জন্মের পর বাবা-মা ছেলেটির নাম রাখেন সৈয়দ মীর নিসার আলী। পাঁচ-ছয় বছর বয়সে নিসার আলীর প্রচণ্ড জ্বর হয়। এই জ্বর সারানোর জন্য তাকে ঘুষড়া নামের ভীষণ তেতো ওষুধ খেতে দেয়া হয়। সেইসময় এই তেতো ওষুধটি অন্য ছেলে-মেয়েরা সহজে খেতে চাইতো না। আর তাদেরকে জোড় করে খাওয়াতে গেলে ভীষণ কান্না-কাটি করে চোখ-নাক কুঁচকিয়ে অবশেষে ওষুধটি গিলত তারা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই ভয়ংকর তেতো ওষুধটি যখন মীর নিসার আলী নামের এই ছোট ছেলেটিকে দেয়া হলো তখন সে কোন রকম আপত্তি না করে চোখ-নাখ কুঁচকানো ছাড়াই হাসিমুখে খেয়ে ফেলল। ছেলের এই কাণ্ডে বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই খুব অবাক হলেন এবং নিসার আলীর ডাকনাম রাখলেন তেতো। তেতো থেকে পরবর্তীতে হলো তিতু। তার সঙ্গে মীর লাগিয়ে হয় তিতুমীর। ব্রিটিশবিরোধী লড়াই-সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখার কারণে তিতু নামের এই ছেলেটিই বিদ্রোহী তিতুমীর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।ছেলেবেলাতে ভীষণ সেই তেতো ওষুধটি হাসিমুখে খাওয়ার মধ্য দিয়েই জানান দিয়েছিলেন যেকোনো কষ্টকেই হাসিমুখে বরণ করে নিতে পারেন তিনি, এমনকি মৃত্যুকেও। আর তাইতো নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও পালিয়ে না যেয়ে লড়াকু বীরের ন্যায় ব্রিটিশ সরকারের ছোঁড়া কামানের গোলার সামনে লড়েছেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত।
তিতুমীর। ব্রিটিশবিরোধী এই বিপ্লবীর নাম শুনলেই চেতনার আয়নায় ভেসে ওঠে নারকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লার কথা। হিন্দু জমিদার ও ইংরেজদের যৌথ আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিতুমীর ১৮৩১ সালের ২৩ অক্টোবর বারাসাতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। বাঁশ এবং কাদা দিয়ে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এই কেল্লা নির্মাণ করেন তিনি। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও অন্য ধর্মের প্রতিও ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা। তাই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এই অকুতোভয় বীরকে দুর্ভেদ্য বাঁশের কেল্লা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিল জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষ। তিতুমীরের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে প্রতিরোধ করার জন্য সশস্ত্রভাবে প্রস্তুত ছিলেন। তিতুমীর অত্যাচারিত-বঞ্চিত কৃষকদেরকে সংগঠিত করে লাঠি-সড়কি জাতীয় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী গড়ে তোলেন। এই কেল্লাতে অবস্থান করেই তিতুমীর তাঁর সঙ্গী ও গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের নিয়ে জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরূদ্ধে তুমুল লড়াই গড়ে তুলেছিলেন। বেশ কয়েকবার ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিল। অবশেষে এই কেল্লাতে অবস্থান করেই তিতুমীর লড়াকু বীরের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেন ।
তিতুমীরের জন্ম ১৭৮২ সালের ২৭শে জানুয়ারী। চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমার আন্তঃপাতী চাঁদপুর গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মীর হাসান আলী। মায়ের নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। তিতুমীররা চার ভাই-বোন। তাঁর পূর্বপুরুষ সৈয়দ শাহাদাত আলী ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রথম আরব থেকে বঙ্গে আসেন।
তিতুমীরের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে, বাবার কাছে। ১৭৮৬ সালে তিতুমীরের বয়স যখন ৪ বছর তখন বাবা মীর হাসান আলী তাঁর হাতে তখতী দিয়ে হাতেখড়ি দেন। হাতেখড়ির পর তিনি গ্রামের ওস্তাদের কাছে উর্দূ, আরবী, ফারসী, বাংলা ভাষা ও ধারাপাত (অংক) শেখেন।
এরপর গ্রামের মাদ্রাসায় তিতুমীর ২ বছর শরীয়তী ও তরীকতী পড়াশুনা করার পর ১৭৯৮ সালে শিক্ষাবিদ হাফিজ নিয়ামত উল্লাহ’র সাথে বিহার শরীফে যান। ৬ মাস শিক্ষাসফর শেষে ওস্তাদ-সাগরেদ মিলে চাঁদপুরের হায়দারপুর গ্রামে ফিরে আসেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি মুষ্টিযুদ্ধ, লাঠিখেলা, তীর ছোড়া ও অসি চালনা শেখেন। তখন যুবকরা আখড়া বা সংঘের আওতায় কুস্তি, কাবাডিসহ স্থানীয় নানা খেলাধুলা চর্চা করত। সে সময় এই সকল শরীরচর্চামূলক খেলাধুলায় প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতা ছিলো সর্বত্র। যৌবনের সূচনালগ্নে তিতুমীর ছিলেন নাম করা কুস্তিগীর।
১৮০১ সালে ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরানে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সেইসাথে তিনি বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষা, দর্শন ও কাব্যশাস্ত্রে সমান দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি জ্ঞান অর্জনের জন্য সময় পেলেই ঘুরে বেড়াতেন দূর-দূরান্তে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। এভাবে চলতে থাকে বেশ কিছু দিন।
কর্ম জীবন শুরুর পূর্বে তিতুমীর মায়মূনা খাতুনকে বিয়ে করেন। মায়মূনা খাতুন ছিলেন চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়ার অন্তর্গত খালপুর গ্রামের হযরত শাহ সূফী মুহম্মদ রহীম উল্লাহ সিদ্দিকীর মেয়ে। বিয়ের ৬ মাস পর তিতুমীরের বাবা সৈয়দ হাসান আলী মারা যান। কিছু দিন পর তিনি তাঁর শিক্ষক হাফিজ নিয়ামত উল্লাহের সাথে কলকাতায় যান।
খুব সম্ভবত ১৮০৮-১৮১০ সালের কোনো এক সময়ে তিনি ভাগ্যন্বেষণে কলকাতা শহরে যান। এখানেও তিনি কুস্তি লড়াইয়ের প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতেন। তিনি একবার কলকাতায় কুস্তি লড়াইয়ে প্রথম হয়েছিলেন। এরপর থেকে তিতুমীরের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই কারণে তিনি জমিদার মির্জা গোলাম আম্বিয়ার সুনজরে পড়েন এবং তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন। তিতুমীর এখানে বসে যুদ্ধ জয়ের সামরিক কৌশল আয়ত্ব করেন। মির্জা গোলাম আম্বিয়া ছিলেন কলকাতার মির্জাপুর এলাকার জমিদার। তিতুমীর যেখানে যেতেন সেখানেই নানা বিষয় শেখার চেষ্টা করতেন ফলে কর্মজীবনে তিনি কোথাও স্থায়ী হতে পারেনি। তিনি কিছুটা বাউণ্ডুলে স্বভাবের ছিলেন। তিনি প্রচণ্ড সাহসী ও দৃঢচেতার অধিকারী ছিলেন। তিনি সাধারণ ধর্মভীরু মুসলমান হিসেবে নামাজ-রোজা করতেন।
‘ব্রিটিশ-ভারতের সরকারী নথি অনুযায়ী, ১৮১৫ সালের দিকে তিতুমীর বাজে ও দুষ্ট প্রকৃতির ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ সময় তিনি নদিয়া জমিদারের অধিনে চাকুরী নেন এবং তাঁর হিংসাত্মক কার্যাবলীর জন্য কারাবরণ করেন।’ ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট কোলডিন তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘তিতুমীর ছিলেন একটি গোলযোগ সৃষ্টিকারী ও বিশৃঙ্খল চরিত্রের, যার জন্য তাঁকে বিভিন্ন সময় দায়ী করা হয়েছিলো। এর ফলে তাঁকে জেল ও শাস্তি ভোগ করতে হয়’। সেইসময় ব্রিটিশ সরকার এরকম অপবাদ-দুর্ণাম প্রতিটা স্বাধীনতাকামী-প্রতিবাদী মানুষের মানবিক চরিত্রে লাগিয়ে দিয়েছিলো।
১৮২২ সালে তিনি হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গেলেন। কাবা শরীফে হজ্জ পালনের পর তিনি মদিনায় গমনের উদ্যোগ নেন। হজ্জে যাওয়ার পর থেকেই তিতুমীরের চিন্তাধারার বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়। মদিনায় গমনের পূর্বে তিনি হযরত শাহ মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইনের সাথে দেখা করেন। তিনি তিতুমীরকে নিয়ে তাঁর পীর হযরত ব্রেলভীর কাছে যান। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন সংগ্রামী ও ধর্মপ্রাণ মানুষ। হযরত ব্রেলভী তখন মক্কায় বাস করছিলেন। তিনি তখন বিখ্যাত ইসলামি ধর্মসংস্কারক ও বিপ্লবী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হযরত ব্রেলভী প্রথম দেখাতেই তিতুমীরের প্রতি আকৃষ্ট হন। ২-৩ দিন গুরু-শিষ্যের মনদর্শন বিষয়ে আলোচনা শেষে তিতুমীর তাঁর মুরিদ হলেন। এরপর গুরু-শিষ্যের দল মদিনায় যান। তখন তিতুমীরের বয়স ৩৯ বছর। মদিনার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে মিশর, পারস্য, আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক স্থানগুলো দর্শন ও পীর-আলেমদের কবর জিয়ারত শেষে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন তিনি। এ সময় তিতুমীর ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন।
১৮২৭ সালে নিজ গ্রামে ফিরে এসে তিনি শিরক ও বিদয়াতমুক্ত মুসলিম সমাজ গঠনের দাওয়াতে নেমে পড়েন। মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দিকেও মনোযোগ দেন তিনি। তাঁর কাজ শুরু হয় চব্বিশ-পরগনা ও নদীয়া জেলায়। তিতুমীর নদীয়া জেলার নারিকেলবাড়িয়ার কাছাকাছি হায়দরপুরে বসবাস শুরু করেন এবং ধর্ম সংস্কারক হিসেবে তাঁর কাজ অব্যাহত রাখেন। ওয়াহাবী আন্দোলনের মতাদর্শ প্রচারের স্বল্পকালের মধ্যেই তিনি তিন-চার’শ শিষ্য সংগ্রহ করেন ৷
তিতুমীর তাঁর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদেরকে সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে ‘তাহ্বান্দ’ নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। ১৮২৮ সাল পর্যন্ত তিতুমীরের মুসলিম সমাজ গঠনের দাওয়াত শান্তিপূর্ণভাবে চলে।
অন্যদিকে ১৮২০ সালে সৈয়দ আহম্মদ শহীদ উত্তর ভারত ও বাংলাদেশে এক বিশুদ্ধবাদী ইসলাম প্রচার করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ওই সময় তাঁর ইসলাম প্রচারে মুগ্ধ হয়ে এ অঞ্চলের শত শত মানুষ ইসলাম প্রচার করার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হয়। ১৮২২ সালে সৈয়দ আহম্মদ শহীদ শত শত অনুসারীদের নিয়ে মক্কায় হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে যান। ১৮২৩ সালে অনুসারীদের নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন। ১৮২৪ সালে তিনি শিখ মহারাজা রনজিৎ সিংহের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। এভাবে চলতে থাকে সৈয়দ আহম্মদ শহীদ অনুসারীদের সংগ্রাম। যে সংগ্রাম ও প্রতিবাদ তিতুমীরের ইসলাম প্রচার ও ইংরেজকে রুখে দাঁড়ানোর অনুকূলে কাজ করে। যার ধারাবাহিকতায় ১৯২৮ সালে তিতুমীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। তিনি ধীরে ধীরে ৩০০-৪০০ জন অনুসারীদের একটা দল গড়ে তোলেন।
ক্রমেই তিতুমীরের বিচক্ষণতা এবং পারদর্শিতা সবার দৃষ্টি কাড়ে। শুধু ধর্মসংস্কারই নয়, হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার থেকে নিম্নবিত্ত মুসলমান জনসাধারণকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যেও তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বীয় ধর্মের অত্যাচারিত মানুষ তাঁর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হতে থাকে। তাঁর এই অসাধারণ সাফল্যে হিন্দু জমিদাররা ভয় পেয়ে যায় ৷ তিতুমীরের কার্যকলাপে রুষ্ট হয়ে ওঠেন জমিদার ও নীলকররা এবং তারা সবাই মিলে তিতুমীরকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
শুরু হয় ওয়াহাবীদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার, এমনকি তাঁদের দাড়ির ওপর খাজনা আদায় শুরু হয়। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত ‘দাড়ির খাজনা’ (Beared Tax) এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। এরপর তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। ফলে তিতুমীর জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। এই সময় ফকির মিসকিন শাহ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে তিতুমীরের সাথে এক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করার প্রতিজ্ঞা করেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেবনাথ রায় (গোবরা গোবিন্দপুর), গৌড়ী প্রসাদ চৌধুরী (নাগপুর), রাজনারায়ণ (তারাকান্দি), কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় (গোবরডাঙ্গা) প্রমুখ হিন্দু জমিদারদের সাথে তিতুমীরের লড়াই বাঁধে। সেইসময় স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে কয়েকটি সংঘর্ষে তিতুমীর জয়লাভ করেন ৷ তাঁর দলে অনেকে এসে যোগ দেয়। তাঁর নির্দেশে হিন্দু-মুসলমান প্রজারা জমিদারদের খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়।
শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমঝোতা করার সব উপায় ব্যর্থ হবার পর তিতুমীর বারাসাতে ইংরেজ সরকারের বিপক্ষে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চব্বিশ পরগনার কিছু অংশ, নদীয়া ও ফরিদপুরের একাংশ নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। এটাই বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত হয়। বর্ণহিন্দুর অত্যাচারে জর্জরিত অনেক হিন্দু কৃষকও এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। বারাসাত বিদ্রোহে গোবরাগোবিন্দপুরের জমিদার নিহত হয় ।
জমিদার ও নীলকরদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৮৩০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে পাঠায় তিতুমীরকে দমন করার জন্য। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট ও তার সিপাহি বাহিনী তিতুমীরের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হয় ৷ তিতুমীরের বাহিনী বাঘারেয়ার নীলকুঠি প্রাঙ্গণের এক যুদ্ধে নদীয়ার কালেক্টর এবং নদীয়া ও গোবরডাঙ্গার জমিদারের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হয়। তিতুমীর বাহিনী কয়েকটি নীলকুঠিও লুণ্ঠন করে। ইতিমধ্যে তিতুমীর নিজেকে স্বাধীন বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করেন।
ওই বছর জমিদার কৃষ্ণদেব রায় পার্শ্ববর্তী সরফরাজপুরে (বর্তমান সর্পরাজপুর) শত শত লোক জড় করে লাঠিসোঁটা, ঢাল-তলোয়ার, সড়কিসহ শুক্রবার জুমার নামাজরত অবস্থায় মসজিদ ঘিরে ফেলে এবং মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওইদিন দু’জন মৃত্যুবরণ করেন, আহত হন অসংখ্য যোদ্ধা। মুসলিম বিদ্বেষী পুলিশ ঘটনাস্থলে না গিয়ে থানায় বসেই মামলার রিপোর্ট দেয়।
তিতুমীর তাঁর লোকজন নিয়ে সরফরাজপুর থেকে ১৮৩১ সালের ১৭ অক্টোবর নারকেলবাড়িয়ায় হিজরত করেন। জমিদার ও ব্রিটিশদের সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলার জন্য নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে একটি সুদৃঢ় বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন তিনি ৷ এ কেল্লায় তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় ৫,০০০ জনে গিয়ে পৌছে। এই দুর্গে তিনি তাঁর শিষ্যদের লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করার কৌশল শেখানোর পাশাপাশি তাদের আক্রমণ করার প্রস্তুতিও নিতে থাকেন তিতুমীর বাহিনী। তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হন।
ওই বছর ২৯ অক্টোবরেই কৃষ্ণদেব নারকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে বহু লোক হতাহত করে। ৩০ অক্টোবর এই বিষয়ে মামলা দায়ের করতে গেলে কোনো ফল হয় না। জমিদার ও কৃষ্ণদেবের তৃতীয়বার অত্যাচারের সংবাদ পেয়ে তিতুমীরের ছেলে সৈয়দ গওহর আলী ও তাঁর ভাগনে শেখ গোলাম মাসুম চাঁদপুর, হায়দারপুর, কীর্তিপুর, রাজাপুর, নয়াপাড়া, আটঘরাসহ বিভিন্ন এলাকার পাঁচশতাধিক বীর লড়াকুদের নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ায় উপস্থিত হলেন।
গোলাম মাসুম নারিকেলবাড়িয়ায় উপস্থিত হওয়ায় সবাই খুব খুশি হলেন। সবাই মিলে সমবেত কন্ঠে বললেন, “আমরা এই অত্যচারের প্রতিকার চাই”। গোলাম মাসুম তাঁর মামা তিতুমীরকে বললেন, “শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য আমাদেরকে আরো শক্তিশালী হতে হবে। এবং শত্রুরা যেন সহজেই কোনো ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য আত্মরক্ষা করতে হবে”। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী আত্মরক্ষার জন্য সবাই মিলে বিশাল এলাকা জুড়ে বেড়া নির্মাণ করলেন। দক্ষিণ ও উত্তর দিকে দুটি দরজা রাখা হল। এই দরজায় নিয়মিত প্রহরী রাখার ব্যবস্থা হলো। প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় প্রায় সকল মুসল্লিদের লাঠি খেলা, সাড়কী চালনাসহ শরীরচর্চামূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হত।
আত্মরক্ষার কাজ শেষ হওয়ার পর গোলাম মাসুম পরামর্শ সভা ডাকলেন। সভায় নানা বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা শেষে গোলাম মাসুমকে যোদ্ধা দলের নেতা নির্বাচিত করা হল এবং তিতুমীরকে সকল কাজের ও দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া হলো।
৬ নভেম্বর কৃষ্ণদেব আবার নারকেলবাড়িয়ার মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করল। উভয় দলের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হলো। হতাহত হলো প্রচুর। কৃষ্ণদেব এই খবর তাঁর জমিদার ও প্রভূ ব্রিটিশের কাছে এমনভাবে প্রচার করলো যে সবার ধারণা হলো, তিতুমীর বাহিনী নিষ্ঠুর ভাবে শান্তিপ্রিয় হিন্দু জমিদার ও তাদের জনগণকে অত্যাচার করেছে। গোবর ডাঙ্গার নীলকর জমিদার কালী প্রসন্ন মোল্লা, আটী নীলকুটির ম্যানেজার মি. ডেভিসকে এই খবর দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুললেন। মি. ডেভিস ক্ষেপে গিয়ে প্রায় ৪ শতাধিক হাবশী যোদ্ধা ও বিভিন্ন মরণাস্ত্রসহ নারকেলবাড়ীয়া আক্রমণ করলেন। প্রচণ্ড সংঘর্ষের ফলে এবারও বেশ কিছু লোক হতাহত হল। তিতুমীর বাহিনীর কাছে নিশ্চিত পরাজয় দেখে শেষ পর্যন্ত মি. ডেভিস প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেলেন। ২-৩ দিন পর জমিদার দেবনাথ বাহিনী নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণের উদ্দেশ্যে এলেন। গোলাম মাসুম এই খবর শুনে তাঁর বাহিনী নিয়ে জমিদার দেবনাথ বাহিনীকে মোকাবেলা করেন। এখানেই জমিদার দেবনাথ প্রাণ হারায়।
এ রকম কয়েকটি সংঘর্ষের পর ১৩ নভেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকার কর্নেল স্টুয়ার্ডকে সেনাপতি করে একশত ঘোড়া, তিনশত পদাতিক সৈন্য, দু’টি কামানসহ নারকেলবাড়ীয়ায় পাঠায়। উদ্দেশ্য বিদ্রোহী তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের চিরতরের জন্য নিঃশেষ করে দেয়া। ম্যাজিষ্ট্রেট আলেকজান্ডার একজন হাবিলদার, একজন জমাদার, পঞ্চাশ জন বন্দুক ও তরবারীধারী সৈন্য নিয়ে নারকেলবাড়িয়ার কাছাকাছি ভাদুড়িয়ায় উপস্থিত হন। বশিরহাটের দারোগা সিপাহী নিয়ে ভাদুড়িয়ায় আলেকজান্ডারের সাথে মিলিত হয়। প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় তিতুমীর বাহিনীর সাথে। এতে উভয় পক্ষের লোক হতাহত হয়। যুদ্ধে দারোগা ও একজন জমাদ্দার মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়, বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি. আলেকজান্ডার পালিয়ে বেঁচে যান।
১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর। তত্কালীন ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ও কর্নেল স্টুয়ার্ডের নেতৃত্বে বিরাট সেনা বহর পাঠান তিতুমীরকে শায়েস্তা করার জন্য। কর্নেল স্টুয়ার্ড বিরাট সেনাবহর আর গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। স্টুয়ার্ডের ছিল হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য আর অজস্র গোলাবারুদ। তিতুমীরের ছিল মাত্র চার-পাঁচ হাজার স্বাধীনতাপ্রিয় সৈনিক। তাঁর না ছিল কামান, না ছিল গোলাবারুদ-বন্দুক। তবুও প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। তিতুমীর আর তাঁর বীর সৈনিকরা প্রাণপণ যুদ্ধ করলেন। কিন্তু তাঁরা তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়াতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে কেউ পিছু হঠেননি, জীবন বাঁচানোর জন্য পালিয়েও যাননি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইংরেজ সৈনিকদের গোলার আঘাতে ছারখার হয়ে যায় নারকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লা। শহীদ হলেন বীর তিতুমীর। শহীদ হলেন অসংখ্য মুক্তিকামী বীর সৈনিক। তিতুমীরের ২৫০ জনেরও বেশী সৈন্যকে ইংরেজরা বন্দী করল। এঁদের কারও হলো কারাদণ্ড, কারও হলো ফাঁসি। আর এভাবেই শেষ হলো নারিকেলবাড়িয়ার বিখ্যাত বাঁশের কেল্লা যুদ্ধ।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এই বাঁশের কেল্লা পরবর্তী লড়াই-সংগ্রামকে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তিতুমীর জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তাঁর বাঁশের কেল্লার জন্য জগৎবিখ্যাত হয়ে আছেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: তিতুমীরের জন্ম ১৭৮২ সালের ২৭শে জানুয়ারী। চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমার আন্তঃপাতী চাঁদপুর গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে) তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা-মা: তাঁর বাবার নাম মীর হাসান আলী। মায়ের নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। তিতুমীররা চার ভাই-বোন।
পড়াশুনা: তিতুমীরের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে, বাবার কাছে। ১৭৮৬ সালে তিতুমীরের বয়স যখন ৪ বছর তখন বাবা মীর হাসান আলী তাঁর হাতে তখতী দিয়ে হাতেখড়ি দেন। হাতেখড়ির পর তিনি গ্রামের ওস্তাদের কাছে উর্দূ, আরবী, ফারসী, বাংলা ভাষা ও ধারাপাত (অংক) শেখেন।
এরপর গ্রামের মাদ্রাসায় তিতুমীর ২ বছর শরীয়তী ও তরীকতী পড়াশুনা করার পর ১৭৯৮ সালে শিক্ষাবিদ হাফিজ নিয়ামত উল্লাহ’র সাথে বিহার শরীফে যান। ৬ মাস শিক্ষাসফর শেষে ওস্তাদ-সাগরেদ মিলে চাঁদপুরের হায়দারপুর গ্রামে ফিরে আসেন।১৮০১ সালে ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরানে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সেইসাথে তিনি বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষা, দর্শন ও কাব্যশাস্ত্রে সমান দক্ষতা অর্জন করেন।
সংসার জীবন: তিতুমীর মায়মূনা খাতুনকে বিয়ে করেন। মায়মূনা খাতুন ছিলেন চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়ার অন্তর্গত খালপুর গ্রামের হযরত শাহ সূফী মুহম্মদ রহীম উল্লাহ সিদ্দিকীর মেয়ে।
কর্মজীবন: খুব সম্ভবত ১৮০৮-১৮১০ সালের কোনো এক সময়ে তিনি ভাগ্যন্বেষণে কলকাতা শহরে যান। এখানেও তিনি কুস্তি লড়াইয়ের প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতেন। তিনি একবার কলকাতায় কুস্তি লড়াইয়ে প্রথম হয়েছিলেন। এরপর থেকে তিতুমীরের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই কারণে তিনি জমিদার মির্জা গোলাম আম্বিয়ার সুনজরে পড়েন এবং তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন। তিতুমীর এখানে বসে যুদ্ধ জয়ের সামরিক কৌশল আয়ত্ব করেন। মির্জা গোলাম আম্বিয়া ছিলেন কলকাতার মির্জাপুর এলাকার জমিদার। তিতুমীর যেখানে যেতেন সেখানেই নানা বিষয় শেখার চেষ্টা করতেন ফলে কর্মজীবনে তিনি কোথাও স্থায়ী হতে পারেনি।
মৃত্যু: ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। শহীদ তিতুমীর : আব্দুল গফুর সিদ্দিকী, প্রকাশক : বাংলা একাডেমী। প্রকাশকাল : ১৯৯২।
২। ব্রিটিশ ভারতীয় নথিতে তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীগণ – অনুবাদ : ড. গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া, প্রকাশক : বাংলা একাডেমী। প্রকাশকাল : জুন ১৯৯৯।
৩। বিদ্রোহী তিতুমীর : মনির জামান, প্রকাশক : কথা প্রকাশ। প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারী ২০১০।
৪। ব্রিটিশ ভারতীয় নথিতে তিতুমীর ও তার অনুসারীরা – ড. মুঈনউদ্দীন আহমদ খান। প্রকাশকাল : জুন ১৯৯৯।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)