ব্রিটিশ তাঁকে কালাপানি/আন্দামান/দ্বীপান্তর পাঠিয়েছে-এই কথাগুলো এক সময় মানুষের মনে প্রচণ্ড ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করত। কারণ এখানে গেলে কেউ আর কোনো দিন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পারত না। কালাপানি/আন্দামান/দ্বীপান্তর এই তিনটি শব্দ দিয়ে মূলত ‘আন্দামান সেলুলার জেলকে’ বুঝানো হয়েছে। এটা ছিল ব্রিটিশদের তৈরি করা দ্বিতীয় মৃত্যুকূপ। খোপ খোপ করা বিশাল এক কারাগার। দুর্ধর্ষ, সশস্ত্র বিপ্লববাদী বন্দিদের পিষে মারার জন্য এখানে পাঠানো হত।
ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ভারত উপমহাদেশের মানুষকে শাসন করার জন্য শুরু থেকেই নানারকম দমননীতির আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে জেলখানাগুলো ছিল তাদের এই দমননীতির প্রধান হাতিয়ার। আর আন্দামান সেলুলার জেল ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর জেল। এক কথায় বলা যায়, মৃত্যু ফাঁদ।
সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, যাঁরা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশ-শাসনকে উচ্ছেদ করতে চাইবে, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে রেহাই পাবে তাঁদের সকলকে আন্দামানে পাঠানো হবে। বিংশ শতাব্দীতেও তাঁদের এই সিদ্ধান্ত বহাল ছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে রেহাই পাওয়া প্রায় সকল সশস্ত্র বিপ্লবীকে আন্দামানে পাঠায়। এ সমস্ত বিপ্লবীদের মধ্যে বরিশালের নলিনী দাস অন্যতম।
নলিনী দাস, একটি নাম। বিপ্লব ও সংগ্রামের। যে নামটি শুনলে চেতনা মুহূর্তের মধ্যে স্তিমিত হয়ে যায়। চেতনার কল্পনায় ভেসে ওঠে বিপ্লবী জীবনের প্রতিচ্ছবি, ফাঁসির দৃশ্য ও আন্দামান সেলুলার জেলের নিষ্ঠুর-নির্মম নির্যাতন এবং মৃত্যু। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চেতনা তার তন্দ্রা ভেঙ্গে বিদ্রোহ করে বলে, মানুষের জন্য দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। অবশ্য অনুভূতি উপলব্ধি করার মত চেতনা থাকতে হবে। যে মানুষের চেতনায় দেশপ্রেম নেই, মানবতা-মনুষ্যত্ববোধ নেই, সে নলিনী দাস কেন; কোনো সংগ্রামী ও বিপ্লবীকে বুঝতে পারবে না। চট্টগ্রামের সূর্য সেন, বরিশালের নলিনী দাস ছিলেন ব্রিটিশরাজের আতঙ্ক। এই দু’জনকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার ৫ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করে।
ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তার মূলে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে নলিনী দাস প্রথম সারির একজন অন্যতম বিপ্লবী।
অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই অনুশীলন, যুগান্তর প্রভৃতি বিপ্লবী দলের সঙ্গে তিনি শৈশবে যুক্ত হয়ে পড়েন। অগ্নিযুগের ভগৎ সিং, সূর্য সেন, বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, তারেকশ্বর দস্তিদার, দীনেশ মজুমদার, বিনয় কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত, সুশীল লাহিড়ী, বসন্ত বিশ্বাস, রাম প্রসাদ, রামকৃষ্ণ রায়সহ আরো অনেকের মতো ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নলিনী দাসকে হত্যা করার চেষ্টা করে ব্রিটিশ সরকার ব্যর্থ হয়। নলিনী দাসের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভিন্ন হত্যামামলার তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ার কারণে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আন্দামান দ্বীপান্তর সেলুলার জেলে পাঠিয়ে দেয়।
আন্দামান দ্বীপান্তর গিয়ে নলিনী দাস জেলখানার মধ্যে সকল বন্দীকে সংঘবদ্ধ করে জেল প্রশাসন ও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আমরণ অনশন করেন। আন্দামান বন্দীরা প্রথম অনশন শুরু করেন ১৯৩৩ সালের ১১ মে। এই অনশন দীর্ঘ ৩৭ দিন ব্যাপী চলেছিল। তখন এই অনশনের মূল দাবী ছিল খাদ্যের মান-উন্নয়নসহ বন্দীদের মর্যাদা দেয়া। ৩৭ দিনের এ অনশনে ৩ জন বিপ্লবীর মৃত্যু হয়।
১৯৩৩ সালের কথা। এ অনশনের ৭ দিনের দিন ১৭ মে মহাবীর সিং (লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা) প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েন। তবুও কোনো খাবার গ্রহণ করলেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে কারা কর্তৃপক্ষ জোর করে হাত-পা বেঁধে নাকে নল ঢুকিয়ে দুধ খাইয়ে দেয়। ওই দুধ ফুসফুসে চলে যাওয়ার কারণে তিনি মারা যান। একইভাবে একই কারণে ১২ দিনের দিন ২৩ মে মোহিত মিত্র (অস্ত্র আইন মামলা) ও ১৩ দিনের দিন ২৪ মে সকাল বেলা মোহন দাস (ময়মনসিংহ ষড়যন্ত্র মামলা) মারা যান। ৩৭ দিনের শেষে এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে জেল কোড আইন অনুসারে বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম পরিবেশ নিশ্চিত করে।
ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প ও অফুরন্ত কর্মশক্তির অধিকারী, আমৃত্যু ত্যাগী এই বিপ্লবী তাঁর সারাটি জীবন মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। মানব সভ্যতাকে সাম্যবাদে উত্তরণের ক্ষেত্রে বিপ্লবী সংগ্রামে তিনি ছিলেন আত্মনিবেদিত। মার্কসবাদের মতবাদকে গ্রহণ করে কমিউনিজমের মহান ব্রত নিয়ে নিবেদিত করেছেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত । নলিনী দাস তাঁর ৭২ বছরের ২৩ বছর আন্দামান, ব্রিটিশ-ভারতের জেলে ও পাকিস্তানের জেলে ছিলেন। এছাড়া আরো ২০ বছর ৯ মাস তাঁর কাটে পলাতক জীবনের বিপ্লবী রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায়।
নলিনী দাস ১৯১০ সালের ১ জানুয়ারী বরিশাল জেলার উত্তর শাহাবাজপুরে (বর্তমান ভোলায়) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা দূর্গামোহন দাস। তিনি ছিলেন ভোলার স্থানীয় জমিদারী এস্টেটের নায়েব। নলিনী দাসের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। শৈশবে তাঁর শিক্ষা জীবন ভোলাতেই শুরু হয়। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। দুরন্ত চঞ্চল মেধাবী এই বালক ১৯২১ সালে কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির আহবানে হরতাল ধর্মঘটের সময় ৫ম শ্রেণীর ছাত্র অবস্থায় গ্রেফতার হন। এক দিনের সাজা দিয়ে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়। এ কারণে কিশোর নলিনী দাস প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন ব্রিটিশকে দেশ থেকে তাড়াবেন। এ সময় থেকেই তিনি ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতমাতাকে মুক্ত করার জন্য অগ্নিশপথ নেন। ১৯২৪ সালে তিনি যুক্ত হন বিপ্লববাদী ‘যুগান্তর’ দলে। পড়াশুনা আর দেশের স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়চিত্তে শুরু করেন অক্লান্ত পরিশ্রম। ১৯২৮ সালে সশস্ত্র বিপ্লববাদী দলের সাথে যুক্ত অবস্থায় প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর বরিশালের বিএম কলেজে আই.এস.সি.-তে ভর্তি হন। আই.এস.সি. পরীক্ষার পূর্বে কলকাতা মেছুয়া বাজারে বোমা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়। শুরু হয় পলাতক জীবন। ১৯৩০ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতায় পুলিশ কমিশনার টেগার্ট হত্যা প্রচেষ্টা মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ না পাওয়ায় তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়া সত্বেও ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বিশেষ আইনের বলে প্রেসিডান্সি জেলে প্রেরণ করে। তারপর ১৯৩১ সালে তাঁকে হিজলী ক্যাম্পে পাঠানো হয়।
১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হিজলী ক্যাম্পে ব্রিটিশ পুলিশ রাজবন্দীদের উপর গুলি বর্ষণ করে। এ সময় কলকাতার সন্তোষ মিত্র ও বরিশালের তারেকেশ্বর সেনগুপ্ত নিহত হন। আহত অবস্থায় নলিনী দাস ও ফনী দাসগুপ্ত হিজলী জেল থেকে পলায়ন করেন। আবার শুরু হয় পলাতক জীবন। ফরাসী অধিকৃত চন্দননগরের একটি বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন নলিনী দাস, বীরেন রায় ও দিনেশ মজুমদার। (দিনেশ মজুমদার, টেগার্ট হত্যা প্রচেষ্টা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও মেদেনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার হতে পলাতক এবং বীরেন রায়, ওয়াটসন হত্যা প্রচেষ্টা মামলার আসামী)।
১৯৩২ সালে দিনের বেলায় পুলিশ চন্দননগরের ওই বাড়ি ঘেরাও করে। বিপ্লবীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। চন্দননগরের ৫/৬ মাইল দীর্ঘ রাস্তাজুড়ে ও বিভিন্ন পুলিশ ফাঁড়িতে মাত্র এই ৩ জন বিপ্লবী পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘ ৪ ঘন্টাব্যাপী খণ্ডযুদ্ধ চালিয়ে যান। এতে পুলিশ কমিশনার কিউ নিহত হয়। শেষ পর্যন্ত বীরেন রায় গ্রেপ্তার হন। চন্দননগরের ঘটনার পর কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটে বিপ্লবী কর্মী নারায়ণ ব্যানার্জীর বাড়িতে নলিনী দাস, দিনেশ মজুমদার ও জগদানন্দ মূখার্জী আশ্রয় নিলেন।
১৯৩৩ সালের ২২ মে পুলিশ নারায়ণ ব্যানার্জীর বাড়ী ঘেরাও করে। শুরু হয় বিপ্লবীদের সাথে খণ্ডযুদ্ধ। এক পর্যায়ে আহত অবস্থায় ধরা পড়েন তিন বিপ্লবী। বিচারে দিনেশ মজুমদারের ফাঁসি হয়। এ সময় নলিনী দাস ও জগদানন্দ মুখার্জীর বিরুদ্ধে ফাঁসি দেয়ার মতো কোনো অভিযোগ না পাওয়ায় তাঁদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে ১৯৩৪ সালের মে মাসে আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। তৎকালীন সময়ে তাঁর সহযোদ্ধারা তাঁকে ‘দুর্ধর্ষ বিপ্লবী’ খেতাব দেন। তাঁর বিপ্লবী জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন।
আন্দামান সেলুলার জেলে নলিনী দাস অন্যান্য বিপ্লবীদেরকে নিয়ে এক প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৩৪ সালের শেষের দিকে তিনি তাঁর বিপ্লবী জীবনের হিসেব-নিকেশ শুরু করলেন। ভাবনা-চিন্তা করতে লাগলেন সকল স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের নিয়ে। বিপ্লববাদী পথ নিয়েও ভাবলেন। এ সময় তিনি রাজনৈতিক পড়াশুনাও বাড়ালেন।
১৯৩৫ সালের এপ্রিল মাসে আন্দামান সেলুলার জেলে দুই কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আব্দুল হালিম ও সরোজ মুখার্জী রাজবন্দী হয়ে এলেন। এই দুই বিপ্লবী আন্দামানে বন্দীদের রাজনৈতিক পড়াশুনা ও সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ সম্পর্কে ধারণা দিলেন। বন্দীদের মধ্যে প্রতিদিন গোপনে গোপনে বৈঠক হতো। এভাবে তাঁরা গঠন করলেন কমিউনিস্ট গ্রুপ। যে গ্রুপের মধ্যে নলিনী দাস ছিলেন সবচেয়ে বেশী আন্তরিক। অন্যদিকে বন্দীদের মধ্যেও নলিনী দাস ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। তাই সবকিছু বিবেচনা করে নলিনী দাসই বন্দীদের মাঝে পার্টি গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন। ওই বছর সতীশ পাকড়াশী, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত ও সুনির্মল সেন আন্দামান সেলুলার জেল থেকে দেশে চলে এলেন।
১৯৩৫ সালের ২৬ এপ্রিল আন্দামান সেলুলার জেলে কমিউনিস্ট কনসলিডেশন (কমিউনিস্টদেরকে শক্তিশালী করার জন্য কমিটি) গঠন করা হয়। ১ মে, মে দিবসের কর্মসূচিতে ওই কনসলিডেশনে ৩৫ জন যুক্ত হয়। ১৯৩৬ সালে সুধীন্দ্র রায় (খোকাদা), রবি নিয়োগীসহ আরো কয়েক জন দেশে ফিরে যান।
কমিউনিস্ট কনসলিডেশন আন্দামান সেলুলার জেলে রাজবন্দীদের নিয়ে বিপ্লবী নিকেতন গড়ে তোলে। সেলুলার জেলকে বিপ্লবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার জন্য শুরু হয় পড়াশুনা। এই লক্ষ্যে সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এবং ১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বিপ্লবীদেরকে নিয়ে শুরু হয় নিয়মিত ক্লাস। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হত ক্লাসে। কমরেড কার্ল মার্ক্সের সাম্যবাদের ইশতেহার, লেনিনের পার্টিতত্ত্ব, স্টালিনের লেখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিপ্লবীরা জ্ঞান অর্জন করে। স্টালিনের লেখা ‘লেনিনবাদের ভিত্তি’র উপর ক্লাস নিতেন নিরঞ্জন সেনগুপ্ত। ১৯৩৬ সালে কমিউনিস্ট কনসলিডেশন মে দিবস পালন করে। নলিনী দাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এই আন্দামান সেলুলার জেলে কমিউনিস্ট পার্টির গ্রুপ গঠিত হয়। ওই সময় কমিউনিস্ট কনসলিডেশন ‘দুনিয়ার খবর’ ও ‘দি কল’ নামে দুটি হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশ করে । এর দায়িত্বে ছিলেন নলিনী দাস।
ওই বছর শেষের দিকে আন্দামানে রাজবন্দীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার তার সাম্রাজ্য ও আধিপত্য রক্ষার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবীদের ধরে আন্দামানে পাঠায়। নতুন রাজবন্দীরাও এই কমিউনিস্ট কনসলিডেশনে যুক্ত হতে থাকেন। ১৯৩৭ সালের পুরোটা সময় জুড়ে চলে পড়াশুনা, সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি, বন্দীদের বেঁচে থাকার নূন্যতম অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আর সেলুলার জেল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমরণ অনশনের পরিকল্পনা। সেইসাথে অব্যাহত থাকে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বাইরের বিপ্লবীদের যোগাযোগ, যাতে তাঁরা এই অনশনে সমর্থন দেন। এক পর্যায়ে নলিনী দাসের প্রচেষ্টায় আন্দামানের প্রায় সকল বন্দী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়।
১৯৩৮ সালের ২৫ জুলাই আবার আমরণ অনশন শুরু করেন বিপ্লবীরা। বার বার অনশন এবং প্রথম অনশনের জন্য ৩ জন বিপ্লবীর মৃত্যুর ফলে বন্দীদের কিছু দাবি-দাওয়া পূরণ হয়। বন্দীরা পড়াশুনার সুযোগ পান। ‘বিপ্লবী বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করে তাঁরা পড়াশুনায় গভীর মনোযোগ দেন। এ অনশনের নেতৃত্বের অন্যতম একজন হলেন বিপ্লবী নলিনী দাস। অনশনের মূল দাবি ছিল আন্দামান সেলুলার জেলের সকল বন্দীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং সকলকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে হবে। এক পর্যায়ে এই অনশনে সকল বন্দীরা যোগ দেন।
অন্যদিকে অনশনকারীদের সমর্থনে ভারতব্যাপী উত্তাল আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন যুগান্তর, অনুশীলন ও কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ। ফলে ১৯৩৮ সালের ১৯ জানুয়ারী ব্রিটিশ সরকার চাপের মুখে আন্দামান বন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। এই মৃত্যু ফাঁদের সকল সহযাত্রীকে নিয়ে নলিনী দাস একদিন দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু নলিনী দাসসহ ৩০ জন বন্দীকে দেশে এনে মুক্তি না দিয়ে আলীপুর, দমদম, প্রেসিডেন্সি ইত্যাদি কারাগারে পাঠানো হয়। এ সমস্ত জেলে নলিনী দাস রাজবন্দীদের নিয়ে পার্টির গ্রুপ গঠন করায় ব্রিটিশ সরকার এক পর্যায়ে অন্য বন্দীদের সাথে তাঁর যোগাযোগের সব রকমের পথ বন্ধ করে দেয়। তখন তিনি আন্দামান সেলুলার জেলের এক অনবদ্য ইতিহাস ‘দ্বীপান্তরের বন্দী’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। বইটি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। এটিই একমাত্র তথ্যবহুল আন্দামানের নির্মম ইতিহাস বহন করে।
অবশেষে ১৯৪৬ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর নলিনী দাস মুক্তি পান। দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে কৃষক সমিতিকে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। গোটা পাকিস্তান আমলটাই তাঁর কেটেছে জেলে বন্দী অবস্থায় আর আত্মগোপন করে।
মুসলীম লীগের শাসন আমলের কথা। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বরিশালের রাকুদিয়া গ্রামে কৃষক সমিতির এক বৈঠক থেকে নলিনী দাসসহ আরো কয়েক জন বিপ্লবীকে পাকিস্তান পুলিশ গ্রেফতার করে। পুলিশ তাঁদের নামে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দায়ের করে। সে মামলায় নিম্ন আদালতে বেআইনী অস্ত্র রাখার অভিযোগে নলিনী দাসকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। এই মামলায় তিনি হাইকোর্টের আদেশে বেকসুর খালাস পেলেও মুসলীম লীগ সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়নি। নানা অযুহাতে বিনা বিচারে আটকিয়ে রাখে। এ সময়ও তিনি বন্দীদের নিয়ে পার্টির গ্রুপ গঠন করেন।
অবশেষে ১৯৫৫ সালে আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভা যখন সমস্ত কমিউনিস্ট ও বিপ্লবীদের উপর থেকে জেল-জলুম-হুলিয়া তুলে নেয় তখন তিনি মুক্তি পান। এর ঠিক একমাস পরে ধর্মঘটে উস্কানি দেয়ার অভিযোগে আবু হোসেন সরকার ঢালাওভাবে সকল বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। তখন নলিনী দাসকে গ্রেফতার করা হয়। কিছু দিন পরে কে.এস.পি. মন্ত্রিসভা গঠিত হলে সমস্ত কমিউনিস্ট ও বিপ্লবীদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বরিশাল জেলা পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব শাহীর শাসন আমল থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি এক দশক ধরে আন্ডারগ্রাউণ্ডে ছিলেন। তিনি বৃহত্তর বরিশালে কমিউনিষ্ট পার্টি এবং মেহনতি মানুষদের আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। অবশ্য এ কাজে তাঁকে মুকুল সেন, খোকা রায়, জগদীশ আইচ, নূরুল ইসলাম মুনিসহ আরো অনেকে সহয়তা করেন। আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন ওই অঞ্চলের আতঙ্ক।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে তিনি বরিশালের ছাত্রদেরকে সংগঠিত করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে তিনি বৃহত্তর বরিশালের ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। ৭০’-এ স্বরূপকাঠীর ব্যাসকাঠীর কৃষক সম্মেলনে কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনন্য। এই সম্মেলনে প্রখ্যাত কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ, হাতেম আলী খাঁ ও মহিউদ্দিন আহম্মেদ উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নলিনী দাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর বরিশালের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। তরুণ ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক ও কৃষকদের রিক্রুট, ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদের ব্যবস্থা করতেন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর যোদ্ধাদের অন্যতম পরিচালক ও সংগঠকও ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে নবউদ্যমে নলিনী দাস বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অগ্রসেনানী হিসেবে শোষণ মুক্তির লড়াই-সংগ্রামকে অগ্রসর করতে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮২ সালের ১৯ জুন এই বীর বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করেন।
দেশমাতৃকা ও দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তির আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ কমরেড নলিনী দাস লক্ষ লক্ষ টাকা মূল্যের পৈত্রিক সম্পত্তি পিতা দূর্গামোহন দাসের নামকরণে একটি জনকল্যাণ ট্রাষ্টের নিকট হস্তান্তর করেন।
এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে কমরেড নলিনী দাস এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। লড়াই-সংগ্রাম ব্যতীত এই কিংবদন্তী বিপ্লবীর জীবনে সময়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই তিনি মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যয় করেছেন। তাঁর বিপ্লবী জীবন থেকে নতুন প্রজন্ম অনুপ্ররণা পাবে, উদ্বুদ্ধ হবে। সব রকমের স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে জাতির যেকোন সংকটময় মুহুর্তে তাঁরা এগিয়ে আসবে।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১. স্বাধীনতা সংগ্রামে দ্বীপান্তরের বন্দী – নলিনী দাস; প্রকাশকাল : ১৯৭৫
২. বিপ্লবী নলিনী দাস স্মারকগ্রন্থ: সম্পাদক – সুবোধ দাশগুপ্ত; প্রকাশকাল : ১৯৮৫
৩. মুক্তির সংগ্রামে বিপ্লবী – ড. তাইবুল হাসান; প্রকাশকাল : ১৯৯০
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)