১৯৩১ সালের ৭ জুলাই। দীনেশ গুপ্ত ভোরবেলা স্নান করার পর ফাঁসির পোশাক পরে হাসতে হাসতে সার্জেন্টকে বললেন, “এবার যাওয়া যেতে পারে”। এরপর ধীর পায়ে ফাঁসিমঞ্চের দিকে অগ্রসর হলেন মৃত্যুঞ্জয়ী দীনেশ গুপ্ত। সার্জেন্ট তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,”তোমার কিছু বলার আছে কি বন্দী?” দীনেশ গুপ্ত উত্তর দিলেন, “প্লিজ স্টপ। আমাদের বলার অধিকার যে কেড়ে নিয়েছে, সে কথা তোমরাই ভাল জান। ডু ইওর ডিউটি, আই এম রেডি।” পর মুহূর্তে দীনেশ গুপ্ত ফাঁসির মঞ্চে উঠে স্বহস্তে ফাঁসির রজ্জু গলায় পরেন। ‘বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম’ বলতে বলতে ফাঁসির রজ্জুতে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস থমকে যায়। সেই সাথে নিভে যায় বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের জীবন প্রদীপ। ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর।
ভারত উপমহাদেশে বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তার মূলে যে সকল বিপ্লবী রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ঢাকার দীনেশ গুপ্ত অন্যতম বিপ্লবী। অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই ঢাকার ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘যুগান্তর পার্টি’, চট্টগ্রামের ‘দি ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’, ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’, মামলার ‘বিপ্লবী দল’, কলকাতার ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘মেদিনীপুর বিপ্লবী দল’, ‘বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠন’, ‘স্বরাজ পার্টি’সহ অন্যান্য বিপ্লবী দল স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এসব দলের অসংখ্য বিপ্লবী সদস্যরা ভারতের স্বাধীনতার জন্য জীবন বলিদানের মন্ত্র সানন্দে গ্রহণ করেন এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই জীবন উৎসর্গ করেন। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত এই জীবন উৎসর্গকারীদের একজন।
১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) যশোলঙে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সতীশচন্দ্র গুপ্ত। আর মায়ের নাম বিনোদিনী দেবী। ছোটবেলায় দীনেশ গুপ্তের ডাকনাম ছিল নসু। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে দীনেশ গুপ্ত ছিলেন বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান।
দীনেশ গুপ্তের বাবা সতীশচন্দ্র ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী। চাকরি সূত্রে তিনি একবার পরিবার নিয়ে বেশ কিছুদিন গৌরীপুরে ছিলেন। গৌরীপুরের একটি পাঠশালাতে দীনেশ গুপ্তের পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়। এরপর তাঁর বাবা চাকুরীর কারণে ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন। তখন দীনেশ গুপ্ত নয় বছরে পা দিয়েছেন। ঢাকায় আসার পর তাঁকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এসময় দীনেশ গুপ্ত ঢাকার গেন্ডারিয়া অঞ্চলে দাদার বাড়িতে বসবাস করতেন। কিছুদিন পর পৈত্রিক বাসভবন ওয়ারীতে চলে আসেন।
ছোটবেলা থেকেই দীনেশ গুপ্ত ছিলেন নির্ভীক ও দুরন্ত প্রকৃতির। পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও পারদর্শী ছিলেন তিনি। স্কুল জীবন থেকেই দীনেশ গুপ্ত স্বদেশপ্রেম ও রাজনীতির বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠতে থাকেন। কারণ ওই সময় সারা ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। যা প্রতিটি সচেতন পরিবারের সদস্যরা জানতেন এবং সন্ধ্যার পর পাড়া-মহল্লায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন নিয়ে নানা আলোচনা হতো। এই আলোচনায় মাঝে মাঝে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীনসহ আরো অনেক বিপ্লবীর বিপ্লবী জীবনের কথা উঠে আসতো। তখন এসব পরিবারের কিশোর-তরুণরা খুব মনোযোগ দিয়ে এই কিংবদন্তী বিপ্লবীদের জীবন কাহিনী শুনতেন। কিশোর- তরুণরা সেসময় বিপ্লবীদের নিয়ে লেখা বই- পুস্তকও বেশ আগ্রহ সহকারে পড়তেন। দীনেশ গুপ্ত ছিলেন সেইসব তরুণদের একজন। ১০ম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ (বিভি) নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সংস্পর্শে আসেন।
১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে (ঢাকা বোর্ড) ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। পরীক্ষার পর তিনি মেদেনীপুরে বেড়াতে যান। সেখানে তাঁর বড়ভাই জ্যোতিশ চন্দ্র গুপ্ত থাকতেন। তিনি ছিলেন মেদিনীপুর আদালতে স্বনামধন্য আইনজীবী।
মেদেনীপুর ছিল বাংলার বিপ্লবীদের আরেক তীর্থ স্থান। মেদেনীপুরের বিপ্লবীদের সাথে প্রায় ভারতের সকল বিপ্লববাদী দলের কমবেশী সম্পর্ক ছিল। এই সময় দীনেশ গুপ্ত মেদেনীপুরের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার কথা দলকে জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু দল তাঁকে মেদেনীপুরে কাজ করার অনুমতি দেয়নি। বরং তাঁকে ঢাকায় গিয়ে কাজ করতে বলা হয়। ঢাকায় ফিরে দীনেশ গুপ্ত ঢাকা কলেজে আই.এস.সি.-তে ভর্তি হন। পড়াশুনা ও বিপ্লবী কাজকর্মে মনোনিবেশ করেন। এক পর্যায়ে তিনি পড়াশুনার চেয়ে বিপ্লবী দলের কাজকর্মের উপর বেশী গুরুত্ব দেন। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে আই.এস.সি. পরীক্ষা দেন। কিন্তু পড়াশুনার চেয়ে বিপ্লবী দলের কাজকর্মের উপর বেশী গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তিনি আই.এস.সি. পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হতে পারেননি।
ওই বছর সুভাষ চন্দ্র বসু নতুনভাবে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীকে গড়ে তোলেন। যার চরিত্র ছিল সামরিক। ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীতে নারী ও পুরুষ বিপ্লবী ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীকে সামরিক মানসিকতায় শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে বিপ্লবীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। দীনেশ গুপ্ত ঢাকা কলেজে পড়ার সময় সুভাষ চন্দ্র বসুর নতুনভাবে গড়া ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে’র সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হন। ১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময় দীনেশ গুপ্ত মেদিনীপুর গিয়ে পড়াশুনা করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর তিনি দলের অনুমতি নিয়ে মেদেনীপুরে চলে যান। সেখানে গিয়ে মেদেনীপুর বিপ্লবী দলের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। সাথে সাথে তিনি ওইখানে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীর শাখা স্থাপনের কাজ শুরু করেন। তখন দীনেশ গুপ্ত পড়াশুনা করার জন্য ভর্তি হলেন মেদিনীপুর কলেজে। থাকতেন আইনজীবী ভাইয়ের কাছে। এসময় তিনি বিপ্লবী দলের সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকেন। দীনেশ মেদিনীপুরের বহু স্কুল-কলেজের ছাত্রকে বিপ্লবী দলে টেনে এনেছিলেন। সেসময় বাংলার বিপ্লবীসহ সারা ভারতের বিপ্লবীদের উপর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে শুরু করে। একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে নিয়ে জেলখানায় আটক রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায়। যে কারণে ওই সময় অনেক বিপ্লবী মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে যায়। ক্ষুদিরামের ফাঁসির পর ব্রিটিশ সরকার দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, যারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশ-শাসনকে উচ্ছেদ করতে চাইবে, তাদের মধ্যে যারা ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে রেহাই পাবে, তাদেরকে আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠানো হবে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে রেহাই পাওয়া প্রায় সকল সশস্ত্র বিপ্লবীকে আন্দামানে যেতে হয়েছিল। আর আন্দামান সেলুলার জেল ছিল সবচেয়ে ভয়ংকার জেল। এক কথায় বলা যায়, মৃত্যু ফাঁদ।
এসব কারণে ব্রিটিশদের চরম শিক্ষা দেয়ার জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু তখন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সকে এ্যাকশনধর্মী বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন। শুরু হয় বিপ্লবীদের আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণে দীনেশ গুপ্তও বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। এক পর্যায়ে সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এই সংগঠনের বিপ্লবীরা কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদেরকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। ১৯২৯-৩০ সালের মধ্যে দীনেশ গুপ্তের প্রশিক্ষিত বিপ্লবীরা ডগলাস, বার্জ এবং পেডি এই তিনজন কুখ্যাত ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রটকে হত্যা করেছিল।
১৯৩০ সালে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-নির্যাতন আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। শতশত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে জেলে আটক রেখে নির্যাতন চালায়। এই সময় ব্রিটিশ পুলিশ সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সত্য বকসীর মতো নেতৃত্বকেও গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটক রাখে। একের পর এক নেতা- কর্মীকে গ্রেপ্তার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ভরিয়ে ফেলা হচ্ছিল। এই সব বন্দীদের মধ্যে ছিলেন অসংখ্য সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সদস্য এবং অহিংস আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবকরা। একপর্যায়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নতুন বন্দীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছিলনা নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে।
জেলের মধ্যে সৃষ্টি হলো এক অসহনীয় অবস্থা। রাজবন্দীদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠল। তাঁরা জেলকোড অনুযায়ী কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন শুরু করলেন। এই আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ পুলিশ নিষ্ঠুরভাবে লাঠিচার্জ করে। এরপর পাগলা ঘন্টি বাজানো হয়। রাজবন্দীদের উপর চলল নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার। এই নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সত্য বকসীরাও বাদ গেলেন না । এঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ল জেলের বাইরে। এই নির্মম- নিষ্ঠুর অত্যাচারের পিছনে ছিল ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসন।
বিপ্লবীরা প্রস্তুতি নিলেন অত্যাচারী সিম্পসনকে উচিৎ শিক্ষা দেয়ার জন্য। পরিকল্পনা হলো শুধু সিম্পসন নয়, ইংরেজ আমলাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, বাঙ্গালীরাও লড়তে জানে, মারতে জানে। কাঁপিয়ে দিতে হবে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদকে।
বিপ্লবীরা জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসনকে টার্গেট করলেন। শুধু সিম্পসন নয়, ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ করে ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যা করে ওদের অত্যাচার-জুলুমের জবাব দেয়ার পরিকল্পনা করলেন তাঁরা। কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ছিল ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয়। যার নাম রাখা হয়েছিল ‘রাইটার্স বিল্ডিং’। এই ভবনেই উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ আমলারা অফিস করতেন। অসংখ্য পুলিশ প্রহরী পরিবেষ্টিত দুর্ভেদ্য অফিস ‘রাইটার্স বিল্ডিং’। এই ভবন আক্রমণ করে সেখান হতে ফেরার আশা কেউ করতে পারে না।
বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা চলল কে এই আক্রমণ পরিচালনা করবেন? এই দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন দীনেশ গুপ্ত, বিনয় বসু ও বাদল গুপ্ত। কিশোর বয়স থেকেই বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্ত পরস্পর পরিচিত ছিলেন। তিনজনই ছিলেন পূর্ববাংলার (ঢাকার) সন্তান। কৈশোরকাল থেকে তিনজন দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতার মুক্তিযজ্ঞে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন। ঘটনাচক্রে এই তিন বন্ধুই একসঙ্গে ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণের দায়িত্ব নেন।
১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। আক্রমণের জন্য সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। খুব সতর্ক অবস্থায় তাঁদের প্রশিক্ষণের কাজও সমাপ্ত হয়। দিনেশ গুপ্ত, বিনয় বসু ও বাদল গুপ্ত বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে বিদায় নিলেন। ৮ ডিসেম্বর এ্যাকশনের জন্য তিন বিপ্লবী প্রস্তুত। ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ এর একটি কক্ষে কারা বিভাগের সর্বময় কর্তা ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন তাঁর কাজকর্ম পরিচালনা করছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী জ্ঞান গুহ পাশে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছেন। বেলা ঠিক ১২ টা। সামরিক পোশাক পরে তিনজন বাঙালী যুবক এসে কর্নেল সিম্পসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
তাঁরা সিম্পসনের চাপরাশীকে (সহকারী) ঠেলে কামরার ভিতরে প্রবেশ করেন। হঠাৎ পদধ্বনী শুনে কর্নেল তাঁদের দিকে তাকান। বিস্ময়-বিমূঢ় চিত্তে দেখতে পান সম্মুখে মিলিটারী পোশাক পরে তিনজন বাঙালী যুবক রিভলবার হাতে দণ্ডায়মান। মুহূর্তের মধ্যে বিনয়ের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, “প্রে টু গড কর্নেল। ইওর লাষ্ট আওয়ার ইজ কামিং।” কথাগুলি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি রিভলবার হতে ছয়টি গুলি সিম্পসনের দেহ ভেদ করে। সিম্পসন লুটিয়ে পড়ে মেঝের উপর। এরপরই গুলির আঘাতে আহত হন জুডিসিয়েল সেক্রেটারী মি. নেলসন। এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করতে করতে আততায়ীরা পরবর্তী লক্ষ্য হোম সেক্রেটারী আলবিয়ান মারের কক্ষের দিকে অগ্রসর হন। ততক্ষণে এই আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ছুটে আসেন পুলিশ-ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. ক্র্যাগ ও সহকারী ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. জোনস। তাঁরা কয়েক রাউণ্ড গুলিও ছোঁড়েন। কিন্তু বিনয়-বাদল- দীনেশের বেপরোয়া গুলির মুখে তাঁরা দাঁড়াতে পারলেন না। প্রাণ নিয়ে পালালেন। সমস্ত ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ জুড়ে তখন এক বিভীষিকাময় রাজত্ব। চারিদিকে শুধু ছুটাছুটি। কে কোন দিকে পালাবে খুঁজে পায় না। কলরব-কোলাহল- চিৎকার। শুধু এক রব ‘বাঁচতে চাও তো পালাও’। ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণের সংবাদ পেয়ে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট আসেন। ডেপুটি কমিশনার গার্ডন আসেন সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে। জুডিসিয়েল সেক্রেটারী মি. নেলসন, মি. টয়নয় প্রমুখ আহত হলেন। আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ডেকে আনা হল গুর্খা বাহিনীকেও।
একদিকে তিনজন বাঙালী তরুণ, হাতে শুধু তিনটি রিভলবার। আর অপরদিকে রাইফেলধারী সুশিক্ষিত গুর্খাবাহিনী। আরম্ভ হল ‘অলিন্দ যুদ্ধ’। ইংরেজ মুখপত্র ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার ভাষায় ‘বারান্দা বেটল’। দীনেশের পিঠে একটি গুলি বিদ্ধ হল। তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। অসংকোচে গুলিবর্ষণ করতে লাগলেন শত্রুকে লক্ষ্য করে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিনয়- বাদল-দিনেশের হাতে গুলি ছিল, ততক্ষণ কেউ তাঁদের আক্রমণ করে প্রতিহত করতে পারেননি। একপর্যায়ে তাঁদের গুলি নিঃশেষ হল। গুর্খা ফৌজ অনবরত গুলিবর্ষণ করে চলল। তখন তিনজন বিপ্লবী একটি শূন্য কক্ষে প্রবেশ করে সঙ্গে আনা ‘সায়নাইড’-বিষের পুরিয়াগুলি মুখে দিলেন। বিষ-ক্রিয়ায় অতি-দ্রুত জীবনপ্রদীপ নিবে না যাওয়ার আশংকায় এবং মৃত্যুকে নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেকেই নিজ নিজ ললাট লক্ষ্য করে রিভলবারে রাখা শেষ গুলিটি ছুঁড়ে দিলেন। বাদল তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। বিনয় ও দীনেশ সাংঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মেঝের উপর পড়ে রইলেন।
ভীষণভাবে আহত বিনয় ও দীনেশকে একটু সুস্থ করে ইংরেজ বাহিনী তাঁদের উপর চালাল প্রচণ্ড অত্যাচার। এরপর উভয়কেই পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
বিনয় ছিলেন মেডিকেল স্কুলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তিনি জানতেন মৃত্যুর পথ। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তিনি ১৪ ডিসেম্বর রাতে আকাঙ্খিত মৃত্যুকে বরণ করার জন্য মস্তিষ্কের ব্যাণ্ডেজের ভিতর অঙ্গুল ঢুকিয়ে স্বীয় মস্তিষ্ক বের করে আনেন এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেন।
অন্যদিকে ডাক্তার ও নার্সদের আপ্রাণ চেষ্টায় দীনেশ ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠেন। সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে ‘কনডেমড’ সেলে নেয়া হয়। তারপর দীনেশের বিচারের জন্য আলীপুরের সেসন জজ মি. গ্রালিকের সভাপতিত্বে ব্রিটিশ সরকার এক ট্রাইবুনাল গঠন করে ফাঁসির আদেশ দেয়। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই দীনেশের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ৮ জুলাই দীনেশের ফাঁসির দিন সমস্ত কলকাতা নগরী শোকাভিভুত হয়ে হরতাল পালন করে। লক্ষ লক্ষ বিষাদ-ক্লিষ্ট নর- নারী মনুমেন্টের নীচে সমবেত হয়ে সেদিন বিকালবেলা দীনেশের বিপ্লবী কর্মকান্ডের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং ভারতমাতার স্বাধীনতার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করার শপথ নেয়। আর বিপ্লবী তরুণরা ঘোষণা করেছিল, “দীনেশ আমাদের জাতীয় বীর। অন্যায়ভাবে তাঁর ফাঁসি আমরা কিছুতেই বরদাস্ত করিব না। এর প্রতিশোধ আমরা নিবোই।” সত্যিই বিপ্লবীরা এর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন বলেই ভারত স্বাধীন হয়েছে।
বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অংশে বিনয়, বাদল এবং দিনেশকে শহীদ বিপ্লবী হিসেবে সম্মান করা হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে বিনয়-বাদল-দীনেশের নামানুসারে কলকাতার ডালহৌসি স্কয়ারের নাম পাল্টে রাখা হয় বি-বা-দী বাগ। অর্থাৎ বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। অগ্নিযুগের ইতিহাস: ব্রজেন্দ্রনাথ অর্জুন। প্রকাশক: মুক্তধারা। প্রকাশকাল; ডিসেম্বর ১৯৭৯।
২। বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা: হেমচন্দ্র কানুনগো। চিরায়ত প্রকাশনী, কলকাতা। প্রকাশকাল: জুন, ১৯২৮।
৩। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা।
৪। ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা: চিন্ময় চৌধুরী। দে’জ পাবলিকেশন, কলকাতা। প্রকাশকাল: জানুয়ারী ১৯৯৮।
৫। বিদ্রোহী ভারত: নীহাররঞ্জন গুপ্ত। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:- কলকাতা, প্রকাশকাল: অগ্রহায়ণ-১৩৯১।
৬। হেমেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, ভারতের বিপ্লব কাহিনী, ২য় ও ৩য় খন্ড, কলকাতা, ১৯৪৮।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)