকে বিনাবিচারে রাজবন্দী হিসাবে আটক রাখা হয়। এ জেলেই তিনি ‘যুগান্তর’, ‘অনুশীলন’ ও কমিউনিষ্ট মতাদর্শের অসংখ্য বিপ্লবীদের সাক্ষাৎ পান। জিতেন ঘোষ ছিলেন যুগান্তর দলের সদস্য। এই জেলে অবস্থানকালে তিনি পুরোপুরি কমিউনিস্ট মতাদর্শ গ্রহণ করেন। সাত বছর বিনা বিচারে আটক থাকার পর ১৯৩৮ সালে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর ওই বছরই তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন। তারপর নিজ গ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য কৃষকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। বিক্রমপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী অনেকেই তখন জিতেন ঘোষের মাধ্যমে কৃষক সংগঠনে যুক্ত হন। তারপর তিনি ঢাকা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য কাজ করেন। এসময় তিনি কৃষকদের সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে ঢাকা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেন।
১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঢাকার কমিউনিস্ট কর্মীরা সারা উপমহাদেশের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ঢাকার গেন্ডারিয়ায় কংগ্রেস কর্মী সম্মেলনের আয়োজন করেন। ব্রিটিশ সরকার এই কংগ্রেস কর্মী সম্মেলনের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। সেদিন কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীরা ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে সম্মেলন অনুষ্ঠিত করে। কমরেড নেপাল নাগ, নরেশ গুহ, বঙ্গেশ্বর, ফণী গুহ, প্রমথ নন্দী, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, জ্ঞান চক্রবর্তী, সুশীল সরকার, জিতেন ঘোষ প্রমুখ এই সম্মেলনের নেতৃত্ব দেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন অগ্নিযুগের বিভিন্ন বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্য। এসময় ১৭ জন কমিউনিস্ট নেতার সাথে আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪১ সালের শেষের দিকে তিনি মুক্তি পান। মুক্তির পর তিনি মুন্সিগঞ্জ মহকুমায় ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৪২ সালে পুনরায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় এক বছর পর মুক্তি লাভ করেন তিনি।
১৯৪৩ সাল ইতিহাসে মন্বন্তরের সাল হিসেবে পরিচিত। এই সময় ইংরেজ শাসকদের অবহেলার কারণে সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয়। গ্রাম-বাংলার অনাহারী মানুষ খাবারের জন্য কলকাতার দিকে ছুটতে থাকে। ওলিতে-গলিতে, রাজপথে-ফুটপথে অগণিত মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। কাক ও কুকুরের সঙ্গে বুভুক্ষু মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খুঁজে ফিরছে ডাস্টবিনে- নর্দমায়। এ সময় কমিউনিষ্ট পার্টি সারা দেশব্যাপী লঙ্গরখানা খুলে বুভুক্ষু মানুষকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে। এই দুর্ভিক্ষ থেকে বিক্রমপুরের মানুষকে বাঁচাতে জিতেন ঘোষ অমানুষিক পরিশ্রম করেন। তিনি দুর্ভিক্ষের সময় চাঁদা তুলে বিক্রমপুরে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বিক্রমপুর তাঁতি ও জেলেদের মধ্যে কো- অপারেটিভ সোসাইটি গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ ও শ্রম তুলনাহীন।
১৯৪৭ সালে জিতেন ঘোষ ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে পাক-পুলিশ তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। জেলে নিম্নকর্মচারী ও সহবন্দীদের নিয়ে রাজনীতি বিষয়ে পড়াশুনার স্কুল চালু করেন তিনি। মানুষের মুক্তি কিসে, কিভাবে এবং এক্ষেত্রে কার কি করণীয় এসব বিষয় নিয়ে নিয়মিত পড়াশুনা হত। জেলের সাধারণ কয়েদীরা তাঁর সংস্পর্শে এসে কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শ গ্রহণ করেন এবং তাঁরা জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালের শেষ ভাগে জিতেন ঘোষ মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এরপর তিনি চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান। সেখানে প্রায় তিন বছর ছিলেন। এখানে তিনি অসুস্থ্ শরীর নিয়ে মাঝে মধ্যে পার্টির কাজে, কৃষকদের কাজে বের হয়ে পড়তেন। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারী মাসে পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা জেলার শত শত কৃষক প্রতিনিধি দল নিয়ে তিনি এই সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনের পর ঢাকা জেলার কৃষক সমিতি গঠিত হয়। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় এক কৃষক সমাবেশের আহ্বান জানায় পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি। এই সমাবেশের মাধ্যমে কৃষক সমিতির কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সভাপতি হন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সম্পাদক হন জিতেন ঘোষ। অক্টোবর মাসে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে গণহারে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠান। এসময় জিতেন ঘোষকে গ্রেফতার করা হয়। এবার জেলের মধ্যে তিনি বেশ কয়েকবার মারাত্মকভাবে অসুস্থ্ হয়ে পড়েন। কিন্তু পাক-সরকার তাঁকে মুক্তি দেননি। অবশেষে ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক সংগঠনের কাজে যুক্ত হন। মুন্সিগঞ্জ, বিক্রমপুর, নারায়নগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া, কাপাসিয়াতে বড় বড় কৃষক সম্মেলন সংগঠিত করেন তিনি। ১৯৬৩ সালে জিতেন ঘোষ ও হাতেম আলী খান একত্রে মিলে ওসমান গনি রোডে কৃষক সমিতির কার্যক্রম পরিচালনা করেন। জিতেন ঘোষ থাকতেন ঢাকা জেলা কৃষক সমিতির অফিসে (১৫৪/এ রেবতী মোহন দাস রোড, সুত্রাপুর)। সন্তোষ গুপ্ত ঢাকায় এলে মাঝে মাঝে জিতেন ঘোষের সাথে থাকতেন।
১৯৬৪ সালে কাশ্মীরের হযরতবাল মসজিদ থেকে ইসলাম ধর্মের স্মৃতিচিহ্ন চুরি হয়ে যায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও খুলনাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। যার ফলে ওসমান গনি রোডে কৃষক সমিতির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন পর তিনি বিক্রমপুরে চলে যান। সেখানে তিনি কৃষকদের নিয়ে রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে দাঙ্গা মোকাবেলা করেন। ১৯৬৫ সালের মধ্যে তিনি ঢাকা জেলায় একটি শক্তিশালী কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তাঁকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার কিছু দিন পর আবার তাঁকে জেলে যেতে হয়। কারণ পাকিস্তান সরকার তাঁকে জেলের বাইরে রেখে স্বস্তি পাচ্ছিল না। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থানের সময় মুক্তি পান। ওই বছর ১৪ এপ্রিল এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে ঢাকা ও কুমিল্লা জেলায় শত শত লোক মারা যায় এবং ঘরবাড়ি ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। শুধু ডেমরাতে ৮০০ লোক মারা যায়। এসময় জিতেন ঘোষ তাঁর কৃষক কর্মীবাহিনী নিয়ে দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যান এবং দুর্গতদের মাঝে বিতরণ করেন। অসংখ্য গৃহহীন মানুষকে গৃহ নির্মাণ করে দেন। এতে করে ওই সমস্ত এলাকায় তাঁর বেশ পরিচিতি গড়ে উঠে। যার ধারাবাহিকতায় তিনি ওই এলাকাগুলোতে কৃষক আন্দোলন ও সংগঠন ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। ১৯৭০ সালের প্রথমভাগে অনেকগুলো দাবি নিয়ে সর্বকালের বৃহত্তম শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত করেন তিনি। আড়াই মাইলব্যাপী এই শোভাযাত্রা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বস্ত্র, টাকা ও খাদ্য সংগ্রহ করেন। ১৯৭৫ সালে রেকর্ড বর্গার অধীনস্থ আন্দোলন শুরু করেন তিনি। হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে এই আন্দোলনে জয়যুক্ত হলে দেশের ১৫ হাজার কৃষক জমির পূর্ণ মালিকানা লাভ করেন। এ সময় বেশ কিছুদিন তিনি অন্তরীণ জীবন যাপন করেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হলে এই সংগঠনের জাতীয় কৃষক লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনীত হন। জিতেন ঘোষ ছিলেন চিরকুমার। তিনি সারা জীবন কৃষক ও মেহনতী মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। জেল খেটেছেন যুগের পর যুগ। তিনি বহু গ্রন্থও রচনা করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: গারোদের আড়াল থেকে, অগ্নিদিনের বর্মা, জেল থেকে জেলে। জিতেন ঘোষ ১৯৭৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ: জ্ঞান চক্রবর্তী। প্রকাশক জিতেন ঘোষ কল্যাণ ট্রাষ্ট্রের পক্ষে কাজী আকরাম হোসেন। প্রকাশকাল: অক্টোবর ১৯৭৭ সাল।
২। জিতেন ঘোষ রচনাসমগ্র: সম্পাদনা আব্দুল হালিম খান ও দিলওয়ার হোসেন। প্রকাশক: রাজন ইসলাম। প্রকাশকাল: ২০১০ সাল।
৩। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের জীবনকথা: তপন কুমার দে। জাগৃতি প্রকাশনী, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারী ২০০৫।
৪। গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন- মাহাফুজা খানম ও তপন কুমার দে। প্রকাশক: ডা. মাহফুজ শফিক, প্রকাশকাল: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সাল।
৫। ছবি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
লেখক: রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)