১৯৩০ সালের কথা। ঢাকায় পুলিশের এক ইনফর্মার ‘যুগান্তর’ দলের কর্মীদের ওপর অযথা উৎপাত শুরু করে। ঘটনা গড়াতে গড়াতে এমন অবস্থায় পৌঁছায়, যদি তাকে হত্যা করা না হয় তবে ‘যুগান্তর’ দলের কয়েকজন বিশিষ্ট কর্মীর জীবননাশ অনিবার্য হয়ে পড়বে। ইনফর্মারটি অত্যন্ত হুঁশিয়ার ও দুর্দান্ত ছিল। তার বাড়িতেই তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ‘যুগান্তর’ দলের কর্মীরা। বেশ কয়েকদিন চেষ্টার পর একদিন তাকে বাগে পাওয়া গেল। পাগল সেজে সত্যভূষণ গুহবিশ্বাস তাকে অনুসরণ করে চলেছেন। অন্যদিকে রাতের অন্ধকারে খালি গায়ে নেপাল নাগের নেতৃত্বে অন্যেরা অপেক্ষা করছেন ইনফার্মারের বাড়ির দরজায়। ইনফার্মারটি যখন বাড়ির সামনে এসে নিজেকে অত্যন্ত নিরাপদ ভেবে সতর্কতার হাল ছেড়ে দিয়েছে ঠিক তখনই তাকে আক্রমণ করা হলো। নেপাল নাগ প্রথমে আঘাত হেনে তাকে ধরাশায়ী করেন। এরপর অপূর্ব রায় তাকে হত্যা করেন।
ঘটনার পর সরে যাবার পালা। অন্যান্যরা অন্য দিকে চলে গেছেন। বাকি তিনজন নেপাল নাগ, রমণী রায় ও বঙ্গেশ্বর রায়কে যেতে হবে প্রায় আড়াই মাইল দূরে। সবারই খালি পা, জামা কোমরে বাঁধা, যেন ওপাড়ারই ছেলে। ওয়ারি এলাকার মধ্যে এসে পথচারিদের বিভ্রান্ত করার জন্য বেশ সরবে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করলেন তাঁরা। ‘আচ্ছা কে দৌড়ে আগে যেতে পারে’- উঁচু গলায় এই কথা বলে নেপাল নাগ প্রথমে দৌড় শুরু করেন । পথচারীরা ভাবলেন, পাড়ার ছেলেরা হয়তো নিজেদের মধ্যে দৌড়ঝাঁপ করছে। পথচারীরা বুঝতেই পারেননি সদ্য হত্যাকাণ্ডের পর তাঁরা দৌড় প্রতিযোগিতার ছলে ঘটনাস্থল থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে বহুদূরে চলে যাচ্ছেন।
১৯৩০ সালের আরেকটি ঘটনা। ঢাকার সারস্বত সমাজে জমায়েত তিন-চারশ শিক্ষকের মাঝ থেকে সরকারী টাকা ছিনিয়ে নেয়ার নায়ক ছিলেন নেপাল নাগ। তৎকালীন গভর্নর বাহাদুর বছরে একবার শিক্ষকদের পাঁচ-সাত টাকা করে উপহার দিতেন। পরেশ রায় ওই খবর এনে দিলেন ‘যুগান্তর’ দলের বিপ্লবীদের কাছে। তখন ‘যুগান্তর’ দলের বিপ্লবীদের অস্ত্র কেনার জন্য টাকার খুব প্রয়োজন ছিল। গভর্নরের বাড়িটি ছিল দোতলা। নিচে প্রায় তিনশ ও ওপরের তলায় প্রায় একশ’র মতো শিক্ষক জমায়েত হয়েছেন। টাকাগুলো আছে ওপরতলায়। বাড়ির গেট, সিঁড়ি, একতলা এবং দোতলায় ছ’জন বিপ্লবী সশস্ত্র অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন ডিউটিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ওপর তলায় তিনজন- নেপাল নাগ, বিনয় বসু ও বঙ্গেশ্বর রায়। সিঁড়িতে রয়েছেন-অসিত ঘোষ এবং নিচে সুবোধ মল্লিক ও শান্তি বসু। তাঁরা পরিকল্পনা করেছিলেন, বিনয় বসু তাঁর পিস্তলটি ওপরে ছাদের দিকে তাক করে এক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ার পর দোতলায় নেপাল নাগ ও বঙ্গেশ্বর রায় টাকাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে অসিত ঘোষের হাতে দেবেন এবং অসিত ঘোষ টাকাগুলো নিয়ে নিচতলায় যারা আছেন তাঁদের হাতে তুলে দেবেন। এরপর তাঁরা সবাই চলে যাবেন। আর নেপাল নাগ ও বঙ্গেশ্বর রায় তাঁদের পিছু পিছু যাবেন।
পরিকল্পনা মতো বিনয় বসু পিস্তলের আওয়াজ করতেই ঘর ভর্তি লোক বাইরের বারান্দার দিকে সরে গেলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে নেপাল নাগ ও বঙ্গেশ্বর রায় টাকাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে অসিত ঘোষের হাতে তুলে দিলেন। এরপর পরিকল্পনা মতো বিপ্লবীরা সেগুলো নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় নেপাল নাগ শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে জোরগলায় বললেন, ‘এই টাকা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ব্যয় হবে। যদি সরকার আপনাদের প্রাপ্য টাকা না দেয় তবে নিশ্চিত থাকুন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কড়ায় গণ্ডায় এ টাকা আমরা আপনাদের ফেরত দেব।’
নেপাল নাগ ব্রিটিশবিরোধী এই বিপ্লবী ভারতের স্বাধীনতার জন্য সারাজীবন এভাবেই লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তার মূলে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে নেপাল নাগ প্রথম সারির একজন অন্যতম বিপ্লবী।
নেপাল নাগ জন্মেছিলেন ১৯০৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। ঢাকা শহরের গেণ্ডারিয়ায়। দীর্ঘ পাতলা গড়নের নেপাল নাগ ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন ডানপিঠে। তাঁর ভাল নাম ছিল শৈলেশ নাগ। স্কুলের লেখাপড়ার প্রতি নেপাল নাগের আকর্ষণ ছিল কম। পাঠ্য বই নয়, বাইরের বই পড়ার প্রতি তাঁর অধিক মনোযোগ ছিল। যে কারণে সহপাঠীদের চেয়ে যেকোন বিষয়ে তাঁর জানাশোনা ছিল অনেক বেশি। স্কুলে পড়ার সময় তিনি অনিল রায়ের নেতৃত্বাধীন ঢাকার গোপন বিপ্লবী দল ‘শ্রীসংঘে’র সাথে যুক্ত হন। এসময়ই তাঁকে বাছাই করা হয়েছিল গোপন বিপ্লবী দলের চরম সাহসী কাজের জন্য।
বাবা ছিলেন প্রকৌশলী। তিনি মধ্যপ্রদেশে ঠিকাদারি করতেন। ছোট বয়সেই উপার্জনের জন্য নেপাল নাগের বড় ভাই চলে গেলেন বাবার কাজে সাহায্য করতে। বাবার দেয়া সামান্য টাকায় সংসার চালাতেন মা। অস্বচ্ছল সংসারের অভাব অনটনের মধ্যে কঠিন বাস্তবতার মাঝে বেড়ে উঠেছেন তিনি।
ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন পরোপকারী ও প্রতিবাদী স্বভাবের। গ্রামে কারও অসুখ হলে স্বেচ্ছায় ছুটে যেতেন সেবা করার জন্য। তিনি অন্যান্য সহপাঠীকে নিয়ে রোগীদের সেবা করার ভার নিতেন। কোথাও অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতেন। এই বৈশিষ্ট্যের সাথে যুক্ত হয়েছিল দেশপ্রেম। ব্রিটিশের হাত থেকে দেশমাতাকে মুক্ত করার জন্য যুক্ত হয়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লববাদী দলে। জীবনবাজী রেখে সংগঠিত করেছেন বিপ্লবী কর্মকান্ড। নেপাল নাগ কৈশোর ও প্রথম যৌবনের দিনগুলো উৎসর্গ করেছিলেন সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে।
১৯৩০ সালে নেপাল নাগ পলাতক জীবন যাপন করেন। গোপনে গোপনে তিনি বিপ্লবী কর্মী তৈরীর কাজ করেন এবং তাঁদেরকে নিয়ে সিনিয়রদের কাছে পৌঁছে দেন। ১৯৩১ সালে ২২ বছর বয়সে ঢাকা শহরের এক গোপন আস্তানা থেকে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করতে পারেনি। কিন্তু এরপরও তাঁকে বিনা-বিচারে রাজস্থানের দেউলী বন্দিশিবিরে সাত বছর আটক রাখা হয়।
এই বন্দিশিবিরে তখন অসংখ্য সশস্ত্র বিপ্লববাদী বন্দী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বিপ্লবী দলের অন্যতম নেতা রেবতী বর্মন। কমরেড রেবতী বর্মণ ছিলেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। ইংরেজী সাহিত্যে এবং মার্কসবাদে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। নেপাল নাগ ছিলেন তাঁর অন্যতম উপযুক্ত শিষ্য। তাঁর সঙ্গে নেপাল নাগের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কমরেড বর্মণের শিক্ষা বেশ কয়েকজন রাজবন্দীকে কমিউনিস্ট মতবাদ গ্রহণে সাহায্য করে। পরবর্তীতে পণ্ডিত রেবতী বর্মন ও নেপাল নাগের ঐকান্তিক প্রচষ্টোয় অনেক বিপ্লবী মার্কসবাদী কমিউনিস্ট মতাদর্শের পথ গ্রহণ করেন। দেউলী বন্দীনিবাসে ‘কমিউনিস্ট কনসলিডেশন’-এ যোগ দিয়ে অনেক বিপ্লবী স্বাধীনতা-গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
দীর্ঘ সাত বছর কারাগারে থাকার পর নেপাল নাগ ২৯ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে মুক্তি লাভ করেন। কারাগারে বসেই তিনি কমিউনিস্ট হয়েছেন। মার্কসবাদ-লেলিনবাদকে তিনি জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
মুক্তি পেয়ে তিনি বাড়িতে না গিয়ে কলকাতায় যে ঘরে কমরেড মুজফফর আহমদ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, আবদুল হালিম থাকতেন সেখানে ওঠেন। কমরেড মুজফফর আহমদ তাঁকে বিহারে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন তৈরি করার জন্য পাঠিয়ে দেন। সেখানে সাফল্যের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি করে ফিরে এলে মুজফফর আহমদ তাঁকে নিজের জেলায় অর্থাৎ ঢাকায় সুতাকল শ্রমিকদের মাঝে সংগঠন তৈরি করার পরামর্শ দেন।
নেপাল নাগ ঢাকায় এসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বাংলা শাখার গোপন দপ্তরে কাজ শুরু করেন। নিজেদের বাড়িতে না উঠে ডেরা বাঁধলেন কমিউনিস্ট কর্মীদের কর্মকেন্দ্রে। নারিন্দা এলাকায় একটা একতলা দালানের সস্তা হোটেলের সামনের দিকের একচিলতে ঘরে থাকা শুরু করলেন। একচিলতে ঘরে টেবিলের পাশে চাটাই-এর ওপর ছিল তাঁর রাতের বিছানা। দিনের বেলায় বিছানা গুটিয়ে টেবিলের তলায় রাখতেন। টেবিলে স্তূপীকৃত ছিল তাঁর জেল জীবনে সংগৃহীত দেশ-বিদেশ থেকে আনা মার্কসীয় তত্ত্বের বই। যাতে দেউলী বন্দীশিবিরের ছাপ মারা ছিল।
নারায়ণগঞ্জের বৃহত্তর সূতা ও বস্ত্রকল অঞ্চলে শ্রমিক ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের দায়িত্বে নিজেকে নিয়েজিত করেন। মিল-মালিক, ভাড়াটে গুণ্ডা ও পুলিশ-গোয়েন্দাদের বাধা অতিক্রম করে তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত সূতাকল এলাকায় বলিষ্ঠ আন্দোলন, বিশাল ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলেন।
কয়েকমাস পর দক্ষিণ মৈশণ্ডীর জোড়পুল লেনে পার্টির জন্য একটা ছোট বাসা নেওয়া হয়। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত শ্রমিক ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংগঠনের মিটিং চলে এখানে। বন্দী শিবিরের সাথী দীর্ঘকালের বিপ্লবী জ্ঞান চক্রবর্তীও ঢাকার বাসা ছেড়ে জোড়পুল লেনের বাসায় এসে ওঠেন। রাতে নেপাল নাগ ও জ্ঞান চক্রবর্তী পার্টি অফিসে থাকেন। ঢাকার শ্রমিকনেতা সুধীর কর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা রমেশ রায়ও ছিলেন এই ডেরাতে। জেলার বিভিন্ন কেন্দ্র থেকেও অনবরত কর্মীরা এসে অতিথি হতেন। জ্ঞান চক্রবর্তী ছিলেন একেবারেই কম কথা বলার লোক। আর নেপাল নাগ ছিলেন চরম আলাপী। জ্ঞান চক্রবর্তী ঢাকা জেলার গ্রামের মানুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছিলেন। আর নেপাল নাগ প্রধানত যোগাযোগ করতেন শ্রমিকদের সঙ্গে। এই দুজনের মধ্যে গভীর হৃদ্যতা ছিল।
১৯৩৯-৪০ সালে নেপাল নাগ নারায়ণগঞ্জের আশেপাশে সুতাকল অঞ্চলের শ্রমিক সংগঠন গড়ার জন্যে যাতায়াতকারী কমিউনিস্ট কর্মীদের যে গ্রুপ গঠিত হয়েছিল সেটির সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল মানুষ ও নেতা হয়ে ওঠেন। এ সময় তাঁর খাওয়া-দাওয়ার চরম অনিয়ম ঘটে। জোড়পুল লেনের বাসাতেই কখনও কখনও খেতে আসতেন বিকেল চারটায়। এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে শ্রমিক আন্দোলন, শ্রমিক সংগঠন এবং শ্রমিকদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন তিনি।
১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঢাকার কমিউনিস্ট কর্মীরা সারা উপমহাদেশের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ঢাকার গেন্ডারিয়ায় কংগ্রেস কর্মী সম্মেলনের আয়োজন করেন। ব্রিটিশ সরকার এই কংগ্রেস কর্মী সম্মেলনের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। সেদিন কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীরা ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে সম্মেলন অনুষ্ঠিত করে। নেপাল নাগ ও নরেশ গুহ, বঙ্গেশ্বর, ফণী গুহ, প্রমথ নন্দী, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, জ্ঞান চক্রবর্তী, সুশীল সরকার, জিতেন ঘোষ প্রমুখ এই সম্মেলনের নেতৃত্ব দেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন অগ্নিযুগের বিভিন্ন বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্য।
ফলে ১৯৪০ সালের জুনে ব্রিটিশ পুলিশ নেপাল নাগসহ ঢাকা জেলার ১৫/১৬ জন প্রধান কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করে। এই কংগ্রেস কর্মী সম্মেলন বেআইনী বলে বিচারের নামে এক প্রহসনের নাটক শুরু হয়। নেপাল নাগকে প্রথমে এক বছর, পরে কমিয়ে ছ’মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বরে তিনি মুক্তি পান। এরপর পুলিশ তাঁকে নিজগৃহে অন্তরীণ করে রাখে। নেপাল নাগ দু’চার দিনের মধ্যেই অন্তরীণের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে চলে যান তাঁর পুরনো ঘাঁটি নারায়ণগঞ্জের সুতা ও বস্ত্রকল এলাকায়। সেখানে বিভিন্ন শ্রমিক পরিবারের আশ্রয়ে ১৯৪১-৪২ সাল পর্যন্ত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে আত্মগোপনে থেকে শ্রমিক ও কমিউনিস্ট পার্টির জন্য কাজ করেন।
১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ঢাকায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে যোগদান করার পথে সোমেন চন্দ শহীদ হন। এ সম্মেলনের মূলশক্তি যুগিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ সুতাকল এলাকার শ্রমিকরা। যাঁরা ১২/১৩ মাইল পথ পায়ে হেঁটে এই সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন এবং হাঙ্গামা থেকে রক্ষা করে এই সম্মেলনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার কাজে সহায়তা করেছিলেন। এই শ্রমিকদের তিলে তিলে সংগঠিত করেছিলেন নেপাল নাগ। এ সময়ে তিনি নারায়ণগঞ্জের সুতাকল অঞ্চলে আত্মগোপনে ছিলেন। আত্মগোপনকালে তিনি কালো লম্বা দাড়ি, মালাধারী প্রবীণ পুরোহিত সেজে লাঠি হাতে নিয়ে ঠুকতে ঠুকতে চলতেন। তখন ব্রিটিশ পুলিশ হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজছে। পুরস্কার ঘোষণা করা হয় তাঁকে ধরিয়ে দেবার জন্য। ৯ মার্চ তিনি ঢাকা শহরে উপস্থিত হন। বিভিন্ন কমরেডের বাড়িতে ছদ্মবেশে অবস্থান করে সংকট সমাধানে পার্টিকে সহযোগিতা করেন। তারপর মিল এলাকায় এসে নাগ সহযোগী হিসেবে পেলেন কমরেড অনিল মুখার্জি এবং বারীণ দত্তকে। এসময় নেপাল নাগ পরেশ ও দাশু নামে পরিচিত ছিলেন। নেপাল নাগ প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা ও সুদর্শন ছিলেন। চল্লিশের দশকে নেপাল নাগ ও অনিল মুখার্জি শ্রমিকদের কাছে থেকে ‘মানিকজোড়’ আখ্যা পেয়েছিলেন।
১৯৪৩ সালে যুক্তবাংলার প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে পার্টির প্রাদেশিক শাখার সদস্য নির্বাচিত হন নেপাল নাগ। এ সময় তাঁকে পার্টির পক্ষ থেকে কলকাতা ও শহরতলীতে সুতাকল শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৪২ সালের শেষের দিকে নিবেদিতা নাগের সঙ্গে কমরেড নেপাল নাগের পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নিবেদিতা নাগ ছিলেন ঢাকার বিশিষ্ট কমিউনিস্ট কর্মী। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। বিয়ের কিছুদিন পর নিবেদিতা নাগ সব ছেড়ে দিয়ে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে পার্টিতে যুক্ত হন। নেপাল নাগ ও নিবেদিতা নাগের বিয়ের রেজিস্ট্রি হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন- মুজফ্ফর আহমদ, ভবানী সেন, আব্দুল হালিম, আব্দুল্লা রসুল, গোপেন চক্রবর্তী, সৈয়দ হাবিবুল্লা প্রমুখ।
নিজের প্রৌঢ়া মা ও বড়ভাইকেও নেপাল নাগ গোপন বিপ্লবী কাজে যুক্ত করেন। সেসময় মৃত্যু-পরোয়ানা মাথায় নিয়ে যেসব বিপ্লবী আত্মগোপনে যেতেন অথবা বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করতেন, তাঁরা তাঁর মায়ের আটপৌরে গৃহস্থালির আড়ালে তৈরি আস্তানাগুলোতে নিরাপদে আশ্রয় নিতেন।
১৯৪৩ সালে যুক্তবাংলায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের সুতাকল শ্রমিকরা কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় ঐক্যসাধনের রাজনীতি, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ এবং ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সমাবেশ গঠনের কার্যক্রমের অগ্রভাগে ছিলেন। ঢাকাতেও সুতাকল শ্রমিকরা শক্তিশালী ইউনিয়ন গঠন করেছিলেন। এজন্যে কমরেড নেপাল নাগকে একই সঙ্গে কলকাতা এবং ঢাকায় যাতায়াত করতে হতো।
অগ্নিবর্ষী বক্তা ছিলেন নেপাল নাগ। বর্ষীয়ান জননেতা ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মুজফফর আহমদ একবার বলেছিলেন, “নেপাল নাগ বক্তৃতা দিতে উঠলে মরা মানুষও লাফ দিয়ে উঠত”।
১৯৪৪-৪৭ সাল পর্যন্ত প্রচণ্ড কাজের চাপ মাথায় নিয়েও দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশভাগের চক্রান্ত, অবশেষে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, এ সমস্ত দুর্দৈবের বিরুদ্ধে পার্টি তার সীমিত শক্তি নিয়ে প্রাণপণে লড়াই করেছিল। সেই লড়াইয়ে নেপাল নাগ ছিলেন অন্যতম। এছাড়াও তিনি এই দিনগুলোতে হাওড়া, হুগলী, চব্বিশ পরগণায় শ্রমিক সংগঠনের কাজে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন।
১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসে চটকল শ্রমিক এলাকা থেকে বঙ্কিম মুখার্জীকে বিধান সভায় নির্বাচনের জন্য দাঁড় করানো হয়। এই নির্বাচন ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নেপাল নাগ। ওই সময় একদিন বিকাল বেলা কংগ্রেসী গুণ্ডারা ক্যাম্প আক্রমণ করে। অন্যরা পালিয়ে বাঁচলেও তিনি ক্যাম্প ছাড়েননি। চারদিক থেকে বর্ষিত ইট তাঁকে ক্ষত বিক্ষত, অবশেষে অজ্ঞান করে ফেলে। একটি মাত্র লাঠির সাহায্যে মাথাটাকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। বাঁ হাতের হাড় ভেঙে গিয়েছিল তাঁর।
দেশ বিভাগের পর নেপাল নাগ পূর্ব পাকিস্তানকে নিজের কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। ১৯৪৯-৬২ সাল পর্যন্ত তিনি ‘রহমান ভাই’ নাম গ্রহণ করে দীর্ঘকাল আত্মগোপন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করেন। এই ১৪ বছরে তিনি প্রকাশ্যে আসতে পারেননি। এ ছাড়াও তিনি কোনো সময় রহমান ভাই, কোনো সময় পরেশদা, কোনো সময় দাসুদা নামে পরিচিত ছিলেন।
১৯৪৯ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালে রেল ধর্মঘট, ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুদয় এবং ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের ক্ষেত্রে নেপাল নাগের উদ্যোগ, কাজ ও ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ১৯৫৫ সালে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৫৬ সালে আত্মগোপনে থেকেই ভাঙ্গা শরীর নিয়ে তিনি পূর্ণোদ্যমে পার্টির কাজ শুরু করেন। ১৯৬০ সালে তিনি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ব কমিউনিস্ট মহাসম্মেলনে (৮১ পার্টি সম্মেলনে) যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বাবিংশ কংগ্রেসে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অবস্থান করেন এবং হো চি মিন, মিকোয়ান, চৌ এন লাই এবং আইদিতের সঙ্গে পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেন। ফেরার পথে তিনি লন্ডনে গিয়ে রজনী পাম দত্তের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে দেশে আসেন। ১৯৬২ সালে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
পরবর্তীতে তাঁর বাঁ ফুসফুসে গভীর টিউবারকুলার ক্ষত ধরা পড়ে। তারপর অনেক দিন রোগে ভুগেছেন। রোগাক্রান্ত অবস্থায়ও তিনি পার্টির কাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। যতটুক কাজ করতে পেরেছেন, তা করেছেন। অবশেষে ১৯৭৮ সালের ৫ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। কমরেড নেপাল নাগ জন্ম শতবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি: সম্পাদনায়-শাহরিয়ার কবির, প্রকাশকাল ২০০৮।
২। দীক্ষাগুরু বিপ্লবী নেপাল নাগ স্মরণে: বঙ্গেশ্বর রায় (কমরেড নেপাল নাগ জন্ম শতবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি-তে প্রকাশিত)।
৩। বিপ্লবী সাথী নেপাল নাগ: রণশে দাশগুপ্ত (কমরেড নেপাল নাগ জন্ম শতবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি-তে প্রকাশিত)।
৪। আমাদের জীবন: নিবেদিতা নাগ (কমরেড নেপাল নাগ জন্ম শতবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি-তে প্রকাশিত)।
৫। সাপ্তাহিক একতা, ৩ অক্টোবর ১৯৮৩
৬। গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন: মাহফুজা খানম/তপন কুমার দে, প্রকাশকাল ২০০৯।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)