১৯২৪ সালের কথা। দিনটির কথা কারো মনে নেই। খুব সম্ভবত জুলাই-আগস্ট মাসের কোনো একদিন। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর ভ্যাপসা গরম পড়েছে। আকাশেও মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে। ভাই-বোনরা সবাই পড়ছে। রানী তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়েন। রানী প্রীতিলতার ডাক নাম। মা-বাবা আদর করে প্রীতিলতাকে রানী বলে ডাকতেন।
সবাই পড়ছে। শুধু থেমে আছেন মধুসূদন। মধুসূদন রানীর বড়দা। বড়দা’র পড়া শুনতে না পেয়ে রানী তাঁর দিকে তাকালেন। মধুসূদন বোনের মুখের দিক তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, “আজ রেল শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন দেয়ার জন্য বিপুল অংকের টাকা ব্রিটিশ কর্মচারীরা ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছিল। ওই গাড়িতে দুজন পুলিশও ছিল। কিন্তু হঠাৎ দিনের বেলায় বড় রাস্তার ধারে চারজন লোক পিস্তল হাতে সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামালেন। তাঁরা গাড়ি থেকে সবাইকে নামিয়ে দিয়ে টাকাসহ গাড়ি নিয়ে চম্পট দিলেন। পরে জানা গেলো ওই লোকগুলো ডাকাত নয়, স্বদেশী। স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁরা কাজ করছেন। তাঁরা মৃত্যুকে পরোয়া করেন না”। এই দুর্ধর্ষ ডাকাতির কথা সেদিন রানীকে দারুণভাবে আলোড়িত করে।
এক মাস পর, একদিন সেই স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের আস্তানায় পুলিশ হামলা চালায়। উভয় দলের সাথে শুরু হয় সংঘর্ষ। দীর্ঘ সময় ধরে চলে বন্দুক যুদ্ধ। অবশেষে শোনা গেল সেই স্বদেশী দলের দুজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আহত দুজনের একজন হলো উমাতারা ইংরেজী বিদ্যালয়ের শিক্ষক সূর্যসেন। অন্যজন পোস্ট অফিসের কেরানী অম্বিকা চক্রবর্তী।
গরুর গাড়ীতে করে রহমতগঞ্জের রাস্তা দিয়ে জে. এম. সেন হলের পাশ দিয়ে গ্রেফতারকৃত স্বদেশী দুজনকে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন রানী তাঁর এক সহপাঠিনীর বাসার জানালার ধারে বসে তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছিলেন। সহপাঠিনীর যে ভাইটি উমাতারা স্কুলে পড়ে, সে বলে উঠলো, “ঐ-তো আমাদের মাষ্টারমশাই, চাদর গায়ে বসে আছেন। উনি আমাদের অংকের মাষ্টার”। একথা শুনে সবাই অবাক হলেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ তাঁদেরকে লাথি, চড় মারছে। ক্লান্ত অবস্থায় দুজনই গাড়ীর মধ্যে বার বার ঢুলে পড়ছেন। এই দৃশ্য দেখে রানী খুব কষ্ট পেলেন। তাঁদের জন্য খুব মায়া হল। কিন্তু কিছুই করার নেই তাঁর। বাসায় গিয়ে রানী মা-বাবাকে বললেন, “চল আমরা মাষ্টারমশাইকে দেখে আসি”। বাবা সরকারী চাকরী করার কারণে রানীর অনুরোধ রাখতে পারলেন না। একবুক কষ্ট নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না রানীর।
কিছুদিন পর শোনা গেল, কলকাতা থেকে বিখ্যাত ব্যারিষ্টার যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত সূর্যসেন ও অম্বিকা চক্রবর্তীর পক্ষ সমর্থন করে চট্টগ্রাম এসেছেন। এই মামলা দেখার জন্য কোর্টে অনেক লোকের ভিড় জমল। কিছু দিন পর তাঁরা দুজন বেকসুর খালাস পেলেন।
রানীর স্কুলের শিক্ষিকা উষাদি একদিন মধ্যাহ্ন বিরতির সময় গল্প করার জন্য অন্যান্য মেয়েদের সাথে রানীকে ডেকে নিয়ে গেলেন। তাঁদেরকে দেশ-বিদেশের অনেক গল্প শুনালেন । ওই দিন উষাদি তাঁকে একখানা বই ‘ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই’ দিয়ে বললেন, “এটা ভাল করে পড়। এটা পড়া শেষ হলে আরো বই পড়তে দেব”। উষাদি ছিলেন স্বদেশীদের গোপন সহযোগী। বাড়ীতে ফিরে তিনি ওই বইখানি পড়ে শেষ করলেন। তাঁর খুড়তুত ভাই পূর্ণেন্দু দস্তিদার ও উষাদি’র সংস্পর্শে এসে রানী রাজনীতির অনেক কিছু বুঝতে শিখলেন।
স্কুলে তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজন ছিলেন কল্পনা দত্ত (পরবর্তীতে বিপ্লবী)। কল্পনা দত্তের চেয়ে তিনি এক ক্লাসের বড়। তিনি কল্পনা দত্তের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। তাঁদের স্বপ্নের কথা লিখেছেন কল্পনা দত্ত: ‘কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময় ঝাঁসীর রানী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম’।
১৯২৪ সাল। ভারত উপমহাদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। সর্বত্র সংগঠিত হচ্ছে সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন। চট্টগ্রামে রেলওয়ে ডাকাতি, বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক ডাকাতি ও বিপ্লববাদীদের সশস্ত্র কার্যকলাপের কারণে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে ব্রিটিশ সরকার ‘বেঙ্গল অর্ডিনান্স’ নামে একটি জরুরি আইন পাশ করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ‘রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক রাখা’। এই আইন পাশ হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের গ্রেফতার করা শুরু করে। চট্টগ্রাম থেকে সূর্যসেন, অম্বিকা চক্রবর্তীসহ অনেককেই এই আইনের মাধ্যমে আটক করা হয়েছিল।
একবার পুলিশ সূর্যসেনকে ধরার জন্য দেওয়ান বাজারে তাঁর এক আত্মীয় বাড়ি ঘেরাও করে। সূর্যসেন পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে চট্টগ্রাম কলেজের এক মেধাবী ছাত্রের বাসায় উঠেন। এই মেধাবী ছাত্রটি রানীর খুড়তুত ভাই পূর্ণেন্দু দস্তিদার। তিনি শহরের ছাত্র-যুব বিপ্লবীচক্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। এই তরুণ বিপ্লবী নেতা সূর্যসেনের পলাতক জীবনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করলেন। চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের যেসব গোপন বই-পত্র ছিল তা রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল এই তরুণ যুবকটির উপর।
‘বেঙ্গল অর্ডিনান্স’-এ নেতৃস্থানীয় বিপ্লবীরা ধরা পড়ার পর পূর্ণেন্দু দস্তিদার বইগুলো কাগজে মুড়িয়ে রানীকে রাখার জন্য দিলেন এবং বইগুলো কাউকে দেখাতে নিষেধ করলেন। বললেন, এগুলো কেউ দেখে ফেললে অনেক বড় ক্ষতি হবে। রানী প্রতিজ্ঞা করলেন, দাদা আমি এই বইগুলো লুকিয়ে রাখবো, এমনকি মা-বাবাকেও দেখাব না। তিনি ততদিনে বেশ রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছেন। বইগুলো পাওয়ার পর থেকে তিনি চিন্তা করতে শুরু করলেন, এর মধ্যে এমন কি বই আছে যা কেউ দেখলে অনেক বড় ক্ষতি হবে? একদিন ভাবলেন দাদা বইগুলো অন্যদের দেখাতে নিষেধ করেছেন কিন্তু আমাকে দেখতে বা পড়তে নিষেধ করেননি। তাই একদিন রাতে বাসার সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়লেন, তখন ওই কাগজে মোড়ানো বইয়ের প্যাকেটটি খুললেন। খুলে দেখলেন ‘ক্ষুদিরাম’, ‘বাঘা যতীন’, ‘কানাইলাল’, ‘দেশের কথা ও সরকারী রাউলাট কমিশন’ ইত্যাদি বই। ‘বেঙ্গল অর্ডিনান্স’সহ আরো কিছু কাগজ-পত্র ছিল সেখানে। মাসখানেকের মধ্যে তিনি এই বইগুলো পড়ে শেষ করলেন।
২ মাস পর একদিন পূর্ণেন্দু দস্তিদার রানীদের বাসায় এলেন। তখন বিকেল বেলা। রানী তখন বাড়ির পাশে আম গাছের নিচে বসে ‘বাঘা যতীন’ বইটি পড়ছেন। রানীকে ঘরে না পেয়ে তিনি বাড়ির পাশে আম গাছের নিচে চলে গেলেন। তিনি আগে থেকেই জানতেন রানী মাঝে মাঝে এই সময়টাতে সেখানে গিয়ে বই পড়েন। চুপিচুপি তাঁর পাশে গিয়ে তিনি দেখলেন, রানী ‘বাঘা যতীন’ বইটি পড়ছেন। প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন পূর্ণেন্দু দস্তিদার। তিনি বললেন, “রানী একি করছিস”? রানী উত্তরে বললেন, “দাদা, ভয় নেই, আমি কাউকে এই বই দেখাইনি। শুধু গোপনে গোপনে আমি পড়ছি”। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে দুজন ঘরে চলে গেলেন।
পূর্ণেন্দু দস্তিদার টেবিলের পাশে বসে রানীর ইতিহাসের বইটি উল্টাচ্ছিলেন। হঠাৎ বইয়ের পৃষ্ঠার মধ্য থেকে একটি ছবি পড়ে গেল। রানী ছবিটি উঠিয়ে দাদাকে দেখিয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই তুমি এই ছবিটি চেনো? ‘ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই’। আমি এই বইটি অনেক আগেই পড়ে শেষ করেছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঝাঁসির রানী, রানী ভবানীর মতো আমি দেশের জন্য কাজ করবো, লড়বো। প্রয়োজনে এদের মতো জীবন উৎসর্গ করবো। তোমাদের সাথে যুক্ত হব। তাছাড়া তোমরা আমায় ‘রানী’ বলে ডাক। নাটোরের রানী আর ঝাঁসির রানী যা পেরেছিল, চাটগাঁর রানী নিশ্চয়ই তা পারবে, দাদা?” পূর্ণেন্দু দস্তিদার অবাক হয়ে তাঁর কথাগুলো শুনলেন। কিছুই বললেন না। কারণ দলের অনুমতি নেই। পরে একদিন পূর্ণেন্দু দস্তিদার এই কথাগুলো দলনেতা সূর্যসেনকে বললেন। মূলত এই বইগুলো পড়ার পর রানী মনে মনে বিপ্লবী হয়ে উঠতে শুরু করেন। দেশের মুক্তির জন্য অগ্নি শপথ নেন। রানী থেকে বিপ্লবী প্রীতিলতার বিপ্লব জীবনের সূত্রপাত হয় এখানে।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করার জন্য নিজেকে গড়ে তোলার পাশাপশি অসংখ্য বিপ্লবীদের প্রশিক্ষিত, অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করে গেছেন।
ভারত উপমহাদেশের অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই অনেক নারী প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ‘অনুশীলন’, ‘যুগান্তর’ প্রভৃতি বিপ্লবী দলের সঙ্গে ঘরে ঘরে মা, বোন, মাসিমা, কাকিমা, দিদি, বৌদিরা যুক্ত ছিলেন। যেমন ছিলেন অগ্নিযুগের প্রথম পর্বে স্বর্ণ কুমারী দেবী, সরলা দেবী, আশালতা সেন, সরোজিনী নাইডু, ননী বালা, দুকড়ি বালা, পরবর্তীকালে ইন্দুমতি দেবী, লীলা রায়, পটিয়া ধলঘাটের সাবিত্রী দেবী প্রমুখ দেশপ্রেমিক নারী। তারই ধারাবাহিকতায় সেই অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা, বীর কন্যা প্রীতিলতার আবির্ভাব।
প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে। এখানে জন্ম হয়েছে অসংখ্য বিপ্লবীর। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এই গ্রাম ছিল বিপ্লবীদের প্রধান ঘাঁটি। প্রীতিলতার বাবার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের প্রধান কেরানী। বাবার মৃত্যুর পর জগবন্ধু শৈশবে পৈত্রিক বাড়ী ডেঙ্গাপাড়া ত্যাগ করে মায়ের সাথে পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে চলে আসেন। ধলঘাট ছিল তাঁর মামা বাড়ি। এখানেই তিনি বড় হন এবং বসতি স্থাপন করেন।
মা প্রতিভাদেবী ছিলেন গৃহিণী। জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার ও প্রতিভাদেবীর পরিবারে ছয় সন্তানের জন্ম হয়। মধুসূদন, প্রীতিলতা, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ। জগবন্ধু পরিবারের আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত। তাঁদের বংশের কোনো এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে ‘ওয়াহেদেদার’ উপাধি পেয়েছিলেন। সেই ওয়াহেদেদার থেকে ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার হয়।
প্রীতিলতার পড়াশুনার হাতেখড়ি বাবা, মায়ের কাছে। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। যে কারণে জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার মেয়েকে ১ম ও ২য় শ্রেণিতে ভর্তি না করিয়ে ডা. খাস্তগীর উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করান । এটি ওই সময়ের অন্যতম নারী শিক্ষালয় ছিল। এই নামকরা স্কুলে প্রতিটি শ্রেণীতে তিনি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় ছিলেন। ৮ম শ্রেণীতে প্রীতিলতা বৃত্তি পান।
ওই স্কুল থেকে প্রীতিলতা ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করার পর ভর্তি হন ঢাকার ইডেন কলেজে। থাকেন কলেজের ছাত্রীনিবাসে। এ সময় প্রীতিলতা বিপ্লবী লীলা নাগের সংস্পর্শে আসেন। তখন বিপ্লবী লীলা নাগের নেতৃত্বে ‘দীপালী সংঘ’ সংগঠনটি পরিচালিত হত। দীপালী সংঘ ছিল ‘শ্রীসংঘ’-এর মহিলা শাখা সংগঠন। ‘শ্রীসংঘ’ ছিল তখনকার ঢাকার একটি বিপ্লবী দল।
অনেকদিন পর লীলা নাগের সাথে প্রীতিলতার ‘দীপালী সংঘ’ নিয়ে কথা হল। কথাবার্তার মাধ্যমে লীলা নাগ বুঝে নিলেন প্রীতিলতাকে দিয়ে দেশের কাজ হবে। তাই লীলা নাগ তাঁকে ‘দীপালী সংঘে’র সদস্য হওয়ার জন্য একটি ফর্ম দিয়ে বললেন, ‘তুমি এর উদ্দেশ্য ও আদর্শের সাথে একমত পোষণ করলে বাড়ী থেকে এসে ফর্মটি পূরণ করে দিও।’
বাড়ী আসার পরের দিন তিনি ওই ফর্মটি পূর্ণেন্দু দস্তিদারকে দেখিয়ে বললেন, “দাদা, আমি এই সংঘের সাথে কাজ করবো। তোমরা তো আর আমাকে তোমাদের দলে নিবে না, তাই এখানে যুক্ত হয়ে আমি দেশের জন্য কাজ করব। পূর্ণেন্দু দস্তিদার ওই ফর্মটি প্রীতিলতার কাছ থেকে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, দলনেতাকে দেখিয়ে তোমাকে এটি ফেরত দিব”।
১৯২৯ সাল। তখন সূর্যসেন চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক। পূর্ণেন্দু দস্তিদার প্রীতিলতার কাছ থেকে ফর্মটি নেয়ার পরের দিন বিকেল বেলা বিপ্লবীদের গোপন বৈঠকে উপস্থিত হলেন। বৈঠক শেষে জেলা কংগ্রেসের কার্যালয়ে তিনি মাষ্টারদা সূর্যসেনকে ওই ফর্মটি দেখালেন এবং প্রীতিলতার মনের কথাগুলো বললেন। মাষ্টারদা সূর্যসেন সবকিছু শুনে পূর্ণেন্দু দস্তিদারকে বললেন, আজ থেকে আমরা প্রীতিলতাকে আমাদের দলের সদস্য করে নিলাম। কিন্তু এই কথা আপাতত আমরা তিনজন ছাড়া অন্য কাউকে জানানো যাবে না। প্রীতিলতাকে একদিন আমার কাছে নিয়ে এসো।
আই.এ. পরীক্ষা শেষ করে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে চলে আসেন। সূর্যসেনের সাথে প্রীতিলতার ভবিষৎ কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়। কিছুদিন পর প্রীতিলতার আই.এ. পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি পাবেন তিনি। ঠিক হলো কলকাতার বেথুন কলেজে পড়াশুনা করবেন। ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে বি.এ. ভর্তি হলেন প্রীতিলতা। থাকেন ছাত্রীনিবাসে।
এখানে মাষ্টারদার নির্দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করলেন তিনি। গড়ে তুললেন এক বিপ্লবী চক্র। এই বিপ্লবী চক্রে অনেক মেয়ে সদস্য যোগ দিলেন। তাঁদের মূল কাজই হলো অর্থ সংগ্রহ। অর্থ সংগ্রহ করে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে পাঠাতে লাগলেন।
কলকাতার এক গোপন কারখানায় তখন তৈরি হয় বোমার খোল। মাষ্টারদার নির্দেশ অনুযায়ী সেই বোমার খোল সংগ্রহ করেন প্রীতিলতা।
১৯২৯ সালে পূজার ছুটিতে কল্পনা দত্ত, সরোজিনি পাল, নলিনী পাল, কুমুদিনী রৰিতকে নিয়ে প্রীতিলতা চট্টগ্রাম আসেন। বোমার খোলগুলো পৌঁছে দেন বিপ্লবীদের হাতে। মাষ্টারদার নির্দেশ অনুযায়ী প্রীতিলতা এরপর প্রকাশ্য বিপ্লবী কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভারও তাঁকে নিতে হয়। কলকাতায় যে বিপ্লবী চক্র গঠন করা হয়েছে, তাঁদের সকল প্রকার প্রশিক্ষণও প্রীতিলতাকে দিতে হতো।
বি.এ. শেষ বর্ষে পড়ার সময় চট্টগ্রামের অস্ত্রগার দখল, জালালাবাদ সংঘর্ষ ও সেই যুদ্ধে তাঁর আত্মীয় শহীদ হওয়ায় লেখাপড়ায় তিনি অমনোযোগী হয়ে ওঠেন এবং রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির পর থেকে তিনি বি.এ. পরীক্ষা না দেয়ার জন্য মনস্থির করেন। কিন্তু তাঁর শুভাকাংক্ষীদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে ডিসটিংশনে পাস করলেন তিনি।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মহানায়ক সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম দখল হলো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন অচল হয়ে গেলো। টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল, সরকারি অস্ত্রাগার লুন্ঠন, রিজার্ভ পুলিশ ছত্রভঙ্গ ও রেললাইন উপড়ে ফেলা হলো। স্বদেশী বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর দখল করে ফেলেছে। এ সময় প্রীতিলতা কলকাতায়। চট্টগ্রামে আসার জন্য ব্যাকুল। সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তখনো পর্যন্ত মাষ্টারদার অনুমতি মেলেনি।
বি.এ. পরীক্ষা শেষে মাষ্টারদার নির্দেশে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসেন। ১৯৩২ সালে বি.এ. পাস করার পর চট্টগ্রাম অপর্ণাচরণ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় বিপ্লবী কাজে আরো বেশি সক্রিয় হওয়ার তাগিদ দিলেন মাষ্টারদা সূর্যসেন।
১৯৩২ সালের মে মাসে প্রীতিলতার জন্মস্থান ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে মাষ্টারদা তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন। এই বৈঠক চলার সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে বিপ্লবীদের বন্দুক যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে প্রাণ দেন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। সূর্যসেন প্রীতিলতাকে নিয়ে বাড়ির পাশে ডোবার পানিতে ও গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর মাস্টারদা বলেন, ‘প্রীতি, তুমি বাড়ি ফিরে গিয়ে স্কুলের কাজে যোগ দেবে, তাহলে গত রাতের ঘটনায় কেউ তোমাকে সন্দেহ করবে না।’ সাবিত্রী দেবীর বাড়িটি পুলিশ পুড়িয়ে দেয়।
এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সরকার প্রীতিলতাকে সন্দেহ করা শুরু করে। মাষ্টারদার নির্দেশে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। অন্য একটি বিপ্লবী গ্রুপ ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে ব্যর্থ হয়। যার কারণে মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে বলেন। এই জন্য কাট্টলি সমুদ্র সৈকতে বিপ্লবী দলকে মাষ্টারদা সামরিক প্রশিক্ষণ দেন।
১৯৩২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে এক গোপন বৈঠকে মাস্টারদার নির্দেশে প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করার জন্য একটি গ্রামের উদ্দেশ্যে পুরুষের বেশে রওনা দেন। কিন্তু পথে পাহাড়তলীতে কল্পনা দত্ত ধরা পড়েন। প্রীতিলতা নিরাপদে নির্দিষ্ট গ্রামে এসে পৌঁছেন। এখানেই প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয় ।
আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য কাট্টলীর সাগরতীরে প্রীতিলতা ও তাঁর সাথীদের অস্ত্র শিক্ষা শুরু হয়।
প্রশিক্ষণ শেষে বীরকন্যা প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সফল হন। আক্রমণ শেষে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড বিষ খেয়ে আত্মাহত্যা করেন তিনি। কারণ ধরা পড়লে বিপ্লবীদের অনেক গোপন তথ্য ব্রিটিশ পুলিশের মারের মুখে ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
প্রীতিলতা মারা যাওয়ার আগে মায়ের কাছে লিখেছিলেন, ‘মাগো, অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভাবে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা! তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উত্সর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?’
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। বীর কন্যা প্রীতিলতা: পূর্ণেন্দু দস্তিদার, প্রকাশকাল ১৩৭৯ বাংলা
২। স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম: পূর্ণেন্দু দস্তিদার, প্রকাশকাল ১৩৭৪ বাংলা, প্রকাশক: চট্টগ্রাম বই ঘর
৩। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, প্রকাশকাল ১৯৯০ সাল, কলকাতা
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)