জসীমউদ্দীন মণ্ডলের দাদাবাড়ি ছিলো নদীয়া জেলার হৃদয়পুর গ্রামে। ছেলেবেলায় সেই গ্রামে গরু চরাতে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বহুদিন নীলকুঠির ভাঙাচোরা দালানের কাছাকাছি যেতেন। সেখানে কোনো গাছের ছায়ায় বসে গ্রামের বয়স্ক লোকদের কাছ থেকে কুঠিয়াল ইংরেজদের অত্যাচারের কাহিনী শুনতেন। নীল জিনিসটা কি, সেটা তিনি তখনো বুঝতেন না। তবে ইংরেজরা যে নীল চাষের জন্য চাষাভুষো মানুষদের ওপর অত্যাচার করতো, সেটা তাঁর কাছে ওই বয়সেই অন্যায় কাজ বলে মনে হতো। সে কারণে ইংরেজদের ওপর সেই ছেলেবেলাতেই বিতৃষ্ণা জন্মেছিলো তাঁর মনে ।
তাঁরা যখন পার্বতীপুরে ছিলেন তখন তাঁদের পাশের বাসায় থাকতেন তাঁর বাবার এক সহকর্মী বন্ধু। তিনি ছিলেন স্বদেশী। বাবার অনুরোধে একদিন তিনি তাঁকে পড়াতে শুরু করলেন। কিন্তু পড়াশোনার দিকে জসীমউদ্দীন মণ্ডলের আদৌ কোনো মনোযোগ ছিলো না। তাঁর বাবার সেই বন্ধুটি তাঁকে পড়ানোর জন্য খুব চেষ্টা করতেন। তবে পড়ার চাইতে তিনি তাঁর সেই শিক্ষকের কাছ থেকে স্বদেশীদের গল্প শুনতে বেশি পছন্দ করতেন। তখন ব্রিটিশ রাজকে তাড়াবার জন্য তরুণরা হাতে তুলে নিয়েছেন অস্ত্র। তাঁদের সেই সব রোমাঞ্চকর কাহিনী তখন লোকের মুখে মুখে। মাস্টারদা, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা তখন কিংবদন্তির নায়ক-নায়িকা। ধুতির কোঁচায় পিস্তল গুজে রাখা, বোমাবাজি করা এসব ছিলো জসীমউদ্দীন মণ্ডলের কাছে সত্যিকারভাবেই রোমাঞ্চকর ঘটনা। তাঁর কাছে শুনতেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে মাস্টারদার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কথা, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে প্রীতিলতা ও কল্পনার সাহসিকতার কথা। সেসব কথা বলতে বলতে এক একদিন তাঁর শিক্ষকও উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। তাঁর চোখ দুটো অজানা আক্রোশে ধিকি-ধিকি জ্বলে উঠত।
সেসব গল্প শুনতে শুনতে জসীমউদ্দীন মণ্ডলের মনে হতো, হায়, তাঁর কোমরেও যদি এমনি একটা পিস্তল থাকতো, তিনিও যদি স্বদেশী হতে পারতেন! এসব গল্প শোনার কারণে সেই ছেলেবেলাতেই স্বদেশীদের ওপর তাঁর মোহ জন্মে এবং ইংরেজদের প্রতি জন্মে ক্ষোভ। আর তাই তো ব্রিটিশদেরকে এদেশ থেকে তাড়ানোর জন্য, এদেশের মানুষকে তাঁদের অত্যাচার, নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং বিপ্লবী ও শ্রমিক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
জসীমউদ্দীন মণ্ডলের জন্ম হয়েছিলো এমন একটা পরিবারে, যেখানে জন্ম-তারিখ কিংবা জন্মসন ঘটা করে লিখে রাখবার কোনো রেওয়াজ ছিলো না। তাঁর মা বলতেন, “সেই যে দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ শুরু হলো, তার ঠিক দশ বছর পর তোর জন্ম।” তার থেকেই আন্দাজ করা যায়, ১৯১৪ সাল থেকে দশ বছর পরে অর্থাৎ ১৯২৪ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আজকের কুষ্টিয়া জেলা তখন অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নদীয়া জেলার কালীদাশপুর গ্রাম তাঁর জন্মস্থান। তাঁর বাবার নাম হাউসউদ্দীন মণ্ডল। ছেলেবেলায় দাদীর মুখে শুনেছিলেন, দাদী আদর করে তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন হাউস অর্থাৎ শখ। তাঁর বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন।
সে সময় আজকের দিনের মতো এতো স্কুল ছিল না। গ্রামে তো প্রায় ছিলো না বললেই চলে। দু’একটা মক্তব, পাঠশালা যাও-বা ছিলো, সেগুলোরও প্রায় টিম-টিমে অবস্থা। নানাবাড়ির গ্রামের এমনি একটা পাঠশালায় শুরু হয় তাঁর বিদ্যা অর্জনের কসরত। তবে বিদ্যা অর্জনের চাইতে বিদ্যা বিসর্জনের আয়োজনই ছিলো সেখানে বেশি। পাঠশালার মাষ্টার মশাই তাঁদেরকে সেদিনকার মতো পাঠ ধরিয়ে দিয়ে নড়বড়ে টেবিলে খ্যাংরা কাঠির মতো পা দু’খানা তুলে আয়েশ করে সটান হতেন। কিছুক্ষণের ভেতরেই শুরু হতো তাঁর নাকের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর গর্জন। তাঁরা সেই অবসরে পিঠটান দিতেন আমবাগান মুখে। কতোবার যে আম পাড়তে গিয়ে মাষ্টার মশাইয়ের বকুনি খেয়েছেন তার হিসেব নেই।
১৯৩২ সালে তাঁর বাবা বদলি হয়ে এলেন সিরাজগঞ্জে। এরপর তিনি বদলি হলেন রানাঘাটে। সেখান থেকে পার্বতীপুর। জসীমউদ্দীন মণ্ডলরাও বাবার সাথে সাথে চলে এলেন পার্বতীপুর। মূলত তাঁর বাবার এই ঘন ঘন বদলির কারণে, তাঁর পড়াশোনা তেমন এগোতে পারেনি। তবে দুনিয়াদারি সম্পর্কে তাঁর ধারণা হয়েছিলো বিস্তর। এরপর তাঁর বাবা বদলি হয়ে এলেন ঈশ্বরদী। ঈশ্বরদীতে আফসার ছিলো তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
এরপর একদিন তাঁর বাবা বদলি হলেন কলকাতায়। তাঁর অনেকদিনের শখ পূরন হলো এবার। এখন থেকে প্রাণভরে স্বদেশী দেখতে পারবেন ও স্বদেশীদের সাথে মিশতে পারবেন। তাঁদের বাসা ছিল নারকেলডাঙা কলোনিতে। কলোনিটি চারপাশে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। প্রাচীরের পাশ দিয়ে চলে গেছে বড় বাজারের রাস্তা। রাস্তার উপর নারকেলডাঙা ব্রিজ। সেই রাস্তা ধরে দুপুরের খর রোদে মিছিল করে চলে যেতো অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষরা। আর মিছিলের পুরোভাগে দৃপ্ত পদভারে বুক চিতিয়ে হেঁটে যেতেন শ্রমিকের দল। তখন সমস্ত কলকাতাই পরিণত হয়েছিলো যেনো মিছিলের নগরীতে। ইংরেজ খেদাবার জন্য সমস্ত শহরের মানুষ যেনো ক্ষীপ্ত হয়ে উঠেছে। নারকেলডাঙা কলোনির তাঁরা ক’জন কিশোর প্রাচীরের ওপর বসে বসে দেখতেন সেইসব মিছিল আর পদযাত্রা। মিছিল থেকে “ইংরেজ বেনিয়া এদেশ ছাড়ো, ভারত মাতাকে মুক্ত কর”, “লাল ঝাণ্ডা কি জয়”, “ভারত মাতা কি জয়” ইত্যাদি শ্লোগান উঠতো।
প্রতিদিন মিছিল দেখে দেখে আর শ্লোগান শুনে শুনে জসীমউদ্দীন মণ্ডল মনে মনে উৎসাহ বোধ করতেন মিছিলে যাবার জন্য। মাঝে মাঝে মিছিলের লোকজনও তাঁদের ডাকতেন, “এই খোকারা চলে এসো আমাদের মিছিলে।” একদিন সত্যি সত্যি সম্মোহিতের মতো তাঁরা দল বেঁধে যোগ দিলেন লাল ঝাণ্ডার মিছিলে। প্ল্যাকার্ড তুলে নিলেন দৃঢ় দুই হাতে। উঁচিয়ে ধরলেন লাল ঝাণ্ডা। তারপর থেকে শুরু হলো নিয়মিত মিছিলে যোগ দেয়ার পালা। মনে মনে নিজেকে কল্পনা করতেন লাল ঝাণ্ডার একজন বলিষ্ঠ সৈনিক হিসেবে। মিছিল ছুটতো ধর্মতলা আর বউ বাজার ঘুরে মনুমেন্টের দিকে। মাঝে মাঝে থেমে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে অনলবর্ষী বক্তৃতা দিতেন নেতারা। সেসব বক্তৃতার কী তেজ! বুকের গভীরে ঢুকে রক্তে মাতম লাগিয়ে দিতো।
মনুমেন্টের এই রকমের সভা-সমাবেশ শেষে বিলিতি কাপড় পোড়ানোর ধুম পড়ে যেতো। তাঁরা যারা অল্প বয়সের, তাদেরকে বলা হতো বিলিতি কাপড় সংগ্রহ করে আনার জন্য। কতোদিন তাঁরা আউটরাম ঘাটে স্নানরতা মহিলাদের বিলিতি কাপড় চুরি করে এনে নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছেন! আস্তে আস্তে মিছিলে যোগ দেয়া, যেখানেই হোক জনসভা শুনতে যাওয়া তাঁর একটা নেশায় পরিণত হলো। ধর্মঘটের স্লোগান শুনলেই তাঁর বুকের মধ্যে আগুন ধরে যেত।
১৯৪০ সালের মাঝামাঝিতে শিয়ালদহে মাসিক ১৫ টাকা মাইনেতে রেলের চাকরিতে যোগ দিলেন জসীমউদ্দীন মণ্ডল। চাকরির পাশাপাশি ক্রমে ক্রমে লাল ঝাণ্ডার একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি বেশ পরিচিতি পেলেন। এমন কি কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শেও এসে গেলেন একদিন। ১৯৪০ সালের শেষে এসে সদস্য হলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির। গর্বে সেদিন তাঁর বুক ভরে উঠেছিলো শোষিত মানুষের পার্টি, সর্বহারা শ্রেণীর সংগঠন, সেই পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য হয়েছেন তিনি।
১৯৪১-৪২ সালের দিকে জসীমউদ্দীন মণ্ডলের প্রমোশন হলো সেকেন্ড ফায়ারম্যান হিসেবে। ইঞ্জিন চালনায় তাঁর এখন একটা মূখ্য ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা ইঞ্জিনে কয়লা না মারলে ইঞ্জিন চলবে না। বার্মায় ব্রিটিশের সাথে জাপানিদের প্রচণ্ড যুদ্ধের খবর কানে আসছে। আর সেই খবরে কলকাতার মানুষগুলো আনন্দে আত্মহারা। ব্রিটিশদের বিপর্যয় লক্ষ করে ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষ উৎফুল্ল। ঠিক হয়েছে! এতদিন ভারতের অসহায় মানুষের ওপর একতরফা গুঁতোনি চালিয়েছে বাবা ব্রিটিশ! এবার জাপানি গুঁতোনি কেমন লাগে, একটুখানি চেখে দেখো না কেনো বাছাধন!
তখন জাপানের নাম ভারতের প্রতিটি মানুষের অন্তরে গাঁথা। আজাদ হিন্দু ফৌজের প্রতিষ্ঠা, নেতাজী সুভাষ বোস এবং বিপ্লবী মহানায়ক রাসবিহারী ঘোষের জার্মান ও জাপানিদের সাথে সমঝোতার ফলে জার্মান ও জাপানিদের ভারতের মানুষ আপন বলে ভাবতে শুরু করেছিলো। আর কি না সেই জাপানের বিরুদ্ধেই বার্মায় যুদ্ধ চলছে! প্রচণ্ড যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে ব্রিটিশদের অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ তাঁরাই ট্রেনে করে পৌঁছে দিচ্ছেন। আর সেটাই ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁদেরই শুভাকাক্ষীদের বিরুদ্ধে। না, এ কিছুতেই হতে দেয়া যায় না!
তখন বোম্বে ও মাদ্রাজগামী সব ট্রেনই চিৎপুর হয়ে যেতো। হরহামেশাই বার্মা রণাঙ্গনে ব্রিটিশের অস্ত্র বোঝাই ট্রেন চলাচল করছে। এরই মধ্যে একদিন চিৎপুর স্টেশনের চায়ের দোকানে বসে তাঁরা ড্রাইভার ও ফায়ারম্যানের দল সিদ্ধান্ত নিলেন, কেউ ইঞ্জিনে উঠবেন না। বার্মার যুদ্ধে ব্রিটিশকে সাহায্য করা যাবে না। বন্ধ করতে হবে ট্রেন চলাচল। যেই কথা সেই কাজ। চিৎপুর স্টেশনে সমস্ত ট্রেন থেমে রইলো। চারদিকে হুলস্থূল পড়ে গেল। খবর পেয়ে রেলের গোরা সাহেবরা সবাই পড়িমরি করে ছুটে এলেন। প্রথমে হুমকি ধামকি, তারপর অনুরোধ- উপরোধ। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না।
তাঁরা সিদ্ধান্তে অটল। অবশেষে গোরারা শরণাপন্ন হলেন তাঁদের নেতাদের। খবর পেয়ে ছুটে এলেন কমরেড মুজফফর আহমেদ আর সোমনাথ লাহিড়ীসহ ক’জন নেতা। অনেক বোঝালেন তাঁদের কিন্তু তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্তে তখনো অটল।
জসীমউদ্দীন মণ্ডলরা বললেন, “এতদিন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা বলেছেন, কিন্তু আজ যখন ব্রিটিশকে বাগে পাওয়া গেছে, তখন আপনারাই আবার সুর বদলে বলছেন, ব্রিটিশকে সাহায্য করো। এ আপনাদের কেমন ধারা নীতি?”
এর কারণ হলো ১৯৪১ সালের ২২ জুন হঠাৎ করে ফ্যাসিস্ট হিটলার আক্রমণ করে বসলো সমাজতন্ত্রের সূতিকাগার সোভিয়েত রাশিয়া। আর সে প্রেক্ষাপটেই কমিউনিস্ট পার্টি তার নীতি পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলো। দেউলি বন্দী নিবাসে আবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম শ্রেণীর নেতৃবৃন্দ ১৯৪১ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, এ যুদ্ধ ‘জনযুদ্ধ’। কাজেই দেশের জনসাধারণকেও এগুতে হবে সেভাবেই। এই সিদ্ধান্ত থেকেই বাংলার কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ জেল থেকে প্রকাশ করলেন একটি ইশতেহার। তাতে বলা হলো, “বিপ্লবের কেন্দ্রভূমি রাশিয়া আক্রান্ত, সুতরাং এ যুদ্ধ ‘জনযুদ্ধ’, যে করেই হোক সর্বশক্তি দিয়ে হিটলারকে রুখতে হবে। তার জন্যই আজ ব্রিটিশের সাথে সহযোগিতা প্রয়োজন।”
আন্তর্জাতিক রাজনীতি তখন তাঁরা অতোশতো বুঝতেন না। তাঁদের কাছে তখন ব্রিটিশের বিরোধিতাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যা’হোক নেতৃবৃন্দ শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁদের ধর্মঘট তুলে নিতে রাজি করালেন। রেলের সাহেবরা তাঁদের কাছ থেকে বন্ড লিখিয়ে নিলেন, যুদ্ধের ভেতরে ভবিষ্যতে তাঁরা যেনো এমন কাজ আর না করে! শেষমেষ বিকেলের দিকে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হলো।
কিন্তু সেদিনকার সেই ঘটনার জের হিসেবে বেছে বেছে তাঁদের ক’জনকে বদলি করা হলো বিভিন্ন জায়গায়। জসীমউদ্দীন মণ্ডলকে বদলি করা হলো কাঠিহার লোকোইয়ার্ডে।
১৯৪২ সালের শেষের দিকে তাঁর বন্ধু আফসারের ছোট বোন মরিয়মের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ জুগিয়েছেন সারাজীবন। তাঁর পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে।
১৯৪৯ সালের দিকে দুর্ভিক্ষ যখন চরমে, তখন রেলওয়ে রেশন সপ থেকে শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ করা হলো খুদ। এ ছিলো আর এক প্রহসন। পাকিস্তানে এসে রাতারাতি রেলের শ্রমিকরা মানুষ থেকে বনে গেলো মুরগি। মুরগির খাবারের খুদই সরবরাহ করতে লাগলো তাদের জন্য। মুসলমানের দেশ, তাই অফিসারদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা। তারা পায় চাল। আর শ্রমিকদের জন্য খুদ। হায়রে পাকিস্তান! অচিরেই শ্রমিকরা হয়ে উঠলো ক্ষুব্ধ। তাঁদের নেতৃবৃন্দ ঘনঘন বৈঠক করতে লাগলেন শ্রমিকদের সাথে। প্রকাশ্যে তো কিছু করা যায় না, কারণ শিশু রাষ্ট্র! বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না। গোপনেই বৈঠক করতেন নেতারা। দেশ বিভাগ হলেও তাঁদের ট্রেড ইউনিয়ন কিন্তু তখনো বিভক্ত হয়নি, তখনো তাঁদের কর্মকাণ্ড কলকাতাকে ঘিরেই চলছে। তাঁদের সেইসব গোপন বৈঠকে তখন আসতেন সোমনাথ লাহিড়ী, ব্যারিস্টার লতীফ, জ্যোতি বসু, ইলা মিত্র, রমেন মিত্র ও ভবানী সেনের মতো আরও কত নেতা! ঈশ্বরদীতে লাল ঝাণ্ডার কর্মী কমরেড সাহাবুদ্দীনের বাসায় মাঝে-মধ্যেই বসতো তাঁদের গোপন বৈঠক। সাধের পাকিস্তানে বাস করে মানুষ থেকে মুরগি কিছুতেই হওয়া যাবে না। অতএব, আন্দোলন। গড়ে তোলো দুর্বার আন্দোলন। বন্ধ করে দাও রেলের চাকা। টনক নড়ুক কর্তৃপক্ষের। সিদ্ধান্তমতো চারদিকে পড়ে গেলো সাজ সাজ রব শ্রমিকদের মধ্যে। আন্দোলনের পক্ষে চলতে লাগলো মিছিল ও পথসভা ইত্যাদি প্রায় প্রতিদিনই।
১৯৪৯ সালের দিকের কথা। গর্জে উঠলো লোকোসেডের শ্রমিকরা। সেড খালাসীরা হাতের গাঁইতি-কোদাল ফেলে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালো। পোর্টার, সান্টার, ফায়ারম্যান, ড্রাইভার সবাই কাজ বন্ধ রেখে শরিক হলো মিছিলে। মুহূর্তখানেকের ভেতরেই সমস্ত সেড এলাকা নীরব নিথর হয়ে পড়লো। তখনো ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ ছিলো। ফলে দার্জিলিং থেকে কলকাতাগামী সব ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে পড়লো ঈশ্বরদী প্লাটফরমে। প্যাসেঞ্জাররা বিরক্ত হলেও সাধারণ মানুষ আর সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারিরা কিন্তু মহাউল্লাসে ফেটে পড়লো। ঠিক হয়েছে বেশ হয়েছে, জসীম মন্ডলরা ঠিক মারই দিয়েছে। চালের বদলে তোমরা খাওয়াবে খুদ, আর আমরা মুখ বুজে সব সহ্য করব? এ আর হচ্ছে না।
অবশেষে বিকেল পাঁচটার দিকে পাবনা থেকে কয়েক লরি রিজার্ভ ফোর্স এসে পৌছুলো। সে সময়কার বিপ্লবী শ্রমিক-কর্মী বাহাদুরপুরের দেলওয়ার দৌড়ে এসে খবর দিলেন, “জসীম ভাই, পালাতে হবে, পুলিশ এসে গেছে।” খবর শুনে তিনি পশ্চিমে শ্রমিক কলোনির একটি বাসায় এসে আশ্রয় নিলেন। সারাদিন কিছু খাননি। ক্ষিদেয় পেট জ্বালা করছিলো তাঁর। খাবারের কথা বলতেই শ্রমিক কলোনির অনেকেই খাবার নিয়ে হাজির হলেন। শোনা গেলো, স্ট্রাইকের সাথে জড়িত নেতৃবৃন্দকে হন্যে হয়ে পুলিশ খুঁজছে। তাই তিনি রেল কলোনিতে থাকা আর নিরাপদ মনে করলেন না। সরে গেলেন আরও উত্তরে আউটার সিগনালের কাছে শ্রমিক কলোনির আর একটি বাসায়।
এরপর ট্রেনে চেপে তাঁরা পৌছুলেন আবদুলপুর স্টেশনে। সেখান থেকে হাঁটাপথে নাটোর হয়ে বাসুদেবপুর গ্রামের হালদারপাড়ায় গিয়ে উঠলেন গভীর রাতে। এরি মধ্যে একদিন খবর পেলেন ‘খুদ স্টাইকের’ অপরাধে জসীমউদ্দীন মণ্ডল, দেলওয়ার, হামিদ আর রুহুলসহ মোট ছ’জনের নামে হুলিয়া হয়েছে। পুলিশ তাঁদের খ্যাপা কুকুরের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই অবস্থায় ঈশ্বরদী ফিরে যাওয়া কোনোক্রমেই নিরাপদ নয়। কমরেডরা পরামর্শ দিলেন, সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে সেল্টার নিতে। সে সময় সাঁওতালদের ভেতরে পার্টির শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। জসীমউদ্দীন মণ্ডলের গায়ের রং-চেহারা আর স্বাস্থ্যের সাথে সাঁওতালদের মিল থাকায় সহজেই ওদের সাথে মিশে গেলেন তিনি। ফলে ওদের সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করার সময় কেউ ধরতেই পারতো না যে তিনি সাঁওতাল নন। এভাবে কাজ করতে করতেই কয়দিনের ভেতরে ওরা তাঁকে আপন করে নিলো।
ঈশ্বরদীতে সংগঠনের অবস্থার কথা চিন্তা করে মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। অস্থির হয়ে উঠলেন ভেতরে ভেতরে। তাই প্রায় ছ’মাসের মাথায় সাঁওতাল পাড়া থেকে ঈশ্বরদী ফিরলেন একদিন। আশ্রয় নিলেন লোকোসেডে কমরেড সাহাবুদ্দিনের বাসায়। ওখান থেকেই পুলিশ ১৯৪৯ সালে তাঁকে গ্রেফতার করলো।
তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হলো পাবনা জেলে। জেল সম্পর্কে তাঁর একটা মোটামুটি ধারণা হয়েছিলো এর মধ্যেই। তবে সেটা ছিলো বৃটিশের জেলখানা। এর আগেও কয়েকবারই কলকাতা থাকতে জেল হাজতে গিয়েছেন। তবে স্বল্প সময়ের জন্য। জেলের খাওয়া-দাওয়ার চরম অব্যবস্থার কথা জানা ছিলো। তাই ঘাবড়ালেন না। রাতে তাঁকে রাখা হলো হাজতিদের সাথে।
রাতে দেয়া হলো দুটো করে রুটি আর ডাল। সে রুটির কী চেহারা! আটার মধ্যে পোকার ছড়াছড়ি। আর দুর্গন্ধ, সে কথা বলবার নয়। তাই খেতে হলো। ভেবেছিলেন, পাকিস্তানে জেলের বুঝি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো লক্ষণ টের পেলেন না।
ভোরবেলা তাঁকে ঘানি টানতে বলা হলো। কিন্তু তিনি ঘানি টানতে নারাজ। এ অপরাধে তাঁকে পিছমোড়া করে ধরলো দু’জন, আর দু’জন মিলে এলোপাতাড়ি হান্টারের বাড়ি মারতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর সারা শরীর আঘাতে আঘাতে রক্তারক্তি হয়ে গেলো। তারপর জেলার সাহেবের হুকুমে তাঁকে কয়েদি সেলে তোলা হলো। শুরু হলো অমানুষিক নির্যাতন। সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলে নিয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে রাখা হলো। পায়ের নিচে মেঝেতে পানি ঢেলে দেয়া হলো। শীতের দিন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তার ওপর উদোম গা। হুহু করে কাঁপতে লাগলেন তিনি। সারাটা দিনই গেলো এইভাবে। পেটে অসম্ভব ক্ষিদে। জ্বরজ্বর বোধ করতে লাগলেন।
সিদ্ধান্ত নিলেন, এই অমানুষিকতার প্রতিবাদ করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন অনশন করবেন। যতোক্ষণ না এর প্রতিকার হয়, ততোক্ষণ ছোবেন না দানাপানি।
সারাদিন অভুক্ত রইলেন। খাবার ফিরিয়ে দিলেন। সবাই জেনে গেলো চার নম্বর সেলের কয়েদি জসীম মণ্ডল অনশন করেছে। দিন গড়িয়ে রাত এলো, তাঁকে রাখা হয়েছে তেমনি বিবস্ত্র আবস্থায়।
তাঁর ‘হাঙ্গার স্টাইক’-এর খবরটা আর চাপা থাকলো না। শেষ পর্যন্ত তা পৌঁছে গেলো কর্তৃপক্ষের কানে। জেল কর্তৃপক্ষ হাঙ্গার স্টাইককে বড়ই ভয় করতো সেইকালে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন জেলার চাকলাদার। প্রথমে অনুরোধ-উপরোধ, তারপর হুমকি-ধামকি। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্তে অটল। বললেন, ‘অনশন কিছুতেই ভাঙবেন না। আপনি ডি.সি. সাহেবকে খবর পাঠান, তার সাথে কথা বলতে চাই।’ অবশেষে অনন্যোপায় হয়ে জেলার সাহেব খবর পাঠালেন ডি.সি. সাহেবকে।
ডি.সি. সাহেব আসার পর তাঁকে তিনি বললেন খাবারের পরিমাণ ও মান বাড়ানোর জন্য। কয়েদিদের দিয়ে ঘানি টানা বন্ধ করার কথাও তিনি ডি.সি সাহেবকে বললেন । সবকিছু শুনে বললেন, “সব ব্যবস্থা হবে। আপনি এখন কিছু খেয়ে নিন। আমি আপনার খাওয়া দেখে যেতে চাই।” ডাক্তার সাহেব সঙ্গেই ছিলেন। তাঁকে ডাবের পানি আর গ্লুকোজ খেতে দিলেন তিনি। জসীমউদ্দীন মণ্ডল অনশন ভঙ্গ করলে ডি.সি. সাহেব জেলারকে বললেন, “যতোদিন ওর শরীর সুস্থ না হয়, ততোদিন ওকে হাসপাতালে রাখবার ব্যবস্থা করবেন।”
এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হলো হাসপাতালে। হাসপাতালে মোটামুটি আরামেই দিন কাটছে। খাওয়া-দাওয়াও ভালো। প্রায় ছ’মাস পাবনা জেলে কাটানোর পর তাঁকে বদলি করা হলো রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে। এখানে এসেও তাঁর উপর অনেক নির্যাতন- অত্যাচার চলতে লাগল।
১৯৫৪ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন। জেল থেকে ফিরে আসার পর রেলের চাকরি আর করা হয়নি তাঁর। কারণ রেল কর্তৃপক্ষ এই মর্মে বন্ড চেয়েছিলেন, ‘এরপর থেকে আমি আর কোনরকম আন্দোলনে অংশ নেব না।’ কিন্তু তিনি বন্ড দিতে অস্বীকার করায় তাঁর আর চাকরি হয়নি।
মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পর ১৯৫৪ সালেই আবার শত শত রাজনৈতিক কর্মীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে পোরা হলো জেলে। জসীমউদ্দীন মণ্ডলও রেহাই পেলেন না তার আওতা থেকে।
এসময় রাজশাহী জেলে কিছুদিন থাকার পর তাঁকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বদলি করা হলো। ঢাকা জেলে তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বহু কর্মী নেতারা বন্দি জীবনযাপন করছেন। ১৯৫৬ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬২ সালের দিকে আবার গ্রেফতার হলেন তিনি এবং ১৯৬৪ সালের দিকে মুক্তি লাভ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে প্রচার চালান। মুক্তিযুদ্ধের সময় দশ কাঠা জমির উপর তাঁর স্ত্রীর তিল তিল করে গড়ে তোলা চালাঘর দুটোও বিহারিরা পুড়িয়ে দিয়েছিলো জসীমউদ্দীন মণ্ডলের রাজনীতি করার অপরাধে। সেই দশ কাঠা জমিও বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। আজ সারা বাংলাদেশে তাঁর এতোটুকু জায়গা নেই, যে জমিটুকু তিনি নিজের বলে দাবি করতে পারেন। একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে বর্তমানে বসবাস করছেন। তারও বৈধ মালিক তিনি নন।
সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জীবনের পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখেন, পাওয়ার পাল্লাটি শূন্য। বঞ্চনার পাল্লাটি ভারি হয়ে আছে বেশি। তবুও হতাশ নন তিনি। এ যেনো এক কঠিন নেশা, সুতীব্র আকর্ষণ, যা উপেক্ষা করে থাকা কখনো সম্ভব নয়। তাইতো অনাচার- অত্যাচারের প্রতিবাদে এই বৃদ্ধ বয়সেও ছোটেন মিছিলে, ঝাঁপিয়ে পড়েন আন্দোলনে। বক্তৃতার ঝড় তোলেন সভামঞ্চে। যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততোদিন অক্ষুণ্ণ থাকবে তাঁর জীবেনর এই ধারা।
সূত্র: জীবনের রেলগাড়ি, সংগ্রামী স্মৃতিকথা- জসীমউদ্দীন মণ্ডল, অনুলিখন-আবুল কালাম আজাদ, প্রকাশনী- সাহিত্য প্রকাশ, প্রকাশক-মফিদুল হক।
লেখক : মৌরী তানিয়া